নৃত্যচর্চার অনবদ্য দলিল

নওশাদ জামিল

তরুণ প্রজন্মের অনেক নৃত্যশিল্পী বরেণ্য নৃত্যবিদ দুলাল তালুকদারকে চেনেন না, তাঁর সৃজনকর্ম ও বিশিষ্ট নৃত্যধারা সম্পর্কে জানেন না; তরুণদের অবশ্য জানার কথাও নয়। যাঁদের জানার কথা – তাঁরা কী কখনো বুঝতে পেরেছিলেন তিনি কত বড় নৃত্যশিল্পী? যদি বুঝতেই পারতেন – তাহলে কেন তাঁর মূল্যায়ন হয়নি? স্বাধীনতার পূর্বে প্রায় একদশক ধরে যিনি সারা পৃথিবীতে চষে বেড়িয়েছেন বাঙালির নিজস্ব নৃত্য-ঐতিহ্য নিয়ে, নৃত্যের অপূর্ব সব তালমুদ্রায় যিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বাঙালিরই ব্রতকথা, প্রশংসা কুড়িয়েছেন পৃথিবীখ্যাত গুণীজনের, স্বাধীনতার পর তিনি কেন থাকেননি বাংলাদেশে, কেনইবা আমরা তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করিনি? বাংলাদেশে নৃত্যধারা বিকাশে তিনি যে চেষ্টা করেননি তা নয়, কিন্তু সম্মান ও কাজের সুযোগটা তিনি পাননি। নৃত্যশিল্পী দুলাল তালুকদার সম্পর্কে জানাশোনার পর, তাঁর সৃজনকর্ম সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর কেবলই মনে হয় – দেশের নৃত্যজগত বঞ্চিত হলো এক মহীরুহের ছায়া থেকে।

দুলাল তালুকদার শুধু নৃত্যশিল্পী নন, একজন নৃত্যবিশারদও। পাশাপাশি তিনি পৃথিবীখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ডান্সের শিক্ষক, বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার ও সংগীতজ্ঞ। তাঁর শৈল্পিক নৃত্য আঙ্গিক, বাঙালির নিজস্ব নৃত্যভাবনা, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার মিশেল – তাঁকে দিয়েছে খ্যাতি ও বিপুল জনপ্রিয়তা। তাঁর সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁর নৃত্য যাঁরা উপভোগ করেছেন, তাঁদের প্রায়ই বলতে শোনা যায় – বাংলাদেশের নৃত্যসম্রাট বুলবুল চৌধুরীর যোগ্য পতাকাবাহী দুলাল তালুকদার।

বছরদুয়েক আগে উপমহাদেশের নৃত্যগুরু ও নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরীর সহধর্মিণী নৃত্যশিল্পী আফরোজা বুলবুলের আত্মকথা ‘সুন্দর এই পৃথিবী আমার’ পড়েছিলাম, দুলাল তালুকদারের আত্মকথা আমি পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল সেই পাঠস্মৃতি – মুসলমান হয়ে নৃত্যের জন্য বুলবুল ভীষণ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, দুলাল তালুকদারের ত্যাগ-তিতিক্ষাও কম নয়।

বুলবুল চৌধুরী যখন নৃত্যকলায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন, বাঙালি মুসলমান সমাজে তখন নাচের চর্চা প্রায় নেই। মুসলমান সমাজে নৃত্য ‘নিন্দিত ও নিষিদ্ধ’ বিষয়। মুসলিম তরুণ বুলবুল সব বাধা পেরিয়ে নৃত্যশিল্পকে মুসলমান সমাজের ‘বন্ধ জানালা’ খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর সহধর্মিণী আফরোজা বুলবুলকে নিয়ে এ অঞ্চলের নৃত্যের প্রচার ও প্রসারে অনেক কাজ করেন বুলবুল চৌধুরী। মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই মারা যান প্রখ্যাত এই নৃত্যগুরু, স্বামীর মৃত্যুর পর থমকে থাকেননি আফরোজা বুলবুল। স্বামীর দেখানো পথে, নৃত্যকে হৃদয়ে নিয়ে একের পর এক কাজ করেছেন, নৃত্যচর্চা ও নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন পাকিস্তানের করাচিতে বুলবুল ইনস্টিটিউট অব কালচারাল এবং ঢাকায় বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা)।

লক্ষণীয় বিষয় যে, বুলবুল চৌধুরীর যেখানে শেষ, সেখান থেকেই শুরু দুলাল তালুকদারের। বুলবুলের মৃত্যুর বছর খানিক পরই তাঁর নামাঙ্কিত নৃত্যপ্রতিষ্ঠান বাফার প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন দুলাল তালুকদার। আত্মকথা আমি শিরোনামের বইটির একেবারে শুরুর দিকে খুদে দুলাল স্মৃতিচারণ করেছেন বাফার প্রথম দিনটির কথা। তিনি লিখেছেন, ‘‘আববা এক সকালে আমাকে নিয়ে গেলেন ৭ নং ওয়াইজঘাট, সদরঘাটে বুলবুল একাডেমিতে ভর্তি করাতে। দেখলাম বিরাট রাজবাড়ির মতো বাড়ি। লোকজন খুব একটা নেই। লম্বা চুলওয়ালা একজন ভদ্রলোক বালতি থেকে পানি নিয়ে মুখ ধুচ্ছিলেন। তিনি আববাকে দেখে এগিয়ে এসে নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘আমার নাম অজিত স্যানাল। আববা বললেন, ছেলেকে নিয়ে এসেছেন ভর্তি করাতে। খুব ভালো কথা।’ কিন্তু তিনি একটু অবাকও হলেন। নাচের ক্লাসে কোনো মুসলমান ছেলে ভর্তি হতে আসেনি।’’

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়, দুলাল তালুকদার ছিলেন বাফার প্রথম মুসলমান ছেলে, যিনি নাচ শিখতে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই খুদে ছেলেটি একটি রক্ষণশীল পরিবার ও সমাজের নানা বাধা পেরিয়ে কিভাবে নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠলেন, কীভাবে নিজেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিষ্ঠা করলেন, তার এক অনবদ্য বয়ান আমি শীর্ষক আত্মজীবনী।

 

দুই

নৃত্যশিল্পী দুলাল তালুকদারের জন্ম ১৯৪৬ সালের, ১৭ ফেব্রম্নয়ারি, কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাঁর পরিবার ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় এসে তাঁরা উঠেন কমলাপুরের ঠাকুরপাড়ায়। তাঁর জন্ম বৃটিশ ভারতে হলেও বেড়ে ওঠা, নৃত্য শেখা এবং খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠা-সবই পাকিস্তান আমলে। অল্প বয়সেই তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় নৃত্যের প্রতিভা, কৈশোরে পা দিয়েই নিজের অধ্যবসায় ও সাধনায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম নৃত্যশিল্পী। তারপর তো ইতিহাস, দেশ ছাড়িয়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব-আঙিনায়। গত শতকের গোটা ষাটের দশকজুড়ে সদ্য তরুণ দুলাল পৃথিবীর নানা প্রামেত্ম নৃত্যপরিবেশন করেছেন, তুলে ধরেছেন বাঙালির নিজস্ব পরম্পরা, ঐতিহ্য ও নৃত্যধারা। পাকিস্তান আমলেই দুলাল তালুকদার পাকিস্তানের জাতীয় সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশে নৃত্য পরিবেশনায় অংশ নেন। কিন্তু তাঁর সেই নৃত্যাভিযাত্রা তো সহজ ছিল না, সে জন্য দুলালকে কী পরিমাণ বাঁধা-বিপত্তি পেরোতে হয়, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত সদ্য পাকিস্তানে, সেই সময়ের মুসলমান সমাজে তা ছিল সত্যিই অকল্পনীয়। দুলাল তালুকদার সেইসব কথা লিখেছেন তাঁর বইটায়, সহজ ও প্রাঞ্জলভাবে, সেটা এই যুগের নৃত্যশিল্পীদের জন্য এক অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় স্মারক।

পঞ্চাশের শুরুতে, মুসলমান সমাজে সংগীত কিছুটা গ্রহণীয় ছিল বটে, কিন্তু নাচ ততটা নয়। ফলে দুলালকেও বাঁধার পাহাড় ডিঙাতে হয়, পাড়ি দিতে হয় বন্ধুর পথ। বইটির ভূমিকায় তিনি সেই কথা বলতে ভুলেননি। দুলাল তালুকদার লিখেছেন, ‘‘একটি রক্ষণশীল পরিবার, ততোধিক রক্ষণশীল সমাজের ব্যূহ ভেদ করে পুরুষ হয়ে নৃত্যশিল্পের চর্চা করা, আন্তর্জাতিক পরিসরে উঠে আসার প্রচেষ্টা নিতান্ত সহজ বিষয় ছিল না। ষাটের দশকে পাকিস্তানের রবীন্দ্র-বিরোধিতার সময়ে রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘স্বর্গ হতে বিদায়’ অবলম্বনে ‘শ্যামল মাটির ধরাতলে’ ইত্যাদি নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণও ছিল আমার জন্য কঠিন সময়। নানা রকম বাধা-বিঘ্ন ও প্রতিকূল পরিবেশে সাফল্য কতটুকু পেয়েছি, তা আমার নিজের বিবেচ্য নয়।’’

অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্রভাষায় লিখেছেন দুলাল, বলেছেন লেখালেখি নিয়ে তাঁর খানিক ভয়ের কথা। তাই শুরুতেই পরিস্কার করে, বিনয়ের সঙ্গেই তিনি বলেছেন, ‘‘আমি লেখক নই- সেই কথাটি মনে রেখেই স্মৃতিকথা লেখার এই দুঃসাহস। পাঠকবর্গকেও সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই, আমার পা যতটা সচল, হাত ততটা নয়। পায়ে ঘুঙুর বাঁধলে তা আপনা থেকেই নেচে ওঠে, কিন্তু কলম তুলে নিলে অনভ্যস্তহাত কাঁপতে থাকে। তারপরও জীবন-স্মৃতি লেখার এহেন দুর্বার আকাঙ্খা কিছুতেই রোধ করা গেল না।’’ লেখালেখি তাঁর পেশা নয়, নেশাও নয়; তাঁর সব সাধনা, ধ্যান নৃত্য ঘিরেই, তারপরও তিনি কলম ধরে অনুপম একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। নৃত্যের মতো তাঁর বলার ভঙ্গি ও লেখার স্টাইলটাও আকর্ষণীয়, আর সেই সাবলীল ভঙ্গিমায় তিনি শুধু নিজের কথা বলেননি, পাকিস্তান আমলে সংস্কৃতিচর্চার নানা দিকে আলোকপাত করেছেন। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন তৎকালীণ সমাজের নৃত্য ও সংস্কৃতি চর্চার নানা অজানা অধ্যায়, পাঠক হিসেবে, লেখক হিসেবে, সাংস্কৃতিক সাংবাদিক হিসেবে আশা করি, দুলাল তালুকদারের সৃজনশীল লেখালেখি এটাই শেষ নয়, শুরু।

বইটি পাঠ শেষে জানা যায়, হাঁটতে শেখার বয়স থেকেই গান ও নাচ শেখার ঝোঁক ছিল তাঁর। ঠাকুরপাড়ায় তাঁদের পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যাঁরা তাঁকে নাচের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিলেন। খুব ছোটবেলায় তাঁদের পড়শী ছিলেন অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। যখন তাঁর বয়স সাত/আট, তখনই সাবিত্রীই আবিস্কার করেন যে, খুদে দুলালের মধ্যে রয়েছে নৃত্যের বিরল প্রতিভা।  পরে তাঁকে আর থামিয়ে রাখা যায়নি, মস্নান হয়ে যায়নি তাঁর প্রতিভা। সদ্য প্রতিষ্ঠিত বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হন দুলাল, প্রথম দিকে তাঁর বাবাকে তেমন উৎসাহ দেননি, বরং তাঁকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেন তাঁরই বড় ভাই বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার। বইটিতে ঘুরে-ফিরে এসেছে মাহবুব তালুকদারে কথা, কেননা তাঁর উৎসাহ ও পরামর্শেই দুলাল খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর ভালোবাসায় জায়গা, তাঁর দাঁড়াবার মাটি। সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টি থাকলেও পরিবারের উৎসাহ ছিল দুলালের সঙ্গে, পিতা প্রথমদিকে রাজি না থাকলেও ছেলের জন্য তাঁর ছিল ভীষণ ভালোবাসা-মতিঝিল থেকে বাসে করে পুরান ঢাকায় নাচ শিখতে যেতেন কিশোর দুলাল, ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেত, তখন অন্ধকারে হারিকেন নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতেন পিতা। বোঝা যায়, পরিবার থেকে নাচ শেখার যে উৎসাহ পেয়েছিলেন তিনি, বস্ত্তত তা ছিল তাঁর জন্য এক অনুপ্রেরণার বিষয়।

 

তিন

১৯৫৫ সালে শুরু হয় দুলাল তালুকদারের প্রাতিষ্ঠানিক নৃত্য শেখা। বাফার দিনগুলো আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করেছেন তিনি, বলেছেন ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটির শুরুর দিকের নানা কথাপুঞ্জ। বাফার নাচের ক্লাসে প্রথম শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন মন্দিরা নন্দী, দুলাল তালুকদার ও রাহিজা খানম ঝুনু। আর সেখানে নৃত্যগুরু হিসেবে পান অজিত সান্যাল, জিএ মান্নান প্রমুখকে। মেয়েদের সঙ্গে ক্লাস করতে হতো দুলালকে, কেননা ছেলেদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। নাচ শেখার পাশাপাশি দুলাল পড়াশোনা করেন নবাবপুর স্কুলে, ষাটের দশকের শুরুতে এই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। তবে তার কয়েক বছর আগে থেকেই নৃত্যশিল্পী হিসেবে তুমুল ব্যস্তহয়ে ওঠেন কিশোর দুলাল। তখন দেশে তিনি যত নৃত্য পরিবেশন করতেন, তার চেয়ে বেশি নৃত্যপরিবেশনায় ডাক পেতেন পৃথিবীর নানা দেশ থেকে। অনেক বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কের সম্মানে, অনেক শহরে  তিনি নাচ করেছেন, খ্যাতিমানদের তালিকা দেখলে বিস্ময় জাগে মনে। ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভি, চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে নানা সময় আয়োজিত হয়েছে নানা নৃত্যানুষ্ঠান, পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে সেইসব অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন দুলাল তালুকদার। এ ছাড়াও তিনি সান্নিধ্য পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বখ্যাত ওস্তাদ বিসমিলস্নাহ খান, গজলসম্রাট মেহেদী হাসান, নৃত্যরানি সিতারা দেবী, উদয়শঙ্কর, প–ত রবিশঙ্করসহ বহু গুণীর।

১৯৬০ সালে প্রথমবার বিদেশে নৃত্যপরিবেশন করেন দুলাল তালুকদার, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর, প্রথমবার মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে তিনি নৃত্য পরিবেশন করেন, তারপর পৃথিবীর নানা জায়গায়, নানা শহরে তিনি নৃত্য পরিবেশন করেছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক দল বিদেশে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নিয়েছে, তাতে অংশ নিয়েছেন তরুণ দুলাল। দূর দেশে কখনো তুলে ধরেছেন নকশি কাঁথার মাঠ, পলস্নীকবির এই নৃত্যনাট্য প্রথমবারের মঞ্চায়ণের সঙ্গে জড়িয়ে তিনি, আবার কখনো বাঙালির লোকঐতিহ্যের নৃত্য, কখনোবা রাহিজা খানম ঝুনুর সঙ্গে জুটি বেঁধে করেছেন সাড়াজাগানো নৃত্য ‘সুর ও ছন্দ’ ইত্যাদি।

মোটামুটি ষাটের দশকের শুরু থেকে সত্তরের মাঝামাঝি পর্যন্ত অনেক দেশে নৃত্য পরিবেশন করেছেন দুলাল তালুকদার। তাঁদের বিদেশ পাঠিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত, ফলে সারা বছরই বিদেশে অনুষ্ঠান লেগে থাকত সেই সাংস্কৃতিক দলের। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে শুরু হয় তাঁর নানা বঞ্চনা, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে তখন থাকতে হয় পাকিস্তানে,  মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁকে দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। পরে প্রায় পালিয়ে দেশেই আসার কিছুদিন পরই স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ।

সদ্য স্বাধীন দেশে নৃত্যশিল্পকে একটা ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন দুলাল তালুকদার। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি পারেননি, তেমন একটা সহযোগিতা পাননি। তারপর ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান স্থায়ীভাবে। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিদেশেই নৃত্যচর্চা করছেন তিনি। আমেরিকায় নাচের শিক্ষক ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), বোস্টন ইউনিভার্সিটি, বিশ্বখ্যাত লোকনৃত্যদল ‘মান্দালা’সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ডান্সের সঙ্গে যুক্ত আছেন। বিদেশের মাটিতে দেশের সূর্যসমত্মান শিক্ষা দিচ্ছেন নাচের, বিদেশে তুলে ধরছেন  প্রাচ্যের রূপ-রস ও রহস্যময় নানা নৃত্যধারা।

 

চার

নৃত্যগুরু দুলাল তালুকদারের আত্মজীবনী আমি হয়তো পূণাঙ্গ নয়, আশা করি, তিনি লিখবেন তাঁর জীবনের আরো নানা কথা। দীর্ঘ জীবনে তিনি যেমন দেখেছেন পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পরিবেশ, তেমন করে তিনি দেখেছেন বৈশ্বিক নানা কিছু, সেইসবের নির্বাচিত ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে এই বই। পাশাপাশি এটাও আশা করি, পরম শ্রদ্ধেয় এই নৃত্যশিল্পী দেশের নৃত্যধারা ও নৃত্যজগত বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন, তরুণ শিল্পীদের মাঝে ছড়িয়ে দেবেন তাঁর অভিজ্ঞতা ও প্রাজ্ঞতার বহুবর্ণিল আলোকচ্ছটা।

অনেকেই বলেন, নৃত্য সব ললিতকলার জন্মদাত্রী। কথা সত্য। শিশুর মুখে যখন বুলি ফোটে, তার আগেই শিশু অঙ্গ সঞ্চালন করে, হাত-পা নেড়ে মনের ভাব প্রকাশ করে। অনুরূপভাবে সংগীত ও চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, নাটকসহ সব মাধ্যমেই রয়েছে নৃত্যের নানাবিধ ব্যবহার। ফলে এই মাধ্যমটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্যশিল্পীদের দীর্ঘদিনের দাবি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে নৃত্যকলাকে অন্তভূর্ক্ত করা। সেটা সম্ভব হলে শিশু-কিশোরদের শিক্ষার শুরু মুগ্ধতা ও বিস্ময় দিয়ে সূচিত হবে, তার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে জেগে উঠবে আনন্দের লহরি। বাল্যকালে শিশুরা যদি সুকুমার শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে কাজ করবে সত্যিকারের সৃজনশীলতা, কাজ করবে অসাম্প্রায়িক চেতনা। দীর্ঘদির পরে হলেও নৃত্যের বিকাশে দেশে কিছু সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগ খোলা হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যসূচিতে নৃত্যকলাকে সংযুক্তি করার প্রক্রিয়া চলছে। পাঠ্যসূচি প্রণয়ন থেকে শুরু করে শিক্ষাদানের নানা স্তরের জন্য উৎকৃষ্ট পরামর্শক হতে পারেন দুলাল তালুকদার। বিশ্বাস করি তাঁর মধ্য দিয়ে আমাদের নৃত্যধারা নতুন নিক্কণে বেজে উঠবে, নতুন উদ্যমে জেগে উঠবে সুর ও সংগীতের সমবায়ে ঐশ্বর্যময় নৃত্যজগত।

খ্যাতিমান নৃত্যগবেষক ও অগ্রজ বন্ধু শেখ মেহেদী হাসানকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে দুলাল তালুকদার বলেছিলেন, ‘আমি ৪৫ বছর ধরে বিদেশে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে বাংলাদেশে। দেশের জন্য কিছু করতে চাই।’ সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়, নৃত্যসংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা আশা করি তা অনুধাবন করবেন, নৃত্যের বিকাশে গ্রহণ করবেন যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ।