আনিসুল হক
৬২ বছর বয়সে ডাক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন সাহেব আবিষ্কার করলেন, বালিকা রতন আর বালিকা নেই, রমণী হয়ে গেছে। এটা আবিষ্কার করবার জন্য তাকে সেই অপরাহ্ণের জন্য অপেক্ষা করতে হলো, যখন তিনি দোরঘণ্টি বাজিয়ে নিজবাড়ির দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন, আর রতন স্নানঘরে ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছিল, হঠাৎ কলবেল বেজে ওঠায় তড়িঘড়ি করে একটা জামা গায়ে চাপিয়ে সে ছুটে এসেছিল, ভেজা গায়ে পাতলা জামা ভেদ করে তার কিশোরী শরীর দুধে ভেজা পাউরুটির মতো ফুলে উঠেছিল এবং পোস্টমাস্টার জেনারেল আবুল হোসেনের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। কে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার গৃহপরিচারিকা রতন, নাকি কোনো অপ্সরী, আবুল হোসেন সাহেবের ধন্দ লেগেছিল। আজ থেকে আট বছর আগে আট বছর বয়সী রতন এ-বাড়িতে এসেছিল, তখন শামীমাও এ-বাড়িতেই থাকতেন। ৫৪ বছরের ডাক-কর্মকর্তা আবুল হোসেন এই নবাগতা গৃহকর্মী রতনকে নিতান্ত শিশু ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি। তিনি শামীমাকে বলেছিলেন, ‘এই বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়ে ঘরের কাজ করানো কি ঠিক হবে? এটা কি শিশুশ্রম হয়ে যায় না?’ শামীমা বলেছিলেন, ‘শোনো, ময়লার ঝুড়িটা নিয়ে বের হবে, রাস্তার ডাস্টবিনে তুমি ফেলবে, আমি রতনকে দিয়ে এ-কাজ করাব না। শিশুশ্রম একটু কম কম হোক।’ ওই একদিনই বিবেকের তাড়না বোধ করেছিলেন আবুল হোসেন সাহেব, এরপরে আট বছরের শিশুটি যে তাদের বাসায় রয়ে গেল, মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে ঘুমায়, এটা-ওটা কাজ করে, মেঝেতে পিঁড়ি পেতে বসে ভাত খায়, সেটা তার কাছে হয়ে গেল একটা স্বাভাবিক দৃশ্য। একটা ছুটা বুয়াও ছিল, সকালে এসে ঘরদোর ঝাড়মোছ করত, কাপড়চোপড় ধুয়ে দিয়ে যেত।
বছরছয়েক আগে, আবুল হোসেনের বয়স তখন ৫৬, আর হিসাব করলেই বেরিয়ে আসে যে, রতনের বয়স তখন ১০, শামীমা আমেরিকা চলে যান। আমেরিকায় তার একমাত্র ছেলে মিল্টন আছে, লস অ্যাঞ্জেলেসে, মিল্টনের বউয়ের বাচ্চা হয়েছে, তাকে দেখভাল করার কেউ নেই। কাজেই ‘মা আসো মা আসো’ বলে মিল্টন, আর ‘মা আসেন মা আসেন’ বলে মিল্টনের বউ সাবরিনা শামীমার কান ঝালাপালা করে ফেলতে থাকলে শামীমা ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়ান এবং একদিন ভিসা পেয়ে গেলে শামীমা স্বামীকে বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম ভিসা পাব না, কতজনই তো ভিসা পায় না, তাই ভেবেছিলাম আমারটাও হবে না, আমার আমেরিকা যাওয়াও লাগবে না; এখন ভিসা হয়ে গেছে, এখন আমি কী করি?’ কী আর করবেন শামীমা, আমেরিকা চলে যান নাতির মুখ-দর্শনের জন্য। বলে যান, ‘চিন্তা করো না, বুয়া আসবে সকাল-বিকাল, আমি বুয়াকে বলে যাচ্ছি, আর রতন তো রইলই। ও এখন অনেক কাজ পারে, তোমাকে চা করে দিতে পারবে, লাগলে ভাতও রাঁধতে পারবে, খুব সুন্দর ডাল রাঁধে জানো!’
সেই থেকে শ্যাওড়াপাড়ার এই দোতলার বাসার দোতলায় আবুল হোসেন সাহেব একাই থাকেন। আর সঙ্গে থাকে বালিকা রতন। এক মাসের জন্য গিয়েছিলেন শামীমা, আজ ছয় বছর, তিনি আর ফিরে আসেননি। রতনটাও যে বড় হয়ে গেছে, সেটাও আবুল হোসেন সাহেব বুঝতে পারেননি।
কিন্তু একদিন, খুবই হঠাৎ করেই, পেনশনের টাকা তুলে বেলা ৩টার দিকে বাসায় ফিরে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দোরঘণ্টি বাজিয়ে সামনে একটা অপ্সরা, তার সাদা ভেজা জামা, আর জামার আড়ালে স্তনাভাস, কালো ঘের, বৃন্ত-উন্নতি ইত্যাদি তাকে এক নতুন উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়।
তিনি বুঝতে পারেন, তার শরীর শিরশির করছে।
কিন্তু বালিকা রতন রমণীর স্থান অধিকার করলেও জননীর স্থান অধিকার করে না। কারণ আবুল হোসেন সাহেবের জ্বর আসে না। তার ললাট তপ্ত হয় না, কাজেই শাঁখাপরা হাতের স্পর্শ পাওয়ার প্রয়োজন হয় না। ঘটনা ঘটে উলটো। রতনেরই একদিন জ্বরজ্বর লাগে, প্রথমে হাঁচি আর পরে সে কাশি দিতে থাকে, তখন সে দুপুরবেলায় মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে, আর অনেকক্ষণ পড়ে থাকে, রোদ মরে আসে পশ্চিমের জানালায়, তবু সে ওঠে না। তখন আবুল হোসেন সাহেবই রতনের কাছে যান, রতনের শয্যাপাশে মেঝেতে বসেন, হাত দিয়ে রতনের কপালের জ্বর অনুভব করার চেষ্টা করেন, রতন চোখ মেলে না, অস্ফুট স্বরে বলে, নানা…
আবুল হোসেন সাহেব প্রথমে কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপেন, তারপর রতনের গলায় হাত দেন, এখানে তাপ আরেকটু বেশি, তারপর জামার ভেতরে হাত দিয়ে দেখেন, সেখানটা একেবারে গরম ভাতের হাঁড়ির মতো গরম, তিনি হাতটা রতনের একটা স্তনের ওপরে রেখে দেন, তার মনে হয়, তার হাতের মধ্যে একটা কবুতরের বুক কাঁপছে। তারপর হুঁশ হলে তিনি ছুটে যান প্যারাসিটামল কেনার জন্য।
আবুল হোসেন খুব যতœ করেন রতনের। রতনকে এমনকি ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে স্পঞ্জ পর্যন্ত করে দেন। তারপর তাকে বলেন, এই জ্বর নিয়ে তোকে আর মেঝেতে শুতে হবে না, তুই আমার সঙ্গে আমার ঘরে শো, না হলে কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটরের লাইন এইখানে থাকবে না, জ্বরের মধ্যে তোর কষ্ট হবে।
রতন আবুল হোসেন সাহেবের শোবার ঘরের মেঝেতে নিজের জায়গা করে নেয়। জ্বর সেরে গেলে প্রায় প্রতিদিনই আধঘণ্টার জন্য আবুল হোসেন সাহেবের বিছানাতেও তার জায়গা হতে থাকে। আবুল হোসেন সাহেবকে এই সময় জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজটা করতে হয়। স্ত্রী বিদেশে থাকা অবস্থাতেও একটা পুরো বাক্স কনডম কিনে আনতে হয়। ওষুধের দোকানের ছেলেটা অবশ্য কোনো প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন যাতে সে না করতে পারে সেজন্যেই তিনি তার বাসা থেকে দূরবর্তী একটা অপরিচিত দোকানেই গমন করেন।
রতন তার নতুন মর্যাদা ভীষণ উপভোগ করে। কাজের বুয়াটা বদলে গেছে, নতুন বুয়াটা আরো বৃদ্ধা, তাই তার কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই এ-বাড়িতে, যেটা কিনা রতনের আছে। নানা তাকে কানের দুল কিনে দিয়েছেন, তাকে শাড়ি কিনে দেন, তার জন্য ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি কিনে আনেন, এমনকি তার পিঠে ব্যথার কথা জানতে পেরে পিঠও টিপে দেন।
আবুল হোসেন সাহেবও ৬২ বছর বয়সে ১৬ বছরের কিশোরীর প্রেমে পড়ে আকাশে উড়তে থাকেন। তার দিনরাত্রিগুলো রতনময় হয়ে ওঠে।
শামীমা যে ফিরতে পারেন না, সেটা তার নিজের ইচ্ছায় নয়। মিল্টন তার পাসপোর্ট আটকে রাখে, এবং বারবার করে তার ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করে এবং সফল হয়। শামীমা প্রতি রোববার রাতে ঢাকায় ফোন করেন এবং খোঁজখবর নেন। স্বামীকে কতদিন দেখেন না তিনি, তার খুব কান্না পায় এবং ফোনে তিনি কান্নাকাটিও করেন। তিনি বলেন, মিল্টন বলেছে, তার মেয়েটাকে স্কুলে দিলেই আমার ঢাকা যাওয়ার টিকিট করে দেবে। আর তিন মাস।
আবুল হোসেন মনে মনে বলেন, সাবরিনার আরেকটা বাচ্চা হোক, শামীমা আরো অনেকদিন থাকুক আমেরিকাতেই, রতনকে নিয়ে রিটায়ার্ড পোস্টমাস্টার জেনারেল মহাসুখে আছেন। এমনকি তিনি একদিন ভায়াগ্রা কিনে এনে তার সিকিভাগ খেয়েও দেখেছেন। জীবনটা বড়ই সুখেই যাচ্ছে।
সুখ চিরস্থায়ী হয় না। শামীমা ফিরে আসেন। রতন আবার ডাইনিং রুমের মেঝের দিনগুলোয় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আর আবুল হোসেন রাতের বেলা ঘুম ভাঙলে দেখেন একজন মোটা বৃদ্ধা চিৎ হয়ে মৃত তেলাপোকার মতো তার পাশে শুয়ে আছে। তিনি অস্থির বোধ করেন।
প্রেম এমন একটা জিনিস, যা গোপন করে রাখা যায় না। রতনের সঙ্গে আবুল হোসেনের পরিণয়টা শামীমা অচিরেই আবিষ্কার করে ফেলেন এবং কান্নাকাটি করতে থাকেন। আবুল হোসেন বাথরুমে গিয়ে রতনের জন্য অশ্র“ বিসর্জন করেন। সেটা শামীমা টের পান না। কিন্তু রতনের ট্রাংক খুলে শাড়ি-গয়নার বাহার দেখে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। মোটা মানুষ! পড়ে যাওয়ার শব্দটা এত জোরে হয় যে, নিচতলার ভাড়াটের বউ পর্যন্ত দৌড়ে আসে দোতলায় কী ঘটল তা জানার জন্য।
এ পর্যন্তও হয়তো সহ্য হতো। একদিন রাত ৩টায় ঘুম ভেঙে গেলে শামীমা দেখেন তার পাশে তার স্বামীধন নেই, তিনি বিছানা ছাড়েন, রান্নাঘরের দিকে যান, এবং দেখতে পান, ডাইনিং স্পেসের মেঝেতে অর্ধনগ্ন আবুল হোসেন ও রতন বিভোর হয়ে গলা জড়াজড়ি করে ঘুমুচ্ছে।
তিনি রতনকে পরের দিন সকালবেলা পত্রপাঠ বিদায় করেন।
আবুল হোসেন প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। তিনি চুপচাপ বসে থাকেন। এবং খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করেন। তার মনে হয়, যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে নিয়ে আসি। তখন ফ্যানের বাতাসে তার মনে একটা চিরপুরাতন তত্ত্ব উদিত হয়। তিনি নিজেকে বলেন, গিয়া ফল কী? জগতে কে কাহার?
কিন্তু রতন এত সহজেই দমিত হয় না। সে তার নানাকে ভীষণ ভালোবাসে। নানাকে কতদিন দেখি না, তিনদিনের দিনই তার মনে এ-হাহাকার তীব্রভাবে দেখা দেয়। সে নানাকে ফোন করে। নানা তখন রতনের নানির সামনে। তিনি ফোন কেটে দেন। পরে তিনি আবারো বাথরুমে গমন করেন এবং কমোডের ওপরে বসে সর্বশেষ আসা নম্বরটায় কল করেন।
‘হ্যালো নানা!’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কেমন আছেন?’
‘খুব খারাপ! তোর জন্য মনটা পোড়ে। তুই কেমন আছিস?’
‘নানা, আপনারে ছাড়া আমি বাঁচুম না।’ মোবাইল ফোনে রতনের কান্না শোনা যায়।
‘তুই এখন রাখ। তোর নানি আছে।’
আবুল হোসেন সাহেব ঘেমে-নেয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসেন।
তারা গোপনে গোপনে কথা বলা ও এসএমএস চালাচালি করতে থাকেন। রতন অশিক্ষিত হলেও কীভাবে টেক্সট মেসেজ পাঠাতে সক্ষম হয়, তা সে জানে।
কিন্তু এইখানে, প্রিয় পাঠক, আমরা একবার শামীমার কথাটাও ভাবিব। শামীমা বড় আশা করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছিল স্বামীর নিকট। আমেরিকার দিবস-রজনীগুলি তাহার নিকট বিষবৎ বোধ হইত। সারাদিন ওই অচেনা-অজানা পরিবেশে একা একা থাকা তাহার অসহ্য বোধ হইত। মিল্টনের ছেলে আসওয়াদ ও মেয়ে আবরিনা একটু বড় হইলে পরে তবু তাহাদের লইয়াই ব্যতিব্যস্ত থাকা যাইত। তাহা সত্ত্বেও শামীমার নিকট নিজেকে কাজের মেয়ে ছাড়া আর বেশি কিছু মনে হয় নাই। বহুদিন মনে হইয়াছে, তিনি নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন করিবেন, পুলিশ আসিলে তিনি বলিবেন, তিনি বন্দিনী, তাহার মুক্তির একটা ব্যবস্থা পুলিশ করিয়া দিক। আমেরিকায় বহু বছর থাকিয়া তিনি নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন করিবার মতো কেতাও কিছু শিখিয়া ফেলিয়াছিলেন। তিনি সর্বদা স্বপ্ন দেখিতেন, দেশে ফিরিয়া যাইবেন, নিজের সংসারের হাল ধরিবেন। এইখানে পুত্রবধূর সংসার তাহার কাছে কারাগারের মতো মনে হইত।
আমেরিকায় পুত্রের বাটিতে নিজেকে তাহার মনে হইত ক্রীতদাসী, আর এখন এইখানে নিজের সংসারে ফিরিয়া আসিয়া তাহার মনে হইল, তাহার জীবন দাসীরও অধম। একজন দাসীর যাহা আছে, তাহা তাহার নাই। যৌবনই কি তাহা হইলে নারীর একমাত্র সহায়। যৌবন নাই তো নারীর কিছুই নাই?
অতঃপর শামীমা ও তাহার স্বামী পোস্টমাস্টার জেনারেল (রিটায়ার্ড) আবুল হোসেন দুজনেই জায়নামাজে বসিয়া একই প্রার্থনা করিতেন, হে পরওয়ারদিগার, উহাকে তুলিয়া লহো। কতজনেই তো মরে। আমার স্বামী/স্ত্রী কেন মরে না?
আবুল হোসেন মারা গেলে বিষয়-সম্পত্তি যা আছে, তা দিয়ে শামীমার দিন ভালোই চলে যাবে, শামীমা হিসাব কষেন। শামীমা মারা গেলে রতনকে নিয়ে এসে আমি স্বর্গখেলনা রচনা করতে পারব, আবুল হোসেন আকাশকুসুম চয়ন করেন।
রতনের ফোন আসে। আবুল হোসেন সকালবেলা হাঁটতে গিয়ে কলটা রিসিভ করেন। রতন বলে, নানা, আমারে বিয়া করেন।
আবুল হোসেন জবাব দেন, সে কী করে হবে?
ব্যাপারটা যে কী কী কারণে অসম্ভব কিশোরীকে বোঝানোর প্রয়োজন তিনি বোধ করেন না। কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে তিনি পরিষ্কার, বাংলাদেশের আইনে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ করা অসম্ভব। একটা উপায় আছে, শামীমাকে ডিভোর্স দেওয়া। কিন্তু এ-বয়সে এসে মানী লোকের মান তো আর বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া চলে না।
কাজেই আবুল মোনাজাত করেন, হে আল্লাহ, শামীমারে তুলে নাও।
কাজেই শামীমা জায়নামাজে বসে কান্নাকাটি করেন, হে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, বুড়াটা মরে না কেন?
এই দুই প্রার্থনার মধ্যে আল্লাহতালা শামীমার প্রার্থনাটাই পূরণ করেন। কেন করেন, তা আমরা জানি না। আর আবুল হোসেনের মোনাজাত কেন তিনি পূর্ণ করেন না, তিনিই জানেন। বিধাতার লীলা আমাদের পক্ষে অনুধাবন করা সত্যিই কষ্টকর। তবে, আমাদের মনে হয়, আল্লাহ যা করেন ভালোই করেন। শামীমা আগে মারা গেলে আবুল হোসেন রতনকে ঘরে আনতেন। ঘরে আনলে রতন বিয়ের জন্য চাপ দিতে পারত। বলা যায় না, কনডম ফুটো করে পেটে বাচ্চা বাঁধিয়ে ফেলে শেষমেশ বিয়ের পিঁড়িতে বসতে আবুল হোসেনকে বাধ্য করেও ছাড়তে পারত।
আমরা রতনকে এ-কথা জিগ্যেস করি নাই, রতন হয়তো তার প্রিয় নানাকে ব্ল্যাকমেইল নাও করতে পারত। তবে প্রেমে ও যুদ্ধে নৈতিকতা বলতেও তো কিছু নাই।
আবুল হোসেন সকালবেলা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। শ্যাওড়াপাড়ার আকাশে ছিল কালো মেঘ, দোতলা বাড়ির পেছনের নিমগাছগুলো বাদল-বাতাসে মাথা দোলাচ্ছিল। সামনের বড় রাস্তায় পানি জমে গিয়েছিল।
রতন টেলিভিশনে একটা বাংলা সিনেমা দেখছিল তার বস্তিঘরে বসে। সিনেমার নাম বাবা কেন চাকর। ছবির নিচে স্ক্রলে হঠাৎ খবর ওঠে, সাবেক পোস্টমাস্টার জেনারেল আবুল হোসেন আজ সকালে হৃদরোগের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)।
রতনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তখন সত্যি সত্যি ভীষণ জোরে দেওয়া ডেকেও ওঠে। একহাঁটু পানি মাড়িয়ে রতন শ্যাওড়াপাড়ার ওই দোতলা বাড়ির দিকে রওনা হয়।
লাশ তখন বাড়ির নিচতলার গ্যারাজে রাখা হয়েছে। পাড়ার মসজিদ থেকে আনা খাটিয়ায় যে-চাদরটার নিচে আবুল হোসেন শুয়ে আছে, সে-চাদরটা রতনের খুব চেনা। আগরবাতি জ্বলছে। দু-একজন আত্মীয়স্বজন ও পাড়ার লোকজন ভিড় করতে শুরু করেছে। একটা আরএফএল প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে একটা অল্পবয়সী হুজুর দুলে দুলে কোরান শরিফ পাঠ করছে।
রতন চাদরটা সরিয়ে তার নানার শরীরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে বলতে থাকে, নানা, নানা, আপনি চইলা গেলেন, নানির জন্য বাড়ি রাইখা গেলেন, আমার লাইগা কী থুয়া গেলেন। আপনি যান, আমার দুঃখ নাই, খালি আমারে আপনার সাথে নিয়া যান। আমি আপনার সাথে কবরে যাইতে চাই।
নিচতলার ভাড়াটে কাশেম সাহেব রতনের ডানা ধরে তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। রতন বাধা মানতে চায় না। ‘আমি আমার নানার লগে যামু। আমি আমার নানার লগে যামু।’ রতন ডুকরে কেঁদে ওঠে।
কাশেম সাহেব চোখ মোছেন। আহারে, পোস্টমাস্টার সাব তার এই নাতনিটারে একেরে নিজের নাতনির মতোই আদর করত।
রতন ফিরে আসে। বৃষ্টি আরো বেড়ে গেছে। শ্যাওড়াপাড়ার রাস্তা জলে থইথই করছে। একটা রিকশা একটা ড্রেনে পড়ে কাত হয়ে গেছে, তার সিট সমান পানি।
কোমরপানি মাড়িয়ে রতন ফিরে আসে, তার মনে কোনো তত্ত্বের উদয় হয় কি-না, আমরা জানি না। আকাশে তখন বিজলি চমকায়। ইলেকট্রিক তারে কাক কা-কা করে ডেকে ওঠে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.