প্রিয়জন চলে যান না- ফেরার দেশে, থেকে যাই অভাগাজন!

ছাব্বিশ নভেম্বর, দু-হাজার উনিশের সকালে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের (বাস্থই) সাবেক সভাপতি এবং আর্কএশিয়ার আগামী সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত প্রিয় বন্ধু স্থপতি ড. আবু সাঈদের ফোনে ঘুম ভাঙল! মধ্যরাতে বা ঊষালগ্নে কোনো ফোন পেলে আমার একষট্টি বছরের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে, ভয় হয়; মনে হয় খুব প্রিয় কিছু হারানোর খবর আসবে! হলোও তাই। সাঈদের মুখে শুনলাম আমাদের গুরু, অভিভাবক, প্রিয়জন, দেশবরেণ্য স্থপতি ও কবি, রবিউল হুসাইন, আমাদের সকলের প্রিয় রবিদা আর আমাদের মাঝে নেই!
নেই শোনার পর ফোনের কথা থেমে গেল, দুজনেই লাইনে কিন্তু কথা নেই, নির্বাক! কষ্টের বোঝাকে লালন করতে হবে Ñ এমন ভাবনা থেকেই মনে হলো, আমাদের এই
পথচলার জীবনে, জীবনবৃত্তের কেন্দ্রের খুব কাছের একজন মানুষ আজ সকালে নেই হয়ে গেলেন!
কেউ ছিলেন কিন্তু নেই! এই আছে এবং নেইয়ের মাঝে শূন্যতার যে-ব্যাপ্তি, কষ্টের যে-তীব্রতা তা অন্তরে, অনুভবে নিতে হলে যাঁর জন্য হৃদয়ে এই ক্ষরণ হয় সেই মানুষকে চিনতে হয়, নিজ মনের গহিন থেকে তাঁকে অনুভবে নিতে জানতে হয়, তাঁর মনে খানিকটা হলেও জায়গা করে নিতে হয়!

দুই
বাংলাদেশে এশিয়ার একুশটি দেশের স্থপতিদের সম্মেলন ‘আর্কএশিয়া ফোরাম … বিশ’ শেষ হতে-না-হতেই খবর এলো রবিদা অসুস্থ! তাঁর এ-অসুস্থতার খবরে প্রয়াণের কয়েকদিন আগে এক সকালে, স্থপতি কাজী নুরুল করিম, দিলুভাই হিসেবেই বেশি পরিচিতি তাঁর, তিনি আর আমি বিশেষ অনুমতি নিয়েই বিএসএমএমইউতে রবিদাকে দেখতে গিয়েছিলাম! দেখা হলে তিনি হাসপাতালের বিছানায় বসে আমাদের বললেন, ‘একটু দূরে বসুন, আমি তো এখন জার্মের কঠিন ডিপো!’ সেদিন সকালের তিরিশ মিনিটের আমাদের তিনজনের কথোপকথনে তাঁর কত কথা, কত স্মৃতিচারণ! সেই সময়কালেও বাস্থই নিয়ে কথা, সদ্যসমাপ্ত আর্কএশিয়া সম্মেলন নিয়ে কথা! আমরা না করলেও তিনি বলছেন আর আমরা শুনছি! আসলে তাঁর যে বলতেই হবে, বাস্থই, স্থপতি ও স্থাপত্য যে তাঁর হৃদয়ের গহিনে প্রোথিত!
পঁচিশে নভেম্বরের রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দিলুভাইয়ের সঙ্গে পরদিনের প্রোগ্রাম ঠিক করছিলাম! বলেছিলাম, সকালে রবিদার কাছে যাব, তাকে দেখব, একটু কথা বলে দিন শুরু করব! মনের সকল ইচ্ছে কখনো পূরণ হয় না, প্রকৃতি তা চায় না! হয়তো অতৃপ্তি শব্দটি জীবন থেকে হারিয়ে যাবে সেই ভয় থাকে
প্রকৃতির! ছাব্বিশের সকালে সাঈদের ফোন পেয়ে দিলুভাইকে জানালাম আর মোবাশ্বেরভাইকে! তিনজন মিলে হাসপাতালের পথে যাত্রা এবং তার মাঝে রবিদার ভক্তদের খোঁজ নেওয়ার উত্তর! পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেখি তাঁর বন্ধু আর ভক্তদের আগমন বাড়ছে! মাননীয় সংসদ সদস্য অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এবং কবি তারিক সুজাত সমুখে এগোলেন, সঙ্গে স্থপতি মোবাশ্বের আর নুরুল করিম! প্রাথমিক চিন্তা থেকে এলো, আজকে রবিদাকে শেষ গোসল দিয়ে তাঁর ধানম-ির বাসা ঘুরিয়ে আবার এনে হিমঘরে রাখা হবে, পরদিন সকালে কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে রাখা হবে সর্বজনের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য, তারপর জানাজা শেষে দাফন! নূরভাইকে বললাম, দাফনের আগে তাঁর প্রিয় স্থান বাস্থই প্রাঙ্গণের মাটি ছোঁয়াতে চাই! মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুলভাই বললেন জাদুঘরের কথা।

তিন
সকাল থেকেই প্রাণহীন রবিদার সঙ্গে আমরা! গোসলশেষে ধানম-ি, তাঁর বাড়ির চত্বরে তাঁকে রাখা হলো! দুপুরের দিকে প্রধানমন্ত্রী ধানম-িতে এলেন রবিদাকে শেষবারের মতো দেখতে! দুপুরে সেখানে জানাজাশেষে আবার বিএসএমএমইউর হিমঘরে! অপেক্ষা পরদিন সকালের!
স্থপতি, কবি রবিউল হুসাইন নিয়ে কত স্মৃতি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনজুড়ে! কত ঘটনা, দেশ এবং দেশের বাইরের! স্মৃতিচারণে তো একাধিক হৃষ্টপুষ্ট বইয়ের সম্ভার! এক জীবনে সে-স্মৃতির চারণে আমার এই জীবন তো অনেক বেশি ক্ষুদ্র, ধারণের বেশ বাইরে! আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল এশিয়া, সংক্ষেপে আর্কএশিয়া! এর অনেক কার্যকর কমিটির মধ্যে একটি কমিটি ফেলোশিপ কমিটি! যাঁরা দুবার আর্কএশিয়া কাউন্সিল মিটিংয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা ওই কমিটির সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং আর্কএশিয়া ফেলো হিসেবে বিবেচিত হন! এই কমিটি অনেকটা আর্কএশিয়ার চিন্তার ভান্ডার হিসেবে কাজ করে, প্রয়োজনে নির্বাহী কমিটিকে উপদেশ দেয়! এ-কমিটির নেতৃত্বকে বলে কমিটি কনভেনর, সেই কনভেনর নির্বাচনের জন্য আমরা একবার রবিদাকে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলাম! রবিদা জয়ী হলেন, তাঁর বিপরীতে যিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি ভাবতে পারেননি এমন করে হারবেন, বুঝতে পারেননি এশিয়ার দেশগুলোতে অন্যান্য স্থপতি নেতার কাছে রবিদার অবস্থান, তাঁর বন্ধুত্বের বিস্তৃতি কতদূর!
তাঁর নেতৃত্বের ওই সময়কালে দুই বছর রবিদার সঙ্গে থেকে কাজ করেছি এবং রবিদার কনভেনর থাকার সময়কালে যে প্রথম ফেলোশিপ ডিরেক্টরি বের করেছিলাম; এখনো সেটাই ফেলোশিপ কমিটির প্রথম প্রকাশনা। আশা করি আগামী বছর আরেকজন বাংলাদেশি ফেলোশিপ কনভেনর, রবিউল হুসাইনের প্রিয়জন, স্থপতি কাজী আরিফের দায়িত্ব পালনের সময়কালে দ্বিতীয় প্রকাশনা আসবে এবং সেখানে রবিউল হুসাইন আমাদের সকলের ভালোবাসার জায়গাটুকু নিয়েই থাকবেন!

চার
আর্কএশিয়া পরিবারের একটি রীতি আছে! আর্কএশিয়া সম্মেলনের শেষ দিনে সকল দেশের সদস্য স্থপতিরা মিলে একটি দারুণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন, বন্ধুত্বের রাত্রি! সদস্য সকলে নিজ নিজ দেশের বিষয় উপস্থাপনা করেন! এমন একটি আর্কএশিয়া সম্মেলনে আমাদের সঙ্গে একবার যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের এ-ধরনের কার্যক্রম পালনে অভিজ্ঞতা খুব বেশি উচ্চমানের না হওয়ায় কী করা যায় ভাবতে ভাবতে আমি একটি ছড়া লিখলাম আর্কএশিয়ার থিম নিয়ে, আর্কএশিয়া পরিবারের বন্ধুত্ব নিয়ে! নাম দিলাম, বেঁচে থাকুক আর্কএশিয়া! লেখাটি রবিদাকে দেখালাম, তিনি পুরো লেখাটি পড়লেন, লেখাটি ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে নিজেই উপস্থাপন করলেন ওইদিনের আয়োজনে! আবৃত্তির আগে সকলকে জানিয়ে দিলেন তিনি আবৃত্তি করলেও লেখাটি তার নয়, লেখাটি আমার! তিনি যেহেতু কবি তাই আরেকজন ক্ষুদ্র কবিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন! রবিদা বোধহয় এরকমই, নির্লোভ, অতি সজ্জন, বন্ধুবৎসল একজন মানুষ!
এমন একজন সুন্দর মনের মানুষের সঙ্গে আমার গভীর পরিচয়ের শুরু বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের (বাস্থই) নির্বাহী পরিষদে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে! তিনি সভাপতি আর আমি একজন নির্বাহী সদস্য মাত্র! এর আগে তাঁকে চিনতাম দেশের প্রখ্যাত উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের একজন স্থপতি কর্ণধার হিসেবে, মুখে কিছু আটকায় না এমন প্রতিবাদী এক তরুণ হিসেবে, কিন্তু আন্তরিকতা তখনো ততটা জন্মায়নি!
শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে যোগদানের আগে তিনি ছাত্র থাকাকালীন থেকেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বাস্তুকলাবিদে স্থাপত্য আচার্য মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে কাজ করেছেন, দুনিয়া-কাঁপানো প্রকৌশলী এফ আর খানের সঙ্গে কাজ করেছেন, পড়াশোনা শেষে স্থপতি আলমগীর কবির এবং স্থপতি সামসুল ওয়ারেসের সঙ্গে নিজেদের একটি প্রতিষ্ঠানও গড়েছিলেন! কিছুদিন খ-কালীন শিক্ষকতাও করেছিলেন তাঁর প্রিয় বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদে!
ধানম-ি চার নম্বর সড়কের লেকের তীরে বাস্থইয়ের সেই প্রথম অফিসে বসে নির্বাহী পরিষদে কাজ করতে গিয়ে অনুভব করলাম, কী বিশাল মাপের একজনকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, তাঁর নেতৃত্বে একত্রে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে! তারপর কাজের সূত্রে ক্রমান্বয়ে কাছে যাওয়া, ঘনিষ্ঠতা, এবং প্রতিদিন নতুন রূপে চেনা! আজ বাস্থই অনেক পরিণত, শিল্প ও সাহিত্যজগতের গুণীদের সঙ্গে অনেক অন্তরঙ্গতা! শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যের এই যে মেলবন্ধন, শিল্পী, লেখক ও স্থপতিদের যে-সম্পর্কের সূত্রপাত তার অনুঘটক ছিলেন রবিউল হুসাইন, সকলের প্রিয় রবিদা!

পাঁচ
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একটি পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের জন্ম নেওয়া কমিটিতে স্থাপত্য আচার্য মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে প্রথম নির্বাহী কমিটিতে তিনি প্রতিষ্ঠাতা ট্রেজারার হিসেবে যুক্ত ছিলেন! পেশাজীবীদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে নিজ পায়ে দাঁড় করানোর জন্য জীবনভর অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করেছেন রবিদা!
আসলে তিনি কর্মের প্রতি নিবেদিত একজন, মানুষের উপকারে নিয়োজিত একজন! সকলের ভালোবাসার এই পাত্র বাস্থইয়ের চারবারের সভাপতি, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থাপত্য ইনস্টিটিউটের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান সার্চের এক সময়ের সভাপতি, এশিয়ান স্থাপত্য ইনস্টিটিউটসমূহের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান আর্কএশিয়ার অন্যতম সহসভাপতি, আর্কএশিয়ার ফেলোশিপ কমিটির কনভেনর, কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের স্থাপত্য ইনস্টিটিউটের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান সিএএর সহসভাপতি, কবিতা পরিষদের সভাপতি, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের অগ্রযাত্রী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংগ্রাহক, বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট, ঢাকা নগর জাদুঘর, শিশুদের কচিকাঁচার মেলা, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এমনি কত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, সকল জায়গাতেই তাঁর সম্পৃক্ততা একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে!
১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ঝিনাইদহে জন্ম নেওয়া শিশুটির শেষ নিশ্বাসের সময়কাল ২০১৯-এর ২৬ নভেম্বর! ৭৬ বছরের সময়কালে তাঁর জীবনের অনেক উত্থান-পতন! জীবনযুদ্ধের একজন লড়াকু সৈনিক! অবিচল, দৃঢ় এক মনোবলের মানুষ! এ মনোবল না থাকলে পিতার মৃত্যুর পর সংসার এবং দায়িত্বের চাপে
কোথাও না কোথাও চাকরিতে ঢুকে জীবন থেকে হারিয়ে যেতেন তিনি! একরোখা, প্রতিবাদী এক তরুণের আর জন্ম হতো না! তাই তো স্থাপত্যের আঙিনায় ছাত্র থাকাকালীন ওই দুই কাঁধে পুরো পরিবারের ওজন নিয়েছিলেন সাহসের সঙ্গে! তাঁর জীবনের এই লড়াইয়ের চিত্র বারংবার এসেছে তাঁর লেখনীতে! চিরাচরিত বাকসোর বাইরে এসে কাজ করেছেন তিনি, স্বীকৃতি পেয়েছেন কাজের জন্য! বহু নান্দনিক স্থাপত্য সৃষ্টির জনক, বহু গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধের রচয়িতা, প্রকাশিত বহু বই তাঁর ভক্ত পাঠকদের হাতে! ২০০৯ সালে কবি হিসেবে বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত, পরে ২০১৩ সালে স্থপতি হিসেবে তাঁর সামগ্রিক কার্যক্রমের জন্য বার্জার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ২০১৬ সালে পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ সম্মান বাস্থই স্বর্ণপদক এবং ২০১৮-তে দেশের জন্য অবদানের ক্ষেত্রে অন্যতম এক সম্মাননা একুশে পদক! এমনি করে হারিয়ে না গেলে আমাদের স্মৃতির ভান্ডারে তাঁর পদকপ্রাপ্তির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ত, জীবনের কর্মক্ষেত্রে আরো নানাবিধ সম্মানে তিনি ভূষিত হতেন!

ছয়
রবিদা এমন একজন যাঁকে ভালোবাসেন না, তাঁর নির্মল হাসিতে মুগ্ধ নন, ভক্ত নন, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর! সে-কারণেই এই গুণাবলির কাছে সকল পুরস্কার মø­ান হয়ে যায়! দেশ কিংবা বিদেশ, যখনি কোনো স্থাপত্যের সম্মেলনে অংশগ্রহণ, তখনি আমার অন্যতম সঙ্গী রবিদা আর দিলুভাই! তাঁরা দুজন আবার আরো অন্তরঙ্গতায়, হোটেলে রুমমেট! তাঁর সঙ্গে আড্ডা, গল্পে আর জীবনের স্মৃতিচারণে হারিয়ে যেতাম আমরা! সদ্যসমাপ্ত আর্কএশিয়া সম্মেলনে অনেক দেশ থেকে অনেক গুরুস্থপতি বাংলাদেশে এসেছিলেন শুধু তাঁদের বন্ধু রবিউলের সঙ্গে দেখা করার জন্য! এমনি তাঁর গ্রহণযোগ্যতা, এমনি তাঁর বন্ধুভাগ্য! তাঁর প্রয়াণে আমার এই স্থপতিজীবনের একজন মেন্টর, বন্ধু, সহযোদ্ধা, অভিভাবক এবং বড়ভাইয়ের আদরের ছোঁয়া থেকে আজীবনের জন্য বঞ্চিত হলাম আমি!

সাত
আপনার পাশে বসে, স্পর্শ নিয়ে, স্নেহের পরশ নিয়ে এমনি আদরের ছবি আর কোনোদিন তোলা হবে না রবিদা! যেখানে চলে গেলেন সেখানে ভালো থাকুন, আমাদের মনের গহিনে জেগে থাকুক আপনার এই অনন্ত পথচলা! অন্তর্জালের জগতের এই ছবি তাঁর আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকুক, প্রিয় রবিদাকে আমার মাঝে নিয়ে আসুক বারংবার! শীত এলেই আমার গলায় একটি মাফলার ঝোলে! সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে টাই না ঝুলিয়ে এ-মাফলার ঝোলানোর জন্য অনেক বকাও খেয়েছি; কিন্তু মাফলার ছাড়তে পারিনি! যিনি বকা দিতেন, তিনিই আবার আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁর সঙ্গীদের বলতেন Ñ ‘ওর কথা বাদ দাও, শিল্পী মানুষ, যা মন চায় পরুক!’ আপনাকে দেখেই এটুকু আপনার থেকে নেওয়া, প্রিয়জনকে একটু অন্ধের মতোই অনুকরণের চেষ্টা! তাই তো কোথাও মাফলার কিনতে গেলে একই রকম দুটি হাতে উঠত Ñ একটি আমার, আরেকটি আপনার জন্য!
প্রখ্যাত স্থপতি ও নির্মাতা এনামুল করিম নির্ঝরের সঙ্গে একান্তে কথা বলার সময় রবিদা অকপটে স্বীকার করেছিলেন, স্থাপত্য নিয়ে তাঁর পড়ার অনুপ্রেরণা ছিল একটি চুরি করা স্থাপত্য ম্যাগাজিন! একটি চুরি মেডিক্যালের প্রাঙ্গণ থেকে স্থাপত্যের অঙ্গনে তাঁকে এনে দিয়েছিল! লাইব্রেরি থেকে তিনি ম্যাগাজিনটি চুরি করেছিলেন, তাঁর ভাষ্যে সেটাই তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ চুরি! রবিদা আপনি জানেন না, আপনার জীবনের কর্মে ও ব্যবহারে, নির্মল ও সরল হাসিতে আমাদের মতো লাখো মানুষের হৃদয় আপনার অজান্তেই আপনি চুরি করেছেন এবং এই চুরি প্রক্রিয়ায় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সক্রিয় থেকে গেছেন আপনি! তাই সাতাশ নভেম্বরের সকালে কেন্দ্রীয় শহীদমিনার প্রাঙ্গণে এবং বিকেলে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরটি, আপনার শেষ আবাসনের স্থানটি, বহুজনের মনের এবং চোখের জলে বারংবার ভিজেছিল!