পরানের গহীন ভিতরপানে

তরুণ সান্যাল
সময়মতোই পৌঁছনো গেল। অসুস্থতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কবি বসে আছেন অপেক্ষায়। প্রাথমিক আলাপের পর শুরু হলো আলোচনা। শুরুতেই জানিয়ে দিলেন বক্তব্যের অভিমুখ, বাংলা সাহিত্যে লৌকিকভাষা ও সেই প্রেক্ষিতে পরাণের গহীন ভিতর সম্পর্কিত তাঁর প্রতিক্রিয়া। সৈয়দ শামসুল হকের সমগ্র সাহিত্যকৃতির সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ঘটেনি, তাই তাঁর রচনা সম্পর্কে কোনো অভিমত জ্ঞাপন করবেন না। শুধুমাত্র পরাণের গহীন ভিতর গ্রন্থটুকুই এই আলাপের উপজীব্য। এই স্পষ্ট বক্তব্যের জন্যেই আমরা তরুণ সান্যালকে চিনি। ইনিই আমাদের পরিচিত বিদগ্ধ কবি, প্রাবন্ধিক, যিনি এক সংযত পরিমিতত্বে নিজেকে যতেœ বেঁধেছেন। কাব্য-কথকতার দীর্ঘ যাত্রাপথে পূর্ববাংলার সঙ্গে তাঁর আজন্মের সম্পর্ক। ওপার বাংলার ভূমিপুত্র কবি তাঁর জীবনে-লেখনে তা বারবার স্মরণ করেছেন। এরই নাম অন্য বাংলাদেশ (১৯৭১), তোমার জন্যেই বাংলাদেশ (১৯৭২) এই দুই গ্রন্থ সেই সাক্ষ্য বয়ে চলে। তাঁর ‘গাজন মেলা’, ‘স্বদেশী বিদেশী’, ‘জলের মধ্যে লেখাজোকা’ প্রমুখ কবিতায় লোকভাষার সহজ-সুষমা পাঠকদের মুগ্ধ করে। সেই লোকজ মননের কাছেই তো পৌঁছে যান সৈয়দ শামসুল হক। লোক-লব্জে লেখা তাঁর কবিতাগুলো এক লহমায় কবিকে নিয়ে চলে যায় স্মৃতির বাংলায়, পূর্ববাংলায়।
যে-দেশের জল-হাওয়ায় কেটেছে তরুণ সান্যালের বাল্যজীবন। অসুস্থতার মধ্যেও রাত জেগে একনাগাড়ে পড়ে শেষ করেন পরাণের গহীন ভিতর। আবহমান বাংলা কবিতার চিরন্তন প্রবাহে এ-গ্রন্থ এক অন্য মাত্রা নিয়ে ধরা দেয় তাঁর কাছে। পুজো শুরুর আগে এক বিকেলে কবি জানালেন সেইসব কথা। – শৌভিক মুখোপাধ্যায়)
এ-বছরটা আলালের ঘরের দুলালের লেখক প্যারীচরণ মিত্রের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী। যিনি বাংলার লোকভাষায় ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে একটি বই লিখেছিলেন। বলা যেতে পারে, সংস্কৃত অনুসারে এবং ইংরেজি গঠনভিত্তিক তৎকালীন দুশো বছর আগেকার বাংলা ভাষায় এক বড় বিদ্রোহ এনেছিলেন টেকচাঁদ ঠাকুর। সে বুলিটি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের চুঁচুড়া ও তার পরিপার্শ্বের লোককথন। আমাদের কাছে সেও শিষ্টভাষা। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ আরো এক শিষ্ট লোকভাষায় লিখেছিলেন। চার-ইয়ারী কথা, যা আমাদের এখনো মুগ্ধ করে। কিন্তু আমার ধারণা, সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুরকেন্দ্রিক অর্থাৎ তথাকথিত পশ্চিমবঙ্গীয় লোককথনের সঙ্গে পদ্মার ওপারের লোককথনের কোনো মিল নেই। বরেন্দ্র, রাঢ়, সমতট, বঙ্গ, হরিকেল, শ্রীহট্টভিত্তিক নানাবর্গীয় বাংলা ভাষার মধ্যে ইংরেজ শাসনের সুযোগ নিয়েছিল কলকাতা, নবদ্বীপ ও কৃষ্ণনগর। আমার ধারণা, যদি জাহাঙ্গীরনগর ওইরকম ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হতো, পূর্ববঙ্গের ভাষাও লেখ্য ভাষা হয়ে উঠত। এমনকি ওই বিচারে চট্টগ্রাম অধিবর্গের ভাষা ও শাহজালালের কথনও শিষ্ট বাংলা হিসেবে গণ্য হতো। উত্তরবঙ্গ, গৌড়ের ভাষা তো বটেই।
১৯৪৭ সালে বঙ্গবিভাজনের ফলে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার চাপ পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ফলে, ঢাকার লোকভাষা, বা গৌড়ের লোকভাষা কিংবা হরিকেল-কথন শিষ্ট বাংলাদেশি লিখনভাষা হয়নি। যেহেতু বালক বয়স থেকে আমি পাবনা জেলার উত্তরবঙ্গীয় বরেন্দ্র সন্তান তাই ছেলেবেলা থেকেই বাঁকুড়া, বর্ধমানসহ রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া অঞ্চলের কথনভঙ্গি শুনেছি। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, ওইসব অঞ্চলের লোককথনের চিত্রময় লব্জ যেমন মাধুর্য ও বহু অনুষঙ্গ-সম্পর্কিত, তেমনি কলকাতা বা তার আশপাশের ভাষার সঙ্গে তার কোনো সাদৃশ্য নেই। বঙ্গবিভাজনের পর বাংলা কবিতার শিষ্ট ধারাটিও জীবনানন্দে শেষ। কিন্তু পূর্ববঙ্গের শাসকরা মোনায়েম খাঁর তত্ত্বাবধানে হয়ে উঠেছিল বাংলা কবিতার ঐতিহ্যবিনাশী। শুনেছি, সেই মহাপাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত বাতিল করতে চেয়েও বাঙালি কবিদের রবীন্দ্রসংগীত লিখতে বলেছিলেন।
স্কটিশ চার্চ কলেজে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সহপাঠী ছিলেন ফারুক রহমান। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার সঙ্গে ফারুক সাহেবের কবিতার যুগবৈচিত্র্যে মিল নেই। বাংলা কবিতার আবহমান ধারা যেন সেই শামসুর রাহমান, আল মাহমুদেই শেষ। কিন্তু এক সাগর রক্তক্ষরণে পূর্ববঙ্গের মানুষ যে-স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন তার সহগ উৎপাদন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সাহিত্য। বিশেষভাবে আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী পূর্ববঙ্গের বাংলা কবিতাকে অনেক বেশি স্পষ্ট কথনভিত্তিক করে দেখেছি কিন্তু পূর্ববঙ্গের ভাষামূলক স্বাদ তাতে নেই। অথচ কবিতায় লৌকিক ভাষা, বাগভঙ্গির এক বিশেষ স্থান আছে।
ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের পর বাংলা কবিতায় যে-ঘরানা তৈরি হয়েছে, সেখানে নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখ পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট গ্রাহ্য হয়েছেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের সময় যেমন সিকান্দার আবু জাফরের কবিতা রেডিও মারফত শুনেছি। কিন্তু শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা’ কবিতা এবং ‘বন্দিশিবির থেকে লেখা’ কবিতাগুলো আমাদের খুব মুগ্ধ করে। এমনকি হিন্দুবাংলাতেও ‘জায়নামাজ’ শব্দটি কতখানি অর্থবহ তা ভাবতে বসি।
তবে কি বাংলা কবিতাভূমে, রবীন্দ্রনাথ ও বহু হিন্দু মিথ অন্তর্গতকারী কাজী নজরুল ইসলামকে সামনে রেখে রবীন্দ্র-অনুসারী ও রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিকদের বিচার করব? আমার ধারণা, কবিতার একটি নিজস্ব জাতিগত বিকাশ আছে। সেই বিচারে পঞ্চগৌড়ের ভাষাও আলাদা এবং সত্যি কথা বলতে কি ভাওয়াই, গম্ভীরা থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের ঝুমুর সবকিছু মিলেই আসলে জাতিসত্তার শিকড়গুলো পাওয়া যায় এবং ভাটিয়ালি, মুর্শিদা, বাউল গানে তো বিশেষভাবে এর সাক্ষ্য মেলে। একসময় বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ কবির কবিতা ছিল কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক প্রভৃতি ঘরানার। কিন্তু জসীমউদ্দীনের কবিতা ফরিদপুরের লোকচিত্র বহন করে আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। শুনেছি তাঁর সোজনবাদিয়ার ঘাট একদা কলকাতাবাসী শিষ্ট হিন্দু লেখকদের বিরূপ করে তুলেছিল। যেহেতু মুসলিম যুবকের সঙ্গে নমশূদ্র হিন্দু মেয়ের প্রণয়কাহিনি ওই গাথার উপজীব্য ছিল।
সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা আমি কিছু-কিছু পড়েছি। একদা তাঁর নূরলদীনের সারাজীবন বইটি আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। যেমন ‘দেবী চৌধুরানী’ রংপুরের বাসিন্দা হয়েছিলেন বঙ্কিমী রচনায়, ‘নূরলদীন’ও ওই একই অঞ্চলের অধিবাসী। আমার বাল্যস্মৃতিতে রাখা আছে পাবনা, রাজশাহী, বগুড়ার লোকভাষার আশ্চর্য চিত্রময়রূপ। আমার দুই দিদি আমার জন্মের আগে রংপুরে সরোজিনী দেবীর জমিদারিতে কাজ করার সুবাদে বাবার কাজের সঙ্গী হয়েছিল। তাঁদের কাছেই প্রথম শিক্ষা পাই সুকুমার রায়ের রচনারও। অর্থাৎ ওই অঞ্চলের শিষ্ট জনগণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি সুকুমার রায়ের রচনাও পাঠ করা হতো। শুনেছি কালিদাস রায় প্রথম জীবনে যখন রংপুরে শিক্ষক হয়ে গিয়েছিলেন, ওখানকার সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁকে কবিশেখর উপাধি দেওয়া হয়েছিল। কালিদাস রায় ওই কবিশেখর উপাধিটি বর্জন করেননি।
তাছাড়া আমার জ্যেষ্ঠাগ্রজ রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। বাংলা তথা ভারতের প্রথম শহীদ বগুড়ার বিহার গ্রামের প্রফুল্ল চাকির ঘনিষ্ঠতা ছিল ওই কলেজের সঙ্গে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় রচনায় যাকে সত্যি মাতৃভাষা বলে মনে করি, সেই আমার মায়ের মুখের ভাষা ‘কাইড়্যা নিতে চায়’ যে শিষ্ট বাংলা ভাষারীতি, আমি তার সত্যিকারের অনুগত নই। আমার জীবন, মায়ের জীবনকালে, দেশবিভাগের পর এই বাংলায় আসার পরেও ওই পাবনা, রাজশাহীর কথনে কথা বলতাম। তবে তার মধ্যে কখনো কখনো বাঁকুড়া-বর্ধমান ঢুকে পড়ত। আমার ব্যক্তিজীবনে বালক বয়স থেকে ইচ্ছা ছিল গ্রামের ক্ষেতের চাষি হওয়া, বর্ষায় নদীর জল বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধান-পাটক্ষেত যখন ভাসিয়ে দিত সেই একগলা জলে, পাটচাষির মতো, ‘হাইয়া হাইয়া’ গান গাইতে চেয়েছি। আমি অবশ্য জানি না সৈয়দ শামসুল হকের জন্মস্থানটি কোথায় এবং কোথায় তিনি বড় হয়েছেন। ভাষাকে বাহন করে তিনি স্বদেশ আবিষ্কার করেছেন বা বস্তুগত-ভাবগত বাহনগুলো কোন ভাষার মাধ্যমে আত্মস্থ করেছিলেন।
কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ ড. সোনিয়া নিশাত আমিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আমার বাড়িতে আমার ছোট মেয়ের সঙ্গে বাস করে গেছেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্যে আমি প্রথম রাতেই ঘুমিয়ে পড়ি। ড. আমিন আমার কাছে প্রায় মধ্যরাতে, রাত দশটায় আমাকে জাগিয়ে কিছু কথা বলেন এবং Deep Within the Heart নামে সৈয়দ শামসুল হকের পরাণের গহীন ভিতর বইটির অনুবাদ আমাকে উপহার দেন। চক্ষুরোগে কাতর আমি ওই বইটি রাতজেগেই পড়ি। লক্ষ করি, বইটিতে লোকভাষায় ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে লেখা তেত্রিশটি সনেট আছে। তার সঙ্গে অতি চমৎকার ইংরেজিতে শ্রীমতী আমিনের অনুবাদের সহাবস্থান। আমার অবশ্য ইংরেজি লেখাটি পড়া সত্ত্বেও শামসুল হকের লোকভাষা বুঝতে একদ-ও অসুবিধে হয়নি। আমি তাঁর সম্ভবত প্রতিটি তথাকথিত শিষ্ট বাংলায় সাজানো শব্দ বুঝতে পেরেছিলাম এবং দেখতে পেরেছিলাম।
বিকাশের মধ্যেই ভাষার গঠন হয়। কবিতার ভাষাই পরা ভাষা। ব্রিটেনের এক সমালোচক বলেছিলেন, কবিতা হলো সবচেয়ে ভালো শব্দের চমৎকার সংগঠন। আমাদের কাছেও সেই best word কী! তা কি তথাকথিত সংস্কৃত, আরবি ও পারসিক নাকি অনুগত
শিষ্ট বাংলা! নাকি লোকমুখের ভাষা! আমি তো বিস্মিত হয়ে পড়ি,
আবার তোমার কোলে ফিরা যায় তোমার সন্তান,
আবার তোমার কোলে, খালি কোল, উথলায়া পড়ে
দুধের ঘেরানে ভরা, জননী গো, পুন্নিমার চান –
আবার সে ঘরে ফিরা আইসাছে সারাদিন পরে।
আবার সে আইসাছে করালের ঘুম চক্ষে নিয়া,
চক্ষের ভিতরে তার গেরেপ্তার বিহানের সোনা,
তবনের নীল খোপে শিমুলের লাল রঙ নিয়া,
আবার সে আইসাছে, জননী গো, তুমি কাইন্দো না। (২৪)
এই যে কবিতার ‘উথলায়া’, ‘ঘেরানে ভরা’, ‘পুন্নিমার চান’, ‘করালের ঘুম’, ‘বিহানের সোনা’, ‘তবনের নীল খোপে’, ‘শিমুলের লাল রঙ’ ‘কাইন্দো না’ শব্দগুলো আমাদের অন্তরাত্মাকে পাগল করে দেয়। রবীন্দ্রনাথের যেমন কালের রাখাল আমরা পড়ি, তেমনই শামসুল হকের আছে কালের গোপাল।
কত না রঙীলা নাও নিয়া গ্যাছে কাল যমুনায়,
অঘোরে হারায়া গাভী ফেরে নাই নিজস্ব রাখাল। (২৫)
প্রতিটি কবিতায় এরকম আশ্চর্য লোকশব্দগুলো আছে, যা আমার বাল্যকাল থেকে চেনা।
ক্যান তুই গিয়াছিলি? – আমি তোরে জিগামু অখন
চন্দ্রের ভিতর ফের, যেইখানে জটিলতা বাড়ে,
অশথ জড়ায়া থাকে নদী নিয়া জলের কিনারে,
আমার গেরাম ঘিরা যেইখানে খালি পলায়ন –
মানুষের, মানুষের, আর তর চক্ষের কাজল,
যেইখানে মেলা দেয় একখানা সুনসান নাও,
সে নায়ে সোয়ার নাই, ‘কেডা যাও, কেডা বায়া যাও?’
কেবল আছাড় দিয়া ওঠে কালা যমুনার জল?
কেউ নাই, কেউ তর নাই, তুই নিজে জানস,
তবু ক্যান গিয়াছিলি? ক্যান তুই দিয়াছিলি ফাল?
কিসের কী বাদ্যে তর রক্ত করে উথাল পাথাল,
আমারে ক’ দেখি তুই? ক’ না দেখি, কি ছিল মানস?
ল’ যাই জলের ধারে, দ্যাখ ছায়া আমার কি তর?
মানুষে মানুষে নাই কোনো ভেদ দুঃখের ভিতর। (২৬)
সোনিয়া আমিন অনুবাদ করতে গিয়ে ‘এলোমেলো চুল’ ও ‘আউলা বাউলা কেশ’ দুয়ের মধ্যে তফাৎ করেছেন। প্রথমটি শিষ্ট বাংলা। দ্বিতীয়টি লোকশ্রুতি। অবশ্য সৈয়দ শামসুল হক, এই দুই উচ্চারণ ‘এলোমেলো’ ও ‘আউলা বাউলা’ এক করে দেখার কথা ভাবেননি। তবু তাঁর মনে হয়েছে, একটি শিষ্ট ভাষার অন্তর্গত, অপরটি কথ্য ভাষার অন্তর্গত। মার্কিন নিগ্রো কবি, স্কটিশ ও আফ্রিকার কবি লৌকিক বাগভঙ্গির শব্দ ও উচ্চারণ ব্যবহার করে সম্পর্ক ও স্মরণীয় কবিতা লিখতে পারেন, আমরাই বা কেন বাংলা ভাষায় সে সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখব না… পাশাপাশি অথবা একই সঙ্গে? ফরাসি ভাষায় সেনেগালের কবি Leopold Sedar Senghor আবিষ্কার করেছিলেন নিগ্রোত্ব এবং জুলু বিদ্রোহের নায়ক শাকা-কে নিয়ে এক আশ্চর্য কাব্যনাট্য লিখেছিলেন। তাছাড়া তো তাঁর কবিতাও আছে। তিনি কিন্তু কবিতায় নিগ্রোত্ব বর্জন করেননি, আমার মনে হয় পঞ্চগৌড়ের কবিদের আপন গৌড়ীয় অস্তিত্ব আবিষ্কার করা আশু প্রয়োজন। কত আশ্চর্য গ্রামীণ ভাষা শামসুল হক ব্যবহার করেছেন এবং নারীকেও খুব সুন্দরভাবে ব্যঞ্জনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন ৩২ সংখ্যক কবিতায় –
চক্ষের পলকে তুমি দেখা দিয়া করো মেছমার;
রতির আগুনে সব দাউদাউ, পরিণামে খাক্
আমার এ দেহ বটে, ভবিষ্যৎ পায় না নিস্তার;
সকল কিছুর পরে দ্যাও তুমি উড়ায়া বাদাম,
তীরের মতন তারা ধায়া যায় কও কোন ধাম?
বরং তোমার থিকা দয়াবতী জোয়ার তিস্তার। (৩২)
রচনা দীর্ঘ করতে চাই না। আমার যা বলার তা বলা হয়ে গেছে। রঘুবংশমের সূত্রপাতে কালিদাস লিখেছিলেন,
বাক্ এবং অর্থ, পার্বতী-পরমেশ্বরের মতোই অবিচ্ছেদ্য।
শ্রীমতী আমিন, শামসুল হকের কবিতার চমৎকার অনুসৃজন করেছেন। অনুবাদের পরিশিষ্টে রেখেছেন মুন্শিয়ানা। ভালো লাগল বঙ্গ ইতিহাস গবেষিকা বঙ্গের বিশেষ অঞ্চলের ভাষার আবহমান প্রবহমানতাকে অন্তর্গত করতে চেয়েছেন এবং আমাদের কাছে সেই অনুসৃজন উপহার দিয়েছেন বলে। 
অনুলিখন ও সম্পাদনা – শৌভিক মুখোপাধ্যায়