পলাতকা ছায়া

সনৎকুমার সাহা

 

বইটির কবিতাগুলো নিয়ে কাউকে খুব একটা কথা বলতে শুনি না। তাঁর ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’র ভাগ্য বুঝি এদেরও। পেছনে গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালির (১৯১০-১৪) এক সুসম্পূর্ণ ও বিশ্বনন্দিত ভুবন; তারপরই সাহসী পালাবদল এগিয়ে-যাওয়া বলাকায় (১৯১৬)। একটু ক্ষান্তি দিয়ে অল্পসময়ের একপশলা বর্ষণ – পলাতকার (১৯১৮) প্রায় এক ধরনের এই কটি কবিতা। মোট সংখ্যা পনেরো। শিশু ভোলানাথ (১৯২২) পড়ার সময় মন কেমন করে। স্মৃতি-বিস্মৃতির শৈশব, কাছের-দূরের কল্পনার-করুণার-অসহায়তার শৈশব, ওই জগতের মায়ায় আমাদের বাঁধে। তাদের নির্বিকার সরলতা মহার্ঘ্য। কিন্তু তারা পূর্ণ প্রাণের সুখ-দুঃখ আকুতির গভীরতার বা সীমা ছাড়ানোর কোনো অনুভব জাগায় না। ফিরে আসে তা পূরবীতে (১৯২৫)। বলাকার পর সেই ধারায় যেন আবার যুক্ত হওয়া। তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর আবার সার্বিক। চৈতন্যসমগ্রের কাছে তাদের আবেদন। এবং বিশ্বচরাচরের সমস্তটাকেই তারা এরপর ক্রমাগত গ্রাস করে চলে। আসক্তি থেকে নিরাসক্তিতে; কিন্তু সত্যকে ধ্রুবতারা করে, যে-সত্য নিজের বাস্তবের অভিঘাতে ক্রমাগত ভোল পালটায়। কবির মানবিক অভিযান তাই অনিঃশেষ, কিন্তু প্রবলভাবে সমর্থ, নির্ভয় ও মর্মার্থী। এবং সে-কারণে বহুরূপী বাস্তবতায় চলমান সত্যের পরিবর্তমান স্বরূপের মুখোমুখি হতে তাঁর বাধে না। আঘাতকে অপবাদকে তিনি এড়িয়ে যান না। ‘অন্ধকারের অন্তরে’ও তাঁর দৃষ্টি। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা সুন্দরের এবং সুদূরের। এই প্রেক্ষাপটে পলাতকার প্রায় অনালোচিত, কিছুটা যেন ছায়াবৃতা, কবিতাগুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দিই। তবে তার আগে একটা কথা, প্রায় সবাই বলে, চোখ অন্যদিকে ফেরান, তার ভাবার্থ বোঝার কিঞ্চিৎ চেষ্টা করে নিই। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত শোক-দুঃখের ছাপ এখানে ধরা পড়ে, বিষয়টা এই নিয়ে। তা থাকতে পারে এবং তাতে কবিতা যদি গভীরতর ব্যঞ্জনা পায়, তবে এ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ইদানীং একটা বাতিক কারো কারো ভেতরে লক্ষ করি, তাঁরা তাঁর সব রচনাকেই আত্মজৈবনিক বলে তার ওপর একের পর এক ফতোয়া জারি করে চলেন। প্রেমের কবিতা হলে তো বাজার গরম করতে অণুবীক্ষণ-দৃষ্টিতে পরকীয়ার সাত-সতেরোর ইঙ্গিত মেলে সবখানে। তারপরে সব এক করে রবীন্দ্রনাথকে পণ্য করে লেখালেখির ব্যবসা চলে ভালোই। প্রেরণা আসে বাইরে থেকে। সেখানে জীবনী উপন্যাসে অনেক রগরগে ব্যাপার-স্যাপার থাকে। আমাদের রকবাজ-লুম্পেন সমাজের চালাক-চতুরেরা মনে করেন, আমরাই বা কম কিসে! মুশকিল একটা বাধে, সেখানে উল্লেখযোগ্য পাত্র-পাত্রী খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। বিশেষ করে এমনসব মানব-মানবীকে, যাঁদের নাম পৃথিবীজোড়া, এবং যাঁরা আমাদের চেতনাকে প্রসারিত করেছেন অনেক দূর। তাঁদের যদি নামিয়ে আনা যায় রিপুতাড়িত কুকুর-বেড়ালের সারিতে, তবে সহজেই বলা যায়, আসলি বাত্ এই। নিজেদের অবস্থানকেও যৌক্তিক ও সংগত মনে হয়। রঞ্জন সাবানের ভেজাল-মেশানো ফেনিল বুদ্বুদে গা যতই চটচট করুক, আর মগজ যতই ফাঁকা লাগুক, তার তাৎক্ষণিক আমোদে অনেকেই আমরা মজি। কালের অসংগতি থোরাই কেয়ার করি। আর ইতরতাই যদি সামাজিক লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা সাধারণ স্বীকৃতিও পায়। এই স্বীকৃতি পাওয়াটাই ওই সময়ে বাস্তবের লক্ষণ। যাঁদের নিয়ে লেখা, তাঁদের নিজেদের বাস্তবতা থাক, বা, না-থাক।

অন্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা একটা চিঠি থেকে এখানে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃতি দিই। ১৩২২ বঙ্গাব্দে (১৯১৫-১৬ খ্রিষ্টাব্দ) ঘরে-বাইরে উপন্যাস সবুজপত্রে ধারাবাহিক বের হয়। বই হয়ে বেরোয় ১৩২৩-এ। ধারাবাহিক প্রকাশের সময় এক চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্রতেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে লেখেন, ‘… এই আখ্যায়িকাটি অধিকাংশ গল্পের আখ্যায়িকার মতোই আমার কল্পনাপ্রসূত।… ঠিক একটা গল্পের ঘটনা সেই গল্পের অনুরূপ অবস্থার মধ্যেই ঘটতে পারে, আর কোথাও ঘটতে পারে না… কোনো বিশেষ পরিবারে কী ঘটেছে সে-কথা স্মরণ করে গুজব করাই চলে, গল্প লেখা চলে না। মানবচরিত্রে যেসব সম্ভবপরতা আছে সেইগুলিকেই ঘটনাবৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে গল্পে নাটকে বিচিত্র করে তোলা হয়। মানবচরিত্রের মধ্যে চিরন্তনত্ব আছে কিন্তু ঘটনার মধ্যে নেই। ঘটনা নানা আকারে নানা জায়গায় ঘটে, একই ঘটনা দুই জায়গায় ঠিক একই রকম ঘটে না। কিন্তু তার মূলে যে মানবচরিত্র আছে সে চিরকালই নিজেকে প্রকাশ করে এসেছে। এজন্য সেই মানবচরিত্রের প্রতিই লেখক দৃষ্টি রাখেন, কোনো ঘটনার নকল করার প্রতি নয়।…’ (রবীন্দ্র উপন্যাস সংগ্রহ, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ১৯৯০, পৃ ১২৯৬)

এও সত্য, লেখক মানবচরিত্রের সম্ভবপরতা তাঁর স্থান-কাল তাঁর চৈতন্যে যতভাবে-যতদূর দেখায়, তার ভেতরেই কল্পনায় প্রত্যক্ষ করেন। ঘটমান বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে নয়। সেও তার অনিবার্য উপাদান। তবে একমাত্র নয়। এবং তাঁর পছন্দ-অপছন্দকে তা প্রভাবিত করে অবশ্যই। তাঁর ব্যক্তিগত আচরণকে আরো বেশি। উনিশ শতকের শেষে বা বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের এক বিশিষ্টজন। দেবেন্দ্রনাথ বেঁচে। তাঁর রক্ষণশীলতাকে অমান্য করার সাহস রবীন্দ্রনাথ পিতার জীবদ্দশায় কখনো দেখাননি। অবশ্য তাঁর নৈতিক দৃঢ়তা গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। যখন তিনি নষ্টনীড় লেখেন দেবেন্দ্রনাথ তখনো বর্তমান। তাঁর পারিবারিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে, এমন কিছুর আভাস ওই সময়ে কবি গল্পেও দিতে পারতেন বলে মনে হয় না। নষ্টনীড়, অতএব, নষ্টনীড়ই। বাস্তব ঘটনার স্থূলতা দিয়ে তাকে কদর্য না করাই ভালো। অবশ্য বাস্তব সম্ভবপরতা তার যে-কোনো সময় থাকতে পারে। এজন্যেই তা আমাদের ভাবনাকে আকৃষ্ট করে। বিপর্যস্তও করে।

বিপরীত দিক থেকে বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আর একটা জায়গায় দৃষ্টি আকর্ষণ করি। প্রতিভাবান ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহধন্য ছিলেন। মৃণালিনী দেবীর, আরো। তাঁর অকালপ্রয়াণ যখন ঘটে, দেবেন্দ্রনাথ তখনো বর্তমান। বলেন্দ্রনাথের বালিকাবধূকে তাঁর বাবা কাশীতে নিজের কাছে নিয়ে যান এবং পুনর্বিবাহের উদ্যোগ নেন। দেবেন্দ্রনাথ জানতে পেরেই তা ঠেকাতে রবীন্দ্রনাথকে কাশী পাঠান। তাঁর অন্য ছেলেরা কেউ তাঁর আদেশ মানেননি। বিধবা বালিকাবধূকে ‘উদ্ধার’ করে এনে রবীন্দ্রনাথ বীরদর্পে বাবার কাছে সমর্পণ করেন। অথচ এই পলাতকাতেই আমরা দেখব এর বিপরীত আখ্যানচিত্র। আমরা জানি, তার আগেই উনিশ শতকের শেষাশেষি তখনকার আধুনিক ব্রাহ্মসমাজে বেশকটি উল্লেখযোগ্য বিধবা-বিবাহ ঘটেছে। সেইসব পরিবার ছিল বিখ্যাত এবং পরবর্তী প্রজন্মে কেউ কেউ বিশ্বখ্যাত। রবীন্দ্রনাথের কিন্তু তখনো সংস্কারের দাসত্ব ঘোচেনি। তা অবশ্য ঘুচেছে মহর্ষির মৃত্যুর পর। নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথের ঠাকুর-পরিবারেই বাল-বিধবা প্রতিমা দেবীর সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি নিজেই পৌরোহিত্য করেন।

এটাও আমাদের ধাঁধায় ফেলে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর তিন মেয়েরই বিয়ে দিয়েছেন নিতান্তই বালিকা বয়সে। অথচ সত্যেন্দ্রনাথ-জ্ঞানদানন্দিনীকন্যা ইন্দিরা দেবীর যখন বিয়ে হয়েছে, তখন তাঁর বয়স বিশ পেরিয়ে গেছে। তাঁর স্বামী প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের শুধু স্নেহধন্য নন, তাঁর চিন্তার সঙ্গীও। তাঁর উৎসাহেই রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্রে লেখেন। নিজের লেখায় তাঁর পালাবদল ঘটে। তার আগে উনিশ শতকেই ইন্দিরাকে লেখা তাঁর চিঠিগুলো ছিন্নপত্র, বাংলা পত্রসাহিত্যে চিরকালের সম্পদ। এই পরিবারের আর এক কন্যা সরলা দেবীরও বিয়ে হয় এক পাঞ্জাবি পাত্রের সঙ্গে। মেয়ের বয়স এখানেও বিশের ওপরে। ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে সরলা দেবীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে উদ্দীপনা সঞ্চারে।

এই পর্বে অর্থাৎ উনিশ-বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে মনে হয়, তিনি যে বৃহৎ সমাজের এক প্রধান পুরুষ, এ-কথা রবীন্দ্রনাথের অবচেতনে নিরন্তর কাজ করে চলেছে। ব্যক্তিগত আচরণে কোনো বিদ্রোহ তিনি করেননি। প্রচলিত নিয়মের বাইরে যাননি। তাঁরা যে ছিলেন পিরালি ব্রাহ্মণ, এটাও একটা ব্যাপার। কোনো যোগ্য পাত্র সেধে তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে আসবে না, এ-বিষয়টাও তাঁকে চিন্তায় ফেলেছিল। মেয়েদের বাইরের জগতে বেরোবার যথেচ্ছ অধিকার তিনি কিন্তু দেননি। প্রাচীন ভারতের সমাজচিত্র তাঁকে তখন অনেকটাই আচ্ছন্ন করেছিল।

মেয়েরা তাঁর অশিক্ষিত ছিল না। কিন্তু ইন্দিরা দেবী বা সরলা দেবীর মতো বাইরে তারা পড়েনি। স্কুলে শিক্ষায় তাঁর যে একটা অনাস্থা ছিল, এটাও এখানে কাজ করে থাকতে পারে। পরে অবশ্য তিনি নারীর অধিকার প্রবলভাবে সমর্থন করেছেন। মহুয়ার (১৯২৯) কবিতাগুলোয় তার প্রকাশ অনিরুদ্ধ।

পলাতকার কিছু আগে বলাকার সমসময়ে, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ১৩২৩-এ) তিনি লেখেন ছোট একটি উপন্যাস, চতুরঙ্গ। নানা কারণে এটি বিশিষ্ট। প্রথম ছাপা হয় সবুজপত্রে। অথচ ভাষা ওই পত্রিকার ঘরানার নয়। এখানে কথোপকথনেও সাধু ক্রিয়াপদের ব্যবহার। কিন্তু বিষয় জীবনের মৌলিক প্রশ্নে নিবিষ্ট। কোনো সদুত্তর মেলেনি এখনো। হয়তো মিলবে না কোনো দিনই। তৃপ্তি-অতৃপ্তির পূর্ণ-অপূর্ণ মায়া – নাকি সত্য-স্বরূপ – নির্বাচিত মানব-মানবীর ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতায় তিনি খোঁজেন। কিন্তু শেষ মেলে কই? ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে?’ – ব্যাপারটা কি তাই? আমি একে রবীন্দ্রনাথের সেরা সৃষ্টির একটি মনে করি। তাঁর বহুগানের রেশ এতে ভেসে-ভেসে যায়। ভাষা যে অনাধুনিক, তা মাথাতেই আসে না। কিন্তু আশ্চর্য! এই চতুরঙ্গ নিয়ে বিশেষজ্ঞ বা রসিকজনদের উৎসাহ চোখে পড়ে সামান্যই। অবশ্য একটা অসাধারণ রচনা পড়েছিলাম ইমতিয়ার শামীমের। সে কি কালি ও কলমেই? এখানে কথাটা তোলার কারণ, চতুরঙ্গে দামিনীকে না পেলে বোধহয় পলাতকায় আসতে পারতাম না।

আসলে কবিতা বা কথাসাহিত্যে একজন সত্যিকারের লেখক ব্যক্তিগতভাবে থাকেন, আবার, থাকেন না। তাঁর চৈতন্যেই চলে সৃষ্টির লীলাখেলা। তবে নিজেকে তা থেকে বিচ্ছিন্নও করতে হয় তাঁকে। এই দূরত্ব না থাকলে তিনি নিরাসক্ত হতে পারেন না। যাঁকে মানুষ কল্পনা করে ঈশ্বর বলে, তাঁর তুল্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর চরিতার্থ হয় না। অনেক আগে ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় (১৮৯৭) রবীন্দ্রনাথ ঋষি নারদের মুখে এই স্পর্ধাবাণী বসিয়ে দিয়েছিলেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি,/ …কবি, তব মনোভূমি/ রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ এই ইঙ্গিতটুকু অবহেলা করলে লেখক ও পাঠক, দুদিক থেকেই আমাদের পতন অনিবার্য। তামসিকতায় মগ্ন হওয়াই সেখানে আমাদের নিয়তি।

ভনিতাটুকু সেরে এবার আমরা পলাতকার কবিতাগুলোর দিকে নজর দিই।

 

দুই

আগেই বলেছি, পলাতকায় কবিতাসংখ্যা পনেরো। বেশিরভাগ আখ্যানধর্মী। দুটো বাদে বাকিগুলোয় বলাকার মুক্ত ছন্দের রেশ আছে। তবে গভীর বাণী তেমন করে উঠে আসে না। কোনো-কোনোটি সুস্পষ্ট ছোটগল্পঘেঁষা। বোধহয়, সেগুলোই বেশি সফল। এটাও খেয়াল করার, এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ কোনো ছোটগল্প লেখেননি। কবিতাই বিকল্পে গল্পের বাহন। এমন কবিতা তিনি বরাবর লিখেছেন। আগের ‘দুই বিঘা জমি’, ‘দেবতার গ্রাস’, কথা ও কাহিনীর ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’, ‘পূজারিণী’, বা ‘অভিসার’, এগুলো তো অবিস্মরণীয়। বারবার পড়েও পুরনো হয় না। পরেও লিখেছেন এই রকম অজস্র কবিতা, – যেমন, আকাশ-প্রদীপে ‘বধূ’ বা ‘শ্যামা’র মতো স্মৃতিমেদুর, ‘ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে’র মতো বিষণ্ণ বা, পুনশ্চর ‘ক্যামেলিয়া’ বা ‘সাধারণ মেয়ে’, এখনো যারা পড়ুয়াদের মন জোগায়, মন জাগায়। পলাতকায় এজাতের কবিতাতেও তাঁর স্বাক্ষর চেনা যায়। তবে মনে হয়, কোথায় যেন একফালি করুণার মিশেল রয়ে যায়। যদিও বলা সহজ ঢঙে। যেন কোনো দুঃখকে চাপা দিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা।

কথাটা বোধহয় একেবারে অমূলক নয়। তাঁর মেয়েদের তিনি অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন, সে-কথাটা মনে রাখি। বড় মেয়ে বেলা বা মাধুরীলতার বিয়ে দেন ১৩০৮ সালে। পাত্র কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর চতুর্থ পুত্র শরৎচন্দ্র। বেলার বয়স তখন চৌদ্দো বছর। পরের মাস শ্রাবণেই মেজ মেয়ে রেণুকার বিয়ে। কবির জন্যে অসম্মানই বয়ে আনে। তখন রেণুকার বয়স ছিল সাড়ে এগারো। মেয়ে-জামাই, কেউই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সদাচরণ করেননি। ছোট মেয়ে মীরার বিয়ে দেন ১৩১৪ সালে। পাত্র নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, কবি তাঁর বিলেত যাওয়ার ব্যবস্থা করে সব খরচ জোগাবেন, এই শর্তে বিয়ে করতে রাজি হয়। ছেলে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে জামাই নগেন্দ্রনাথকেও কৃষিবিদ করে গড়ে তোলার জন্যে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা পাঠান। সব বিয়েতেই পাত্রপক্ষ যৌতুক একরকম জুলুম করে আদায় করে। কবির দেশজোড়া ভাবমূর্তি এখানে কোনো কাজে আসেনি। তিনিও প্রথা বা দেশাচার অমান্য করেননি। যাঁরা কবিকে নিয়ে বেয়াড়া অসভ্যতার গল্প ফাঁদেন, তারা এটা খেয়াল করেন কিনা জানি না।

যে-বছরে তিনি পলাতকা লেখেন, সে-বছরেই তাঁর নিঃসন্তান বড় মেয়ে বেলা মারা যায়। সন্তান না হলে ওই সময়ে বিবাহিত মেয়েদের সংসারে কোনো সম্মান জুটত না। বেলারও জোটেনি। এই অকৃতার্থতার গ্লানি নিয়ে তাঁর জীবনাবসান। বিশ্বচরাচরে জীবনমৃত্যুর প্রবাহে তাঁর বেদনাকে মিশিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা খোঁজার প্রসন্ন প্রয়াস পলাতকাতে যেন মিশে আছে।

উপান্তিক কবিতা ‘শেষগানে’ পড়ি –

…তাই তো যখন শেষে

একে একে আপন জনে সূর্য-আলোর অন্তরালের দেশে

অাঁখির নাগাল এড়িয়ে পালায়, তখন রিক্ত শুষ্ক জীবন মম

শীর্ণ রেখায় মিলিয়ে আসে বর্ষাশেষের নির্ঝরিণীসম

শূন্য বালুর, একটি প্রান্তে ক্লান্ত সলিল স্রস্ত অবহেলায়।

তাই যারা আজ রইল পাশে এই জীবনে সূর্য-ডোবার বেলায়

তাদের হাতে হাত দিয়ে তুই গান গেয়ে নে থাকতে

দিনের আলো –

বলে নে ভাই, এই যে দেখা, এই যে ছোঁওয়া, এই

ভালো, এই ভালো।…

আরো একটা কথা বলে নিই। এইটি ও ‘ঠাকুরদাদার ছুটি’, কবিতা দুটির উপস্থাপনায় বলাকার ছন্দের ছাপ নেই। ভাব-ব্যঞ্জনাতেও এদের অন্তর্গূঢ় মিল ধরা পড়ে। পলাতকার অন্য কবিতাকটিতে কিন্তু বলাকা পেরিয়ে আসার ছাপ আছে। যদিও ভাবনা তুচ্ছ জীবনের লীলাভূমিতে।

‘পলাতকা’ ও ‘হারিয়ে যাওয়া’ কবিতাদুটিতেও, অনুমান, বেলা-স্মৃতি আছে। তবে কবিতা পড়ার সময় তা আমাদের মনোযোগে ভাগ বসায় না। প্রতীকী মায়া অথবা সর্বজনীন আকুতি সামনে আসে। আমরা তাতেই মগ্ন থাকতে পারি। কবিতা স্বয়ংসিদ্ধা হয়। এবং তা নিজের জোরেই থাকে। এখন, এবং আন্দাজ করি, আগামীকালের স্রোতে আরো অনেক অনেক এখন।

‘পলাতকা’য় আছে এক পোষা হরিণের কথা, এক কুকুরছানার সঙ্গে যার ভাব। কিন্তু এক ফাগুনদিনে বহুযুগের ওপার হতে কোন সে বাঁশির সুর তার বুকে এসে বাজে। তারই টানে সে ঘর ছাড়ে, মাঠ ছাড়ে, কুকুরছানার সঙ্গ ছাড়ে, ছুটে চলে দূর থেকে অজানা আরো দূরে। কবিতার মুন্শিয়ানায় এ চিরকালের ছবি হয়ে যায়। গোটা কবিতাই ছবির পর ছবি দিয়ে সাজানো –

ওই যেখানে শিরীষ গাছে

ঝুরু ঝুরু কচিপাতার নাচে

ঘাসের পরে ছায়াখানি কাঁপায় থরথর

ঝরাফুলের গন্ধে ভরভর –

ওইখানে মোর পোষা হরিণ চরত আপন মনে

হেনা-বেড়ার কোণে

শীতের রোদে সারা সকালবেলা।

তারি সঙ্গে করত খেলা

পাহাড়-থেকে-আনা –

ঘন রাঙা রোঁয়ায় ঢাকা একটি কুকুরছানা।…

তারপর ‘ফাগুন মাসে’ ‘পাগল দখিন হাওয়া’ যখন জাগল, তখন –

হরিণ যে কার উদাস-করা বাণী

হঠাৎ কখন শুনতে পেলে আমরা তা কি জানি।

তাই যে কালো চোখের কোণে

চাউনি তাহার উতল হল অকারণে;

তাই সে থেকে থেকে

হঠাৎ আপন ছায়া দেখে

চমকে দাঁড়ায় বেঁকে।

তারপরে এক বিকেলবেলায় যখন –

তপ্ত হাওয়া ব্যথিয়ে ওঠে আমের বোলের বাসে,

মাঠের পর মাঠ হয়ে পার ছুটল হরিণ নিরুদ্দেশের আশে।

সম্মুখে তার জীবনমরণ সকল একাকার,

অজানিতের ভয় কিছু নেই আর।

এদিকে কুকুরছানা বারেবারে এসে কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে কেঁদে কেঁদে চোখের চাওয়ায় জনে জনে সুধায়, ‘কোথায় গেল, কোথায় গেল, কেন তারে না দেখি অঙ্গনে।’

কবি এই বলে ভবিতব্য মানেন,

অাঁধার তারে ডাক দিয়েছে কেঁদে

আলোক তারে রাখল না আর বেঁধে।

আরো আগে লেখা ডাকঘর নাটকের সুর যেন এখানেও বাজে। মনে হয়, তাঁর চেতনায় এ যেন এক ‘ধ্রুবপদ’। তবে বিশ্বজোড়া অশান্তি পরে তাঁর প্রশান্ত সমীকরণকেও বিপর্যস্ত করেছিল। সেই অমীমাংসেয় বাস্তবতা এই কবিতায় অন্তত ছায়া ফেলেনি।

‘হারিয়ে-যাওয়া’তেও প্রত্যক্ষের ‘অশ্রুভরা বেদনা’ নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্তিতে শোধিত হয়ে কেবল তার ছায়াটুকু রেখে যায়। এমনকি চিত্রকল্পনায় যে-ছবি ফোটে, তা নিজে সামনে থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা পেতে পারে। আমরা যদি শুধু তাতেই মজে থাকি, তবে কবিতা হারিয়ে যায় না, বা খাটো হয় না, তার মায়া আরেকভাবে আমাদের বাঁধে। যদিও তার অন্তর্লীন আক্ষেপ একেবারে মিলিয়ে যায় না। কবিতাটি সবাই পড়ে। বাচ্চারাও। বোধহয় সবারই ভালো লাগে। গভীরতার দিকে যখন যায়, তখনো।

যখন পড়ি,

… সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে

প্রদীপটা তার নিভে গেছে বাতাসেতে।

শুধাই তারে, ‘কী হয়েছে বামী?’

সে কেঁদে কয় নীচে থেকে ‘হারিয়ে গেছি আমি।’

মেয়ের কথার ব্যঞ্জনা উলটে গিয়ে ছবিটার ব্যাপ্তি বাড়ায়। হয়তো কবি ইচ্ছে করেই এতে একটু মজা মিশিয়ে দেন। পরের কথাগুলো ফলে সহজেই আমাদের টেনে নিয়ে যায় :

তারায়-ভরা চৈত্রমাসের রাতে

ফিরে গিয়ে ছাতে

মনে হল আকাশ-পানে চেয়ে,

আমার বামীর মতোই যেন অমনি কে এক মেয়ে

নীলাম্বরের অাঁচলখানি ঘিরে

দীপশিখাটি বাঁচিয়ে একা চলছে ধীরে ধীরে।

নিবত যদি আলো, যদি হঠাৎ যেত থামি,

আকাশ ভরে উঠত কেঁদে, ‘হারিয়ে গেছি আমি!’

শেষ কবিতা ‘শেষ প্রতিষ্ঠা’তে কিন্তু আত্ম-সান্ত্বনার একটা যুক্তি ফাঁদার চেষ্টা – এবং সে-যুক্তি তখনো তাঁর ভাবনা-কাঠামোর মূলে অনিবার্য বিশ্বস্ততায় গাঁথা, আমরা খেয়াল করি। তবে এ বোধহয় ব্যক্তিগতই থাকে। হয়তো অন্যদের অনুরূপ বেদনায় কিছু শক্তি জোগায়। তিনি শোনান –

এই কথা সদা শুনি ‘গেছে চলে’ ‘গেছে চলে’।

তবু রাখি বলে

বোলো না, ‘সে নাই’

সে কথাটা মিথ্যা, তাই

কিছুতেই সহে না যে,

মর্মে গিয়ে বাজে।

মানুষের কাছে

যাওয়া-আসা ভাগ হয়ে আছে।

তাই তার ভাষা

বহে শুধু আধখানা আশা।

আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ

যে সমুদ্রে ‘আছে’ ‘নাই’ পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান।

কিন্তু আমরা জানি, এই আস্থার আশ্বাস তাঁর শেষ পর্যন্ত থাকেনি। আরো প্রায় পনেরো বছর পরে এক সান্ত্বনাহীন আর্তি মর্মান্তিক অসহায়তায় তাঁকে বিধ্বস্ত করে। এখানে দুঃখের কারণ, অতিপ্রিয় দৌহিত্র নীতিনের দূরবিদেশে অকালপ্রয়াণ। শোকস্তব্ধ কন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে চেতনায় আলোড়নে বেরিয়ে আসে তাঁর দুঃসহ বেদনার কবিতারূপ, ‘দুর্ভাগিনী’। বিশ্বাস এখন ভেঙে পড়েছে উত্তরহীন প্রশ্নে। লেখেন, ‘তোমার সম্মুখে আসি দুর্ভাগিনী, দাঁড়াই যখন/ নত হয় মন।’ এও যথেষ্ট মনে হয় না। পরে যোগ করেন, ‘প্রকান্ড এ নিষ্ফলতা,/ অভ্রভেদী ব্যথা/ দাবদগ্ধ পর্বতের মতো/ খররৌদ্রে রয়েছে উন্নত/ লয়ে নগ্ন কালো কালো শিলাস্তূপ/ ভীষণ বিরূপ।’ সামনে শুধু নিরাকার নির্মমতা। তাই, ‘দেবতা যেখানে ছিল সেথা জ্বালাইতে গেলে ধূপ,/ সেখানে বিদ্রূপ।’ কোনো সমাধান তাঁর আর জানা নেই। কবিতার অন্তিমে তাই ‘বিরাট নিরুত্তর’ই শুধু শূন্যে ভাসে। পড়তে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে, ‘তুমি স্থির সীমাহীন নৈরাশ্যের তীরে/ নির্বাক অপার নির্বাসনে।/ অশ্রুহীন তোমার নয়নে/ অবিশ্রাম প্রশ্ন জাগে যেন -/ কেন, ওগো কেন!’

এই কবিতা নিয়ে ও রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের অনুরূপ ভাবনা নিয়ে তুলনাহীন আলোচনা করেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথে। আমি তাই কথা বাড়াতে চাই না। তাছাড়া আমার বলা পলাতকা নিয়ে। সেখানেই যে কবি থেমে থাকেন না, আরো অনেক ‘দুঃখের অাঁধার রাত্রি’ পার করেন, এটিই শুধু এখানে মনে করিয়ে দেওয়া।

‘মুক্তি’, ‘ফাঁকি’ ও ‘ছিন্নপত্র’ তিনটে কবিতাই স্মৃতিমেদুর। তবে তিনটিই কন্যাকেন্দ্রিক নয়। ‘ফাঁকি’ অবশ্যই। বাইরের খবর মিলিয়ে মনে হয়, ‘মুক্তি’ও। ‘ছিন্নপত্র’ হতে পারে চেনাজানা কারো কথা। হয়তো টুকরো কোনো ঘটনা। বাকিটা কল্পনা। তবে এখানে অন্য কটি কবিতার মতো এরাও হতে পারত ছোটগল্পের বিষয়। আসলে মূলত সবাই এরা ছোটগল্প। পুশকিনের ইভানজিন ওনেগিন বা বিক্রম শেঠের দ্য গোল্ডেন গেট, অথবা বায়রনের ডনজুয়ান যদি কবিতায় উপন্যাস হয়, তবে এরাও কবিতার ধাঁচে ছোটগল্প। তার পরেও ‘মুক্তি’তে রয়েছে এই কালজয়ী কটি চরণ :

আমি নারী, আমি মহীয়সী,

আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী।

আমি নইলে মিথ্যা হ’ত সন্ধ্যাতারা-ওঠা,

মিথ্যা হ’ত কাননে ফুল-ফোটা।

এবং এ-উপলব্ধি সংসারের চাকায় নিরর্থক জুড়ে থাকা এমন এক তরুণী বধূর, মৃত্যুতেই যে স্বপ্ন দেখে বিশ্বপ্রকৃতির অসীম ঐশ্বর্যে মুক্তির। আত্মমগ্ন ভাবনায় তার ধরা পড়ে :

বাইশ বছর রয়েছি সেই এক চাকাতেই বাঁধা

পাকের ঘোরে অাঁধা।

জানি নাই তো আমি যে কী, জানি নাই এ বৃহৎ বসুন্ধরা।

কী অর্থে যে ভরা।

শুনি নাই তো মানুষের কী বাণী

মহাকালের বীণায় বাজে। আমি কেবল জানি,

রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধা –

বাইশ বছর এক চাকাতেই বাঁধা।

এ-ছবিতে হয়তো মিল খুঁজে পাবে আমাদের অধিকাংশ নারী। এজন্যেই কি আমাদের পাঠক-সমাজের এ-কবিতায় অস্বস্তি? মৃত্যুতে মুক্তি খোঁজার সহজ সমাধান বা প্রশান্তি যে প্রশ্নের সদুত্তর নয়, তা অবশ্য আমরা মানি।

বিষয়গতভাবে ‘মালা’ সোনারতরীর ‘পুরস্কার’ ঘরানার। তফাৎ একটা আছে। এখানে গান গেয়ে মণির মালা জেতা রানীর হাতে সোনার থালা থেকে, রাজার কাছ থেকে নয়। তবে মণিহারের ভার এ-কবিতাতেও বিড়ম্বনা। রানীর কোলে সোনার থালায় নয়, পদ্মপাতার ডালায় লুকনো বরণমালাতেই মনের সাধ মেটে। ‘মায়ের সম্মান’ও একটা গল্পই। অসাধারণ নয়।

এরকম কবিতা পড়ে মনে হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ সমাজ-সংসারে উদাসীনতাকেই শ্রেয় মনে করতেন। যদি তা করেও থাকেন, তবু বাস্তবে কিন্তু সামাজিক-রাজনৈতিক সার্বিক প্রশ্নকে উপেক্ষা করেননি। এবং সেখানে ব্যক্তিস্বার্থ নয়, আপন বিবেকের কণ্ঠস্বরকেই মূল্য দিয়েছেন। ‘হোমরুলে’র দাবি না ছাড়ায় এ্যানি বেসান্তকে ওইসময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার অন্তরীণ করে রেখেছিল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তাঁকেই সভাপতি করার কথা ভাবে। তাতে সভায় অভ্যর্থনা কমিটির দায়িত্ব নিতে এমন একজনের প্রয়োজন পড়ে যাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে উড়িয়ে দেওয়া দেওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথকেই মনে করেন তাঁরা উদ্ধারকর্তা। তাঁর উপস্থিতির গুরুত্ব এমনকি এ্যানি বেসান্তকে মুক্ত করায় কাজে আসতে পারে। বাস্তবে ঘটেও তাই। তবে রবীন্দ্রনাথ শর্ত দেন, কংগ্রেসের বার্ষিক সভা সাঙ্গ হলেই তিনি ওই অভ্যর্থনা কমিটি থেকে সরে আসবেন। এ্যানি বেসান্ত কংগ্রেসের সভাপতি হন। রবীন্দ্রনাথও পদত্যাগ করেন। পরে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ঘটে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড। তিনি কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। ওই সময়ে এর গুরুত্ব ছিল বিপুল।

এরকম সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরোক্ষ প্রতিফলন আছে পলাতকার দুটো কবিতায়। তবে তার যে অনিষ্টকারী ছবি এখানে অাঁকা, বাস্তবেও কবির মূল্যায়ন তেমনই ছিল, এমনটি ভাবা কতটুকু ঠিক হবে, জানি না। জনসমুদ্র তিনি এড়িয়ে চললেও গণদায়িত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ঠিকই। কবিতাদুটোর কথা তাই আক্ষরিক অর্থে না নেওয়াই বোধহয় ভালো। তাঁর চিঠিপত্রের অনেক মন্তব্যও, মনে হয়, খাঁটি বলে ধরে নেওয়ার আগে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে যাচাই করে নেওয়া দরকার। এমনটি দাবি করে তাঁর আত্মস্মৃতিগন্ধী রচনাগুলোও।

পলাতকার কবিতাদুটি ‘ছিন্নপত্র’ ও ‘আসল’।

‘ছিন্নপত্র’তে দেখি –

তিনটে চারটে সভা ছিল জুড়ে আমার কাঁধ;

দৈনিকে আর সাপ্তাহিকে ছাড়তে হত নকল সিংহনাদ;

বিডনকুঞ্জে মিটিং হলে আমি হতেম বক্তা;

রিপোর্ট লিখতে হত তক্তা তক্তা,

যুদ্ধ হত সেনেট-সিন্ডিকেটে,…

দিনরাত্রি যেত কোথায় দিয়ে।

আর, ‘আসল’ কবিতায় –

এখন আমার বয়স হল ষাট

গুরুতর কাজের ঝঞ্ঝাট।

পাগল করে দিলে পলিটিক্সে

কোনটা সত্য কোনটা স্বচ্ছ আজকে পর্যন্ত

হয়নি জানা ঠিক সে;

ইতিহাসের নজির টেনে সোজা

একটা দেশের ঘাড়ে চাপাই আরেক দেশের

কর্মফলের বোঝা,

সমাজ কোথায় পড়ে থাকে নিয়ে সমাজতত্ত্ব

মাসিকপত্রে প্রবন্ধ উন্মত্ত।

কবিতাকে কোনো কবির আপন জীবনের প্রতিবেদন কেউ বলবে না। তবে ভাবার্থে তাঁর মানসিকতার প্রতিফলনই লোকে অনুমান করে। এমনসব রচনায় সত্যের খন্ডাংশ হয়তো আছে। তবে অতিশয়োক্তি থেকে তাকে বাছাই করা মুশকিল। শিল্পকলা ও কর্মসাধনা দুটোতেই তিনি জীবনের অর্থময়তা খুঁজেছেন। ‘চিরদিনের দাগী’, ‘ভোলা’ ও ‘কালো মেয়ে’ এই তিনটি কবিতা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলছি না। এমন নয় যে, আন্তরিকতায় বা করুণায় এদের কোনোটিতে কোনো খাদ আছে। বিশেষ করে শুধু মেয়ে হয়ে জন্মাবার জন্যেই মেয়েদের যে শাস্তি ভোগ করতে করতে বড় হয়, তার কষ্ট মিশে আছে দুটোতে। তবে তা এখানে বেশিরভাগ কবিতাতেই আমরা পেয়েছি। তাই একই ভাবের অতিরিক্ত পুনরাবৃত্তি আর করতে চাইছি না। আমরা নজর দিই, আর একটা কবিতা যে বাকি থাকলো, সেই ‘নিষ্কৃতি’র ওপর। আমার মনে হয়, এখানে কেন্দ্রীয় কবিতা বুঝি এইটিই। সমাজ-বাস্তবতায় মেয়ের অসহায়তার কথাই শুধু এখানে নেই, একই সঙ্গে মেরুদন্ডহীন পুরুষ-প্রাধান্যের গ্লানিকে নির্বিকার ব্যঙ্গে তিনি চিনিয়ে দেন আর চূড়ান্ত পরিণতিতে মেয়ে নিজের ভাগ্য নিজের হাতে তুলে নেয়। বাস্তবের সত্যিকারের পলাতকা বোধহয় একমাত্র সে-ই। চতুরঙ্গের দামিনীর মতো বিদ্যুৎশিখা সে নয়। কিন্তু সে দামিনীকে মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য তার মতো করে। প্রায় কোনো কথা না বলে। গোটা কবিতাই কথা বলে তার হয়ে। একটা বিষয় আমাকে একটু ভাবায়। পুনশ্চর ‘সাধারণ মেয়ে’ অসাধারণ কবিতা। কোনো ভুল নেই এতে। আমরা এই কবিতাটি বারবার শুনি। কিন্তু ‘নিষ্কৃতি’ একবারও না। অথচ কবিতার ভারসাম্য এখানেও এতটুকু টাল খায় না। হালকা চালের কথাও বুকে শূলের মতো বেঁধে।

কবিতাটি যে-কন্যাকে নিয়ে, তার নাম মঞ্জুলিকা। বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছে পঞ্চাননের সঙ্গে। বয়স মেয়ের পাঁচগুণ। মা কেঁদে বলে, ‘- তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়োসড়ো।/ এমন বিয়ে ঘটতে দেব নাকো।’ বাপ গর্জে ওঠে, ‘কান্না তোমার রাখো -’ কারণ, ‘অনেক দিনের খোঁজে’ – পঞ্চাননকে পাওয়া গেছে। ‘মস্ত কুলীন ও যে!’ মা বলে, একই পাড়ার ছেলে, পুলিন। সোনার টুকরা ছেলে। ‘ওরই সঙ্গে হেসে খেলে/ মেয়ে আমার মানুষ হল – ওকে যদি বলি আমি আজই/ এক্ষনি হয় রাজি।’ বাপ আরো গলা চড়ায় – ‘ওরা আছে সমাজের সব-তলায়।… দেখতে-শুনতে ভালো হলেই পাত্র হল! রাধে!/ স্ত্রীবুদ্ধি কি শাস্ত্রে বলে সাধে!’

বাপের দাপটে মঞ্জুলিকার বিয়ে হয়ে যায় বুড়ো বরের সঙ্গে। কিন্তু দুমাস না যেতেই যমে ধরলো ওই বুড়োকে। ‘মঞ্জুলিকা বাপের ঘরে ফিরে এল সিঁদুর মুছে শিরে।’

এদিকে ‘- কখন শিশুকালে/ হৃদয়-লতার পাতার অন্তরালে/ বেরিয়েছিল একটি কুঁড়ি/ প্রাণের গোপন রহস্যতল ফুঁড়ি -/ জানত না তো আপ্নাকে সে,/ শুধায় নি তার নাম কোনোদিন বাহির হতে খেপা বাতাস এসে,/ সেই কুঁড়ি তার অন্তরে আজ উঠছে ফুটে/ মধুর রসে ভ’রে উঠে।’/ সে যে প্রেমের ফুল/ আপন রাঙা পাপড়িভারে আপ্নি সমাকুল।’ মা তার সব বোঝে। ‘মঞ্জুলিকার কালো চোখে ঘনিয়ে তোলে জল-ভরা এক ছায়া;/ অশ্রু-ভেজা গভীর প্রাণের ব্যথা/ এনে দিল অধরে তার শরৎনিশির স্তব্ধ ব্যাকুলতা/ মায়ের মুখে অন্ন রোচে নাকো;/ কেঁদে বলে, ‘হায় ভগবান, অভাগীরে ফেলে কোথায় থাকো!’

বাপের কাছে গিয়ে মা আর্জি জানায়, ‘যার খুশি সে নিন্দে করুক, মরুক বিষে জ’রে,/ আমি কিন্তু পারি যেমন করে/ মঞ্জুলিকার দেবই দেব বিয়ে।’ কঠিন হেসে বাপ বলে, ‘তোমরা মায়ে ঝিয়ে/ এক লগ্নেই বিয়ে কোরো আমার মরার পরে;/ সেই কটা দিন থাকো ধৈর্য ধরে।’

দুঃখ-তাপে, হতাশায় জ্বলতে জ্বলতে মা একদিন চোখ বুজলো। বাপ একা হলো। মঞ্জুলিকা বাপের দাবি মিটিয়ে মা ও মেয়ের হয়ে সেবা যতদূর সম্ভব করে। মাঝখানে বাবা অসুখে পড়ে। পুলিন এখন ডাক্তার। তার ডাক পড়ে। তার ও মঞ্জুলিকার চিকিৎসায় ও শুশ্রূষায় বাপের অসুখ সারে। তারই ভেতরে একদিন পুলিন মঞ্জুলিকাকে একান্তে ডেকে বলে, ‘জান তুমি, তোমার মায়ের সাধ ছিল এই চিতে/ মোদের দোঁহার বিয়ে দিতে।/ সে ইচ্ছাটি তাঁরি/ পুরাতে চাই যেমন ক’রেই পারি।/ এমন করে আর কেন দিন কাটাই মিছিমিছি।’ মঞ্জুলিকা শরমে মরে। দৌড়ে পালায়। ভাবে, বুঝি ধরা পড়ে গেছে সে। আরো বেশি করে বাবার সেবায় মন দেয়। বাপ কিন্তু সুস্থ হয়েই আর একটা বউ আনতে জোগাড়-যন্ত্র শুরু করে। মায়ের স্মৃতি, মায়ের অপমান মঞ্জুলিকার বুকে নির্মম আঘাত হানে। ‘ছেড়ে লজ্জাভয়/ কন্যা তখন নিঃসংকোচে কয়/ বাপের কাছে গিয়ে,/ ‘তুমি নাকি করতে যাবে বিয়ে!/ আমরা তোমার ছেলেমেয়ে নাতনি-নাতি যত/ সবার মাথা করবে নত?/ মায়ের কথা ভুলবে তবে?/ তোমার প্রাণ কি এত কঠিন হবে!’ গোটা কবিতায় এই একবারই আমরা মঞ্জুলিকার মুখে কথা শুনি। উত্তরে ‘বাবা বললে শুষ্ক হাসে,/ ‘কঠিন আমি কেই বা জানে না সে!/ আমার পক্ষে বিয়ে করা বিষম কঠোর কর্ম,/ কিন্তু গৃহধর্ম/ স্ত্রী না হলে অপূর্ণ যে রয় -/ মনু হতে মহাভারত সকল শাস্ত্রে কয়। সহজ তো নয় ধর্মপথে হাঁটা।/ এ তো কেবল হৃদয় নিয়ে নয়কো কাঁদাকাটা।/ যে করে ভয় দুঃখ নিতে, দুঃখ দিতে,/ সে কাপুরুষ কেনই আসে পৃথিবীতে।’

বাপ বিয়ে করতে গেল বাখরগঞ্জে। তারপর –

বউকে নিয়ে শেষে

যখন ফিরে এলেন দেশে,

ঘরেতে নেই মঞ্জুলিকা। খবর পেলেন চিঠি প’ড়ে

পুলিন তাকে বিয়ে করে

গেছে দোঁহে ফরাক্কাবাদ চলে

সেইখানেতেই ঘর পাতবে বলে।

আগুন হয়ে বাপ

বারে বারে দিলেন অভিশাপ\

এই হলো কবিতা ‘নিষ্কৃতি’র কথা। এতে শ্লেষ আছে, পরিহাস আছে, বিদ্রূপ আছে। সবটাই হালকা চালে। কিন্তু লক্ষ্য ভেদ করে অব্যর্থ। আরো দশ বছর পরে মহুয়াতে ‘সবলা’ কবিতায় নারীর এই ফরিয়াদ তিনি তার কণ্ঠেই শুনিয়েছেন, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা?’ এই দাবি পূরণের একটা সক্রিয় প্রয়াস আমরা পাই ‘নিষ্কৃতি’তে। হয়তো পূর্ণমাত্রায় সবদিক থেকে নয়। বাস্তবে সব পথ এখনো খোলেনি। এখনই কি খুলেছে? খুললেও কি স্বেচ্ছাচারী হওয়া যায়? জীবনযাপনে স্ববিরোধ থেকে মুক্তি নেই। তবে বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ যে কিছুদিন বর্ণাশ্রমের দিকেও ঝুঁকেছিলেন, তা থেকে বেরিয়ে এসেছেন পলাতকায়। নারীর মুক্তির দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ চতুরঙ্গ ভাবের জগতে পরিবর্তনটিকে চিনিয়ে দেয় আগেই। তার একটি কণা সম্বল করে পূর্ণতা পায় ‘নিষ্কৃতি’। যে-পলাতকায় আছে অন্য জগতের হাতছানি, তা ইহজগতেও মুক্তির পথ, সার্থকতার পথ খোঁজে।

একটা কথা আরো একবার বলি। বাস্তবের প্রেক্ষণবিন্দুকে সাহিত্য এড়িয়ে যায় না। যেতে পারে না। এমনকি চৈতন্যের জগতেও আলো-ছায়ার প্রসারণ-সংকোচন তারই সংকর্ষণে। কিন্তু সাহিত্য বাস্তবের হুবহু প্রতিবেদন নয়। তাতে যে ‘সম্ভবপরতা’র বীজরাশি, তা থেকে তিনি বেছে নেন তাঁর কল্পনার যাত্রাপথ। অবশ্যই তাতে তাঁর পছন্দ-অপছন্দ মেশে। কিন্তু তা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন-ব্যক্তিগত বিষয় থাকে না। সর্বজনীন অনুভবে একটা আবেদন সে খোঁজে। মানব চেতনায় ঈশ্বরের ভাবরূপের ধারণা-রচনায় উপনিষদের এক জায়গায় আরো কটি বিশেষণের সঙ্গে দেখি, ‘কবিমণীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভুঃ।’ (ঈশ, ৮) রবীন্দ্রনাথের কাছে এটি প্রেরণাস্বরূপ ছিল। এই কল্পনার ঈশ্বরের আদলে নিজেকে দাঁড় করাতে প্রত্যক্ষের সঙ্গে একটা দূরত্ব তিনি গড়ে নেন। কিন্তু তাকে প্রত্যাখ্যান করেন না। তার বাস্তবিক-আন্তরিক সম্ভাব্যতা খোঁজেন। পলাতকাতেও তাই। এর চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত তাঁর সৃষ্টিকলায় কোনোখানেই তিনি নন। ‘সর্বজনের মনের মাঝে’ তাঁর ‘মুক্তি’র আকাঙ্ক্ষা।