নির্বস্তুকতার ভিতর-বাহির

আবুল মনসুর

বিংশ শতকের ত্রয়োদশ বছরে এসে আমরা এমন প্রত্যয়ের দিকে ঝুঁকছি যে, সৃজনকলার সকল শাখায় এ-শতাব্দী ভরপুর থাকবে বহুবাচনিক বিবিধ ক্রিয়াকলাপে। দৃশ্যকলার জগতে বিগত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকেই চেতনাগত রূপান্তরের যে-প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছে তাতে এটি প্রতীয়মান যে, প্রতিনিধিত্বশীল একটি শিল্পধারার মাধ্যমে কোনো একটি সময়খণ্ডকে চিহ্নিত করার দিন অবসিত হয়েছে। তবে এর ফলে ‘যে-কোনো কিছুই শিল্প হিসেবে চলতে পারে’ গোছের একটি ধারণা যেমন চালু হয়েছে, এর বিপরীতে ‘আগের মতো শিল্প এখন আর সৃষ্টি হচ্ছে না’ অভিমতও গড়ে উঠেছে। এসবই দৃশ্যকলা জগৎকে খানিকটা অবিন্যস্ত ও বিক্ষিপ্ত চেহারা দিয়েছে আর দর্শকের জন্য সৃষ্টি করেছে একধরনের বিপন্নতা।
এসব ডামাডোলের মধ্যেও বিমূর্ত বা নির্বস্তুক শিল্পের চর্চা থেমে থাকেনি। বিগত শতকের বিশের দশকে চিত্রশিল্পে নির্বস্তুকতার প্রয়াসটি সূচিত হয়েছিল মূলত সংগীতের বিমূর্তরূপের গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে আকৃতি ও বর্ণের বিমূর্ত সন্নিবেশনের নিরীক্ষা দ্বারা। প্রায় শতবর্ষ পেরিয়ে নির্বস্তুকতা আজও নানাবিধ দর্শনের দৃশ্যপটে চর্চিত হয়ে চলেছে, এটি শিল্পকলার এ-ধারাটির অন্তর্নিহিত শক্তি ও সমন্বয়-ক্ষমতারও পরিচায়ক বটে। পাশ্চাত্যে একবিংশ শতকের নির্বস্তুকতাবাদীরা একদিকে যেমন মিনিমালিস্ট শিল্পী কার্ল আঁদ্রের ভাস্কর্য বা ফ্র্যাঙ্ক স্টেলার চিত্রকর্মকে সাম্প্রতিক তত্ত্বের আলোকে নবতর ব্যাখ্যা প্রদান করতে চাইছেন, তেমনি চিত্রী ও ভাস্কররা নিজেদের শিল্পকর্মে এ-ধারার ভিন্নতর ভাষ্য নির্মাণ করতে প্রয়াসী হচ্ছেন। পশ্চিমের সাম্প্রতিককালের নির্বস্তুকতাবাদী শিল্পীদের মধ্যে জন ম্যাকললিন বা অ্যাগনেস মার্টিনের মধ্যে মিনিমালিস্ট চিন্তার রসদ দেখা গেলেও স্যাম ফ্রান্সিস, সাই টোয়াম্বলি, রিচার্ড ডিয়েবেনকর্ন, হেলেন ফ্রাঙ্কেনথ্যালার, জোন মিশেল প্রমুখ ও নবীনতর কিছু শিল্পীর কাজে দেখি নির্বস্তুকতার এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার প্রসারণ।
বিংশ শতকে পশ্চিমে দৃশ্যকলায় বিমূর্ততার বিকাশের সামাজিক-ঐতিহাসিক কারণ হিসেবে উৎপাদন ও শ্রমনির্ভর সমাজে সামাজিক সম্পর্কের ক্রমিক বিমূর্তায়নকে চিহ্নিত করেছেন থিয়োডোর অ্যাডর্নো। ফ্রেডেরিক জেমসন একে দেখেছেন পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজির বিমূর্ত শক্তির মধ্যে, যা সবকিছুকেই ভোগ্যবস্তু ও অর্থমূল্যে বিনিময়যোগ্য করে তুলেছে। অর্থাৎ বিমূর্ত শিল্পের সামাজিক ব্যাখ্যা হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে আধুনিক সমাজে নাগরিক-অস্তিত্বেরই বিমূর্তায়ন – আইনি ও আমলাতান্ত্রিক নৈর্ব্যক্তিকতা, ক্ষমতা ও তথ্য-নিয়ন্ত্রণের অধিকার ইত্যাকার বিমূর্ত দাপটের কাছে ব্যক্তিমানুষের অকিঞ্চিৎকরতা। তবে একইসঙ্গে নিওডাডা, ফ্লাক্সাস ও চিন্তনধর্মী বিবিধ শিল্পধারার মধ্য দিয়ে অবয়বী শিল্পের পুনরুত্থানও ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় মানুষের অসহায়ত্বকেই মূর্তিমান করছে। এর ফলে বিমূর্ত ও অবয়বী শিল্পের মধ্যে পার্থক্য অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে আর বিভিন্ন শিল্পধারার শিল্পীদের পক্ষে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় শৈলী বেছে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নির্বস্তুক শিল্পধারার প্রতি পক্ষপাত বাংলাদেশে ১৯৬০-এর দশক থেকেই শক্ত ভূমি অর্জন করতে শুরু করে এবং আজ পর্যন্ত তা একটি প্রধান ধারা হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ শিল্পীদের নিজভূমির সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের দিকে ফিরে তাকাতে অনুপ্রাণিত করে এবং এ-সময় থেকে অবয়বী ধারার নানা বৈচিত্র্যময় চর্চা বিমূর্ত ধারার প্রাধান্যকে বেশ খানিকটা খর্ব করেছে। এসব সত্ত্বেও নির্বস্তুক শিল্পের একটি ধারা এখনো বাংলাদেশের শিল্পবাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেছে এবং এমনটি বলা যায় যে, এদেশীয় বিমূর্ত শিল্পধারার একটি স্বতন্ত্র চরিত্র নির্মিত হয়েছে। আমাদের নির্বস্তুকতাবাদী শিল্পীরা বিমূর্ততার যে-ধরনটি পছন্দ করেন সেটিকে বলা যায় ঢিলেঢালাভাবে অভিব্যক্তিবাদী (এক্সপ্রেশনিস্ট), যেখানে রেখা, আকৃতি, বর্ণ ও বুনটের স্বাধীন ও আবেগতাড়িত সমন্বয় ঘটানো যায়। বিষয় এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়, শিল্পকর্মটির দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনই প্রাধান্য পায়। এই বিশেষ শিল্পধারাটির প্রবক্তা ও আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। তাঁর সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত চিত্রতল, রেখা ও আকৃতির সন্নিবেশনে পরিসরের কুশলী বিন্যাস, বুনটের প্রয়োগ এবং সর্বোপরি বর্ণের সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল সমন্বয়ে গড়া চিত্রকর্ম তাঁকে দেশে ও বিদেশে এনে দিয়েছে খ্যাতি ও সম্মান। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অনুসারীর দল সংখ্যায় কম নয়, তবে তাঁদের বেশিরভাগই কিবরিয়ার বিন্যাসক্ষমতা ও সংবেদনশীলতাকে সামান্যই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কিবরিয়া-বর্গের বিমূর্ততাবাদীদের মধ্যে বোধহয় একমাত্র মাহমুদুল হকই কিবরিয়ার চিত্রবিন্যাসের সংবেদকে ধরতে পেরেছেন এবং নিজস্ব অনুসন্ধান-প্রক্রিয়ায় স্বকীয় একটি শিল্পচরিত্র অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন।
মাহমুদুল হক চিত্রবিদ্যার ক্রিয়াকৌশল শিখেছেন ঢাকা ও টোকিওতে এবং ১৯৭০-এর দশকে চিত্রী ও ছাপচিত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর গুরু কিবরিয়ার মতোই ছাপাইছবির বিভিন্ন কলাকৌশল তিনি রপ্ত করেছেন জাপানের শিক্ষালয়ে। জাপানি শিল্পভাবনায় পরিসরের বিন্যাস যে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে তা মাহমুদুল হককে স্থায়ীভাবে প্রাণিত করেছে এবং এমনটি ভাবা হয়তো ভুল হবে না যে, তাঁর শিল্পনির্মাণে যে-কারিগরি কুশলতা ও পরিসর-ভাবনার প্রতি সযতœ দৃষ্টিপাত রয়েছে তাতে জাপানি অভিজ্ঞতার ছাপ দৃশ্যমান। আর এ-বৈশিষ্ট্য তাঁর স্বকীয়তা নির্মাণেও সহায়ক হয়েছে। তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ নির্বস্তুকতাবাদী শিল্পীর মতো তিনিও তাঁর প্রেরণার অন্তর্লীন উৎস হিসেবে বাংলাদেশের বর্ণাঢ্য প্রকৃতি ও বৈচিত্র্যময় ঋতুচক্রকেই চিহ্নিত করেন এবং চিত্রতলকে নির্মাণ করেন একটি নিবিড় সামঞ্জস্যপূর্ণ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় অনুভূতি নির্মাণের ক্ষেত্র হিসেবে। শিল্পকর্মের স্থানিক ও সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে এখানে বড়রকমের বিতর্কের অবকাশ রয়েছে, যা আমাদের বিমূর্ততাবাদী প্রায় সব শিল্পসৃষ্টি সম্পর্কেই প্রযোজ্য। মতপার্থক্যের অবকাশ সত্ত্বেও এটি স্বীকার্য যে, মাহমুদুল  হকের চিত্রকলা ও ছাপাইছবিতে আমরা যেমন একদিকে পাই মাধ্যম ও বিরচনকৌশলের বৈচিত্র্যময় কুশলতা, অন্যদিকে লক্ষ করতে পারি পরিপার্শ্বে ছড়িয়ে থাকা নানান অকিঞ্চিৎকর দৃশ্যবস্তুর প্রতি আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণের সংবেদনশীল দৃষ্টিপাত, যা নির্বস্তুকতাবাদী ঘরানার শিল্পীদের মধ্যে তাঁর জন্য প্রস্তুত করেছে বিশেষ অভিনিবেশের চাহিদা।
ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে শিল্পী মাহমুদুল হকের চলমান প্রদর্শনীটি অবশ্য শুধুই চিত্রকর্ম সংবলিত। সমগ্র প্রদর্শনীর দিকে একটি সার্বিক দৃষ্টিপাতে আকৃতি, বর্ণ ও বুনটের একটি ঘনীভূত রূপ প্রবল হয়ে দেখা দেয়। তাঁর বৃহৎ ও জমাটি অবয়বগুলো চিত্রতলে ভাসমান থেকেও পটভূমির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে মূলত চিত্রপটে আঁচড়, ফুটি-ফাটকা ও বুনটের নিবিড় বন্ধন রচনার মধ্য দিয়ে। তবে মাহমুদুল হকের চিত্রকৃতি বিশেষ স্বকীয়তায় প্রতিভাত হয়ে ওঠে মূলত তাঁর বর্ণচয়নের বিশিষ্টতায়। এমন নয় যে, তিনি ব্যবহার করেন এমন রং যা অন্য শিল্পীরা ব্যবহার করেন না, তবে মনে হয় তাঁর চিত্ররূপ পৃথক একটি স্বকীয়তায় প্রতিভাত হয়ে ওঠে তখনই যখন তিনি চিত্রপটে একাধিক বর্ণের সমাহার ঘটান। এখানে তাঁর নির্বাচন অন্যদের চেয়ে একেবারে ভিন্ন রকমের। নির্বস্তুক চিত্রধারার জগতে এটিই হয়তো মাহমুদুল হকের অনন্যতা এবং এ-বিশিষ্টতা তাঁকে বাংলাদেশে এ-ধারার অন্যান্য চিত্রশিল্পীর চেয়ে উচ্চতর একটি আসনের দাবিদার করে তুলেছে।
দৃশ্যকলা যখন বিশ্বজুড়ে বিশাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এক অভাবনীয় অবয়বে উপস্থাপিত হচ্ছে, যখন উচ্চ-নিচ শিল্প, শিক্ষিত-শিল্প ও লোককলা-কারুকলার পার্থক্য, এমনকী দৃশ্যকলা ও পরিবেশনকলার দূরত্ব একাকার হয়ে যাচ্ছে, শিল্পে পাশ্চাত্যকেন্দ্রিকতার বিপরীতে স্থানিক বৈশিষ্ট্যের বিভিন্নতাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে তখনও একসময়কার শিল্পের বৈশ্বিক একমাত্রিকতার অন্যতম প্রতিভূ নির্বস্তুক শিল্পের চর্চা কিন্তু লুপ্ত হয়নি। বাংলাদেশে মাহমুদুল হক ছাড়াও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিল্পী এ-ধারায় শিল্পচর্চা করছেন, যদিও অধিকাংশই গতানুগতিক ধারণা ও চর্চিত ধারার বাইরে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার প্রসারণে আগ্রহী নন। মনে হয়, দৃশ্যকলার এ-পটপরিবর্তনের মধ্যেও নির্বস্তুক শিল্পের চর্চা অব্যাহত থাকবে এবং আমরা আশাবাদী থাকবো মাহমুদুল হকের মতো সংবেদনশীল শিল্পীদের হাত ধরে এ-শিল্পধারা যুগের চাহিদা ও রূপান্তরণ প্রক্রিয়ার প্রবাহকে আত্মস্থ করে নিজেকে অধিকতর প্রাসঙ্গিক করে তুলতে সচেষ্ট থাকবে।  বর্তমান প্রদর্শনীর মাধ্যমে মাহমুদুল হকের শিল্পকৃতি তেমন উত্তরণের আভাস জ্ঞাপন করছে, এটি অবশ্যই আমাদের আশাবাদী করে।