পটেশ্বরী

শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

 

 

\ ১ \

 

এপাশ থেকে ওপাশ হওয়াটাও সমস্যা হয়ে পড়েছে। বলতে গেলে নিরেট অন্ধকার থেকে আলো আর রঙের দিকে মুখ করার মতো।

কেউ কি এমন কথা বলেছে আগে যে, মৃত্যু হলো রঙের ছবির ওপর একটা কালো পর্দা পড়া? এই কথাটা অমৃতার এখন মনে হচেছ।

পাশ ফিরলেই অমৃতার মনে হচ্ছে, ওর শরীরের রোগটা এক রোগ থেকে অন্য রোগে বদলে যাচ্ছে। শরীর চুলোয় যাক, মনটা শান্ত হয় এমন একটা অসুখও নিশ্চিন্ত মনে উল্লেখ করা যাচ্ছে না কারো কাছে। সেদিন ইকবাল এসে

হঠাৎ যখন দরজায় টোকা দিলো, শরীরটা তখন একদম বেঁকে বসেছে, বিছানায় উঠে বসারও জো নেই। ও দরজা ঠেলে ঢুকে এসে বলল, এ কী হাল তোমার? এত ফ্যাকাশে লাগছে কেন?

ইকবাল এলো বলেই কিনা জানি না, চোখের সামনের ফিকে অন্ধকারটা আরেকটু ফিকে হলো যেন। কথা বলতে কষ্টই হচ্ছিল, কিন্তু বলতেই হচ্ছিল – স্যার আবদুল আর লেডি কাদিরের বাড়িতে পকোড়া খাওয়াই কাল হলো।

ইকবাল বলল, কেন, তাতে কী হলো?

বললাম, এই যে দেখছ। সেই থেকে ঘোর আমাশা।

ইকবাল বলল, ভিক্টর কী বলছে?

বললাম, ওষুধ দিয়েছে।

ইকবাল বলল, ও-ই বলেছে অ্যাকিউট ডিসেন্ট্রি!

শরীরের যা দশা, ‘হ্যাঁ’ বোঝাতে মাথাও ঝাঁকাতে পারলাম না। ও কিছু একটা ধারণা করে চলে গেল। ও দরজা ভেজাতেই আগের ফিকে অন্ধকারটা খানিকটা গাঢ় হয়ে ফিরে এলো।

রং আর অন্ধকারকে এখন দুটো আলাদা ছবির মতো মনে হয় অমৃতার। একটা প্রশ্নও তৈরি হয় সেই সঙ্গে। কেন একটা শবযাত্রা অাঁকার বাসনা হয়েছিল ওঁর? অাঁকাও হয়ে গেল সেই দৃশ্য রেখায়, তারপর শখ হলো তাতে রং চাপানোর? এ কি মৃত্যুকে কাছাকাছি পাওয়া? হাত দিয়ে ছোঁয়ার মতো কাছে? তুলি আর রং দিয়ে বাঁধার মতো কাছাকাছি। ভিক্টর তো মনে করেই ছিল, এর মধ্যে মৃত্যুর পূর্বাভাস আছে। কেন করেছিল ও?

অমৃতার নিজেরই বা কেন মনে হয়েছিল? দেহে জরা, মৃত্যুর কোনো ছাপ নেই, তবু কোথায় একটা তাড়া। কাজ শেষ করো, কাজ শেষ করো, দিন ফুরোলো বলে! এমনি-এমনিই এতকিছু মনে হওয়া?

জঠরে এক সন্তান ধারণের উপক্রম হয়েছিল কি? পারলে ভিক্টরই বলতে পারবে, কিন্তু ও আর কবে কী বলে? বিয়ের সময় আমরা যে-শর্ত করেছিলাম আমরা কেউই তা ভাঙতে চাইনি। আমরা বাচ্চা করব না, কেউ কারো জীবনে হস্তক্ষেপ করব না। অপূর্ব! অপূর্ব শর্ত! আমার পুরুষ বন্ধুরা আমার থাকবে, আমার যৌনজীবন স্বাধীন। আমাদের কিশোর-কিশোরীকালের প্রেম তাতে মাথা কুটে মরবে কি? হা-প্রেম! হা-কিশোরীকা-ল! হা-রং, তুলি, নারীদের ন্যুড!

ইকবাল সেদিন চলে যাওয়ার পর অমৃতা গায়ের নরম কম্বলটা সরিয়ে ১৯৩৩-এর ওই তৈলরং ছবির নগ্নিকার শোয়ার ভঙ্গিতে বিছানায় চিৎ হয়ে শুলো। ঘাড় একদিকে হেলিয়ে, ডান হাতটা শরীরের পাশে রেখে, বাঁ হাতের কনুই ভেঙে মাথার চুলের মধ্যে তালুর পিঠ ছুঁইয়ে রেখে। নগ্নিকার মতো চোখ দুটো বন্ধ করতে হলো না, বন্ধই ছিল। শুধু শরীরে পরা ছিল পরিধান। ওর ইচ্ছে হলো ভিক্টর এসে ওকে বিবস্ত্র করে ছবির ন্যুডের মতো করে দিলে আরাম হয়। মরে যাওয়াও তো এক অর্থে চিত্রার্পিত হওয়া। শীতল, নিথর, পূর্ণ।

প্রিয় ন্যুডটির মধ্যেও একটা নিদ্রার ভনিতা ছিল। এখন সেই ভনিতাকে এক চিরনিদ্রার ভনিতা মনে হলো অমৃতার। ও হাত দিয়ে গায়ের কাপড় একটু সরাল। অমনি দুটো চাপ বোধ করল শরীরে। প্রথমেই একটা হি-হি ঠান্ডার ভাব। তারিখটা যে ৫ ডিসেম্বর। আর তারপরেই একটা প্রচন্ড চাপ তলপেটে। ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রির উড়াল খটোলা এখন ভেসে বেড়াচ্ছে উদরের কন্দরে কন্দরে। ওকে বাথরুম যেতে হবে।

অমৃতা কি নিজেকে টেনে তুলতে পারল? নাকি জঠরের এক অতীত রহস্য আর মনের এক লুকোনো বেদনা ওকে স্মৃতির অতলে টেনে নিল। ক্রমশ তলিয়ে যাওয়া চেতনার মধ্যে ও একটা জাহাজের ভোঁ শুনতে পেল। ইতালীয় সমুদ্রতরী এমভি ভিক্টোরিয়া।

জাহাজে যেতে-যেতেই অমৃতা আবিষ্কার করেছিল যে, ও         অন্তঃসত্ত্বা। ও ছুটে গেল জাহাজের ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার তো অবাক! আপনি রওনা হওয়ার আগে টের পাননি? অমৃতার উত্তর ছিল, কিছু করতে পারলে করুন। অত কথায় কাজ কী?

ডাক্তার প্রথমে চুল, তারপর কান, তারপর নাক চুলকে বলেছিলেন, আপনি সন্তান প্রসব করতে চাইলে তার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু যদি…

অমৃতার আর তর সয়নি – হ্যাঁ, যদি ভ্রূণহত্যা…

– সেটাই সমস্যা। আইন আছে, জীবনের ঝুঁকি… বোঝেন তো।

সব বুঝি, আবার কিছুই বুঝি না। বলেই হন হন করে ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল অমৃতা। নিজের কেবিনে ফিরে জানালার বাইরে নীল সমুদ্রের দিকে চেয়ে বসে রইল। যে-নীল জলের ওপারে কোথাও নেপলস শহর। যেখানে ওর অপেক্ষায় দিন গুনছে হবু-বর ভিক্টর এগান।

দুজনে ওরা নেপলস থেকে জেনোয়া গেল। সেখানে পৌঁছে ট্রেন ধরল বুদাপেস্তের। যেখানে ওদের বিয়ে হবে।

বিয়ের আগে ভিক্টর জানেনি ওর নববধূ অন্তঃসত্ত্বা। তাতে ভালোই কষ্ট পেল বেচারা। যদিও বিয়ের প্রাক-শর্তই ছিল এই বন্ধনে কারোই স্বাধীনতা খর্ব হবে না। কষ্টটা ভিক্টরের বউ            অন্তঃসত্ত্বা হওয়াতে নয়, ওকে আগে না-জানানোয়। যাই হোক, পেট খালাসের কাজটা যাতে শীঘ্র ও নিরাপদে ঘটে তার ব্যবস্থাও করল।

পেটটা খুব মুছড়োচ্ছে অমৃতার। কিন্তু ওঠা, চলা বা বরকে ডাকার শক্তিই খুঁজে পাচ্ছে না। এটা কি জ্ঞান হারানোর আগের অবস্থা? যেমন অবস্থায় রং কিংবা অন্ধকার কিছুই দেখা যায় না। যখন শুধু চোখ নয়, মনও দেখে না। আর কিছু যখন দেখা যায় না, চোখে বা মনে, তা কি মৃত্যু? যাকে শুধু বাইরে থেকে অাঁকা যায়, ভেতর থেকে নয়। তাই কেউ নিজের মৃত্যু অাঁকে না, অন্তত ভেতর থেকে নয়।

তাহলে এত তাড়াতাড়ি আলো ও রং হারানোর কী প্রয়োজন? – ভাবল অমৃতা। তারপর জামা ঠিকঠাক করে, গায়ে ফের কম্বল ফেলে, আলো ও রঙের দিকে পাশ ফিরে শুলো।

একটা ভাবনা আসতে, অমৃতা বুঝল, ওর ঠোঁটে একটা সরু হাসি ভর করেছে। ভাবনাটা হলো, মৃত্যুকে ওপর থেকে, তলা থেকে, পাশ থেকে, সোজা বা তির্যক কোনোভাবেই দেখা সম্ভব নয়। কারণ মৃত্যু জ্ঞানহীন অন্ধকার। হ্যাঁ, ভেতর থেকে দেখা মৃত্যু। বাইরে থেকে দেখা মৃত্যু। অন্যের মৃত্যু দেখার জন্য একটু দূরত্ব, একটু আলো এবং একটা প্রেক্ষিত চাই। যেমন একটা দূরত্ব, আলো, রং ও প্রেক্ষিত নিয়ে কী অপূর্ব জীবন দেখা হলো শেষ অাঁকা ছবিটায়। নাম রাখা গেল ‘ছাদ থেকে’।

ওই ছবিতে পৌঁছানোর পর কেন এমন ঘোর অমানিশায় পড়তে হলো? আর কদিন বাদেই অত বড় প্রদর্শনী!

‘ছাদ থেকে’ এখনো শেষ হয়নি, গ্যালারিতে তোলার আগে আরেকটু কাজ বাকি। অনেক চেষ্টা করে, স্মৃতির শেষ বিন্দুগুলোকে ভর করে অমৃতা ঠেলে উঠল ‘ছাদ থেকে’ ছবির ছাদে। আর উঠে পড়তেই ওর সেই নির্ভার মনটাকে খুঁজে পেল। রং, আলো, দৃষ্টিকোণের কী মেশামিশি, ছড়াছড়ি! ওর মনে হলো, ও এখন উড়তেও পারে। তৎক্ষণাৎ মনকে শাসন করল অমৃতা – ডানায় ভর করলে চলবে না। মাটিতে পা ফেলে দ্যাখো, আলো আর রং কোথায় যায়। জীবনের ছবি কতটা জীবনের কাছে আসে।

অমৃতা চিৎ হয়ে শুলো। মনের সামনে ‘ছাদ থেকে’ মেলে ধরা। ছবির লাল দেখে নিজের আমাশার লাল রক্ত মনে এলো অমৃতার। প্রশ্ন জাগল : যে-লাল জীবন, যৌবন, ঠোঁট ও চুম্বনের রং তা কেন মৃত্যু বয়ে আনছে ওর? সত্যিই এ কি রক্ত আমাশার রং, নাকি জঠরের যে-জীবনটার মৃত্যু চায় ও এবং ভিক্টর সেই মৃত্যুর রং? নিজের শরীরের রক্ত দিয়েই কি সে-ভ্রূণ নিজের মৃত্যু অাঁকছে? অমৃতার গলা দিয়ে একটা যন্ত্রণার ধ্বনি বেরুলো – ওফ্! আর ফিরে এলো ছাদের দৃশ্য।

আহা, এই আমার লাহোর, লাহোরের বর্ষাতি, বর্ষাতির ছড়ানো ছাদ! চড়তে হলে গাঁটে লাগে বইকি! কিন্তু একবার চড়ে গেলে মানুষজনের সমাজ ও কলরব সব উবে যায়। ছাদের মাথা থেকে দেখা এই দৃশ্যটাই ছবি, যে-জন্য নাম দিলাম ‘ছাদ থেকে’। এই ছবির মজাটাই হলো গ্রাম আর শহরে বাসভূমির গলাগলি।

গত বছরটা কেটেছিল হাতি আর উট অাঁকায়, এবার ছবিতে কালো মোষ ধরে আনলাম। ওরা শান্ত, কিন্তু খেপলেও খেপতেও পারে।

ছবির বিষয়ে আহামরি ব্যাপার আছে কি মস্ত কিছু? এমন কি জানলা থেকে দেখার দৃষ্টিকোণে! অথচ দিশি মেজাজের দৃশ্যে যে-বিলিতি রকমসকম মেলে, এটা যে কী কান্ড তা আমি নিজের মুখে না বললেও কালে-কালে চর্চা হবেই। মনে হয় কার্ল ব্যাপারটা ধরতে পারবে, অন্যদের বোঝাতেও পারবে। পারলে ভালো, না পারলেও বয়েই গেল। জ্ঞানগম্যি থাকলেও ছবির অনেক ব্যাপারেই লোকজন বেশ গবেট। ছবিতে কী চাইছি তা যদি বলে-বলে মাথায় গলাতে হয় তাহলে আমি কিন্তু ক্ষ্যামা দিলাম। আমি বলদ অাঁকতে পারব, কিন্তু তাদের ক্লাস নিতে পারব না।

খুব খারাপ করে কথাটা বললাম কি? ওভাবে চাইনি কিন্তু বলা হয়ে গেল। আমার এরকমই হয়… চিরকাল। দশ বছর আগে ভিক্টরকে একটা চিঠিতে লিখেওছিলাম – তুমি বুঝতে পারো না যখন আমি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে যাই কিংবা বিশ্রী ঠাট্টা করি, তখন আসলে আমি খুব মুগ্ধ হয়ে আছি?

যাকগে, অন্য লোককে নিয়ে আমার কাজ নেই, আমার সময় চলে যাচ্ছে। ভিক্টর আমার চিকিচ্ছের কী দশা করেছে তা ওর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। আমি নিজেই যখন নিজের অবস্থার তল দেখছি না।

এই তো, দিব্যি এসে পড়ল কথাটা – তল। ‘ছাদ থেকে’তে তলের কী অতল মধুরিমা! আমার আগের সব কাজে আমি বিষয়কে দেখেছি মাটির স্তর থেকে। সোজাসুজি। বাঁধা দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রেক্ষিত নিয়ে চোখ ভাবেনি। যদিও জীবনের বেশির ভাগটা পাহাড়ে কাটালাম, কই ওই ওপর থেকে দেখা কোনো ছবি তো অাঁকলাম না কখনো! আশ্চর্য, খুবই আশ্চর্য!

আর আজ দ্যাখো মনে মনে ছাদে উঠে নিচে তাকাচ্ছি। ‘ছাদ থেকে’কে ভালো করে দেখতেও তল পেরোতে হচ্ছে। অথচ বিছানায় শুধু রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছি, একটু চলে বাথরুম যাওয়ার জায়গায় নেই। কী এক অতল যেন টানছে, কত নিচে দেহমন কেউই জানে না। আমার নিজের এমন একটা ছবি আঁকতে পারলে মন্দ হতো না। একটা ছবি এঁকেছিলাম না বছর দশ আগে! ‘লাল ফুল নিয়ে আত্মপ্রতিকৃতি’। এবারেরটা হতো ‘রক্তে ভাসা আমি’। নাকি ‘লাল রক্ত নগ্নিতা’? তাহলে এই শরীরের কষ্টটা ছবির বেদনায় ঢেকে দেওয়া যেত। যা আগেও করেছি। না বুঝে। এবার বুঝে। কারণ এখন মৃত্যুর পাশাপাশি শুয়ে মৃত্যুকে দেখছি। অন্য একজনের মৃত্যু হয়তো, যাকে আমি অমৃতা শের-গিল বলে ভাবছি।

ভাবছি কেন, ও তো সত্যিই অমৃতা। অমৃতা শের-গিল। যে ১৯৩০ সালে প্যারিসে নিজেকে এঁকেছিল ‘লাল পশ্চাদপটে আত্মপ্রতিকৃতি’তে। আমি সে-সময় দীর্ঘসময় ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, এটা আমি? অমৃতা আমাকে এভাবে আঁকল। ঠেট সর্দারনি যেন। কী অপরূপ মুখ আমার, আর শরীরটা বলিষ্ঠ, মাংস আর পেশিতে ভরভরন্ত। আমার শরীরের এই শক্তিটাকেই ও বার করে আনতে চাইল? কেন, আমার শরীর ও মুখের সেই কোমল চেহারাটাও আরো ছড়িয়ে দিতে পারত ছবিতে ছবিতে। যেমন একবার করেও বসল প্যারিসে। ইজেলের সামনে আমি, পিছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। কী একটা নরম, সহজ তাকানো। আমি তাকিয়ে আছি আপনমনে নিজের দিকে। ছবির রঙের ব্যবহারও ফরাসি। আমি বলি যে, এই সেলফ পোর্ট্রেট আর এর কিছুকাল পর, ১৯৩৪-এ, পল গোগ্যাঁর ছবির ঘোরে আঁকা ‘তাহিতীয় নারী হিসেবে আত্মপ্রতিকৃতি’তে আমার ওই আদুরে, লাজুক আর অভিমানী অমৃতাকে সহজে পেয়ে যাই। আমার যে-মনভোলানো স্তন আঁকতে পেরেছি ‘সেলফ পোর্ট্রেট অ্যাজ অ তাহিশিয়ানে’, ওই সৌন্দর্য বুঝতে আমাকে অমৃতার বাইরে এসে দাঁড়াতে হয়েছে। আমার সমস্ত অনুরাগ ও অনুভূতি দিয়ে অমৃতার নগ্ন, নির্জন ঊর্ধ্বাঙ্গ দেখে অনুভব করেছি যে, আমি অমৃতাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে এতটাই চাই যে, মনস্তত্ত্বে একে আত্মরতি বলে বর্ণনা করবে। এখন যখন মৃত্যুর পাশাপাশি শুয়ে হয় মৃত্যুর লাল, নয় মৃত্যুর গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে দুলছি আমি ও অমৃতা, আমি জানি না, কে কার মৃত্যুর সাক্ষী হচ্ছি।

আহা, এই আমার লাহোর! আর কদিন পর কত বড় প্রদর্শনী আমার! ঠিক এই সময় বিছানা নেওয়াটা একটা প্রহসনের মতো হয়ে পড়ছে। মিথ্যে বলা তো আসে না আমার, তবু ইকবালকে পকোড়ার গল্পটা ধরাতে হলো। আমার কোনো কথাকে ও অবিশ্বাস করে না, এই বয়ানটাও ও শেষ সত্য বলে মেনে নেবে। যদিও নিজেই আমি এখন বুঝতে পারছি না কোন সত্যটা আসলে সত্যি। জানি না ভিক্টর কাকে কোথায় কী বলছে, কিন্তু এত সব বয়ানের মধ্যে আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। রঙের মধ্যে রং মিশলেও কি ছবির সত্য এভাবে প্রতিফলিত, প্রতিবিম্বিত এবং প্রতিহত হয়?

আমার বড় ঘুম পাচ্ছে। পাছে লম্বা ঘুমিয়ে ফেলি তাই আর ঘুমোতে চাইছি না।

অমৃতা ‘ছাদ থেকে’ ছবির ছাদ থেকে নেমে এসে গায়ের কম্বলের দিকে নিজের জামার মধ্যে নিজের স্তনের ওপর হাত রাখল। আলতো চাপ দিলো সুডৌল, মসৃণ স্তনে এবং নিজেকে আশ্বস্ত করল, নাহ, আটাশ বছর বয়েসটা কোনো মরার বয়েস না। যতই কিনা তাড়া দিই; বয়েস গেল! বয়েস গেল!

আমার প্রদর্শনী এই এলো বলে। তবু এত দূর মনে হচ্ছে কেন? এই এখনই তো মনে হওয়া শুরু হয়নি। দিন পনেরো আগেই যখন কার্লকে চিঠি লিখে বললাম, সত্বর আমার একজিবিশনের ব্রোশিওরের জন্য একটা লেখা লিখে দাও, তখনই মনে হতে লাগল, কী জানি, বড্ড দেরিই করে ফেললাম! ও হয়তো লিখে দিতে পারবে না। নাকি, বিমানবাহিনীর চাকরির অজুহাত দেখিয়ে চাইবে না! যে-ঠিকানায় ওকে চিঠি দিচ্ছি সেখানেই ও এখন থাকে কিনা তাও তো জানি না। মানুষটা বেঁচে কি মরে, তাও কি জানি! লাহোরে এসে ওঠার পর প্রিয় কার্ল খন্ডেলওয়াল কী রকম হাতের বাইরে চলে গেল। হায়!

একে তো মেধাবী ছেলেটা পড়াশুনোর ব্যাপার-স্যাপার ছেড়ে এয়ারফোর্সে ঢুকে পড়ল। তাতে ওর নতুন উড়ান হলো ঠিকই, কিন্তু আমি হারালাম আমার সবচেয়ে বড় শিল্পবোদ্ধাকে। বাকি যেগুলো শিল্প-সমালোচক বলে চলে সেগুলো যে কী…

হাতের বাইরে চলে গেল কার্ল, তাই তো? ও যখন শেষবারের মতো চলে যাচ্ছে ট্রেনে করে ওকে যতক্ষণ দেখতে পেলাম প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ততক্ষণই হাত নেড়ে গেলাম। ভিক্টর একবার শুধু বলেছিল, চলো এবার যাই। সঙ্গে সঙ্গে কড়া স্বরে বলেছিলাম, না, থাকব।

যখন এটা বললাম তখনই কার্ল ওর কামরা খুঁজছিল। শেষে হাত নাড়তে নাড়তে যখন দেখছি ও দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, কেন জানি না একটা অভিমান হলো; সব ভালো কিছু আমার দূরে সরে যায় কেন? আর সব মানুষ যা চায়, আর শর্ত অনুসারে আমি বা ভিক্টর কেউই চাই না, তা ফিরে ফিরে আসে কেন?

বাড়ি ফিরতে-ফিরতে শরীরের ভাবটা টের পেল অমৃতা। ভিক্টরকে বলতে বর বলল, দেখতে হবে প্রেগন্যান্সি কিনা।

আবার প্রেগন্যান্সি! তার মানে আবার অ্যাবরশান! বিরক্তি আর অবাক হওয়া দুটোই মিশে ছিল অমৃতার প্রতিক্রিয়ায়। ভিক্টর সেই নিজের মতোই, নিরুত্তাপ ডাক্তার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের সেই ডাক্তারি নিষ্পৃহতায় বলল, দেখার আরেকটা জিনিসও আছে। পুরনো দিনের সেই যৌনরোগটাই ফিরল কিনা।

অমৃতা খুব দমতে লাগল এতগুলো খারাপ সম্ভাবনার কথা মাথায় এসে। লুডো খেলায় ঘর থেকে বেরুনোর দানে যেমন ছক্কার জায়গায় বারবার পুট পড়ে। আর পাকা হওয়ার মুহূর্তে যখন একটা পুট প্রয়োজন তখন দফায়-দফায় ছক্কা।

মনের ব্যথা আর শরীরের বেদনার টানাপড়েনে অমৃতা আর ঠাওরে উঠতে পারছে না শরীর থেকে কিছু একটা বার করার যন্ত্রণায় ও একটা ছক্কার দান চাইছে, না কোনো কিছু পাকা করার ব্রাহ্মমুহূর্তে একটা পুটের চাল। লুডোর খেলায় উলটো দিকে কে যে বসে ওর কোনো হদিসই নেই। ও নিজে না আমি অমৃতা।

স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে আমিই কি ভিক্টরকে বলেছিলাম যে, পেটের মধ্যে কেউ এসেছে? আর তাতে ও ধারণা করল আমি সন্তানসম্ভবা? এমনও ধারণা করল যে, আমার সেই প্রাচীন যৌনরোগটাই নতুন করে ফিরল।

নাকি আমিই গোপন করে গেলাম যে, আমি অন্তঃসত্ত্বা? আমার ছবির কল্পনা, জন্ম ও আঁকার মুহূর্তগুলো সম্পর্কে ওর যেমন কোনো খোঁজই থাকে না। কেবল আঁকা হয়ে যাওয়ারও বেশ পরে হঠাৎ একদিন চিত্রপটের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, বাহ্, দারুণ তো!

আমার তখন বেশ হাসিই পায়। এই তুমি অমৃতা শের-গিলের স্বামী! কোথায় আছো কিশোরীকালের নাগর আমার? কম যুদ্ধ করতে হলো শত শত প্রেমিকের ভিড়েও শুধু তোমার হাতটাই শক্ত করে ধরে থাকতে? প্রেমে তো আমিও পড়ে গেছিলাম বলে আশঙ্কা হয় জওহরলালের। কত যে চর্চা এখন তাই নিয়ে। কেমন একটা চাপা স্বরের গেল! গেল! রব। তখন কিন্তু তোমার-আমার বিয়ে তলে-তলে ঠিক। অথচ চর্চা হচ্ছে কংগ্রেসের জাতীয় নেতা কি অত কম বয়সীর…? হোক না পরমাসুন্দরী… হোক না দুর্ধর্ষ শিল্পী… হোক না অমৃতা শের-গিল।

তুমি কদ্দুর কী ভেবেছিলে জানি না। কতটুকু জানতে তাও জানি না। তবে আমার পেটে যে এবার বাচ্চা এসেছে, এই তো কদিন আগে, হয়তো তোমারই সন্তান, তাও তুমি টের পাওনি। খবরও রাখোনি যে, এখানকার এক হাতুড়ের কাছে গেছিলাম ভ্রূণহত্যা করাতে। তোমায় কিছু জানাইনি সবটাই গোপনে সারতে।

সর্বনাশটা করল ব্যাটা হাতুড়ে! খালাস করতে গিয়ে আমাকেই নিকেশ করে দিলো আর কি! আমার ভেতরটা ছিঁড়েফুঁড়ে একাকার করে ফেলল। শেষে সেই তোমাকেই হাল ধরতে হলো, যখন আমি ডুবছি… ডুবছি… ডুবছি…

তুমি আমাকে সামলেও দিলে। বললে, আমার বড় বিশ্রাম দরকার। কিন্তু হায়, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি! বুঝছি দোষ করেছিলাম পেটের কথা তোমায় না বলে – সত্যিই তো পেটের কথা! – তাতে প্রাণ বিসর্জন যাচ্ছিল, তবু তোমার মতো কম কথার ডাক্তারেরও একটাই পরামর্শ কানে নিলাম না। অত্যন্ত ভারি একটা ছবি নিজের হাতে তুলতে গিয়ে ভেতরটা ফের ফাটিয়ে চৌচির করে দিলাম। তুমি, প্রিয় বর, প্রিয় ডাক্তার, ভেতরের রক্তারক্তির যে-ঘটনাকে বলছ পেট্রোনাইটিস।

কিন্তু এসবের কোনোটাই যে সত্যি তা হলফ করে বলতে পারি না। ছবির যেমন একটাই অবিচল মানে হয় না, আমার এই করুণ দশার একটাই ধ্রুব কারণ হতে পারে না। আমার পেটে যে বাচ্চা এসেছিল এবং আমি যে তাকে ভ্রূণেই মারতে চেয়েছিলাম সে-কথা পৃথিবীর কাউকে না বলি অন্তত হেলেনকে বলতাম। জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ গোপন কথা ওর কাছে গোপন রাখিনি। কোন পুরুষের সঙ্গে কীভাবে মিশি, কতদূর যাই – আক্ষরিক অর্থেই – ওকে জানাতে কসুর করিনি। সেই হেলেনকেও বলিনি। তাহলে এর সবই কি এই শুয়ে-শুয়ে যন্ত্রণায় ও কল্পনায় গাঁথছি? শুনেছি মৃত্যুর মুখে মানুষ সিনেমার মতো নিজের গোটা জীবনটা দেখতে পায়। কিংবা জলে ডুবে যাওয়ার সময়। তাহলে আমি কেন দেখছি? মরছি বলে, না ডুবছি বলে?

তা বলে গোটা জীবনও তো দেখছি না। শুধু এই অসুখটাই দেখছি, যেন একটা গোটা জীবন। একটা অসুখ যে কত রঙে আর অন্ধকারে ধরা দিতে পারে তা-ই দেখছি এখন। অসুখটা যে কতখানি গোলমেলে তা ভিক্টরের মুখ দেখলেই বুঝতে পারি। থেকে-থেকে ভ্রূণহত্যাকারী ওই ডাক্তারের মুখের জায়গায় আমি ভিক্টরের মুখ দেখছি। তাহলে ও-ই কি সেই ডাক্তার, যার হাতে আমার প্রাণ যেতে বসেছিল?

সত্যি তো, আমি তো সেই হাতুড়ের মুখ কখনো দেখি না! শুধু ভিক্টরের মুখ! ডক্টর ভিক্টর এগান। দুর্বোধ্য রকম শান্ত ও গম্ভীর মুখের ডাক্তার। কখন কীভাবে অন্তঃসত্ত্বা হলাম ও জানতে পারেনি। অথচ ডাক্তার ডাকবে না লোক জানাজানির আশঙ্কায়। নিজেই যা করার করবে। আমার সুনামের প্রতি এত নজর, এত যত্ন!

তাহলে আমার এত বড় প্রদর্শনীর মুখে এসে এই কান্ডকারখানা কেন? কে-ই বা জানতে পারত আমি অন্তঃসত্ত্বা?

তাহলে… তাহলে ওই পকোড়ার গল্পটাই সত্যি? স্যার আব্দুল ও লেডি কাদিরের বাড়ির ওই পকোড়ার গল্প। আমার রক্ত আমাশার বৃত্তান্ত। আজ ইকবাল ফের আসবে। আসবেই। ও জানতে চাইবে আমাশার দশা। কী বলব? যা-ই বলি সত্যিই বলব, সত্যির তো কতই প্রকার। কিন্তু অন্যের কাছে মিথ্যে শোনাবে। অবাক হচ্ছি ভেবে একটা কথা। জীবন তো অফুরান সত্য ও অফুরান মিথ্যেয় পরিকীর্ণ এক বৃত্তান্ত। এখন দেখছি মৃত্যুও তাই। সত্য-মিথ্যেতে অন্ধকার। যে-কোনো জীবন, সব জীবন একেকটা গোয়েন্দা কাহিনি। কে জানে, হয়তো একটা ছবির মতোই। যে যেভাবে দেখে। বোঝে। বা বোঝে না।

অমৃতা এবার চিৎ হয়ে শুয়ে নিজের একটা নগ্নিকা মূর্তি দেখা শুরু করল। রঙের প্যালেট হাতে নিয়ে নিজের নগ্নিকা প্রতিকৃতি। কী মেজাজে আঁকা হয়েছিল আজ আর মনে পড়ে না। কেন যে অমন একটা আত্মপ্রতিকৃতি তারও কোনো কারণ খুঁজে পায় না ও। নিজেকে ভেঙেচুরে এহেন নগ্নদশায় কেন দেখতে চেয়েছিল তার কোনো ইঙ্গিত হয়তো জীবনে আছে, ছবির আকার-প্রকারে নেই। ’৩২ সালে প্যারিসে বসে আঁকা, শেষে নগ্নিকার কপাল থেকে নিচের ঠোঁট অবধি একটা রঙের প্রলেপ দেওয়া। এভাবে নিজেকে দেখতে পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল না তখন; যদিও আজকের এই বেহাল দশার সঙ্গে খুব মানিয়ে যাচ্ছে ওই ন্যুড। যা ওর আত্মপ্রতিকৃতি, কিন্তু যার মধ্যে ও নিজেকে দেখতে পায় না।

এর কিছুদিন আগেই প্যারিস থেকে ভিক্টরকে লেখা এক চিঠিতে বলছে অমৃতা : আমি আমার রূপকে উপভোগ করে যাব, কারণ এ তো খুব অল্প সময়ের জন্যই থাকবে। আর আনন্দ উপভোগই তো স্বল্পস্থায়ী। তবু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এই রূপ ছাড়াও আমার আরো কিছু দেখার বা বলার মতো আছে।

অমৃতার মন চলে যায় একেবারে প্রথম দিকের একটা তেলরঙে। ১৯৩০-এর ছবির নাম রেখেছিল ‘উপবিষ্ট নগ্নিতা’। আজ ওর মনে হচ্ছে, ওটাও এক আত্মপ্রতিকৃতি। মুখ এক ধারে ঘোরানো, যেন শিল্পী আর রঙ-তুলির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চায়। নিজের নগ্নতা ও নির্জনতায় ভরে আছে। কথা বলে যাচ্ছে শুধু ওই দৃপ্ত, উদ্ধত, যুবতী শরীর। যে-শরীর অন্য শরীর চায়।

কী রকম শরীর? বোজার আতেলিয়েতে সহপাঠী বোরিস তাজলিৎস্কির মতো? সুদর্শন, সুপুরুষ যে-বোরিসকে বারবার মডেল করে আঁকা হলো নানা ভঙ্গিমায়। শেষবার, ১৯৩২-এ, ওর হাতে টকটকে লাল আপেল। আঁকতে আঁকতে বলেও ছিল, ওহে আদম, জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাও। তোমার ইভ এই তো সামনে!

বোরিস হাসতে-হাসতে বলল, জ্ঞানের জন্য এত আপেল খেতে হবে? জ্ঞান হওয়ার হলে এক কামড়েই হবে।

এমন একটা ছেনালির কথা বললেও বোরিসকে সেদিন কিন্তু বড় সরল, সুন্দর লাগছিল। ফুলহাতা শাদা শার্ট, বাদামি ট্রাউজার্সে কেমন একটা লাজুক চেহারা নিয়ে বসেছিল। জামার তলে শক্তপোক্ত দেহ আর মুখের ওই নিষ্পাপ একটা ভাব ঢেউ তুলছিল অমৃতার মধ্যে। কিন্তু ছবিটা এত সুন্দর দাঁড়াচ্ছিল যে, ও আর অন্যদিকে মন সরাতে চাইল না।

ওই নিষ্পাপ মুখেই বোরিস টুক করে বলে ফেলল, একটু জ্ঞান হলে কি অনেক পাপ হয়ে পড়বে?

অমৃতা কথাটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিল, বলল, ইভকে নিয়ে সমস্যা নেই, আদমের জামা, শরীর আর মুখের ভাঁজগুলো ফিরিয়ে আনা মুশকিল হবে।

দেখতে-দেখতে আপেলের লালটাও যেন উঠে এলো ছবিতে ধরা বোরিসের ঠোঁটে আর গালে।

‘আপেল হাতে তরুণ’ ছবিটা ১৯৩৪-এ প্রদর্শিত হয়েছিল সাঁল দে তুইলেরিতে আর সেই প্রদর্শনী যুগের সেরা এক্সিবিশনের স্বীকৃতি পেল। প্রদর্শনীর এই ছবি নিয়েও দিব্যি তোলপাড়। হাতে আপেল পেয়ে আদমের মতো ইভকে পাওয়ার বাসনা জেগেছিল ইহুদি ছোকরা বোরিস তাজলিৎস্কির।

তাজলিৎস্কির জন্ম প্যারিসে, ১৯১১-এ। রাশিয়া ছেড়ে চলে এসে যেখানে দেখা ও বিয়ে ওর ইহুদি বাবা ও মায়ের। অমৃতার সঙ্গে সাক্ষাৎ ১৯৩০-এ বোজারে। সেই প্রথম দেখাটাও জীবনের সায়াহ্ন অবধি ভুলতে পারেনি বোরিস। বলেছে…

বোজারে আমি ছাত্র, যেখানে দেখা ওর সঙ্গে। যেদিন প্রথম ক্লাসে এলো অমনি গোটা ঘর নীরব হয়ে পড়ল, এমন এক উপস্থিতি ওর। আমি তখন সবে উনিশ, ও হয়তো সতেরো। অবাক হয়ে গেলাম ওই বয়সেই কী দারুণ আঁকে দেখে। আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম।

ও আমার তিনটে পোর্ট্রেট করেছিল, আর একটা আমার মায়েরও। পয়সার টানে পড়ে ছবিগুলো আমি বিক্রি করেছিলাম। ওরও তিনটে প্রতিকৃতি করেছি আমি। প্রায়ই তখন আমাদের বাড়িতে আসত। আর প্যারিসের বাইরে বেড়াতে গেলে ওর গ্রামোফোন আর রেকর্ড ছেড়ে যেত আমার ওখানে।

ওর মা গায়িকা ছিলেন আর আধা-হাঙ্গেরীয়। ওদের বাড়িতে গানের বৈঠক লেগেই থাকত। বোন ইন্দু বাজাত পিয়ানো, দেখতেও ভারি মিষ্টি ছিল, একটু চাপা স্বভাবের। অমৃতার প্যাশন ছিল ছবি আর গান। আমার প্রেমে পড়াটা একপেশে ছিল না, কিছুদিন ওর দিক থেকেও সাড়া আসছিল।

তবে আমি তো গরিবই ছিলাম। ওর রাগী স্বভাবের মা একদিন ডেকে বললেন, খবরদার, আমার মেয়েকে ছোঁবে না!

তাতেও পিছিয়ে যেতাম না, শেষে অমৃতাই একদিন জানিয়ে দিলো ও ওর হাঙ্গেরীয় মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে প্রেম করে। ওকেই বিয়ে করবে। অতএব… এই তো জীবন!

কোথাও কোনো ঘরে কি একটা ঘণ্টা বাজল ঘড়ির? এই বাড়ির… স্যার গঙ্গারাম ম্যানসনের কোনো ঘড়ির? এ-বাড়িতে ঘণ্টা দেওয়া ঘড়ি আছে? নাকি অন্তিমকালে মানুষ মৃত্যুর ঘণ্টা শুনতে পায়?

প্রবল কষ্টের মধ্যেও অমৃতার হাসি পেল। ওর আরেকটু কিছু শুনতে ইচ্ছে করল। বিশেষত দিনটা যখন ৫ ডিসেম্বর। কী করে জানল ও তারিখটা ৫? মনে রাখলই বা কেন তারিখটা?

হঠাৎ-হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য ইন্দুকে মনে আসছে। সম্পর্কটা এত খারাপভাবে শেষ হলো যে বেদনাটা কিছুতেই যাচ্ছে না। বয়সে ছোট-বড় হলেও বড় হলাম যমজ। বোনের মতো। সিমলার বাড়িতে ও পিয়ানোর সামনে বসলে আমার পক্ষে আঁকার ঘরে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ত। ওর হাতে শোপ্যাঁ বা লিজট বাজলে আমি থুম্ হয়ে বসতাম। একদিন প্রবল শীতের মধ্যে মোজার্ট বাজচ্ছিল, জানালার বাইরে ঘন কুয়াশায় ছাওয়া আকাশ, গাছপালা, পাহাড়।

বললাম, মোৎজার্ট!

ও বলল, পিয়ানো কনচের্তো নাম্বার…

ও আর কী বলল কানে গেল না। শুধু পিয়ানোই পশছে কানে…

বাজাতে বাজাতেই ও বলল, আজ ৫ ডিসেম্বর…

জিজ্ঞেস করলাম, তো?

– ভলফগাং আমাডেয়সের মৃত্যুদিন!

আজ ফের সেই ৫ ডিসেম্বর। মোৎজার্টের রিকুইয়ম শুনতে পেলে হতো।

আবার ভাবছি – না থাক। শুনতে-শুনতে আনন্দেই হোক, বেদনায়ই হোক, মরে যাব হয়তো।

আরো খারাপ – ইন্দুকে মনে পড়বে। আমাকে বাড়ির থেকে বার করে দিয়েছিল! আমি এতই অবাক হয়েছিলাম যে বিশ্বাসই করতে পারিনি ইন্দু আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছে! ওইভাবে গলা তুলে! তক্ষুনি!

আমি আর সহ্য করতে পারিনি। আমার দুটো ক্যানভাস            দু-হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলাম দিকশূন্যহীনভাবে। রাগই আমাকে শক্তি জোগালো গোটা পথ। হেঁটেই চলেছি… কোনো কিছু না ভেবে যেন পটে রং ছড়িয়ে যাচ্ছি।

পরে জেনেছি আমি একবারও না থেমে দশ মাইল হেঁটে গিয়েছিলাম। দু-হাতে দুটো ছবি। না ফেরার জন্য চলে যাওয়া।

একবারই মাত্র এরপর ইন্দু একদিন এলো। একটা শাড়ি দিলো, বলল আমার জন্য কিনেছে। হাই! হ্যালো! হলো। চলে গেল। আমার জীবনে ইন্দুর পরিচ্ছেদটা আমি বন্ধ করে দিয়েছি। আমার কানে, মনে, হৃদয়ে ওর পিয়ানো বাদন চিরদিনের মতো নীরব হয়ে গেছে। ওর কান্না, ওর হাসি, ওর কণ্ঠস্বর সব নীরব। আমার কাছে ও মৃত অতীত। জানি না এত স্থির নীরবতাকে, রক্তক্ষয়ী আত্মীয়তাকে কবিরা ভালোবাসা বলবে কিনা। কী বলতেন প্রিয় দস্তেয়েফস্কি বা ইবসেন? উফ্, আমাশার রক্ত যেন মস্তিষ্কের কোষ থেকে ঝরছে! মরেও আরাম।

ব্যথার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল অমৃতা।

স্বপ্নের মধ্যে মা এলো, এসেই হারিয়ে গেল।

তারপর বাবা এলো। সিমলার বাড়িতে টেলিস্কোপ ধরে ওকে রাতের আকাশে তারা চেনাতে বসল। বলল, যা তারা তুমি দেখছ এরা কেউই হয়তো আর জীবিত নেই। শুধু তাদের আলোটুকুই দেখছ।

জিজ্ঞেস করলাম, আলো থাকাই তো জীবন, বাবা, তাই না?

বাবা বলল, এই দৃশ্যমান ব্রহ্মান্ড হয়তো একটা অসীম ক্যানভাস। ওই আলোরাই রঙের ফোটা।

বললাম, কে আঁকছে?

বাবা বলল, এই অনন্ত আলো এবং অনন্ত আঁধার যাঁর সাম্রাজ্য। আলোয়-আলোয় যাঁর সত্যের মুখ আবৃত। যাঁর ধ্যান করা যায় শুধু চক্ষু মুদে, অন্ধকারে।

বলতে-বলতে বাবা দূরবীনে একটা তারার পতন দেখাল। সেই তারা দেখতে-দেখতে অমৃতা এক সুদূর অন্ধকারে ভেসে গেল। ঘন, বাস্তব অন্ধকার।

লাহোরে অন্ধকার নেমেছে। স্যার গঙ্গারাম ম্যানসনে নেমেছে নিস্তব্ধতা। গোটা বাড়িতে গোটা কয় আলো মাত্র জ্বলছে। অমৃতার রং আর আলোর দিক, আর অন্ধকারের দিক মিশে যাচ্ছে। যে-অবস্থায় রং আর আলো রাতের আকাশ বা ব্রহ্মান্ডের চিত্রপটের মতো রূপদ্রব অন্ধকার হয়ে যায়। বোজারে এক শিল্পী যেমন ঠাট্টা করে বলেছিল কতদিন আগে – আলোর মতো কালোরও বর্ণালি আছে।

সেই কালোর বর্ণালিতে ডুবে যাচ্ছিল আস্তে-আস্তে অমৃতা।

যখন ইকবাল এলো ওদের বাড়িতে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে ইকবাল দেখল ভিক্টর বেজায় গোমড়া মুখ করে নামছে। মুখ নিচু, কিছু দেখছেও না। ইকবাল ওর চোখের দিকে চোখ রেখে উঠতে থাকল। কিন্তু চোখে চোখ পড়ল না। শেষে সিঁড়ির দুটো ধাপের দূরত্বে এসে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছে অমরি?

ভিক্টর একটু দাঁড়াল সিঁড়িতে। সিঁড়ির রেলিংয়ে রাখা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, খুব খারাপ।

তারপর ওপরে কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলে বলল, বাঁচবে বলে মনে হচ্ছে না।

ইকবালের হাঁটুটা হঠাৎ কেঁপে গেল। লোকটা বলে কী? এই তো সেদিন দেখে গেল পেটের অসুখে পড়েছে। এর মধ্যে এত কী ঘটল? আর ভিক্টরই বা কী? একটা খবর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না?

জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার দেখিয়েছ?

উত্তর এলো, আমি যা করার করছি। যা করা সম্ভব।

– কেন?

– ও কোমায় চলে গেছে।

কোমা! অমৃতা কোমায়! তার মানে…

মানের নিকুচি করেছে! ও আর একটা সিঁড়িও না চড়ে নামা ধরল। বাইরে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে হেলেন চমনলালের বাড়ির রাস্তা ধরল। লাহোরে এত ভালো ভালো ডাক্তার থাকতে ভিক্টর একটা কাউকে খবর দিলো না। পেটের রোগের কী ডাক্তারি করল তাহলে অ্যাদ্দিন! কোনো তাপ-উত্তাপও নেই।

আজকের দিনে পেটের রোগে কেউ মরে!

একটা গাড়ির পিছনে ব্রেক কষল ইকবাল।

ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি কি টিউবারকুলোসিস না ক্যান্সার!

একটা রাস্তার মোড় ঘুরল ইকবাল।

কটা পকোড়ায় কোমা পর্যন্ত গড়ায়!

হেলেনের বাড়ির গেটে এসে দাঁড়াল ইকবাল।

কী ব্যাপার ইকবাল, কোনো সমস্যা? হেলেন জানতে চাইল।

বলছি। আগে গাড়িতে ওঠো। ব্যাখ্যা করার কটা মুহূর্তও নেই ইকবালের।

কী ব্যাপার! কী ব্যাপার! বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন দেওয়ান চমনলাল।

ইকবাল বলল, আপনিও গাড়িতে উঠুন। সময় নেই।

গাড়ি রাস্তা পেরিয়ে একটা বাঁক নিতে হেলেন বলল, এখন বলবে…?

রাস্তার অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে গিয়ার বদলাতে বদলাতে ইকবাল বলল – অমরি মারা যাচ্ছে!

কী!!! হেলেন ও দেওয়ানের দুটো বিস্মিত ‘কী!’ মিলে এক হয়ে গেল।

ইকবাল গলা নামিয়ে, শান্তভাবে বলল, এখন কোমায়।

একটা ব্রেক কষল ইকবাল।

হেলেন জিজ্ঞেস করল, কে দেখছে?

ইকবাল অ্যাক্সিলেটারে চাপ বাড়িয়ে বলল, কেউ না।

হেলেন ও দেওয়ান ফের সমস্বরে চমকাল, মানে?

– মানেটা ডক্টর ভিক্টর এগান বলতে পারবে।

– তার মানে…

ইকবাল চুপ করে অন্ধকারে গাড়ি চালিয়ে গেল। শীতের লাহোরের রাস্তার অন্ধকারটা গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে। হেলেনের এক্ষুনি বেরুনো দরকার।

গাড়ি স্যার গঙ্গারাম ম্যানসনে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে দরজা কূলে ছিটকে বেরিয়ে গেল হেলেন। একটু পর তরতর করে ওপরে উঠে অমৃতার ঘরের দরজা ঠেলে আরেক অন্ধকারের মধ্যে এসে পড়ল।

ঘরের কোণে একটা আলো জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু টেবল ল্যাম্প বা বেঁটে হল ল্যাম্প যা-ই হোক, একটা শেডে চাপা পড়ে বেশ নরম হয়ে আছে সেটার আলো। যেদিকে মুখ ফেরালে অমৃতা আলো ও রং দেখে এবং যার উলটোদিকে মুখ করলে অন্ধকার। এখন যদিও উভয় দিক মিশে যাচ্ছে একটু একটু করে। সেই গড়ে ওঠা অন্ধকারের মধ্যে এক ক্ষীণ আলোর মতো দেখা দিলো হেলেন।

গলায় আওয়াজ আসছে কি অমৃতার? কষ্ট হলেও একটা কিছু উচ্চারণ করতে পারা নিষ্কৃতি। অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার এক ভয়ানক ষড়যন্ত্র চলছে এই ঘরে। এই তো সেদিন… পাঞ্জাব লিটেরারি লিগ হলে কী ভীষণ, কী ভীষণ বকবক করে গেলাম আমার প্রদর্শনী নিয়ে। কী অফুরান হাসলাম। মনে হলো যত গুঁইগাঁই করি না কেন, লাহোর আমাকে দু-হাত ভরে দিচ্ছে। কখনো কখনো হেসেছি যখন এখানকার কেউ লাহোরকে মাথায় তুলেছে ওই হেক্কারির কথাটা বলে – মিস লাহোর ন দেখি-ও জন্মাই নহি। আহা, শুনতে ভালোই লাগে এমন সুন্দর করে বলা শৌখিন কথা। তাহলে আমি কি উলটোটাও প্রমাণ করে যাব? লাহোর বিনা শেষনিঃশ্বাস ফেলার মতো শহর কোথায়?

কিন্তু… কিন্তু দরজা সরিয়ে কে এলো শরীরের এই অবেলায়? নারী, না পুরুষ? ভিক্টর, না ইকবাল? গলাটা হেলেনের না? তুমি অত গম্ভীর হয়ে কথা বলছ কেন হেলেন? তুমি কী বলছ, হেলেন? আমি কেমন আছি? আমার কী কষ্ট? না, না, আর কদিন বাদে আমার এক্সিবিশন, আমি কোনো অলক্ষুণে কথা শুনব না, উত্তর করব না। আমি রং দেখতে চাই, তুমি কী রং পরে আছ, হেলেন? ঠিক ঠাওরাতে পারছি না, তবু জানি তুমি কী পরে থাকতে পারো। বলব?

হেলেন চমনলাল বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতে ল্যাম্পের চাপা আলো ওর গায়ে ও শাড়িতে এসে পড়ল। একটা ঘোরের মধ্যে সেদিকে চেয়ে থেকে প্রায় মশকরার সুরে অমৃতা বলল, লাইল্যাক ছাড়া আর কোনো রংই তুমি গায়ে তুলবে না, না? কী ব্যাপার, ওভাবে কী দেখছ? ভয় নেই, আমি কম্বলের তলায় নগ্নিকা সেজে নেই। একটা আইডিয়া অবশ্য তুমি দিলে আমাকে। বিছানা ছাড়লে এঁকেও ফেলব –  দ্য লাইল্যাক ন্যুড।… কী সেটিং, কী কম্পোজিশন জানি না… শুধু রং দেখছি…

হেলেন, হেলেন, তুমি তো কথা বলছ না আর, তুমি চলে যাচ্ছ? ধন্যবাদ, এই একটুক্ষণের জন্যে এসে একটু রং দেখিয়ে গেলে… রাগ বলে যে-জিনিসটা ভারতীয় সংগীতে তার মানেও রং… আমার বাঙালি বন্ধুরা… সারদা উকিল, ভবেশ সান্যালরা বলে বাংলায় রাগ মানে রাগ, মানে গুস্সা, মানে অ্যাঙ্গার, মানে স্প্লিন… না, না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় অত রাগ আমি দেখি না, অনেক নরম অভিমান দেখি… মৃত্যুকেও কী সুন্দর অভ্যর্থনা গীতাঞ্জলিতে! নিজেকেই জিজ্ঞেস করছেন, কী ধন দেবে উহারে… মরণ যেদিন আসবে তব দুয়ারে… ঠিক মনে পড়ছে না কথাগুলো… এইরকমই কিছু… প্রথম যেদিন পড়ি কথাগুলো ভেবেছিলাম, ইস্, নিজের মৃত্যুর দিনেও যদি এই কথাগুলোই, বা এরকমই কিছু ভাবতে ভাবতে চলে যেতে পারি…

হেলেন দেখল অমৃতা কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু শব্দে পৌঁছাচ্ছে না। ওর মুখ, চোখ, শরীরে মৃত্যু নামছে। ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, খারাপ হবার আর কিছু বাকি নেই। শিগগির চলো, ডাক্তার আনতে হবে।

ডা. নিহালচন্দ সিক্রি এলেন। আনা হলো জার্মান চিকিৎসক ডা. কালিশকে। দুজনেরই এক কথা : বড্ড দেরি হয়ে গেছে। পেরিটোনাইটিস ধরে নিয়েছে। অন্ত্রনালিতে ছিদ্র হয়ে গেছে। রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার নয়। অমৃতা বাঁচবে না।

ভিক্টর শেষ অবধি রাজি হলো লাহোরের বিশ্রুত বৈদ্য ডা. রঘুবীর সিংহকে ডেকে পাঠাতে।

ডা. কালিশ মনে করলেন মেয়েটার শরীরের জলও শুকিয়ে ভেতরটা ঠা-ঠা। এসবই আমাশা চাপতে এপসম সল্ট গেলানোর প্রতিফল।

ডা. রঘুবীর সিংহের ধারণা হলো অমৃতা অন্তঃসত্ত্বা ছিল। লোকলজ্জার ভয়ে ভিক্টরই স্ত্রীর গর্ভ স্বহস্তে পাত করতে গেছে। এবং বারোটা বাজিয়েছে।

এখন সত্যি বারোটা বাজে। কোথাও কি ঘড়ির ঘণ্টা বাজল?

ভিক্টর বলল, ডক্টর সিং, ওর রক্ত চাই।

– কটা বাজে জানো?

– কিন্তু রক্ত তো দিতেই হবে।

– সেটা অন্তিমকালে মনে পড়ল কেন?

– আমাশার চিকিৎসা তো চলছিল…

– রক্তক্ষরণের অন্য কারণও কি নেই?

– আমরা কি ওই তর্কে যাব এই মধ্যরাতে?

– রক্তই বা দেব কী করে?

– কেন?

– রক্ত কোথায়?

– কেন, আমি দেব।

– কোন ভরসায় নেব বা দেব?

– বলছেন ব্লাড গ্রুপ নাও মিলতে পারে?

– অবশ্যই।

– যদি বলি আমার রিস্কে?

– তোমার রিস্কে আমি অমৃতার জীবন বিপন্ন করব কেন?

– বিপন্ন হওয়ার কী বাকি?

– কেন, আমার সুনাম?

– আপনি সুনামের কথা ভাবছেন?

– অমৃতার সুনামও।

– ওর জীবনের চেয়েও…

– মনে রেখো নামটা অমৃতা শের-গিল। জীবন চলে গেলেও নামটা অমর হবে। কারণ নামটাই অমৃতা…

ওর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে যখন দুই ডাক্তারের তর্ক চলছে অমৃতার শেষনিঃশ্বাসটা নীরবে শরীর ছেড়ে চলে গেল।

 

দুই

টেলিগ্রামটা হাতে এসে পড়তেই মারি আঁতোয়ানেতের একটা তীব্র কান্নার ধ্বনি, একটাই… কিন্তু ব্যথায়, রাগে ও অবিশ্বাসে ত্রিফলা হয়ে ঘরের কড়ি-বর্গায় গিয়ে আছড়ে পড়ল। শব্দটা হয়েই মারির গলা থমকে গেল; আর্তনাদ করে কেউ মূর্ছা গেলে অথবা হৃদাঘাতে মুচড়ে ওঠা ব্যথার আওয়াজ হয়ে যেমন কণ্ঠ বোবা মেরে যায়। মারির চোখ দুটো ক্রমশ বিস্ফারিত হতে লাগল, হাতের দুলাইনের তারবার্তাটা একটা শীতল অগ্নিশিখার মতো জ্বলতে থাকল।

শীতল-আগুন টেলিগ্রাম কিন্তু মারির বুকের মধ্যে একটা বারুদের স্তূপ খুঁজছে। মারি বুঝতেই পারছেন না এর পরের মুহূর্তটা কী দাঁড়াবে। তারের বার্তাকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে, না এটা অমরির এক বীভৎস ঠাট্টা বলে ছুড়ে ফেলা যাবে।

কিন্তু টেলিগ্রাম তো পাঠিয়েছে চন্নি। অমরির খুড়তুতো ভাই।

মারি আঁতোয়ানেত নিজের অজান্তেই কাগজটা দিভানের পাশে ছুড়ে ফেলে দু-হাতে নিজের গলা চেপে ধরলেন। পাছে প্রাণবায়ু কণ্ঠ বেয়ে শূন্যে হারিয়ে যায়।

কতক্ষণ এভাবে গলা চেপে বসেছিলেন মারির খেয়াল রইল না। বার্তাটা ঘরে এসে ওঁর হাতে দিয়েই বেরিয়ে গেছিলেন উমরাও। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে ওঁরও একটা বুকফাটার আওয়াজ এলো। ওঁর প্রিয় সংস্কৃত ভাষায় কিছু একটা বললেও… মারির এখন সব ধ্বনিকেই অর্থহীন মনে হচ্ছে। হৃৎস্পন্দনের ধুকপুকুনির মতো নিরর্থক… অথচ ওই স্পন্দনের লীলা থমকে গিয়েই অমরি হয়তো ওর লাহোরের বাড়িতে নিজের একটা ছবির মতো স্থির হয়ে আছে।

না, সংস্কৃত-টংস্কৃত নয়, উমরাও কি অমরির সঙ্গে কথা বলছে? ও কি দূরবীন নিয়ে মেয়েকে রাতের আকাশ চেনাচ্ছে? নাকি মৃত্যুর রহস্য বোঝাচ্ছে? নাকি বোঝানোর চেষ্টায় আছে যে ওই লাহোরেই ও পেটে এসেছিল আমার, আর ওখানেই শেষ হয়ে গিয়ে একটা জীবন-মৃত্যুর বৃত্ত সম্পূর্ণ করল?

ফের একটা চাপা কান্না শুনলেন যেন মারি? সত্যিই কান্না? কার কান্না? নাকি নিজের রক্তপ্রবাহের উন্মাদ শিস? রাগে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে টের পেলেন যে জীবনে এই প্রথম রাগ একটা অবান্তর অনুভূতির মতো হয়ে পড়ছে। অকারণ রাগ একটা বড়লোকি বিলাসিতা, নয়তো প্রহসনের রসদ। মৃত্যুতে কি রাগ হয়? – এটা ভাবতে গিয়ে তুমুল কান্না এলো মারি আঁতোয়ানেতের দুচোখ বেয়ে। এবং নিজের কান্নার মধ্যে তিনি আবছা শুনতে পেলেন স্বামী পাশের ঘরে বসে ওর অদ্ভুত কোনো কান্নার সঙ্গে যুঝছে। দুই ঘরের দুই কান্নায় ফায়ারপ্লেসে উষ্ণ করা দুটো ঘর বরফশীতল হয়ে উঠছে।

রবি নদীর ধারের শ্মশানে কন্যার চিতায় আগুন দিতে দিতে উমরাও সিংহ শের-গিলের মনে হলো শরীরের আগুন থেকে যে-প্রাণের জন্ম দিয়েছিলেন আজ তাকেই পাটকাঠির আগুনে নির্বাপিত করছেন। অমৃতাও ওঁর জীবনের একটা শুরু এবং অনেকখানি শেষ। শাস্ত্রে বলছে, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই অমৃতে গমন করতে হবে। আমার শাস্ত্রে আজ থেকে অমৃত শব্দটা বদলে যাবে। অমৃতা আসবে।

উমরাওয়ের আরেকটা প্রসঙ্গও মনে এলো। নিয়তির প্রসঙ্গ। আটাশ বছর আগেই তো এই লাহোরে গর্ভে এসেছিল অমরি। আর আজ এই লাহোরেরই রাস্তা ধরে-ধরে ওকে বয়ে আনা হলো শ্মশানে। কাশ্মিরি শালে জড়ানো ওর শরীরে কোনো ফুলই ছড়ানো হয়নি! কী সাংঘাতিক কথা। এক শিখ নারীর শব পুষ্পহীন! যেমন নববধূ অলঙ্কারহীন হতে পারে, কিন্তু ফুলহীন কখনো না। ফুলই তো ধরিত্রীর অলঙ্কার, মর্ত্যের মাধুর্য, মানবীমনের মুখ।

ব্যাপারটা নজরে আসতে যে-সব বন্ধুর বাগানে ফুল হয়েছে তারা ফুল আনতে ছুটল। ফুলে সাজানো হতে শব নিয়ে জনাচল্লিশের শ্মশানযাত্রীর দল চলল। ম্যাল, লোয়ার ম্যাল ধরে, বাদশাহী মসজিদের ধার দিয়ে, লাহোর দুর্গের পাশ বেয়ে… নদীর পাড়ে শ্মশানে। নদীকে উমরাও সিংহ চিরকাল দেখেছেন জীবনের প্রতিমা হিসেবে… অমৃতার ভস্ম গ্রহণ করে নতুন প্রাণে মেশাবে বলে শীতের আকাশতলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রবি নদ। ঠিকই তো রবি তো নদই, নদী কেন হবে? অমৃতার অস্থিতে নতুন বীজ বপন করবে রবি।

উমরাও বুঝতে পারছিলেন ওঁর মেধা ধ্বংস হচ্ছে। জগতে কোনো শাস্ত্র নেই, ধর্ম নেই যা সন্তানশোকে আশ্রয় হয়। ওঁর আরো যন্ত্রণা অমৃতা লাহোরে সংসার পেতে অনুরোধ করেছিল একবারটি ঘুরে যেতে। গিয়ে থাকতে। মারিও বলেছিল, যাও না! ওদের হয়তো দরকার হবে তোমাকে।

উমরাও নড়েননি। দূর, কী আর সামলাব গিয়ে! তিরিশ বছর হলো লাহোর ছেড়েছি। অ্যাদ্দিনে শহরটার কী ভোল বদলেছে কে জানে!

মারি বললেন, কেন, তোমার বন্ধুবান্ধব কী কম ওখানে?

– যে-কজন আছে সবার সঙ্গে তো পরিচয় করিয়েছি।

যেটা বলেননি উমরাও তা হলো, যে-সংস্কৃত কাজটার অনুবাদে হাত দিয়েছেন তা থেকে নড়বেন না। শুধু অমৃতাকেই জানিয়েছিলেন, পরে আসছি।

তখন বুঝিনি ঠিক কী পরিস্থিতিতে শেষ অবধি যেতে হবে। আমার যে-আশঙ্কা, যে-সংস্কার, আমার যামিনীকালের কুহকিনী ডাক যে এভাবে সত্যি হয়ে নেমে আসবে আমি কি ভাবতে পেরেছিলাম কখনো? দুষ্মন্তের হাত ধরে শকুন্তলা আশ্রম ছেড়ে যাবার সময় কন্ব মুণির কেন একটা অশুভ ভাব জেগেছিল মনে? নিছকই সাহিত্য ওই ভীরু শঙ্কা? কেন সিমলা থেকে লাহোর যাবার পথে বারবার মনে হয়েছে খবরটা সত্যি নয়, অমরি মারা যায়নি।… আশ্চর্য, ওর মা’র কিন্তু ওই ভ্রম ছিল না, আমরা আসছি যখন।

আমরা লাহোরমুখী যখন, আমাদের দুজনের কারোই চোখে জল নেই। কোনো কান্নার দমক নেই, কে জানে হয়তো ব্যথারও কোনো গমক নেই! এক স্তম্ভিত অবস্থা। চোখ মন বুদ্ধি দেহ অসাড়। ছ-তারিখ সন্ধ্যায় ওদের বাড়ি পৌঁছে দৌড়ে উঠে গেলাম ওর ঘরে। দেখলাম একটা চাদরে ঢাকা পড়ে আছে অমরি। চাদরটা সরিয়ে দেখলাম ও গভীর নিদ্রায়; শীতল, নিথর, মৃত।

যার ছবিতে এত রং, এত প্রাণ তার নিজের শরীরে কোনো তাপ, কোনো সাড় নেই। রং… তাই বা কোথায়?

দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যখন চিতা এবং অমৃতার অপরূপ শরীর, উমরাওয়ের চোখ পড়ল ওর আঙুল ও মাথার দিকে। ওই আঙুল যা রূপেরসেরঙে জীবনকে এঁকেছে, আর ওই মগজ যে-ছবি ধারণ করেছে, অবিনশ্বর আত্মার প্রেরণার জাগ্রত হয়ে, আমার চোখের সামনে ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোমে মিশে যাবে। কিন্তু ওর অমৃত আত্মা অমৃতা হয়ে থাকবে…

অনুশোচনায় বুক জ্বলছে উমরাওয়ের। এই তো সেদিন, অক্টোবরে, অমরি লিখেছিল ওর মাকে : যে-জন্য  এত কিছু বলা। একটা বাড়তি ঘর তৈরি করে ফেলা গেছে। বাবার এখানে ভালোই মানিয়ে যাবে… জানি না, আমাদের রাঁধুনিটা ওর পছন্দের দিশি রান্না দাঁড় করাতে পারবে কিনা। তবে বাবা তো অত ঘ্যানঘ্যান করার লোক নয় খাবার-দাবার নিয়ে; ও ব্যবস্থা আমরা সেরে ফেলব…

আর আমাকে লিখল ওর ওই মিষ্টি ‘দুসি’ সম্বোধনে : হ্যাঁ, দুসি, আমি চাই তুমি শিগগির, শিগগির মনস্থির করে চলে আসো!

সেই সঙ্গে ওর আগামী প্রদর্শনীর জন্য সিমলা থেকে ওর কী কী ছবি নিয়ে যেতে হবে তারও একটা তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই ছবিগুলো ও আর চাইবে না, সারা দেশ চাইবে। কী জবাব দেবে উমরাও সারা পৃথিবীকে? মেয়েটা এত করে ডাকল, তুমি গেলে না। সংস্কৃত তর্জমার অজুহাত দেখাচ্ছ? তোমার গিন্নির বিশ্বাস ওর বর ভিক্টরই ওকে খুন করেছে। তুমি সিমলার ঘরের দেয়ালে কান পাতলে এই কথা শুনতে পাবে। মানুষের মনের কথা দেয়াল শোনে। যে-দেয়ালে অমরির একটা ছবি ঝোলে। সেলফ পোর্ট্রেট। যাকে তুমি অলবিদা করে এলে কাল। যার সামনে তুমি কবুল করলে কাল, বড় দেরি করে ফেললাম রে! ক্ষমা করিস, যদি পারিস।

তুমি… তুমি… তুমি উমরাও সিংহ শের-গিল, তোমার এত ভয় লাহোর আসতে! লাহোর সে-লাহোর নেই, এই যুক্তিতে! সারা দুনিয়ার মগজদাররা লাহোরে আসছে… বাদশাহ আকবর ১৫৮৪ থেকে ১৫৯৮ এই চোদ্দ বছর লাহোরে ওঁর রাজধানী বসিয়েছিলেন। এখানেই ওঁর পুত্র সেলিম সাধারণ মেয়ে আনারকলির প্রেমে পড়েছিল। এখানেই বেচারি মেয়েটিকে জ্যান্ত কবর দিলেন বাদশাহ। আর হায় রে, সেই সেলিম বড় হয়ে জাহাঙ্গীর শাহ হয়ে এই লাহোরেই দেখা পেলেন নূরজাহানের। শাদিও এখানে।

কিন্তু না জাহাঙ্গীর, না লাহোর, আনারকলিকে ভুলতে পেরেছে। জাহাঙ্গীর লাহোরে সেই অবিস্মরণীয়ার নামে সৌধ গড়েছেন। লাহোরিরা তাদের মেয়েটির নামে গড়েছে আনারকলি বাজার। তুমিও কি ভুলতে পেরেছ, উমরাও, সেই সব দিন যখন কারণে, অকারণে ঢুকে পড়তে বাজারে? কিছু কেনার নেই, শুধু চোখ ভরে জিনিস দেখছ, দার্শনিক সক্রেটিসের মতো নিজেকেই শোনাচ্ছ – আহা, কত জিনিসই যে আছে যার কোনো দরকারই নেই আমার!

তোমার অমরিও কখনো লাহোরকে ভোলেনি। যাও, বাড়ি গিয়ে দ্যাখো গত বছর মেয়ের আঁকা ‘গল্প বলা দাদু’। ‘এনশেন্ট স্টোরি টেলার’। রাতের অন্ধকারে মসজিদের হাতায় বসে গল্প শোনাচ্ছে বক্তাদের। কী গল্প? কে জানে, সেলিম-আনারকলির কিস্সা হয়তো! প্রেমের গল্প শোনার জন্য বয়স হতে হয় না লাহোরে। মরার জন্যও। আনারকলি, আর এখন অমৃতাও সেটাই প্রমাণ করেছে।

এই তুলোর মতো সাদা চুলদাড়ির গল্পকার নিয়ে গল্প শুনিয়েছিলাম বহুকাল আগে অমরিকে। গল্পকারের কথা গল্প-গল্প করেই। এক বাঙালি লেখক বন্ধুর কাছে শোনা। সেই গল্পকার রাতের বেলা গিয়ে গিয়ে হারেমের জেনানাদের গল্প শোনাত। গল্প মানে কী? সব প্রেমের গাথা – প্রেম বিরহ ছাড়াছাড়ি মৃত্যু পুনর্জন্ম…. যত কিছু ভাবা যায় ভালবাসাবাসি নিয়ে। হুজুরের অপেক্ষায় অপেক্ষায় অভাগিনীদের প্রেম তো মরে ভূত হয়ে যেত, না?

সেই অতিবৃদ্ধ রাতের কাহিনিকার, রাত কে গওয়াইয়া-ও এসেছিলেন দিল্লিতে এই লাহোর থেকে। নাম বাবা লাহোরি। গেয়ে গেয়ে গল্প শুনিয়ে রাতকে মাত করে দিতেন। রাতের সেই সব পিপাসার্ত মেয়ে বলত, ওই রাতটুকুই আমাদের দিন। বাবা লাহোরি আসলে পরি। হারেমের পাহারাদার খোজারাও বাবাকে কুর্নিশ করে বলত, বাবা শ’ সাল জিয়ে!

বাবা হেসে বলতেন, শ’ সাল তো জি চুকে হ্যায়, বেটা!

– একশ!

– একশ পাঁচ।

– আর গল্প শুনিয়েছেন কত?

– পাঁচ হাজার!

– পাঁচ হজার তিনশো সাতাত্তন।

অমরি, তোর এই ছবিটা দেখতে কী মনে পড়ল জানিস, নিজেকে! ওই লম্বা চুল, লম্বা দাড়ি, বয়সের গাছপাথর নেই, দুনিয়াটাকে দেখেই যাচ্ছি, দেখেই যাচ্ছি ক্যামেরার চোখ দিয়ে। বিশেষ করে তোর সেই সব ছবি, যে-চোখে কোনো পিতা দেখেনি কন্যাকে এদেশে। যেভাবে তুই হয়তো নিজেকে দেখেছিস আত্মপ্রতিকৃতিতে। যে-দেখার একটা সভ্যতা এবং আবিষ্কার আছে। রস আছে, রঙ্গ আছে, কেউ কেউ বলেছে রহস্য আছে। লুমিয়ের ভাইদের উদ্ভাবনের অনুসরণে যে-ডজনখানেক কালার পজিটিভ করেছিলাম কাচের প্লেটে তাতে রঙের যে-আভাস দেখেছি আজ এই বার্ধক্যে এসে সেই রংই তার আঁকা ছবিতে ঝলসে উঠতে দেখেছি। তখন মনে হয়েছে, রাতের অন্ধকারেও তুই যে-মেঠো বেপরোয়া লাল খুঁজে নিতিস তাতে শুধু জীবন কেন, হয়তো কোথাও, আমাদের দৃষ্টির বাইরে একফোঁটা মৃত্যুও আছে। ভাব না, এই তো সেদিন আঁকা তোর ‘চারপাইয়ে শোয়া নারী’ ছবিটা। লালে লাল হয়ে শোয়া ওই মহিলাকে দেখে বুকটা ছাঁৎ করে উঠেছিল। বেঁচে আছে তো? পাশে বসা মেয়েটাকে অত অবসন্ন, হতাশ কেন লেগেছিল? নাকি পুরোটাই মাথায় খেলেছে ওই ছবি আঁকা হওয়ার সময়কাল নিয়ে?

সারায়া, গোরখপুর থেকে একটা চিঠি লিখেছিলি… কী শোক তাতে প্যারিসের পতন হয়েছে বলে! ওই বাক্যটায় থমকে গিয়েছিলাম, চিঠির বাকি অংশ পড়তে অনেক সময় লেগে গেল। যখন পড়লাম তুই তোর প্রিয় প্রুস্তের ‘আ ল্য রর্শেশ দু তঁ পের্দু’র কয়েকটা ভলিউম পাঠাতে বলছিস দিল্লি থেকে, তখনই বুঝলাম তুই নতুন করে হারানো সময় খুঁজতে বেরুচ্ছিস। যে-সময় মারা গেছে বা মারা যাচ্ছে।

অথচ কী আশ্চর্য, তোর ছবিতে কোনো মৃত্যু নেই! তোর গোটা জীবনটাই একটা জীবনের গল্প। কেবল তোর ওই হঠাৎ-হঠাৎ দুর্মুখ হয়ে ওঠা দেখলে ভাবতাম, কই, এই তো জীবনের কথা নয়! তোকে বলেছিও তা, তাতে আরো কিছু কঠিন শব্দ ফেরত এসেছে।

এত ধোঁয়া উঠেছে, আমায় সরে যেতে হবে একটু দূরে। কিন্তু মৃত্যুর কথাগুলো আমাদের এখানেই শেষ হবে না। আমার আতঙ্ক হচ্ছে, তোর এই মৃত্যুকে তোর মা কীভাবে নেবে। ওর চুপ মেরে থাকাকেই ভয় পাই…

বড় ধোঁয়া; আমার চোখের জল কান্নার না ধোঁয়ার তা নিয়েও ভাবছি না। ভাবছি তোর একটা ছবি নিয়ে। মৃত্যু নিয়ে তোর সম্ভবত একটাই তেলরং। আর কিছু এঁকেছিলি কিনা এখন আর মনে করতে পারছি না। কিন্তু ওই ছবিটাও খুব অবাক করেছিল আমাকে। আঁকলি একটা কবরখানার ছবি, আর নাম দিলি ‘দ্য মেরি সিমেটেরি’! গোরস্তানও আনন্দোজ্জ্বল? ছবিটা দেখেও কিন্তু তা-ই মনে হলো। স্মৃতি ও স্ফূর্তির মেলামেশা রাতের আকাশের নিচে। যেন সন্ধের পার্টি জমছে।

কিন্তু এই শ্মশানে কোনো আনন্দবার্তা নেই। শান্তির কথা বলা হয়, যে-শান্তির কোনো প্রয়োজন ছিল না তোর। আমি বুঝতেও পারছি না মৃত্যুর জন্য লাহোরকে তোর পছন্দ ছিল কিনা। তোর মা হয়তো ওর ওই তিরিক্ষি মেজাজে বলে দেবে, মরার আর জায়গা পেল না মেয়েটা! মরার জন্য আর রোগ খুঁজে পেল না! ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি! আমি বিশ্বাস করি না!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটাই বিশ্বাস জন্মাল মারি আঁতোয়ানেতের। ওঁর অমরি খুন হয়েছে। এবং খুনি ভিক্টর এগান।

একটা প্রতিজ্ঞাও জন্মাল। আমি ছাড়ব না! r (চলবে)