পায়ে উর্বর পলি

হাবীবুল্লাহ সিরাজী
সে এক কাল ছিল, পদাবলি ছিল। ছিল গৌরবের অসামান্য বয়ান, অতীতের টানে সিক্ত জীবন-বর্তমান। ভূমি ও আকাশ একাকার, আমাদের সঙ্গে আরো ভবিষ্যতের কবিতার সুযোগের সম্ভার। শব্দ এবং স্বর, অতঃপর রাজপথে ঝান্ডা উড়িয়ে হৃদয়ের রক্তাক্ত খবর আদান-প্রদান। তিনি ছিলেন তাঁর তাপে কিংবা বরফে গতি বদলিয়ে ছিল বায়ু, নক্ষত্র জ্বেলেছিল আয়ু এবং চৈতন্য জুড়ে ছিল কবিতার স্বেদ। বোঝার অবকাশ না দিয়ে বিবর্তন লেগেছে পাড়ে, যমুনার বুঝিবা মিলেছে নতুন জলের সমাচার। হয়তো জলেশ্বরী ধরেছে মানুষের সীমারেখা, আমাদের প্রতিরক্ষাকূল। কুড়িগ্রাম করে আনচান : ‘আমার মাটির সন্তান, দুধের বিছানা পাতে ত্যাগিয়া জাহান’। দুরন্ত বাজিকর এক সৈয়দ শামসুল হক, তাঁকে কবি বললে পূর্ণ হয় ভাষার সম্মান।
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরাণের গহীন ভিতর ॥
শব্দ তাঁর জাদু, বর্ণ তাঁর ঘোর, আর স্বপ্ন তাঁর অসামান্য সম্ভাবনা; মিলিয়ে নিলে তাঁকে পদ্যে-গদ্যে-গীতে একাকার যেমন করা যায়; সেরূপ মঞ্চ কাঁপিয়ে কিংবা রং ছড়িয়ে বসিয়ে দেওয়া যায় বাঙালে কি ব্রাত্যে। মহাজনে এত্তেলা দেয় দুনিয়ার, এবং ভুবন জুড়ে লেগে পড়ে খেলা। বেলা বাড়ে তো ছায়ারা নানাদিকে ছড়ায় : ‘সাপ আর জ্যোৎস্না চলে গেলে… পড়ে থাকে তারালেখা আকাশ’। এই আকাশ বাংলার, এই জ্যোৎস্না মানুষের;
আর কূট ও কৌশলে উন্মত্ত দিগম্বর এক সাপ সামলে সম্মুখে অভিযান। তাঁর ডাক ফিরে ফিরে আসে মর্মে-কর্মে অপার আকাক্সক্ষায়, তাঁর আওয়াজ মেলে বৈশাখে রচিত পংক্তিমালায়। তাঁকে জড়িয়ে ধরে পাখি বুঝি জন্মগীত গায়।
মানুষ এমন তয় একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর
কী আছে ওই শ্বাসে কিংবা কী বা থাকে আপ্ত অভিলাষে? আছে, থাকে; প্রপাতে প্রস্তর আছে – ফেনাও মিশে থাকে মূলে। খুলে ফেললে, আর মেলে ধরলে প্রকৃতির পরশখানি পাশে এসে বসে। টেনে আনে অতীত এবং ছুটতে থাকে ভবিষ্যৎ। কবি তাঁর আনন নত করে স্পর্শ করেন ভূমি। শস্যে পূর্ণ হয় গোলাঘর, অনন্তের সন্ধান। তার পরও একজন সৈয়দ হক আপনার ফলাফলে অধিক মনোনিবেশপূর্বক
প্রকৃতির মগ্নরেখায় বিবাদভঞ্জন করেন কাদা ও শাদার। সবুজ এবং লালের সৌহার্দ্য বিস্তারিত হয় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে। মাধুর্য এসে বলে, ‘কার ছায়া পড়েছে/ মনের আয়নাতে’? অবশিষ্টেরও নাশ নেই, ইঁদুর ও মানুষ পাশাপাশি চলছে! শ্লোক এবং শিকড়ের নাগালের আশায় উন্মুখ চরাচর।
পথিক, বাংলায় যদি জন্ম তোমার
আমার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাবে
তাঁকে বাংলাদেশ শুনতে পেয়েছিল; তবে দীর্ঘশ্বাসে নয়, অপার ভালোবাসায়। ইচ্ছা করেছিলেন লালনের সমান আয়ু। হয়নি। অপূর্ণতা কি অন্তিমে অধিক বেজেছিল? বাজতেই পারে! যে জন তাঁর আয়ুর ঠিকানা পূর্বাহ্ণেই পেয়ে যান, তখন তাঁর যুদ্ধ কেবল কবরের ঘ্রাণের সঙ্গে। এ বড়ো দুরূহ কাল, এ বড়ো বেদনার প্রহর। বিবেচনা করি, কবি সৈয়দ শামসুল হক মৃত্যুকে তেমন গ্রাহ্যে নেননি। একাশি বছরের জীবনে তলোয়ার ফেলে কদাচিৎ যেমন শুধু ঢাল ব্যবহার করেছেন, আবার তেমনি পিঁপড়ের পিঠে গোটা ভাত দেখেও হননি বিচলিত। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের চিত্র তো তাঁকে জীবনের অন্যরূপ দর্শন করিয়েছিল। সন্ধান দিয়েছিল ক্ষুধার, সহমর্মিতার এবং সর্বোপরি বাংলার অসহায়ত্বের।
তবু কবি নিরাশ হননি, জন্মে-জন্মে ফিরে আসতে চেয়েছেন তাঁর বাংলায়।
জন্মে জন্মে বারবার কবি হয়ে
ফিরে আসব এই বাংলায়

দুই
এক প্রান্তে ভূমি শুকিয়ে দড় হলেও অন্য প্রান্তে প্রকৃতি তৈরি হয় ভিন্ন উপাদানে। সদর্পে প্রবেশ করে বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ। উদ্যাপন করে হাহাকারের মধ্যে বিজয়ের বিন্দুসমূহ। স্মরণের প্রান্ত থেকে জাগিয়ে তোলে আত্মপরিচয়ের চর। ভূমির দখল নেয় অকৃত্রিম সূত্রধর। বঙ্গোপসাগরকূলে রচিত হয় মানুষের ইতিহাস, বাংলার ভূগোল। আকাশ অভয় দেয় আর ভালোবাসার দুরন্ত ঘোড়সওয়ার যেন অভিনব বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয় বাংলার প্রতিটি ধূলিকণায়।
যখন খরার মাঠ হ’তে থাকে সজল সবুজ,
তখন কৃষকরূপে দেখে নিয়ো তোমার বন্ধুকে।
পলি-বিজয়ের অভিযাত্রী জারি রাখলেন তাঁর অভিযান। সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না তাঁকে সঙ্গ দিলো, কুর্নিশ জানাল বাংলাভাষার মুগ্ধ সন্তানেরা।
উঠে আসা যাক সেই রৌদ্র থেকে, পঞ্চাশের সেই সচল প্রবাহ থেকে, যা মূলত ভাষা-আন্দোলন-পরবর্তী আমাদের কবিতার অন্য যাত্রা। পেছন ফিরে সচল অংশটুকু মান্যতায় নিয়ে একে-একে অগ্রসর হওয়া। সৈয়দ শামসুল হক, সেই যাত্রার সফল লিপিকার, সার্থক
কাল-বিচারক। বুনো বৃষ্টির গান, একদা এক রাজ্যে, বিরতিহীন উৎসব, বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা থেকে প্রতিধ্বনিগণ, অপর পুরুষ, পরাণের গহীন ভিতর কাব্যসমূহ তাঁর মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের এবং পরের চেতনাকে প্রতিফলিত করে। এবং নিঃসন্দেহে একদিকে বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা এবং অন্যদিকে পরাণের গহীন ভিতর যুগপৎ আমাদের উদ্ভাসিত করে ব্যতিক্রমী মাত্রায়। কবির শক্তি ও দম্ভ, কাল ও চক্র, ভাষা ও প্রেরণা, গতি ও গ্রহণক্ষমতা – শুধু বিস্মিতই করে না, আমাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটায় অনিবার্যতার। এই অনিবার্যতা – সংশয়ে, সংকটে, দ্রোহে, দারিদ্র্যে, মালিন্যে ও মমতায় কবিতাকে পুষ্ট করে; বিতরিত হয় নব কাব্যসুষমা। বাংলাভাষায় লিখিত কবিতার বিবেচনায় তা যেমন আধুনিক, তেমনি মৌলিক ও ভূমিগন্ধী। তাঁর নিশানা বদলেছে, কবির তা বদলায়; কবি ও কবিতা মিলেমিশে ধাতু ও কাষ্ঠের যুগলবিহার। কখনো তা পাত্রের, কখনো বা গাত্রের। সৈয়দের কৃতিত্ব সেখানেই – টান হওয়া সুতো ও পাকা রংকে তিনি এক করতে জানেন। তাঁর স্পর্ধা তাঁর ভালোবাসার মতোই ঋজু, শব্দকে তিনি পুষেছেন, বড়ো করেছেন এবং সময়মতো আসন পেতে বসিয়ে দিয়েছেন। শব্দমাত্রা তাই যখন ভাষামাত্রায় প্রকাশিত হয় – তখন অন্দরমহল থেকে জানান দেয় কাব্যমাত্রা। তাঁর কবিতারা কুড়িগ্রাম থেকে হেঁটে ঢাকা আসে, তারপর উড়ে যায় অচিন শহরে।
সভ্যতা বিদায় নেয়, বংশের পতন হয়, দাঁড়িয়ে সে থাকে
অথচ আমি তো নই, তোমার বিদায়ে।

তিন
মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ – একই বৃত্তে তিনি ধারণ করেছেন এই তিন মহান সন্ধান। আমাদের নেত্র উন্মোচনের কাল, আমাদের
প্রাণ-স্থাপনের বিন্দু এবং আমাদের সুবর্ণ যাপনের যাত্রায় তাঁর উচ্চারণ :
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি
চোখে নীলাকাশ বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।
তিনি কবি, ভালোবাসার টান মাটি ও নারীতে; আর স্বপ্ন সেই স্বর্গে, যেখানে শরীর মানে জীবন-কুসুম। তবু কি খোঁজ মেলে তার?
দেহের ভেতর দেহ! সেই দেহ আজও খোলে নাই!
এবং হৃদয়-দেশে হৃদয়েরও খোলেনি দরোজা।
এ কোন হৃদয়-দেশ, যার দরোজা খোলার অপেক্ষায় কবি উন্মুখ?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির ব-দ্বীপ।
তাঁর কবিতা গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যে-চিত্রমালা দিয়েছিল, এ-শতাব্দীর প্রথম দশকে তার রূপ ছিল আলাদা। সাত দশক ধরে আলাদা হওয়ার ক্রিয়াকৌশল ক্রমান্বয়ে তাঁকে সময়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে, মুক্ত করেছে বন্ধনের কৃষ্ণজট। নীরবে, অতি সন্তর্পণে বেজে চলেছে – নিজস্ব বিষয়, এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি, রজ্জুপথে চলেছি, আমি জন্মগ্রহণ করিনি, নাভিমূলে ভস্মাধার… ইত্যাদি। নীরবতা যেন ভেতর মহলের চলাচল আবার সন্তর্পণের মধ্যেও – ‘আমারও সংসার হবে – শিল্পের সংসার’। শিল্পযাপনের এই সংসার, সৈয়দ শামসুল হকের একান্ত।
১. নিত্য বাজে বাঁশি আর পর্দা পড়ে যায়
আমার দক্ষিণে বামে সোনার বাংলায়।
২. বাংলার বিপুল জল করে কলরব।
৩. আমারই মতন কোনো যুবকের হাতে
শিল্পের সরোজগুলো শব্দহীন হ’য়ে থাকবে না;
৪. আমিও বাংলার লোক, স্বভাবত বাংলার মতই
সমতল, সংগীতের শস্যভারে নত, দূরগামী
পদ্মার মতই ধীর, পলিমাটি আত্মায় সঞ্চিত।

চার
যে-কথা বলি না কেন, যা কিছু লিখি না কেন, সৈয়দ শামসুল হক এমন এক কবির নাম – যাঁর কবিতা বাংলাভাষার মাত্রাটিকে মাটি-পাথরে একাকার করেছে; মুগ্ধ গন্ধ বিলিয়েছে যৌবনের ঘড়ি-চলাচলে। কাতর যেজন সে জানে, ক্লান্ত যেজন সেও বোঝে – হক তাঁর যাত্রাপথে টুকে রেখেছেন রক্তের গ্রুপ এবং সুষম খাদ্যতালিকা। এই সুষম বলতে সমবণ্টনের প্রশ্নটিও এসে যায়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলা শব্দের ভাষারূপ নির্মাণে পদের ব্যবহার যেন ছিল তাঁর মস্তিষ্কের জাদু। অবিরাম সচল, নিত্য অগ্রসরপ্রবণ এই কবি – খননের জন্য প্রস্তুত করে গেছেন তাঁর কাব্য। পাঠের আনন্দমহলে কিংবা প্রেরণার পরগনায় তাঁর ইজারাদারি চিরস্থায়ী হোক। 