‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, সমাজ তাকে নারী বানায়।’ সিমোন দ্য বুভয়ারের এ-ভাষ্য চিরকালের নারী-পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিগত সমাজ মনস্তত্ত্বকে তুলে ধরে। যুগে যুগে কালে কালে পুরুষরা নারীকে যেমন প্রমোদ ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মনে করে এসেছে, তেমনি নারীদেরও তাদের অবস্থানের ব্যাপারে সজাগ হতে সময় লেগেছে। এমনই এক মনস্তত্ত্ব নিয়ে নাট্যদল থিয়েটারের নতুন প্রযোজনা পোহালে শর্বরী নাটকটি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে নানা বৈচিত্র্যমুখী নাটক মঞ্চায়িত হলেও নারীর আর্তনাদের আর প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি নাটকে খুব বেশি শোনা যায়নি। থিয়েটার নাট্যদল তাদের নতুন প্রযোজনা পোহালে শর্বরী নাটকে
নারী-অধিকারের কথা বলেছে। হিন্দি ভাষার নাট্যকার সুরেন্দ্র ভার্মার একটি নাটক বাংলায় পোহালে শর্বরী শিরোনামে অনুবাদ করেছেন অংশুমান ভৌমিক। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন রামেন্দু মজুমদার। সংযুক্ত নির্দেশনায় ছিলেন ত্রপা মজুমদার।
আজকের পৃথিবী যখন নারী-পুরুষের সম-অধিকারের দিকে এগিয়ে গেছে, তখন বাংলাদেশে নারী-পুরুষের পাশে সমমর্যাদায় দাঁড়াতে পারেনি। সমাজ-ধর্মের নানা আদেশ-নিষেধ কিংবা রীতির বেড়াজালে নারীরা আবদ্ধ ও মনোজাগতিক দাসত্বের শিকলে বাঁধা পড়েছে। মূলত এদেশে নারী অধিকার বলতে নারীর চাকরি করার অধিকারকে শুধু চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু যৌনতার অধিকারও যে নারীর অধিকার তা কখনো বলা হয়নি। এ-নাটকটি সেই জৈবিক ও মানবিক দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। নাট্যকার সুরেন্দ্র ভার্মা নারীকে নিছক সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মনে করতে চাননি। তিনি বলতে চেয়েছেন, নারীরও যৌন স্বাধীনতা রয়েছে। নারীরও চাওয়া-পাওয়া, উপভোগের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তবে তা নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নয়। হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজের নারীকেন্দ্রিক ট্যাবুকে তিনি ভাঙতে চেয়েছেন।
পোহালে শর্বরী নাটকটির হিন্দি নাম সুরয কি অন্তিম কিরণ সে সুরয কি পহেলি কিরণ তক। হিন্দি নামকরণের অর্থ দাঁড়ায় ‘গোধূলিলগ্ন থেকে ঊষাকাল’। ১৯৭২ সালে মারাঠি ভাষায় অমল পালেকর এটি প্রথম প্রযোজনা করেন। তারপর ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা রেপার্টরিও কয়েকবার নাটকটি প্রযোজনা করে। হিন্দি ভাষায় নির্দেশনা দিয়েছিলেন রামগোপাল বাজাজ। নাটকটি নারীর অবস্থানগত দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচনের কারণে ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
নাটকটিতে আশ্রয় করেছে যে দার্শনিক ভিত্তি তা হলো, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। অর্থাৎ পুত্র সন্তান লাভই স্ত্রীসান্নিধ্যের একমাত্র উদ্দেশ্য। সে-পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী জাতি শুধু বংশরক্ষার অবশ্যম্ভাবী উৎপাদনযন্ত্রে পরিণত হয়। স্বামী পুরুষটি অক্ষম হলেও স্ত্রীকে সন্তান উৎপাদনে নানামুখী কার্যসম্পাদন করার মতো জঘন্য মানসিক বিকৃতির পরিচয় দিতে হয়। নাটকটিতে প্রাচীন এসব প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আজকের বাস্তবতায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকার, ক্ষমতা ও অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অংশুমান ভৌমিক তাঁর অনুবাদেও মূল নাটকের দ্বন্দ্ব ও মানবিক সংঘাতকে উসকে দিতে চেয়েছেন। বাংলাদেশে থিয়েটার নাট্যদল ২০২২ সালের পহেলা জুলাই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন করে। এরপর ২০২৪ সালের ২০শে নভেম্বর বাংলাদেশ মহিলা সমিতি মঞ্চে নাটকটির একটি প্রদর্শনী হয়।
প্রসেনিয়াম মঞ্চবিন্যাসে বাস্তববাদী ধারায় নাটকটির পরিবেশনা। নাটকটির উপস্থাপনা শুরু হয় রানী শীলবতীর উপপতি গ্রহণের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। নাটকটির গল্পের গঠন সরলরৈখিক হলেও পরতে পরতে রয়েছে নাট্যমুহূর্তের বিমোক্ষণ। উত্তরাধিকার তৈরি করার জন্য প্রাচীন সনাতন ধর্মীয় রীতি মেনে রানীকে এক রাতের জন্য উপপতি গ্রহণে বাধ্য করে রাজপারিষদ। রানী তেমনটা করার পর তাঁর মানসিক অবস্থায় পরিবর্তন আসে। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন তাঁর নারীত্ব; অনুভব করেন স্বামী-সংসার, সমাজের রীতি-নীতি ও জীবনের প্রকৃত রূপ। তখন রানী শীলবতী হয়ে ওঠেন ভিন্নতর এক নারী।
নাটকের আখ্যানভাগের রাতটি শেষ হওয়ার পর শীলবতীর নামের প্রতীকী নারী চরিত্রের কী অনুভব, কী অনুভূতি কিংবা কী চেতনায় মন-মনন উদ্ভাসন ঘটে তা যেন দর্শকের মর্মমূলে আঘাত হানে। এ-নাটকের ঘটমান সময় সূর্যাস্ত থেকে পরদিন সূর্যোদয় পর্যন্ত – এক রাত। ওক্কাক নামে এক রাজার প্রাসাদ এর স্থান। মল্লরাজ্যের শাসক মহারাজ ওক্কাক নপুংসক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে করেছিলেন অপরূপা সুন্দরী শীলবতীকে। ওক্কাকের আশা ছিল, নারী সংস্পর্শ ও প্রেমের মধ্য দিয়ে সে অসুখ থেকে মুক্তি পেতে পারে। নিজের স্বার্থেই নারীকে অবলম্বন করেছিল সে। কিন্তু ওক্কাক ব্যর্থ। এদিকে রাজবংশ রক্ষা করার জন্য পারিষদ শীলবতীকে উপপতি গ্রহণে বাধ্য করতে চাইলে ওক্কাক আর্তচিৎকারে ফেটে পড়ে – ওক্কাক : এর কোনোটাই আমি মেনে নিতে পারছি না। আমাদের বংশ এক লজ্জাজনক উদাহরণ হয়ে টিকে থাকুক – এ আমি চাই না। চাই না যে আজ থেকে একশ বছর বাদে লোকে রসিয়ে রসিয়ে বলুক যে মল্লরাজ্যের শাসক ওক্কাক … নপুংসক ছিল বলে তাঁর ন্ত্রীকে গর্ভধারণ করার জন্যে রাজপ্রাসাদের বাইরে যেতে হয়েছিল।
এ-নাটক এগিয়েছে টানটান দ্বান্দ্বিক মনস্তত্ত্বে। নাটকে শীলবতী প্রথমে অবুঝ, নারীচেতনাহীন। কিন্তু রাজপারিষদ ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। মহামাতা শীলবতীকে আবেগে আপ্লুত করে তুলতে থাকে –
মহামাতা : নারীত্বের সার্থকতা কীসে? … এই অপূর্ণতা আপনাকে কাঁদায় না? ঘরময় খিলখিল করে হাসতে হাসতে একটি দুধে শিশু ছুটে বেড়াচ্ছে দেখতে ইচ্ছে করে না? যে হাসলে পাতার মতো নরম ঠোঁটের পেছনে ছোট ছোট দাঁত দেখা যাবে … কাঁদলে চোখের কোল বেয়ে মুক্তোর মতো জল গড়িয়ে পড়বে … আধো আধো বুলিতে আপনাকে ডাকবে, সেই ডাক শুনে চেতনার একেকটা তার বীণার মতো বেজে উঠবে … সেই ডাক, যে ডাকের মধ্যে সমগ্র মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির বীজ লুকিয়ে আছে।
শীলবতী সম্মোহিত হয়ে পড়েন। মানসিক স্থিতি যেন পাল্টে যায়। ব্যক্তিত্ব পরাজিত হয় নারীত্বের কাছে। তিনি মহারাজ ওক্কাকুকে গভীরভাবে ভালোবাসলেও তার কাছে বংশরক্ষা প্রধান কর্তব্য হিসেবে গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। টানটান গতিশীলতায় হৃদক্ষরণের ঘাত-প্রতিঘাতগুলো মঞ্চে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে থাকে।
নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘বিষয়বস্তুর কথা জেনে উৎসাহিত হই, কারণ সমাজে নারীর অবস্থান আমরা আমাদের একাধিক নাটকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। মহাভারতের যুগের ‘মাধবী’ থেকে আমাদের কালের ‘কোকিলারা’ কেবল পুরুষের প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয়েছে। তেমনি দেড়-দুই হাজার বছরের আশেপাশে এক কালখণ্ডে রাজবংশের উত্তরাধিকারের সংকটে নারীকে তার কামনা-বাসনার কোনো মূল্য না দিয়ে নিছক সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করার এক কাহিনি বিধৃত হয়েছে এ-নাটকে। তার পাশাপাশি রয়েছে ধর্মের অনুশাসন ও রাজনীতির কূটকৌশল – যার শিকার হয়েছে একইভাবে পুরুষও। নাটকের স্থান-কাল-পাত্রের ক্ষেত্রে শিল্পের স্বাধীনতা নিয়েছি আমরা। স্থান বা পাত্র কিছুটা নির্দিষ্ট করা গেলেও কালের ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা নিয়মে নিজেদের খুব একটা বাঁধিনি – পোশাক বা মঞ্চসজ্জায় তার প্রভাব লক্ষণীয়। বিষয়বস্তু বা মূল বক্তব্য যেমন আজো প্রাসঙ্গিক, উপস্থাপনা রীতিও তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখারই চেষ্টা করেছি আমরা।’ (সুভ্যেনির)
নাটকে মাত্র নয়টি চরিত্র। চরিত্রাভিনয়ের ধারায় নাটকটি উপস্থাপিত হয়েছে। প্রতিহারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন গুলশান আরা মুন্নী। মহত্তরিকা চরিত্রে নাজমুন নাহার নাজু। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওক্কাক ও শীলবতী। এই দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আপন আহসান ও তানভীন সুইটি। তাছাড়াও মহামাতা চরিত্রে আছেন ত্রপা মজুমদার। রাজপুরোহিত চরিত্রে জোয়ারদার সাইফ। সৈন্যাধ্যক্ষ চরিত্রে সামিরুল আহসান ও প্রতোষ চরিত্রে রাশেদুল রহমান/ রবিন বসাক অভিনয় করেছেন।
নাট্যচরিত্রগুলো রাজা-বাদশা অর্থাৎ রাজকীয় বাস্তবতা তৈরি করলেও এর অন্তর্স্পন্দন চিরন্তন। চিরদিনের নারী-পুরুষের আবেগকেই তুলে ধরেছে। নাটকটিতে শীলবতী চরিত্রে তানভীন সুইটির অভিনয়ে ছিল হৃদয়স্পর্শী অনুভবের প্রকাশ, সুস্পষ্ট সংলাপ ও চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্য চলনবাস্তবতা। অপরদিকে নপুংসক রাজা চরিত্রে আপন আহসানের সংলাপ ও চরিত্রায়নে ছিল সুদৃঢ় বাস্তবতা। রাজকীয় প্রাসাদের নৈর্ব্যক্তিক সাজেশনে সংগীত ও আলো-আঁধারির দোলাচলে অনবদ্য হয়ে ওঠে মানবিক দ্বন্দ্ব। চরিত্রগুলোর চিন্তার বিকাশও লক্ষণীয়।
নির্দেশক রিয়ালিস্টিক অভিনয় পদ্ধতিতে কিছু নৈর্ব্যক্তিক উপকরণ ব্যবহার করে নির্মাণ করেছেন নাট্যটির সময়কাল। মেটাফোর কিংবা বিশেষ শিল্পবৈচিত্র্য তৈরির চেয়ে মূল মেসেজকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। ফলে নাটকটির উপস্থাপনায় অভিনয় ও মূল মেসেজের অনুরণনই প্রধান হয়ে উঠেছে।
পোহালে শর্বরী নাটকটিকে বলা যেতে পারে এক নারীবাদী ব্যাখ্যান। এ-নাটকের নির্দেশনায় একজন নারীও আছেন। নানা কারণেই নারীর চাওয়া-পাওয়া এখানে বড় হয়ে উঠেছে। নির্দেশক মঞ্চের পেছনে লাল রঙের পর্দা ঝুলিয়ে, রাজপ্রাসাদের সাজেশন দিয়ে ও সামনে ডানের একপাশে রাজার প্রতীকী আসন স্থাপন করে দৃশ্য নির্মাণ করে নাট্য আবহ তৈরি করেছেন। কাহিনির পরম্পরায় প্রতীকী নানা উপকরণে রাজকীয় জীবনব্যবস্থা তুলে ধরেছেন। অমাত্যবর্গসহ রাজকীয় বাস্তবতার আলেখ্যে নারীর জীবন সংকট এখানে চিত্রিত। নাটকে মোট তিনটি অঙ্ক। প্রথম অঙ্কটি ঘটনার প্রস্তাবনা পর্ব, দ্বিতীয় অঙ্কটি রাত্রিযাপন ও তৃতীয় অঙ্কটি সূর্যোদয়ের সময়। এ নাটকে দ্বন্দ্ব প্রতিটি সংলাপের পরতে পরতে। যখন শীলবতী সারারাত উপপতির সঙ্গে কাটিয়ে এসেছেন সন্তান কামনায়, সবাই যখন আশা করছে শীলবতী এখন গর্ভবতী হবেন, তখন নাটকের কাহিনি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। শীলবতী ইচ্ছে করেই গর্ভনিরোধক ওষুধ খেয়ে নিয়েছে। নাটকে তখন এক চরম বিমোক্ষণ তৈরি হয়। তাই তো ক্ষোভে ওক্কাক বলে ওঠে –
ওক্কাক : রাজমহিষী গিয়েছিলেন ধর্মনটী হয়ে, ফিরেছেন কামনটী হয়ে। … মানমর্যাদার কোনো মূল্য তোমার কাছে নেই।
শীলবতী : কত যুবতী তো বিয়ের আগেই কৌমার্য হারায় … অথচ আমি বিবাহিতা হলেও ব্রহ্মচারিণী ছিলাম। আর কত দিন? … সাধারণ মেয়ে আমি। যে শরীর আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে তার চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য দেব না?
ওক্কাক : এত নিচে নামতে পারো তুমি? এতো স্বার্থপর …
শীলবতী : ওহ! … আর তুমি কি নিঃস্বার্থ … ন্যূনতম সামর্থ্য ছাড়া বিয়ে করার মতো জঘন্য পাপে লিপ্ত হতে পেরেছো …
নাটকের শেষ দৃশ্য শীলবতী দাঁড়ায় স্বামী ওক্কাকুর মুখোমুখি। শীলবতী তখন সমাজের পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। শীলবতী বিদায়ের আগে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করে –
শীলবতী : নিজে অতৃপ্ত থেকে কি অন্যকে তৃপ্ত করা যায়? বংশরক্ষার এই ধর্মাচরণ এবং রাজনীতি, যা আমাদের দুজনের কেউই চাইনি, এক নতুন স্বরূপের দিগন্ত খুলে দিয়েছে আমার অজান্তে। আমি অনুভব করেছি, আমি শুধু ধর্মীয়
আচার-আচরণ মানা, রাজনীতির কুটিল শেকলে বাঁধা রানী নই, আমি রক্তমাংসের নারী। আমি আজ আর রানি হতে চাই না, নারী হতে চাই।
নাটকটি নারীর সম্ভ্রমহীনতা, অশালীনতার পক্ষে নয়। কিন্তু সারারাত শেষে শীলবতী যখন শরীরের দুর্গন্ধ নিয়ে ফেরেন, তখন শিল্পকৌশলই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শিল্প মানে জীবনের প্রতিচ্ছবি। দুর্গন্ধের প্রসঙ্গটি না এনে কিংবা ভিন্ন প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করলে নাটকটি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠতে পারতো। রাজপ্রাসাদের নানা নৈর্ব্যক্তিক বা ইঙ্গিতবহ উপকরণ ব্যবহারে অনবদ্য
সে-বাস্তবতা। এ-নাটক নারীর চিরন্তন স্বাধিকারের নাট্যিক পরিবেশনা। নাটকটিতে তুলে ধরা হয়েছে নারীর আবেগের অধিকার, ভালোবাসার অধিকার, যৌন অধিকার এবং আত্মমর্যাদার অধিকারের প্রসঙ্গ। রাজা ও রানীর মানবীয় দ্বন্দ্ব এমন চমৎকার নাটকীয়তায় উপস্থাপিত যে দর্শক হৃদয়ের কোণে গভীর বেদনা অনুভব না করে পারে না। শীলবতী উপলব্ধি করেন জীবনের মর্ম, তার নারীত্ব; অনুভব করেন স্বামী-সংসার, সমাজের রীতি-নীতি। নাটক শেষে রানী শীলবতী হয়ে ওঠেন ভিন্নতর এক নারী শীলবতী অথচ এই নারীকে এতদিন ধরে ধর্মের নামে, সম্মানের নামে, ভালোবাসার ছলনায়, রাজনীতির কৌশলে জীবনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল।
আলো-সংগীত, সংলাপ সবকিছু মিলে এক সুন্দর নাট্যিক পরিবেশনা পোহালে শর্বরী। এর মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন পলাশ হেন্ড্রি সেন। ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর পোশাক পরিকল্পনায় রাজকীয় উচ্চসম্ভ্রান্তবোধ বোঝাতে লাল রঙের আধিক্য দিয়েছেন। পোশাক পরিকল্পনায় রাজকীয় জৌলুসের ইঙ্গিত থাকলেও মানুষসত্তা হিসেবেই নির্মাণ করতে চেয়েছেন। আবহ সংগীতে তানভীর আলম সজীব নাটকীয় মুহূর্তের আবেগকে উসকে দিয়েছেন। আর বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সক্রিয় চলনবিন্যাস তৈরি করেছেন স্নাতা শাহরিন।
পোহালে শর্বরী নাটকটির বক্তব্য এমন, সমাজ ‘নারী’ প্রপঞ্চের যে রূপরেখা তৈরি করেছে তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ‘পুরুষ’-‘নারী’র মধ্যে লিঙ্গান্তর বা জৈবিক ভিন্নতা ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই। প্রকৃতিগতভাবে একে অপরের পরিপূরক হলেও যুগ যুগ ধরে পুরুষরা নারীকে করেছে অবদমিত। পুরুষের মতো নারীরও যে কামনা-বাসনা-হৃদয়বৃত্তি আছে তা পুরুষশাসিত সমাজে কখনোই স্বীকৃতি পায়নি।
এ-নাটক যেন হয়ে উঠেছে নারীর কামনা-আকাক্সক্ষা-অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ। তাই নাটকের শেষে শত অনুরোধ সত্ত্বেও রানী শীলবতী রাজপ্রাসাদ ছেড়ে যখন একজন পুরুষের হাত ধরে অজানার উদ্দেশে পা বাড়ান, তখন দর্শক হিসেবে চমকে উঠতে হয়। শীলবতীর দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ তখন কানে বাজতে থাকে – ‘আমি রানী হতে চাই না; আমি নারী হতে চাই।’


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.