প্রিয়াগ্নি

বুলবন ওসমান

দরজায় অশোক গাড়ির ভেঁপু বাজিয়ে চলেছে।

মমতা উষ্মা প্রকাশ করে, বাবা থাম! মানুষদুটোকে খাওয়া শেষ করতে দে!

ফজল আর তপন মোটামুটি খাওয়া শেষ করেই এনেছিল।

তপন স্ত্রীকে বলে, তুমি বাইরে গিয়ে অশোককে জানাও আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হাজির হবো।

মমতাকে বেরোতে হলো না।

অশোকের শুভবুদ্ধি। ভেঁপুর নিরসন।

আসলে বেলা বারোটায় ফাগুন মাসে আরামবাগ থেকে বিষ্ণুপুর যাওয়া বিড়ম্বনাই বটে।

কাঁটায় কাঁটায় বারোটা পাঁচে দুই সুহৃদ ছোট ছোট ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়ে।

আরো ঘণ্টাখানেক আগে বেরোতে পারলে ভালো হতো। বাবু, সবকিছু দেখে সারার আগেই অন্ধকার হয়ে যাবে।

তোমাকে তবে পাইলট নিয়েছি কেন! তপন মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে বলে।

অশোকের মুখেও হাসি। তার সঙ্গী অ্যাম্বাসাডার রোদ মেখে ঝকঝক করছে। গাড়ি অশোকের নিজের। সন্তানের মতো যত্ন। ওর বাড়ি খানাকুল থানায় – কামারশাল। পাশে রাজহাটি বন্দর। একদিকে নন্দনপুর, অন্য পাশে সবলসিংহপুর – ফজলদের গ্রাম।

আরামবাগ মহকুমা শহর হিসেবে বেশ ছিমছাম। শহরে নতুন নির্মাণ রবীন্দ্রভবন দেখার মতো। মার্বেলে মোড়া। দেড় হাজার ক্যাপাসিটি। নেতাজি সুভাষ-চত্বরও নজর কাড়ে। ফজলের শুধু একটা মূর্তির অভাব বোধ। পূর্ণ মূর্তিতে রাজা রামমোহন রায়। হুগলি কেন আধুনিক ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। রামমোহন কেন্দ্রে একটা বাস্ট মূর্তি অবশ্য আছে।

দারকেশ্বর নদীর ওপর গাড়ি। দুদিকে চোখ মেলে ফজলের নজরে আসে শুধু চর আর চর। রবি-কবির কবিতার মতো বাংলার প্রায় নদী ‘আমাদের ছোট নদী…’ -তে রূপান্তরিত। বিশেষ করে পূর্ববাংলায় বা বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গে কিছু কিছু নদীতে বাঁধ দেওয়ায় চাষের জন্য জল জমা থাকে। সব নদী সে-সুবিধা পায় না। যেমন ছেলেবেলায় তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে মুণ্ডেশ্বরী নদীতে শীতকালে পায়ের পাতা-ডোবা জল দেখত। এখন তা প্রায় আধেক ভরাট থাকে। কী স্বচ্ছ জল। নীলচে। রোজই প্রায় বাজারে চিঁয়োমাছ পাওয়া যায়। আগে অত পাওয়া যেত না। চিঁয়ো তার প্রিয় মাছ। এটা মুণ্ডেশ্বরীর জল ধারণের জন্য সম্ভব হয়েছে। এমনকি হুগলির পাশের জেলা বর্ধমানেও অনেকে চিঁয়োমাছ চেনে না। না দেখলে চিনবে কী করে! এটা হুগলি-হাওড়ার সাধারণ মাছ। একটা লালচে হয় … প্রায় ফুটখানেক লম্বা। ওটা অনেকে পছন্দ করে না। হালকা সবুজাভ ছোট চিঁয়ো খুব সুস্বাদু। ছোটবেলায় মামাবাড়ি ঝামটিয়ায় নিয়মিত পেত। দুটো খাল ছিল গ্রামের মধ্যে। একটা বড় খাল, একটা ছোট। দুটোতেই চিঁয়ো আর বাগদা চিংড়ি ছিল অঢেল। অন্ত্যজ শ্রেণির বাগদি মেয়েরা মাছ ধরে সোজা হাজির বড়দি মানে তার নানির কাছে। আর নানি কখনো কাউকে ফেরাত না। প্রয়োজন থাক বা না থাক।

দারকেশ্বর সেতু পার হয়ে অশোক গতি বাড়ায়। রাস্তা তেমন উন্নত নয়। কাজ চলার মতো। রাস্তার পাশে কিছু কিছু দোকানপাট। আস্তে আস্তে ফাঁকা মাঠ দেখা গেল। আর তালগাছের বাহার। কোথাও পুরো পুকুর ঘিরে।

কোথাও আলের সীমানা। কোথাও একা। আশপাশ জাতিগোত্রহীন। একপায়ে ছাড়া কোনো গাছই-বা দুপায়ে দাঁড়ায়! মৃত্তিকা-সংলগ্ন অনড় প্রাণ। হাওয়ার হিল্লোলে তাদের নড়ন।

দাদা, জলের বোতলটা দেখছি না, বলে তপন। আপনার ঝুলিটা দেখুন তো!

ফজল হাতড়ে চলে।

নেই।

তাহলে তো দু-লিটারের একটা বোতল কিনতে হয়।

বনলতায় গাড়ি থামাব। চা-ও খাবেন, জলও নেবেন, সামনে থেকে অশোকের আশ্বাস।

ঠিক আছে।

বনলতাটা কী?

জানতে চায় ফজল।

জয়পুর বনের মধ্যে রেস্ট হাউজ। সবকিছু পাওয়া যায়।

অশোক তপনকে বাক-খরচ থেকে বাঁচিয়ে চলে।

জয়পুর বনাঞ্চলটা কোথায়?

ওটা বাঁকুড়ায়। বিষ্ণুপুর যাওয়ার আগে পড়ে।

প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার বন। রাস্তাটা মাঝখান দিয়ে।

বাহ্, চমৎকার হবে! এদিকে যে বনাঞ্চল আছে আমার ধারণাই ছিল না।

বাঁকুড়া কিন্তু হুগলি-হাওড়ার মতো সমতল নয়। কিছুটা বীরভূম আদলের, বলে তপন। আর আমরা যেখানে যাচ্ছি বিষ্ণুপুর তো পুরোদস্ত্তর টিলাময়। মিনিয়েচার মালভূমি।

তাই বুঝি মল্লরাজাদের রাজত্ব!

একরকম তাই। অবশ্য মলস্ন বলতে বোঝায় কুস্তি। ওদের আদি মল্লের নাম রঘুনাথ। ৬৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ওদের রাজ্যের সূচনা। ওরা মল্লাব্দ চালু করেছিল।

বাহ্, ইন্টারেস্টিং।

এই মল্লরাজাদের রাজ্য বেশ বড় ছিল। বাঁকুড়া, বর্ধমানের কিছু অংশ, এমনকি পুরুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর এদের রাজ্যে কোনো বিচ্ছিন্নতা ঘটেনি। প্রায় ছাপ্পান্ন পুরুষ একটানা চলে ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজ নীলমণি সিংহের মৃত্যুর পর ১৯২৯ পর্যন্ত বিষ্ণুপুরের সিংহাসন খালি থাকে। ১৯৩০-এ কালিপদ সিংহ ঠাকুরের অভিষেক।

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন। তারপর রাজবংশের সমাপ্তি।

এই সময় রাস্তার দুপাশে বনাঞ্চল শুরু।

আমরা জয়পুর বনে ঢুকে পড়েছি, সামনে থেকে বার্তা অশোকের।

ক্রমশ বন বেশ বনের রূপ নিতে লাগল। সামনে এক জায়গায় বেশ পরিচ্ছন্ন দোকানপাটের দেখা মেলে। অশোক ভেতরে গাড়ি প্রবেশ করায়।

আমরা কোথায় এলাম?

বনলতা। বলেছিলাম না, চা খাওয়া যাবে। জল কিনতে পারবেন। তাঁতের কাপড় থেকে শুরু করে বালুচরিও পাবেন। হ্যান্ডিক্র্যাফটসের দোকানও আছে। ভেতরে রেস্ট হাউজ।

সুন্দর শেড দিয়ে চা-পানের ব্যবস্থা।

ভেতরে একটা বড় পুকুর। টলটলে জল।

পুকুরপাড়ে যাওয়ার আগে পড়ে একটা শীর্ণ ঝরনা। এটাকে রেস্ট হাউজ কর্তৃপক্ষ নালা করে সচল রেখেছে। জলের ধারা আপনমনে প্রবাহিত। একটা সঞ্চরণ-ধ্বনি কানে আসে।

পুকুরের ওপারে রেস্ট হাউজটি বেশ বড়। এপারে ওদের দফতর। কক্ষে প্রবেশ করে ফজল ট্যারিফ কার্ড চাইল।

যুবক কর্মী জানাল যে, ছাপানো নেই, তবে ওয়েভ লাইনে জানতে পারবেন। ফজল নোটবইয়ে টুকে নেয়।

অশোক ততক্ষণে চায়ের অর্ডার দিয়েছে। একটি ছেলে তার হাতে চায়ের পেপারকাপ ধরিয়ে দেয়।

চলেন দাদাবাবু, একটা গামছা কিনতে হবে।

পাশের দোকানে গিয়ে গামছা দেখে ছাই রঙের একটা গামছা পছন্দ করে অশোক।

গামছাটা জোড়া। দুটো একসঙ্গে।

হাত দিয়ে ফজলের মসৃণতা পছন্দ।

দুটোই নাও অশোক। আমি একটা নেব।

দোকানের বিক্রেতা মেয়েটি কাঁচি দিয়ে কেটে দুটো প্যাকেট করে দেয়। জোড়া একশ চল্লিশ টাকা। মনে মনে হিসাব করে ফজল, বাংলাদেশে এমন মোলায়েম গামছা একশর কম হতো না।

চা-পান, জল ক্রয়, গামছা কেনা সেরে তারা শকটে।

অশোক সজোরে সটান।

এই, আস্তে চালাও, তপনের মৃদু প্রতিবাদ।

না অশোক। আরো বেগ নাও।

আমার বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান শুধু নয়, মা-ও বেঁচে, ধারাভাষ্য তপনের।

আমার কেউ নেই। অশোক আরো জোর।

অশোক অবশ্য মধ্যপন্থা ধরে।

জয়পুর বনাঞ্চল বেশ গভীর। এদিকটা ঘন। গুল্মও আছে। প্রায় কুড়ি মিনিট পর বনাঞ্চলের সমাপ্তি। তবে টিলাময় অঞ্চলের রেশ।

খানিকপর বাঁদিকে ঘেঁষে অশোক গাড়ির গতি কমায়। একটা প্রায় সমাপ্ত তোরণের সামনে থামে।

এটা নতুন হচ্ছে। আমরা বিষ্ণুপুরে প্রবেশ করলাম।

বেশ কয়েকজন মিস্ত্রি কর্মরত।

চলো, এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই।

গাড়ি গতি নেয়।

খানিক পর বিষ্ণুপুর নগরারম্ভ।

বড় রাস্তার বাঁয়ে মূল নগর।

ফিরতিমুখী অনেক গাড়ি।

যারা সকালে এসেছিল ফেরত যাচ্ছে।

বেলা দুটোয় প্রবেশ। আসলে এটা দর্শনের বিপরীত সময়। তবে শীতকাতুরে ফজল ফাগুনের আগুনকে স্বাগত জানায়।

তারপরও একটা হালকা সোয়েটার গায়ে। কোট ছাড়তে পেরেছে। এতেই খুশি। মাথায় ক্যাপ লাগাতে ভোলেনি। ফিরতি পথের বিপত্তিকে সোয়েটারে বেঁধে নিয়েছে। এখন কিছুটা কষ্ট দিলে দিক। অবশ্য গরম ভালোই বোধ করছিল।

বিষ্ণুপুর ছোট মহকুমা শহর। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর হঠাৎ করে ফজল দূর থেকে মন্দিরচূড়া দেখতে পায়। আর তার অবাক হওয়ার পালা। ইট-নির্মিত পিরামিডের চূড়া।

কাছে পৌঁছে আরো অবাক।

পিরামিড-চূড়ার চারপাশে চৌচালা ছাদ। খিলান একেবারে সুলতানি আমলের মসজিদের মতো। থামগুলো বেঁটে। বর্গাকৃতির স্থাপনাটি একটা ইউনিক নির্মাণ। বাংলা কেন, ভারতবর্ষেও এমন আরেকটা নেই। তাহলে তো বিশ্বের অন্যতম।

ফটকে ফলক : রাসমঞ্চ। তার রাজশাহীর পুটিয়ার দোলমঞ্চটির কথা মনে পড়ে। এর কাছে ওটা নস্যি। বর্গাকৃতির স্থাপনাটি চবিবশ দশমিক পাঁচ মিটার। উচ্চতা বারো দশমিক পাঁচ মিটার। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মল্লরাজা বীরহাম্বির দেবের নির্মাণ। নির্মাণকাল সাত বছর। বোঝা যায় রাজকোষের কী পরিণতি হয়েছিল।

জানতে পারে জয়পুরের কাছাকাছি প্রদ্যুম্নপুরে ছিল আদি রাজধানী। মহারাজ জগৎমল্ল বিষ্ণুপুরে রাজধানী স্থানান্তর করেন ৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। আগে এই জায়গার নাম ছিল বনবিষ্ণুপুর। রাজপরিবার বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করায় বিষ্ণুপুর। নামের সার্থকতা।

টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করে তপন আর ফজল। টেরাকোটা ফলকগুলো দেখতে থাকে। বেশিরভাগ ফলক নষ্ট। এখনো নজর দিলে টেকানো যাবে। দক্ষ কারিগর দিয়ে মেরামত সম্ভব।

ফজল তপনের কাছ থেকে জানতে পারে রাজ্যের পুরাতত্ত্বের খরচ কেন্দ্রীয় সরকার বহন করে। তাই যা আছে এখনো আছে। রাজ্যের হাতে টাকা কোথায়! কেন্দ্রের কাছে ঋণ দুই লক্ষাধিক কোটি টাকা।

আগে কার্তিক মাসে রাসপূর্ণিমায় এই রাসমঞ্চে একশ আটটি বিগ্রহের সমাবেশে উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। এখন তা কৃষ্ণগঞ্জ ও মাধবগঞ্জ মহল্লায় অনুষ্ঠিত।

ভিটের ওপর চারদিক দুপাক দেয় ফজল। ভেতরে গর্তগৃহের মূর্তির অবস্থাও ভালো নয়। চত্বরটা বড় সুন্দর। ঘাসাচ্ছাদন সবুজ কার্পেট বুনেছে। মাঝে ছোট ছোট পাতাবাহার।

পুবদিকে মন্দির প্রাকার ঘেঁষে ঘন পাকাবসতি। আর একটু স্পেস পেলে মনোরম হতো মন্দির-চত্বর। এদেশে মানুষ এখনো স্পেসকে এনজয় করতে শেখেনি। বাগান আর বনাঞ্চলের পার্থক্য বোঝে না।

রাসমঞ্চ থেকে বেরোনোর পর অশোক বলে, দাদাবাবু, সোজা লালবাঁধ চলে যাই? তারপর হাঁটতে শুরু করবেন। সব তো কাছাকাছি।

ঠিক আছে, চলো, তপনের সায়।

অল্প দূরত্ব।

লালবাঁধের ঢালে অশোক একটা গাছতলায় গাড়ি পার্ক করে।

পাশেই জলাশয়।

লালবাঁধ মানে কী? মাটি লাল বলে? ফজলের অনুসন্ধান।

না। ব্যাপারটা তা নয়। ঠিক উলটো। জলাশয় কেন্দ্র করে এই বাঁধের নাম। জানেন তো বিষ্ণুপুর একটা খরাপ্রবণ অঞ্চল। তাই জলের আধার নির্মাণে রাজারা সাতটা জলাশয় করে এগুলোকেই বাঁধ বলে। সাতটা বাঁধের একটা লালবাঁধ।

বাকিগুলোর নাম কী?

শ্যামবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ, যমুনাবাঁধ, কালিন্দিবাঁধ পোকাবাঁধ … আর একটা ঠিক মনে আসছে না … ভাবতে থাকি মনে পড়ে যাবে … মনে পড়েছে … পাঁতাতবাঁধ। পাঁতাত মানে কী তা অবশ্য আমার অজানা।

অদ্ভুত নাম তো?

অদ্ভুতই বটে। বাকি নাম সব চেনাজানা শব্দ। এটা যে কী, অবশ্য ওই অঞ্চলের বয়স্ক লোকদের কাছে খোঁজ নিলে অর্থ মিলতেও পারে।

আজকে তো আমরা ঝটিকা সফরে এলাম, তারপর কয়েকদিন থেকে গেলে হদিস করা যাবে। বিষ্ণুপুর বাংলার ইতিহাসে এত পিছিয়ে কেন, আমি ভেবে পাই না। যারা বারো-তেরেশো বছর একটানা রাজত্ব করল, স্থাপত্য-সংগীতে এত অবদান রাখল তারা তো মর্যাদার দাবিদার। গৌড়ও তো একটানা রাজধানী থাকেনি। বিষ্ণুপুর তো ময়নামতির সমসাময়িক। সে-তুলনায় ঢাকা, মুর্শিদাবাদ তো অর্বাচীন।

গাড়ি থেকে নেমে তারা সামনেই পেয়ে গেল দল-মাদল কামান। যে-কামান নজরুল-সাহিত্যে বিখ্যাত। কাজী নজরুলের কামানে হেলান দেওয়া আলোকচিত্র সবার স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

এখন কামান গ্রিলঘেরা। পুরাতাত্ত্বিক নজরদারিতে।

তুমি আমার একটা ফটো নাও তপন, গ্রিলে ঠেস দিয়েই দাঁড়াই। নজরুল-কপি হোক।

হুকুম তামিল তপনের। এরপর ছিন্নমস্তা মন্দির। পাশে সর্বমঙ্গলা। ওটা ছাড়িয়ে মন্দির রাধামাধব আর কালাচাঁদ। মন্দিরগুলো সবই উঁচু ভিত্তির ওপর। ইটনির্মিত। বিষ্ণুপুরে স্থাপত্য ঘরানার ছাপ সুস্পষ্ট। বাঁকরৈখিক কার্নিশ সর্বজনীন মোটিফ, যা পরবর্তীকালে মুসলিম বা সুলতানি আমলের মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। বাংলার এই স্থাপত্যরীতিটি এতই মনোমুগ্ধকর যে, ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে তা গৃহীত হয়।

এমনকি লাহোর ফোর্টে আয়নামহলটি এর স্পষ্ট নমুনা। দাক্ষিণাত্যেও এর বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশে রাজশাহীর পুটিয়া আর দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরে এর প্রভাব সহজেই পরিলক্ষিত।

এবার তারা বিএড কলেজ রোড ধরে এগোয়। এখানে একঝাঁক বালিকা ছুটি পেয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে। ওদের ইউনিফর্ম ফজলের দৃষ্টি কাড়ে। সাদার ওপর হালকা গেরুয়া। বেশ একটা নয়নসুখকর রং। আর নবীন পোশাকধারীদের জন্য তা আরো জীবন্ত।

মেয়ের দলের পেছনে একজন তরুণীকে দেখে। সাইকেল ঠেলে এগিয়ে আসছে। নিশ্চয় একজন দিদিমণি। পড়ন্ত আলো মুখে। সুদর্শনার সাজ আরো বাড়িয়েছে।

তপন, তুমি একটু এগোও। আমি ওই দিদিমণির সঙ্গে আলাপ করব।

আজ্ঞাবহ তপন এগিয়ে যায়।

মেয়েদের দঙ্গল পার হওয়ার পর সাইকেল সামনে আসতেই তরুণীর সামনে গিয়ে নমস্কার জানায় ফজল।

আমি ঢাকা থেকে। আপনাদের স্কুলের ইউনিফর্মটা তো বড় সুদিং কালারের।

আপনি ছবি আঁকেন?

শখে। মূলকর্ম সাহিত্য। শিক্ষকতা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বাহ্! আপনি তো তাহলে একজন সেলিব্রেটি।

আরে না। অর্ডিনারি মানুষ। মোস্ট অর্ডিনারি। তবে ভাগ্যে বাংলা অ্যাকাডেমি আওয়ার্ডটা জুটে গেছে।

ধরা পড়ে গেলেন।

ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি … গুনগুনিয়ে ওঠে ফজল…

ওটা রামকেলি রাগে বাঁধা…

দাদরা…

সংগীতচর্চা করেন?

ওটা পাস্ট টেন্সে।

কিয়াবাত … এখনো ঠিকঠাক আছেন…

তুমি গান করো? তুমি বলে ফেললাম!

স্বাভাবিক। আমারও পাস্ট টেন্সে।

একটা অনুরোধ যদি করি!

করে ফেলুন। সম্ভব হলে পূর্ণ করব।

তোমাদের নগর পরিক্রমায় সঙ্গ দেওয়ার মতো কাল আছে?

খানিক চুপ করে থাকে মেয়েটি। তারপর বলে, ঠিক আছে। কিছুটা সময় বের করা যাবে।

দেখো, তোমার নামটাই জানা হয়নি।

প্রিয়াগ্নি।

তোমরা কি লোকাল?

লোকাল হয়ে গেছি। ঠাকুরদা সরকারি চাকরি করতেন। তিনি যখন এখানে আসেন প্রায় ছিল বনাঞ্চল। তার ভালো লেগে যায়। বাড়ি করে ফেলেন। আমাদের আসল বাড়ি কিশোরগঞ্জ … ময়মনসিংহ।

তার মানে বাংলাদেশি!

খুব যেতে ইচ্ছে করে।

আমার সঙ্গে চলো। কবি চন্দ্রাবতীর আবাসস্থল দেখে আসবে। ও হ্যাঁ, তোমাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি তোমার ডিসিপ্লিন কী?

প্রথমে বাংলা। পরে ইংরেজি সাহিত্য।

ওরে বাবা! আমি তো তোমাকে কিশোরী মনে করেছিলাম।

কেন, এখন কি বুড়ি লাগছে?

বুড়ি। বুড়ি হতে যাবে কেন! তোমাকে আমার সমীহ করে চলতে হবে। বাবা, ডাবল এমএ, তা-ও আবার সাহিত্যে! কাব্যচর্চা আছে?

যৎসামান্য। ওই বয়সধর্ম অনুযায়ী।

পুস্তক?

নৈব নৈবচ…

চ-র পরে ছ। ছ কিন্তু ছাপার সময় ব্যবহৃত।

জাস্ট মনের খেয়ালে লেখা। কবি হবো বলে লিখি না।

হাঁটতে হাঁটতে মোড়ে পৌঁছে প্রিয়াগ্নি হতাশ মুখ করে ফজলকে বলে, আপনার ভাগ্য খারাপ।

কেন?

সামনে কী দেখছেন?

জাদুঘর।

ফটকে নজর দিন।

তালা।

বোধগম্য হলো?

আজ তো সোমবার!

আমাদের সোমবার জাদুঘর বন্ধ।

তিনতলা ভবনটির একটা ফটোগ্রাফ নিয়ে নেয় ফজল। অন্তত জাদুঘর ভবনটি ক্যামেরায় থাক। আফসোস। বন্ধের দিনটা জানা থাকলে আসত আগামীকাল। এত তাড়াহুড়ো করত না। অবশ্য সব জায়গায় একটা নেক্সট টাইম থাকে। তারা জাদুঘর বাঁয়ে রেখে এগিয়ে চলে। রাস্তার ডানে একটা নামি শাড়ির দোকান। বিষ্ণুপুরের বালুচরি বাংলা কেন, ভারতবিখ্যাত।

দেখবেন নাকি শাড়ি?

না। পরে আবার আসব ওদের বয়ন কৌশল দেখতে।

কারো জন্য একটা শাড়িও নেবেন না? না। কেউ নেই। একটাই বোন ছিল, বছরতিনেক হলো মারা গেছে, ঘর একেবারে শূন্য। কিছুটা ধারণা করে ফজলকে বুঝতে পেরেও প্রিয়াগ্নির নীরবতা।

খানিক এগিয়ে একটা পুরনো মন্দির দেখে ফজল জানতে চায়, এটা মেরামত হয়নি কেন? সারা গায়ে ঘাস-লতাগুল্ম?

বিষ্ণুপুরের পুরাকীর্তি সবটা কেন্দ্রীয় সরকার তদারকি করে। এটা হয়তো আর মেরামতযোগ্য নয় মনে করছে। তবে এই মন্দিরের নাম মহাপ্রভু মন্দির। ছিল জোড়বাংলা। অষ্টাদশ শতকের।

সামান্য এগোতে একটা ফাঁকা জায়গা। তারপর একটা একতলা বাড়ি। দেয়ালঘেরা। পুরো দেয়াল ও বাড়ি নতুন রং করা। বাসন্তী রঙে উজ্জ্বল।

ঘরটার একটা ছবি তুলতে হয়। কী চমৎকার হলুদ!

খুবই আনইউজুয়াল রং, লেমন ইয়েলো।

চমৎকৃত হয় ফজল।

তুমি নিশ্চয় ওয়াটার কালার করো।

করতাম। এই লেখাপড়া … সব বরবাদ করে দিয়েছে। ছবি এঁকে শহরে অনেক প্রাইজও পেয়েছি। এমনকি বাঁকুড়াতেও।

কলকাতা?

কলকাতা অবধি যাওয়া হয়নি। তার আগেই সমাপ্তি।

এখনো করতে পারো। রবীন্দ্রনাথ আমাদের ছবি আঁকার প্রেরণা। ভেবে দেখো, সত্তর বছর বয়সে কাজ শুরু।

ক্ষণজন্মা পুরুষ।

দেয়ালের পাশে ভাঁটফুলের রাজত্ব। মিষ্টি গন্ধ আসছে। প্রিয়াগ্নির পাশে হাঁটতে হাঁটতে ফজল তেমনি একটা সুবাস পায়। দূরে পিউ কাঁহার তান। কেমন একটা ঘোর পেয়ে বসে।

কেন জানি ভেতর থেকে তার সংগীত জেগে ওঠে : বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের … শিস দিয়ে গায়।

আরো এগোলে সামনে ডানে পড়ে টিলাসদৃশ ঢিবি। তার ওপর বর্গাকৃতির একটি স্থাপনা। লাল ইট কালচে হয়ে গেছে। ফলকে বড় বড় অক্ষরে লেখা : গুমগড়।

গুম শব্দের সঙ্গে ফজল সম্প্রতি রাজনীতির অনুষঙ্গ বোধ করে।

গুমগড়টা কী প্রিয়াগ্নি?

কথিত আছে রাজারা মানুষকে ধরে এনে শাস্তি দিত। আবার অনেকের ধারণা এটা রাজাদের গোলাঘর। তবে যেসব নমুনা পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় এটা ছিল জলের ট্যাংক। তাই টিলার মাথায় অবস্থিত। গুমগড় বা গুমঘর এত প্রকাশ্যে হওয়ার কথা নয়।

গুমগড়ের পশ্চিমদিকের সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে তারা একটি মনোরম মন্দিরের সামনে দাঁড়ায়।

মন্দিরের চূড়া দেখছি পাঁচটা, মন্তব্য ফজলের।

এটা শ্যামরায় মন্দির। লোকে পাঁচচূড়া মন্দিরও বলে। এটা ১৬৪৩ সালে মলস্নরাজ হাম্বিরের পুত্র রঘুনাথ সিংহের তৈরি।

ফজল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। পোড়ামাটির এত নিখুঁত অলংকরণ সে কম দেখেছে।

এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় দেয় ফজল। এত অলংকরণ। রামায়ণ-মহাভারতের নিখুঁত ইলাস্ট্রেশন।

এবার আমরা উত্তরদিকে যাব, বলে প্রিয়াগ্নি। দেখব মৃণ্ময়ী মন্দির।

আচ্ছা, তোমাকে একটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করব?

নির্ভয়ে।

আচ্ছা, তোমার নাম প্রিয়াগ্নি কে রাখল? এত অরিজিনাল। আমার জীবনে প্রথম এই শব্দটা শুনলাম। তা-ও আবার নাম হিসেবে। কে রেখেছিল তোমার নাম? আর এর তাৎপর্যই-বা কী?

ওরে বাবারে। এ তো একেবারে সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার প্রশ্ন হয়ে গেল।

উত্তর আকাঙ্ক্ষিত।

আমি যখন জন্মেছিলাম, আভা নাকি ছিল আগুনের মতো। নামটা রেখেছিলেন আমার ঠাকুরমা।

তিনি কবি ছিলেন?

ঠিক কবি নন … তবে কথায় কথায় প্রচুর ছড়া কাটতেন … আর ঠাকুরমার বাবাবাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহে।

কবি চন্দ্রাবতীর নাম শুনেছ?

অফকোর্স।

ঠাকুরদার বাড়ি?

নেত্রকোনা।

উত্তরাধিকার সূত্রে বাঙাল।

অফকোর্স … বেশ জোর দিয়ে বলে প্রিয়াগ্নি।

এই যে একতলা মন্দিরটি দেখছেন এটা মৃণ্ময়ী মন্দির। অদূরে পেছনে যে ধ্বংসাবশেষ, ওখানে ছিল রাজবাড়ি। আজ সব স্তব্ধ। এই মন্দিরে যে-মূর্তিটি দেখছেন, কথিত আছে এটা গঙ্গামাটির তৈরি। দুর্গাপুজোর সময় পনেরো দিন ধরে পুজো চলে। এই মন্দির বেশ পুরনো। হাজার বছর পার হয়ে গেছে। তোপধ্বনি করে মায়ের পুজো আরম্ভ হয়। এখনো এই ঐতিহ্য বজায় আছে। প্রচুর দর্শনার্থী আর পর্যটক আসে। রামকৃষ্ণও মাকে দর্শনে এসেছিলেন।

সামান্য এগিয়ে ফজলের চোখে আরো একটা বাড়ির ওপর নজর পড়ে। একেবারে প্রথম বাড়িটার মতো লেমন ইয়েলোয় লেপা। সামনে দোল বলে কি এরা এমন রং করেছে!

এই সময় বালকদিগের সর্দার ফটিকের মতো ফজলের মাথায় দুষ্টুমি জাগে।

সে বলে, এই বাড়িটাও দেখছি হলুদ।

বসমেত্মর রং তো!

তোমার গায়েহলুদ কবে?

হবে না। প্রিয়াগ্নি গম্ভীর।

মানে?

হবে না। প্রিয়াগ্নি ভাবান্তরহীন।

কেন হবে না?

জানি না।

ফজল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমি জানি।

তাই নাকি!

হ্যাঁ।

শুনি, কেন?

আচ্ছা, তুমি কি বাড়ির প্রথম সন্তান?

হ্যাঁ।

ভাইবোন কি সাত-আটজন?

একজাক্টলি। তোমার এমন মনে হলো কেন? তুমি বলে ফেললাম … ঠিক আছে। মেঘে ঢাকা তারা সিনেমা দেখেছ?

হ্যাঁ।

বাংলায় কেন, সারা ভারতে একটা সময় গেছে যখন সংসারে একজন নিজেকে সবার মঙ্গলের জন্য বিলিয়ে দিত। কারো কাছ থেকে কিছু আশা না করে। এত করেও কিন্তু কারো মন পেত না। সব মুখ বুজে সহ্য করে যেত। একসময় এগজস্ট হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাওয়ার উপক্রম। তখন বাকিরা ভাবত তাদের বঞ্চিত করার জন্যই রোগ বাধিয়েছে।

কিছুক্ষণ প্রিয়াগ্নি ফজলের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

একসময় বলে, আচ্ছা, তুমি কি বাড়ির বড় ছেলে?

হ্যাঁ।

তোমার কি সাত-আটজন ভাইবোন?

একজাক্টলি।

দেখো, তোমার সঙ্গে আমার কী অদ্ভুত মিল!

অমিলও আছে। বয়স। তুমি বাঙাল অরিজিন। আমি ঘটি। থাকি বাংলাদেশে।

মূল বাড়ি কোথায়?

বিষ্ণুপুরের কাছেই। আরামবাগ।

হুগলি!

হ্যাঁ। আগে আরামবাগের নাম ছিল জাহানাবাদ।

জানতাম না। তবে তুমি যে সিঙ্গেল তা আগেই ধরতে পেরেছি।

কেমন করে? আমি তো তোমার হাত ধরার চেষ্টা করিনি!

তা করোনি, কিন্তু শাড়ি কেনায় অনাগ্রহ দেখেই বুঝেছি।

তোমার নামটা এমন টাচি, একটু সংক্ষেপে যে ডাকব তার উপায় নেই। কথা ঘোরানোর জন্য প্রসঙ্গ পালটায় ফজল।

টাচি মানে!

প্রিয়া বলা যার তার সাজে না। তারপর অগ্নি বললে তুমি অগ্নিমূর্তি ধারণ করতে পারো।

সংক্ষেপ করার কি প্রয়োজন আছে?

না; তা নেই। তবে এতক্ষণ ধরে হাঁটছি, পর পর ভাবটা তো রয়েই গেল।

পরই তো আপন হয়। আপন আর আপন হবে কী করে!

এটা তো ভেবে দেখিনি।

বয়স বেশি হলেই কি সব জানা হয়ে যায়!

এই সময় তারা একটা মন্দিরের সামনে চলে আসে। এটা বেশ ভিন্ন প্রকৃতির মন্দির। ওপরের চূড়া বা রত্নটি বেশ উঁচু। বর্গাকৃতির বাঁকরৈখিক কার্নিশ খুবই দৃষ্টিনন্দন। মন্দিরে একসঙ্গে রাধাশ্যাম, নিতাই-গৌর আর জগন্নাথ ঠাকুরের মূর্তি পূজিত। মন্দির-সংলগ্ন তুলসীমঞ্চটি ওড়িষা স্থাপত্যরীতির। এটা রাধাশ্যাম মন্দির। মাকড়া পাথরে তৈরি, বলে প্রিয়াগ্নি।

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে তারা মন্দিরটা দেখে চলে।

মন্দির-চত্বর দেয়ালঘেরা। আছে নাটমঞ্চ। চমৎকার রান্নাঘর। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে আছে ইটের তৈরি সুদৃশ্য নহবতখানা। এখন অবশ্য তা শুধুই ইতিহাস। কালের নীরব সাক্ষী।

রাধাশ্যাম মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আরেকটা চমৎকার মন্দির।

বাহ্! জোড়বাংলা! প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে ফজল।

ঠিক ধরেছ, ওটা জোড়বাংলাই। এটা রাজা প্রথম রঘুনাথ ১৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করান। মূল নাম কৃষ্ণরাই। কিন্তু জোড়বাংলা নামেই বেশি পরিচিত। পোড়ামাটির অলংকরণে এটা শ্রেষ্ঠগুলোর মধ্যে একটা।

বেলা পড়ে এসেছে। রোদের রং কমলা। গোধূলি বলা যায়।

এই সময় তারা বড় একটা ফটকের সামনে এসে দাঁড়ায়।

এটা বড় পাথর দরজা, বলে প্রিয়াগ্নি। এটাই হলো বিষ্ণুপুরের উত্তরদিকের প্রবেশপথ। সৈন্যরা দোতলায় দুদিকে অবস্থান নিত। সম্ভবত সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে রাজা বীরসিংহ তৈরি করেছিলেন।

জায়গাটা বেশ টিলাময়। অদূরে বেশ কিছুটা ঢালে আরেকটা দরজা দেখা যাচ্ছে।

নিচে যেটা দেখছ ওটা ছোট পাথর দরজা।

এই সময় পেছনে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল।

ফজল পেছন ফিরে দেখে অশোকের অ্যাম্বাসাডার। আরো কিছুটা দূরে তপন কি যেন মনোযোগ দিয়ে দেখছে।

এখান থেকে নিচে শহর কোমল রোদে মায়াময় হয়ে উঠেছে। সে প্রিয়াগ্নিকে বলে, আচ্ছা, এরকম একটা পরিবেশ বিষ্ণুপুর নিয়ে লেখা গল্পের পটভূমিতে যদি থাকে, কী নাম দেওয়া যায় বলো তো?

বিষ্ণুপুর গোধূলিলগ্নে বা গোধূলিলগ্নে বিষ্ণুপুর। চটপট জবাব প্রিয়াগ্নির।

বেশ কাব্যময় নাম, কিন্তু এ-ধরনের নামের মধ্যে কোনো নতুনত্ব পাওয়া যাচ্ছে না।

তাহলে তুমি কী নাম দিতে চাও?

সিম্পল…

কী?

প্রিয়াগ্নি।

প্রিয়াগ্নি ফিক করে হেসেই গম্ভীর হয়ে গেল।

পেছন থেকে তপনের হাঁক, ফজলদা, ফিরতে হবে। সন্ধ্যার পর রাস্তায় জ্যাম হয়।

তপন তার ধ্যান ভেঙে এগিয়ে আসছে।

ফজল বুঝতে পারে এবার ফেরার পালা।

প্রিয়াগ্নি, এবার তো যেতে হবে। সময়টা বড় আনন্দে কাটল।

আমার যে কাটল নিরানন্দে।

মানে!

প্রথম দেখাতেই যে তোমাকে আমার ভালো লেগে গেছে!

বলেই আর অপেক্ষা করে না প্রিয়াগ্নি।

মুহূর্তের মধ্যে রেসিং সাইক্লিস্টের মতো সাইকেলে লাফিয়ে ওঠে। দ্রুত প্যাডেল চালায়।

গড়ানে সাইকেল সাঁইসাঁই করে ছুটছে। ছুটছে।

ফজল দেখে পড়ন্ত রোদ প্রিয়াগ্নির পিঠে সওয়ার। ওর পিঠে দাউ দাউ করে জ্বলছে।

ছোট দরজার কাছে গিয়ে প্রিয়াগ্নি হঠাৎ সাইকেল থামায়। এক পা মাটিতে রেখে ঘাড় ফেরায়।

ফজল তখনো একদৃষ্টে চেয়ে। প্রিয়াগ্নির মুখে রোদ। এত দূর থেকে তার চাউনি পড়তে পারল না।

মিনিটখানেক যায়নি। ঘাড় সিধে করে প্রিয়াগ্নি আবার সাইকেল আরোহী। এগিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে ছোট পাথর দরজার দেয়ালে আড়াল হয়ে গেল।