প্রজ্ঞা ও মননের সমন্বয়ে এক অনন্য স্থপতি

লুভা নাহিদ চৌধুরী

স্থপতি সাইফ উল হকের অফিসে বসে আমরা ছবি দেখে কয়েকটি পুরনো ইমারতের নকশা আঁকার চেষ্টা করছি। ঘর উজ্জ্বল, বড় জানালা দিয়ে অনেক আলো ঢুকছে। আমরা সাদা টেবিলে ট্রেসিং পেপার এঁটেছি, হাতে সরু নিবের কলম। হাত রাখলেই ভেজা গরমে কাগজ চুপসে যাচ্ছে, সোজা লাইন চুপসে যাওয়া কাগজে বেঁকে যাচ্ছে। এ নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। হাতে আছে কিছু মাপের কাগজ আর সাদা-কালো ছবি, যা দেখে চোখের আন্দাজে মাপ মিলিয়ে ক্ষনিয়া দীঘি মসজিদ, সোনারং মন্দির ইত্যাদি ইমারতের জটিল কারুকাজের নকশা কাগজে তোলার চেষ্টা করছি। অধিকাংশই পোড়ামাটির ফলকে অলংকৃত। স্থপতি সাইফ উল হকের তত্ত্বাবধানে ‘চেতনা’র একটি প্রকল্পের জন্য এ-নকশা প্রণয়ন করছি আমরা কয়েকজন নবীন স্থপতি ও প্রবীণ নকশাকার। এ-ধরনের কাজ আগে কখনো করিনি বলে আমাদের আগ্রহের সীমা নেই। তখনো কম্পিউটারের ব্যবহার সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। তাই একজন স্থপতির পক্ষে সুচারু ড্রাফটসম্যান বা নকশাবিদ হওয়া একান্ত জরুরি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা অধ্যাপক পারভীন হাসানকে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। তিনি এমন অভিনব ভঙ্গিতে পাঠশিক্ষা দিয়েছিলেন যে, তা ছবির মতো মনে গেঁথে ছিল। পরে ‘চেতনা’র জন্য পুরনো ইমারতগুলোর নকশা হাতে আঁকতে গিয়ে ঐতিহ্য ও ইতিহাস আমাদের নতুন করে আপ্লুত করল।
‘চেতনা’ সম্বন্ধে তখনো আমাদের খুব ভালো ধারণা নেই। মাজহারুল ইসলাম সাহেবের পরীবাগের সুপ্রশস্ত বাড়িতে ‘চেতনা’র সভা হয়, স্থাপত্য-রাজনীতি-সমাজ নিয়ে চড়া আলোচনা হয়, আর যখন সভার স্বর নরম হয়ে আসে, তখন শুরু হয় গান-ফিল্ম-আর্ট নিয়ে সরস আলাপ। সঙ্গে থাকে সুস্বাদু চা-নাস্তা। আমরা মুগ্ধ শ্রোতা এসব সভায়। আলোচনার অনেক কিছুই বুঝি না, সমীহ-শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ি। ইসলাম সাহেব সম্বন্ধে যা শুনি তাতে শ্রদ্ধার সঙ্গে ভীতির অংশও কম নয়। তবে তাঁকে বাস্তুকলাবিদ অফিসে বিকেলের এসব আসরে হাস্যোজ্জ্বল, সজীব দেখেছি। আমরা দাঁড়িয়ে শুনি। যাঁরা ওঁর কথা বোঝেন তাঁরা আলোচনায় অংশ নেন, কখনো তর্কের ঝড় তোলেন। আমরা খেই হারিয়ে বাড়ি ফিরে যাই; কিন্তু সেই স্বাদু আলাপের রেশ কোথাও একটা রয়ে যায়। তাহলে স্থাপত্যচর্চা মানে কি এই? জলবায়ু-জনরুচি-দেশ-কাল-সমাজ এসবের সঙ্গে স্থাপত্যের সম্বন্ধ কতটুকু ও কত গভীর সে-সম্পর্কে আমাদের তখন (হয়তো এখনো!) পরিষ্কার ধারণা নেই। বিশেষ করে এ-কারণে যে, এসবের সঙ্গে আমাদের রোজকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার তেমন মিল ছিল না। ইসলাম সাহেবকে যাঁরা কাছে পেয়েছিলেন, তাঁরা এসব নিয়ে ভাবতে শিখেছিলেন।
উনিশশো ছিয়াশি সালে শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে ঢোকার দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। শুনেছি শহীদুল্লাহ সাহেব কড়া মেজাজের মানুষ, স্পষ্টবাদী। তাঁকে আর ইসলাম সাহেবকে সবাই দুর্ধর্ষ জুটি হিসেবেই চেনেন। আমি কি এখানে চাকরি পাবো? ভাগ্যিস শহীদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে বেশি কথা বলতে হলো না, স্থপতি রবিউল হুসাইন, আমাদের রবিউলভাই, ওখান থেকে উদ্ধার করে নিজের কক্ষে নিয়ে গেলেন। যে-কথাটা বলতে চেয়েছিলাম, সেটা আর বলা হয়নি। মাত্র এগারোশো টাকা, তেরোশো হলে ভালো হতো, অন্যেরা পনেরোশো মায়না দিচ্ছে। শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে আমার স্বল্প চাকরিজীবনে অনেকের সঙ্গে গভীর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। তাঁদের মধ্যে যাঁর স্নেহ এখনো অমলিন তিনি হচ্ছেন রবিউলভাই।
সামনে অনেক ব্লু-প্রিন্ট পড়ে আছে। ঘরে ধোঁয়া। উলটোদিকের টেবিলে স্মৃতিসৌধের স্থপতি মইনুলভাই স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে সিগারেট টানছেন। পলিটেকনিকের ড্রয়িংগুলো ভালো করে দেখে নিতে বলেছেন বড়রা। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ওগুলো হচ্ছে। ভেবে খুবই আহ্লাদিত হলাম যে, স্ট্যানলি টাইগারম্যানের মতো অত বড় আর্কিটেক্টের ডিজাইন হাতের কাছে পেয়েছি। পরে জানতে ইচ্ছে হয়েছিল, এসব স্থপতি বাংলাদেশের খোঁজ পেলেন কী করে? পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এদেশে কী-ই বা ছিল। স্ট্যানলি টাইগারম্যানসহ পল রুডলফ, লুই কান – এঁরা সবাই জলা-জংলার দেশে এলেন মাজহারুল ইসলামের হাত ধরে। স্থাপত্যচর্চার ভবিষ্যৎ নির্মাণে তাঁর যে-দূরদর্শিতা, সে-ঋণ শোধ হওয়ার নয়।
ইসলাম সাহেব যে শুধু বড়মাপের স্থপতি ও চিন্তাবিদদের বাংলাদেশের সংস্পর্শে এনেছিলেন তা নয়, নিজের চিন্তাপ্রসূত উন্নত স্থাপত্য-চেতনার যে-মনস্তাত্ত্বিক বীজ তিনি বপন করেছিলেন তা পূর্ণতা পায় লুই কানের শক্তিশালী কাজকে ধারণ করে। এ-ভূখণ্ডের গত দুহাজার বছরের ইতিহাসে আগ্রাসন, আদর্শের লড়াই ও ধর্মীয় চেতনার উত্থান-পতনের অসম চিত্র ফুটে ওঠে। আবার এরই মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সমীকরণ, সামঞ্জস্যবিধান আর আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার নানাবিধ রূপায়ণ। মহাস্থান, সোমপুর, ময়নামতি থেকে আরম্ভ করে সুলতানি আমল পর্যন্ত বহুমাত্রিক, বৈচিত্র্যপূর্ণ অথচ নিরন্তর দেশীয় স্থাপত্যভাষা নির্মাণের যে-চেষ্টা, সেটি আত্তীকরণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মুঘল ও তৎপরবর্তী ঔপনিবেশিক আমলেও চলে স্বীয়করণের প্রক্রিয়া। কৃষিনির্ভর লৌকিক সংস্কৃতি, নাগরিক ও অনুপ্রবেশকারী বিদেশি সংস্কৃতির ত্রিবেণী মিলনে এদেশে চলেছে নিরন্তর সংমিশ্রণ ও সম্মিলন। পরিবর্তনশীল এসব নানান উপাদানের জটিল ক্রিয়ায় একটি বিষয়ই ছিল স্থায়ী ও অকাট্য, তা হচ্ছে বাংলাদেশের সমতল নদীধৌত ব-দ্বীপের চেহারাখানা ও জল-মাটির রসায়ন। তবে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সংকুচিত সময়ের মধ্যে যেভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের মানচিত্র পালটে যায় এবং আদর্শের ভিত দুর্বল হয়, তা সমীকরণ প্রক্রিয়াকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। একদিকে জোরপূর্বক রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার চাপ, আরেকদিকে আধুনিকায়ন ও উদ্ভাবনের তাড়ন – এ দুইয়ের টানাপড়েনে সাংস্কৃতিক সমীকরণের প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায়। স্থাপত্যভাষা নির্মাণের ধারাবাহিক চেষ্টা এবং সে-লক্ষ্যে চিন্তা ও চেতনা হারায় গতি।
একক যোদ্ধা হিসেবে নানা বাধা-বিপত্তি ও অসহনশীল মনোবৃত্তির শিকার হয়েছেন ইসলাম সাহেব। তাঁর প্রজ্ঞার বলে বহু আগেই তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, আত্মপরিচয়ের যে মৌলিক প্রশ্ন পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের মানুষকে বারবার তাড়িত করেছে (এবং এখনো করছে!), তার একটি প্রধান নির্ণায়ক হতে পারে দেশের স্থাপত্যচর্চার ভাষা। তাই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে তিনি স্থাপত্যচিন্তার এমন একটি সংজ্ঞা দাঁড় করেছিলেন যা একাধারে আধুনিক, পরিশীলিত এবং বাংলাদেশের বৃষ্টি-জল-কাদা সংলগ্ন। তাই লুই কান তাঁর ‘সেকেন্ড ক্যাপিটালে’ বিস্তীর্ণ সবুজ, প্রশান্ত জল ও বাঙ্ময় লাল ইটের ব্যঞ্জনায় যে-কাব্যিক ভাষা নির্মাণ করেছেন, তার পূর্বসূত্র খুঁজে পাই ইসলাম সাহেবের কাজে। শেরেবাংলা নগরে লুই কানের ভবনগুলো নির্মিত হওয়ার পর এদেশে আর্কিটেকচারের মোড় ঘুরে যায়। অবয়বের যুগান্তকারী জ্যামিতিক গঠন, স্পেসের বিভাজন ও বিশ্লেষণকে সবাই স্বাগত জানালেন কিন্তু গ্রহণ করলেন ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। স্থপতিসমাজে অনেকে এর বাহ্যিক গঠন ও নির্মাণ কৌশলে অভিভূত হয়ে নিজেদের ডিজাইনে ইটের ‘ফ্ল্যাট আর্চ’ আর কৌণিক কাটা অবয়ব সরাসরি সংযোজন করতে দ্বিধা করলেন না। আবার অনেকেই এর গভীরে গিয়ে অনুধাবন করলেন ইসলাম সাহেবের দর্শন, খুঁজে পেলেন তাঁর কর্মপ্রসূত চেতনার দূরাভাস। স্থাপত্যভাষা রূপায়ণে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের অবস্থান যে পরস্পরবিরোধী নয় বরং সম্ভাবনায় ও শক্তিতে শৈলী প্রাঞ্জল হয়, ইসলাম সাহেবের কাজ তার মূর্ত প্রমাণ।
ইসলাম সাহেব কী বলতে চেয়েছিলেন? তা আর পুরোপুরি জানা হবে না। অনুমান করি তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যে, স্থাপত্যকলায় উত্তরণের পথ পাঠ, চর্চা ও সাধনার মধ্যে নিহিত। এর জন্য জিজ্ঞাসা-উন্মুখ, সংবেদনশীল ও আত্মপরিচয়-অন্বেষণকারী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।