পোট্রেটটা তোমার কাছে থাক

অপূর্ব, কেমন আছ?
ফোনে কথাটা শুনে সে চমকে ওঠে। এই টোনে এই ঢংয়ে তাকে মাত্র দুজন ডাকত। এক. সাহিত্যিক আতিউর, দুই. মানসী। আতিউর সাহেবের বাড়ি কুষ্টিয়া। চোস্ত বাংলা বলতেন। তার মধ্যেও একটা শান্তিপুরি টান ছিল। তিনি মারা গেছেন তিন-চার বছর। তাহলে বাকি থাকে মানসী। কিন্তু কণ্ঠটা মেয়েলি নয়। পুরুষঘেঁষা। এটাই অপূর্বর সামনে দ্বিধা তৈরি করে। শেষে সে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ে। প্রত্যুত্তরে বলে, আমার কথা পরে, আগে তোমার কথা বলো?
আমার খবর ভালো। অপারেশন সাকসেসফুল। তাই তোমাদের সবাইকে দেখতে চলে এলাম। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।
আরে, তোমার হয়েছিল কী? তাই তো জানি না! তখনো শিওর হতে পারেনি অপূর্ব, কথার পিঠে কথা জুড়ে চলে।
কেন, তুমি জানতে না? দিদি তো গত বছর ঘুরে গেছে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি? দিদি যে এসেছিল তা-ও তো জানি না! দিদিকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলাম, ও মনে হয় করিমদার সঙ্গেই সময় কাটিয়েছে, তোমার খোঁজ নেবার সময় পায়নি।
মিতালিদি আমার সঙ্গে দেখা করল না? এখন অপূর্ব মানসীকে ঠিক ঠিক ধরেছে। কিন্তু তুমি তো সুন্দর গান গাইতে, তোমার কণ্ঠ এত ভারি হলো কী করে? কী করে আবার, কেমো দিতে হলো … সব চুল পড়ে গেল … এখন অবশ্য আবার সব উঠেছে। বাঁদিকের ব্রেস্টটা রিমুভ করতে হলো। নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটির চাকরিটা আগে আগে না ছাড়লে পারতাম। অবশ্য অগ্রিম অবসর নিয়ে পেনশনের টাকায় চিকিৎসা করলাম।
তোমার স্বামীর খবর কী?
ও, তুমি জানো না! বছর দুয়েক হলো ও মারা গেছে।
যোগাযোগ ছিন্ন থাকলে কী করে জানব? কী হয়েছিল?
ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। হসপিটালে নেবার আগেই শেষ হয়ে গেছে।
তোমার অসুখটা কি ও দেখে গেছে?
হ্যাঁ। এটা শোনার পরই ওর অ্যাটাকটা হয়।
জীবন কেমন দেখো, অসুখ হলো তোমার, আর মারা গেল ও।
হ্যাঁ। জীবনের কোনো যুক্তিযুক্ততা নেই। এখানে উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়েই পড়ে বেশি।
যা বলেছ।
দেখো না, অসুখের কথা শুনে আমি ভেঙে পড়লাম না, ও একেবারে চলেই গেল।
তুমি তো শারীরিক-মানসিক দুদিক দিয়ে চাপে পড়ে গেলে!
কী আর করব। জীবন তো সবকিছু করিয়ে নেয়।
মেয়েরা কোথায়?
একজন দিল্লিতে। আর একজন কলকাতায়। তুমি আমাদের পাম প্লেসের বাড়িটা তো চেনো … ওটা বিক্রি হয়ে গেছে। ওর পাশেই একটা ভাড়াটে বাড়িতে থাকে ছোট মেয়ে আর জামাই। ওরা দুজন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে।
জামাইয়ের বাড়ি কোথায়?
বাঁকুড়া। ভালো ছেলে। প্রগ্রেসিভ।
আর বড় মেয়ে?
ও এখনো বিয়ে করেনি।
কেন?
ব্যক্তিগত ইচ্ছা। আমি জোর করি না। হয়তো স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে … হ্যাঁ শোনো, বেশিদিন থাকব না। আজকেই তোমার বাসায় আসতে চাই। বাসায় আছো?
হ্যাঁ। গাড়ি পাঠাব?
না। কাকাতোভাইয়ের ভাড়াটে বাসায় উঠেছি, নয়াপল্টন। ওর গাড়ি আছে। তোমার ঠিকানা আগেই জোগাড় করেছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছব।
আরে তুমি তৈরি হও। আমি চলে আসছি। তাহলে আরো কিছুটা সময় তোমার সঙ্গে থাকতে পারছি।
আচ্ছা, এসো।
দশ মিনিটের মধ্যে অপূর্ব নয়াপল্টনের বাড়িতে হাজির।
চারতলায় দরজা খোলে এক সুশ্রী মেয়ে।
আসুন আঙ্কল … আমি তাপসী, মানসী আমার পিসি।
তাই! কী পড়ছ?
আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বোটানিতে অনার্স পড়ছি … সেকেন্ড ইয়ার।
এই সময় শাড়ি হাতে মানসীর প্রবেশ।
আরে অপূর্ব! বলে দুজন হাত মেলায়। কেউ হাত ছাড়ে না।
তুমি একটু ভারি হয়েছো। বলে মানসী।
বয়স কি কম হলো?
অপূর্ব মানসীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। উজ্জ্বল শ্যামলা ছিল মানসী। এখন কেমন একটা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। সারামুখে বিষণœতা। দীর্ঘ চুল ছিল … এখন ববছাঁট। গালটা শীর্ণ দেখাচ্ছে।
মানসী মনে হয় অপূর্বর মন পড়ে ফেলে।
কি, আমাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে?
না, তা নয়। কণ্ঠটা বড় ভারি হয়ে গেছে।
এমনিতে জানো তো হরমোনাল পরিবর্তন হলে বয়সকালে মেয়েদের কণ্ঠ ভারি হয়ে যায় … তারপর অসুখ থেকে উঠলাম। নাও, তুমি বসো। এসে যখন পড়েছো স্নানটা সেরে নিই চট করে। কাকিমা কেমন আছেন?
ভালো। তবে হাঁটুর প্রবলেম …
ও বয়সকালে ওটা হবেই … ওঁর শরীর তো বেশ ভারি …
হ্যাঁ।
মানসীর প্রস্থান। তাপসী পিসির জায়গা নেয়।
আপনার বাসা কোথায় আঙ্কল?
এই তো রাজারবাগ।
তাহলে তো খুবই কাছে।
মাঝখানে শুধু পুলিশ ব্যারাকটা।
আপনি একটু বসুন, আমি এখনি আসছি। অপূর্ব খবরের কাগজ দেখতে থাকে।
পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত হবার আগেই তাপসী হাজির। হাতে ট্রে এবং চা-বিস্কুট সাজানো।
এগুলো কেন করতে গেলে?
প্রথম দিন এলেন। পিসির মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি। বাবার মুখেও শুনেছি। একসময় আমাদের ওয়ারীর বাড়িতে আপনি নাকি রোজ আসতেন। ছোট পিসির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
হ্যাঁ। তারপর তোমার পিসি কলকাতা পড়তে চলে গেল।
চলে গেল, না সরিয়ে দেওয়া হলো! বলে তাপসী গম্ভীর হয়ে যায়।
পাড়ার ছেলেপিলে পিছু লেগে গিয়েছিল … জানো, আমি তোমার পিসির একটা পোর্ট্রেট করেছিলাম। ফটো দেখে নয়, একেবারে সামনাসামনি সিটিং দিয়ে বসিয়ে।
তাই?
হ্যাঁ।
পোর্ট্রেটটা কোথায়?
আমি তোমার পিসিকে ওটা দিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। প্রথমদিকে ও চেয়েও ছিল। পরে কলকাতা যাবার সময় মত বদলে ফেলল। বলল, ওটা তোমার কাছে রেখে দাও। আমি ভাবলাম, কলকাতা নিয়ে যেতে অসুবিধে হবে। খুব ছোট সাইজ … দেড় বাই এক ফুট। নিতে কোনো অসুবিধে হতো না। কেন জানি ও নিল না। আমি খুব সুন্দর করে প্যাক করেছিলাম।
আপনার বাসায় তো একদিন যেতে হয় পোর্ট্রেটটা দেখতে!
তা আসতে পারো।
এখন তো পিসি এসে গেছে। আজকে যাওয়া যাবে না। পিসিকে রাজি করিয়ে আর একদিন যাব।
ঠিক আছে।
খানিক পর মানসী হাজির। হালকা নীল রঙের শাড়িতে ওর বিষণœতাটা কিছুটা কেটেছে। মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলে, চলো বেরোই।
তাপসী, দেখা হবে। চলি।
আবার আসবেন। আঙ্কল।
আচ্ছা।
গাড়িতে উঠে মানসী বলল, এমন একটা গাড়ি কেনার খুব শখ ছিল সুবীরের। আমি অসুস্থ হলাম ও চলে গেল, গাড়ি কেনা আর হলো না।
ঢাকায় চলে এসো, গাড়ি কিনতে হবে না।
হ্যাঁ, এরপর বেশিদিনের জন্যে আসব। এবার ঝাটিকা সফর দিলাম।
একটা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছে অপূর্ব। তার মনের মধ্যে পুরনো দিনগুলো ফিরতে শুরু করে। কখন যে মানসীর ডান হাতখানা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে খেয়াল করেনি। সদ্যস্নাত শীতল হাত ক্রমে উষ্ণতা ছড়ায়। তবে মনে পড়ে, আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে সে চারুকলায় তার কক্ষে মানসীকে সিটিং দিইয়ে পোর্ট্রেটটা করে। বেশ কয়েকদিন সিটিং দিতে হয়। ছুটির দিন ছাড়া সম্ভব ছিল না। বিভাগের পিয়নটিকে আসতে বলে দিত চা-নাস্তার তদারকির জন্যে।
মানসী সিটিংয়ের মাঝে নড়াচড়া করত।
ধমক দিত অপূর্ব।
নড়াচড়া চলবে না।
আমি একনাগাড়ে এতক্ষণ বসতে পারব না।
তাহলে পোর্ট্রেট হবে না।
মানসী আর কথা বলত না। ওর এই দুর্বলতাটা ধরে ফেলে অপূর্ব। তাই উসখুস করলেই ও আঁকা বন্ধ করত। বলত, আজ আর আঁকব না। কনসেনট্রেশনটা নষ্ট হচ্ছে। মানসী আবার স্থির হতো।
মাঝে থাকত টি-ব্রেক। আধঘণ্টা। খুনসুটিতে সময় কখন যে কেটে যেত।
দুপুরে ওদের প্রিয় জায়গা ছিল বলাকা বিল্ডিং। হালকা চায়নিজ খেয়ে ঢুকত ম্যাটিনি শোতে। বলাকায় খুব ভালো ভালো সব বিদেশি ফিল্ম আসত। রক হাডসন ছিল মানসীর প্রিয় তারকা।
সিনেমা চলার মাঝেই মানসীর কমেন্ট চলত।
দেখেছ, কি হ্যান্ডসাম মানুষ!
তা ঠিক। তোমার একজন বিদেশি বিয়ে করা উচিত।
কি, হিংসা হচ্ছে?
তা কিছুটা তো হচ্ছেই।
হিংসা হওয়া ভালো। মানুষটাকে বোঝা যায় যে স্বাভাবিক। সাধু-সন্ত নয়।
সাধু-সন্ত তো আগে হয় না, আঘাত খেয়ে হয়।
এটা অবশ্য তর্কের বিষয়।
ওখান থেকে বেরিয়ে অনেক সময় ওরা ঢুকত রমনা রেস্টুরেন্টে। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা … লেকের ওপর ব্যালকনিতে জনসমাগম বাড়লে ওরা উঠে পড়ত।
অল্প দূরত্ব বলে কল্পনার দৌড় বেশিদূর এগোল না। গাড়ি অপূর্বদের বাড়িতে পৌঁছে গেল।
ছোট বাড়ি অপূর্বদের। তিনতলা। দোতলায় মায়ের কাছে গিয়ে বসে তারা।
মা মানসীর পরিচয় পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। বাতের রোগী। কিন্তু মনে হলো কোনো অসুখ নেই।
বুঝলে মা মানসী, তোমার বাবা ছিলেন ধন্বন্তরি। তোমার কাকা আর তোমার বাবা এমন ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে একেবারে রাম-লক্ষ্মণ সম্পর্ক। তোমার বাবা চলে যাওয়ায় আমরা একেবারে অসহায় বোধ করি। মজুমদারদা বাড়িতে এলেই সব রোগ দূর হয়ে যেত।
বাবা তো দেশ ছাড়তে চাননি, কিন্তু বাড়ি যখন আক্রান্ত হলো তখন সবাই মিলে পাহারা দিয়ে বাঁচাল, কিন্তু থাকতে নিষেধ করল। বাবা তারপরও যেতে চাননি, কিন্তু কেউ ভরসা দিতে পারল না। অগত্যা …
জলপাইগুড়িতে লোকজন নিশ্চয় দাদাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল?
তা আর বলতে! বাবা ছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের গোল্ডমেডেলিস্ট স্টুডেন্ট, কত লোককে দেখেছি কলকাতা থেকে ঢাকায় বাবার কাছে আসতেন।
তুমি কদিন আছো মা?
কাকিমা, আর মাত্র দুদিন।
আচ্ছা বসো। বলে অপূর্বর মা উঠে গেলেন।
খানিক পর খাবার-দাবার এলো। অপূর্বর মায়ের হাতে একটা হালকা নীল রঙের ঢাকাই জামদানি।
নাও, এটা রাখো।
এটা আবার কেন কাকিমা!
আরে তুমি মজুমদার দাদার মেয়ে, তোমাকে এটুকু উপহার দিয়ে তোমার বাবার কথাই মনে করছি …
মানসী উঠে গিয়ে অপূর্বর মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।
থাক থাক মা। বেঁচে থাকো।
বেশিদিন বাঁচব না কাকিমা।
অমন করে বলছ কেন?
মানসী সোফায় বলে বলল, অপূর্ব কিছু বলেনি!
না তো!
আমি তো ক্যান্সার পেশেন্ট! তবে মোটামুটি সেরে উঠেছি।
ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন মা। তোমার বাবা সবাইকে নিরাময় করতেন আর ভগবান কি না তার মেয়েকেই কঠোর রোগ দিলেন।
কপাল কাকিমা। এসবে বিশ্বাস নেই, কিন্তু এমনভাবে সব ঘটনা ঘটে যে মানুষ নিজের বোধ-বুদ্ধির ওপর আস্থা রাখতে পারে না।
আচ্ছা, তোমার বাবা ওখানে গিয়ে মন বসাতে পেরেছিলেন?
কাজের মধ্যে ছিলেন তো, তাই আমরা অতটা বুঝতে পারতাম না, কিন্তু মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা প্রায়ই রাতে দেশের জন্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন এবং স্বগতোক্তি করতেন … বিড়বিড় করে কী সব বলতেন।
আচ্ছা, তোমার বাবাকে নাকি বাংলাদেশ সরকার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল?
হ্যাঁ। সে অনেক ঘটনা কাকিমা।
দাদা কি আসতে চাননি?
না কাকিমা, বাবা আসার জন্যে সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কেমন করে জানি স্থানীয় একজন ব্যাপারটা জানতে পারে। বাবা বাড়ি থেকে বেরোবার আগেই শয়ে শয়ে লোক বাড়ির চারদিকে জড়ো হয়। আর তাদের মিনতি, আপনি চলে গেলে আমরা সব এতিম হয়ে যাব।
অনেক অনুনয় করেও বাবা মুক্ত হতে পারেননি। তিনি এ-ও বলেছিলেন যে, ছ-মাস পরপর তিনি দু-মাস একনাগাড়ে চিকিৎসা করে যাবেন। তারপরও অনেকে কান্না জুড়ে দেয়। বাবা শেষ পর্যন্ত বাধ্য হন মত বদলাতে। সে এক নাটক।
ঠিক বলেছ। নাটকটা আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।
এরপর থেকে বাবা কেমন নীরব হয়ে গেলেন। কথাবার্তা খুব কম বলতেন। দিন দিন শরীরটাও শুকিয়ে যেতে লাগল। সাতাশি বছর বাঁচলেন, কিন্তু সেই ভারি চেহারা শেষের দিকে একেবারে শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
দেশভাগ একটা বালাই গো মা।
ঠিক বলেছেন কাকিমা। আমি বাবার মুখে শুনেছি, রহমান কাকাবাবু তো পাকিস্তান তৈরির বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করে কলকাতায় মার খেয়েছিলেন।
হ্যাঁ। তোমরা কথা বলো মা, আমি একটু স্নানে ঢুকব।
ঠিক আছে কাকিমা।
অপূর্ব মানসীকে নিয়ে নিজের শোবারঘরে ঢোকে।
মানসী বিছানায় বসে সবকিছু দেখতে থাকে। বলে, অপূর্ব, তুমি ঠিক আগের মতোই আছো। সবকিছু সাজানো-গোছানো।
বেডরুমটা তো আর স্টুডিও নয়। তাই চেষ্টা করি অগোছালো না রাখতে। চোখ যাতে পীড়িত না হয়।
আচ্ছা, আমার ছবিটা কোথায়?
ওটা আলমারিতে র‌্যাপ করা আছে। নিয়ে যাবে নাকি?
না, কাকিমার সামনে দিয়ে নিতে চাই না। পরে তাপসীকে বলব নিয়ে যেতে।
ঠিক আছে।
একটা মজার ব্যাপার জানো অপূর্ব, ঢাকায় সবাই আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলে, তুমি আগে কী সুন্দর আছিলা … কিন্তু আমি যে আগে ভালো ছাত্রী ছিলাম, ভালো নাচতাম, সেটা কেউ জিজ্ঞেস করে না।
মানুষের ভেতরটা কে দেখে বলো! সবাই তো দেখে বাইরেটা।
একদম। সত্যি বলো তো, আমাকে খুব কি অসুন্দর লাগছে?
এটা তো নির্ভর করে কার চোখ দিয়ে কে দেখছে।
হুঁ, এড়িয়ে যাচ্ছ!
একদম না। আমার চোখে তুমি সবসময় সুন্দর।
হ্যাঁ, কথা ভালো রপ্ত করেছ। কাকিমাও এত সুন্দর করে কথা বলেন…
ওর বাড়ি তো হাওড়া, হবে না!
কিন্তু কথা বলেন তো একেবারে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের বাংলায়।
সে তো হতেই হবে। মা তো শরৎচন্দ্রের বাড়ি হুগলির বউ। আবার ছোটবেলায় মা লেখাপড়া করেছেন কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়ালে …
ওরে বাবা, হাওড়া-হুগলি-কলকাতা …
শুধু নদিয়াটা বাদ পড়ে গেছে।
একদম।
মায়ের স্নান সারা হয়ে যাবার পর মানসী বিদায় নেয়। অপূর্ব পোর্ট্রেটটার কথা আর একবার মানসীকে বলেছিল, কিন্তু মানসী অসম্মতি জানায়। বলে, পরে তাপসী এসে একসময় নিয়ে যাবে।
মানসী চলে যাবার পর বেশ কয়েকদিন অপূর্ব তাপসীকে আশা করেছিল, কিন্তু, আসেনি। দেখতে দেখতে সে-ও পোর্ট্রেটটার কথা ভুলে যায়।
এক বছর পর অপূর্ব শাহবাগে বেলা এগারোটায় জাদুঘরে প্রবেশের জন্যে টিকিট কাটতে যাচ্ছে এমন সময় মোবাইলে ফোন নম্বরটা দেখে বুকটা ধক্ করে ওঠে। মানসীর ফোন।
ভরাট গলায় মানসী বলল, অপূর্ব, বিদেশে তোমার বোনের মৃত্যুর খবর শুনেছি। গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। তুমি কেমন আছো?
শরীর একরকম। মনটা ভালো নেই। একমাত্র বোন। বয়সে অনেক ছোট। তোমার শরীর কেমন?
ভালো নেই। ব্যাধিটা এখন বক্ষ থেকে কোলোনকে আক্রমণ করেছে।
তুমি এখন কোথায়?
আমি দিল্লিতে।
মাসদুয়েক পর কলকাতা যাবো। তুমি কি ও-সময় এদিকে থাকবে!
না। চিকিৎসার জন্যে আমাকে এখন বেশ কিছুদিন এখানে থাকতে হবে।
আচ্ছা, তোমার পোর্ট্রেটটা নিতে তাপসী তো এলো না!
এ-কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মানসী বলে, আমার পিএইচ.ডি থিসিসটা হলো গুপ্তযুগের বাংলা। তোমাদের ওখান থেকে ওটা ছাপানো যায়? ব্যবস্থা নিতে পারবে?
তুমি পাঠিয়ে দাও, আমি চেষ্টা করব। আর পোর্ট্রেটটা?
আমি তাপসীকে বলে দেবো ও-যাতে তোমার কাছে না যায়।
মানে?
পোর্ট্রেটটা তোমার কাছে থাক।