নৈশভোজে রক্তপাত ও ব্যক্তিগত অনুষঙ্গের সৈয়দ হক

ফারুক আলমগীর

একজন সৈয়দ শামসুল হক কী অসাধারণ হয়ে ক্রমশ সব্যসাচীতে উপনীত হলেন তাঁর অভিনব ভাষাশৈলী,  কি কবিতায়, কি উপন্যাসে, কি গল্পে, কি কাব্যনাট্যে পলস্নবিত হয়ে আমাদের সাহিত্যভা-ারকে যেন এক কুহকী জগতে উত্তরণ ঘটালেন, যেখানে একজন সাধারণ মনুষ্য-পাঠক, একজন গবেষক আজীবন মোহাচ্ছন্ন হয়ে স্বপ্নের মণি-মুক্তা অন্বেষণ করবেন। দৈবের বশে তিনি কবিতা লেখেন না, স্বভাব-কবিত্বে তিনি অবিশ্বাসী। কবিতার চাল, লয়, ছন্দ আর কবিতাটি কী হবে, কবিতায় কী বলবেন সব তাঁর করোটিতে একই সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা। এটাই তাঁর বিশ্বাস। তিনি কবিতাকে দেখতে পান অবয়বে, সংকেতে-সংকল্পে, এমনকি কবিতার দৈর্ঘ্য, ব্যক্তিত্ব, বিষয়ের চক্ষুষ্মান কেমন ও কতটা কৌণিক সবই তাঁর পরিজ্ঞাত হয়ে যায় প্রথম অক্ষর লিখনের পূর্বেই। এত স্বীকারোক্তির পরেও তাঁর কোনো কোনো কবিতা রচনা যে দৈবের বশে হয়নি তা নয়, এমন সন্দেহও প্রকাশ করতে দেখি কবিকে। এই যেমন ‘নৈশভোজে রক্তপাত’ কবিতাটির রচনা প্রক্রিয়া অবলোকন করলে তা স্পষ্ট হবে।

 

দুই

কেন এই কবিতাটি আমি বেছে নিলাম এবং এই কবিতার প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব, তার ভূমিকা না দিলে নয়। আমি ১৯৮৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে খ-কালীন শিক্ষক ছিলাম। আমার পাঠদানের বিষয় ছিল ইলেকট্রনিক জার্নালিজম বা সম্প্রচার সাংবাদিকতা। পাঠদানের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় Visualization, যার বাংলা শ্রদ্ধেয় নূরউদ্দিন স্যার করেছিলেন চিত্র-রূপায়ণ, যদিও আমার মতে, চিত্র-রূপায়ণ কথাটির মধ্যে বিষয়টির ভাব ও ব্যাপকতার যথার্থ প্রকাশ ঘটে না। রেনেসাঁস আমলের চিত্রকলা থেকে আভা-গার্দ সাহিত্য-শিল্পকলা, এমনকি নব্য-বাস্তব ও পরাবাস্তব চলচ্চিত্রও বাদ যেত না। কবিতায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ এমনকি বন্দে আলী মিয়াও আমার পাঠদানে স্থান করে নিয়েছিলেন। তবে ১৯৯৭ সালে সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে হৃৎকলমের টানে পড়তে গিয়ে আমার ‘নৈশভোজে রক্তপাত’ কবিতাটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। সৈয়দ শামসুল হকের এই কবিতাটির অমত্মঃসত্ত্বা থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত অসাধারণ বর্ণনাগুণে আমি কবির অনন্য Visualization প্রত্যক্ষ করেছিলাম আর কবিতাটি যেন আমার পেশাগত শৈল্পিকমানের চেয়েও উত্তীর্ণ অন্য একটি জগৎ উন্মোচন করল, যা আমি পনেরো বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত করার চেষ্টা করেছি। পাঠকের আগ্রহের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নিবারণের জন্য একবার কবিতাটি দেখে নিই-

রাতের এ-রেস্তোরাঁয় একটি বিড়াল-চোখ তার

ফিরোজা পাথর, পৃথিবীর সবটুকু অন্ধকার

তসরের মতো টেনে বসে ছিল। একটি টেবিলে

ঘন নীল ন্যাপকিন কোলে পেতে দুই ব্যক্তি মিলে

সামুদ্রিক সেদ্ধ মাছ থেকে কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে

পাল্লা দিয়ে বলছিল – কে কোথায় গিয়েছে বেড়াতে।

 

এ যদি সিলেট বলে, ও বলে সুন্দরবন। নামে

যদি জোৎস্নায় হরিণ, পাহাড়েরও স্তন কবে ঘামে।

নাভি ফেটে যায় যদি গর্ভচাপে, বেরোয় প্রপাত-

হরিণের পালে পড়ে ডোরাকাটা বাঘ অকস্মাৎ।

বেড়াল অপেক্ষা করে, ভাগ্যে তার জুটবে কখন

কাঁটা-কানকো-ধৈর্যসীমা আছে তারও। হঠাৎ তখন

 

চোখের পলকে বাতি নিভে যায় বিদ্যুৎ বিপাকে।

‘মোম আনো, মোম’ কেউ ডেকে ওঠে ভূতুড়ে গলায়।

খাদ্য ও খাদক বসে ঘষে ঘষে ভুষোকালি মাখে।

ছুরি ডিশ পোর্সিলিন ভেঙ্গে পড়ে ঘোর স্তব্ধতায়।

ভ্রমণ যে এতক্ষণ ছিল শুধু কথার চাতুরি-

সে কথা বেড়াল জানে, জেনেছিল টেবিলের ছুরি।

 

বেড়ালটা ডেকে ওঠে, শব্দ ওঠে শুকনো পাতায়

সমুদ্র আছাড় খায়, নুন ওঠে তখন মাথায়।

তখন ছুরিতে হাত কেটে ফ্যালে – কে কার সঠিক?

হঠাৎ কে হয়ে ওঠে নৈশভোজে ক্রুদ্ধ নাগরিক?

অন্ধকার হয়ে ওঠে কার কাছে আলোর অধিক?

একজন কবি ছিল। অন্যজন কবিতা ক্রিটিক।

 

তিন

অপূর্ব, অনন্যসাধারণ একটি কবিতা, যা আমি বারবার পড়েছি আর মনে হয়েছে Visualization-এর জন্য এর চেয়ে সঠিক অন্য কিছু আছে কি? কী নেই এই কবিতায়? আমার আরাধ্য Realism, Neo-realism, Surrealism সবকিছুর সরণি পার করে পাঠকের হৃদয়ে শেষান্তে একটা নতুন অভিঘাত সৃষ্টি করে। কবি নিজেই বলছেন, ‘কিছু দিন থেকে মনের মধ্যে একটা ছবি বহন করে বেড়াচ্ছি একদিন একটি রেস্তোরাঁ, সন্ধ্যে বেলা, কফি খাবার জন্য কাচের দরোজা ঠেলে ভেতরে এসে দেখি এত বড় ঘরে দূরের টেবিলে দু’টি মাত্র লোক, তৃতীয় কোন খদ্দের নেই, মেঝের এক কোণে কালো একটি বেড়াল বসে আছে চোখ বুঁজে, রেস্তোরাঁটি পরিপাটি সাজানো, তাই এর নির্জনতাটুকু এত ধারালো, তাই যেন খুব গভীর দাগে আমার ভেতরে ছবিটা আঁকা হয়ে গেলো তৎক্ষণাৎ।’

এই গভীরভাবে দাগ কাটা ছবিটা কবিকে তাড়িত করেছে বহুদিন, বিশেষ করে চোখ বুজে থাকা ঘরের কোণের বেড়াল থেকেও তিনি মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। ছবিটা ছিল সন্ধেবেলার, কিন্তু তিনি কলম ধরতেই রাত ঘনিয়ে গভীর হতে থাকল আর চোখ বুজে থাকা বেড়ালের চোখটাই কিনা ‘ফিরোজা পাথর’ হয়ে গেল। পৃথিবীর সবটুকু অন্ধকার বোঝাতে ‘তসর’-এর প্রয়োগ একান্তই সৈয়দ হকের এক অভিনব উদ্ভাবনা। একবার ‘রেশম’ ব্যবহার করতে গিয়ে জীবনানন্দকে মনে পড়ায় শব্দটি লিখেও কেটে ফেলেন। ‘সিল্ক’ তৃপ্তিকর মনে না হওয়ায় সেটা কেটে শেষ পর্যন্ত ‘তসর’ শব্দে আমাদের মনে তসরের একটা খসখস শব্দ অনুরণন জাগিয়ে তোলেন। আলো-অন্ধকারে ‘ঘন নীল ন্যাপকিন কোলে’ বর্ণনা করে রঙের খেলায় নিমগ্ন কবির মনে একটি আত্মীয় রং ধরা দেয়, যা অতি স্বাভাবিক আবার অদ্ভুতুড়ে বটে! লোক দুটোর প্রাথমিক পরিচয় জানা গেল পর্যটক তাদের সামুদ্রিক মাছের কাঁটা ছাড়ানোর অন্তরালবর্তী কথার প্রগলভতায়। এসবই কিন্তু কবির ধারণা থেকে জন্ম নিচ্ছে ধীরে ধীরে, যা প্রত্যক্ষভাবে বাস্তব। বেড়ানোর স্থান নির্ধারণে যেতেই আমরা সম্মুখীন হচ্ছি নব্য-বাস্তবতার যেখানে হরিণ, ডোরাকাটা বাঘ আর পাহাড়ের স্তন যুক্ত হয় যার নাভি ফেটে বেরিয়ে আসে জলপ্রপাত। আশ্চর্য একটা পরাবাস্তববাদের সম্মুখীন হয়ে গেলাম আমরা। বাস্তবে বেড়ালের ধৈর্যসীমাও আমাদের ঘামাতে থাকে। এখানেই কবিতাটি শেষ করা যেত। কবিও মনে করেছিলেন। ‘উঠে যাব কলম বন্ধ করে? ভেতরটা না-না করে ওঠে। লেখা শুধু লেখা তো নয়, লেখকের কাছে কখনো তা খেলাও বটে – স্কোয়াশের চত্বরে বল পাঠিয়ে বল পেটানোর মত, বল একবার ফিরে এলে র‌্যাকেটসহ হাত উঠে আসবেই ফিরে চাপ মারবার মজায়। তা’হলে দেখাই যাক না নাটকের ওপর আমিই বা কোন নাটকীয়তার চাপাত দিতে পারি।’ কবিতাটির সময়কালে প্রায় প্রতিদিন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছিল। লোডশেডিংয়ের অসহনীয় কাল যাপনের কথা চিন্তা করে কবির করোটিতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটতেই অন্য এক শিহরণ খেলে গেল, ‘আলোতে আমরা এক প্রকার, অন্ধকারে আরেক প্রকার, আলোতে আমরা যা আচ্ছাদিত করে রাখি, অন্ধকারে তা একটানে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।’ অবাক হয়ে দেখি অন্ধকার সব মায়াবী জাল, সব কুহকের অবসান ঘটিয়ে লোক দুটির আসল পরিচয় উন্মোচন করে দিলো। ‘ভ্রমণ যে এতক্ষণ ছিল শুধু কথার চাতুরি সে কথা বেড়াল জানে, জেনেছিল টেবিলের ছুরি।’ বেড়ালকে বিদায় করতে চেয়েছিলেন কবি একবার, কিন্তু বেড়াল নিষ্ক্রান্ত হয়নি কখনো। ‘বিদ্যুৎ চলে যাওয়া, অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়া, বেড়ালের টেবিলে লাফ ও মাছের প্রতি থাবা বিস্তারের ফলে ছুরি ডিশ পোর্সিলিনের ঝন ঝন শব্দের সাহায্যে অভিনয়টা ভেঙ্গে দিই।’

পুরো ঘটনাটা যেন ম্যাজিক-রিয়ালিজম। কবি লোক দুটির অভিনয় ভেঙে দিতেই পাঠক আবিষ্কার করে তাদের একজন কবি, আর-একজন কবিতা ক্রিটিক। তিনি সমালোচক শব্দটি লেখেননি। কেন? কবির উত্তর এই রকম, ‘সমালোচক না বলে ক্রিটিক লিখলাম – ‘সঠিক’, ‘অধিক’, ‘নাগরিক’-এর সঙ্গে মিল দেবার জন্য নয়, মিলটা সুখ-আকস্মিক, আমি একে প্রয়োগ করেছি ‘ক্রিটিক’ শব্দটি বাঙ্গালীজনের বাগধারায় যে তিরস্কার ও সমালোচনা নিয়ে ব্যবহৃত হয় ফলে এটি আর ইংরেজি শব্দ থাকে না, বাংলা শব্দই হয়ে যায় – সেই অভিধায়।’

চার

যেমন আশ্চর্য মেধা ও ব্যক্তিত্বময় পুরুষ ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, তেমনি পরোপকারের চেষ্টাও তাঁর চরিত্রে নিহিত ছিল, যা তিনি সজ্ঞানে করতেন এবং কেউ তা মনে করিয়ে দিলে সজ্ঞানেই এড়িয়ে চলতেন। এই পরোপকার তাঁর নিজস্ব সংসারের একাধিক সহোদর-সহোদরার ও সেই সঙ্গে স্ত্রীর পিতৃগৃহে পিতার মৃত্যুর পর একাধিক শ্যালক-শ্যালিকার লালন-পালনে সীমাবদ্ধ সংগতির অধিক অন্যের বেলায়ও প্রযোজ্য ছিল। লেখার নিয়মিত অভ্যাস ও বহুবিধ বহুমাত্রিক লেখনীর চারিত্র্য নিয়ে যেমন আপসহীন ছিলেন, তেমনি বিশ্বসংসারের কর্মযোগী মানুষ হিসেবেও ছিলেন আপসহীন।

হকভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ ও আলাপ ১৯৬৭ সালের কোনো এক সময়ে যখন স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে কিংবা পরীক্ষা পাশের পর বেকার থাকলেও বসে নেই। বসে নেই এ-কারণে যে, আমি তখন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী রূপে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। দেশের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ তদানীন্তন পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ, দেশের প্রখ্যাত সংগীতবেত্তা, রবীন্দ্রসংগীতের দিকপাল শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হকের হাত ধরে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা আনোয়ারুল হক খান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। তবে চলচ্চিত্র সংসদের প্রাণপুরুষ ছিল একজন একনিষ্ঠ চলচ্চিত্রবেত্তা মুহাম্মদ খসরু। কবি শামসুর রাহমান ছিলেন প্রথম থেকেই আমাদের চলচ্চিত্র সংসদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যিনি নিয়মিত সংসদের চলচ্চিত্র দেখার ব্যাপারে অতি আগ্রহী ছিলেন। কবি শামসুর রাহমানকে আগে থেকেই চিনতাম। বাষট্টির গোড়ার দিকে তাঁর রৌদ্র করোটি বের হওয়ার সময় বোধকরি কবি হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন দৈনিক বাংলার দফতরে। আমার চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহ ও সংসদকর্মী হওয়ায় কবি শামসুর রাহমান আমার একটা চাকরির সংস্থান করে দেওয়ার জন্য একটা পত্র দিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের কাছে পাঠালেন। তিনি তখন মনুভাইয়ের অফিস (সচিত্র সন্ধানীখ্যাত গাজী শাহাবুদ্দিন) পুরানা পল্টনে চিত্রিতা নামে একটি বিনোদনমূলক পত্রিকার সম্পাদক রূপে নিচতলায় বসতেন। চিত্রিতা আসলে ছিল সেই সময়ের বামপন্থি রাজনীতিক লায়লা সামাদের পত্রিকা। আমি পত্রটি সৈয়দ শামসুল হকের হাতে দিতেই তিনি বললেন, ‘আরে তোমাকে তো আমি নামেই চিনি। কতদিন এনায়েতকে বলেছি তোমাকে চিত্রালী অফিসে নিয়ে আসতে।’ আমি কাঁচুমাচু করতে লাগলাম এবং অবাক হলাম চিত্রালীতে প্রকাশিত সস্তা প্রেমের গল্প লেখক হিসেবে তিনি আমাকে চিনে ফেললেন। আসলে আমি নিজে ডাকযোগে চিত্রালীতে ১৯৬৪-৬৫ সালে গল্প পাঠাতাম, নেহাত নিজের পকেট খরচ জোগাড় করতে। এনায়েতভাই আর্ট কলেজের একজন সিনিয়র ছাত্র, চিত্রালীর অংকনশিল্পী ছিলেন এবং আমার পূর্বপরিচিতদের একজন। একবার আমার একটা গল্পের ইলাস্ট্রেশন দেখলাম এনায়েতভাইয়ের স্থলে কাইয়ুম চৌধুরী করেছেন। গল্পটির নাম ‘একটি অনুভূতির জন্ম’ এখনো মনে আছে, এত বড় একজন শিল্পী আমার গল্পের ইলাস্ট্রেশনটা কেন করলেন, এনায়েতভাইকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, কাইয়ুমভাই আমাদের দফতরে বেড়াতে এসেছিলেন। হকভাই তখন আমার গল্পটি মনোনীত করে কাইয়ুমভাইকে পড়তে দিয়েছিলেন আর কাইয়ুমভাই গল্পটি এতই পছন্দ করলেন যে, তাৎক্ষণিক নিজে থেকে গল্পের শিরোনামসহ অংকন করলেন। আমি তখন দ্বিতীয়/ তৃতীয় বর্ষের অনার্সের ছাত্র ও সামান্য কবি ও গল্পলেখক রূপে সেদিন ওই দুই কৃতী পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হই। যাক মূলকথায় আসি, হকভাই আমাকে চেনা সত্ত্বেও চাকরি দিতে পারবেন না বলে ড্রয়ার থেকে চারপাতার একটি ইংরেজি নিবন্ধ আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘দুই দিন পরে এর ভাবানুবাদ দিতে হবে।’ দেখলাম বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ‘অরসন ওয়েলস’-এর একটা লেখা। আমি দুদিন নয়, পরের দিন তাঁর হাতে ভাবানুবাদ দিতেই তিনি তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে নগদ পঞ্চাশ টাকা দিলেন। চিত্রালীর লেখা প্রতিটি গল্পের জন্য আমি পঁচিশ টাকা পেতাম, যা মধ্যষাটে কল্পনাহীন এবং ওই টাকাগুলো আমাকে নানাভাবে জীবনধারণে সাহায্য করেছে। কেননা আমার পিতা তখন শয্যাগ্রস্ত এবং সরকারি চাকরিতে দীর্ঘকাল অনুপস্থিতির জন্য নিয়ম অনুযায়ী অর্ধেক বেতন পেতেন। হকভাই আমাকে বলেছিলেন, চিত্রালীতে যদি সেই সময়ে দেখা করতে হয়তো একটা খ-কালীন চাকরি দেওয়া সম্ভব হতো, যা তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার কোনো ব্যাঘাত ঘটাত না। আসলে তাই, আমাদের অনেকে তখন পত্রিকা অফিসে শিক্ষানবিস হিসেবে ঢুকে সাব-এডিটরের চাকরি করার পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল এবং এ-মুহূর্তে আমার সতীর্থ বন্ধু গোলাম সারওয়ার, আ.ন.ম. গোলাম মোস্তফা ও শহীদুর রহমানের কথা মনে পড়ছে। শেষোক্ত দুজন অকাল প্রয়াত এবং তার মধ্যে আ.ন.ম. গোলাম মোস্তফা স্বাধীনতার ঊষালগ্নে আলবদর-রাজকারের হাতে শহিদ। গোলাম সারওয়ার একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক, এখন সমকালের সম্পাদক। চিত্রিতার জন্য ‘অরসন ওয়েলস’ জাতীয় এমনি অনেক বিশ্ব চলচ্চিত্রের খ্যাতিমানদের নিয়ে একাধিক লেখা অনুবাদ করে আমি বেশ ভালো আনুতোষিক পেয়েছিলাম, যা আমাকে অর্থহীনতার হীনতা থেকে রক্ষা করেছে। হকভাইয়ের কাছে এসব কথা মনে করিয়ে দিলে, তিনি খেপে যেতেন এবং বলতেন, চুপ। অথচ কোনোদিন তাঁর নিজের অর্থহীনতার কথা কাউকে বুঝতে দিতেন না। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে, বিজ্ঞাপনের অনেক তুখোড় সেস্নাগান লিখে তিনি এই অর্থহীনতা থেকে বাঁচতে চাইতেন। এসবই তাঁর আশির দশকের দিকের ঘটনা। বিবিসির বিত্ত অনেক আগে ফুরিয়েছে। সব্যসাচী লেখক হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন রাতারাতি, কিন্তু একজন সার্বক্ষণিক লেখক হিসেবে জীবন বেছে নিয়ে যশোত্তম পর্যায়ে পৌঁছেও তাঁর আর্থিক লাভ তেমন হয়নি যতটা হওয়া উচিত ছিল। অন্যের নামে প্রচারিত একটি তুখোড় সেস্নাগানের জন্য তিনি ষাট হাজার টাকা পেয়েছিলেন মাত্র, অথচ তাঁকে দেওয়ার কথা ছিল এক লাখ টাকা। আমি ছাড়া এ-কাহিনি হয়তো তাঁর খুব নিকটজনের দু-একজন জানতে পারেন সম্ভবত।

বছর কয়েক আগে কলকাতায় আমার স্ত্রীর চিকিৎসাশেষে নেতাজি বিমানবন্দরে ঢাকা ফেরার জন্য পৌঁছে দেখি হকভাই আর ভাবি বসে আছেন। ভাবির সঙ্গে আমার দু-একটি অনুষ্ঠানে কদাচিৎ দেখা হয়েছে, তেমন আলাপ নেই যদিও তাঁর ভাই শিল্পী কাফিল অসুস্থ হলে একবার হকভাইয়ের বনানীর বাড়িতে আমি ও আমার স্ত্রী দেখতে গিয়েছিলাম। হকভাই বিমানবন্দরে আমাকে ভাবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এভাবে, ‘ও কিন্তু ষাটের একজন প্রধান কবি, মাঝখানে দশ বছর লেখেনি।’ কি আশ্চর্য, আমি যে ১৯৭২ থেকে ১৯৮১-৮২ পর্যন্ত লিখিনি, এ-কথা স্পষ্ট মনে রাখলেন কী করে? আমাদের একটি বেসরকারি বিমানের ফ্লাইট বিলম্বিত হতে হতে দুই-তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। হকভাই আর আমি হাঁটছি, কথা বলছি সেই পুরনো দিনের কথা। তিনি চিত্রনাট্য লিখছেন, চলচ্চিত্রের জন্য অসাধারণ গান লিখছেন, এমনই গান যেগুলো তাঁকে গীতিকার হিসেবে চিরদিন স্মরণ্য করে রাখবে – সেসব পুরনো দিনের কথা। তারপর ফির মিলেঙ্গে হাম দুনো এই চিত্রনির্মাণের আজব প্রেক্ষাপট বললেন। ভাবি ওইদিকে একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার স্ত্রীর খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং ‘অ্যাপোলাস্টিক অ্যানেমিয়া’ নিয়ে বিশদ আলোচনা করছেন এবং কলকাতা এসে তা কীভাবে নিরাময় হলো, বিস্ময় প্রকাশ করছেন। এর মধ্যে খবর এলো সন্ধ্যা নাগাদ দুবাই থেকে একটা এয়ারবাস আসবে, যা সরাসরি চট্টগ্রাম যাবে এবং সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের বাঙালি ভাইবোনদের নামিয়ে আমাদের ঢাকায় নামাবে। হকভাই এতক্ষণ বসে থাকতে রাজি নন। বেসরকারি বিমানটির ম্যানেজার ও বাংলাদেশ বিমানের স্টেশন ম্যানেজার দুজনে মিলে দুটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারওয়েজের ঢাকাগামী একটা পেস্ননে হকভাই ও ভাবিকে উঠিয়ে দিলো। হকভাই আমাকে বললেন, ‘ফির মিলেঙ্গে হাম দুনো’।

পাঁচ

কলকাতায় নেতাজি বিমানবন্দরে জিন্স আর জিন্সের হাফ-জ্যাকেট পরা সটান হেঁটে যাওয়া আপনাকে দেখে আমার স্ত্রী বলেছিল, হকভাই এখনো সটান হাঁটেন, অথচ তুমি কেমন কুঁজো হয়ে যাচ্ছ।  ভাবি বলেছিলেন, ‘ওদের ওটা বংশগত শারীরিক গঠন, সোজা হয়ে হাঁটে, খুবই চমৎকার।’ এই তো সেদিন আশিতম জন্মদিনেও ছিলেন কেমন প্রগলভ। দরাজ কণ্ঠ। কিন্তু কবি রফিক আজাদের মৃত্যুর দিনে বাংলা একাডেমির বটতলার মঞ্চে আপনার হাতে যখন হাত রাখি; হাতটা বড় শীতল আর নরম মনে হয়েছিল। হয়তো রফিকের মৃত্যু আপনাকে ভঙ্গুর করেছিল। তাঁর দু-মাস পরই শুনলাম, আপনি জরাগ্রস্ত, লন্ডনে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। আমি তখন অস্ট্রেলিয়ায় আর অস্ট্রেলিয়ায় থাকতেই আপনার তিরোধানের খবর এলো। পরানের গহীন ভিতর আমার মেয়ের টেবিলে তখন শোকে মুহ্যমান। আমি লিখলাম আপনার জন্য এলিজি। আমাদের কষ্ট দিন। আপনি শামিত্মতে থাকুন।

 

এলিজি : সব্যসাচীর জন্য

ক.

মধ্য-পৌষের সন্ধ্যায় খোলা আকাশের নিচে

বসেছিলো উৎসব তোমার জন্মদিনের

কবিতা পরিষদের কবিরা ছাড়াও ছিলো

অনেক শুভার্থী যারা শুনবে তোমার কথা

কোমল-কঠিন, প্রিয় বাংলাদেশের কালপঞ্জী

অশীতি বর্ষের যেন এক পদযাত্রার শুমারি।

 

তোমার দীর্ঘ-ভাষণে উঠে আসে দেশ-কাল

মানব যাত্রার নানা বর্ণময় দিনের কাহিনী

হাজার দশ-শব্দের কলরোলে কাঁপে শাহবাগ

জলদ গম্ভীর স্বরে জাগাও বাংলার ইতিহাস

গৌরবময় যুদ্ধের দিনগুলি বিপন্ন মানুষ

দশ-হাজার শব্দরা খুঁজে নেয় বাংলার মৃত্তিকা

স্নেহজল সুবাতাস পিতৃপুরুষের ভালোবাসা

তোমার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে খরস্রোতা হয়

তেরশত নদী, কলকল করে আধাকোশা

নামের অজ্ঞাতনামা নদীটি, যে ছিলো শুধু

তোমার বুকের মধ্যে, জলেশ্বরীর মতোন

মনোভূমি স্বচ্ছ হয় দিগন্তের কোল জুড়ে

যা কিনা রামের জন্মভূমি অযোধ্যার চেয়ে

সত্য জেনেছ, অদ্যপি আজন্ম ভালোবাসায়

কণ্ঠ ছিঁড়ে বের হয়ে আসে জয়তু জলেশ্বরীর জয়।

 

ফুলের শুভেচ্ছা ডালি সাজায়ে মঞ্চের পরে

সবার আনন্দে নুয়ে পড়ে তামাম আকাশ

করতালি দেয় কতজন রাখে হাত হাতের পরে

যদিও নামেনি হিম আর পৌষের বাতাস

দোহাই থামুন সবে কবিকে বলতে দিন

ফুলের বেসাতি করে এনেছেন শুধু ফুল

জীবনে উড়ায়া করে যিনি মৃত্যু অমলিন

তাকে কি মানায় ফুল রজনী-গন্ধা বকুল

তাই তো এনেছি সঙ্গে কবিতা জন্মদিনের

একখানি পদ্য লয়ে ‘জেগে আছি’ এগোবার

কত শুক-সারি বক শালিক হাজারো রকমের

কবিকে ঘিরেছে ধরে ধনেশ ডাহুক বেশুমার

নদীর সোপানে শুনি আচানক পরীদের স্বর

জল কাঁপে ছায়া কাঁপে পরানের গহীন ভিতর।  r