পরের গল্প

অর্ণব রায়

নিমু ডাক্তারের বাড়ি পার করে বাঁয়ে ঘুরে দু-প্যাডেল সাইকেল চালালেই ভূদেব উকিলদের এজমালি জোড়া পুকুর। এই পুকুরের ধারেই একটু ঝোপমতন আড়াল করে নিজের পরের গল্পটিকে পড়ে থাকতে দেখলেন পরিতোষ রায়। এখনো নিশ্চয়ই কেউ দেখেনি। দেখলে কি আর এভাবে পড়ে থাকে! না, থাকে না। এ-যাবৎ লেখা পরিতোষ রায়ের সব গল্পে ইতোমধ্যেই একজন-দুজন করে লোক জড়ো হতে হতে ভিড় জমে যায়। ভিড়, তার গল্পের প্রাণ। লাল মেঝেতে একমুঠো সাইকেলের বলবেয়ারিংয়ের মতো তারা ছড়িয়ে পড়ে জমাট বাঁধে, ঝামেলা করে, মারপিট বাধায়। নানারকম কথায়, হাবেভাবে তার গল্পদের জ্যান্ত ছটফটে করে তোলে। কলাইয়ের ডালমাখা ভাত যেমন হুড়হুড় করে গলা বেয়ে নেমে যায় পেটের দিকে, পাঠকও গল্পের টানে টানে তার লেখার শেষ লাইনে পৌঁছে যায় কখন যেন। তাই ভিড় জমে ওঠার আগেই তাকে এই পরিবেশ-পরিস্থিতি এই আধো অন্ধকার, ঝিঁ-ঝিঁ আর ব্যাঙের ডাক, কালো হয়ে আসা পুকুরের জলে জলফড়িংদের দাগ ফেলে ফেলে ভেসে যাওয়া, মশার ঝাঁকের গুনগুন, তুলসীবাড়ি মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ সবসমেত গল্পটিকে নিটোলভাবে তুলে নিতে হবে। সাইকেলটাকে স্ট্যান্ড করে পরিতোষ রায় এক-পা, দু-পা করে এগিয়ে যান।

‘জলার ধারে দু-হাত ছড়িয়ে পড়েছিল মেয়েটি। মুখের একপাশ চুলে আর ঘাসে ঢাকা পড়ে আছে। পরনের কাপড় এলোমেলো। ছড়ানো একটি হাতের পাতা গিয়ে পড়েছে জলে। ঢেউয়ে অল্প অল্প নড়ছে।’

প্রথম কয়েকটা লাইন তো হাতেপাতেই তৈরি হয়ে যায়। খুব বেশি নজর করে দেখতেও হয় না। তারপর? তারপরই তো আসল খেলা। ফাঁকা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তরোয়াল চালানো। যেদিকেই চালাও হাওয়াই কাটবে। যেদিকে পা ফেলবে, সেই রাসত্মাতেই গল্প এগোবে। যে-কোনো কিছুই তো হতে পারে। ধর্ষণ! খুন! প্রাণ কি একেবারে নেই দেহে?

‘পার্লার থেকে বেরোতে আজ অনেকটাই দেরি হয়ে গেল। পুজো-ঈদ কিচ্ছুটি নেই, তাও কি কাস্টমারের কমতি আছে। তার ওপর সুলেখাটা আজ না বলে-কয়ে ডুব মেরেছে। নিশ্চয়ই ওই সবজিওয়ালা কেষ্টোটার সাথে সিনেমায় গেছে। এ সপ্তাহেই তো পোসেনজিতের বই রিলিজ করল না! সে যে একটু সিনেমায় কি মেলায় যাবে, বা একটু শখ-আহ্লাদ করবে, তার কি এতটুকু উপায় আছে! আর পার্লারের দিদির কথা তো যত কম বলা যায় ততই ভালো। যেই দেখবে পার্লারে মেয়ে কম, অমনি ওর ওপর পিরিত একেবারে উথলে উঠবে। ‘এই দুটো কাস্টমার একটু করে দে বাবু। এই তো একটা ফেসিয়াল আর একটা ভুরু পস্নাক। কতটুকু আর সময় লাগবে! ওরকম মুখ বেঁকাচ্ছিস কেন? চা খাবি? দাঁড়া গোবিন্দকে বলি।’ জোড়া পুকুরের ধারে আসতেই গা-টা কেমন ছমছম করে ওঠে। রাসত্মায় লোকজনও নেই সেরকম। কারা যেন পেছনে আসছে মনে হচ্ছে না?’

নাকি সুইসাইড কেস! ও বাবা, তাতে তো আবার শতেক ফ্যাকড়া! প্রেমে ব্যর্থ থেকে মোবাইলের জন্য বায়না, কিছু একটা লেজুড় ধরে ঝুলে পড়লে বা শিরা বরাবর বেস্নড চালিয়ে দিলেই হলো। না না, সুইসাইড তো বাড়িতে করবে। সবার আড়ালে। একা একা। একা একটি জোয়ান বয়সের মেয়েকে সুইসাইড করার জন্য পুকুরের ধারে এনে ফেললে গল্প দাঁড়াবে না। যদি না সে জলে ডুবে মরতে আসে। কিন্তু তাহলে তো বডি জলে ভাসবে। এভাবে পুকুরের পাড়ে পড়ে থাকবে না। মেয়েমানুষের লাশ। চিৎ হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ভেসে থাকবে। ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলবে। চারদিকের পাড়ে ভিড় করে থাকবে মানুষ, কেউ এগোবে না। কিন্তু এরকম লাশ রাত পার করে আবছা আবছা সকালে ভেসে উঠলেই ভালো মানায় না কি?

‘বাঁশ আর কলাগাছ বেঁধে তড়িঘড়ি বানানো ভেলাটা দ্রম্নত মাঝপুকুরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল যুগী। তার পায়ের কাছে বেড় দিয়ে ফেলে রাখা মোটা কাছি দড়ি। তাড়াহুড়োয় ভেলাটা জুত করে বাঁধা হয়নি। ফাঁকফোকর দিয়ে এন্তার জল চোয়াচ্ছে। কাছি দড়িটা ভিজে ভিজে যাচ্ছে। ভেলার ঢেউয়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে বডিটা একটু একটু করে পেছিয়ে যাচ্ছে।’

এক মিনিট এক মিনিট। এলাকার পুকুরে মেয়েমানুষের বডি ভেসে উঠল, পাবলিক জমা হলো। আর পাড়ার ছেলে-ছোকরারা সাঁতরে গিয়ে বডি পাড়ে তোলার বদলে কলাগাছ আর বাঁশ দিয়ে ভেলা বানাতে বসল? ইয়ার্কি না কি? সাপ-ব্যাঙ যা হোক একটা লিখে দিলেই হলো!

সাপের কথায় মনে হলো, সাপে কাটা কেস নয়তো? গরিবের মেয়ে। দিনের শেষে পুকুরে গা ধুতে, কি পুকুরপাড় থেকে কলমি বা নালতে শাক তুলতে এসে সাপের কাপড় খেল। সম্ভব, খুবই সম্ভব। কিন্তু তাহলে ব্যাকগ্রাউন্ডটা কী হবে?

‘আজকের গল্প’ থেকে উদয়নদা ফোন করেছিল। একথা-সেকথা, লেখা চাওয়া, পিএনপিসির পরে বলল, বুঝলে, তোমার গল্পে পাগল, মাতাল, চোর, বেশ্যা – এরা সব বড় বেশি করে চলে আসছে হে। আমি এটাকে খারাপ বলছি না। কিন্তু বারবার এই ধরনের মানুষদের, মানে ওই যাকে বলে প্রান্তিক মানুষদের তোমার লেখায় ঘুরেফিরে আসতে দেখলে একজন মনোযোগী পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, তুমি কি তাহলে সাধারণ গেরস্ত মানুষদের নিয়ে, তাদের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ নিয়ে গল্প লিখতে পারো না?

ফোন রাখার আগে ও পরে মনে মনে গুছিয়ে খিসিত্ম করলেও উদয়ন দত্তের কথাগুলো সেদিন থেকে মাথার মধ্যে খচখচ করতে থাকে। কিন্তু গরিবের মেয়ের সাপে কাটার গল্পকে আগে-পিছে, ওপর-নিচে কোনদিকেই বা টেনে নিয়ে যাবেন তিনি? সহানুভূতির তাস খেলবেন? না কি অসহায় মেয়েটিকে ভূতে ধরাবেন?

গরিবের মেয়ে। পোশাক-আশাক কেমন? একটু কাছে না গেলে বোঝা যাচ্ছে না। একবার ভালো করে নজর না করতে পারলে খুঁটিনাটি ডিটেইলে ভুল থেকে যাবে। পরিতোষ পায়ে পায়ে ঢালটা বেয়ে নামতে থাকেন। পেছল। গোড়ালি সমান ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে পায়ের বুড়ো আঙুল গেঁথে গেঁথে নামতে থাকেন তিনি। ভিজে নরম কাদামাটি। ঠান্ডা। জোলো। জলের কিনার ঘেঁষে দুনিয়ার ময়লা ফুলমালা ভাঙা হাঁড়িকুড়ি মূর্তির কাঠামো জমা হয়ে আছে। মাথা তুলে তাকাতে কালো জলের বিসত্মার ওই দূর পর্যন্ত দেখা গেল। পুকুর হিসেবে বিরাটই বলা যায়। এই বিরাট কালো হয়ে আসা আকাশের তলে জলের ধারে একা একটি মেয়ে পড়ে আছে। গল্পে রাখার পক্ষে খুবই লোভনীয় দৃশ্য। এরকম দৃশ্যেই তো গল্প শুরু হবে বা আচমকা শেষ হবে।

নামতে নামতে মেয়েটির প্রায় শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েন পরিতোষ রায়।

সিংহরায় বাড়ির মাসমাইনের গোয়ালা রতন পাশ থেকে খিঁচিয়ে ওঠে, ‘আরে আফনে কি আকাশ নদী ঘাস এইসব লিয়্যা লিখবেন না কি? সেসব তো আফনের বাড়ির ছাদ থেকেও দেখতে পাবেন। মেয়াটা যে কখুন থেক্যে আফনের লেগ্যা বুক ছিতরায়ে পড়ে আছে, উয়ারে আগে দেখেন।’

রতনকে পরিতোষ রেখে এসেছিলেন সিংহরায়দের গোয়ালে। সেই সেদিন সকালবেলা যখন কালীগাইয়ের বাছুর মরে যাওয়াতে দুধ দিচ্ছিল না, এই রতনই না খড় আর চামড়া দিয়ে গরুর মাথার মতো কিছু একটা বানিয়ে গাইকে দেখিয়ে দুধ দুইয়েছিল। এখনো ওখান থেকেই উঠে এসেছে মনে হচ্ছে।

পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন, মণাক্ষক্ষপী ওর বিরাট পুঁটলিটা কাঁখে করে কখন এসে দাঁড়িয়ে গেছে। কাপড়চোপড়ের যথারীতি কিছু ঠিকঠিকানা নেই। একমনে একটা নোংরা শাঁকালু কামড়াচ্ছে। সামনে দাঁড়ালে ওর বিরাট বিরাট দুই বুকের দিকে চোখ না পড়ে থাকবে না। ওকে লেখার সময়ও পরিতোষের তা-ই হচ্ছিল। সমস্ত শরীরের মধ্যে বুকের কথাই বারবার চলে আসছিল লেখায়।

রসক্ষ্যাপা তারক, খালপাড়ের বসিত্মর বসত্মা মেলে, নদীতে মরে যাওয়া ধীরেন হালদার, জানপাগলা, হোমো আনন্দগোপল – সবাই ভিড় করে এসেছে পুকুরের ধার ঘেঁষে, তার চারপাশে। প্রায় সকলের সমবেত এক ইচ্ছায় পরিতোষ ঝুঁকে পড়ে মেয়েটির এলানো হাতটা ধরেন। এ ঠান্ডা তিনি পেয়েছেন সকালে মাছবাজারে মাছের চুবড়ির মধ্যে হাত ভরে। তেমনই ভেজা, মাংসল।

‘জয়দেব ডাক্তারের বাড়ি পার করে বাঁয়ে ঘুরে দু-প্যাডেল সাইকেল চালাতেই মনোহর উকিলদের এজমালি জোড়া পুকুর। আর এই পুকুরের ধারেই একটু ঝোপমতন আড়ালে মেয়েটিকে পড়ে থাকতে দেখলেন পরমেশ রাহা।’

হিসাবমতো এবার তাহলে পাবলিকের চলে আসা উচিত। বর্ষাকালের পিঁপড়ের মতো হুড়হুড় করে পুকুরের চারপাশ ভরে দেবে। বড়দামতন কেউ এসে খপ করে বাঘের মতন চেপে ধরবে। ‘কে রে তুই? এই অন্ধকারে পুকুরধারে মেয়েমানুষের বডি নিয়ে কি করছিস?’ এরপরই পরিতোষ রায়ের খেলা। কত রকমভাবে যে এই ভিড়কে খেলানো যায়! কখনো এরা ‘শালা চামড়াচোর’ বলে ফেলে মারে। কখনো ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে বেঁধে গায়ে পেচ্ছাব করে দেয়।

আসে না। সেরকমভাবে হইহই করে কেউ তার দিকে তেড়ে আসে না। বরং পুকুরধারে একজন-দুজন করে আরো কেউ কেউ জড়ো হয়। তারা নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলে। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। অন্ধকারে ওদের চোখের সাদা দেখা যায়। ওদেরকে চিনতে পারেন না পরিতোষ। কোন গল্পে লিখে রেখে এসেছেন ওদের? নাকি এক বছর দুবছর পাঁচ বছর পরে লিখবেন এরকম কোনো গল্প থেকে উঠে এসেছে ওরা?

খোঁচা খোঁচা হয়ে উঠে থাকা ঘাস, ঝোপ, মাকড়সার ঝুল, গেঁড়ি গুগলির খোল, কাদা – এসবের মধ্যে উবু হয়ে গল্পটির পাশে বসেন পরিতোষ। খুব আলতো করে পরের পর্বে চলে যান। এবারে মুখের বর্ণনা। আন্নাবুড়ি তার বাড়ির বাগান থেকে ইস্স করে ওঠে। কেউ একটা ‘আহারে’ বলে উঠলেও কানে নেন না পরিতোষ। গল্পের প্রতি দুর্বলতা গল্পকে দুর্বল করে দেয়।

‘ভিড়ের মধ্যে এবার একটা গুঞ্জন উঠল যা ক্রমে বড় হতে লাগল। কে মেয়ে? কাদের বাড়ির মেয়ে? এখানে কে ফেলে রেখে গেল? মুখটা চেনা চেনা লাগছে না?’

দেখব, না কি নিজে থেকে বানিয়ে লিখব? ‘মেয়ে কই? নারী চরিত্র কোথায় তোমার গল্পে? একখানা গল্প নারীর পারস্পেক্টিভে লিখতে পারো না, কেমন গল্পকার তুমি?’ বলেছিল শিখা। শিখার সঙ্গে বিয়েটা তখনো বিষ হয়ে ওঠেনি। তখনো জোরজার করলে তার লেখা দু-একটা পড়ত। কিন্তু মুখ? মায়া, সে বড় মায়ার বস্ত্ত। একবার তিলে তিলে শব্দে শব্দে চোখ নাক চুল তাকানো হাসি অভিমান তৈরি করে ফেললে, আর তার সঙ্গে কিছুতেই খারাপ কিছু করতে পারবেন না লেখায়। বাস্তবেও কি পারবেন? পেরেছেন? শিখা সত্যি সত্যি কতটা শিখা ছিল, আর কতটা ছিল পরিতোষের মনের বানানো? তাই তো শুধুই শুনে গেছেন, ‘লেখক হয়েছো, লেখক? আগে মানুষ হও, তারপর লেখক হবে।’

‘চেনামুখই তো। আমার চেনামুখ, আপনার চেনামুখ। রোজ সকালে চায়ের কাপ সামনে ধরে, ঠেলে ঠেলে বাজারে পাঠায়, ঝগড়া করে, ভাইফোঁটা দেয়, বিছানায় যায় আপনার সঙ্গে, মাথায় হাত বোলায়, বুকে জ্বালা ধরায় – আমার-আপনার মা-বোন-বউ কেউ একটা হবে। কারো একটা মুখ এই ঘাসে জলে পোকা কেঁচো পিঁপড়ে আর সাপের মাঝে হেলাফেলা করে ছুড়ে ফেলে দিন। এই সেই মুখ।’

একটা চায়না টর্চের আলো সোজা এসে মুখে পড়ে। না তাকালে চোখ ধাঁধায় না। প্রতিবর্ত ক্রিয়া। পরিতোষকে তাকাতেই হয়। দৃষ্টির ঠিক মাঝখানে একটা গোলমতো সাদা অন্ধত্ব তৈরি হয়। দৃশ্যে যথেষ্ট নাটক ঢালতে এই আধখানা উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় লাঠির মতো টর্চের আলোর সামনে পরিতোষের হাতে আঁচল বা ওড়নার একটা অংশ দেখা যাওয়া উচিত নয় কি?

পরিতোষ রায়ের গল্পে ওই গোলমতো অন্ধত্বের আড়ে আড়ে কেউ না কেউ তার দিকে এগিয়ে আসবে আর সাঁড়াশির মতো তার হাত চেপে ধরবে। সেকরমই হয়। চোখে টর্চের আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিতোষ নিশ্চিত হন যে, তারই লেখা বা পরে লিখবেন এরকম একটা গল্প তার সঙ্গে হচ্ছে। কিন্তু যে ভিড়কে, যে মাছের ডিমের মতো জোট হয়ে থাকা মানুষের দলাকে তিনি হেলায় ছুটিয়েছেন থামিয়েছেন এক কলমের খোঁচায়, এবার তাদের সন্দেহ হতে থাকে। ভয় হতে থাকে। কারণ তার গল্পে এরকম জনতার বৃত্তের কেন্দ্রে থাকা মানুষটির সঙ্গে শেষ অবধি কী হয়, তা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে! সে বীভৎস পরিণতির কথা তিনি কোনো গল্পে সাহস করে লিখে পর্যন্ত উঠতে পারেননি। ছোটগল্পের আকস্মিকতার দোহাই দিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন। এখানে তাদের কে থামাবে? যখন তাকে ঘিরে থাকা ভিড় ক্রমে বৃত্ত কমিয়ে কমিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসবে, কে শেষ দাঁড়িটা টানবে?

না কি নিজের গল্পের ভেতরে আছেন বলে এরা সব তার ইশারায় চলবে? লেখক তার নিজের গল্পের ভেতরে থাকলেও, পাবলিকে তাকে ঘিরে ধরে মারতে থাকলেও, গল্পের কি কিছু আসে-যায়? গল্প একবার যে রাসত্মায় চলতে শুরু করে দিয়েছে, লেখকের খাতিরেও কি আর সে রাসত্মা বদল করবে?

দুজন মাঝবয়সী লোক টর্চ ফেলতে ফেলতে কাদা বাঁচিয়ে সাপখোপে ভয় পেতে পেতে পড়ে যাওয়া সামলাতে সামলাতে তার দিকে এগিয়ে আসে। আর কি আশ্চর্য, বেশ ভদ্রভাবেই তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কে? এখানে কী করছেন? এই মেয়েটি কে? ইত্যাদি।

ব্যাপারটা বেশ পছন্দ হয় পরিতোষের। বা রে, পাবলিক প্রথমেই রে রে করে তেড়ে না এসে বেশ ভালোভাবে প্রশ্নটশ্ন করছে। এরকমও হয় না কি? এটাকে পরের গল্পে ব্যবহার করতে হবে তো! এরা কি তার পোশাক-আশাক দেখে ভদ্রলোক বুঝে প্রথমেই চড়-থাপ্পড় দিয়ে শুরু করছে না? না কি এটা তার গল্প বলে তাকে রেয়াত করা হচ্ছে?

তারা আবার প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার? এখানে কী হয়েছে? এই মেয়েটা কে? বেঁচে আছে, না মারা গেছে? আপনি কে? এখানে কী করছেন?

এক পরিতোষ দুজন হয়ে যান। এক পরিতোষ বলেন, হাউমাউ করেই বলেন, আমি কিছু জানি না দাদা। আমি এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। টর্চের আলোয় দেখলাম জলের ধারে মানুষের মতো কি একটা পড়ে আছে। তাই দেখতে এলাম। আমি কিছু করিনি ভাই। দেখেন, আমি অমুক অফিসে চাকরি করি। তমুকবাবুর বাড়িতে ভাড়া থাকি। এই টাউনে অনেকদিন আছি। অনেকেই আমাকে চেনে। ওই তো বয়েজ ইস্কুলের মোটা করে মাস্টারটা, কী যেন নাম, দরবেশপাড়া বাড়ি, আমাকে দাদা দাদা করে। তারপর ধরেন গিয়ে ব্যাংকের পিয়ন রামরতন, তুলসীবাড়ির সফিকুল টেলার – এরাও ধরেন আমাকে চেনে। আমি কিছু জানি না ভাই।

আর এক পরিতোষ ঘাড়ট্যারা করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি নিশ্চিত, এটা তারই গল্প। তা না হলে এই ঘিরে ধরা জনতা, সামনে পড়ে আছে ঠান্ডা শরীরের বয়সের মেয়েমানুষ, আশপাশে আর কেউ নেই, তার হাতে ধরা মেয়েটির ওড়না বা আঁচল – এটা তার লেখা গল্প না হলে এরা তাকে এত খাতির করে কথা বলে?

আর তখনই তার মনে সন্দেহটা সাপবাজির মতো হুশহুশ ধোঁয়া নিয়ে গোলস্না পাকিয়ে ওঠে, তার লেখা গল্প হলে তো পাবলিক এরকম পরিবেশে হাতেনাতে ধরাপড়া মানুষকে এমন খাতির করে কথা বলবে না। এটা তবে কার গল্প? কে আড়াল থেকে বুকে বালিশ নিয়ে পাশে সিগারেটের প্যাকেট-লাইটার আর জলের বোতল রেখে কালো কালির পাইলট পেনে খস্খস্ করে তাকে সমেত এই গল্পটা লিখে চলেছে?

দুই পরিতোষেরই বা এক পরিতোষের বা তিন-চার যে-কোনো সংখ্যক পরিতোষের কানে একসঙ্গে ঝনঝন করে বেজে ওঠে, কে এই মেয়েটা? কী করেছেন আপনি এর সঙ্গে? কে হয় এ আপনার? কুকাজ করে ফেলে রেখে যেতে এসেছেন?

সবকটা পরিতোষ একসঙ্গে বা সব পরিতোষ এককণ্ঠে বলে ওঠে, না না না, ফেলে যেতে আসিনি। আমি তো বরং তুলে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। ওই মুখের অল্প হাঁ হয়ে থাকা, বন্ধ চোখের ফাঁকে বেরিয়ে থাকা চোখের সাদা, এলিয়ে পড়ে থাকা হাতের ভঙ্গিটি, নখের ফাঁকে ঢুকে যাওয়া কাদা, ছড়িয়ে থাকা পা – এই আকাশ মাটি জল সন্ধের আলো – সবসমেত কুরনি দিয়ে কুরে কুরে, শব্দ বাই শব্দ অক্ষর বাই অক্ষর তুলে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। একে আমি ফেলে রেখে যেতে পারি? এ যে আমার পরের লেখাটি! যতক্ষণ না সাদা পাতায় কালো কালো অক্ষরে নামিয়ে ফেলতে পারছি, ততক্ষণ এ আমার বুকের মণিটি। তুলতুলে, ভঙ্গুর।

ওরা বোধহয় তার এতগুলো কথা শুনতে পায় না। দুতিনজন মিলে তার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে থাকে।

পুলিশ কই, পুলিশ? এখুনি পুলিশ আসা দরকার। বুদ্ধিমান লোকজন তো কম নেই আশপাশে। সামনে মেয়েমানুষের বডি পড়ে আছে, একটা লোককে সন্দেহের বশে পাবলিক আটক করে রেখেছে, যে-কোনো সময় গণধোলাই শুরু হয়ে যাবে, কারোর মাথায় এলো না, এরকম সময় পুলিশে একটা খবর দেওয়া দরকার? নিজেরই হোক আর যারই লেখা হোক, গল্পটির ওপর অত্যন্ত বিরক্ত হন পরিতোষ। ছি ছি ছি, এটা কি একটা গল্পের শেষ হলো! এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, একটা পুলিশের দেখা নেই!

ওরা তাকে ধাক্কা দিতে দিতে পাড়ের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। পরিতোষ জানেন, এই দৃশ্যেই গল্পটা শেষ হয়ে যাবে। আয়নার মুখোমুখি আয়না বসিয়ে আয়নার ভেতর দিয়ে অনন্ত পথ। গল্পের লেখক, লেখকের গল্প পরপর বুকের বালিশ ঠেলে উঠে যাবে। সিগারেট ধরাবে। বড় করে শ্বাস ফেলবে, যাক শেষ হলো বলে। এরা কিন্তু তাকে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে যেতেই থাকবে। জল থেকে ডাঙার দিকে। ছোটগল্প থেকে উপন্যাসের দিকে। r