প্রলাপ

তারক রেজ

হাতের তালুতে এক টাকার কয়েন। কখন থেকে যে ধরা আছে কে জানে! অনেকক্ষণ ভেবেছে। কে দিয়েছে মনে নেই। শুধু একটাই প্রশ্ন, ভিখিরি মনে করে দিলো নাকি! খুব রাগ হচ্ছিল। জটা-ধরা মাথাটা এককালে বোতাম ছিল, এখন গিট্টি দেওয়া। উদোম গা। এগুলো কি সব ভিখিরির চিহ্ন! এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল, আইববাস নামেতেই তো ভিখিরি ভিখিরি ভাব। ফকির, পুরো নাম ফকিরচাঁদ। তো চাঁদ এখন উধাও। ফকিরের সঙ্গে সে ঘর বাঁধবে কেন! বাঁধবে না। আর তখনই মনে পড়ে গেল, লালন-ও তো ফকির ছিল, তাই বলে সে কি ভিখিরি ছিল! ওই যে গো গানটা, সব লোকে কয় লালন কী জাত…। গাইবে নাকি গানটা দুহাতে তালি দিয়ে!
ভোরের আলো ফোটেনি ভালো করে। চারদিকটা তেমন জাগেনি এখনো অবধি। কালো গাড়ি থেকে সাদা পুলিশগুলো নামছে। তিন-চারটে গাড়ি এসে গেল। অমনি গাইলে যদি কানচাপাটি মারে! পুলিশ তো পাগলকেও ছাড়ে না। তাইলে চুপ। মুখভর্তি দাড়ি চুলকোচ্ছে। ওদিকে বাহ্যে পেয়েছে। পেট চেপে বসে না থাকে খালাস করি গে – বলেই দুপা এগোতে পুলিশ-বাড়ির পেছনটায় জমা ময়লার ওপর দিলো খালাস করে। প্যান্টের পেছনটায় ফুটো থাকায় সামনের গিঁট খুলতেই হয়নি। ঝট করে কাজ শেষ।
টাকাটা হাতের মুঠোয় সাপটে আছে। একটু দূরে ফুটপাতে চায়ের দোকান সাজিয়ে বসেছে তাগড়াই লোকটা। লেড়ো বিস্কুট ছুড়ে দিলো একটা কালো কুকুরের দিকে। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েও টাল সামলে নিল। কুকুরটা মুখের ভেতর খরখর করে পুরে ফেলেছে গোটা বিস্কুটটা। ফকির পা-পা এগিয়ে এলো। হাত বাড়াতেই লোকটা বলল, চা খাবি? আহা দয়ার শরীর গো। একটুকু ভাঁড়ে চা আর লেড়ো বিস্কুট। কুকুরটা বিস্কুটটার দিকে চাইছিল। শালা ভাগ্যিস চা খায় না। মুঠো হাতের দুটো আঙুল দিয়ে বিস্কুট আর এক হাতে ধরা চায়ে ডুবিয়ে তারপর মুখে ঢোকাতেই চোখ বুজে গেল। আহা! আর ঠিক তখনই মনে হলো, শালা ভিখিরি মনে করল নাকি! খিঁচরে গেল মনটা। শুধোবে নাকি!
চা শেষ হতেই ভাঁড়টা পকেটে পুরে ফেলতে গিয়ে হাতে ঠেকল পোড়া বিড়িটা। এই বিড়িটা যে কতদিন ওর পকেটে কে জানে! দুটো ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে বিনা আগুনেই টান দিলো। আগুন থাকলে তো বিড়িটা শেষ হয়ে যেত কবে। সুখটান। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। আপন মনেই বিড়বিড় করল, যাহ্, মাপ করে দিলুম।
যে সে নয়। বিধু মালিকের ছেলে সে। মা সুধারানি। হেঃ, জীবনী লিখতে তো এমনভাবেই শুরু করতে হয়। জোতদার বাপ। পাঁচটা ধানের কল, দুশো বিঘে জমি। এত্তসব। বর্ধমান টাউনের ওপর দু-দুটো কোঠাবাড়ি। তবু বাপটা বোকার হদ্দ। ভেবেছিল, ফকিরচাঁদকে এত্তবড় ডাক্তার বানাবে। হায়ার সেকেন্ডারিতে স্টার পাওয়ার আগেই তৈরি হয়ে গেছিল খসড়া। জয়েন্ট, এমবিবিএস, এমডি, এমআরসিপি, লন্ডন। ধুস্ শালা জাবর। একঘেয়ে। এক সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা। তো সেটা এড়াতেই একদিন ড্রেন-পাইপ ধরে দোতলার ব্যালকনিতে উঠেছিল। ভেবেছিল, একটু অন্যরকম হবে। তা হলো না।
এটা কেন! ডাক্তার সামন্ত মাথা দুলিয়ে বললেন, মেন্টাল ডিসঅর্ডার। ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার। মানে! বিধু মালিকের চোখ দুটোতে আতঙ্ক। এতগুলো চালের কল, জমি, বাড়ি – সবের মালিক হবে তো এই ছেলেই। ফকিরচাঁদ মালিক। কেন ডিসঅর্ডার! ডাক্তার উত্তর না দিয়ে খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে হাত বাড়িয়ে ভিজিট নিতে নিতে বললেন, একটু মেন্টাল পারগেশন দরকার। সুধারানির চোখ ছলছল, হ্যাঁ গো, কী হবে?
ফকিরচাঁদ শুনছিল কথাগুলো আড়াল থেকে। এতোদিন ছিল মালিক-মালিক ভাব। এখন শালিকের মতো ফুরুত করে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কে দিচ্ছে উড়তে! উড়তেই গিয়েছিল, দুদিকে হাতদুটো পাখার মতো ছড়িয়ে ছাতে উঠে সবে উড়তে যাবে, পেছন থেকে জাপটে ধরল কে যেন। ব্যস হয়ে গেল।
তারপর শুধু ওষুধের গন্ধ। গলার নালিতে তিতকুট্টে বিস্বাদ ওষুধ আটকে থাকে সর্বক্ষণ। ইঞ্জেকশন ভূরি ভূরি। আহ্, খুলে দিন ডাক্তারবাবু – ঘুমের মধ্যেও চেঁচিয়ে ওঠে ফকির। তো কে কার কথা শোনে! আরো চেপে বেঁধে রাখে।
পয়সাটা হাতের তালুতে তেমনি সাপটে আছে। তাহলে ভিখিরি ভেবেই দিয়েছে লোকটা। ওর আর দোষ কি! একমুখ দাড়ি। জুলফি দুটো থেকে থুতনি, তারপর আরো খানিকটা বেড়ে গলা থেকে বুক। একটা কাচ পেলে দেখত। কতদিন দেখেনি। সেই যে হারিয়ে গেল তারপর আজ পর্যন্ত – নাহ্, দেখা হয়নি ফকিরচাঁদকে। হঠাৎ হাসি পেল, তা বিঘের হিসেবে কতটা জমিতে এই দাড়ি! চোখের নিচ থেকে প্রায় বুক – তা কতটা! ধান রোয়াতে ঘাম ছোটে, আর দাড়ির বেলায় মেহনতই হয় না। ও তো আপনি আপনি গজায়।
আবার মনে হলো, নাহ্, লোকটার দোষ নেই। আর যদি দোষ থাকে, যাঃ, মাপ করে দিলুম।
লোকটা চেপে ধরেছিল আরো জোরে। আহ্, ছেড়ে দাও। একটু দূরে ঘোরানো চেয়ারে বসে ডাক্তার ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে। চোখ দুটোতে কেমন একটা হিংস্র-হিংস্র ভাব। মা গো – বলতে গিয়ে গলায় আটকে গেল। এটা তো ওর বাড়ি নয়। হাসপাতাল। মানসিক। জোর দিয়ে একটু ঘুরতেই কাচের গেলাসটা আলটপকা হাতের নাগালে পেয়ে গেল। সেটাই তুলে নিয়ে ঠুকে দিলো লোকটার মাথায়। ধপাস। মাথায় হাত দিয়ে লোকটা বসে পড়ল মাটিতে। আর সে-সুযোগে ভোঁ-দৌড়। লন পার হয়ে পাঁচিল টপকে সোজা রাস্তায়। তারপর আবার দৌড়। তারপর ট্রেন। কলকাতা। ডাক্তারের মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার। শালা বেকুব, পাগলকে ধরে রাখা যায়? যায় না। সে তো বাইরের সম্পত্তি। পাবলিকের মাল। লোকাল ট্রেনের দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে উবু হয়ে বসে থাকতে-থাকতে দমকা হাওয়ায় মগজ শান্ত হলো। আর তখুনি বিড়বিড় করল, যাঃ, মাপ করে দিলুম।
বোঁ-ও-ও-ও সাইরেন বাজছে। লাল বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সাদা গাড়ি। আগু-পিছু কালো গাড়ি। একটু দূরে গাড়ি বারান্দার থামের আড়াল থেকে দেখছে ফকির। শালা ধরেছে আরেক পাগলকে। কালো কোট পরা দুটো লোক দুপাশে। ইয়াবড় চেহারার। পেছনে আরো দুটো। পালাবি কোথা! ঠিক অমনি করে ফকিরের মনে আছে, চারিদিকে ঘিরে ওকে নিয়ে গিয়েছিল, ওই কী বলে গো, হাসপাতালে। সাদা ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবির লোকটা হনহন করে হাঁটছে বটে, তবে ফকির তো জানে, সামনে-পেছনে লোক না থাকলে ভোঁ-দৌড় দিত। চেঁচিয়ে বলতে যাচ্ছিল ফকির, পালা-পালা। কিন্তু তার আগেই, ঠকাস। একটা পুলিশ পাছায় হাঁকিয়েছে। ও নিজেই ভোঁ-দৌড় দিলো। দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে। শালা হইছিল আর কি! ওই ডাক্তারের লোকগুলো এখনো খুঁজছে ওকে। পেলে ঢুকিয়ে দেবে ওই লোকটার মতো লালবাড়িতে। ওখানে একবার ঢুকলে…!
জায়গাটা ভালো নয়। কত জায়গা পালটে যে এখানে এসেছে তা গুনতি করা যায় না। কতবার? দশবার? না, তারও বেশি? কে জানে! যা-ই হোক ভাগতে হবে। এখানেও ডাক্তারের লোক গিজগিজ করছে। লুকিয়ে আর কদিন চলে! গোটাতে হবে পাততাড়ি। পাততাড়ি মানে! যাঃ শালা কিচ্ছু না। ফক্কা। পাগল তো ট্রান্সফারেবল জব করে। আজ এখানে তো কাল সেখানে। পালাতে হবে। পেটের ভেতর খিদেটা হঠাৎ খ্যাঁক খ্যাঁক করে উব্জে উঠল। আর সে-সময়ই হাতের মুঠোয় সেঁটে থাকা কয়েনটা যেন বলল, ম্যায় হুঁ না। সামনে একজন পাকা পেঁপে কেটে সাজিয়ে রেখেছে ডালায়। হলুদ-সাদা। তা হোক পয়সা দিয়েই তো খাবে। দাও তো গো – বলে সামনে দাঁড়াতেই লোকটা খেঁকিয়ে উঠল, ভাগ শালা ভিখিরি।
বলে কী! চমকে উঠল ফকির। বিধু মালিকের ছেলে সে। তাকে কিনা…! হাতের মুঠো খুলে পয়সাটা দেখিয়ে বলল, নেবে? ফোট শালা – বলে তেড়ে আসতে গিয়ে লোকটার কী মনে হলো, একপাশে পেতে রাখা বস্তার ওপর পেঁপের খোলা ডাঁই করা, সেদিক পানে আঙুল দেখিয়ে বলল, খা। খিদের জাত একটাই, খিদে। হামলে পড়ল ফকির। এক হাতে মুঠো মুঠো মুখে তুলে খাচ্ছে। মুখ আঠায় জড়িয়ে যাচ্ছে। তো তো বিস্বাদ। জিভটুকু পেরিয়ে পেটে সেঁধোতেই আবার ফুরফুরে হয়ে গেল মনটা। ভিখিরি বলেছে, তা বলুক গে। বিড়বিড় করল ফকির, যাঃ মাপ করে দিলুম। লোকটা পেঁপে কাটতে কাটতে হাঁ করে ওর খাওয়া দেখছে। ফকিরের হাসি পেল, শালা মাপটা যেন গিলছে। তার চিবানো পেঁপের কষ ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
হঠাৎ শুনল, দিতে হবে দিতে হবে। কী! পিঁপড়ের সারির মতো একদল মানুষ। দিতে হবে, দিতে হবে। ফুটপাতে উবু হয়ে বসে আছে ফকির। তা, যা না বিধু মালিকের কাছে। ধানকলের একটা শ্রমিক কুয়োয় পড়ে গেছিল। একটা ধুমসোমতো লোক নাকি ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। ভিড়ের মধ্যে সে অবশ্য হাওয়া। খতম। কী জানি, রাতে পুলিশ এলো বিধু মালিকের কাছে। কী সব কথা হলো চাপা গলায় বিড়বিড় করে। তারপর পুলিশটা গলাটা একটু উঁচু করে বলল, দিতে হবে। বিধু মালিক, মালিক বলে কথা। ক্যাশ বাক্স খুলে…। হয়ে গেল। পুলিশটা হাসি-হাসি মুখে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে। তার কদিন পর কে যেন বলল, তোর বাপটা ঘুষ দিয়ে পুলিশের মুখ বন্ধ করেছে। শালা ঘুষখোর পুলিশ। আর শ্রমিকটা যে কুয়োয় পড়ে মারা গেল তার কী হলো! কিচ্ছু না। ওর বিধবা বউটা ছেলে কাঁখে নিয়ে কদিন ঘুরল-ফিরল। কিচ্ছু না। বাপটা কি তাহলে খুন করল! খুনি! কী জানি, ঢোকে না মাথায়। মাথাটা বেবাক শূন্য হয়ে যায়। তারপর থেকেই মাথার ভেতরে যে-ঘড়িটা আছে, তার কাঁটা দুটো হু-হু করে উলটোদিকে ছুটতে লাগল। ছুটতেই লাগল। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।
অমনি দ্রুম। শব্দটা কাছ থেকে। সারি ভেঙে মানুষগুলো দৌড়াচ্ছে। সাদা আর হলুদ পুলিশ ঘিরে ফেলেছে জায়গাটা। অনেকটা ছুটে এসে একটা গাড়িবারান্দার থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছে ফকির। চারপাশে ধোঁয়া। চোখমুখ জ্বালা করছে। কতক্ষণ এভাবে কাটল কে জানে! তারপর সব শান্ত। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে, আবার পসরা সাজিয়ে বেচাকেনা। হাঁকাহাঁকি। যেন কিচ্ছু হয়নি। ঠিক যেমন পরের দিন বাপ বিধু মালিক একটা রোবট কিনে এনে ফকিরের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, দ্যাখ কেমন ব্যাটারিতে চলে। ও দেখছিল বাপকে। কিচ্ছু হয়নি। শান্ত। ব্যাটারি বন্ধ করে দিলে রোবট যেমন শান্ত, ঠিক তেমনি।
ফুটপাতের ওপর চৌবাচ্চা। তাতে ফুটো। আর সেই ফুটো দিয়ে জল পড়ছে। কজন চান করতে করতে দিলো এক বালতি জল ওর মাথায় ঢেলে। ভিজে সপসপে। শাল্লা…! মুখ উগরে খিস্তি আসছিল, কিন্তু দেহটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মনটাও। গা-টা যদি কেউ মুছিয়ে দিত। ঠিক যেমন সুধারানি মুছিয়ে দিত। সেই কবেকার কথা, কিচ্ছু মনে নেই। যাক গে। ঠান্ডা হয়ে মনটা আবার ফুরফুরে হয়ে উঠল, যাঃ মাপ করে দিলুম।
গায়ে জল পড়তেই খিদেটা কেমন চনমনিয়ে উঠল। কটা পেঁপের খোসা, ওতে কী হয়! হয় না। বিধু মালিকের ছেলে সে। ওপাশে ফুটপাতে হোটেল বসে গেছে। মাছ ভাজা, ডাল, আলু ভাজা, মাংস। আহা। বেঞ্চ-পাতা। কজন পাত পেড়ে খাচ্ছে। একটা ফচকে ছেলে চেঁচাচ্ছে, গরম গরম গরমা গরম। সেই সকালের কেলে কুকুরটা ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছে। ওকে দেখে ল্যাজ নাড়া থামিয়ে আড়চোখে ওকে দেখল। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে আবার নাড়তে শুরু করল। শালা গন্ডগোল বাধবে। ফটিক তো কাউকে চেনে না। জায়গা পালটাতে পালটাতে জেরবার ফকির সবে তো কাল রাত্তিরে এসেছে এ-পাড়ায়। তো কি! হাতের মুঠো থেকে কয়েনটা বলল, ম্যায় হুঁ না! তাছাড়া পাগলের আবার চেনা-অচেনা কি! তাকে সবাই চেনে এক ডাকে, পাগলও চেনে সববাইকে। নইলে পাগল হবে কেন!
বেঞ্চের কাছটাতে যেতেই ফচকে ছেলেটা হইহই করে উঠল, ভাগ ভাগ। ফকির বিড়বিড় করল, ভাগ নয়, গুণ গুণ, হাতের তালুতে ধরা কয়েনটা দেখিয়ে বলল, টাকার গুণ। গুঁফো মালিকটা বলল, সরে যা সরে যা। সরেই তো আছে ফকির। সরতে সরতে আর কতদূর! ঠিক দুপুরবেলা লাল বাড়ির অনেক ওপরে চিল উড়ছে। এক হাতের তালু দিয়ে চোখ আড়াল করে দেখেছে ফকির। কত চিল! তার মধ্যে কয়েকটা শকুনিও থাকতে পারে। তার মানে! শাল্লা মরা। মরা খুঁজছে। আর তখনি ভয়ে থরথর কেঁপে উঠল। এই শহরটার মতো সেও কি তাহলে মরা! আবার ছুট।
একটা এঁটো পাতায় এঁটো ভাত আর ঝোল খাচ্ছে ফকির। দাড়িতে কষের মতো মাছের ঝোল মাখামাখি, গড়িয়ে পড়ছে বুক অবধি। তোফা। একটু দূরে সকালের সেই কেলে কুকুরটা। আর একটা পাতে খাচ্ছে। সন্দেহের চোখে ফকিরকে দেখে নিল। তারপর খাওয়ায় মন দিলো। গুঁফো মালিকটা বলল, খা খা। হঠাৎ মনে হলো, শাল্লা ভিখিরি ভাবছে না কি! বিধু মালিকের ছেলে সে। ভিখিরি, কভি নেহি। একবার ভাবল উঠে পড়ে, শাল্লা খাওয়ার নিকুচি করেছে। ঠিক তখনই খিদেটা মোচড় দিয়ে জানান দিলো, অন্ন খেয়ে ধন্য হ।
পেটটা জুড়লো। তো মনটাও। ভরদুপুরে, এ-সময়টা একটু যেন সুনসান। ফুটপাতে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে ফুরফুরে মনে বিড়বিড় করল, যাঃ মাপ করে দিলুম।
চোখদুটো একটু জুড়ে এসেছিল। ধানক্ষেতের আল ধরে দৌড়াচ্ছে মেয়েটা। হলুদ ফ্রক হাওয়ায় উড়ছে। পেছন থেকে পড়িমরি কেউ ডাকল, পুঁটি-ই-ই-ই অ পুঁটি। হলুদ ধান মাথা নুইয়ে দুলছে। হলুদ ফ্রক হারিয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর উপুড় করা কড়াইয়ের মতো নীল আকাশখানা ঝুপ করে গাঙের জলে। পানকৌড়িটা অমনি হুঁশ করে উড়ে গিয়ে সজনে গাছের ডালে বসেছে। ঘুমের মধ্যে ফিসফিস করে ফকির যেন বলল, আমি এখানে। আয় পুঁটি। আয়। আর অমনি হাঁটুতে লাঠির গুঁতো। পুলিশ। ভাগ শালা। ভেতরটা থরথর করে কেঁপে উঠল, বলে কী! বিধু মালিকের ছেলে, তাকে বলে ভাগ! ভিখিরি ভাবল নাকি! পাশ ফিরে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে শুতে যাবে, অমনি ঠকাস। মোক্ষম। হাঁটুটা কনকন করে উঠল। পুলিশ বলল, পাগল কাঁহাকা। ধড়মড় করে উঠে বসল ফকির। তারপর বিড়বিড় করল, পাগল তোর বাপ শালা। আবার বিড়বিড় করল, এ-শহরটা হলো গিয়ে পাগলের কারখানা। মনে ভাবল, পালাতে হবে – এই নিয়ে কতবার কে জানে! লাঠি উঠলো ওর মাথা লক্ষ করে। একরকম খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়। গির্জার কাছে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে ফকির। শালা ভিখিরি ভেবেছে! হাঁটু গেড়ে বসে পকেট হাতড়ে সেই পোড়া বিড়িটা দুটো ঠোঁটের ফাঁকে গলিয়ে দিয়ে অদৃশ্য ধোঁয়া ছাড়ল। গির্জার ভেতরে প্রার্থনা হচ্ছে, রোল অ্যাওয়ে রোল অ্যাওয়ে অল দ্য সিন রোল অ্যাওয়ে…। মনে পড়ে গেল, কোয়ালিটি অফ মারিস… সেই কবে পড়া! অমনি মনটা কেমন প্রশান্তিতে ভরে গেল, যাঃ মাপ করে দিলুম।
শালা অমনি গণসংগীত ধরেছে পেটের নাড়িভুঁড়িগুলো। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই মুড়িওয়ালা। অফিসফেরতা বাবুরা ঘিরে আছে। কেউ আবার ঝালমুড়ি চিবোতে চিবোতে বাসের লাইনে। জাবর কাটছে। গরুর মতো। তা কাটুক। দিন যাবে রাত যাবে, বর্ষা শীত গ্রীষ্ম – সব যাবে। কিন্তু জাবর চলবে।
মুড়ির লোকটার কাছেই ফকির, কিন্তু আরেকটা লোক একটা গোল যন্ত্র নিয়ে ওজন মাপছে। সোজা গিয়ে তার কাছেই দাঁড়াল ফকির। হাতের পয়সাটা দেখিয়ে বলল, মেপে দাও তো। ওজনদার এক পলক দেখে নিয়ে বলল, ভাগ। ফকির মাথা নেড়ে বলল, ভাগ নয়, গুণ। টাকা দেব। কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো যন্ত্রের ওপর। অভ্যাসমতো লোকটা মাথা নিচু করে দেখে নিয়ে বলল, তেত্রিশ। যন্ত্র থেকে নামতে নামতে ফকির বিড়বিড় করল, এক কেজি লস। গত বছর ছিল চৌত্রিশ। শাল্লা খেতে হবে। তারপর ওজনদারের সায় নিতেই বোধহয় একটু জোরে বলল, খেতে হবে। কী বলো? কে শোনে! ওজনদারের যন্ত্রে ততোক্ষণে চেপে বসেছে ইয়াববড় একটা লোক।
না শুনুক। খেতে তো হবেই। মুড়িওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এক ঠোঙা দাও দিকিনি। মুড়িওয়ালা বলল, ভাগ। আবার ভাগ! ভাগ করতে করতে ভাগফল তো শূন্য হয়ে যাবে। শালা উড়ে যাবে তো! মুখের ওপর জবাব দেওয়ার ভঙ্গিতে মুঠো খুলে কয়েনটা দেখাল। মুড়িওয়ালা আবার বলল, ভাগ শালা ভিখিরি কাঁহাকা। বলে কি! বিধু মালিকের ছেলে সে। তার বাড়িতে ধামা-ধামা মুড়ি। দশ জেলা খেলেও ফুরোবে না। তাকে বলে ভিখিরি! একটা ঢ্যাঙা ছেলে সঙ্গে একটা বেঁটে মেয়ে মুড়িওয়ালার সামনে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা খানিকটা তফাতে সরে গিয়ে চাপা গলায় বলল, এঃ পাগল! ছেলেটার অমনি পুরুষ-পুরুষ ভাবটা জেগে উঠল, কী রে, মুড়ি খাবি?
শালা, আবার ভিখিরি ভেবেছে। ঘাড় নাড়ার আগেই ছেলেটা বলল, দাও, তিন টাকার মুড়ি ওকেও দাও। শালা হরিশচন্দ্র মাড়াচ্ছে। যেন বিশ্ব লিখে দিচ্ছে। ঘাড়টা দ্রুত নাড়িয়ে বলতে যাচ্ছিল, কভি নেহি। তোর মুড়িতে আমি ইয়ে করে দিই। আর ঠিক তখনই পেটটা মোচড় দিলো। তেত্রিশ কেজি, খেতে হবে তো।
মুড়ি চিবোচ্ছে ফকির। ফুটপাতে হাঁটু গেড়ে বসে। জাবর। হেসে ফেলল ফিক করে। পেটের ভেতর তিন টাকা সেঁধোতেই মনটা আবার ফুরফুরে। বলল, যাঃ মাপ করে দিলুম। ওই ঢ্যাঙা ছেলেটার উদ্দেশেই বলল বোধহয়।
লালবাড়ির সামনের গাছটায় কিচির-মিচির পাখির ঝগড়া, খুনসুটি শেষ হতে হতে নিওন আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারধার। গির্জার ধারেই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ফকির। কৃষ্ণচূড়ার মাথায় আকাশ। একটা একটা করে অনেক তারা সেখানে। পুবে একফালি চাঁদ। নিলপুর-বাজারে একফালি কুমড়োর মতো। একটা পুলিশ হাতে খৈনি টিপতে টিপতে আড়চোখে দেখল ওকে। একটু আগে সাইরেন বাজিয়ে পাগলটাকে লালবাড়ির বাইরে নিয়ে গেল কটা পুলিশ।
চোখটা আপনি বুজে আসছে। কিন্তু পেটের মধ্যে হঠাৎ শোরগোল। পেঁপের খোসা, দুপুরের এঁটো ভাত, বিকেলের মুড়ি সব খিচুড়ি পাকিয়ে একশা। পুলিশবাড়ির পেছনটাতেই যেতে হবে পেটটা খোলসা করতে। ঝাপসা অন্ধকার। ডাঁই করা ময়লার স্তূপের একপাশে সেই কেলেটা বসে। শালা কামড়াবে নাকি! সকালে লেড়ে বিস্কুটটার কথা…! ও গিয়ে একপাশে বসল। কেলে গলা থেকে একটা চাপা শব্দ করল। কি হলো! দাঁড়িয়ে এধার-ওধার চাইতেই একটা পুঁটলির মতো। সাদা থান কাপড়ে মোড়া কিছু একটা। একটু কাছে যেতেই দেখল, কাপড়টা রক্তমাখা। আপনমনেই বিড়বিড় করল ফকির, পাপ। শালা! খালাস করে ভেগেছে। কেলে মাথা নাড়ছে। তুলে নিল পুঁটলিটা। পুঁটলির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আছে কচি মাথাটা। চোখ দুটো, যেন ঘুমুচ্ছে, নাকি…! ওসব বোঝার দায় ফকিরের নেই।
সেই পুলিশটা! খৈনি ঠোঁটে গুঁজে এদিকেই আসছে। শালা পালাতে হবে। সব পাপ বুকে ধরে পালাতে হবে। মানুষের সব পাপ। কেলো ধড়মড় করে উঠে পিছু নিল। ফকির শক্ত করে পুঁটলিটা কোলে এক হাতে জাপটে। ছুটছে ফকির ফুটপাত ছেড়ে গলির মাঝরাস্তা ধরে। ছুটছে। চিৎপুর ছাড়িয়ে কলুটোলা – ছুটছে ফকির। আপনমনে বিড়বিড় করছে, শালা এতো পাপ! এত্ত বড়…! আমি পারব না। ওপর দিকে একফালি চাঁদের দিকে মাথা তুলে চেয়ে ফকির বলল, মাপ করে দে বাপ। সব গলি পার হয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছতেই হবে। এক হাতে পুঁটলি আর এক হাতের মুঠোয় কয়েন, ফকির ছুটছে। পেছনে কেলে। 

Published :


Comments

Leave a Reply