প্রাচ্যকলার সমকালীনতা

জাহিদ মুস্তাফা

Zahid-Mustafa
Zahid-Mustafa

আলুলায়িত কেশরাজি, স্খলিত আভরণ ভেদ করে যৌবনপুষ্ট দেহবল্লরী নিয়ে মদিরা দৃষ্টির নারী সৌন্দর্য বর্ণনার প্রচলিত কৌশল থেকে প্রাচ্যকলাকে বের করে মূলধারার শিল্পের বিষয় ও বিন্যাসে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস লক্ষ করা গেল ওরিয়েন্টাল আর্ট স্টাডি গ্রুপের চিত্র-প্রদর্শনীর কতক কাজে।

ঢাকার চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে গত ১৭ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত এই দলীয় চিত্র-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ওরিয়েন্টাল আর্ট স্টাডি গ্রুপের পঞ্চম আয়োজন ছিল এটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কয়েকজন শিক্ষক এ-গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছেন – প্রাচ্যশিল্পকে আমাদের মূলধারার শিল্প হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াসে।

এঁদেরই আয়োজনে ওয়াশ পেইন্টিং নিয়ে গত বছর জুনে সপ্তাহব্যাপী একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ওই কর্মশালায় অংশ নেওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী  শিল্পী ও কয়েকজন প্রশিক্ষক মিলে এ-প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এর কিউরেটর চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষক ড. মলয় বালা। অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের  মধ্যে তাজুল ইসলাম, জাঁনেসার ওসমান, জাহিদ মুস্তাফা, ড. রশীদ আমিন, জি.সি. ত্রিবেদী, ড. সুশান্ত কুমার অধিকারী ও কান্তিদেব অধিকারী ওই কর্মশালার প্রশিক্ষক।

শিক্ষার্থীসহ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী অন্য শিল্পীরা হলেন – শংকর মজুমদার, তারিক ফেরদৌস খান, সুনীত কুমার, সীমা ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম, মাতুরাম চৌধুরী, গোপাল চন্দ্র সাহা, সুমন বৈদ্য, নায়লা হুমায়রা, মহসিন কবির, আসরাফা সনেট, বিকাশ আনন্দ সেতু, সুমন কুমার সরকার, তানজিনা তাবাসসুম এষা, মুস্তাকিনা তারিন, অমিত নন্দী, শারমিন আকতার, আইরিন সুলতানা লিজা, নাহিদা নিশা, সানজিদা, নিপা রানি সরকার, চন্দন কুমার সরকার, সুস্মিতা সাদিয়া রিমি, এম.এ. হোসেন, হাসিবা ইয়াসমিন, ইতি রাজবংশী, পদ্মাবতী ঢালি, হৃদিতা আনিশা, হরেন্দ্রনাথ রায়, তানভিক জাহান স্বর্ণা, তৌহিদা হক, হাসুরা আকতার রুমকি, কাজী নওরিন মিশা, তানিয়া আকতার সুরাইয়া, তাজমুল হোসেন, সৈয়দা আফসানা কেয়া, সামিনা জাহান, আফরোজ শাম্মি ও মামুনুর রশিদ।

পৃথিবীজুড়ে চারুশিল্পের প্রধান দুটি ভাগ। একপক্ষে প্রাচ্যশিল্প, অন্যদিকে পাশ্চাত্যশিল্প। বাংলা-পাক-ভারত-পারস্য ও চীন-জাপানসহ এশিয়া মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হাজার বছর ধরে জলরঙে ওয়াশ দিয়ে যে-শিল্পধারা প্রচলিত সে-ই তো প্রাচ্যকলা। এই গোটা অঞ্চলজুড়ে প্রাচ্যশিল্পের চর্চা হলেও এক দেশ থেকে আরেক দেশের শিল্পধারায় তাদের জীবনধারার মতো ভিন্নতা দেখা যায়। তা সত্ত্বেও প্রাচ্যশৈলীর মূলধারা ও দর্শনগত সাযুজ্য বিদ্যমান থাকায় প্রাচ্যশিল্প তার স্বাতন্ত্র্য নিয়েই বিকশিত হয়েছে এবং টিকে আছে। সপ্তদশ শতকে ভারতবর্ষে ব্যবসার কারণ দেখিয়ে ইংরেজদের আগমন, শাসকদের অনৈক্যের সুযোগে ভারতের শাসনভার গ্রহণের প্রভাবে ভারতবর্ষে পাশ্চাত্যশিল্প নিজের জায়গা করে নেয়।

গত শতকের প্রথমার্ধে শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর হ্যাভেল সাহেবের অনুপ্রেরণায় ভারতশিল্পের শেকড় সন্ধান করে পুনর্জাগরণের আহবান জানিয়ে নববঙ্গীয় শিল্পরীতির প্রবর্তন করেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষায় পাশ্চাত্য পদ্ধতি আরোপ হওয়া ও উচ্চশিক্ষায় পাশ্চাত্যযাত্রার সহজ সুযোগ থাকায় নববঙ্গীয় শিল্পধারা তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তবে গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আমাদের দেশের প্রধান শিল্পীদের চিত্রপটে বাংলার লোকশিল্পের সঙ্গে আধুনিক শিল্পবোধের সমন্বয়ে যে-শিল্পধারা গড়ে ওঠে তাকেও তো এ মাটি ও শেকড়ের শিল্পঘরানা বলা যায়। এবং প্রাচ্যে বিকাশ, প্রাচ্যে অধিবাস হেতু সেটিও একপ্রকার প্রাচ্যকলা। জয়নুল-কামরুলরা সেটি উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠার পর শিল্পাচার্য জয়নুলের আগ্রহে ১৯৫৫ সালে প্রাচ্যকলা বিভাগের জন্ম। শেকড় চেনার ও শেকড় বিস্তারের একটা সুযোগ ছিল সেটি। প্রাচ্যকলা বিভাগে নানা সময়ে শিক্ষকতা করেছেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম, হাশেম খান, আবদুস সাত্তার ও শওকাতুজ্জামান। এ-বিভাগের শিক্ষক দেশের কৃতীশিল্পী নাসরীন বেগম তাঁর মেধা প্রজ্ঞা ও দক্ষতা  দিয়ে প্রাচ্যকলার শিল্পমূল্যকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

আশার কথা, প্রাচ্যকলাকে মূলধারার শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে চলেছে ওরিয়েন্টাল আর্ট স্টাডি গ্রুপ নামে এ-শিল্পীদলটি। তাঁরা চায়, শুধু ঐতিহ্যবাহী রূপায়ণে নয়, প্রাচ্যশিল্প এগিয়ে যাক নতুন ধ্যান-ধারণায় সমসাময়িক বিষয়কে ধরে। প্রদর্শনীর কাজগুলোয় সেই চিন্তার অনুরণন দেখি। অবন ঠাকুরের ওয়াশ পদ্ধতি প্রায় অক্ষুণ্ণ রেখেই শিল্পীরা আধুনিক ধ্যানে তাঁদের বিষয়গুলোকে উত্থাপন করেছেন।

তাজুল ইসলাম পূর্ণাঙ্গ প্রাচ্যকলা বিভাগের প্রথম শিক্ষার্থী। রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে সহায়ক-শিল্পী হিসেবে ট্যাপেস্ট্রির কাজের জন্য তিনি খ্যাত হয়েছেন। ময়ূর পেখমের মতো বর্ণিল বিস্তার নিয়ে ‘ফর্ম অ্যান্ড কালারস’ শিরোনামে অস্বচ্ছ জলরঙে তিনি এঁকেছেন আলংকারিক কায়দায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলার শিক্ষক সুশান্ত কুমার অধিকারী এঁকেছেন ‘শিরোনামহীন’ এমন এক ফিগর কম্পোজিশন, যেটিতে পাঁচজন দৃশ্যমান। একজন ফুটপাতে বসে দা দিয়ে আখ ছিলছেন, দুজন মেশিনে আখ থেকে রস বের করার কাজে ব্যস্ত আর দুই তরুণ-তরুণী ক্রেতা দাঁড়িয়ে। শিল্পী ছবিটি এঁকেছেন ঐতিহ্যবাহী ওয়াশ পদ্ধতিতে। এ-কাজটি এমন যেটি পেছন ফিরে না তাকিয়ে সমসাময়িকতাকে তুলে ধরেছে।

তারিক ফেরদৌসের ‘নারী ও ফুলদানি’ শীর্ষক কাজটিও এ সময়ের সৌন্দর্যপ্রিয়তাকে তুলে ধরে। মলয় বালার অাঁকা শেকড়ের বিস্তারে শকুন্তলা, কান্তিদেবের দেয়ালের ফাঁক গলে জন্ম নেওয়া সবুজের আশ্বাস বিষয় ও উপস্থাপনায় চিরকালীন। গোপাল সাহা ও অমিত নন্দীর রবীন্দ্রনাথ করণকৌশলে আধুনিক। জাঁনেসার ওসমানের  জলরং কাজটি কাগজে জল ভিজিয়ে রং ছেড়ে দিয়ে গড়াতে দিয়ে করা।

জাহাঙ্গীর আলমের সরাচিত্র কাগজ ভিজিয়ে গুঁড়ো পিগমেন্ট ঢেলে করার পদ্ধতিটি তেমন প্রচলিত নয়। এভাবে কাজ করায় ফলাফলের অনিশ্চয়তা থাকলেও তাঁর দুটি চিত্রকর্ম বেশ মজাদার মনে হয়েছে। সুমন বৈদ্যের জলরং চিত্রে বাংলার বর্ষার স্নিগ্ধতা তুলে ধরা হয়েছে। সীমা ইসলামের অাঁকা নারীদেহের সৌন্দর্য বিবরণীর অস্পষ্টতার আকর্ষণ দৃষ্টি কেড়েছে। অন্যদিকে সুনীত কুমারের অাঁকা ‘নৃত্যরত বালিকা’ অ্যাকাডেমিক রীতির একটি ভালো কাজের নমুনা।

শিল্পে উচ্চশিক্ষার সুবাদে ড. রশীদ আমিন দীর্ঘকাল চীনদেশে থাকায় চীনা ঐতিহ্যবাহী শিল্পচর্চার নানা খুঁটিনাটি, করণকৌশল দেখেছেন ও দর্শন উপলব্ধি করেছেন অত্যন্ত কাছ থেকে। সেই অভিজ্ঞান তিনি প্রাচ্যকলা অনুশীলন শিল্পীদলের কর্মশালায় বয়ান করেছেন। প্রদর্শনীর ব্রোশিওরে প্রাচ্যশিল্পের অনুষঙ্গ নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী একটি লেখার সঙ্গে অাঁকা ‘মন-ছবি ২’ দারুণ উপাদেয় হয়েছে। জলরঙের এ-কাজটিতে শিল্পী স্বচ্ছন্দে নানা রংকে খেলতে দিয়েছেন।  রং ছড়িয়ে-গড়িয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ফর্ম ও নানামুখী রেখা, যেন বৃক্ষের জড়াজড়ি, ফাঁকে ফাঁকে একচিলতে আকাশের আশ্বাস। নিজের গ্রামের স্মৃতি বর্ণিত হয়েছে জাহিদ মুস্তাফার চিত্রে। শিল্পীদলের এ দুজন প্রাচ্যকলায় পাঠ নেননি। গুপু ত্রিবেদী প্রাচ্যকলার শিক্ষক, নিজে অাঁকেন যামিনী রায়-কামরুল হাসানদের থেকে নেওয়া লোকজ ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে। প্রদর্শনীতে তাঁর রেখাচিত্রের শিরোনাম ‘রেখার মায়া’। গাছপালার আবহে দীর্ঘাঙ্গী এক নারীর প্রোফাইল অবয়বের স্নিগ্ধতা দর্শকচোখে মুগ্ধতা আনে।

এ-ধরনের আরো আয়োজনের ভেতর দিয়ে প্রাচ্যকলার আধুনিক যাত্রা বেগবান হোক, আমাদের শিল্পের মূলধারা আরো শক্তিমান হয়ে উঠুক। উদ্যোক্তাদের জন্য শুভকামনা।