পরানের গহিনে বাজে করুণ সুর

সুশীল সাহা

বেহুলা বাংলা ও অন্যান্য কবিতা

তানভীর মোকাম্মেল

আদম

কলকাতা, ২০১৭

১৫০ টাকা

 

 

বাংলাদেশের তানভীর মোকাম্মেলকে আমরা চিনি একজন সার্থক চলচ্চিত্রকার হিসেবে। ওই দেশের ভিন্নধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে তিনি একজন বরেণ্য পথিকৃৎ। সেলুলয়েডে সমাজ ও জীবনের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের দর্শকমহলে সাড়া জাগিয়েছে। কাহিনি ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে বস্ত্তত তাঁর খ্যাতি এখন আন্তর্জাতিক। এই নন্দিত বর্ষীয়ান চলচ্চিত্রকারের অন্য এক পরিচয় – তিনি একজন কবি, সত্যিকারের জীবনঋদ্ধ সমাজসচেতন কবি। এর আগে তাঁর দুটি প্রামাণ্যচিত্র (বস্ত্রবালিকা ও স্বপ্নভূমি) নির্মিত হয়েছে তাঁরই লেখা দুটি স্বতন্ত্র কবিতার অনুসরণে। অবশ্য কবিতার অনুভব যখন বাস্তবের মাটি স্পর্শ করে, তখন তার অবয়ব হয় ভিন্নতর। তাই কবি তানভীর মোকাম্মেলের কবিসত্তা তাঁর চলচ্চিত্রকার সত্তার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে জন্ম দিয়েছে কিছু অনন্য সম্পদের, বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে তা যুক্ত হয়েছে চিরকালের জন্যে।

সম্প্রতি ‘আদম’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তানভীর মোকাম্মেলের প্রথম কবিতার বই বেহুলা বাংলা ও অন্যান্য কবিতা। প্রকৃতপক্ষে এই বই বাংলা কবিতাজগতে এক অনন্য সংযোজন। কবি বাংলার একটি অতিপ্রচলিত মিথ বেহুলা আখ্যানকে নির্ভর করে রচনা করেছেন অনেক কবিতা। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘বেহুলার পুরাণটি নদী, জল ও সাপের দেশ পূর্ববঙ্গের হয়ত সবচেয়ে প্রতীকী পুরাণ। পূর্ববঙ্গের আত্মাই যেন বেহুলা।’ তবে তাঁর স্বদেশভাষ্যে শুধু বেহুলার মিথই নয়, ঠাঁই পেয়েছে সাতচলিস্নশের দেশভাগ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বজন-হারানোর বেদনামথিত কিছু অনুভব। তাই তো তাঁর কবিতা শুধু মর্মস্পর্শীই নয়, দেশ ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে একধরনের ইতিহাসাশ্রয়ী করুণ গাথা। বইটির প্রথম পর্বে তাই কুড়িটি বেহুলা বাংলা সিরিজের কবিতা আসলে একটিই কবিতা। পুরাণের শরীর থেকে যা নেমে আসে ভাগ্যহত আজকের নারীর জীবনভাষ্যে, অদ্ভুত এক সমাজসচেতন বিদ্রোহী সত্তা যেন কাজ করে কবির অন্তরে। তাই তিনি এখানে কেবল নির্বাক দর্শকই নন, একজন প্রতিবাদীও বটে। তাই তো তিনি লেখেন –

… বাংলার কবি শুধু জানে

যশ নয়, বিত্ত নয়, নয় কোনো পার্থিব

প্রতিদান

সাজিয়ে অক্ষরের অলংকারে      সুরে আর লয়ে

দাঁড়িয়ে প্রতিটা নদীর কিনারে       জন্ম জন্মান্তরে

 

তাকে যে যেতেই হবে গেয়ে

বিকুল বেহুলার অজেয় মঙ্গলের গান।

এর পরেই আসে লেখকের দেশভাগের করুণ স্মৃতিবহ একটি কবিতা ‘চৌষট্টির দাঙ্গার স্মৃতি’। কবিতাটির শিরোনাম থেকেই বুঝে নেওয়া যায় একজন সংবেদনশীল কবির অন্তর কতটা ব্যাকুল হলে এমন একটি কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বস্ত্তত কবিতাটির পরতে পরতে স্বজন-হারানো ব্যথার এক গুমরে-মরা অনুভব আমাদেরও অশ্রম্নসিক্ত করে। একজন সমাজমনস্ক কবির জয় এখানেই, যখন তাঁর অন্তরের ব্যথা পাঠকের হৃদয়েও সঞ্চারিত হয়ে যায়। এবং সেটি যেন অনায়াসে করেন এই কবি, কল্পনার নির্মাণে নয়, অভিজ্ঞতার জারকরসে সিঞ্চিত ওঁর মনোভঙ্গি দ্বারা। এই কবিতারই অনুষঙ্গে একে একে চলে আসে তাঁর লেখা ‘ক্ষমা করিস অবিনাশ’ ও

‘ইছামতী-মধুমতী’ কবিতাদুটি। এর পরের কবিতা ‘উমার আসা না-আসা’ এক ভিন্ন সুরের কবিতা হলেও এই কবিতাতেও একধরনের বিষণ্ণতার সুর। বাংলার ঘরে ঘরে যেভাবে উমার আসার জন্য এক ব্যাকুল প্রতীক্ষা, তার এক নিবিড় অবলোকন কবির এই কবিতায়। তিনি জানেন, বাংলার ঘরে ঘরে উমার জন্য এই যে প্রতীক্ষা তা অন্তরের ভালোবাসামাখা এক নিবিড় অনুভব ছাড়া আর কিছু নয়। তাই তো কবির অন্তর বাংলার চিরন্তন সুখ-সমৃদ্ধি প্রত্যাশায় সেই বরাভয় দুর্গতিনাশিনীর প্রতীক্ষা করে – আশ্বিনে নবান্নে যার আবাহন। চিরকালীন এক বেদনামথিত এই বিদায়গাথা, যার শুরু মহাআনন্দের এবং শেষটা বিষাদের। এ যেন আমাদের ঘরের কথা, প্রাণের কথা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কবির মনোজগতের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। বাংলাদেশের যে-কোনো নাগরিকের কাছে এই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কেবল একটি গর্বের বিষয় নয়, মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আত্মপরিচয়ের অহংকার; ইতিহাসের নিরিখে একটি সেরা ঘটনা। স্বভাবতই তানভীর মোকাম্মেলের কলমে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে নানাভাবে। ওঁর আশ্চর্য কলমে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মুক্তিযোদ্ধার বুক চিতিয়ে নিজের আত্মপরিচয়ের দৃপ্ত ঘোষণা এইভাবে ব্যক্ত হয় :

ভাবছেন কীভাবে শেষ করবেন

আমাকে?

আপনার লম্বা চোয়াল পাঠান

সুবেদারটি কি

নদীর কিনারে দাঁড় করিয়ে

ব্রাশ-ফায়ার

নাকি খ্যাপাটে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনটি

খাপ থেকে টেনে পিস্তল টিপবে

ট্রিগার

 

যেভাবেই হোক     আমি তৈরি

 

হ্যাঁ, মেজর, আমি বাঙালি।

মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গে লেখকের কলমে মূর্ত হয়েছে ‘শরণার্থী ’৭১’ কবিতাটি, যার পরতে পরতে রয়েছে সেই দুঃসহ সময়ের এক অসাধারণ বর্ণনা। চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভেসে ওঠে সেই সময়কার দুঃখবহ কিছু চিত্র। আসলে লেখকের চলচ্চিত্রসত্তা এক অসামান্য দক্ষতায় সেলুলয়েডের ভাষ্য রচনা করে দেয় যেন তাঁর লেখনীর সুচারু বর্ণনায়। আমরা জানি এই মানুষটিই ১৯৭১-এর মতো একটি অসামান্য প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন। সত্যনিষ্ঠা এবং ইতিহাসের প্রতি একধরনের বিশ্বস্ততা তাঁর নির্মাণে। তাই এই কবিতা পড়তে পড়তে আমরাও যেন অনুভব করি :

আঁধারই শেষ কথা নয়     শিউলিভোর আর

সহৃদয় আশ্রয়   রয়েছে কোথাও।

ভারতভাগের এক নিদারুণ শিকার হলো দেশত্যাগী কিছু বিহারি সম্প্রদায়। সংখ্যায় খুব অল্প নয়, অথচ নতুন দেশে নতুনভাবে জীবনযাপন করার স্বপ্ন নিয়ে এই সম্প্রদায়ের একটি বিপুল সংখ্যা ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিল। তারা মূলত আর্থিক দিক থেকে পিছিয়েপড়া, অশিক্ষিত এবং কোনো সম্মাননীয় পেশার সঙ্গে যুক্ত নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, পাকিস্তান সরকার এদের নানাভাবে ব্যবহার করেছে। ও-দেশে বিভিন্ন সময়ে নানারকম অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই বিহারিরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা পাকিস্তান সরকারের হয়ে নানাবিধ কুকর্মে লিপ্ত থেকেছে। তাদের সামনে একটাই টোপ ছিল, তা হলো, পাকিস্তান সরকারের জয় হলে তাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা হবে। ওই দেশটায় তাদের ঠাঁই হবে বিপুল সম্মান ও সম্পত্তি নিয়ে। কিন্তু তাদের এই স্বপ্ন সফল হয়নি। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় এবং পরিশেষে এই বিহারিদের দিক থেকে পাকিস্তানের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া – এসবই সবার জানা এক করুণ ইতিহাস। তারপর এদের বাংলাদেশে আটকেপড়া এবং মানবেতর জীবন কাটানো – সবটাই আমাদের জানা; কিন্তু অত্যন্ত নির্দয় ও মনুষ্যত্বহীন সেই মেনে নেওয়া। বস্ত্তত আমরা প্রায় সবাই এদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলাম বহুদিন। কিন্তু তানভীর মোকাম্মেলের মতো ইতিহাস-সচেতন মানবদরদি মানুষ এদের প্রতি এক আশ্চর্য দরদ অনুভব করে আমাদেরও নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন। মনে করিয়েছেন পুরনো সেই আপ্তবাক্যটি – ‘পাপীকে নয়, ঘৃণা করো পাপকে।’ তাঁর লেখা ‘বৃদ্ধা বিহারি’ কবিতাটি আমাদের অশ্রম্নসজল করে, নতুন করে ভাবতে শেখায়। প্রসঙ্গটি নিয়ে একটু বড় করেই লিখতে হলো লেখকের মনোভঙ্গি এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনাকে একটু বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনে। এই কবিতা অবলম্বনেই তিনি পরবর্তীকালে স্বপ্নভূমি নামে একটি অসাধারণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।

তানভীর মোকাম্মেলের বেহুলা বাংলা ও অন্যান্য কবিতা শিরোনামের এ-গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা নিয়েই এমন আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। কেননা গ্রন্থভুক্ত সব কবিতার পেছনে আছে ইতিহাস-সচেতন সমাজমনস্ক একজন মানুষের জীবনবীক্ষা। তাই কবিতা ধরে ধরে আলোচনার পথে না গিয়ে পাঠকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়ে এই আলোচনার ইতি টানতে চাই।

পরিশেষে একটিই কথা, তানভীর মোকাম্মেল-নির্মিত বেশ কয়েকটি ছবি আমরা দেখেছি এবং বাংলাদেশের নতুন ধারার চলচ্চিত্র সম্পর্কে বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছি। তাঁর লেখা প্রবন্ধ, গল্প, ভ্রমণবৃত্তান্ত ও উপন্যাসের সঙ্গেও আমরা ইতোমধ্যে পরিচিত হয়েছি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর স্বকীয়তার চিহ্ন রাখতে সমর্থ হয়েছেন। এই প্রথম তাঁর একটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হলো। আশ্চর্যের কথা, প্রথম গ্রন্থেই তিনি তাঁর নিজস্বতা দেখাতে পেরেছেন। তাই এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি যদি চলচ্চিত্রকার না হতেন, কথাসাহিত্যিকও না হতেন, অন্তত কবি হিসেবেও তাঁর একটি স্বতন্ত্র জায়গা হতো বাংলাদেশ তথা বাংলা কবিতার মানচিত্রে।

আমরা এই প্রচারবিমুখ কবির কাছ থেকে আরো অনেক কবিতা প্রত্যাশা  করি।