নীতিবোধ ও সাহিত্যে এর প্রতিফলন

আদনান সৈয়দ

 

নৈ

তিকতার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক কী? লেখক কি সাহিত্য সৃষ্টিতে প্রচলিত নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকেন না-কি তিনি সাহিত্যে নৈতিকতার নতুন মানদ- নির্মাণ করেন? সাহিত্যে নৈতিকতার অবস্থান, পাশাপাশি লেখকের অবস্থান এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি বাংলা একাডেমি একটি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ করেছে। গ্রন্থটির নাম নৈতিকতা ও সাহিত্য। লেখক হাসান ফেরদৌস। ১৫১ পৃষ্ঠার এ-গ্রন্থে মোট এগারোটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। প্রবন্ধগুলো হল – ১. নৈতিকতা ও সাহিত্য, ২. রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, ইয়ানুশ কোরচাকের ‘পোচতা’, ৩. রবীন্দ্রনাথ বনাম নেরুদা : একটি কুম্ভীলক কাহিনি, ৪. হাসান আজিজুল হকের রচনায় নৈতিকতার সংকট ও সমাধান, ৫. ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ : কবিতা যখন প্রতিবাদ, ৬. শহীদ কাদরীর কবিতায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক, ৭. সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় নিষিদ্ধ প্রেম, ৮. শেখ সাদীর গুলিস্তা, ৯. দুই বহিরাগতর সমান্তরাল জীবন, ১০. সাদাত হাসান মান্টোর ঠান্ডা গোস্ত এবং ১১. রুশ বিপ্লব ও ম্যাক্সিম গোর্কি : বিষাদগাথা (১৯০৫-২১)। প্রবন্ধ-তালিকায় চোখ বুলালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, গ্রন্থে সংকলিত প্রথম প্রবন্ধটির নামানুসারেই গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে। বইটিতে স্থান পাওয়া এগারোটি প্রবন্ধই বিষয় এবং বৈচিত্র্যে যেমন ভিন্নতার স্বাদ রয়েছে, পাশাপাশি প্রতিটি প্রবন্ধই গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য সাহিত্যে ও নৈতিকার প্রশ্নেও অভিন্ন একটি সুর স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে।

 

প্লেটো তাঁর ভাবনার আদর্শ সমাজ থেকে কবি এবং গল্পকারদের বিতাড়িত করেছিলেন এই বলে যে, তাদের কাজকর্ম, চিন্তাভাবনা, সামাজিক ন্যায়বিচার, নৈতিকতা এবং পুণ্যতার পথ আবিষ্কারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কিন্তু সাহিত্য পৃথিবীর সভ্যতার পাশাপাশি সমান গতিতে এগিয়েছে এবং প্রমাণ করেছে যে, সাহিত্যের নিজস্ব একটি ধর্ম আছে, গতিপথ আছে – যেখানে সাহিত্য সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি চরিত্র তৈরি করতে সমর্থ হয়। লেখক সমাজের অনুষঙ্গ থেকে প্রতিনিয়ত তাঁর খোরাক আহরণ করেন বটে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি সাহিত্যের প্রতিটি শব্দ নির্মাণ করেন। এ-কারণেই এলিয়ট লেখকের কল্পনায় শব্দের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ধিং হড়ঃ রহ বীরংঃবহপব নবভড়ৎব ঃযব ঢ়ড়বস ধিং পড়সঢ়ষবঃবফ.’ এলিয়টের কথা-সুরে সুর মেলালে যে-সত্যটি ধরা পড়ে তা হলো লেখক প্রতিনিয়ত সাহিত্যে নতুন চরিত্র তৈরি করেন, নতুন একটি দৃশ্যের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন। লেখক হাসান ফেরদৌস তাঁর গ্রন্থে সাহিত্যে সৃষ্ট শব্দমালা এবং চরিত্রের ভেতর নৈতিকতাকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। হাসান ফেরদৌসের ভাষায়, ‘লেখক প্রচলিত নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হন না, তিনি নৈতিকতার নতুন মানদ- প্রতিষ্ঠা করেন।’

গ্রন্থটির প্রথম এবং মূল প্রবন্ধ ‘নৈতিকতা ও সাহিত্যে’র ভেতর এবার প্রবেশ করা যাক। মানুষের নৈতিক বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এই দুই সংঘর্ষ থেকেই সমাজ প্রতিনিয়ত বদলায়। লেখক সেই দ্বন্দ্বের রেখাচিত্রটি তার কল্পনায় সাহিত্যে তুলে ধরেন। একজন পাঠক সাহিত্যে কি খোরাক খুঁজে পান? সাহিত্যের বর্ণিত চরিত্রগুলো থেকে তারা কি হুবহু সমাজটিকে দেখতে পান না-কি সাহিত্যের শিল্পরসে পাঠক নিমজ্জিত হতে চান। তবে যারা সাহিত্যে নৈতিকতার ঘ্রাণ পেতে চান তাদের হাসান ফেরদৌস প্রবন্ধের শুরুতেই সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এ ব্যাপারেও কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয় যে সাহিত্যের সাথে নৈতিকতার কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই। আবু সায়ীদ আইয়ুব যাকে ‘শ্রেয় নীতি’ বলছেন, সেই নীতিশাস্ত্র বা এথিকসের সাথেও তার কোনো আপাত যোগাযোগ নেই। লেখক পাড়ার পুরুত বা মাদ্রাসার মৌলভি নন যে তাঁকে সারাক্ষণ কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা ঠিক-বেঠিক, তার হিসাব গুনতে হবে।’

(পৃ ১২) তাহলে নৈতিকতার প্রশ্নে সাহিত্যের অবস্থান কী? যেখানে মানুষের জীবন এবং আচার দুটোই ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুশাসনের বেড়াজালে আবিষ্ট সেখানে মানুষের জীবনে কোনটা শ্লীল এবং অশ্লীল, কোনটা নৈতিক আর কোনটা অনৈতিক তা মূলত একধরনের ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ ছাড়া আর কিছুই নয়। যাঁরা সমাজের পুরোহিত, অভিভাবক অথবা সমাজকে যাঁরা নিজ ক্ষমতায় চালিত করেন তাঁরাই মূলত এই ‘কোড অব কন্ডাক্ট’গুলো নির্মাণ করেন। এবং দেখা যায় মানুষের প্রকৃতিগত লেনদেন, তার জীবন-ব্যবস্থা, জীবন-স্বপ্ন এবং জীবন-রচনা অনেকাংশই প্রভাবিত হয় ধর্মীয় অনুশাসন থেকে শুরু বিভিন্ন অনুষঙ্গের বেড়াজালকে আঁকড়ে ধরে। যে-কারণে মানুষ তার প্রকৃত জীবনকে এই সমাজে কখনো তার মতো করে রোপণ করার সুযোগ পায়নি। অন্যদিকে একজন লেখক মানুষের সেই অদেখা স্বপ্নকে নির্মাণ করেন তাঁর শব্দশিল্প দিয়ে। যে-কথা সমাজ অনুমোদন করে না, যে-ক্ষত নিয়ে সমাজ দাঁড়িয়ে

আছে সেই কথাগুলো লেখক অবলীলায় বলে দেন তাঁর সাহিত্যকর্মে। হাসান ফেরদৌস সে-কথাটিই বলেছেন একটু ভিন্ন সুরে, ‘গত আড়াই হাজার বছরের যে সাহিত্যের সাথে আমরা পরিচিত, তাতে লেখককে দেখি এই সামাজিক নৈতিকতার সাথে একটি গোপন লড়াইতে লিপ্ত। কখনো সে এই নৈতিকতার সপক্ষে, কিন্তু অধিকাংশ সময়েই-নিদেনপক্ষে কালজয়ী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন যারা, প্রচলিত নিয়ম ও বিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এটা সাহিত্যের শক্তি।’

(নৈতিকতা ও সাহিত্য, পৃ ১৫)

 

প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে একজন পাঠক সাহিত্যের মধ্যে কী খুঁজে বেড়ান? পাঠক কি সাহিত্যপাঠের মধ্য দিয়ে নৈতিক একটি পথ তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হয়ে হন? না-কি পাঠক সাহিত্য উপাদানে নৈতিকতা খুঁজে বেড়ান? স্পষ্টতই বইটিতে দুটি প্রধান জিজ্ঞাস্য আছে। এক. সাহিত্যে নৈতিকতার অবস্থান এবং দুই. একজন পাঠক তার নৈতিক অবস্থান থেকে সাহিত্যের প্রতি কীভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারেন। হাসান ফেরদৌসের ভাষায়, ‘সাহিত্য উদ্দিষ্ট হল পাঠক, পাঠকের কথা মাথায় রেখেই সাহিত্য নির্মিত হয়। আর পাঠক বায়বীয় বা নৈর্ব্যক্তিক কোন সত্তা নয়। সে বাস করে সুনির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামোর ভেতর, যে কাঠামো নির্মিত প্রচলিত নীতিবোধ ও সামাজিক সম্পর্ক দ্বারা। ফলে চান, না চান, সমাজ আরোপিত মূল্যবোধ-ভালো-মন্দ সম্বন্ধে বিচার-বিবেচনা লেখককে তাঁর হিসেব রাখতেই হয়।’

(নৈতিকতা ও সাহিত্য, পৃ ১২)

 

এবার গ্রন্থটিতে সংকলিত অন্য প্রবন্ধগুলোর দিকে চোখ রাখা যাক। বালুতে একটি চুম্বক গাঁথলে সেখানে যেমন বালুর ভেতর লুকিয়ে থাকা লোহার কণাগুলো অনায়াসে চুম্বকের গায়ে এসে লাগবে, ঠিক একইভাবে গ্রন্থের অন্য প্রবন্ধগুলোর দিকে চোখ রাখলে গ্রন্থটির মূল নির্জাসটুকু পেতে অসুবিধা হয় না। প্রতিটি প্রবন্ধেই লেখক কোনো না কোনোভাবে সাহিত্যের চরিত্রে নৈতিকতার সঙ্গে সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং সেইসঙ্গে লেখকের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।  এ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনলে ‘ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ : কবিতা যখন প্রতিবাদ’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘কবিতায় নিষিদ্ধ প্রেম’, শেখ সাদীর ‘গুলিস্তা’, দুই ‘বহিরাগত’ সমান্তরাল জীবন এবং  ‘শহীদ কাদরীর কবিতায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক’ এই প্রবন্ধগুলো মোটামুটিভাবে একই রকম বাণী বহন করে। লেখক প্রতিটি প্রবন্ধেই ব্যক্তিমানস চরিত্র এবং সেইসঙ্গে সমাজের দায় এই দুটো চরিত্রকে পাশাপাশি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। পাশাপাশি লেখক তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন একজন লেখক কীভাবে দক্ষতার সঙ্গে সাহিত্যেকে উপজীব্য করে নিজের কথাটি বলে যেতে পারেন। যেমন ‘শহীদ কাদরীর কবিতায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক’ প্রবন্ধে কবি শহীদ কাদরী তাঁর ব্যক্তিগত নৈতিক বিশ্বাসকে লালন করে কবিতার শব্দে নিজেকে নির্মাণ করেছেন, ‘সেই স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডা উপাসনালয়ে পেতে         দাও

জায়নামাজ, শুকনো কাঁথা, খাট, স্তূপ স্তূপ          রেশমের স্বাদ।

আলিঙ্গনে, চুম্বনে ফেরাও শৈশবের আহ্লাদ।’

পাশাপাশি সাহিত্যে নৈতিকতা যিনি নির্মাণ করেন সেই নির্মাণশিল্পীকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে লেখক ভোলেননি। ‘রবীন্দ্রনাথ বনাম নেরুদা : একটি কুম্ভীলক কাহিনি’ প্রবন্ধে লেখক শুরুতেই সাহিত্যে চৌর্যবৃত্তির ইতিহাস নিয়ে বিস্তর আলোচনার ক্ষেত্র উন্মোচন করেছেন। প্রবন্ধটি পাঠ করলে দেখা যায় স্প্যানিশ স্বনামধন্য কবি পাবলো নেরুদা বাংলার আরেক স্বনামধন্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা অনেকটা হুবহু স্প্যানিশ ভাষায় নকল করে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। সাহিত্যে এই চৌর্যবৃত্তি নতুন কিছু নয়, তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাবলো নেরুদার মতো একজন বড়মাপের কবির কাছ থেকে এটি কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় লেখক বোর্হেস লেখকদের এই স্খলনের কথা ভেবেই হয়তো বলেছিলেন, ‘একজন লেখক নিজের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি কেবল গতকালের নয়, আজকের, এমনকি আগামীকালের লেখকের কাছে ঋণী।’ অবশ্য রবীন্দ্রনাথের যে-কবিতাটিকে নিয়ে নেরুদা তাঁর গ্রন্থে ষোলো নম্বর প্রেমের কবিতাটি লিখেছিলেন পরে তিনি তা স্বীকার করেছিলেন। নেরুদার বক্তব্য, ‘গ্রন্থভুক্ত ষোলো নম্বর কবিতাটি বহুলাংশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গার্ডেনার’ গ্রন্থের একটি কবিতার শব্দান্তর (‘রবীন্দ্রনাথ বনাম নেরুদা : একটি কুম্ভীলক কাহিনি’, পৃ ৫৯)।

সন্দেহ নেই প্রবন্ধটি সুখপাঠ্য, সেই সঙ্গে সাহিত্যে নির্মিত চরিত্রের নৈতিকার পাশাপাশি লেখকের নৈতিক চরিত্র উন্মোচিত করার প্রয়াস পেয়েছেন লেখক হাসান ফেরদৌস। ‘রুশ বিপ্লব ও ম্যাক্সিম গোর্কি’ প্রবন্ধটি অন্য বিবেচনায় একটু ব্যতিক্রমধর্মী। এই প্রবন্ধটি মূলত রুশ বিপ্লবের আগে এবং পরে সমাজ ও সমাজের নৈতিক অবস্থানকে তুলে আনা হয়েছে। প্রবন্ধে লেখক জানাচ্ছেন নৈতিক অবস্থানগত দিক থেকে লেনিনের সঙ্গে গোর্কির বিশ্বাসের বিস্তর ব্যবধান ছিল। সমাজ বদলের আঁকাবাঁকা পথে গোর্কির নিজস্ব বিশ্বাসের ছাপ পড়েছিল তাঁর সাহিত্যের চরিত্রের মাঝেও। এই প্রবন্ধে হাসান ফেরদৌস লেনিনের সঙ্গে গোর্কির নৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থানগত দূরত্বটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। লেখক যখন বলেছেন, ‘লেনিনের সাথে গোর্কির সম্পর্ক গোড়া থেকেই কিছুটা গোলমেলে ছিল। শিক্ষায় ও বিজ্ঞানে প্রবল অনুরাগী হলেও আধুনিক সাহিত্যের প্রতি লেনিনের তেমন কোনো বাড়তি আগ্রহ ছিল না। বিশ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়ায় যে প্রতিবাদী কাব্য আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার প্রতি লেনিনের মনোভাব ছিল বিদ্রƒপাত্মক।’

(‘রুশ বিপ্লব ও ম্যাক্সিম গোর্কি’, পৃ ১৪৩)

 

‘রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘরে’র পর ইয়ানুশ কোরচাকের ‘পোচতা’ প্রবন্ধটি আমাদের কাছে আরেকটি বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ড হিটলার বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। দেশজুড়ে চলছে নাৎসি সন্ত্রাস, যার অন্যতম শিকার হয়েছিল দেশের পঁয়ত্রিশ লাখ ইহুদি।

সে-সময় ইয়ানুশ কোরচাকের বয়স চৌষট্টি বছর। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে থাকা শ-দুয়েক ইহুদি অনাথ বালক-বালিকাকে হত্যার উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে মূল শহর থেকে দূরে একটি জেলখানায়। উদ্দেশ্য ইহুদি হওয়ার অপরাধে তাদেরকে হত্যা করা। কিন্তু ইয়ানুশ কোরচাক সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি সেই মৃত্যুপথযাত্রী বালক-বালিকাদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর মঞ্চস্থ করাবেন। লেখক হাসান ফেরদৌস লিখছেন, ‘মৃত্যুপথযাত্রী এক বালকের গল্প, আসন্ন মৃত্যুকে যে বরণ করছে আবিষ্কারের আগ্রহে, প্রাত্যহিক কৌতূহলে ও বিমল আনন্দে। সেই আনন্দ এসব অনাথ শিশুর মধ্যে সঞ্চারিত হোক, এই বিশ্বাস থেকে ওয়ারশর ঘেটোতে ‘ডাকঘর’ মঞ্চস্থ হলো ১৮ জুলাই। আড়াই সপ্তাহ পর, ৬ আগস্ট ১৯৪২, নির্দেশ এলো কোরচাক, তাঁর সব সহকর্মী ও অনাথ আশ্রমের ১৯৫ জন শিশুকে অবিলম্বে চলে যেতে হবে ত্রেবলিনকায়।’ (রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, ইয়ানুশ কোরচাকের ‘পোচতা’, পৃ ৩১)। সে-সময় অন্য কোনো নাটক না নিয়ে কোরচাক কেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘরকে বেছে নিয়েছিলেন? লেখক কোরচাকের ভাষায় সেই উত্তরটি দিয়েছেন এভাবে :

‘শিশুরা যেন মৃত্যুকে স্মিতমুখে বরণ করতে পারে, সে উদ্দেশ্যেই এই নাটকের মঞ্চায়ন।’

একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ডাকঘর অন্যদিকে কনসেনট্রশন ক্যাম্পে মৃত্যুপথযাত্রী কিছু বালক-বালিকা মৃত্যু নিয়ে ভাবনা। সাহিত্যের চরিত্রগুলো কখনো কখনো সমাজের দায় মেটায়  আবার পাশাপাশি মানুষের সামাজিক গুরুভারকেও লাঘব করে দিয়ে সমাজের নৈতিক অবস্থানকেও তির্যকভাবে দেখিয়ে দেয়। সাহিত্যে সৃষ্ট একটি চরিত্র পাঠকের হৃদয়কে কত গভীরভাবে ছুঁয়ে যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, ইয়ানুশ কোরচাকের ‘পোচতা’ এর উজ্জ্বল উদাহরণ।

 

কথা হলো সমাজে আমরা যে-বিষয়টিকে ভালো এবং মন্দ বলে মোটা দাগে শনাক্ত করতে চাই সাহিত্যে এর প্রকাশ ঘটে কীভাবে? সমাজের অসংগতি সাহিত্য আয়না ধরা পড়বে তা ভাবা অমূলক নয়। তবে সমাজের অসংগতিগুলো সাহিত্যের পাতায় একজন লেখক কীভাবে তুলে ধরবেন সে-বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সমাজের ক্ষতগুলোর দিক উন্মোচন করাই সাহিত্যিকের কাজ নয়। বরং একজন লেখক সমাজের বিভিন্ন অসামঞ্জস্যকে তাঁর নিজের মতো করে শিল্পিত রূপ দেন। ধরা যাক, সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে লেখা কোন উপন্যাসে ধর্ষণ বিষয়টি সাহিত্যে নানাভাবে এসেছে। বেশিরভাগ সময়ই লেখক সাহিত্যে ধর্ষণের ঘটনাপ্রবাহর মধ্য দিয়ে মূলত নারীর অধিকার এবং সেইসঙ্গে সমাজের মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। আবার এর একটা উলটোদিকও আছে। সমাজ একজন নারীকে পূতপবিত্র, সতীসাধ্বী হিসেবে দেখতে ভালোবাসে। নারী মানেই চরিত্রবান এবং নিষ্কলঙ্ক। পুরুষশাসিত এ-সমাজে একজন পুরুষই বলে দিচ্ছে নারীকে কেমন হতে হবে আর নারী কতদূর পথ যেতে পারবে। কিন্তু সাহিত্যে একজন লেখক সেই চরিত্রটিকে ভিন্নমাত্রায় চিত্রিত করেন। ‘হাসান আজিজুল হকের রচনায় নৈতিকতার সংকট ও সমাধান প্রবন্ধে লেখক হাসান ফেরদৌস বলছেন, ‘উপমহাদেশের সাহিত্যে ধর্ষণ নিয়ে উপন্যাসের অভাব নেই। সেসবের অধিকাংশই লিখিত হয়েছে পুরুষের হাতে, যাতে ব্যক্তিগত নৈতিকতার প্রশ্নটিই কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে। হাসান আজিজুল হকও নৈতিকতার প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু ব্যক্তিগত নৈতিকতার বদলে সম্মিলিত নৈতিকতা-ও তার অনুপস্থিতির-কথাতেই তাঁর আগ্রহ’ (‘হাসান আজিজুল হকের রচনায় নৈতিকতার সংকট ও সমাধান’, পৃ ৭৪)

 

এবার ‘সাদাত হাসান মান্টোর ঠান্ডা গোস্ত’ প্রবন্ধটির দিকে চোখ রাখা যাক। নৈতিকতা এবং অশ্লীলতার প্রশ্নে কথাসাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টোকে তিন তিনবার ভারত এবং পাকিস্তানের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। মান্টো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ওভ ুড়ঁ ভরহফ সু ংঃড়ৎরবং ফরৎঃু, ঃযব ংড়পরবঃু ুড়ঁ ষরাব রহ রং ফরৎঃু. ডরঃয সু ংঃড়ৎরবং,  ও ড়হষু বীঢ়ড়ংব ঃযব ঃৎঁঃয. এ-কথাই ঠিক যে, সমাজের বিরুদ্ধে সাহিত্য যখনই মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে তখনই সাহিত্যের পিঠে খড়্গ নেমে এসেছে। কখনো কখনো সমাজের বিচারে সাহিত্য বাজেয়াপ্ত হয়েছে, কখনো লেখককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এর কারণ হলো, সমাজ কখনো সত্যকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।  ‘সাদাত হাসান মান্টোর ঠান্ডা গোস্ত’ নিবন্ধে লেখক হাসান ফেরদৌস সে কথাটিই বলতে চেয়েছেন। লেখকের ভাষায়, ‘মার্চ ১৯৪৯ সালে সাদাত হাসান মান্টোর ‘ঠান্ডা গোস্ত’ গল্পটি প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়। ছাপা হওয়ার পরপরই গল্পটি ‘অশ্লীল’ এই অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং মান্টোকে অপরাধীর কাঠগড়ায় তোলা হয়। দেশবিভাগের সময় দাঙ্গার ওপর লেখা এ গল্পটি মান্টোর আরো অনেক গল্পের মতোই, প্রবল দাঙ্গাবিরোধী। আমাদের বিবেকের ওপর কশে চাবুক দেয় সে।’ (পৃ ১২৯) উল্লেখ্য, লেখক এই প্রবন্ধে মান্টোর ‘ঠান্ডা গোস্ত’ গল্পটি হুবহু পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। পুরো গল্পটা হুবহু প্রকাশ না করে বরং গল্পটি কেন অশ্লীলতার দায়ে আদালতে উঠেছিল এবং কেনই-বা তা দেশবিভাগকালে দাঙ্গাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল সে নিয়ে আরো বিশদ ব্যাখ্যায় যেতে পারতেন লেখক।

এবার গ্রন্থটির নামকরণ নিয়ে দুটো

কথা। সম্ভবত বইয়ের নামকরণের ক্ষেত্রে এটি খুবই পুরনো একটি রীতি। প্রবন্ধগুলো থেকে মূল একটি প্রবন্ধের নামে গ্রন্থের নামকরণ করা হয়। ‘নৈতিকতা ও সাহিত্য’ গ্রন্থটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বেশ বুঝতে পারি গ্রন্থটির নাম নৈতিকতা  ও সাহিত্য দেখে অনেক উৎসাহী পাঠকের এমন ধারণাও করবেন যে, গ্রন্থটি বুঝি শুধু ‘নৈতিকতা ও সাহিত্য’ এই একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে। তবে গ্রন্থটিতে প্রকাশিত অন্য প্রবন্ধগুলো বিষয়টি বৈচিত্র্যে ভিন্নতার স্বাদ যেমন রয়েছে, তেমনি প্রতিটি প্রবন্ধই শিল্পরসে প্রতিভাত। সবদিক বিবেচনায় নৈতিকতা ও সাহিত্য একটি সফল প্রবন্ধের বই। সাহিত্যে নৈতিকতার অলিগলি যখন ধোঁয়াটে এবং কখনো কখনো প্রশ্নবিদ্ধ তখন এই গ্রন্থটি বর্তমান সময়ের পাঠকদের অনুসন্ধানী মনে বাড়তি খোরাক জোগাতে বাধ্য। বাংলা একাডেমি থেকে এ-ধরনের গ্রন্থ প্রকাশ প্রশংসার দাবি রাখে। আশা করি, বাংলা একাডেমির মহতী কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। লেখক হাসান ফেরদৌসকে অভিনন্দন।

গ্রন্থটির বহুল পাঠ এবং প্রচার কামনা করছি।