পুনরুদ্ধার

প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে মানস। দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াচ্ছে। পালাচ্ছে সে আগুন দেখে, মালিবাগের অগ্নিদগ্ধ বাড়ি দেখে, জগন্নাথ হলের আগুনে পোড়া লাশ দেখে। দাউদাউ করে জ্বলছে নিজের জামা, মাথার চুল, গায়ের চামড়া। চিৎকার করে বলতে চাইছে, আমি তোমাদের লোক, এই পাড়া আমার, এই শহর আমার। আগুনঝরা ওই কৃষ্ণচূড়া গাছ, সেটিও আমার। আমাকে কেন তোমরা মারতে চাইছ?
গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোয় না। কে যেন তার গলা টিপে ধরেছে, বলছে, চুপ, একটা কথাও না। পালাতে থাকে মানস। পালিয়ে কোথায় যাচ্ছে সে জানে না। শুধু এটুকু জানে, তাকে পালাতেই হবে। এখানে তার পাওয়ার আর কিছু নেই, আশ্রয়ের কোনো নিরাপদ ভূমি নেই, নিকট কোনো বন্ধু নেই। যাদের বন্ধু ভাবত, তাদের নিশ্বাস থেকে আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে। বুকের ভেতর চাপা একটা বেদনা, আগুনের চেয়েও ভয়ংকর এক ভীতি তাকে চেপে ধরতে চাইছে।
পালাতে হবে, সবকিছু ছেড়ে পালাতে হবে। অন্য কোথাও, অন্য কোনো নিরাপদ জনপদে।
আগুনকে সে চিরকাল ভয় পায়। খুব শৈশবে ফরিদপুরে নিজের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় গোয়ালঘর পুড়ে যাওয়া দেখেছিল। সাতসকালে হঠাৎ আগুন, পরে জেনেছিল পাশের বাড়ির শিকদার ম-লের সঙ্গে ছোট কাকার সম্পত্তির ভাগ নিয়ে বিবাদ ছিল, তারাই আগুন দিয়েছিল। সবকিছু ভালো মনে নেই, শুধু মনে আছে গোয়ালের খুঁটায় আটক দুটি গরু, সঙ্গে তাদের আরো গোটাদুই বাছুর। আগুনের ভয়ে ছোটাছুটি করছে, দড়িতে বাঁধা থাকায় পালাতে পারছে না। লোকজন এসে পড়ায় জল ছিটিয়ে সে-আগুন নেভানো হলে গরুদুটো বেঁচে যায়, কিন্তু একটা বাছুর দাউদাউ আগুনে পুড়ে একদিন পর চোখের সামনে কাতরাতে কাতরাতে মরে যায়। অনেকদিন ঘুমের মধ্যে বাছুরের ঘন কালো চোখ, সে-চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠেছে সে।
আজো ধড়ফড়িয়ে ওঠে মানস।
নিউইয়র্কে এখন সকাল, ঢাকায় রাত। কাল এবিসি নিউজের রাতের খবরে ঢাকায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হামলার খবর এসেছে। সে-খবর শুনেই কি মানস সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে? যে-দেশটাকে সে গত সাত বছর ভুলতে চেয়েছে মনেপ্রাণে, তাকে নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা তো তার থাকার কথা নয়। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছে, এ-কথা সে খুব ভালো করেই জানে। পেশাদারি আগ্রহ থেকে বিষয়টি সে অনুসরণ করেছে, তার বাইরে নয়। মামার কথা উদ্ধৃত করে বাবা দু-একবার চিঠিতে আবার গ-গোল বাধতে পারে, এমন কথা লিখেছেন। বিষয়টি মনে ধরে রাখেনি। অফিসে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি ইন-ডেপথ ব্যাকগ্রান্ডার লিখতে বলেছিল, ভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টের কথা বলে সে তা এড়িয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। তার বস রেইমন্ড, ঘানার প্রবীণ সাংবাদিক, তাতে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিল। ‘আমি তো ভাবলাম তুমি বাড়তি আগ্রহ নিয়ে কাজটা করবে। তোমার চেয়ে ভালো ওই অঞ্চল এই অফিসে আর কে জানে!’
কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছে মানস। রেইমন্ড আর কথা বাড়ায়নি।
গতকাল দুপুরে ব্যায়াফ্রার গৃহযুদ্ধে পরাজয়ের পর নাইজেরিয়া থেকে পালিয়ে আসা এক বিদ্রোহী কমান্ডারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, সেটি শেষ করে কপি এডিটরকে পাঠিয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে মানস। অফিসঘরে টিভি চলছিল, এবিসির সন্ধ্যার প্রাইম টাইম নিউজ। শিরোনামেই ঢাকা, দিল্লি থেকে রেসিডেন্ট করেস্পন্ডেন্টের ডিসপ্যাচ। সঙ্গে দেড় মিনিটের একটি ভিডিও। এক সপ্তাহের পুরনো খবর, কেউ একজন গোপনে রেকর্ড করে ভিডিওটি পাঠিয়েছে। উপেক্ষা করবে ভেবেছিল, কিন্তু কানে এলো জগন্নাথ হলের নাম। সেনাসদস্যরা হলের ছাত্রদের পাখির মতো গুলি করে মেরেছে।
এই হলটি তার পরিচিত, নিজে কখনো থাকেনি, ঢাকায় তাদের নিজ বাড়িতে থেকেই সে লেখাপড়া করেছে। কিন্তু আড্ডা দিতে, গোপালের সঙ্গে টলটলে জলের মতো ডাল দিয়ে হোস্টেলের লাঞ্চ খেতে কতবার সে এসেছে। টিভির পর্দায় অগ্নিদগ্ধ জগন্নাথ হল দেখে মাথার ভেতর দপ করে একটা বাল্ব জ্বলে ওঠে। যে-স্মৃতিকে এতদিন সযতেœ আড়ালে রেখেছিল, তা কোনো নিরাপদ জনপদে।
আগুনকে সে চিরকাল ভয় পায়। খুব শৈশবে ফরিদপুরে নিজের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় গোয়ালঘর পুড়ে যাওয়া দেখেছিল। সাতসকালে হঠাৎ আগুন, পরে জেনেছিল পাশের বাড়ির শিকদার ম-লের সঙ্গে ছোট কাকার সম্পত্তির ভাগ নিয়ে বিবাদ ছিল, তারাই আগুন দিয়েছিল। সবকিছু ভালো মনে নেই, শুধু মনে আছে গোয়ালের খুঁটায় আটক দুটি গরু, সঙ্গে তাদের আরো গোটাদুই বাছুর। আগুনের ভয়ে ছোটাছুটি করছে, দড়িতে বাঁধা থাকায় পালাতে পারছে না। লোকজন এসে পড়ায় জল ছিটিয়ে সে-আগুন নেভানো হলে গরুদুটো বেঁচে যায়, কিন্তু একটা বাছুর দাউদাউ আগুনে পুড়ে একদিন পর চোখের সামনে কাতরাতে কাতরাতে মরে যায়। অনেকদিন ঘুমের মধ্যে বাছুরের ঘন কালো চোখ, সে-চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠেছে সে।
আজো ধড়ফড়িয়ে ওঠে মানস।
নিউইয়র্কে এখন সকাল, ঢাকায় রাত। কাল এবিসি নিউজের রাতের খবরে ঢাকায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হামলার খবর এসেছে। সে-খবর শুনেই কি মানস সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে? যে-দেশটাকে সে গত সাত বছর ভুলতে চেয়েছে মনেপ্রাণে, তাকে নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা তো তার থাকার কথা নয়। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছে, এ-কথা সে খুব ভালো করেই জানে। পেশাদারি আগ্রহ থেকে বিষয়টি সে অনুসরণ করেছে, তার বাইরে নয়। মামার কথা উদ্ধৃত করে বাবা দু-একবার চিঠিতে আবার গ-গোল বাধতে পারে, এমন কথা লিখেছেন। বিষয়টি মনে ধরে রাখেনি। অফিসে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি ইন-ডেপথ ব্যাকগ্রান্ডার লিখতে বলেছিল, ভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টের কথা বলে সে তা এড়িয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। তার বস রেইমন্ড, ঘানার প্রবীণ সাংবাদিক, তাতে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিল। ‘আমি তো ভাবলাম তুমি বাড়তি আগ্রহ নিয়ে কাজটা করবে। তোমার চেয়ে ভালো ওই অঞ্চল এই অফিসে আর কে জানে!’
কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছে মানস। রেইমন্ড আর কথা বাড়ায়নি।
গতকাল দুপুরে ব্যায়াফ্রার গৃহযুদ্ধে পরাজয়ের পর নাইজেরিয়া থেকে পালিয়ে আসা এক বিদ্রোহী কমান্ডারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, সেটি শেষ করে কপি এডিটরকে পাঠিয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে মানস। অফিসঘরে টিভি চলছিল, এবিসির সন্ধ্যার প্রাইম টাইম নিউজ। শিরোনামেই ঢাকা, দিল্লি থেকে রেসিডেন্ট করেস্পন্ডেন্টের ডিসপ্যাচ। সঙ্গে দেড় মিনিটের একটি ভিডিও। এক সপ্তাহের পুরনো খবর, কেউ একজন গোপনে রেকর্ড করে ভিডিওটি পাঠিয়েছে। উপেক্ষা করবে ভেবেছিল, কিন্তু কানে এলো জগন্নাথ হলের নাম। সেনাসদস্যরা হলের ছাত্রদের পাখির মতো গুলি করে মেরেছে।
এই হলটি তার পরিচিত, নিজে কখনো থাকেনি, ঢাকায় তাদের নিজ বাড়িতে থেকেই সে লেখাপড়া করেছে। কিন্তু আড্ডা দিতে, গোপালের সঙ্গে টলটলে জলের মতো ডাল দিয়ে হোস্টেলের লাঞ্চ খেতে কতবার সে এসেছে। টিভির পর্দায় অগ্নিদগ্ধ জগন্নাথ হল দেখে মাথার ভেতর দপ করে একটা বাল্ব জ্বলে ওঠে। যে-স্মৃতিকে এতদিন সযতেœ আড়ালে রেখেছিল, তা জেগে ওঠে।
এবিসির নতুন তারকা-অ্যাংকর স্যাম ডোনাল্ডসন শব্দহীন ভিডিওটি দেখাতে দেখাতে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার সারসংক্ষেপ জানালেন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হামলা হয়েছে, ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালাচ্ছে, সে-দৃশ্য দেখিয়ে ডোনাল্ডসনের মন্তব্য ছিল, এ যেন বাইবেলে বর্ণিত একজোডাসের পুনরাবৃত্তি। লোভী, ক্রূর মানুষের হাতে আক্রান্ত মানুষ প্রাণভয়ে পালাচ্ছে, তাদের বেঁচে থাকার কী আপ্রাণ চেষ্টা।
একদিন এই শহর থেকে সেও পালিয়েছিল, বেঁচে থাকার জন্য নয়, কঠিন ক্রূর সত্য থেকে নিষ্কৃতি পেতে। সেটি একাত্তরে নয়, আরো আগে ১৯৬৪ সালে।
শেষরাতের দিকে দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায় মানসের। অফিস থেকে ফিরে রাতের খাবার না খেয়েই শুয়ে পড়েছিল। রুমমেট রোমানিয়ার ট্যাক্সিচালক ম্যাথু জিজ্ঞেস করেছিল খাবে কিনা, খিদে নেই বলে কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়েছিল মানস। মাথার মধ্যে রয়ে গিয়েছিল সেই আগুনে পোড়ার দৃশ্য। দাউ-দাউ আগুনে সব পুড়ে যাচ্ছে, জগন্নাথ হল, ফরিদপুরের গোয়ালঘর, মালিবাগে তাদের নিজেদের বাড়ি। বাড়ি নয়, বাবা বলতেন ভদ্রাসন। টিনের দোচালা বাড়ি, ফরিদপুরে নিজের গ্রামের বাড়ি থেকে ঠাকুরদার নিজ হাতে বানানো কাছারিঘরের টিন খুলে এনে লাগানো হয়েছিল। এই নিয়ে তিন ভাইয়ের সঙ্গে বিবাদ হয়েছিল, মুখণ্ডদেখাদেখি বন্ধের জোগাড়। গল্পে শুনেছে, বাবা নিজে হাতে একেকটা টিন খুলে নিতে নিতে তিন কাকুকে শুনিয়ে বলেছিলেন, বাজান থাকব আমার লগে। এই টিন তার সাক্ষী।
আহামরি কোনো বাড়ি নয়, দুখানা কামরা, আলাদা হেঁসেল, আর সামনে সুন্দর একটা বারান্দা। ছোট একটা বাগানও ছিল, মায়ের নিজ হাতে বানানো। মানসের পীড়াপীড়িতে একটি পেয়ারাগাছ লাগানো হয়েছিল, কয়েক বছর ধরে তাতে ফল আসছিল। এমনিতে ছোট পেয়ারা; কিন্তু ভেতরে টসটসে লাল শাঁস। কামড় দিলে আমিত্তির মতো গলে গলে পড়ে। ছোট বোন মাধবী পেয়ারা না বলে আমিত্তিই বলত। বাড়ির আঙিনায় আগে থেকেই একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল, কোনো যতœ ছাড়াই শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে সারা বাড়িটার ওপর ছায়া বিছিয়ে থাকত। ফেব্রুয়ারির আগেই টকটকে লাল ফুলে ভরে উঠত, দূর থেকে দেখলে মনে হতো আগুনের বন্যা ছুটেছে। বেশ কয়েক বছরের পুরনো কৃষ্ণচূড়া, পোক্ত-চওড়া গুঁড়ি, শক্ত গাছের ডাল। সবচেয়ে নিচের ডালটায় মাধবীর জন্য একটি দড়ির দোলনা বানিয়ে দিয়েছিল মানস। একা পারেনি, কলেজের দুই বন্ধুকে ডেকে এনেছিল। শুধু মাধবী নয়, কোনো কোনো শীতের সকালে মা পর্যন্ত এসে দোল খেতেন। মাধবীর কোনো সকাল-দুপুর ছিল না, যখন খুশি এসে বসত। অনেক সময় জোরে জোরে স্কুলের পড়াও মুখস্থ করত। প্রতিবেশী কোনো বন্ধু এলে মহাগর্বের সঙ্গে বলত, আমার দোলনা, দাদা বানিয়ে দিয়েছে।
এই বাড়িতে আলাদা কোনো ঠাকুরঘর ছিল না। ঠাকুর-দেবতায় তার কোনো বিশ্বাস নেই, এ-কথা সবার সামনেই বলতেন বাবা। তবু মায়ের জন্য বারান্দার এক কোণে পূজার স্থান করে দিয়েছিলেন। অবাক ব্যাপার, প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বেরুবার সময় তার নিরীশ্বরবাদী পিতা একবারের জন্য হলেও দূর থেকে মাথায় হাত ছুঁয়ে রাধাকৃষ্ণের সে-মূর্তির প্রতি প্রণামটুকু জানিয়ে যেতেন।
তার সবটাই পুড়ে গেল। মানস স্বপ্নে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ভেঙে পড়ছে ঘরের চৌকাঠ, মায়ের রাধাকৃষ্ণ, বারান্দায় তরতর করে বেড়ে ওঠা তুলসীগাছ, আঙিনায় বাড়ি জুড়ে ছায়া বিছিয়ে রাখা বিশাল
কৃষ্ণচূড়া। হাওয়ায় দোল খাচ্ছে মাধবীর দোলনা, পাটের দড়িতে আগুন ধরে তা থেকে তারাবাতির মতো ফুলকি ছুটছে। বারান্দায় বাবার বেতের ইজি চেয়ারটা কেউ একজন টেনে নামালো, এখনো অক্ষত রয়েছে, পরে কাজে লাগবে। হাতের মশাল নিয়ে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির দিকে ছুটে গেল দুজন। মানস চিৎকার করে বলতে চাইছিল – মুসা, থামা, থামা, ওটা যে মায়ের রাধাকৃষ্ণ। কেউ একজন টেনে নামাল বারান্দার দেয়ালে ঝোলানো রবীন্দ্রনাথের ছবি। অন্য কোনো দেবতা ছিল না বাবার, ছিল এই এক রবীন্দ্রনাথ। বুকের পাঁজরে এসে ঘা লাগল মানসের, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না। দূর থেকে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুসার পাশে দাঁড়ানো কেউ একজন, সম্ভবত মগবাজারের মোক্তারের ছেলে আবু হানিফা, চেঁচিয়ে উঠল, ধর, ওই মালাউনটারে ধর।
পালাতে শুরু করল মানস।
পালাচ্ছে সে ভয়ে নয়, দুঃখে। মুসা তার শৈশবের বন্ধু, একই স্কুলের ছাত্র, বাড়িতে আগুন দেওয়ার কাজে সে নেতৃত্ব দিচ্ছে। চোখেমুখে কী উল্লাস, যেন একটি পবিত্র কাজ করছে, যে-কাজের জন্য দীর্ঘদিন সে অপেক্ষা করেছে। সঙ্গে
পাঁচ-সাতজন মানুষ, অধিকাংশ মালিবাগের এই পাড়ার নয়, বাইরে থেকে আসা। উর্দুভাষী বিহারিরাই সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ, কারো কারো হাতে মশাল, লাঠিসোটা। আরো জনাদশেক দূর থেকে মজা দেখছে, কেউ কেউ বাধা দিতেও চেষ্টা করছে। সেই আগুন ঠেলে কেউ কেউ আবার ঘরের দামি জিনিসপত্র হাতিয়ে নিতে ব্যস্ত। বাবার কাশ্মিরি শালটা বসার ঘরে চেয়ারের ওপর পড়ে ছিল, কেউ একজন আগুন উপেক্ষা করে আলোয়ানটা কুড়িয়ে নিল।
এমন একটা কিছু ঘটতে পারে, সে-আশঙ্কা তাদের ছিল, সেজন্য বাবা সবাইকে দুদিন আগেই টিকাটুলীতে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। একা মানসকে রেখে গিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, রাজনীতি করে, অল্পবিস্তর প্রভাব রয়েছে। বাবাকে সে-ই আশ্বাস দিয়েছিল, সব সে সামলে নিতে পারবে। এই পাড়ায় যদি রায়ট বাধানোর চেষ্টা হয়, সে থাকলে তাদের বাড়ি হামলা করতে কেউ সাহস করবে না। এই পাড়ায় সে সকলের পরিচিত, অধিকাংশ মানুষ তাকে আলাদা চোখে দেখে। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় সে স্ট্যান্ড করেছিল, তাকে নিয়ে এজন্য পাড়ার লোকজন গর্ববোধ করে। তার বাড়িতে কেউ আগুন দিতে পারে, এমন ভাবনাও তার মাথায় আসেনি।
দুপুরে যথারীতি ক্লাস করেছে। গেল বছর, অর্থাৎ ১৯৬৩ সালে ডিসেম্বরের শেষ মাথায় কাশ্মিরের হজরতবাল মসজিদে সংরক্ষিত হজরত মোহাম্মদের পবিত্র চুল খোয়া গেছে – এই ঘটনা নিয়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গা বেধেছে, এ-কথা সে জানত। পূর্ব পাকিস্তানের খুলনাতেও ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছে, দৈনিক ইত্তেফাকে এই নিয়ে গত কয়েকদিন সবিস্তার খবর বেরিয়েছে। কিন্তু সে-ঘটনা যে বাড়তে বাড়তে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে – এ-কথা সে ভাবেনি।
পত্রিকা পড়েই মানস জেনেছে, খুলনার পুরো ব্যাপারটা মুসলিম লীগ নেতা সবুর খানের সঙ্গে স্থানীয় এক হিন্দু ভদ্রলোকের সম্পত্তি নিয়ে বিবাদকে ঘিরে। সবুর খান মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতা, একসময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন, খুলনায় তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। বছরকয়েক আগে তিনি জেলার এক হিন্দু জমিদারের বাড়িঘর দখল করে নেন। সে জমিদার নিজের পরিবার-পরিজন আগেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু নিজে বাড়িঘর আঁকড়ে ছিলেন। সবুর খান তার সম্পত্তি দখল করলে তিনি মামলা ঠুকে বসেন। তিন বছর মামলা চলার পর আশ্চর্যজনকভাবে সে-সম্পত্তি ফিরেও পান তিনি। ব্যাপারটা সবুর খান মেনে নিতে পারেননি, তিনি তক্কেতক্কে ছিলেন কী করে সে-সম্পত্তি ফের হস্তগত করা যায়। টাকা-পয়সা দিয়ে একটা ফয়সালা করতেও চেয়েছিলেন, জমিদারবাবু রাজি হননি। ঠিক এইসময় ঘটে হজরতবালের ঘটনা। হাতে চাঁদ পেলেন সবুর খান। এর আগেও তিনি নিজ জেলায় দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। হিন্দু খেদানোর এমন সুবর্ণ সুযোগ ছাড়তে রাজি হলেন না।
তাকে উস্কে দেওয়ার জন্য পথ বাতলে দিলেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান। ডিসেম্বরের শেষে ঢাকা এসেছিলেন, যাওয়ার আগে বলে গেলেন, হজরতবালের ঘটনা বিশ্বের সকল মুসলমানের পবিত্র বিশ্বাসের ওপর এক হামলা। এর প্রতিশোধ নেওয়ার পুরো অধিকার পাকিস্তানের মুসলমানদের আছে। দেশের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে তাঁর দল কনভেনশন মুসলিম লীগ ঘোষণা দিলো, ৩ জানুয়ারি হবে ‘কাশ্মির দিবস’। সে-ঘোষণার পরপরই দেশ জুড়ে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে খুলনা, তারপর আগুন ছড়াতে ছড়াতে রাজশাহী, পাবনা, সিলেট, এমনকি নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। ৪ জানুয়ারিই জানা গিয়েছিল খোয়া যাওয়া সে-চুল উদ্ধার হয়েছে, তা যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহ্্রুও রেডিওতে ভাষণ দিয়ে আশ্বাস দিলেন, অপরাধীর যথাযথ শাস্তি হবে। ভারতে সহিংস ঘটনা থেমে গেলেও পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা ঠেকানো গেল না। মুসলিম লীগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হজরতবালের ঘটনা ব্যবহার করবে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ঠিকই ধরতে পেরেছিল, সেজন্য তাদের উদ্যোগে দাঙ্গাবিরোধী কমিটি হয়েছিল, প্রেস কনফারেন্স করে যে-কোনো মূল্যে দাঙ্গা ঠেকাবার অঙ্গীকারও করেছিল তারা। কিন্তু দাঙ্গা শুরু হলে সে-কমিটির কারো টিকিটিও খুঁজে পাওয়া গেল না।
শহরে দাঙ্গা হতে পারে, এ-কথা জানার পরও মানসের স্থির বিশ্বাস ছিল, মালিবাগে তাদের পাড়ায় কোনো অঘটন ঘটবে না। যদি বাইরে থেকে এসে কেউ ফ্যাসাদ বাঁধানোর চেষ্টা করে, তা ঠেকানোর মতো ক্ষমতা তাদের রয়েছে। বাবাও বলেছিলেন, দিনকয়েকের উত্তেজনার পর সব ক্রমশ মিইয়ে আসবে। দাঙ্গা এই পাড়ায় আগেও হয়েছে, তা দেখার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। একসময় এই পাড়াটি ছিল হিন্দুপ্রধান, কম করে হলেও কুড়ি-পঁচিশ পরিবার বাস করত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কলকাতায় হোমিওপ্যাথি ব্যবসা তিনি জমাতে পারেননি, ফরিদপুরে ফিরে এসেছিলেন। ফিরে আসার দিনটি পর্যন্ত বাবা মনে রেখেছিলেন, শুক্রবার, ৮ আগস্ট ১৯৪১। মনে রাখার কারণ ঠিক তার আগের দিন দেহত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ। কলকাতা থেকে বাবা রবিঠাকুরের একটি হাতে আঁকা ছবি এনেছিলেন, সেটি সযতেœ বাঁধাই করে বারান্দায় ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। দেশভাগের আগে আগে ফরিদপুরের বাড়ি বিক্রি করে বাবা ঢাকা চলে এলেন, সেটা ’৪৫ সালের মাঝামাঝি।
সেই থেকেই তারা ঢাকায়। মাত্র সাত হাজার টাকায় পাঁচ কাঠার এই জায়গাটুকু কিনেছিলেন বাবা। গ্রামের ভিটেবাড়ি বিক্রির টাকায় কুলোয়নি, বড় মামার কাছ থেকে কিছু ধার নিতে হয়েছিল। রাতারাতি নয়, একটু একটু করে বাড়িটি বানিয়েছেন তিনি। ফরিদপুর থেকে বাবা যখন তাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন, মানসের মন খারাপ হয়েছিল। বন্ধুদের ছেড়ে আসতে হয়েছে, প্রিয় মিশন স্কুল ছেড়ে আসতে হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা, দশ মিনিট হাঁটাপথে কুমার নদ, তাকে বিদায় জানিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু মা খুব খুশি হয়েছিলেন, এবার একেবার নিজের একটি বাড়ি। হোক না ছোট, হোক না মাত্র দুটি কামরার।
দেশভাগের পর গত পনেরো বছরে ঢাকায় ছোটখাটো যে-দাঙ্গা হয়েছে, মালিবাগেও তার আঁচড় পড়েছে। দেশভাগের পর দুই-তিন ঘর হিন্দু এই পাড়া ছেড়ে চলে গেলেও অধিকাংশই মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিল। যারা চলে যায় তাদের অধিকাংশই অবস্থাপন্ন, কেউ কেউ আগে থেকেই কলকাতায় বা এর আশেপাশে চাকরি বা ছোটখাটো ব্যবসা গুছিয়ে নিয়েছিল। একজনের কথা মানসের খুব ভালো করে মনে আছে। অ্যাডভোকেট বিহান রায়, তাদের বাড়ির লাগোয়া ঘর। মনে রাখার আসল কারণ অবশ্য ভিন্ন, হাই স্কুলে পড়ার সময় রায়বাবুর কনিষ্ঠ কন্যা রাকার প্রতি মানসের একটি গোপন টান ছিল। সে-টানের কী অর্থ তা অবশ্য সে কখনো তলিয়ে দেখেনি। চব্বিশ পরগনায় না কোথায় সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করে চলে গেলে হঠাৎ কেমন খালি খালি লেগেছিল। রাকা যাওয়ার আগে একটা রুমাল দিয়ে গিয়েছিল, তা আলাদা করে জমিয়ে রাখার প্রয়োজন দেখেনি মানস।
রায়বাবু চলে যাওয়ার পর তাদের খালি বাড়িতে এসে ওঠেন চাকলাদার কাকুরা। রাতারাতি বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, কাকির সঙ্গে মাকে দেখলে মনে হতো দুই বোন। তারা নিজেরা কখনো জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামায়নি, যখন-তখন চাকলাদার বাড়িতে গিয়ে মুড়ি দিয়ে ছোলা ভাজা খেয়েছে, কাকা-কাকিও ছুটির দিন চা খেতে এসে পড়তেন। তারা নিঃসন্তান, মানস ও মাধবীকে নিজের ছেলেমেয়ের মতোই দেখতেন। পুজো কি ঈদে একে অপরের বাসায় ঘরে বানানো পায়েস ঠিকই পৌঁছে যেত।
পরে আরো কয়েক ঘর মুসলমান পরিবার এখানে ভিটেবাড়ি গড়ে তোলেন। একাধিক মুসলমান পরিবারকে নিজের লাগোয়া বাড়িতে পেয়ে বাবা খুশি হয়েছিলেন। এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিলেন, এবার মিলেমিশে থাকা যাবে, এক প্রতিবেশী অন্য প্রতিবেশীকে আগলে রাখবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উলটো। ভারত থেকে আসা উদ্বাস্তু পরিবারের কেউ কেউ দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ভয়াবহ সব গল্প তাদের কাছ থেকে শোনা গেল। কলকাতার এক দাঙ্গায় নাকি তাদের পরিচিত এক মেয়ের স্তন কেটে নেওয়া হয়েছে, এমন গল্পও শোনা গেল। এদের কেউ কেউ যে ভারতে দাঙ্গার শিকার, তার সব রাগ পড়ল প্রতিবেশী হিন্দুদের ওপর। প্রথমে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বিবাদ। প্রতিবছর পাড়াতেই প্যান্ডেল বেঁধে পুজো হতো, মুসলমানদের প্রতিবাদে সেটা বন্ধ হলো। কারো কারো বাসায় কাঁসার ঘণ্টা বাজিয়ে সান্ধ্যপূজা হতো, সেটাও বন্ধ করতে হলো। পাড়ার মাঠে হিন্দু-মুসলমান ছেলেরা বিকেল হলে একসঙ্গে ফুটবল খেলত, কেউ তাতেও আপত্তি করল। খেলা অবশ্য বন্ধ হলো না।
আরো একটা ঘটনা ঘটেছিল, অতি তুচ্ছ, কিন্তু প্রতিবেশীদের মধ্যে এই নিয়ে মুখণ্ডদেখাদেখি বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। পাড়ার হীরেন বণিক, ছোটখাটো ব্যবসা করতেন, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ, গোল বাধল তাকে নিয়ে। ঠিক তাকে নিয়ে নয়, তার বৃদ্ধ মাকে নিয়ে। বণিকের উঠোনে একটি তুলসীগাছ ছিল, এরকম অনেকের বাসাতেই ছিল, সেটা কোনো ব্যাপার নয়। বেশ ডাগর-ডোগর গাছটি, ঠাকুরমা সকাল-বিকেল স্নানশেষে সে-গাছে জল ঢালতেন। একদিন পাড়ার এক বাড়ির ছাগল ঢুকে সে-গাছের পাতা খেয়ে ফেলে। ঠাকুরমা দেখতে পেয়ে মহাতুলকালাম বাধিয়ে দিলেন। তিনি ছাগলটাকে কাজের ছেলেটাকে দিয়ে ধরিয়ে গোয়ালের খুঁটিতে বেঁধে রাখলেন। দুপুরের পর সে-ছাগল খুঁজতে মানিক নামে এক ছেলে এসে হাজির। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার রফিকউদ্দিনের ছোট ছেলে, ছাগলটি তার খুবই আদরের। মানিককে দেখে ঠাকুরমা রেগে অগ্নিশর্মা। ছাগল তো ফেরত দিলেনই না, উলটো বলে পাঠালেন, এই ছাগল তিনি খোঁয়াড়ে পাঠাবেন। পিঠে খুন্তির এক বাড়ি দিয়ে বললেন, ‘তোর বাপেরে কইস, খোঁয়াড় থাইকা যেন ছাড়াইয়া আনে।’ সন্ধ্যার পর আরো দুই-তিন প্রতিবেশী নিয়ে রফিক মাস্টার এসে হাজির, তিনি তো রাগে ফটফট করছেন। ‘দুইটা পাতা খাইছে তো কি হইছে। তুলসীর পাতা না তো, যেন সোনার মালা।’ তার সে-কথা শুনে হীরেন বণিক তর্কে নাক গলাল। রফিক মাস্টারের পক্ষ নিয়ে লড়তে এগিয়ে এলো তার সঙ্গে আসা হারু মাতব্বরের ছেলে। দুই পক্ষে প্রায় হাতাহাতি। চেঁচামেচি শুনে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দুই পক্ষকে সামাল দিলেন। কিন্তু এই সামান্য ঘটনাই পুরো পরিবেশটাকে বিষিয়ে তুলল।
বাবা এসব ঘটনাকে মোটেও পাত্তা দেননি। চাকলাদার কাকুও তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন, কলকাতায় দাঙ্গা দেখার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। এটি সাময়িক প্রতিক্রিয়া, বাইরের লোকের উস্কানি, তিনি বোঝালেন। একসঙ্গে থাকতে থাকতে সবাই একে অপরের সঙ্গে মানিয়ে নেবে, বাবাও সে-কথা বিশ্বাস করতেন। এই বাড়ি, এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা তার মাথায় আসেওনি। হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হিসেবে এই শহরে তার যশ রয়েছে, পাড়াতেও হিন্দু-মুসলমান সবাই তাকে মান্যগণ্য করে। আগুন ধরানোর মতো কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিতেন, মানসকেও তাতে উৎসাহ জোগাতেন।
কিন্তু তিনি ধরতে পেরেছিলেন হজরতবালের ঘটনাটি ভিন্ন, এর সঙ্গে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি জড়িয়ে আছে। এখন মুসলিম লীগের উস্কানিতে রাজনীতি যুক্ত হলে রক্তারক্তি ঠেকানো অসম্ভব হবে। বছরের প্রথম দিন রামপুরায় হিন্দুবাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সিদ্ধেশ্বরীর কালীবাড়িতেও মাঝরাতে হামলা হয়, সেখানে কিছু দামি মালামাল খোয়া যায়, এমন একটা গুজবও শোনা গেল। ৩০০ বছরের পুরনো কষ্টিপাথরের একটি কালীমূর্তি ছিল, সেটির অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি। এসব দেখেশুনে বাবা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। চাকলাদার কাকুই বললেন, দিনকয়েকের জন্য অন্য কোথাও গিয়ে বেরিয়ে আসুন, আমরাই বাড়িঘর দেখে রাখব।
৩ জানুয়ারি ‘কাশ্মির দিবস’ ঘোষণার পরপরই বাবা ঠিক করলেন মা ও ছোট বোন মাধবীকে নিয়ে টিকাটুলীতে মামাবাড়িতে আশ্রয় নেবেন। সেখানে মামার পাকা বাড়ি, যথেষ্ট সুরক্ষিত। তাছাড়া মামা সরকারি কর্মচারী, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। মানসকেও আসতে বলেছিলেন, কিন্তু সে বুঝিয়ে বলল, বাড়ি একদম খালি করে গেলে চুরি হতে পারে, দাঙ্গাকারীরা আলগা উৎসাহ পাবে। তাছাড়া সে নিজে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের দাঙ্গাবিরোধী কমিটির সদস্য। এই পাড়াতেও তার যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে। তার ওপর হামলা হলে পাড়ার লোকেরাই মুখিয়ে আসবে, এ-বিশ্বাস তার ছিল।
বাস্তবে ঘটল উলটো।
জগন্নাথ হলের অগ্নিদগ্ধ ডাইনিং হল মানসের চোখে ভাসে। আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে জগন্নাথ হল বেশ খানিকটা দূরে, রিকশায় গেলে পাক্কা চার আনা। গোপাল ও সবুরকে একই রিকশায় বসিয়ে কতদিন দুপুরে লাঞ্চ খেতে চলে এসেছে। সবুর সবচেয়ে রোগাপটকা, তাকে বসতে হতো মাঝখানে। একদিকে গোপাল, অন্যদিকে মানস তাকে ঠেসে চেপে ধরত, সবুর চেঁচিয়ে – হাত-পা ছড়িয়ে নিজের জন্য বাড়তি জায়গা করার চেষ্টা করত। খুব একটা কাজে লাগত না। একদিকে সবুরের তারস্বরে চিৎকার, অন্যদিকে তাদের দুজনের অট্টহাসি, রিকশাওয়ালা পর্যন্ত না হেসে পারত না।
সে-কথা মনে পড়ায় হেসে ফেলে মানস। পরক্ষণেই আগুনের ফুলকির মতো ছোবল দেয় হলের দোতলার বারান্দায় ঝুলে থাকা একটি ঝলসানো মৃতদেহের দৃশ্য। দূর থেকে অপেশাদার ভিডিও ক্যামেরায় তোলা কয়েকটি মুহূর্ত, প্রায়ান্ধকারে কোনো কিছুই স্পষ্ট হয় না। অথচ মানসের মনে হয় সে-ফিল্মের প্রতিটি ফ্রেম তার চেনা। এমনকি আঙিনার কৃষ্ণচূড়া গাছটি পর্যন্ত। এই গাছ কি জগন্নাথ হলের, না তার মালিবাগের বাড়ির? স্মৃতি হাতড়ে উত্তর খোঁজে মানস।
মালিবাগে যেদিন দাঙ্গা হয়, সেদিন দুপুরে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ জমায়েতে অংশ নিচ্ছিল মানস। আগুন দেওয়ার মুহূর্তটি তার অজানা। রাত সাড়ে আটটার দিকে বাস থেকে নেমে বাসার দিকে পা বাড়াচ্ছিল, মোড়ের পান-বিড়ির ছোকরা দোকানি তাকে দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে, বর্দা, সর্বনাশ হইয়া গেছে, বাড়িতে আগুন দিছে। কী বলছে কথাটা বুঝতে সামান্য কয়েক মুহূর্ত সময় লেগেছিল। তারপর প্রাণপণে বাড়ির দিকে দৌড়, কিন্তু পৌঁছানোর আগেই বাড়ির অর্ধেক পুড়ে শেষ। চাকলাদার কাকা সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি পথ আটকে দাঁড়ালেন, ওদিকে এখন যেও না, রক্তারক্তি বেধে যেতে পারে। আগুন দিতে ব্যস্ত জনাতিনেক, বাকি সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে যেন তামাসা দেখছে। এদের একজন মুসা, তার হাতে পাকিস্তানের পতাকা জড়ানো একটি লাঠি।
মুসাকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি মানস। শুধু একই পাড়ার নয়, একই কলেজের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে দুজনেই আর্টস ফ্যাকাল্টিতে, মানস ইংরেজিতে, মুসা ইতিহাসে। একতলা-দোতলায় ক্লাস, প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়েছে। শৈশবে পাড়ার মাঠে একসঙ্গে ক্রিকেট খেলেছে, বারদুয়েক দুজনে একসঙ্গে হেঁটে স্টেডিয়ামে টেস্ট ক্রিকেট দেখতে গেছে। অনেক বিকেল ছিল যে তারা হেঁটে হেঁটে রমনা পার্কে চলে গেছে। রানি এলিজাবেথের সংবর্ধনার জন্য এখানে একটি খোলা মঞ্চ বানানো হয়েছিল, তাদের দুজনেরই জায়গাটা প্রিয়। কতদিন সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত আড্ডায় কাটিয়েছে। মুসাকে সে নিকট বন্ধু বলেই জানত। উভয়ে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে ইলেকশন ক্যাম্পেইন করেছে। মুসার হাতের লেখা সুন্দর, মানসের ছবির হাত দারণ। ফলে দুজনে মিলে অনেকবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে চিকা দিয়েছে। মানসের একটি প্রিয় শেফার্স পেন ছিল, ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর বড়মামা উপহার দিয়েছিলেন। কলমের একদিকে সরু নিব, অন্যদিকের নিবটি মোটা। পোস্টার লিখতে খুব কাজ লাগত। মুসা একবার সেই কলমটি চেয়ে নিয়েছিল, আর ফেরত দেয়নি। পরে অপরাধীর মতো বলেছিল, কলমটি হারিয়ে গেছে। এই নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনি মানস।
সেই মুসা?
মাসছয়েক আগে একটি ঘটনায় দুজনের বন্ধুত্বে কিছুটা চিড় ধরে। মানস কোনোভাবেই জড়িত ছিল না, কিন্তু বিবাদটা সাম্প্রদায়িক মোড় নেওয়ায় একটি অনিবার্য দূরত্ব তৈরি হয়। ঘটনাটার সূত্রপাত ইংরেজির সেমিনার রুমে। অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে ছেলেমেয়েদের আলাদা আলাদা বসার নিয়ম থাকলেও ইংরেজিতে সামান্য ব্যবধান রেখে সবাই একসঙ্গেই বসত। অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরাও মাঝেমধ্যে আসত আড্ডা জমাতে। মেয়েদের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন, তাদেরই একজন রেবতি। হাইকোর্টের নামজাদা জজ বিনায়ক ভট্টাচার্যের মেয়ে, ডাকসাইটে সুন্দরী। করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলে অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়ত শুধু দেখার জন্য। শোনা গেল মুসা মেয়েটিকে অপমান করেছে, তাও যেমন-তেমন নয়, মেয়েটির ব্রা ধরে টান দিয়েছে। সেমিনার রুমে আর দু-তিনজন ছেলেমেয়ের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিল, তার ব্লাউসের আড় ঘেঁষে ঘাড়ে চুলের নিচে বেরিয়ে ছিল ব্রার ফিতা। মুসা পেছন থেকে এসে হঠাৎ স্ট্র্যাপে টান দিয়ে দাঁত বের করে হাসতে থাকে। এমন ঘটনা সে কেন করল, এই সাহসই বা কোত্থেকে পেল, সে এক প্রহেলিকা। রেবতিকে সে চিনত, ভালো পরিচয়ও ছিল, কিন্তু তাই বলে সবার সামনে ব্রা ধরে টানার মতো সম্পর্ক তাদের নয়। সে-ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন পার্থ, ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ডাকাবুকো ছেলে। রেবতি এই নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করার আগে তিন টেবিল ডিঙিয়ে লাফিয়ে পড়ে মুসার ওপর। প্রথমে কিল-ঘুসি, তারপর এক লাথিতে মাটিতে ফেলে দেয়। তাতে মুসার দুটি দাঁত ভেঙে যায়।
মুহূর্তে বিষয়টি সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র হয়ে যায়। আসল ঘটনা ঢাকা পড়ে শুধু শোনা গেল এক হিন্দু ছেলে এক মুসলমান ছেলেকে পিটিয়ে প্রায় আধমরা করে ছেড়েছে। এই নিয়ে হিন্দু-মুসলমানে বচসা শুরু হলো, দু-চার জায়গায় হালকা ধাক্কাধাক্কিও হলো। পুরো বিষয় নিয়ে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে তদন্ত হলে দুজনকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তাদের দুজনকেই এক্সপেল করা হবে, পরে শুধু মুসাকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যেতে নির্দেশ দেওয়া হলো। ইতিহাস ছেড়ে ঢাকা কলেজে বিএ পাশ কোর্সে ভর্তি হলো মুসা।
এ-ঘটনায় মানসের কোনো ভূমিকা ছিল না, ঘটনার সময় সেমিনারের ধারেকাছেও সে নেই। অথচ অন্যান্য হিন্দু ছাত্রের মতো সেও মুসার চোখে অপরাধী হয়ে উঠল। তাকে ইউনিভার্সিটি ছাড়তে হয়েছে, এই অপমান মুসা কিছুতেই ভুলতে পারেনি। এরপর যতবারই মুখোমুখি হয়েছে, মানসকে সে উপেক্ষাই করেছে।
কিন্তু সেই ঘটনার জন্য হিন্দুবাড়িতে আগুন দিতে দলবল নিয়ে হাজির হবে মুসা, এ-কথা ভাবতে পারেনি মানস। সে যে পেছন থেকে এসে হাজির হয়েছে, মুসা তাকে দেখেনি। মানসই তাকে দেখে, ভয়ে-আতঙ্কে চেঁচিয়ে বলে, মুসা, এটা কী করছিস! কোনো জবাব দেওয়ার আগেই মুসার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আল-আমিন চেঁচিয়ে ওঠে, ধর, মালাউনটারে ধর।
লাঠির আঘাতটা কে দিয়েছিল মনে নেই, দু-তিনজন একসঙ্গে ধেয়ে এসেছিল, প্রত্যেকের হাতে জ্বলন্ত মশাল। আগুনের হল্কা এসে তার জামায় পড়লে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। কী করবে বোঝার আগেই চাকলাদার কাকা গায়ের কোট খুলে তাকে জড়িয়ে ধরেন।
বাড়িতে আগুন লাগার কথা শুনে বাবা তখনই ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, মা আসতে দেয়নি। মামাও তীব্র আপত্তি করেছিলেন, বলেছিলেন, এখন নয়, দাঙ্গা থামুক, তারপর। পুলিশ জায়গাটা ঘিরে রেখেছে, কিন্তু বিপদ এখনো কাটেনি। খবর নিয়ে জানা গিয়েছিল, তাদের বাড়ি নিয়ে মোট তিন হিন্দুবাড়ি পোড়ানো হয়েছে, আগুনে পুড়ে হারান খুড়োর ছোট ছেলে মারা গেছে। কয়েকজন আহত হয়েছে, কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দৈনিক সংবাদের ভেতরের পাতায় দাঙ্গাবিধ্বস্ত পাড়ার একটি ছবি ছাপা হয়েছিল, তা দেখার পর থাকতে না পেরে দাঙ্গার তিনদিন পর এক বন্ধুকে নিয়ে নিজের বাড়ি দেখে এসেছে মানস। সে বাবাকে জানিয়েছে, সব শেষ, এখন গিয়ে কোনো লাভ নেই।
ওই বাড়িতে মানসদের আর ফিরে যাওয়া হয়নি।