নয়ন আর নয়নতারা

তিলোত্তমা মজুমদার

কনের সাজে পৃথিবীর সব মেয়েকেই নাকি সুন্দর দেখায়। আমাকে? আমাকে কেমন লাগছে? ঘোর অমানিশা রঙের শাড়ি পরেছি আমি। তাতে তারার চুমকি। আমার হাত দুটি দেখাচ্ছে মৃত মানুষের মতো ফ্যাকাশে। আমার মুখ দেখতে চাই আমি। এখুনি। এ-মুহূর্তে। শহরের সেরা কনে সাজিয়ের হাতে আজ গড়ে উঠেছি আমি। আমাকে বানাতে সে নিয়েছে ২৫ হাজার টাকা। কৌশিক, আমি আমার মুখ দেখব। কতটা ফ্যাকাশে দেখব। কতটা মৃত দেখব। দেখব আমি কাঁদলে চোখ থেকে জল পড়ে, না রক্ত!

‘এই নে, এই নে!’ কৌশিক এগিয়ে দিলো একটি আত্মহত্যার আগে লিখিত চিরকুট।

‘এ কী! এসব কী! আমি তো একটা আয়না চেয়েছিলাম। আজ আমার বিয়ে কৌশিক। আজ আমাকে এসব দিস না।’

‘সুইসাইড নোটের চেয়ে ভালো আয়না আর কী হতে পারে? তুই ওটা দ্যাখ রে আমার বকুল-পারুল। আমার চম্পা-চামেলিকা। আমার জবা-জুঁই। আমার ময়নামতি।’

‘না-আ-আ। আমি দেখব না। আমি দেখতে চাই না। আমি আয়না চাই। দর্পণ। দর্পণে বিম্বিত মুখ। দর্পণে বিম্বিত মুখ।’

‘তোর খোঁপায় তারার ফুল। তোর বুকে চাঁদের মালা। তোর কানের নরম দুই লতিতে পারিজাতের দুল। আমার নয়নতারা। আমি যাই। তোর বর আসবে এখনি। নিয়ে যাবে তখনি। আমি আমন্ত্রিত অতিথিদের নুন-পানি দিই।’

‘যাস না কৌশিক। আমায় আয়না না দিয়ে যাস না। তুই যাস না কৌশিক। যাস না।’

ওহ্! কী ভয়ংকর ঝলক! কৌশিক কোথায় মিলিয়ে গেল! এত দুলছে কেন? সবকিছু এত দুলছে কেন! আমি একটা বন্ধ ঘরে ছিলাম। জানালাগুলো খুলে গেল এক লহমায়। কী হাওয়া! আমাকে উড়িয়ে নিল। আছড়ে ফেলল। আবার ওড়াল। কী অাঁকড়ে ধরব আমি? কাকে ধরব। কে আছে আমার? ভয়ে কার বুকে মুখ লুকোব আমি? দুঃখে কার কোলে শুয়ে কাঁদব? কার জন্য, বলো, কার জন্য দুর্জয় সাহস আর অপরিসীম শক্তিতে আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব সেই উড়ন্ত বাজপাখির ডানা, যার শক্ত বাঁকা ঠোঁটে ঝুলতে ঝুলতে চলে যাচ্ছে আমার – আমার – কী আমার? কী?

‘কৌশিক!’

ওহ্! এত হাওয়া কেন? এত ঝড় কেন? পাশের ফ্ল্যাটবাড়িটা দেখো, হাওয়ায় দুলছে যেন কাপড়ে তৈরি। ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে ওর দেয়াল। ভেঙে পড়ছে। ভেঙে পড়ছে! নাকি ছিঁড়ে যাচ্ছে! খসে পড়ছে চাঙড়! খসে পড়ছে ইট। শিরা ও ধমনীর মতো দুমড়ে জড়িয়ে যাচ্ছে পয়ঃপ্রণালি! নীল, ঘন নীল! লাল লাল লাল টকটকে জল। ওই কি আমার হৃদয়? পাশের ফ্ল্যাটবাড়িটা? ভেঙে পড়ছে, ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়? আমার হৃদয়ে এত চেয়ার-টেবিল ছিল? এত ছোট বাচ্চা, ধোলাই যন্ত্র, সাজের সরঞ্জাম, এত হাতা খুন্তি কড়াই চামচ হাঁড়ি, এত শাড়ি, এত সু্ন্দর সব মেয়ে – যারা শুধু ডাঁটাচ্চচড়ি মাংস চাটনি রেঁধে আর এঁটো সাফ করে দিন কাটায় – এত ছিল তারা? এত হাফ পেন্টুল, এত মহুয়া ফল, এত            আফটার-শেভ লোশন, এত কিশোর তরুণ যুবা? যুবা! ওই তো! ওই তো খসে পড়ছে ফাটল বেয়ে। ও তো… ও তো… কে কোথায় আছ গো! বাঁচাও!

‘খুব হয়েছে। তোমাকে আর পাশের বাড়ি দেখতে হবে না। তুমি শিককাবাব বানাও। সরকারি সাহায্য আসবে। আর শোনো, ঋত্বিক যত ভালোই নাচুক, তুমি দেখবে না, তুমি চোখ বুজে থাকবে। কারণ ও পরপুরুষ!’

আ-আ-আঃ! কী খল সব! কী স্বার্থপর! এসব লোকের সঙ্গে আমি থাকি! এক টেবিলে খাই। এক বিছানায় শুই। এক আলমারিতে রাখি আমার পোশাক, ওয়াক থুঃ! স্বার্থপরের দল। পাশের বাড়ির বিপন্নতায় উদ্ধারকর্মে হাত লাগাবে, তা নয়, দেখছে নিজের বাড়ির স্তম্ভ আর খিলানে কোনো ফাটল ধরল কিনা! চাকুম-চুকুম করে শিককাবাব খাবে। বলবে, প্রাণীহত্যা মহাপাপ আর মাদি ঘোড়ার ছাল ছাড়াবে। জানালা গলে পড়ে যাচ্ছিল শিশুরা, আমরা হাত বাড়িয়ে ওদের ধরতে পারতাম না? এত লম্বা সব হাত! ওই মৃত মেয়েদের বুকের ওপর ঘুরঘুর করছে যে জ্যান্ত পিঁপড়ের দল, আরশোলা শুঁড় নাড়াচ্ছে যোনিতে – সেসব তাড়িয়ে দিতে পারতাম না আমরা? টবের বাগান থেকে দুটি বেলফুল যদি দিতাম ওদের কবরে? বেলফুলের মালা গেঁথে বেশ্যালয়ে যাবে, তবু দেবে না একটা ফুল।

আমি থাকব না। আমি চলে যাব। ওগো তোমরা আমাকে যেতে দাও। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোমাদের পায়ে পড়ি। যেতে দাও। দরজা খোলো। দরজা খোলো।

চো-ও-ও-প!

পেট্রোলের কি দাম! যানচলাচল স্তব্ধ প্রতিবাদে।

গ্যাসের কি দাম! ঘরে ঘরে অরন্ধন। আর আমি পেট্রোলে পুড়ছি।

গ্যাস খুলে রেখেছিল। দিয়াশলাই জ্বেলেছি আর দাউদাউ জ্বলেছে আমার চিতা।

কী সহজ! কী সহজ আমার ছাইভস্ম গিলে ফেলা!

কী সহজ, আমার শরীরের গনগনে লাল আঙরায় শীতের রাতে গা হাত পা সেঁকে নেওয়া কি সহজ!

আমাকে কেটে কেটে সেঁকছে আর মহোল্লাসে খাচ্ছে গূঢ় মাংসের কাবাব।

কী সহজ সঙ্গমের পর আমার ন্যাংটো উদোম শরীরকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে আমার বর। আমার পাপ ধুচ্ছে!

‘ওগো, মেরো না। আমাকে মেরো না।’

‘কেন তুই বলিসনি তুই বোবা?’

‘কেমন করে বলব? আমি পারব না।’

‘বল বল।’

‘না।’

‘বল।’

‘না।’

‘জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব তোর। তোর পাছায় লাথি মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াব তোর বুক।’

‘আমি শান্তিনিকেতন যাব। আমাকে ছেড়ে দাও।’

আমার পেটে লাথি পড়ল, আমি গর্ভ হারালাম।

যে শিল-নোড়ায় মশলা বেটে ওদের সুক্তো রেঁধে খাইয়েছি, তাই দিয়ে থেঁতলে দিলো আমার মুখ, যাতে আমাকে চিনতে পারা না যায়।

কৌশিক! কৌশিক রে! আমাকে একটা আয়না দে। আমি মুখ দেখব। আমি মুখ দেখব। কৌশিক।

‘তোমরা আইনকে ভয় করো না?’

‘আমরা আইন ক্রয় করেছি।’

‘পাপকে ডরাও না?’

‘পাপী তুই। তোকে বিয়ে করেছি। কেন তুই বলবি না?’

‘ঈশ্বরের অভিশাপকে ভয় পাও না তোমরা?’

‘হাঃ। ঈশ্বর! তাকে জরি-দেওয়া ঝলমলে পোশাক পরালেই খুশ!’

‘প্রতিহিংসার আগুনে তুমি মরবে একদিন।’

‘আগে তুই মর নির্লজ্জ মেয়েছেলে।’

চাবুক মেরে শান্ত হয় না। শিকলে বেঁধে খুশি হয় না। ঘরে বন্ধ রেখে নিশ্চিন্ত হতে পারে না কেউ। আমার শ্যাম্পু করা চুলে বিজ্ঞাপনের মেয়ের মতো বিনুনি বেঁধে, আমি নিজেই তা বেয়ে বেয়ে পাহাড়চূড়ায় পৌঁছলাম। মেঘ আমার আগুন নিভিয়ে দিলো। বাতাস দিলো পোড়া সারানোর মলম। আপাদমস্তক মলম মেখে আমি এখন মলমপুতুল। আমাকে দেখলে কী বলবে কৌশিক? গান গাইবে – ও আ-মা-র মলমিয়া।

‘ম-য়-না-ম-তি-ই-ই-ই।’

‘কৌ-শি-ই-ই-ক।’

‘এই দ্যাখ আয়নায় সূর্য ধরেছি তোর জন্য।’

‘দে আমাকে।’

‘আয়। আয় এখানে।’

‘কোথায়? কৌশিক তুই কোথায়?’

‘খালের জলে ভেসে যাচ্ছি ময়নামতি। আমার কেয়া! আমার কচুরিপানার ফুল!’

আমি ছুটছি। ছুটে যাচ্ছি সোনাঝুরির পথে। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নয়ানজুলি। নয়নজলি। নয়নজল। ওই জলে ভেসে গিয়েছিল এক দুঃখী কিশোর। সে ছিল কার নয়নতারা। মরে ভেসে গিয়েছিল ছেলেটা। জেলেরা জাল ফেলে তাকে তুলল। আমরা ছুটে ছুটে মড়া দেখতে গেলাম। সেই মড়াকে ঘিরে ছিল সাদা গোলাপি লাল দুধে-আলতারঙা নয়নতারা ফুল। মরে গেলে সব মানুষকে একরকম লাগে। যেমন দোলের সময় রং মাখলে সব মানুষ একরকম। ফাঁসির পর কাসভ ওই মড়া ছেলের মুখ। দুটো টাকার জন্য খুন করতেও রাজি। দুটো টাকার জন্য খুন হতেও রাজি। দুটো টাকার জন্য কত অজস্র নয়নতারা ভেসে যাচ্ছে নয়ানজুলিতে। শত্রুমিত্র এক। মৃত্যুর রং এক। মৃত্যুর রূপ এক। মৃত্যুর গায়ে পচা দুর্গন্ধ ওয়াক্! মরতে মরতে বাঁচলে, মৃত্যুর মাঝে বাঁচলে, মরণ হয় পরম রমণীয়। রমণ আর মরণ। মরণ আর রমণ তার নয়নে নয়নতারা হতে চেয়েই তো আমি স্বয়ং মৃত্যু জন্মালাম!

আমি কার নয়নতারা?

একটা লাশ পাওয়া গেছে। গা পোড়া। মুখ থেঁতলানো। জিভ ছেঁড়া। ছেঁড়াখোঁড়া গর্ভের ফুল আর ভাঙা পিষ্ট তার কণ্ঠ!

মড়া পাওয়া গেছে! মড়া! দেখতে যাবি না? চল চল! এক রাক্ষসী মড়া গিলছে আর উগড়োচ্ছে। বলছে খাব না কেন? ও-ই তো আমার দাঁত জিভ পাকস্থলী। অন্ত্র থেকে পায়ু। ওই তো আমার সোনার বালা, হীরের দুল। ওই তো আমার জারদৌসি শাড়ির সাজে মহার্ঘ্য রেস্তোরাঁ।

ব্যস! মড়া চলল থলে হাতে ধনেপাতা বেগুন আর পাবদা মাছ কিনতে। মাংস কিনতে সেরটাক। মাংস জড়ানো শালপাতায়। শালপাতাটা জড়ানো ছিল এ-ফোর মাপের কাগজে। সে-কাগজে একটা আত্মহত্যার ঠিক আগে লেখা বয়ান। ব্যস! লোকটা পড়ল আর মরল!

‘কৌশিক! তুই এখানে!

‘এই নে। তোর আয়না।’

‘আবার সেই চিরকুট! কথা ছিল আয়নায় ধরা সূর্য দিবি তুই।’

‘আয় আমার সূর্যমুখী! আয় আমরা একসঙ্গে দেখি মড়ার মুখ! ময়নামতি আয়!’

‘কৌশিক, আমি কী করে পুড়লাম?’

‘আমাকে বললি না কেন মুখ ফুটে?’

‘কী করে আমি পুড়ে গেলাম কৌশিক?’

‘ওরা যা চাইছিল, দিলি না কেন? ওরা খুন করল তোকে। পুড়িয়ে মারল! আমার আপনজ্বালা ময়নামতি আর কতবার জ্বলবে?’

‘যা তোর জন্য, তা আর কাউকে কেমন কেন বলব?’

‘আমার সোনা! আমার আদরিণী। আমাকে বললি না কেন?’

‘যদি বলতাম আর সঙ্গে সঙ্গে ভুসভুস করে উবে যেতিস তুই! ফুল দেখিসনি? ফুটলেই শেষ। গন্ধদ্রব্য? মাখলেই শেষ!’

‘হায় রে বোকা! ফুটে শেষ হওয়ার মধ্যেই যে ফুলের সুখ।’

‘তুই কৌশিক, তুই?’

তুই বর পাতিয়ে পুড়লি। আমি বউ পাতিয়ে ঝাঁপ দিলাম।’

‘তারপর?’

‘এক এক নয়নের এক এক রকম তারা। চল, আমরা একসঙ্গে মুখ দেখি।’

‘এক এক নয়নের এক এক রকম তারা। চল, আমরা একসঙ্গে মুখ দেখি।’
আত্মহত্যার চিরকুট। সেই আমাদের সবচেয়ে দামি আয়না। বাজপাখিটা তাই তো নিয়ে যাচ্ছিল ছোঁ মেরে। পারে কখনো?