পূর্ব-পশ্চিমের শিল্পিত বন্ধন

মোবাশ্বির আলম মজুমদার

বাংলাদেশের শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রালগ্ন থেকে পরবর্তী ছয় দশকে সৃষ্টি হয়েছে নানামাত্রিক কাজ। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের শিল্পকলার অবস্থান এখন সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম সৃষ্টির পাশাপাশি পাশ্চাত্য ধারায় শিল্পসৃষ্টির প্রবণতা শুরু হয় পঞ্চাশের দশকের শিল্পীদের কাজে। এথেনা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের আয়োজনে ২৮ জন শিল্পীর কাজে মেলবন্ধনের সুর খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের আটজন ও পাকিস্তানের দশজন শিল্পীর কাজের মাধ্যমে ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক ও তেলরং। বিমূর্ত, আধাবিমূর্ত, জ্যামিতিনির্ভর, বাস্তবরীতির কাজে পাকিস্তানের ঐতিহ্যনির্ভর শিল্পকর্ম নির্মাণের ধারাবাহিকতা থেকে দূরে সরে এসে এ-প্রদর্শনীর শিল্পীদের কাজে দেখা যায় বিষয়ে সরলীকরণ। রং প্রয়োগে কুশলী হয়ে চিত্রতলের ব্যবস্থাপনায় অতি-নাটকীয় রূপ প্রদানও উল্লেখ্য।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এথেনা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ইউনিটি অব সোলস’। শিল্পীদের মাঝে ঐক্য বোঝাতে এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম এমন হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পকলার উত্তরণের ধারাবাহিকতার কিছুটা খোঁজ দেয় এ-প্রদর্শনীর কাজে।

গোলাম ফারুক বেবুল এ-প্রদর্শনীর অগ্রজ শিল্পী। তাঁর শিরোনামহীন কাজে জ্যামিতিক আকৃতি বিন্যাস দেখা যায়। অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে ক্যানভাসে আঁকা এ-কাজে লাল রঙের সঙ্গে বান্টসিয়েনা ও গাঢ় রঙের প্রয়োগ এক রং আরেক রঙের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করেছে। বেবুলের ক্যানভাসের মাঝে চৌকোনো আকৃতির ভেতর জ্যামিতিক ছোট ছোট আকৃতির উপস্থাপন ছবিতে ছন্দ তৈরি করে। ফারুকের এ-কাজটি একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে অাঁকা। রেজাউন নবী ক্যানভাসে মিশ্রমাধ্যম ব্যবহার করেন। তাঁর ছবির বিষয় রোমান্টিক। বাস্তবতার সঙ্গে অতি অাঁকো যুক্ত করে ক্যানভাসে রচনা করেন ব্যক্তিগত স্মৃতি। নীল রঙের আধিক্যে ক্যানভাস দর্শকদের দৃষ্টি কাড়ে। ছোট ছোট বিন্দু আর রেখার সমাবেশে ছবিতে উৎসবের রূপ তৈরি হয়। মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান আনিসের ‘কালিদোসকপিক কমপ্লেক্সিটি’ শিরোনামের কাঠখোদাই ছাপচিত্রের আকার, নগরের নিত্য দেখা স্থাপনাকর্মের অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে তুলে ধরেন তাঁর কাজে। আনিসের কাঠখোদাইয়ে দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। বিষয়ের সঙ্গে দর্শকের যোগাযোগ তৈরি হয় দ্রুত। সহজপাঠ্য আনিসুজ্জামানের বিষয় নান্দনিকতাকে আশ্রয় করেই নির্মাণ করেন। রেখার চলাচলের সঙ্গে চিত্রতলের সহনীয় রঙের প্রয়োগ বিষয়কে ঋদ্ধ করে তুলেছে। এ-প্রদর্শনীর আরেকজন শিল্পী সৈয়দ মোহাম্মদ শামীম। তাঁর ছবির শিরোনাম ‘সার্চিং স্পেস’। ক্যানভাসে বড় স্পেস ছেড়ে দিয়ে দৃষ্টিননদন শিল্পনির্মাণের প্রতি আগ্রহ শামীমের কাজে দেখা যায়। গাঢ় নীল ও সাদা রঙের আস্তর দিয়ে বুনট সৃষ্টি করে একরকম আনন্দদায়ক ক্যানভাস গড়েছেন তিনি। মাহমুদুল ইসলাম বাবু স্যুরিয়ালিস্ট ধারায় ছবি অাঁকেন। তাঁর কাজগুলোতে ঘোড়ার শক্তিমত্তাকে চোঙ আকৃতির মাঝে বন্দি করে দেখিয়েছেন। প্রাণীকুলের দুরন্ত গতি অদম্য। এমন গতিকে অতিমাত্রায় রূপ দিয়ে বাবু ক্যানভাসে সমাপ্ত করেন। এ-প্রদর্শনীর শিল্পী আফরোজা জামিল কংকার বিষয় মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা নারীর মুখ। নারীর বিধ্বস্ত মুখের সামনে একদল কাকের উপস্থিতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীভৎস সময়কে মনে করায়। মো. আবদুল আজিজ প্রাচ্যরীতির শিল্পী। জলরঙের ধোয়ায় তাঁর ক্যানভাস গড়ে ওঠে। বিষয়, নারী ও প্রকৃতি। নারীর মায়াবী মুখের সঙ্গে উলম্ব ও আড়াআড়ি রেখায় বিষয়ে বিভক্তি টেনেছেন। জলরঙের ধোয়াপদ্ধতির দক্ষতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আজিজের কাজে। বাংলাদেশের আশির দশক-পরবর্তীকালের কাজের ধারাবাহিক অঙ্কনরীতির সঙ্গে পাকিস্তানের সমকালীন শিল্পদের শিল্পকর্মের পার্থক্য নিরূপণ সহজ হবে প্রদর্শনীর কাজ দেখে। পাকিস্তানের মনসুর রাহী ২০১০ সালে এঁকেছেন ‘কম্পোজিশন উইথ ফিগার’ ছবিটি। আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা নারী ফিগার জ্যামিতিক আকৃতিতে বিভক্ত। দাঁড়িয়ে-থাকা অবয়ব অস্পষ্ট করে বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন। মনসুর রাহীর কাজে শীতল রঙের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। হাজিরা মনসুর এঁকেছেন ‘কালাসি গার্ল’ শিরোনামের ছবিটি। প্রাচ্যরীতিতে অাঁকা নারীর চোখমুখে টানটান রেখা প্রয়োগ করে নারীর কমনীয়তা তুলে এনেছেন। মোঘল চিত্রকলার ধরনে মনসুর শিল্পকর্ম গড়েন। মোঘল মিনিয়েচার ও রাজপ্রাসাদের দেয়ালে থাকা আলঙ্করি রীতি অনুসরণ করে তাঁর শিল্পকর্ম গড়ে ওঠে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে পাক-শিল্পীদের শিল্পকর্ম দর্শকদের মনে করায় ইউরোপীয় শিল্পকর্মের ধারা রেনোয়াঁর বাস্তবরীতির চিত্রকর্ম। আলো-ছায়ার বিপরীত উপস্থিতি কাজকে বাস্তবধর্মী করে তোলে। শিল্পী মারিয়াম রাসুল রেস্টুরেন্টের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের আলো-ছায়া হুবহু এঁকেছেন। এছাড়াও মুনিজাহ্ জানরাজ ও সুমাইয়া খানের কাজ স্বকীয়তার খোঁজ দেয়।
এথেনা গ্যালারির এ-প্রদর্শনীতে দুদেশের শিল্পীদের কাজ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভাবনার অবকাশ ছিল। শিল্পকর্ম শুধু প্রদর্শনকক্ষে প্রদর্শনীর ব্যবস্থাই শেষ কথা নয়। একটি গ্রহণযোগ্য আয়োজনই প্রদর্শনীকে সফল করে তোলে। আগামীর আয়োজনে এমন ভাবনার আশ্রয় নেবেন কর্তৃপক্ষ। প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২৫ অক্টোবর।