পুরাণের পঞ্চকন্যা : বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নবরূপায়ণ

পূরবী বসু
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যালি সাদারল্যান্ড ২০০৫ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে এক হাজার তরুণ ছেলেমেয়ের ওপর একটি সমীক্ষা চালান। তাদের সবচেয়ে প্রিয় নারীচরিত্র কে, সেটা যাচাই করে নেবার জন্যে প্রাচ্য মিথোলজির কয়েকটি প্রখ্যাত চরিত্রের সঙ্গে তাদের পছন্দ করার জন্যে দেওয়া হয়েছিল সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের বিখ্যাত সব নায়িকা, স্বনামধন্য কয়েকজন লেখক (জনপ্রিয়-জীবিত লেখকসহ) ও শিল্পীসহ বিভিন্ন বিষয়ে অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী বেশ কয়েকজন উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম – সব মিলিয়ে মোট ২৪ জন, যাঁরা সকলেই নারী। ফলাফলে দেখা যায়, অধিকাংশ ভোট পেয়ে অনেক ব্যবধানে প্রথম হয়েছে দুহাজার বছরের পুরনো পৌরাণিক ও কল্পিত চরিত্র সীতা। কোনো রক্তমাংসের মানুষ নয়, এমনকি পৌরাণিক নারী দ্রৌপদী বা তার মতো কেউও নয়। অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির, নির্বিরোধী, সর্বংসহা, নির্জীব এক নারী সীতা। সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে না, পারে না কোনো প্রতিবাদ করতে। নিজের বা অন্য কোনো নারীর প্রতি অন্যায়, দুর্ব্যবহার অথবা কটূক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সে অসমর্থ। অথচ এই রকম একটি জড় পদার্থই ভারত উপমহাদেশের আদর্শ নারীর উদাহরণ, সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত। মুখ বুজে সকল অত্যাচার সইবার ভূমিকায় লোকে (পুরুষ-নারী উভয়েই) বরাবর দেখতে চায় নারীকে। আর সেটা দেখেই অভ্যস্ত তারা। আত্মসচেতন, প্রতিবাদী, অবিচারের প্রতিশোধ নিতে আগ্রহী, তেমন তেজি কাউকে পছন্দ নয় তাদের। অন্তত একজন নারী হিসেবে এই শেষোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো একেবারেই গ্রহণীয় বা বাঞ্ছনীয় নয়। ফলে সীতা-সাবিত্রী যেমন জনপ্রিয়, দ্রৌপদী, কুন্তি কিংবা গান্ধারী তেমন নয়।
‘প্রাচ্য পুরাণ’ থেকে আমার নিজের পছন্দের পঞ্চকন্যাকে শনাক্ত করার আগে ‘প্রাচ্য পুরাণ’ বলতে আসলে এখানে কী বুঝিয়েছি সেটা বলা প্রয়োজন। ‘প্রাচ্য পুরাণ’ বলতে কেবল ১৮টি মহাপুরাণ ও ১৮টি উপপুরাণই বোঝানো হয়নি, এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে পুরুষানুক্রমে প্রবহমান সকল কাহিনি বা ‘মিথ’কেই বুঝিয়েছি। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে শুরু করে খ্রিষ্টের জন্মের পর কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা লিখিত, রোমন্থিত, পরিবেশিত, পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও সংকলিত নানান আদি গ্রন্থ, মূলত ধর্মগ্রন্থ, যেমন – ক) বেদ ও উপনিযদ, খ) উপবেদ, গ) বেদান্ত, ঘ) স্মৃতি সংহিতা, ঙ) গীতা, চ) পুরাণ, ছ) আগমশাস্ত্র, জ) রামায়ণ ও মহাভারত, ঝ) চন্ডী এবং ঞ) ষড়্দর্শন (ছয় দর্শন) প্রাচ্য পুরাণের অন্তর্গত। বেদের আরেক নাম শ্রুতি। এর কারণ, লিপিবদ্ধ হওয়ার আগে দীর্ঘকাল ধরে বেদ মূলত মানুষের স্মৃতিতেই বিধৃত ছিল। একের কাছ থেকে অন্যে, বিশেষ করে গুরুর কাছে শিষ্য, শুনে শুনে শিখত ও মনে রাখত সেসব। এইসব আদি ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণে নানান দেবদেবীর কর্মকান্ড এবং তাদের বন্দনা ও উপাসনার পদ্ধতি লিপিবদ্ধ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে অতিপ্রাকৃতিক সব ঘটনা ও চরিত্রের সমন্বয়ে গড়া বহু কাহিনির বিবরণ।
শান্তনু কায়সারের মতে, ‘মিথ এমন সময়ের কথা যখন পৃথিবী ছিল তরুণ আর কল্পনা ছিল তরুণী, যুক্তির চেয়ে উপলব্ধি দিয়ে জগৎকে চেনা যেত বেশি।’ মিথোলজিই কোনো জাতির সর্বপ্রথম এবং সর্বপুরনো বিস্তৃত কাহিনি বা উপাখ্যান। ফয়েজুন্নেছা বেগম লিখেছেন, ‘পুরাণ সাহিত্য প্রাচীন ভারতবর্ষের একটি জীবন্ত ইতিহাস।’ অন্যভাবে বলা চলে, মিথোলজি কোনো জাতির এক ধরনের অতিরঞ্জিত প্রাচীন ইতিহাস যা সাধারণত বিভিন্ন বয়ানে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ব্যক্তি দ্বারা গ্রন্থিত, যার মাধ্যমে আমরা সেই অঞ্চলের আদিম জনগোষ্ঠীর জীবনের স্বরূপ বুঝতে চেষ্টা করতে পারি। যদিও সেই জীবনাচরণ বা জীবনবোধে থেকে যায়, এমনকি জায়গায় জায়গায় একরকম শক্তভাবেই গেঁথে থাকে, অতিলৌকিক বহু কল্পনার মিশেল। আর সেই কল্পবাস্তবে ঘেরা আবছা জগতেও আমরা প্রত্যক্ষ করি নরনারীর (অথবা দেবদেবীর) চিরন্তন প্রেম ও উন্মাদনা এবং তাদের অবস্থানগত বৈষম্য। এসব পৌরাণিক কাহিনিতে নারীকে আমরা খুঁজে পাই কখনো দেবীরূপে, কখনো ক্ষমতাধর শাসকরূপে, কখনো ব্যাকুল প্রেমিকা হিসেবে, কখনো স্নেহান্ধ জননীরূপে, কখনো কুটিল ষড়যন্ত্রকারী রূপে, এমনকি কখনো মায়াজাল বিস্তারকারিণী ঐন্দ্রজালিক মোহিনীরূপেও; যদিও এই সমস্ত রূপ ভেদ করে শেষ পর্যন্ত নারীকে পুরুষের আনন্দ জোগানোর উৎস ও তাদের ভোগ্যবস্ত্ত হিসেবেই মূলত দেখতে পাওয়া যায়। বড়জোর দেখা যায় আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্যে গুটিকয়েক ব্যতিক্রমী নারীকে অবিরাম সংগ্রাম করে যেতে।
পুরাণের প্রায় সব কাহিনিতেই রয়েছে ধর্ম এবং রাষ্ট্রশাসনের মধ্য দিয়ে সমাজজীবনে নৈতিকতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা। রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নিয়মকানুন এবং বিধিনিষেধের মধ্যে অনেকদিক দিয়েই বহু সাদৃশ্য রয়েছে। পারলৌকিকতা কিংবা আধ্যাত্মিকতা বাদ দিয়ে শুধু এই জীবন এবং ইহজাগতিক সমাজ নিয়ে যদি আমরা কথা বলি, তাহলে দেখা যাবে, রাষ্ট্র ও ধর্ম উভয়েরই মূল উদ্দেশ্য সমাজ নিয়ন্ত্রণ করা – রাষ্ট্র পরিচালনা করা। বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়, ‘ইতিহাসের এক পর্যায়ে, বলা চলে প্রাচীন ও মধ্যযুগ পর্যন্ত, রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি অবিচ্ছেদ্য ছিল। এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক যে মানবজাতির জন্য কল্যাণকর ছিল, এমন নয়।’ পুরাণের বিভিন্ন কাহিনির ছত্রে ছত্রে – সকল উল্লেখযোগ্য পাত্রপাত্রীর মধ্যেই প্রচন্ডভাবে উপস্থিত রয়েছে ক্ষমতার দাপট, দ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসা। পদ, সিংহাসন অথবা অধিকারের জন্যে রেষারেষি-হানাহানি-যুদ্ধ। কখনো তা প্রচ্ছন্ন – কখনো উচ্চকিত। কখনো এই শক্তিপ্রদর্শন বা দ্বন্দ্বের পেছনে রয়েছে রাজ্যশাসনে বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা, কখনো কেবল সিংহাসন বা কোনো বিশেষ নারীকে ছিনিয়ে নেওয়া বা দখল করার অভিলাষ, কখনো বা উঁচু-নিচু বর্ণের মধ্যে, আর্য-অনার্যের মধ্যে, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপড়েন ইত্যাদি।
পুরাণের মূলকথা হলো, ভালোর সঙ্গে মন্দের, ধর্মের সঙ্গে অধর্মের চিরন্তন দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ, এবং পরিশেষে অবধারিতভাবেই মন্দের বা দুষ্টের দমন ও ভালোর, মানে শিষ্টের, অর্থাৎ ন্যায়ের জয়। দেবতার সঙ্গে অসুরের, মানুষের সঙ্গে দানবের চিরকালীন বিরোধ একটা প্রধান বিষয় পুরাণে। এছাড়া রয়েছে নরনারীর চিরন্তন প্রেম-উপাখ্যান, যেমন : কচ ও দেবযানী, রাধা-কৃষ্ণ, সীতা-রাম, দ্রৌপদী ও পঞ্চপান্ডব, দুষ্মন্ত-শকুন্তলা, শিব-পার্বতী, অর্জুন-চিত্রাঙ্গদা, আম্রপালী-বিম্বিসার, সাবিত্রী-সত্যবান, বেহুলা-লখিন্দর, দময়ন্তী ও নল, সত্যবতী ও শান্তনু, অনসূয়া ও অত্রির সম্পর্ক, প্রেম, বিরহ। এরই মাঝে পরিস্থিতি-অনুযায়ী এবং সম্ভবত সুবিধেমতো, ঘটে যায় কোনো কোনো পুরুষের মধ্যে আংশিক স্মৃতিশক্তি বিলোপের ঘটনা, অতিজ্ঞান দর্শনে পুনরায় স্মৃতি ফিরে পাওয়া, নারীর প্রতি মুনি-ঋষি থেকে শুরু করে প্রায় সকল পুরুষের কামার্ত দৃষ্টি, সুন্দরী তরুণী-নারী অপহরণ, বিবাহবহির্ভূত যৌনক্রিয়া, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে যৌন সম্পর্ক, কোনো ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য সাধনে কঠিন ও দীর্ঘ তপস্যা, ভয়ংকর সব অভিশাপ, অলৌকিক বরলাভ, ইচ্ছাশক্তির জয়, ধ্যান বা শাস্তির কারণে কথায় কথায় লোকালয় ছেড়ে বনবাসে গমন ইত্যাদি। সেই সময়ের নৈতিকতার সংজ্ঞা বা ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অন্যান্য মানবিক মূল্যবোধের বেলায়, যেমন – সত্য কথা বলা, অন্যের ক্ষতি না করা, চুরি না করা, যুদ্ধকালীন সময়ে ন্যায়-নীতি-ধর্মের অনুশাসন-অনুযায়ী শত্রুবিনাশ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর যতটা জোর দেওয়া হয়েছে, নরনারীর প্রেম ও যৌনতাবিষয়ক আচরণের ব্যাপারটিতে ততটা নিয়মতান্ত্রিকতা বা স্পর্শকাতরতা দেখা যায়নি। বিশেষ করে পুরুষদের বেলায়। তবে নারীর কৌমার্য ও সতীত্বকে তখনো যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হতো।
আজো কোনো কোনো মানুষ বিশ্বাস করে, পৌরাণিক পঞ্চবতী বা পঞ্চকন্যার নাম উচ্চারণ করলে সকল পাপ দূর হয়ে যায়। জীবদ্দশায় তাদের মহত্ত্ব ও নানাবিধ গুণাবলির জন্যে প্রাচ্যের ‘পঞ্চকন্যা’ বলে প্রসিদ্ধ যে-পাঁচজন পুরাণের নারীর কথা লোকে এখনো স্মরণ করে, তারা হলেন – সীতা, সাবিত্রী, অহল্যা, দ্রৌপদী ও অরুন্ধতী। এছাড়া অন্য এক দলের মতে, পৌরাণিক ‘পঞ্চকন্যা’ হলেন অহল্যা, কুন্তি, দ্রৌপদী, তারা ও মন্দোদরী। এই দুই অভিমতের পঞ্চকন্যার ভেতরেই যে দুজন নারীর উপস্থিতি দেখা যায়, তারা সীতা-সাবিত্রীও নয়, কুন্তি-মন্দোদরীও নয়। তাঁরা হলেন দ্রৌপদী ও অহল্যা। এই পঞ্চকন্যা-নির্বাচনে কারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন আমার জানা নেই, তবে দ্বিতীয় মনোনয়নটি যে অপেক্ষাকৃত বেশি নারীবাদীদের দিয়ে সম্পন্ন, সে-সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও এই দুই ধরনের পঞ্চকন্যার মধ্যেই সীতা-সাবিত্রীর বদলে দ্রৌপদী-অহল্যার উপস্থিতি দেখতে পেয়ে উল্লসিত। কেননা, সীতা-সাবিত্রী ভালো মানুষ হয়তো ছিলেন; কিন্তু তাঁরা যা করেছেন, তা মূলত নিজের জন্যে, নিজের স্বামীর কল্যাণের জন্যে। সংসারের বাইরে বৃহত্তর সমাজের জন্যে মঙ্গলকর কোনো দায়িত্ব তারা পালন করেননি। কোনোপ্রকার অন্যায়ে, অবিচারে, নারীর প্রতি ঘৃণ্য ব্যবহারে তাঁরা মুখ খোলেননি, প্রতিবাদ করেননি, যেমনটি করেছেন দ্রৌপদী, গান্ধারী, কুন্তি। আর অহল্যা? তিনিই একমাত্র গৃহবধূ, শুধু রামায়ণে নয়, সার্বিক প্রাচ্য পুরাণেই, যিনি নিজের শরীরের ওপর, নিজের যৌনতার ওপর নিজের ইচ্ছাপূরণ এবং কর্তৃত্বগ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সার্বিক বিচারে আমার নিজের পছন্দের পুরাণের পঞ্চকন্যা হলেন : দ্রৌপদী, দেবযানী, তারা, গান্ধারী ও কুন্তি। দ্রৌপদী নিজের ইচ্ছায় পাঁচ স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত না হলেও পরিস্থিতির কারণে সেটা যখন ঘটে গেল, তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন তাঁদের সকলকে সুখী ও তৃপ্ত করার জন্যে, সংসারে শান্তি বজায় রাখার জন্যে। কারো প্রতি অবিচার না করে পঞ্চস্বামীকে তুষ্ট করার এক অনন্য গুরুভার গ্রহণ করেছিলেন দ্রৌপদী। অর্জুনকে স্বয়ংবর সভায় নিজে পছন্দ করে মাল্যদান করার পরেও কেন তাঁর মতো এক তেজস্বিনী নারী অন্যের চাপিয়ে দেওয়া পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী হতে অস্বীকৃতি জানালেন না, এটার ব্যাখ্যা একটাই যে, সে-সময়ে নারীর মতামতের কোনো মূল্য ছিল না – কেউ তা গ্রাহ্য করতো না। তবে বিয়ের পরে পদে পদে পরপুরুষের বাড়িয়ে দেওয়া কামার্ত হাত সদর্পে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দ্রৌপদী। তাঁকে পণ রেখে স্বামী যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার পরিণামে প্রকাশ্য জনসভায় দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীর পরিহিত বস্ত্র খুলে নেওয়ার প্রচেষ্টায় রত, দ্রৌপদীর প্রতি এমন অবিচার-অপমানের সময়েও ভীম ব্যতীত তার অন্য স্বামীরা ছিলেন নিষ্ক্রিয়, নীরব। এমনকি বয়স্ক, গুরুজন ভীষ্ম থেকে শুরু করে ধৃতরাষ্ট্র, কর্ণ সকলেই সেখানে দর্শকের ভূমিকায় উপস্থিত ছিলেন। বিব্রত, উত্তেজিত, অপমানিত দ্রৌপদী যখন এই অন্যায়ের মুখর প্রতিবাদ জানান, গান্ধারী ব্যতীত আর কেউ তাঁর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন না। তখন দ্রৌপদী নিতান্ত অনুপায় হয়ে সুহৃদ কৃষ্ণের সাহায্য কামনা করেন। দ্রৌপদী তাঁর প্রতি এই অসম্মান ও অপমানের প্রতিশোধ নিতে বরাবর আগ্রহী ছিলেন। আর ওদিকে দেবযানীই বোধহয় মহাভারতের একমাত্র সুন্দরী, বিদুষী নারী যে শুধু পুনঃপুন প্রেমিকের জীবনই বাঁচাননি, দু-দুবার তাঁর পছন্দের পুরুষকে স্বতঃপ্রণোদিত ও অগ্রণী হয়ে প্রেম নিবেদন করেছেন, যা আজকের যুগেও বিরল ঘটনা, এবং দু-দুবার অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যাত হন। এরপরও ব্রাহ্মণ-কন্যা দেবযানী তাঁর দ্বিতীয় প্রেম ক্ষত্রিয়-পুত্র রাজা যযাতির মন জয় করে তাঁকে বিবাহের মাধ্যমে এই মহাকাব্যের একমাত্র অসবর্ণ বিয়ের নজির রাখার সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। অন্যদিকে নারীবাদী তারা তাঁর স্বামীর কাছে গর্ভের সন্তানের পিতৃত্বের পরিচয় জানাতে অস্বীকার করেছিলেন সম্ভবত এই কারণে যে, তাঁর নিজের শরীরের অভ্যন্তরে ধারণকৃত সন্তানটি তাঁর একান্তই নিজস্ব। তাছাড়া যে-স্বামী তার অপহরণ ও বন্দিত্বের দশা থেকে এত দিনেও তাঁকে মুক্ত করতে অসমর্থ হয়েছেন, অনাগত সন্তানের পিতৃপরিচয় জানার অধিকার তাঁর কতটুকুই বা থাকতে পারে! গান্ধারী তাঁর সততা, নিরপেক্ষতা, প্রজ্ঞা, ন্যায়-নীতিবোধে এবং ধর্মে এত অবিচল ছিলেন যে, আপন পুত্র যখন প্রকাশ্য রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে চাইল, গান্ধারী শুধু প্রতিবাদ করেননি, তাঁর স্বামীকে বলেছিলেন অধর্মের কারণে পুত্রকে পরিত্যাগ করার জন্যে। অথচ জননী তিনি সেই পুত্রদের যুদ্ধে হারিয়ে আবার অত্যন্ত বিমর্ষ ও শোকাতুরা হয়ে পড়েন, অনবরত বিলাপ করতে থাকেন। গান্ধারী অন্ধ স্বামীর প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনে সব সময়ে নিজের সুস্থ চোখ দুটো বেঁধে রাখতেন কাপড় দিয়ে। এই আলোকময় বর্ণিল পৃথিবীর রূপ-রস ভোগ করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও স্বামীর অন্ধত্বের প্রতি সহানুভূতিতে নিজের দৃষ্টিশক্তিকে স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়েছিলেন নিকষ অন্ধকারে। আর কুন্তির মতো কৌশলী, বুদ্ধিমতী ও রাজনৈতিক নারী প্রায় বিরল, কেবল মহাভারতে নয়, সমগ্র পুরাণশাস্ত্রেই। পান্ডবদের দ্বারা হস্তিনাপুরের রাজত্ব রক্ষা করা ও তার শাসনভার গ্রহণ করার প্রচেষ্টায় তাঁর ভূমিকা অদ্বিতীয়। সত্যবতীর মতোই তিনি শক্তি ও ক্ষমতার যুদ্ধে অপ্রতিহত ছিলেন। বিবাহপূর্বকালে জন্ম নেওয়া এবং জন্মলগ্নে তাৎক্ষণিকভাবে পরিত্যাগ করা নিজের প্রথম পুত্র কর্ণের কাছে পর্যন্ত তিনি অবশেষে যেতে দ্বিধা করেননি এবং এত বছর পর কর্ণের কাছে নিজের আসল পরিচয় উন্মুক্ত করে অনুরোধ করেছিলেন পান্ডবদের যুদ্ধে সাহায্য করার জন্যে। কুন্তির ক্ষমতার প্রতি স্পৃহা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা যুধিষ্ঠির ও কৃষ্ণের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ বন্ধ করে সন্ধি স্থাপনের সিদ্ধান্তকে পালটাতে বাধ্য করে। কুন্তির মতো সাহসী, শক্তিশালী, রাজনীতি-সচেতন ও দৃঢ়চেতা নারীর অস্তিত্ব দুর্লভ সর্বকালেই।
আজকের এই নিবন্ধে আমার নির্বাচিত পঞ্চকন্যার জীবন ও কর্মের ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করে, প্রয়োজনমতো আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিখ্যাত সব পৌরাণিক নারী ও পুরুষ চরিত্রের ত্বরিত ও সাধারণ অবতারণার মাধ্যমে নির্ণয় করার চেষ্টা করবো, আদি ও মধ্যযুগের সমাজব্যবস্থায় ও মূল্যবোধে নারীর অবস্থা ও অবস্থানের চিত্র। এছাড়া দেখার চেষ্টা করবো, বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কবি ও গদ্যকারের কল্পনায় এসব নারীচরিত্র কেমন করে পুরাণের মূল চরিত্র থেকে রূপান্তরিত হয়ে নবরূপ লাভ করেছে। মানবতার খাতিরে এই পঞ্চকন্যা বাছাইপর্বে যতটা সম্ভব স্বর্গের দেবী বা অপেক্ষাকৃত নিকট অতীতের (১২-২০ শতকের) কোনো লোকগাথার নায়িকা কিংবা বিশেষভাবে আদৃত ঐতিহাসিক লেজেন্ডারি কোনো চরিত্রকে, প্রায়শই যা অলৌকিক কিছু গুণাবলি দিয়ে সমৃদ্ধ বা কুয়াশাচ্ছন্ন, বাদ দেওয়া হয়েছে। আগেই বলেছি, বৈচিত্র্যময় অজস্র প্রাচ্য-পৌরাণিক নারী চরিত্রের মধ্য থেকে আমি যে পঞ্চকন্যাকে বেছে নিয়েছি, অতিসংক্ষেপে নিচে যাদের জীবন ও কর্ম বর্ণিত হলো, তাঁরা হলেন : তারা, দ্রৌপদী, কুন্তি, গান্ধারী ও দেবযানী।

তারা
তারা হলেন নক্ষত্ররাজ্যের দেবী। তারা বৃহস্পতির স্ত্রী। বৃহস্পতি দেবতাদের পুরোহিত। তারা অতি সুন্দরী যুবতী। একদিন সোম বা চন্দ্র তারাকে দেখে তাঁর রূপে এত অধীর ও মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে, তারাকে বৃহস্পতির কাছ থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে নিজের প্রাসাদে আটকে রাখেন। বৃহস্পতি বা ব্রহ্মার শত অনুরোধেও সোম তারাকে ফিরিয়ে দেন না। সমস্ত দেবকুল তখন সোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সোমের হয়ে লড়াই করে অসুরগণ, যার অধিপতি শুত্রু। বিশাল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মারামারি, কাটাকাটি করে সর্বাংশে ধ্বংস হয়ে যাবার ভয়ে ব্রহ্মা আবার ফিরে আসেন সোমের কাছে; সোমকে তিনি বোঝান। সোম এবার রাজি হন এবং তারাকে মুক্ত করে দেন। তারা ফিরে আসেন বৃহস্পতির কাছে। কিন্তু অচিরেই টের পাওয়া যায়, তারা অন্তঃসত্ত্বা। বৃহস্পতি জানতে চান, এই সন্তানের পিতা কে – তিনি না সোম? কিন্তু তারা কিছুতেই তার জবাব দেন না। বৃহস্পতি তখন সন্তান জন্মের আগে তারাকে গ্রহণ করতে অসম্মতি জানান। বলেন, যতক্ষণ পুত্র জন্মলাভ না করছে তারাকে তিনি গ্রহণ করবেন না। এ-কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তারার গর্ভের পুত্র জন্মগ্রহণ করে ফেলে। উজ্জ্বল সুন্দর দিব্যকান্তির পুত্রকে দেখে সোম ও বৃহস্পতি উভয়েই তাকে নিজের সন্তান বলে দাবি করেন। তাদের মধ্যে এত রেষারেষি, কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব দেখে শিশুটি রেগে গিয়ে উভয়েকেই অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা আবার আসেন তাদের উদ্ধারে। তিনি তারাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বিশেষভাবে জানতে চান আসলেই এই শিশুর পিতা কে – বৃহস্পতি না সোম। তখন তারা স্পষ্ট জানান, সোম। সোম সানন্দে পুত্রকে গ্রহণ করেন এবং তার নাম রাখেন বুধ।
পুরাণে তারার কাহিনি এভাবে বর্ণিত হলেও বীরাঙ্গনা কাব্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের চোখে সোম-তারার সম্পর্ক ভিন্নভাবে, নবরূপে ধরা দিয়েছে। মধুসূদন তাদের সম্পর্ককে অনেকটা কচ-দেবযানীর সম্পর্কের মতো করে এঁকেছেন। এখানে তারাকে তিনি দেবযানীর মতো গুরু-কন্যা না করে কল্পনা করেছেন গুরুপত্নী হিসেবে। গুরুপত্নী প্রায় মায়ের স্থলাভিষিক্ত। ফলে এই প্রেম বৈধ নয়। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যে দেবতাদের পুরোহিত বৃহস্পতি সোমের গুরু। শিক্ষাশেষে সোম যখন গুরুগৃহ ত্যাগ করতে উদ্যত, তখন তাঁর সান্নিধ্যের জন্যে উদ্গ্রীব, তাঁর প্রেমে অধীর গুরুপত্নী তারা সোমকে তাঁর গভীর প্রণয়ের কথা প্রকাশ করে একখানা পত্র লেখেন। সোমের আসন্ন বিরহে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন তারা, যদিও তিনি সম্পূর্ণ অবগত যে, বৃহস্পতি সোমের গুরু। সেই হিসেবে গুরুপত্নীর সঙ্গে রোমান্টিক প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অনৈতিক। এর জন্যে তারার মনেও বহু দ্বিধা, সংকোচ ও অপরাধবোধ। কিন্তু সোমের প্রতি তাঁর বাঁধভাঙা ভালোবাসার কাছে ভেসে যায় সেই শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন, সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সতীত্বরক্ষার অলিখিত নির্দেশ। আসন্ন বিদায়ী সোমকে লেখা তারার সেই চিঠিতে অনেক উদ্ধৃতি, অনেক অতীত দৃশ্যের অবতারণা, অনেক যৌথ অভিজ্ঞতার উল্লেখ রয়েছে। এসব থেকে পাঠককুল নিশ্চিন্ত হবেন যে, তারা এবং সোম দুজনেই দুজনকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন – অনেক দিন থেকেই। ফলে বীরাঙ্গনা কাব্যের ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্র পাঠ করলে মনে হবে সোমের এই তারা-অপহরণ প্রকৃতপক্ষে কোনো অপহরণ ছিল না। অথবা এই সাজানো অপহরণ তারার সহযোগিতা বা ইন্ধনেই ঘটেছিল। কিন্তু পুরাণে তাদের অপহরণপূর্ব কোনো সম্পর্ক বা সোমের অন্তঃপুরে স্বেচ্ছায় তারার গমনের কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি সোম যে বৃহস্পতির শিষ্য, সে-কথাও কোথাও লিপিবদ্ধ নেই।

দ্রৌপদী
দ্রৌপদী সম্ভবত পুরাণের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও বিতর্কিত নায়িকা। দ্রৌপদী (পঞ্চালী, কৃষ্ণা) পঞ্চাল রাজ্যের রাজা দ্রুপদের কন্যা। তাঁর গাঢ় গাত্রবর্ণের জন্যে তাঁর আরেক নাম কৃষ্ণা। পূর্বজন্মে দ্রৌপদী এক ঋষির কুটিরে বাস করতেন এবং সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন। শঙ্কর দেবতাকে অনুক্ষণ তপস্যা করতে করতে শঙ্করের আবির্ভাব ঘটে। শঙ্কর তাকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। দ্রৌপদী তখন তাঁর কাছে পরজন্মে সর্বগুণে গুণান্বিত স্বামী পাবার জন্য বর ভিক্ষা করেন। শঙ্কর যতবার তাঁকে বর দিতে চান ততবারই দ্রৌপদী একই কথা বলেন। পাঁচবার বলায় পরজন্মে দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী হয়। পরজন্মে তাঁর স্বয়ংবর সভায় অর্জুন জলে প্রতিফলিত ছায়া দেখে তার অব্যর্থ তীর ধনুক দিয়ে ঝুলন্ত মাছের চক্ষু ভেদ করে প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে দ্রৌপদীকে বিবাহ করতে সমর্থ হন। যখন দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব বাড়ি আসে, বাইরে থেকে তারা জানায়, ‘মা, আমরা তোমার জন্যে ভিক্ষা করে এনেছি এক রমণীয় পদার্থ।’ ভেতর থেকেই কুন্তি বললেন, ‘যা এনেছ, পাঁচ ভাই ভাগ করে নাও।’ কুন্তি জানতেন না তাঁরা দ্রৌপদীকে নিয়ে এসেছেন। এদিকে দ্রৌপদীকে স্বয়ংবর সভায় দেখা অবধিই পাঁচ ভাই কামার্ত হয়ে পড়েছিলেন। মায়ের এই আদেশের পরে তখন যুথিষ্ঠিরের কথায় পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গেই দ্রৌপদীর বিয়ে হয়। তবে পরবর্তীকালে ভীম আর অর্জুন দ্রৌপদী ছাড়াও আরো কয়েকটি বিয়ে করেন এবং প্রতি স্ত্রীর সঙ্গেই তাদের একটি করে পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। তাই দেখা যায়, দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামী ছিল দ্রৌপদীর ইচ্ছেয় নয়, পান্ডবদের মাতৃ-আজ্ঞা পালনের কারণে। অথবা পূর্বজন্মের বরের বিরোধিতা করলেন না কেন দ্রৌপদী, তিনি কি জানেন না, স্বয়ংবর-সভায় যার গলায় মালা দেওয়া হয় কেবল তিনিই হন তাঁর স্বামী? দ্রৌপদীর অবস্থা দেখে প্রতিভা বসু মন্তব্য করেন, দ্রৌপদী ‘যেন খেলার বল। একের কাছ থেকে (যাচ্ছে) অপরের কাছে।’
পাঁচ স্বামী ছাড়াও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ছিল দ্রৌপদীর। তাঁর বিপদের দিনে কৃষ্ণ বারবার এসে তাঁকে রক্ষা করেছেন। একবার উন্মুক্ত রাজসভাস্থলে দ্রৌপদীকে পণ রেখে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের সঙ্গে হেরে গেলে দুঃশাসনের মাধ্যমে দুর্যোধন দ্রৌপদীর বস্ত্র খুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সকল পান্ডব ও কুরুদের সামনে, এমনকি তাঁর পঞ্চস্বামীর সামনে সেটা ঘটতে যাচ্ছে দেখে দ্রৌপদী তাঁর স্বামীদেরসহ তাঁর শ্বশুরালয়ের সকল গুরুজনকে তিরস্কার করেন তাঁরা অধর্মের পথে যাচ্ছে বলে। তিনি এই অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেননি। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ এসে তাঁর কাপড়ের দৈর্ঘ্য ক্রমাগত বাড়িয়ে দিয়ে দ্রৌপদীকে এই প্রচন্ড অসম্মান থেকে, লজ্জা থেকে, রক্ষা করেন। দ্রৌপদীর এই বহুল আলোচিত বস্ত্র-হরণের ঘটনাটিকে গল্পকার মাহবুব সাদিক সমসাময়িক এক ধর্ষণের দৃশ্যে নান্দনিকভাবে ব্যবহার করে গল্পটি শেষ করেছেন এই বলে যে, ‘এ-কালের কোনো শাড়িই আর অন্তহীন নেই।’ এছাড়া কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে আরেকবার খুব সাহায্য করেছিলেন। পান্ডবরা তখন বনে, দুর্বাসা মুনি পান্ডবদের কুটিরে উপস্থিত হন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মধ্যভোজনের জন্যে। দুর্বাসার মেজাজের জন্যে সকলে তাঁকে ভয় করে। দ্রৌপদীর ঘরে কণামাত্র খাবার রয়েছে। তাঁর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ এসে সেই কণা থেকে সকলের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে উপাদেয় খাদ্য তৈরি করে দেন। দুর্বাসা খুশি হয়ে চলে যান। এবারো দ্রৌপদী তাঁর অসমর্থ ও নিশ্চল স্বামীদের তিরস্কার করেন তাঁদের কোনো ভূমিকা না রাখার প্রতিবাদে।
পাঁচ স্বামীর সঙ্গে যাতে শান্তিপূর্ণভাবে দ্রৌপদী বাস করতে পারেন, নারদ মুনি নিয়ম করে দেন, দ্রৌপদী এক বছর এক স্বামীর সঙ্গে থাকবেন। অন্য স্বামীরা তখন অপেক্ষা করবেন। এক বছর পর অগ্নির ভেতর দিয়ে গিয়ে পুনরায় পবিত্র ও সতী হয়ে তিনি দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে থাকতে শুরু করবেন। এভাবে প্রতি স্বামীকে চার বছর অপেক্ষা করতে হবে এক বছর দ্রৌপদীর সঙ্গলাভের জন্যে। অর্জুন একদা এই নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে তাঁকে এক বছরের জন্যে ব্রহ্মাচার্যে যেতে হয়েছিল আরো দূর বনে। সেখানে গিয়ে অবশ্য অর্জুন ব্রহ্মাচার্যের বদলে আরো তিনখানি বিয়ে করেন – চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রা (কৃষ্ণের বোন) ও উলুপীকে। দ্রৌপদী সকল স্বামীকে শুধু শান্তিতে রাখেননি, সকলের আগে ঘুম থেকে উঠে সামান্য কিছু খেয়ে সারাদিন সমস্ত কাজকর্ম শেষে সকলের পরে শুতে যেতেন। তবে দ্রৌপদী একটা নিয়ম করে দেন তাঁর স্বামীদের, যা তাঁদের মেনে চলতে হয়। দ্রৌপদী জানতেন তাঁর স্বামীদের কারো কারো আরো স্ত্রী রয়েছে। কিন্তু দ্রৌপদীর নির্দেশে তাঁরা কেউ প্রাসাদে ঢুকতে পারতেন না। তাঁদের সঙ্গে মিলিত হতে হলে তাঁর স্বামীদের বাড়ির বাইরে গিয়ে সেই স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে হতো। কৃষ্ণের সহোদরা অর্জুনের স্ত্রী সুভদ্রার বেলায় শুধু এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছিলেন দ্রৌপদী। পাঁচ স্বামীর মধ্যে অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর কিছুটা পক্ষপাতিত্ব থাকলেও ভীমই একমাত্র স্বামী যিনি স্ত্রীর বিপদের দিনে এগিয়ে এসে সাহায্য করেন। বনবাসকালে রাজা বিরাটের স্ত্রী সুদেষ্ণার ভাই কীচক দ্রৌপদীকে জোর করে ভোগ করতে চাইলে দ্রৌপদীর অনুরোধে আর কেউ নয়, ভীম এসে কীচককে খুন করেন। রাজসভায় সকলের সামনে দ্রৌপদীকে জিম্মি রেখে পাশা খেলে যুধিষ্ঠির হেরে গেলে দুর্যোধনের আজ্ঞায় দুঃশাসন দ্রৌপদীর কাপড় খুলতে উদ্যত হলে স্বামীদের ভেতর একমাত্র ভীমই বাধা দেন।
কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামার কাছে দ্রৌপদী স্বীকার করেছেন, পাঁচজন স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখতে তাঁকে কতগুলো কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়। দ্রৌপদী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, বাস্তববাদী নারী। তিনি তাঁর প্রতি অন্যায় আচরণের জন্যে প্রতিশোধ চাইতেন, মুখ বুজে সহ্য করতেন না অবিচার। প্রতি স্বামীর সঙ্গে দ্রৌপদীর একটি করে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর পাঁচটি পুত্রকেই ঘুমন্ত অবস্থায় বধ করে অশ্বত্থামা। অশ্বত্থামার মা একজন ধর্মপ্রাণ নারী ও গুরু। সেই বিবেচনায় এবং পাঁচ পুত্রকে হারিয়ে নিজের শোকাতুর অবস্থা অনুধাবন করে সকলের পরামর্শ ও উপদেশ অগ্রাহ্য করে অশ্বত্থামাকে তিনি ক্ষমা করে দেন। দ্রৌপদী চান না তাঁর মতো করে আরেকটি মা এমন প্রচন্ড শোকে পান্ডুর হোক।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্যে অর্জুনের কাছে দ্রৌপদীর লেখা একখানা চিঠি সংযোজন করেন। মাইকেলের কল্পনায় অর্জুনের প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল দ্রৌপদী সেই চিঠিতে তীব্র প্রতিবাদ করেন স্বামীর ছলনা, এই দীর্ঘ বিরহ এবং তাঁর প্রতি অর্জুনের ঔদাসীন্যের জন্যে। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলায় পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছিলেন, মহাবীর অর্জুন শত্রুদমনের উদ্দেশ্যে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে সুরপুরে চলে যান। কিন্তু অস্ত্রশিক্ষার নাম করে সেখানে গিয়ে নানারকম ভোগবিলাসে মেতে ওঠেন অর্জুন। এর প্রতিবাদেই স্ত্রীর অধিকার নিয়ে লেখা তাঁর এই পত্রে বিরহী ও প্রতারিত দ্রৌপদীর মর্মবেদনা ও ঈর্ষা ফুটে ওঠে। এছাড়া এই বছরই (২০১১ সালে) ভারতের রাজ্যসভার প্রাক্তন সদস্য জারলাগাদ্দা লক্ষ্মীপ্রসাদে (Yarlagadda Lakshmi Prasad) যিনি ২০০৩ সালে তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্যে ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মশ্রী উপাধি পেয়েছিলেন, তেলেগু ভাষায় দ্রৌপদী নামে এক উপন্যাস লেখেন যেখানে তিনি তাঁর কল্পনায় দ্রৌপদীর যৌন আকাঙ্ক্ষা, পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা বিধৃত করেন। কর্ণের প্রতিও দ্রৌপদীর দুর্বলতা ছিল বলে ওই উপন্যাসে ইঙ্গিত রয়েছে। এই বছর ভারতের সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করেছে এই বই।

কুন্তি
কুন্তির আসল নাম পৃথা। তিনি শ্রীকৃষ্ণের পিসি। একবার মহর্ষি দুর্বাসা অতিথিরূপে গৃহে এলে কুন্তি তাঁকে আতিথেয়তা ও পরিচর্যায় সন্তুষ্ট করেন। দুর্বাসা তাঁকে এক অমোঘ মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বলেন যে, এই মন্ত্রের প্রভাবে কুন্তি যে-দেবতাকে স্মরণ করবেন সেই দেবতাই তাঁর নিকটে আসবেন এবং তাঁর সাহায্যে কুন্তির পুত্রলাভ হবে। বর পেয়ে যে কোনো দেবতার সঙ্গে পুত্রসন্তান জন্মাতে পারবেন জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে কিছু না বুঝেই কিশোরী কুন্তি কৌতূহলবশত মন্ত্রের গুণাগুণ পরীক্ষা করার জন্যে সূর্যদেবকে ডেকে বসেন। আসলে কুমারী কুন্তিদেবী গুরুদেবের দেওয়া মন্ত্রের গুরুত্ব না বুঝে ভুলক্রমে বিবাহের পূর্বে সন্তান প্রার্থনার মন্ত্রটা পাঠ করে ফেলেছিলেন। ফলে অবিবাহিত অবস্থায় তাঁর গর্ভে জন্ম নেন কর্ণ। সূর্য যথারীতি চলে যান নিজ গৃহে কুন্তির গর্ভে সন্তানের ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করে। তবে কুন্তি যে জেনেশুনেবুঝে সূর্যকে ডাকেননি এটা বুঝতে পেরে সূর্য কুন্তিকে পুনরায় কুমারীত্বে ফিরে যাওয়ার আশ্বাস দেন পুত্রজন্মের পর, এবং সেটা ঘটে। কৌমার্য হারালে কুন্তির আর বিয়ে হতো না। যথাসময়ে পুত্র কর্ণের জন্ম হয়। মা-বাবা বা সমাজ কেউ কুন্তিকে এই অবস্থায় গ্রহণ করতে পারবে না বলে পুত্র কর্ণকে তিনি জলে ভাসিয়ে দেন। এক সন্তানহীন রথচালক ও তার স্ত্রী আদি রাধা কর্ণকে প্রতিপালন করেন। অতঃপর স্বয়ংবর-সভার মাধ্যমে কুন্তির সঙ্গে বিয়ে হলো পান্ডুর। পান্ডু সন্তান উৎপাদনক্ষম ছিলেন না। হরিণের বেশে রতিক্রিয়ায় রত দুই ঋষিকে শিকার করায় তাঁর প্রতি দেবতার অভিশাপও ছিল, কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করলেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। পান্ডু কুন্তিকে অনুরোধ করেন, দুর্বাসার দেওয়া মন্ত্রের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন করতে। কুন্তি তখন একে একে তিন ধর্মদেবতাকে স্মরণ করে তিন পুত্র লাভ করেন। যমরাজের সঙ্গে জন্ম নেন যুধিষ্ঠির, বায়ুর সঙ্গে ভীম আর ইন্দ্রের সঙ্গে অর্জুন। পৌরুষত্বহীন, নির্জীব পান্ডুকে বিয়ে করে শরীরের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে পারেননি কুন্তি। কিন্তু মন্ত্র ও বরের শক্তিতে তিন দেবতাকে দিয়ে তিন পুত্রের জননী হয়েছেন। এছাড়া, পান্ডু অন্য স্ত্রী মন্দ্রাকে সেই গোপন মন্ত্র শিখিয়ে তাঁর দ্বারাও পান্ডুকে দুই পুত্র, সহদেব আর নকুল, দান করতে সমর্থ হন কুন্তি। এসবই করেছেন তিনি হস্তিনাপুরে নিজ বংশের উত্তরাধিকারী তৈরি করার জন্যে। পঞ্চপান্ডবেরই জন্ম নিয়োগ-পদ্ধতিতে। মন্দ্রার প্রতি একদিন অপ্রতিরোধ্য কামভাব জাগ্রত হলে রতিক্রিয়ার সময়ে পান্ডু অভিশাপের শর্ত-অনুযায়ী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সঙ্গে সহমরণে যান প্রথম স্ত্রী কুন্তি নন, কনিষ্ঠা স্ত্রী মন্দ্রা। তবে মন্দ্রার দুই ছেলেকে কুন্তি নিজের ছেলের মতো করে বড় করেন। ক্ষমতা ও শক্তির খেলায় কুন্তি খুবই পারদর্শী ছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁর নিজের পুত্র যুধিষ্ঠির ও ভাইয়ের (বাসুদেব) পুত্র কৃষ্ণ যখন যুদ্ধ বন্ধ করতে সমঝোতায় যেতে চেয়েছিলেন, কুন্তি তাঁদের তিরস্কার করে আবার যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং দুর্যোধনকে হত্যা করতে বিশেষভাবে আদেশ করেছিলেন। উন্মুক্ত সভাস্থলে দ্রৌপদীর পরিধেয় বস্ত্র খুলে নেওয়ার চেষ্টার অপমান কুন্তি কখনো ভুলতে পারেননি। কুন্তির প্রথম পুত্র কর্ণ (বিবাহের আগে যাঁর জন্ম) যখন কৌরবদের সেনাপতি হিসেবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, মা কুন্তি তখন বাধ্য হয়ে তাঁর নিজ পরিচয় দিয়ে কর্ণকে বোঝাতে চান, পান্ডবদের একই মায়ের পেটের ভাই সে। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া অনুচিত। ফলে দেখা যায় কুন্তি একদিকে যেমন ঘোর বাস্তববাদী, অন্যদিকে তেমনি ক্ষমতালোভী এবং কৌশলী। তা নইলে কর্ণকে অস্বীকার ও পরিত্যাগ করতেন না জন্মের পরেই, তেমনি আবার পান্ডবদের ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে কর্ণকে ফিরিয়ে আনতে স্বপরিচয় প্রদানেও দ্বিধান্বিত হতেন। কুন্তিই একমাত্র রাজনৈতিক নারীচরিত্র মহাভারতে। রবীন্দ্রনাথ কর্ণ-কুন্তী সংবাদে কুন্তির মুখ দিয়ে কর্ণকে পান্ডবদের হয়ে যুদ্ধ করতে যে বলেছিলেন, আসলে মহাভারতে তার বেশিরভাগ কথা শ্রীকৃষ্ণ আগেই কর্ণকে বলেছিলেন। কর্ণের সঙ্গে কুন্তির কথোপকথন সেখানে ছিল অনেক সংক্ষিপ্ত। তবে কর্ণ-কুন্তি আলাপ মহাভারতে যতটা রাজনৈতিক, রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুন্তী সংবাদে সেটি ততটা চোখে পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ কুন্তিকে আরো বেশি মানবিক, প্রকৃত একজন মা হিসেবেই চিত্রণ করেন। মহাভারতে কর্ণ সূর্যের তপস্যা করেন এবং সূর্য তাঁকে নির্দেশ দেন করণীয়ের ব্যাপারে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কর্ণ-কুন্তী সংবাদে সূর্যের নির্দেশের ব্যাপারটা উপেক্ষা করে কাহিনিটিকে পৌরাণিকতা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।

গান্ধারী
মহাভারতের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। গান্ধারী, মহাভারতে বর্ণিত হস্তিনাপুরের জন্মান্ধ মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রের সহধর্মিণী, নরেশ-শকুনীর বোন ও দুর্যোধনসহ শত পুত্রের মাতা। সততা, ধর্মনিষ্ঠা, স্বামীভক্তি এবং পরিস্থিতিকে সহ্য করার অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চারিত্রিক দৃঢ়তা মহাভারতের অন্য কোনো নারীচরিত্রের মধ্যে দেখা যায় না। তবে তাঁর চরিত্রের সকল রূপকে যে রূপটি ঢেকে দিয়েছে, তা হচ্ছে, পুত্রস্নেহ। যদিও পঞ্চপান্ডব ও কুন্তির সঙ্গে শক্তি ও ক্ষমতার রেষারেষি ছিল কৌরবদের এবং গান্ধারীরও, তাহলেও এই শক্তি প্রদর্শনে গান্ধারী কখনো তাঁর যুক্তি, ন্যায়পরায়ণতা, ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। এছাড়া যখন যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের সঙ্গে পাশা খেলায় হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীকে বাজি ধরেও হেরে যায়, তখন দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন সর্বসম্মুখে দ্রৌপদীর শাড়ি খুলতে থাকে, সভাকক্ষে উপস্থিত ভীষ্ম, কর্ণসহ কেউ কিছু বলেন না। ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে প্রতিবাদ করলেও পরে চুপ হয়ে যান। শেষ পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেন শুধু একজন বিবেকবান নারী, তিনি গান্ধারী, যিনি এটাকে অধর্ম বলে পরিত্যাজ্য মনে করেন। তিনি এই কুকর্মের জন্যে পুত্রকেও ত্যাগ করতে বলেন স্বামীকে। ধৃতরাষ্ট্র যখন বলেন, তাহলে কী নিয়ে তিনি থাকবেন, গান্ধারী বলেন, ‘ধর্ম’। শত বিপদেও তিনি অধর্মের পথে চলেননি, সততার সঙ্গেও রফা করেননি। এত শত্রুতা সত্ত্বেও কুন্তির সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখেন। পাশা খেলায় হেরে দ্রৌপদীসহ পঞ্চপান্ডব যখন বনবাসে যান, তাঁরা গান্ধারীর কাছে বিদায় নিতে আসেন। গান্ধারী তাঁদের আশীর্বাদ করেন। স্বামী অন্ধ ছিলেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, স্বামীর মতো এ-পৃথিবীর আলো তিনিও দেখবেন না। তাই স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছিলেন অন্ধত্ব। শত পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের কাউকে কখনো চোখে দেখেননি। সততার কারণেই পুত্রদের প্রতি স্বামীর অন্ধ ভালোবাসাকে যেমন মেনে নেননি, তেমনি ভ্রাতা শকুনীর কূটচালকেও প্রশ্রয় দেননি। ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন অবিচল। তিনি জানতেন, তাঁর ছেলেরা অধর্মের পথে আছে। তাই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ তিনি চাননি। তবু অনিবার্য সে-যুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিজ পুত্রদের দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ দিলেও বিজয়ের আশীর্বাদ দেননি। অধর্মী পুত্রের বিজয় তিনি চাননি সত্য। তবে তাঁদের ধ্বংস এড়াতে শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেছেন। তিনি তাঁর ছেলেকে দীর্ঘজীবী দেখতে চেয়েছিলেন। এই কারণে স্বামীর প্রতি আনুগত্যের নির্দশন সেই স্বেচ্ছা অন্ধত্বকেও কিছুক্ষণের জন্য তিনি ত্যাগ করেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের এক পর্যায়ে দুর্যোধনের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যেই তাঁর সকল শক্তিশালী পরামর্শক ও নেতা – ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য ও কর্ণ – নিহত হয়েছেন। দুঃশাসনসহ নিরানববই ভাই নিহত হয়েছেন। এই চরম দুঃসময়ে গান্ধারী দুর্যোধনকে বললেন সন্ধি করার জন্য। বরাবরের মতোই উদ্ধত দুর্যোধন তাতে রাজি হলেন না। গান্ধারী বুঝলেন ছেলের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, তবু শেষ চেষ্টা করলেন। দুর্যোধনকে তিনি বললেন, নগ্ন অবস্থায় গঙ্গায় স্নান করে সে-অবস্থাতেই তাঁর কাছে আসার জন্য। দুর্যোধন বিব্রতবোধ করলে গান্ধারী বললেন, মায়ের সামনে ছেলের নগ্নাবস্থা বিব্রত হওয়ার মতো কিছু নয়। তাছাড়া দুর্যোধন তো তাঁর কাছে সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের মতোই, যেহেতু তাঁকে তিনি কোনোদিন দেখেননি। দুর্যোধন নগ্ন অবস্থায় গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন। ফেরার পথে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হলো। চতুর শ্রীকৃষ্ণ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দুর্যোধনকে বললেন, রাজপুত্রের এ বেশ শোভা পায় না। দুর্যোধন জানালেন, মায়ের আদেশেই তিনি এটি করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, এ-অবস্থায় একজন সাবালক সন্তানের পক্ষে মায়ের সামনে যাওয়াটা সভ্যতার পর্যায়ে পড়ে না। শ্রীকৃষ্ণের কথায় প্রণোদিত হয়ে দুর্যোধন শরীরের নিম্নাংশটিকে কলাপাতায় আবৃত করে মায়ের সামনে গেলেন। গান্ধারী তাঁর চোখের আবরণ খুললেন। অবাক বিস্ময়ে জীবনে প্রথম নিজ পুত্রকে দেখলেন। পরে ব্যথিত হয়ে বললেন, ‘পুত্র! আমি তোমাকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আমার কাছে আসতে বলেছিলাম। জীবনের এই চরম ক্ষণেও তুমি আমার কথা শুনলে না। যদি তুমি আমার কথা শুনতে তবে তুমি নিরাপদ হয়ে যেতে। কারণ তোমার শরীরের যে-অংশে আমার দৃষ্টির আলোকচ্ছটা লেগেছে, সে-অংশ সকল অকল্যাণ থেকে মুক্তি পেয়েছে। যদি তুমি নগ্নাবস্থায় আসতে তবে তোমার পুরো শরীরই রক্ষা পেত।’ উদ্ধত দুর্যোধন বললেন, ‘এতেই চলবে। আগামীকাল আমি ভীমের সঙ্গে গদাযুদ্ধ করব। এ-যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে কেউ শরীরের নিম্নাংশে আঘাত করতে পারে না। শরীরের বাকি অংশ যেহেতু নিরাপদ সেহেতু ভীম আমার কিছুই করতে পারবে না। আমিই ভীমকে এমন আঘাত করব যে, সে নিশ্চিত মারা যাবে।’ পরদিন যথারীতি গদাযুদ্ধ হলো। ভীম কিছুতেই দুর্যোধনের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। উপায় না পেয়ে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে ভীম কাপুরুষের মতো দুর্যোধনের নিম্নাংশে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করেন। একশ কৌরবকে খুন করে যুদ্ধে জিতে যুধিষ্ঠির যখন গান্ধারীর সঙ্গে দেখা করলেন, বাঁধা চোখের সামান্য ফাঁক দিয়ে পুত্রহারা শোকাতুরা, আহত ও ক্রুদ্ধ গান্ধারী যুধিষ্ঠিরকে সামান্য দেখলেন, তাঁর সেই দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় যুধিষ্ঠিরের শরীর আংশিকভাবে পুড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গান্ধারীর আবেদন’ কাব্যনাটকে মহাভারত আখ্যান থেকে তুলে আনা এক ঘটনাকে অসাধারণ এবং কালজয়ী এক শিল্পকর্মে পরিণত করেছেন। সব মানুষ ও সর্বকালের জন্য রচনা করেছেন তিনি ‘গান্ধারীর আবেদন’। গান্ধারীর ব্যক্তিত্ব এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তাঁর আগ্রহ ও দৃঢ় অবস্থান, আবার সেইসঙ্গে সন্তানের দীর্ঘ জীবনের জন্যে তাঁর আকুতি তাঁকে অনন্য এক নারীতে পরিণত করেছে। সত্যের এবং ন্যায়ের জন্যে প্রয়োজনে নিজ সন্তানকে শাস্তিপ্রদানে পিছপা নন গান্ধারী। মহাভারতের গান্ধারীর চাইতেও রবীন্দ্রনাথের গান্ধারী অধিক সাহসী, প্রাজ্ঞ এবং সৎ।

দেবযানী
ইন্দ্রপুরে দেবতাদের পরম পূজনীয় পুরোহিত ছিলেন আচার্য বৃহস্পতি, অন্যদিকে অসুর সাম্রাজ্যে পূজনীয় ছিলেন আচার্য শুক্রাচার্য। শুক্রাচার্য ছিলেন মৃতসঞ্জীবনীর আবিষ্কারক। এই মৃতসঞ্জীবনীর মন্ত্র দিয়ে তিনি মৃতদের জীবিত করে তুলতে সমর্থ হতেন। তাই অসুর ও দেবতাদের যুদ্ধে অসুরেরা হয়ে উঠতে লাগলো অদম্য কিন্তু দেবতারা তখনো সমুদ্রমন্থন করে অমৃত পান করেননি এবং তাঁরা মৃতসঞ্জীবনীর মন্ত্রও জানতেন না। দেবতারা তখন বিকল্প উপায় না দেখে অনেক যুক্তি-পরামর্শ করে বৃহস্পতির পুত্র কচকে অনুরোধ করলেন শুক্রাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে এবং মৃতসঞ্জীবনীর গোপন মন্ত্র শিখে আসার চেষ্টা করতে। এটা না হলে দেবলোক হয়ে যাবে অসুরালয়। কচ দেবতাদের প্রস্তাবে সম্মত হলেন এবং অসুররাজ্যের রাজধানীতে গিয়ে শুক্রাচার্যের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালেন। সেই সময়ের নিয়ম ছিল, কোনো ব্রাহ্মণগুরু কোনো ব্রাহ্মণশিষ্যকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। তাই শুক্রাচার্য কচকে ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। কচ শুক্রাচার্যের গৃহে বিদ্যাচর্চা শুরু করলেন। তখনকার নিয়ম ও রীতি অনুযায়ী গুরুগৃহের নানারকম দৈনন্দিন গৃহকার্যে সাহায্য করে দিন কাটাতে লাগলেন তিনি। ধীরে ধীরে সদালাপী, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান ও রূপবান কচ শুক্রাচার্যের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্যে পরিণত হলেন। আস্তে আস্তে দেখা গেল, কচ কেবল তাঁর গুরুর নয়, গুরুর বিদুষী কন্যা দেবযানীর মনও জয় করে নিয়েছেন। কচের সুমধুর সংগীত আর অপূর্ব চিত্রকলার প্রতি দেবযানীর মুগ্ধতা ধীরে ধীরে ভালোবাসায় পরিণত হলো। কচের ব্যবহারেও প্রতিনিয়ত দেবযানীর প্রতি তাঁর আগ্রহ ও ভালোলাগা প্রকাশ পেত। অসুরেরা ইন্দ্রপুরবাসী কচের এখানে আসা মোটেই ভালো চোখে দেখেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল, কচকে দেবতারা পাঠিয়েছে মৃতসঞ্জীবনীর গুপ্তবিদ্যা শিখে নেওয়ার জন্য। ফলে অসুরেরা মিলে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করল কীভাবে কচকে ধ্বংস করে ফেলা যায়, যাতে তিনি মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র নিয়ে দেবকুলে ফিরে যেতে না পারেন। একদিন শুক্রাচার্যের গরুদের মাঠে চরাতে নিয়ে গেলে অসুরেরা কচকে মেরে ফেলে ও তার দেহ টুকরো টুকুরো করে কুকুরকে খাইয়ে দেয়। ওদিকে গবাদিপশুগুলো একা একা কচকে ছাড়াই ফিরে এলে দেবযানীর মন তার প্রেমাস্পদের অমঙ্গল-আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। তিনি তাঁর বাবাকে তাঁর আশঙ্কার কথা জানালেন। একমাত্র কন্যার দুঃখে বিচলিত শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনীবিদ্যা প্রয়োগ করে কচকে জীবিত করে তুললেন। কচ আরেকবার জীবন পেয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে গুরুসেবা করতে লাগলেন। একদিন দেবযানী কচের কাছে আবদার করলেন এক বিশেষ ধরনের ফুল এনে দিতে তাঁর খোঁপার জন্য, ওই ফুল শুধু এক গভীর অরণ্যেই পাওয়া যায়। ফুল আনতে গেলে অসুরেরা আবার কচকে হত্যা করলো। এবার তারা কচের হাড়-মাংস মন্ড বানিয়ে তা সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিলো। কিন্তু শুক্রাচার্য আবারো কচকে জীবিত করে তুললেন দেবযানীর অনুরোধে। অসুরেরা তৃতীয়বারের মতন কচকে হত্যা করার আগে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কচের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে সেই ছাই সোমরসের সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে খাইয়ে দিলো। সূর্য অস্ত গেলে গবাদিপশুগুলো একা একাই ফিরে এলো, কিন্তু কচের দেখা নেই। শুক্রাচার্যের মৃতসঞ্জীবনীবিদ্যার প্রয়োগে শুক্রাচার্যের পাকস্থলীতে থাকা ছাই থেকে কচ পুনরায় জীবন লাভ করলেন, কিন্তু সেখান থেকে বের হতে পারছিলেন না। শুক্রাচার্য বুঝতে পারলেন তিনি যদি কচকে জীবিত বের করতে চান তাহলে তাঁকে বরণ করতে হবে মৃত্যু। এ-কথা শুনে দেবযানী আবার কাঁদতে শুরু করলেন, কারণ পিতার জীবনের বিনিময়ে তিনি প্রেমিকের জীবন ফেরত চান না। যে-কোনো একজনের মৃত্যুই তাঁর কাছে নিজের মৃত্যুর সমান। শুক্রাচার্য এই সমস্যারও সমাধান করলেন। তিনি কচকে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শেখালেন, যাতে তাঁর মৃত্যুর পর কচ তাঁকে জীবিত করে তুলতে পারেন। শুক্রাচার্যের পাকস্থলী থেকে বের হয়ে কচ শুক্রাচার্যকে জীবিত করে তুললেন। এরপরও কচ আরো বহু বছর শুক্রাচার্যের গৃহে বিদ্যাচর্চা করলেন। অবশেষ এলো বিদায়ের দিন। গুরুগৃহে শেষদিন কচ শুক্রাচার্যের কাছে এলেন বিদায়ী আশীর্বাদের জন্য। কচের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলে দেবযানী কচকে তাঁর ভালোবাসার কথা জানালেন এবং তাঁকে বিয়ে করতে বললেন। কিন্তু কচ বললেন, আমি পুনর্জীবিত হয়েছি তোমার বাবার পেট থেকে সুতরাং তিনি আমার মাতৃসমান আর তুমি আমার বোন, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারি না। কচের এহেন উত্তরে দেবযানী অত্যন্ত বিচলিত ও দুঃখিত হয়ে বললেন, তুমি বৃহস্পতিপুত্র কচ আর আমি শুক্রাচার্যকন্যা, আমরা কোনোভাবেই ভাইবোন নই, আমাদের বিয়েতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু কচ প্রস্ত্তত ছিলেন না দেবযানীকে গ্রহণ করতে। কেননা তিনি ইন্দ্রপুর থেকে একটি বিশেষ কর্মসম্পাদনের জন্যে এসেছেন, নিজে বিবাহ করার জন্যে নয়। সে-কর্ম সম্পন্ন হয়েছে, ফলে তাঁর ফেরার পালা এখন। কচের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্রোধান্বিত দেযযানী কচকে অভিশাপ দেয় – ‘কচ, আমার নিষ্পাপ ভালোবাসাকে তুমি যেভাবে অপমান করলে, আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তুমি কখনো এই মৃতসঞ্জীবনীবিদ্যা ব্যবহার করে কাউকে জীবনদান করতে পারবে না।’ এই অভিশাপ শুনে কচও রাগান্বিত হন এবং দেবযানীকে অভিশাপ দেন, ‘তোমার এই আচরণ অন্যায়, দেবযানী, আমিও বলছি – কোনো ব্রাহ্মণ-পুত্র কখনো তোমায় বিয়ে করবে না, আর আমি হয়তো এই বিদ্যা ব্যবহার করে কাউকে জীবিত করতে পারব না; কিন্তু আমি আমার ছাত্রদের এটা শেখাতে পারবো, যারা এটা প্রয়োগ করবে।’ দেবযানীর ভালোবাসা উপেক্ষা করে কচ চলে গিয়েছিলেন ইন্দ্রপুরীতে তাঁর কর্তব্যপালনে।
এরপর বহু বছর কেটে যায়। দেবযানীর একসময়ের খুব ঘনিষ্ঠ সখী অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা হঠাৎ হিংসা করে একদিন দেবযানীকে এক গভীর কূপের ভেতর ফেলে দেয়। এই অন্যায় কাজের জন্য অসুররাজ শর্মিষ্ঠাকে চিরদিনের জন্য দেবযানীর দাসী করে দেন। ওদিকে ভরত বংশের মহারাজা যযাতি একদিন শিকার করতে বেরিয়ে শুক্রের কন্যা দেবযানীকে সেই কূপের নিচ থেকে উদ্ধার করেন। কচ বিদায় নিয়ে স্বর্গে ফিরে যাওয়ার পর বহুদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে অথবা কচের উদার বরে (রবীন্দ্রনাথের লেখনীর জোরে), ‘তুমি সুখী হবে; ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে’ কিংবা মহাভারতমতে কচের অভিশাপে (কখনো ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেবযানীর বিয়ে হবে না), ততদিনে দেবযানী সত্যি সত্যি কচের প্রেম থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। আর তাই ক্ষত্রিয়রাজ সুপুরুষ সাহসী যোদ্ধা যযাতির প্রেমে পড়ে যেতে সময় লাগে না দেবযানীর। যযাতি প্রথমে রাজি না হলেও পরে সম্মতি দেন। এর কিছুকাল পরে যখন শুক্র দেবযানীর সঙ্গে যযাতির অসবর্ণ বিয়ে দেন, তখন তিনি যযাতিকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, দাসী শর্মিষ্ঠাকে যযাতি যেন কখনো বিয়ে না করেন। যযাতি সেই সাবধানবাণী না মেনে গোপনে শর্মিষ্ঠাকে বিয়ে করেন। দেবযানীর গর্ভে যযাতির দুই পুত্র – যদু ও তুর্বসু এবং শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিন পুত্র – দ্রুহু্য, অনু ও পুরু জন্মলাভ করে। শর্মিষ্ঠার গোপন বিবাহের কথা দেবযানী জানতে পারার পর শুক্রাচার্যের অভিশাপে যযাতি অকালে জরাগ্রস্ত হন। পরে যযাতি শাপ প্রত্যাহারের জন্য শুক্রকে অনেক অনুনয় করায় শুক্র বললেন, যযাতি ইচ্ছে করলে কারো সম্মতি নিয়ে নিজের জরা অন্যকে দিয়ে তাকে জরাগ্রস্ত করে তার যৌবন নিজে ভোগ করতে পারবেন। যযাতি স্থির করলেন তাঁর নিজের যে-পুত্র যযাতির জরা নিয়ে যযাতিকে তাঁর যৌবনদান করবেন, তাঁকেই তিনি রাজ্য দেবেন। পাঁচ পুত্রের মধ্যে শুধু কনিষ্ঠ পুত্র যযাতির জরা নিতে রাজি হলেন। পুত্র পুরুর যৌবনভিক্ষা নিয়ে যযাতি সহস্র বছর ধরে নারীসঙ্গ ও বিষয় ভোগ করে রাজত্বশাসন করে শেষ পর্যন্ত পুরুকে রাজত্ব দিয়ে বনবাসে চলে যান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতায় কচ-দেবযানী উপাখ্যানের শেষটুকু বদলে দেন। দেবযানীর অভিশাপটি অক্ষত রেখে তিনি কচকে মহৎ বানিয়ে তাঁর মুখ থেকে দেবযানীকে অভিশাপ দেওয়ার পরিবর্তে আশীর্বাদ দেওয়ালেন। ‘আমি বর দিনু দেবী তুমি সুখী হবে; ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে…’। রবীন্দ্রনাথ কর্ম ও দায়িত্বকে ভালোবাসার ওপর স্থান দেন এবং কচকে দেবযানীর থেকে মহৎ করার প্রচেষ্টা করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৫৯ সালে শর্মিষ্ঠা নামে পাশ্চাত্য শৈলীতে রচনা করেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাটক, যার ভেতর বহু তৎসম শব্দসহ দীর্ঘ অনেক সংলাপ ব্যবহৃত হয়েছে। পাশ্চাত্যের রোমান্টিকতার সঙ্গে প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থা ও মূল্যবোধের সংযোজন করে আধুনিকমনস্ক মধুসূদন দত্ত দেবযানী, যযাতি ও শর্মিষ্ঠার ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি এবং তার সংশ্লিষ্ট জটিলতা বিশ্লেষণ করেছেন এই নাটকে। মহাভারতে বর্ণিত কাহিনির ওপর ভিত্তি করে রচিত হলেও এই নাটকের চরিত্র ও ঘটনাবলিতে রয়েছে মহাকবির কল্পনাশক্তির ও কাব্যক্ষমতার স্বাক্ষর। সাম্প্রতিককালে অর্পিতা ঘোষ-রচিত এবং দেবযানী নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে কলকাতায়, যার ভেতর দেবযানীর পছন্দের পাত্রের কাছে দু-দুবার করে তাঁর প্রেম নিবেদন করা ও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঘটনা রয়েছে, রয়েছে দেবযানীর অসবর্ণ বিয়ের সংবাদ। সবচেয়ে বড় কথা, এই নাটক দেখায়, দেবযানীর মতো মানুষরা নিজের অজান্তেই যুগ-যুগ ধরে অন্যদের দ্বারা কীভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছেন।

প্রাচ্য পুরাণে নারীর অবস্থান
পুরাণের নারীচরিত্রগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হয় তারা খুব দয়াবতী, সৎ, অত্যন্ত সহজ-সরল, কিন্তু দুর্বল, প্রতিবাদহীন, অথবা প্রচন্ড দাপটের, কৌশলী, হিংসুটে, ষড়যন্ত্রকারী, অন্যের ক্ষতিকারক, ক্ষমতালোভী, পরশ্রীকাতর। দুটোর অবস্থানই প্রান্তিক। যাঁরা ভালো, সবদিক দিয়েই ভালো – যেমন, সীতা, সাবিত্রী, অরুন্ধতী। যাঁরা দুষ্ট প্রকৃতির, তাঁরা চালাক, মন্দ চরিত্রের এবং কুটিল ও প্রতিশোধপরায়ণ, অর্থাৎ তাঁরা সবদিক দিয়েই খারাপ ও স্বার্থান্বেষী, যেমন – মন্থরা, কুন্তি বা সুপর্ণখা। তার মানে, হয় খুবই ভালো, না হয় নিতান্তই মন্দ, যা অধিকাংশ চরিত্রকে মানবিক করে তোলে না। ভালো-মন্দতে মেশানো স্বাভাবিক মানুষের মতো মনে হয় না তাঁদের। মহাভারতে অবশ্য একটি চরিত্র দেখা যায়, যিনি সাহসী, কিন্তু দয়াবতী ও স্নেহশীল, তিনি রাবণের অনুচর অসুরকন্যা ত্রিজাতা, যাঁকে সীতার পাহারায় রেখেছিলেন রাবণ। সীতাকে রাজি ও বশ করার জন্যে প্রয়োজনে সীতার ওপর অত্যাচার করার অধিকার দিলেও ত্রিজাতা সীতার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তাঁর সঙ্গে শত্রুতার পরিবর্তে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। এভাবে পুরুষদের মধ্যে যত যুদ্ধবিবাদই চলুক না কেন, সম-অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণে কখনো কখনো কিছু মেয়েতে-মেয়েতে প্রকৃত বন্ধুত্ব বা sisterly love গড়ে ওঠে, ত্রিজাতা-সীতা ছাড়াও কুন্তির সঙ্গে গান্ধারীর, দ্রৌপদীর সঙ্গে সত্যভামার, সীতার সঙ্গে মন্দোদরীর এমনকি সতীন হওয়া সত্ত্বেও, দ্রৌপদীর সঙ্গে সুভদ্রার সখ্য। সীতা পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যে আদর্শ বলে পরিগণিত। কিন্তু কেন? আসলে যতক্ষণ নারী পুরুষের বেঁধে দেওয়া গন্ডির ভেতর চলাচল করে, ততক্ষণ সে খুবই গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণীয়। কিন্তু পুরুষের ধারণা, মত বা বিশ্বাসের পরিপন্থী কিছু করলে বা বললেই, বিশেষ করে তাদের সমালোচনা বা প্রচলিত কোনো রীতিনীতির প্রতিবাদ করলেই, সে-নারী পুরুষ ও সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়।
ভারতবর্ষের প্রাচীন শাস্ত্রে একদিকে যেরকম দেখা যায় নারীর শাশ্বত রূপ, অর্থাৎ তার মধ্যে কতগুলো বিশেষ মানবিক গুণের সমাহার – যেমন, দয়ামায়া, স্নেহ, সেবা, ক্ষমাশীলতা, ধৈর্য, সহ্যশক্তি ইত্যাদি, তেমনি দেখা যায় মারামারি, দাঙ্গাবাজি, খুন বা যুদ্ধে প্রায়শই নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা, সেইসঙ্গে আবার কোনো কোনো নারীর ভেতর দেখা যায় কুটিলতা, জটিলতা, হিংসা, লোভ, প্রতিশোধস্পৃহার প্রবল উপস্থিতি। মহাভারতের মতো কালজয়ী বিশাল গ্রন্থে স্বার্থান্বেষী, ব্যবসায়ী মনোভাবাপন্ন সত্যবতীকে যেমন দেখা যায়, সততা, স্নেহ, নিরপেক্ষতা ও সহমর্মিতার উদাহরণ গান্ধারীকেও দেখা যায়।
আদিকালে বেশ কিছু নারী ছিলেন, যেমন গার্গি, মৈত্রেয়ী, অপলা, লোপামুদ্রা, যাঁরা যথেষ্ট বিদুষী ছিলেন। দর্শন রচনা ও চর্চা করতেন তাঁরা, জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিদ্যায় ছিলেন পারদর্শী, তাঁদের আয়ত্তে ছিল তীর-ধনুক চালনা, জাদুবিদ্যা, শিক্ষকতা ও গুরুর দায়িত্ব পালন করা। সাধারণ ও বিশেষ জ্ঞানে পুরুষদের সমকক্ষ ছিলেন তাঁরা এবং পুরুষদের সঙ্গে প্রকাশ্য সভায় বসে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা, তর্ক-বিতর্কে অংশগ্রহণ করার উল্লেখ রয়েছে। তাঁদের কারো কারো বেশ কিছু শিষ্যও ছিল। ফলে আদিকালে নারীরা কেবল গুরুপত্নীই নন, সাক্ষাৎ গুরুও ছিলেন।
অসুরের উৎপাতে সমস্ত মর্ত যখন রসাতলে যাচ্ছে, সকল দেবতা মিলে সবচেয়ে শক্তিশালী যে-দেবতাকে পৃথিবী রক্ষার জন্যে পাঠালেন তিনি দশ হাতে একই সঙ্গে দশটি কর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থ এক নারীদেবী। একাধারে স্নেহশীল আবার অতিশয় বুদ্ধিমতী, কৌশলী, শত্রুবিনাশিনী দুর্গা (শক্তি দেবী), সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী যাঁর বারবার রূপ বদলায় (উমা, রমা, পার্বতী, সতী, কালী, অপর্ণা ইত্যাদি)।
সেই সময় সমাজে মায়ের মোটামুটি উঁচু ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। প্রাণত্যাগের পূর্বে ভীষ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অনুনয় করে বললেন, যেন মৃত্যুর পরে ভগবানের চরণে তাঁর ঠাঁই হয়। শ্রীকৃষ্ণ উত্তরে বললেন, একজন ভক্ত হিসেবে ভগবানের কাছে ভীষ্মের পাওনা আরো অনেক বেশি। ভীষ্ম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভক্তের কাছে ভগবানের চরণে ঠাঁই পাওয়ার চাইতে আর কি বেশি পাওনা থাকতে পারে? উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘মায়ের কোল। মায়ের কোল সন্তানের কাছে ঈশ্বরের চরণযুগলের চেয়েও অনেক বেশি পবিত্র।’ প্রতিশ্রুতি- মতো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মকে তাঁর মা অর্থাৎ দেবী গঙ্গার কোলে চিরঠাঁই দিলেন। এছাড়া কুন্তির কথা ‘যা এনেছ পাঁচ ভাই সমানভাবে ভাগ করে নাও’ শুনে পঞ্চপান্ডব সকলে মিলে দ্রৌপদীকে বিয়ে করেন। তবে আসল কথা হলো, দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের পাঁচবার করে স্বামী পাওয়ার বরের কথা যদি বাদও দিই, শুধু ঘরের ভেতর থেকে কিছু না দেখে, না বুঝেই মায়ের সেই আজ্ঞার জন্যেই কেবল এটি ঘটেছে, তা সর্বাংশে সত্য নাও হতে পারে। কেননা, আদেশ শুনেও সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা দ্রৌপদী যে কোনো বস্ত্ত নয়, রক্তমাংসের একটি মানুষ, যাঁর আবার বিবাহ হয়েছে এক পান্ডবের (অর্জুন) সঙ্গে, সেটা মাকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন। আসলে খোদ স্বয়ংবর-সভা থেকেই অাঁচ পাওয়া যাচ্ছিল, কেবল অর্জুন নয়, অন্য চার পান্ডবও দ্রৌপদীর প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষা বোধ করতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির – যার জন্যে তিনিই এই ধরনের একটি বিবাহের প্রস্তাবক ও সম্পন্নকারী। আসলে এই বিষয়ে দ্রৌপদীরও যে ইচ্ছা-অনিচ্ছার একটা ব্যাপার থাকতে পারে, সেটা যাচাই করার কথা কারো মনেই উদিত হয়নি। জননীর প্রতি ভক্তিতে গদগদ হয়ে সব ভাই মিলে একটি কন্যাকে বিবাহ করেন। মায়ের প্রতি এত ভক্তি থাকা সত্ত্বেও দেখা যায় নারীদের বুদ্ধি-বিবেচনার প্রতি কটাক্ষ পুরাণের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে।
ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা থাকলেও যৌনতার ব্যাপারে তেমন রক্ষণশীল ছিল না সেই সমাজ। বিশেষত পুরুষদের বেলায়। তবে নারীদের কৌমার্য ও সতীত্বকে তখনো বড় করে দেখা হতো। অবিবাহিত অবস্থায় মাতৃত্ব অর্জন বা বিয়ের আগে কৌমার্য হারানো মোটেই গ্রহণীয় ছিল না। যার জন্যে সত্যবতী ও কুন্তির মতো শক্তিশালী, সাহসী এবং যথেষ্ট কৌশলী নারীদেরও বিবাহের পূর্বে সন্তান ধারণ করার পর সমাজের এবং পুরুষের প্রত্যাশা মেটাতে আবার দেবতার দাক্ষিণ্য নিয়ে কুমারী সাজতে হয়েছে – আদায় করতে হয়েছে বর, যাতে দেহের কোথাও কৌমার্যহানির চিহ্ন না থেকে যায়। এ যেন বর্তমান সময়ে কোনো কোনো আফ্রিকান ও আরব দেশে বিবাহযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার জন্যে এবং সামাজিক চাহিদা মেটানোর প্রত্যাশায় অবিবাহিত মেয়েদের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সতীচ্ছদ মেরামত করে পুনরায় কুমারী সেজে ফেরার চেষ্টা। কেবল বিয়ের আগে সন্তানের জন্ম হয়েছে বলেই ব্যাস যেমন সত্যবতীর মতো মায়ের দ্বারা জন্মের পরেই পরিত্যক্ত হন, তেমনি কর্ণও কুন্তিকে দিয়ে পরিত্যক্ত হন একই কারণে। দ্রৌপদীকে প্রতিবার এক স্বামীর কাছ থেকে অন্য স্বামীর কাছে যাওয়ার আগে আগুনের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়ে নতুন করে সতীত্ব ও পবিত্রতা অর্জন করতে হতো। সীতাকেও রামের কাছে সতীত্ব প্রমাণ করতে আগুনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছে। কিন্তু দেবতা, মুনি, ঋষি থেকে শুরু করে মানুষ এমনকি রাক্ষসপুরুষকেও এইভাবে শুদ্ধ বা পবিত্র হতে হয়নি এক নারীর শয্যা থেকে উঠে গিয়ে অন্য নারীর সঙ্গে শয়ন করতে যাওয়ার কালে। অথবা যখন ঘরে পরমা সুন্দরী ও আকর্ষণীয় স্ত্রী দ্রৌপদীকে রেখে অর্জুন ব্রহ্মচর্যের জন্যে বনবাসে গিয়ে তিন তিনটি বিয়ে করে ঘরে ফেরেন। নিয়োগ-পদ্ধতির বৈধতা এবং বংশ অথবা সিংহাসন রক্ষা করার জন্যে নিয়োগ-পদ্ধতির প্রয়োগ যথেষ্ট চালু তখন। নিকটাত্মীয়দের মধ্যে যৌন সম্পর্ক এবং বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্কেরও অজস্র উদাহরণ রয়েছে, এবং সেসব সম্পর্ক তেমন সমাজ-বহির্ভূত বা নিন্দনীয় ছিল বলেও মনে হয় না। অর্জুন, ভীমসহ পঞ্চপান্ডবের সকলেই বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে জন্মগ্রহণ করলেও সেটি নিন্দনীয় হয়নি। তবে তখনকার দিনে অগ্রহণীয় ব্যাপার ছিল ভিন্ন শ্রেণি বা বংশের নরনারীর মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন। যার জন্য অম্বিকা ও অম্বালিকার দাসীর সঙ্গে ব্যাসের সঙ্গমের ফলে উৎপন্ন বিদূর সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবচেয়ে বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র বা পান্ডুর মতো কখনো হস্তিনাপুরের রাজা হওয়ার জন্য বিবেচিত হননি। একইরকমভাবে কর্ণ যদিও সূর্যদেবের সঙ্গে অবিবাহিত কুন্তির সম্পর্কের ফসল, বিবাহের পূর্বে জন্মগ্রহণ করার লজ্জায় পিতা-মাতা দুজনেই তাঁকে পরিত্যাগ করেছিলেন। এক রথচালক ও তাঁর স্ত্রীর মতো নিচু জাতের মা-বাবার দ্বারা লালিত-পালিত হওয়ায় এবং তাঁদের সন্তানের পরিচয়েই পরিচিত হওয়ায় দ্রৌপদী কর্ণকে তাঁর স্বয়ংবর-সভায় সম্ভাব্য পাত্র হিসেবে বিবেচনা করেননি। কারণ, ‘কর্ণ সূতপুত্র’, যদিও প্রকৃতপক্ষে তিনি তা ছিলেন না। একই কারণে কর্ণ হস্তিনাপুরের সিংহাসনের জন্যও স্বাভাবিক অবস্থায় বিবেচিত হননি।
তখনকার দিনে মুনি-ঋষি থেকে শুরু করে দেবতারা সকলেই যেন, মনে হয়, সার্বক্ষণিকভাবে কামার্ত থাকতেন। সুন্দরী যুবতী নারীকে দেখামাত্র দেবতা ও ঋষিদের অতি সহজেই ধ্যানভঙ্গ হয়ে যেত, আর সঙ্গে সঙ্গে কামচেতনার সৃষ্টি হতো। আর তখন বিনা সংকোচে তাঁরা নারীদের কাছে তাঁদের সঙ্গম-সম্ভোগের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। প্রথমে রাজি না হলেও (কখনো কখনো আবার শুরুতেই রাজি, যেমন ইন্দ্রের আহবানে বিবাহিত অহল্যার সম্মতি) প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরে নারীরা রাজি হতো। এই রাজি হওয়া সবসময়ে স্বেচ্ছায় না অভিশাপের ভয়ে হতো, নাকি এটা ঘটতো দেবতা বা মুনি-ঋষিদের শ্রেষ্ঠত্বের কাছে বিগলিতচিত্তে নিজেকে সঁপে দিতে কিংবা বলি দিতে, ধন্য হতে, অর্থাৎ উত্তম-অধমের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের কারণই এর জন্যে দায়ী ছিল, বলা শক্ত। তবে, এত শত বিবাহ-বহির্ভূত যৌনমিলনের কথা মহাভারতে থাকলেও রাবণ কর্তৃক তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে মিলিত হতে উদ্যত অপ্সরী রম্ভাকে ধর্ষণ ছাড়া জোর করে সঙ্গমের তেমন উল্লেখ নেই কোথাও। রাবণের এই কর্মের শাস্তিস্বরূপ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের দেওয়া অভিশাপে রাবণ আর কখনো কাউকে ধর্ষণ করতে সমর্থ হননি। এই অভিশাপের ফলেই কি না কে জানে, অশোকবনে এত দীর্ঘকাল বন্দি থাকা সত্ত্বেও সীতার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতে সমর্থ হননি রাবণ।
স্বামীর যৌনক্ষমতা না থাকলেও কিংবা তা প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও (বেশির ভাগ সময়েই কোনো অভিশাপে) সে অনায়াসে এবং প্রবল উৎসাহে ও প্রতাপে পছন্দমতো বিয়ে করতো তখন, কখনো একাধিকবার পর্যন্ত। যেমন, পান্ডুর দুই স্ত্রী ছিল – কুন্তি ও মন্দ্রা। নারীর অবদমিত বাসনা, তার শারীরিক চাহিদা কারো বিবেচনার বিষয় ছিল বলে মনে হয় না। নপুংসক স্বামীর সঙ্গে সুস্থ যৌবনবতী নারীর বিয়ে ভেঙে যাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা বা উপায় ছিল না। কখনো দেখা গেছে, একাধিক স্ত্রী থাকলেও কেবল কোনো বিশেষ স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক থাকে স্বামীর, আর অন্য স্ত্রীরা মুখ বুজে কেবল স্বামীসেবা করে যায়। যেমন পরের দিকে দ্বিতীয় স্ত্রী কৈকেয়ী ছাড়া রাজা দশরথ কৌশলা বা সুমিত্রার সঙ্গে কখনো শারীরিক সম্পর্কে যেতেন না।
সন্তানের প্রতি তখন পিতার জাগতিক বা নৈতিক কোনো দায়িত্ব ছিল বলে মনে হয় না। সন্তান-উৎপাদনে কেবল বীর্যদান করা ছাড়া বহু পিতার আর কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। বিশেষ করে মুনি-ঋষিদের বেলায়। তাঁরা নিজেদের জৈবিক তাড়নায় মাঝে মাঝে তপস্যা থেকে সাময়িকভাবে বিরতি নিতেন। কখনো সুন্দরী কোনো যুবতী অপ্সরী বা অন্য কোনো আকর্ষণীয় নারী যদি পাশ দিয়ে যেতে থাকতো, সঙ্গে সঙ্গে মুনি-ঋষিদের তপস্যা ভেঙে যেতো। (শিশুদের দিবানিদ্রার চাইতেও মনে হয় পাতলা ও তরল ছিল তাঁদের তপস্যার তন্ময়তা ও একাগ্রতা)। আর সঙ্গে সঙ্গে যৌনকাতর হয়ে পড়তেন মুনি এবং একবার তাঁর শারীরিক ক্ষুধা মিটলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে থেকে চলে যেতেন। সেই গর্ভবতী নারীর বা তাঁর অনাগত সন্তানের কোনো সংবাদ পর্যন্ত আর নিতেন না। এটাই ছিল প্রচলিত রীতি। সন্তানের সব দায়িত্বই পড়ত মায়ের ঘাড়ে। শুধু মুনি-ঋষি কেন, স্বয়ং অর্জুন চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে তাঁর যে-সন্তান জন্মে, তার কোনো খোঁজখবর নেওয়া দূরে থাক, স্ত্রী-পুত্র উভয়কেই বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন প্রাসাদে ফিরে এসে। ঘরে স্ত্রী রেখে আরো তিনটি বিয়ে করতে পারেন যে-লোক ব্রহ্মচর্যের জন্যে বনে গিয়ে এবং চার স্ত্রীর ঘরেই যখন সন্তান আসে, তখন সুবিধামতো একটি স্ত্রীর ব্যাপারে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এভাবে প্রাণেশ্বরী শকুন্তলাকেও ভুলে গিয়েছিলেন দুষ্মন্ত। রক্তমাংসের একটি মানুষকে ভুলে গেলেও একটি বস্ত্ত, দামি একখানি অঙ্গুরীয়, দেখে স্ত্রীর কথা মনে পড়ে তাঁর যতদিনে তাঁদের পুত্রও যথেষ্ট বড় হয়ে গিয়েছে, যাকে দুষ্মন্ত আগে দেখেননি আর তাই চিনতে পারেননি প্রথমে।
বহুবিবাহ সমাজে খুবই প্রচলিত রীতি ছিল। স্বামী যতগুলো খুশি বিবাহ করতে পারে। বিয়ে করার ক্ষেত্রে তখনকার দিনের দেবতারা এবং পুরুষমানুষরা ছিলেন অত্যন্ত বেপরোয়া। তাই এই বহুবিবাহ এবং তাৎক্ষণিক বিবাহের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা, তাঁদের জীবনী লক্ষ করলে দেখা যায়, তাঁরা একজন নারীকে নিয়ে কখনোই সুখী হতেন না, একের অধিক বিয়েই ছিল দেবতা ও পুরুষদের বৈশিষ্ট্য। শান্তনু, ভীম, অর্জুন, দশরথ, পান্ডুর, বিচিত্রবীর্য, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতা বাসুদেবই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ফলে, বোঝা যায়, বহুবিবাহ পুরুষদের জন্যে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য ছিল। এমনকি কোনো কোনো নারীর জন্যেও সেটা নিন্দনীয় ছিল না, যেমন দ্রৌপদী, একাই পাঁচজন পুরুষের স্ত্রী ছিলেন। তবে প্রধান পার্থক্য হলো, পুরুষ বহুবিবাহ করতো তার নিজের অভিলাষে, যৌন তাড়নায়। নারী যদি তা করতো কখনো, সেটা বিয়ে অথবা শারীরিক সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন, হয় তা থাকতো পুরুষ কিংবা দেবতা দ্বারা পূর্বনির্ধারিত অথবা পুরুষের বা দেবতার সাময়িক ইচ্ছায়, কিংবা বংশ বা সিংহাসন রক্ষার খাতিরে। তার নিজের ইচ্ছা প্রায় কখনো মুখ্য ভূমিকা নেয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দ্রৌপদীকে কি কেউ জিজ্ঞেস করেছিল এমন অস্বাভাবিক বিবাহে তাঁর সম্মতি আছে কি না? সে যাই হোক, polygamy ও polyandry দুটোই চালু ছিল তখন। ফলে আজকের দিনে কীটপতঙ্গ, পশুপাখি এবং মানুষের ওপর গবেষণা করে যা আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা, সেই আদিকালেই তা জানা ছিল আর সেটা হলো, monogamy is neither common nor natural among males as well as females in most species. তবে polyandry-র তুলনায় polygamy অনেক বেশি চালু ছিল। কেবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উপস্থিতির জন্যেই নয়, আদি যুগে শিশুমৃত্যুর হার খুব বেশি থাকায় পুরুষদের জন্যে বহুবিবাহ নারীদের জন্য বহুবিবাহের চাইতে সামাজিকভাবে শ্রেয় মনে করা হতো, যাতে মনুষ্যজাতি সংখ্যায় পর্যাপ্ত থাকে। একজন স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকলে তার সন্তানের সংখ্যা বেশি হওয়া স্বাভাবিক। তবে সন্তানটি যে তার আসলেই নিজের সন্তান সে-ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে এবং সম্পত্তি যাতে তারই উত্তরাধিকারীর হাতে যায় সেটা স্থির করতে স্ত্রীদের অন্তঃপুরে রাখার পক্ষপাতি ছিলেন স্বামীরা – তা পরবর্তীকালে নারীদের পর্দাপ্রথা ও গৃহের অভ্যন্তরে বন্দি হওয়ার পথ খুলে দেয়। সন্তানের প্রতি, মানে পুরুষসন্তানের প্রতি, তীব্র আসক্তি ও আকাঙ্ক্ষা পদে পদে লক্ষ করা যায়। সন্তান মানেই যেন পুরুষসন্তান, আর অলৌকিকভাবে প্রাপ্ত প্রায় সব সন্তানই পুরুষ।
সহমরণ বা সতীদাহ প্রথার মতো অমানবিক আচারের উল্লেখ রয়েছে মহাভারতে ও রামায়ণে, তবে সেটির প্রচলন বা কার্যকরতা খুব সর্বজনীন বা সচল ছিল বলে মনে হয় না। পান্ডু মারা গেলে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মন্দ্রা সহমরণে যান; কিন্তু কুন্তি, তাঁর প্রথম স্ত্রী, সহমরণে যান না। ইন্দ্রজিৎ (মেঘনাদ) নিহত হলে প্রমীলা সহমরণে যান, কিন্তু রাবণের মৃত্যুর পর মন্দোদরী সহমরণে যান না। এছাড়া অন্য অনেক উল্লেখযোগ্য নারীচরিত্রকে সহমরণে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় যেতে দেখা যায় না। সত্যবতী ও শান্তনুর পুত্র বিচিত্রবীর্য তাঁর দুই স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকা নামক দুই সহোদরাকে রেখে মৃত্যুবরণ করেছিল। বিচিত্রবীর্য সন্তানহীন অবস্থায় মারা যাওয়ায় তাঁর সঙ্গে এই দুই বিধবাবধূও যদি সহমরণে যেতেন, তাহলে সত্যবতীর এতো সাধের হস্তিনাপুরের সিংহাসনে তাঁর নিজের বংশের কারো বসার মতো কেউ থাকতো না। কেননা, সত্যবতী তো আগেই চুক্তি করে তাঁর বিবাহপূর্বকালে জন্মানো ঋষি পরাশরের সঙ্গে প্রাপ্ত পুত্র ব্যাস এবং শান্তনু গঙ্গার পুত্র ভীষ্মকে উত্তরাধিকারের অধিকার থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই দুই অবহেলিত পুত্রই তখন তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। ফলে সহমরণের পরিবর্তে নিয়োগ-পদ্ধতিতে যদি সত্যবতী সেই দুই পুত্রবধূর জটাধারী রক্তচক্ষু ব্যাস দ্বারা (পিতার কাছে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা-অনুযায়ী তিনি কোনো নারীসঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন) পুত্রবতী না করতেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অনেক আগেই কুরু-পান্ডবদের বংশের সমাপ্তি ঘটতো। প্রত্নতাত্তিক গবেষণায় জানা যায়, কেবল ভারতবর্ষে নয়, মিশরসহ প্রাচীন আফ্রিকার বহু দেশেও রাজা বা ওইরকম বড় কেউ মারা গেলে কেবল তার স্ত্রী নয়, প্রিয় ও নিকটাত্মীয় ও দাস-দাসীদেরও সহমরণে যেতে হতো, যাতে পরকালে গিয়ে জীবনধারণ করতে কোনো বেগ পেতে না হয় সেই রাজা বা নেতার – যাতে কোনো কষ্টই না হয় তাঁদের। এই উপমহাদেশেও, শোনা যায়, একসময়ে রাজারা পরলোকে এই জীবনের ধারাবাহিকতা প্রত্যাশা করতেন, তাই প্রাচীন মিশরের মতো এখানেও কেবল স্ত্রী নয়, সবচেয়ে পছন্দের দাসী, অলংকার, বাসনপত্র সব সঙ্গে দেওয়া হতো চিতায় – যাতে পরজন্মে কোনো অসুবিধা না হয়। তবে কুন্তি যেখানে সহমরণে গেলেন না, মন্দ্রা গেলেন, তাতে মনে হয়, স্বামীভক্তির চাইতে মন্দ্রার ওই ইচ্ছামরণের পেছনে অপরাধবোধ কাজ করেছে বেশি। হরিণের রূপধারী মিথুনে ব্যস্ত ঋষি ও তাঁর স্ত্রীকে না জেনে শিকার করে ফেলায় পান্ডু যে ভয়ংকর অভিশাপ পেয়েছিলেন, স-অনুযায়ী যে-কোনো নারীর সঙ্গে রতিক্রিয়া করতে গেলে অবধারিতভাবে পান্ডুর মৃত্যু হবে। এটা জানা সত্ত্বেও মন্দ্রা ও পান্ডু সেদিন সেই নিষিদ্ধ দেহজ খেলায় মেতে উঠেছিলেন। ফলে সঙ্গে সঙ্গে পান্ডুর মৃত্যু হয়। এত বড় ক্ষতি, এত বড় অপরাধের পর, স্বর্গে যেতে হলে এই সহমরণ ছাড়া আর কোনো গতি ছিল বলে হয়তো মন্দ্রার জানা ছিল না। মন্দ্রার মৃত্যুর পর তাঁর দুই অনাথ যমজ সন্তান সহদেব আর নকুলকে কুন্তি নিজের সন্তানের মতোই বড় করে তোলেন। ফলে, মনে হয়, সহমরণ তখন বাধ্যতামূলক ছিল না। অনিবার্য স্বর্গলাভের জন্যে ওটা ছিল ঐচ্ছিক। বনবাসে থাকাকালে নিজের হাতে উত্তরাকে নৃত্যবিদ্যা শিখিয়ে অর্জুন উত্তরার সঙ্গে অর্জুনের পুত্র (সুভদ্রার সঙ্গে) অভিমন্যুর বিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের মাত্র কিছুদিন পরেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অভিমন্যু নিহত হন। তখন উত্তরা সহমরণে যেতে প্রস্ত্তত হলে কৃষ্ণ এসে তাঁকে বাধা দেন। কেননা, উত্তরা তখন গর্ভবতী ছিলেন এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ভূমিষ্ঠ এই সন্তান, পরীক্ষিতই, হবে কুরুপান্ডব বংশের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারী এবং হস্তিনাপুরের সিংহাসন তাঁকেই গ্রহণ করতে হবে।
সেই সময়ে নারীর ভাগ্য ও করণীয় সবই পুরুষদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। একটি নারী নগরবধূ হবে না গৃহবধূ হবে পুরুষ স্থির করে দিতেন। আম্রপালী অভূতপূর্ব সুন্দরী হওয়ায় সকলেই যখন তাঁকে পেতে চাইছে, রাজ্যের ভেতর আম্রপালীকে নিয়ে রেষারেষি দ্বন্দ্ব-শত্রুতা যখন শুরু হয়ে গিয়েছে, তখন রাজ্যের শান্তিরক্ষার্থে এবং সকল পুরুষকে শান্ত করার জন্যে সবচেয়ে সহজ উপায় বলে আম্রপালীর কোনো মতামত না নিয়ে তাঁকে নগরবধূ করে দেওয়া হলো। আম্রপালীই হয়তো একমাত্র নারী যাকে রাষ্ট্র বারবনিতা বানালো। তাঁর একমাত্র অপরাধ ছিল তিনি অতি সুন্দরী। দ্রৌপদী নিজে কেবল এক স্বামী, অর্জুনকে, চাইলেও তাঁকে পঞ্চস্বামীর ঘর করতে হয়। দ্রৌপদীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা এখানে বিবেচনার বিষয় নয়। দ্রৌপদীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে প্রতিভা বসু লিখেছেন, ‘নারীদেহ তো নয় যেন খেলার বল। একের কাছ থেকে যাচ্ছে অপরের কাছে।’ রাবণকে বধ করার পর রামের ইচ্ছায় বিভীষণ ভ্রাতৃবধূ, রাবণের বিধবা স্ত্রী মন্দোদরীকে বিয়ে করেন। অথচ রাবণের সঙ্গে রামের যুদ্ধে মন্দোদরী সরাসরি স্বামীর সঙ্গে রামের বিরুদ্ধে অস্ত্রচালনা করেন। ভাই হওয়া সত্ত্বেও বিভীষণ রাবণের বিরুদ্ধে যেরকম বিশ্বাসঘাতকতা করে রামের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, তাতে মন্দোদরীর এই বিয়েতে মত ছিল কি না সন্দেহ আছে। কিন্তু সেটা রাম বা বিভীষণের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় হয়নি।
নারীর প্রায় কখনো নিজস্ব কোনো ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার শক্তি বা মতামত ছিল না। পুরুষ অথবা দেবতার কাছ থেকে শক্তি বা ক্ষমতা ধার করে সে শক্তিময়ী হয়ে উঠতো। অথবা প্রয়োজনে পুরুষ বা দেবতা সেই শক্তি ধার দিত নারীকে কোনো একটি বিশেষ কর্ম বা কর্তব্য সম্পাদনের জন্য। এক্ষেত্রে প্রাচ্য-পুরাণের পুরুষ ও নারী আকাশে উদিত সূর্য ও চন্দ্রের মতো। সূর্যের নিজস্ব আলো আছে, তেজ আছে, উত্তাপ আছে। আর চাঁদ কেবল সূর্য থেকে আলো ধার করে আলোকিত হচ্ছে, অথবা অন্ধকারেই পড়ে থাকে। তার নিজস্ব কোনো জ্যোতি নেই। আদি ও মধ্যযুগের বেশিরভাগ নারীর অবস্থাও তাই ছিল। আর তাই দেখা যায়, অধিকাংশ সময়ে পৌরাণিক পুরুষেরাই অভিসম্পাত কিংবা বর দিচ্ছেন নারীকে। এর উলটোটির উদাহরণ খুব বেশি চোখে পড়ে না।
পুরাণের ছত্রে ছত্রে নারীবিদ্বেষ, নারীর অধস্তনতা ও তাদের প্রতি কটাক্ষ লিপিবদ্ধ রয়েছে। যত পুরনো দিনের ধর্মগ্রন্থ, সাধারণত তত বেশি ও তত খোলাখুলি ছিল এই বিদ্রূপ আর কটাক্ষ। যে তিনজন পুরুষ বিশেষ করে অত্যন্ত গর্হিতভাবে, প্রকাশ্যে, খোলাখুলিভাবে নারীবিদ্বেষী এবং অযৌক্তিকভাবে যারা নারীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তাঁরা হলেন, ধর্মাবতার আজীবন কুমার, নারী সংস্রবহীন তপস্বী ভীষ্ম, ধর্মে ও সত্যবাদিতায় অবিচল বলে সুপরিচিত যুধিষ্ঠির যিনি নিজের স্ত্রীকে বাজি রেখে পাশা খেলেছেন এবং একটিবারও তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি বা স্ত্রীর অপমানের প্রতিবাদ করেননি, এবং সকলের জানা প্রচন্ড নারীবিদ্বেষী মুনি মনু ঋষি।
মহাভারতে ভীষ্ম বলেছেন : স্ত্রীলোককে কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী ও বৃদ্ধাবস্থায় পুত্র রক্ষা করবে। তাদের স্বাতন্ত্র্য প্রদান করা বিধেয় নয়। তিনি আরো বলেন : ইহলোকে স্ত্রীলোক অপেক্ষা পাপশীল পদার্থ আর কিছুই নেই। প্রজ্বলিত আগুন, ক্ষুরধার, বিষ, সাপ ও মৃত্যু এইসব ভয়াবহ জিনিসের সঙ্গে তাদের তুলনা করা যায়। মৃত্যুপথযাত্রী ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন : নারীর চেয়ে অশুচি আর কিছু নেই। পূর্বজন্মের পাপের ফলে নারীজন্ম হয়। সাপের মতো নারীকেও কখনো বিশ্বাস করা উচিত নয়। নারীর কাছে মিথ্যা বললে পাপ হয় না। তাঁর মতে, ছটি বস্ত্তকে সর্বক্ষণ চোখে চোখে না রাখলে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায় : গাভী, সেনা, কৃষি, স্ত্রী, বিদ্যা এবং শূদ্রসংসর্গ। যে-ভীষ্ম কোনোদিন বিবাহ করেননি, নারীসঙ্গ ভোগ করেননি, তিনি কেমন করে নারীর যৌনতা সম্পর্কে অবলীলায় বলে যান, ‘উহাদের মতো কামোন্মত্ত আর কেহই নাই। কাষ্ঠরাশি দ্বারা যেমন অগ্নির, অসংখ্য নদীর দ্বারা যেমন সমুদ্রের, সংহার দ্বারা অন্তকের তৃপ্তি হয় না, তদ্রূপ অসংখ্য পুরুষসংসর্গ করিলেও স্ত্রীলোকের তৃপ্তি হয় না।’ মহাভারতে রাজা যযাতির পুত্র দ্রুহু্য নারীকে ভোগ্যবস্ত্তরূপে চিহ্নিত করেছেন। পুরাণে আরো বলা হয়েছে : পুত্র হলো সর্বোচ্চ স্বর্গের প্রদীপ আর কন্যা হলো দুঃখের কারণ। স্মৃতিশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনু নারীকে মিথ্যার মতোই অপবিত্র বলেছেন এবং তাদের বেদপাঠের অধিকার হরণ করেছেন। মনুর মতো নারীবিদ্বেষী ঋষি আর দ্বিতীয়টি দেখা যায়নি। নারীনিন্দার ব্যাপারে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও কম ছিলেন না। কুন্তির মতো যাঁর মা, দ্রৌপদীর মতো যাঁর স্ত্রী, কৌরব-পান্ডবদের মধ্যে এই প্রজন্মের সর্বজ্যেষ্ঠ সন্তান যিনি, সদা সত্যবাদী বলে যাঁর সুনাম চতুর্দিকে, তিনি যে কেন এমন নারীবিদ্বেষী হলেন, বোঝা কঠিন। তিনি নারীকে সর্বপাপের দ্বার বলে অভিযুক্ত করেছেন। তাঁর ভাষায় : গাভী যেমন নতুন নতুন তৃণ ভক্ষণ করতে অভিলাষ করে, সেরকম নারীরাও নিত্যনতুন পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ করতে বাসনা করে থাকে। যুধিষ্ঠির আরো বলেন, স্ত্রীজাতি কোনো বিষয়কেই কখনো গোপন রাখতে পারে না। রোমান্টিক প্রেমিক অর্জুনও স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে জন্মানো তাঁর আপন পুত্রকে চিনতে না পেরে তাঁকে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে তাঁর মায়ের নামে অযথা কটু ও নিষ্ঠুর মন্তব্য করেন। পঞ্চতন্ত্রে বলা হয়েছে : মেয়েরা তখনই কেবল সতী হয়, যখন নিভৃতি নেই, সুযোগ নেই আর প্রার্থীপুরুষ নেই। স্মৃতিশাস্ত্রে রয়েছে পুরুষের প্রভুত্ব আর নারীর দাসত্বের কথা। প্রাচ্য পুরাণে নারী-পুরুষের শাস্তির বিধানও ছিল ভিন্ন। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে যৌন-শুচিতার ক্ষেত্রে প্রচন্ড বৈষম্য লক্ষ করা যায়। অসতী স্ত্রী বিনাশর্তে, বিনাবিচারে পরিত্যাজ্য, পক্ষান্তরে ব্যভিচারী স্বামীর প্রায়শ্চিত্তে নিষ্কৃতি। সতীত্ব সর্বদা নারীরই পালনীয়। অন্যদিকে একমাত্র অজাচার কিংবা অগম্য-গমন ব্যতীত পুরুষের যে-কোনো স্খলন বা ব্যভিচারের বিধান কেবল প্রায়শ্চিত্ত। পরনারী, রজঃস্বলা ও গর্ভবতী স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌনসংসর্গ করলে শুধুমাত্র প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া অন্য কোনো শাস্তির প্রয়োজন নেই পুরুষের। অর্জুনের মতো শক্তিধর লোকদের তাও করতে হয় না। অর্জুন যখন প্রথম সহবাস করে তাঁর চতুর্থ স্ত্রী উলুপীর সঙ্গে, উলুপী তখন অন্যত্র বিবাহিত ছিলেন। তাই অর্জুনের বহুদিন লাগে মনস্থির করতে উলুপীকে আদৌ স্ত্রীর মর্যাদা দেবেন কি দেবেন না। কিন্তু ইতোমধ্যে আরো তিনটি স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও উলুপীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখায় এবং তাঁর সঙ্গে আরেকটি পুত্রের পিতা হওয়ায় অবশেষে অর্জুন উলুপীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। উপনিষদের প্রখ্যাত ঋষি যাজ্ঞবল্ক নারীকে নিজের দেহের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে তিনি বলেন : সম্ভোগে অনিচ্ছুক স্ত্রীকে প্রথমে মিষ্টি কথা বলতে হবে, তাতেও সম্মত না হলে বস্ত্র এবং অলংকার দিয়ে তাকে রাজি করাতে হবে। তাতেও সম্মত না হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে তাকে প্রহার করতে হবে। ভীষ্মের অনুশাসন বলে : ব্যভিচারিণী স্ত্রীকে স্বামীগৃহের মধ্যে বন্ধ করে শুধু বেঁচে থাকার জন্যে একান্ত জরুরি এবং যৎসামান্য খাদ্য দিয়ে রাখবে। কিন্তু স্ত্রী যদি স্বামীকে পরিত্যাগ করে নিকৃষ্ট জাতির সঙ্গে সংসর্গ করে, তবে শাস্ত্রের বিধান-অনুযায়ী স্বামীর উচিত সেই স্ত্রীকে প্রকাশ্যে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো। অন্যদিকে পুরুষ অকুলীন পত্নীতে গমন করলে অথবা অন্য স্ত্রী-সংসর্গ করলে, দুই-তিন বছর ব্রহ্মচর্য পালন করার পর দুই তিনদিন স্বল্পাহার করে দিনের শেষে অগ্নিতে আহূতি দিলেই সব পাপ মোচন হয়ে যাবে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, সাধারণভাবে বর্ণপ্রথার মতোই লিঙ্গবিভেদও সেকালে বড়ই প্রখর ছিল। নারীর অধস্তনতা পুরাণের পরতে পরতে লিপিবদ্ধ। জৈবিক বাসনা-চরিতার্থ করতে এবং গৃহকর্মের জন্যে নারীর প্রয়োজন হলেও পরিবার বা সমাজে তার প্রতি পুরুষের ছিল গভীর অনাস্থা, অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা। যে-যুগে পুরুষ যত খুশি বিয়ে করতে পারতো, সেই যুগে নারীদের সর্বদা ব্যস্ত ও তটস্থ থাকতে হতো তাদের সতীত্ব ও কুমারীত্ব আগলে রাখার জন্যে। শক্তি বা ক্ষমতা যদি কিছু তাদের থাকতো, যদি নিজেদের সিদ্ধান্ত বা মতামত দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো, তাহলে দেখা যেতো অবধারিতভাবেই নারী সেটা অর্জন করেছে কঠিন তপস্যার মাধ্যমে কোনো দেবতার মন গলিয়ে অথবা বর মেগে, কিংবা কোনো কামার্ত মানুষ বা দেবতার সঙ্গে সম্ভোগের বিনিময়ে সেই বিশেষ অধিকার বা ক্ষমতার জন্যে দরকষাকষি করে বা সন্ধি স্থাপন করে। আর তাই আজকের লেখক পুরাণের নারীকে নবরূপায়ণে দেখতে চান (যেমন রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা), তাঁর ক্ষমতায়ন কল্পনা করেন। বাংলা সাহিত্যের দেড়শো বছরের ইতিহাসে এমন লেখকের সংখ্যা একেবারে কম নয়, যারা নারীর এই প্রগাঢ় অবমূল্যায়নে ক্রুদ্ধ, ব্যথিত ও সহানুভূতিশীল ছিলেন, এবং তাঁদের সৃজনশীল রচনাতে তা বারেবারে বিধৃত হয়েছে। আশা করা যায়, প্রাচ্য পুরাণের নারী এবং আজকের প্রাচ্যের নারী উভয়েই আমাদের সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে সামাজিক মূল্যবোধে-জীবনচর্চায় যথাযোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত হবেন। অন্তত লেখকের চিন্তার স্বাধীনতায়, তাঁদের কল্পনায় এবং স্বপ্নে সেটা প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হবে।

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে
প্রাচ্য পুরাণের নবরূপায়ণ
সম্প্রতি মনজুরে মওলা সাহিত্যপত্রিকা কালি ও কলমে লিখেছেন, ‘পুরাণ ব্যবহার করার স্বাধীনতা যেমন সব শিল্পীরই আছে, পুরাণ থেকে সরে আসার অধিকারও তেমনি সব শিল্পীর আছে। পুরাণে, বা, ইতিহাসে যা আছে, তাকে ঠিক তেমনি করে তুলে ধরার দায় শিল্পীর নেই। সত্যি বলতে কী, পুরাণে, বা, ইতিহাসে যা আছে, তা ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করলে শিল্পরচনার কোনো মানে থাকে না, যদি না, যা আছে, তার কোনো বদল না করেও শিল্পীতার মধ্যে নতুন জীবন সঞ্চার করতে পারেন, তাকে নতুন অর্থ দিতে পারেন, তাকে সমকালীন করে তুলতে পারেন, জীবনকে তিনি নিজের মতো করে যেভাবে দেখেন, সেভাবে তুলে ধরতে পারেন। উৎসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা অসম্ভব নয়, কিন্তু বিশ্বস্ত থেকে তাকে নতুন করে তোলা সহজ নয়।’
সাহিত্যে পুরাণের নবরূপায়ণে পরিবেশন লেখকদের জন্যে একটি অতিপরিচিত, স্বীকৃত ও নন্দিত পদ্ধতি, যে-রীতি বহুকাল ধরে চলে আসছে। তবে বাংলা সাহিত্যে এর প্রচলন আগে আরো বেশি ছিল, বর্তমান সময়ে পৌরাণিক চরিত্র বা বিষয়ের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। শ্রুতিমধুর কাব্য ভাগবতপুরাণের প্রথম অনুবাদ হয় বাংলায়, করেন মালাধর বসু এবং এর বাংলা নামকরণ হয় ভাগবত। ১৪৭৩ সালে মালাধর ভাগবতপুরাণের বিষয়বস্ত্ত অবলম্বনে শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যরচনা শুরু করেন। সেই কাব্যরচনা শেষ হয় ১৪৮০ সালে। এই কাব্যের আরেক নাম গোবিন্দমঙ্গল। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের উদ্দীপ্ত করতে এ-গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।
পৌরাণিক যে-সকল নারী চরিত্র মহাভারতে বর্ণিত রূপে বা প্রতীকী সংকেতে বাংলা সাহিত্যে পুনঃপুন ব্যবহৃত হয়েছে, তাঁরা হলেন দ্রোপদী, রাধা, সীতা, শকুন্তলা, দুর্গা (পার্বতী, উমা, সতী, কালী), কুন্তি ও চিত্রাঙ্গদা। কবি ও নাট্যকারের অসীম কল্পনায় এবং তাঁদের নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় পুরাণের মূল কাঠামো (কাহিনি ও চরিত্রসহ) অতি সহজেই ভেঙে পড়ে। মেদ-মাংসহীন সেই কাহিনির কঙ্কালে তখন নিজের কল্পনা মিশিয়ে বিনির্মাণ করেন লেখক এমনসব চরিত্র ও কাহিনি, যা আবহমান কাল ধরে পাঠকের কাছে গৃহীত হয়, তাঁদের আন্দোলিত করে, দেশ-কাল-ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁদের হৃদয়কে দোলা দেয়। প্রাচীন কাহিনির সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতা এবং আধুনিক জীবনের বহু অনুষঙ্গ মিশিয়ে তৈরি করেন তাঁরা নতুন এক সাহিত্য যার গ্রহণযোগ্যতা, নান্দনিকতা ও নতুনত্বের আবেদন অনেক বেশি জোরালো ও স্থায়ী। এই নবরূপায়ণের সময়, বেশিরভাগ সময়েই আদিকালের পাত্রপাত্রীকে বর্তমান সময়ের নরনারীতে পরিণত করা হয়। নির্মলেন্দু গুণ যেমন আজকের সংসারকে সেকালের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ‘সূচ্যগ্র সুখের কণা কেহ কারে সহজে দেবে না/ সংসারযুদ্ধের সুখ পায় স্বেচ্ছাপরাজিত সেনা’ (‘কুরুক্ষেত্র’)।
এই নিবন্ধে নির্বাচিত পৌরাণিক পঞ্চনারীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত্র বর্ণনাকালে কারো কারো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা পুরাণে কেমনভাবে বর্ণিত ছিল আর লেখক বা কবির কল্পনায় বা দৃষ্টিতে তা কেমনভাবে ধরা দিয়েছে তা উল্লিখিত হয়েছে স্ব-স্ব অধ্যায়ে। পুরাণের এই ধরনের নবরূপায়ণ বহু লেখক অনেককাল ধরেই করে আসছেন, যার বিস্তারিত বিবরণ বা তালিকা দেওয়া কঠিন। কিন্তু কেবল উদাহরণ টানার জন্যে এঁদের ভেতর মাত্র কয়েকজন লেখকের লেখা থেকে শুধু একটি বা কয়েকটি রচনার উদ্ধৃতি দেওয়া হলো নিচে :
মালাধর বসু (শ্রীকৃষ্ণবিজয় বা গোবিন্দমঙ্গল), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (শকুন্তলা ও সীতার বনবাস), মদুসূদন দত্ত (শর্মিষ্ঠা নাটক, মেঘনাদবধ কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘নরকবাস’, ‘বিদায় অভিশাপ’, ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’), রাজশেখর বসু (হনুমানের গল্প, যযাতির জরা), বুদ্ধদেব বসু (রাবণ, প্রথম পার্থ, মহাভারতের কথা, তপস্বী ও তরঙ্গিনী), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (রাধাকৃষ্ণ), সুবোধ ঘোষ (ভারত প্রেমকথা), জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (এক যযাতি, সাজানো ফুলের বাগান), আল মাহমুদ (কৃষ্ণকীর্তন), বিনয় মজুমদার (মহাদেবের জটা), পূর্ণেন্দু পত্রী (আমিই কচ, আমিই দেবযানী), নির্মলেন্দু গুণ (কুরুক্ষেত্র), মুহম্মদ নুরুল হুদা (শুক্লা শকুন্তলা, অর্জুন অর্জুন), সাদ কামালী (অনূঢ়া আখ্যান, সুবলাদাসীর ধর্মযুদ্ধ), শাহনাজ মুন্নী (রূপময়ীর ছয়টি হাত), সেজান মাহমুদ (অগ্নিবালক), মাহবুব সাদিক (দ্রৌপদীর শাড়ি), গজেন্দ্রকুমার মিত্র (পাঞ্চজন্য), প্রশান্ত মৃধা (যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী), পূরবী বসু (প্রতিমাপুরাণ, বারে বারে ফিরে ফিরে), লক্ষ্মীপ্রসাদ (দ্রৌপদী)। শামসুর রাহমান কবিতায় সরাসরি প্রাচ্য পুরাণ খুব একটা ব্যবহার করেননি। তবে বিধ্বস্ত নীলিমা গ্রন্থের ‘পুরাণ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন – ‘আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন, তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পুরাণে’। এই কথার ভেতর দিয়ে তিনি পুরাণের অর্থহীনতা ও আজকের যুগে তার অচলতা ও অনুপযুক্ততা প্রকাশ করেছেন। তারপরেও, পুরাণদ্বারা, বিশেষত পশ্চিমি পুরাণদ্বারা তিনি যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে হয়। কোনো কোনো কবিতায় তিনি প্রাচ্য পুরাণের নানা অনুষঙ্গ, প্রসঙ্গ, চরিত্র ও ঘটনাও অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে সীমিতভাবে ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় তাঁর কবিতার শরীরে গেঁথে আছে, ‘মায়ামারীচ’, ‘খান্ডবদাহন’, ‘জতুগৃহ’, ‘কালকূট’, ‘বাল্মীকি’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘শিখন্ডী’ প্রভৃতি শব্দ।
শুধু সাহিত্যে নয়, পুরাণের কথা ও লোকগাথা বহু বাংলা নাটকেরও উপজীব্য। কাজী নজরুল ইসলাম লেটোর দলে পালা গান লিখতে গিয়ে এবং গ্রামোফোনে রেকর্ড করতে গিয়ে অনেক পৌরাণিক কাহিনি ব্যবহার করেন। এসবের অনেকেরই আজ আর হদিস পাওয়া যায় না। তবে অন্যদের মধ্যে তাঁর লেটোর দলের জন্যে লেখা পালাগান শকুনিবধ, দাতা কর্ণ, মেঘনাদবধ কাব্য উদ্ধার করা হয়েছে। শাঁওলী মিত্রের একক অভিনয়ে করা নাথবতী অনাথবৎ নাটকে দ্রৌপদী ও তাঁর পঞ্চস্বামীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও মনোভাবের কথা নবরূপে রূপায়িত হয়েছে। মনসা ও চাঁদ সওদাগরকে নিয়ে শম্ভু মিত্রের লেখা চাঁদ বণিকের পালা নাটকটি ঢাকা ও নিউইয়র্কে মঞ্চস্থ করেছেন রওশন আরা ও জামালউদ্দীন হোসেন। বীরাঙ্গনা কাব্য অবলম্বনে কহে বীরাঙ্গনা এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চস্থ হচ্ছে। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যটি মহাভারতের পটভূমিতে রচিত। প্রেম-বন্ধনে বাঁধা নরনারীর কথোপকথনকে উপজীব্য করে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত বীরাঙ্গনা কাব্য। এখানে আমরা দেখতে পাই, একাকিনী পত্নী বা প্রেমিকাদের প্রত্যেকে (১১ জন) তাঁদের পুরুষকে পত্র লিখছেন। এই নারীদের মধ্যে রয়েছেন শোকাতুরা শকুন্তলা, ঈর্ষান্বিতা দ্রৌপদী, পতির অমঙ্গল-আশঙ্কায় অস্থির দুঃশলা এবং পুত্রশোকে কাতর, পতির ভীরুতার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনকারী জনা। ১১টি পত্র থেকে চারটির নাট্যরূপায়ণই কহে বীরাঙ্গনা। পৌরাণিক কাহিনি হলেও এতে উঠে এসেছে প্রাচ্যের চিরন্তন নারীর বিরহ, বেদনা, একাকিত্ব, হাহাকার। এই নাটকটি পুরোপুরি মনিপুরী সম্প্রদায়ের শিল্পীদের নিয়ে মঞ্চায়িত। সুভাশিস সিনহার পরিচালনায় চারটি অঙ্কেই একক অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিনহা।
আধুনিক যুগে চলচ্চিত্রেও পুরাণ- চরিত্রের নবায়ন অথবা ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। বহু দেব-দেবী, রাধা-কৃষ্ণ ও শিব-পার্বতী, লাইলী-মজনু, এমনকি সরাসরি রামায়ণ, মহাভারত, আম্রপালী, এমনকি বাল্মীকিকে নিয়ে অসংখ্য ছায়াছবি বানানো হয়েছে, হচ্ছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। এসব ছায়াছবির কাহিনি অনেক সময়ে সমসাময়িক বাস্তবতার প্রেক্ষিতেও রচিত হয়। বেহুলা আখ্যান নিয়ে জহির রায়হান নির্মাণ করে গেছেন চলচ্চিত্র বেহুলা। কেবল বেহুলাতে নয়, পুরাণের ধারা অনুসরণ করে সাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি রয়েছে বাংলা ছায়াছবিতে। এখানে সাপ আসে নির্দিষ্ট একটি ভূমিকা পালন করার জন্যে অথবা প্রতীক অর্থে। ছায়াছবিতে তার আবির্ভাব ঘটে দুভাবে – কখনো চরিত্র হিসেবে এবং কখনো মনুষ্যমূর্তি ধারণ করে। চলচ্চিত্র-শিল্পে সাপ একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার অনেক আগেই তা এসেছে পুরাণে, বিভিন্ন লোকগাথায় ও মঙ্গলকাব্যে।
এছাড়া প্রাচ্য পুরাণে নানারকম অনুষঙ্গকে বিভিন্ন মিডিয়ায় বিভিন্ন রকমভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন প্রাচীন পুরাণের আখ্যান বা চরিত্রের সরাসরি প্রয়োগে বা তার ছায়ায় রচিত অত্যাধুনিক ব্যান্ড মিউজিকের কথা থেকে শুরু করে, আরো নানান ধরনের গান (বিশেষ করে ভক্তিগীতি, লোকগীতি), গাজন নাচ, গাজির পট, যাত্রা, বিভিন্ন পূজা-পার্বণ-ব্রত, পথনাটক আজো দারুণ জনপ্রিয় ও সচল বাংলার পথে, ঘাটে, হাটে, বাজারে, উঠানে, ঘরে, মঞ্চে সর্বত্র। এই উপমহাদেশের প্রেমের গানের (ধর্মীয়/ লোকগীতি/ আধুনিক) একটা প্রধান অংশ জুড়ে আছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম। দ্বাদশ শতাব্দীতে বড়ু চন্ডীদাস দিয়ে যার জনপ্রিয়তা শুরু হয়েছিল, বৈষ্ণব সাধক শ্রীচৈতন্য যার প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন, তাঁর আবেদন আজো একইরকম বা আরো বেশি প্রবল। মমতাজের গলায় ‘আজান শুনে ঘুম ভাঙ্গিল/ চোক্ষের পানি রাখতে নারি/ শ্রীদাম রে, ওরে ভাই শ্রীদাম/ কেমন আছে প্রাণেশ্বরী’র মতো গান আবহমান বাংলার যৌথ সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। এছাড়া, লৌকিক উপাখ্যান বা গাথা নিয়ে রামলীলা, কৃষ্ণলীলা, লখিন্দর-বেহুলা পালা, লাইলী-মজনু বা শিরী-ফরহাদ পালা, রাধা-কৃষ্ণের কীর্তন, গাজী কালু ও চম্পাবতী কন্যা নিয়ে গাজীর গান, সংগীতসহ নৃত্য, পাঁচালি, পুঁথিপাঠ এবং জলসা নিয়মিত পরিবেশিত হয়।
কয়েক বছর আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন বলেছিলেন, সরস্বতীকে দেখলে তাঁর মনে কামভাব জাগে (এছাড়া সুনীলের কবিতাতেও আছে, বাল্যকালেই সরস্বতীর মূর্তিকে তিনি আলিঙ্গন করেছিলেন), অথবা কালী দেবীকে তিনি যখন ‘ন্যাংটো সাঁওতাল মাগী’ বলে আখ্যায়িত করেন, চারদিকে হইচই পড়ে যায়, কারো কারো ধর্মানুভূতিতে প্রচন্ড আঘাত লাগে। সুনীলের নামে কোর্টে কেস ওঠে, কিন্তু তাঁর জীবন সংশয় হয় না। কিন্তু মকবুল ফিদা হুসেনের মতো প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর কল্পনা মিশিয়ে অাঁকা দেশমাতৃকার অবয়বে বস্ত্রবিহীন সরস্বতীকে কিছুতেই সে-দেশের হিন্দু সমাজ মেনে নিতে পারে না। শিল্পীর স্বাধীনতার ওপর কট্টর হিন্দুদের এই স্বৈরাচারী আক্রমণে সন্ত্রস্ত ও হতাশ রোমান্টিক শিল্পী ফিদা স্বেচ্ছানির্বাসনে দুবাইয়ে জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কাটিয়ে সম্প্রতি লন্ডনে ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সরস্বতী বা কালীকে নিয়ে সুনীলের এ-ধরনের মন্তব্য অবশ্য তাঁকে যতই ধর্মনিরপেক্ষ, নাস্তিক বা প্রগতিশীল করে তোলে বলে তিনি মনে করুন না কেন, এর পেছনে নারী এবং উপজাতীয়দের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য ও অশ্রদ্ধাও যে ধরা পড়ে, সেটা তিনি হয়তো গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখেননি। লক্ষ্মীপ্রসাদকে তাঁর উপন্যাস দ্রৌপদীর জন্যে ডানপন্থী হিন্দু রাজনৈতিক দল ক্ষুব্ধ হয়ে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় গালাগাল করেছে, কেননা এই উপন্যাসে লক্ষ্মীপ্রসাদ দ্রৌপদীর যৌনতা, স্বামী হিসেবে পঞ্চপান্ডবের মধ্যে তাঁর নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, সর্বোপরি কর্ণের দিকে তাঁর চোখ পড়ার কথাও উল্লেখ করেছেন। কট্টর হিন্দুদের কাছে মনে হয়েছে, যদিও এটি একটি উপন্যাস, তাহলেও সাহিত্য আকাদেমি একে পুরস্কৃত করে হিন্দু ধর্মকে অপমান করেছে। এটি নাকি পর্নোগ্রাফির সমতুল্য। আর সেটা করা হয়েছে হিন্দুদের পূজনীয় নারীচরিত্র দ্রৌপদীকে নিয়ে। তারা এই গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করার অনুরোধ জানান সরকারের কাছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছেও লেখক ও তাঁর পুস্তকের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ যায়। কিন্তু দৃঢ়চেতা লক্ষ্মীপ্রসাদ সটান এবং স্থির দাঁড়িয়ে আছেন নিজস্ব স্থানে। এতটুকু সমঝোতা করার লক্ষণ নেই সেখানে। লেখকের কল্পনা ও তাঁর লেখার স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাস করেন। সাহিত্য অকাদেমি এই পুরস্কারটির নির্বাচনকালে এই অকাদেমির প্রেসিডেন্ট ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যতদূর জানি, তিনি এখনো সেখানে স্থলাভিষিক্ত। সুনীলের আমলে এমন একখানি গ্রন্থ অকাদেমি পুরস্কার পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। লেখকের কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতাকে আর যে-ই হোক, অন্তত সুনীল গলা টিপে মারবেন না বলেই আমাদের ধারণা। আসলে, সৃজনশীলতার গতি বন্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই – থাকা উচিত নয়। প্রাচ্য মিথোলজির ঘটনা ও চরিত্রগুলো আজকের লেখকদেরও প্রবলভাবে আন্দোলিত করছে। তাঁরা পুরাণের আখ্যানকে, চরিত্রকে, বিশেষ করে নারীচরিত্রকে নবায়ন করছেন। আর তাই নবরূপে, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সমকালীন সমাজের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উপস্থাপিত হচ্ছে হাজার হাজার বছরের পুরনো উপাখ্যানের অংশবিশেষ, এর বিভিন্ন অনুষঙ্গ, চরিত্রের নাম ও অন্তর্নিহিত দর্শন, যার আবেদন সর্বজনীন, চিরন্তন। 