প্রিয় বন্ধু কবি রফিক আজাদ এখন গভীর ঘুমে

রবিউল হুসাইন

ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়াজুড়ে উন্মাতাল, উত্তেজনাময়, উদ্দীপক বিট, বিটল্স, হাংরি জেনারেশন – সেই ষাটের দশকে স্যাড জেনারেশন বা বিষণ্ণ প্রজন্ম আন্দোলনের ঘোষণায় কবি রফিক আজাদ উচ্চারণ করেছিলেন, আমরা গতানুগতিকতাবিরোধী, সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মধ্বংসী, মৃত্যুপরায়ণ, বিষণ্ণ। আমাদের একমাত্র বন্ধু সিগারেট, আমাদের রক্তের মধ্যে বিস্ফোরণোন্মুখ ডিনামাইট (জীবন নিরর্থক জেনে), আমরা নিঃশেষিত, বিব্রত, ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ।

১৯৪১-এর ১৪ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ২০১৬-র ১২ মার্চ পর্যন্ত পৃথিবী নামক গ্রহে সৃজন ও সৃষ্টিশীল কবিতা, কবি এবং কবিতা পত্রিকার স্রষ্টা ও বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, পরে শিক্ষক রফিক আজাদ মোট সাতাশ হাজার ছাপ্পান্ন দিন বিচরণ করেছিলেন। তাঁর জীবন বর্ণাঢ্য এবং বহুতল ও সত্মরে বিকশিত হয়েছিল। তিনি প্রচ- আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একজন স্থিতধী কবিপুরম্নষ ছিলেন। তাঁর ডাকনাম ছিল জীবন এবং বিষণ্ণ প্রজন্মের আত্মঘোষণার মধ্য দিয়ে রফিকের জীবনব্যাপী যাত্রাটি এমন স্পষ্ট, সহজ, সোজাসুজি ও উজ্জ্বল ছিল যে, তাঁর বাঁকবদল হয়নি একটুও। যেমন প্রাগুক্ত উচ্চারণ করেছিলেন ঠিক তেমনভাবেই তিনি চলেছেন একাকী নির্জন এবং দৃপ্ত পদাচরণে। টাঙ্গাইলের গুণী গ্রামে এই গুণী কবির জন্ম। বলতেন, অ্যাটম বোমার চেয়ে দুই বছরের বড় তিনি। তিনি কবিতা লিখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে কবিতা অন্যতম প্রধান সৃজনক্ষেত্র। এর একজন অতি পরিশ্রমী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি ও কবিতা নির্মাতা ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষাকে কবিতা দিয়ে শাণিত ও ক্ষুরধার করার অমিত ক্ষমতা ছিল তাঁর। প্রচলিত চিমত্মা-চেতনা ও মন-মননের মধ্যে না গিয়ে তিনি নতুন বোধ ও ভাবনা সৃষ্টি করেছেন। মুখের ভাষার সঙ্গে কবিতার ভাষা মিলিয়ে তার একটি বক্তব্য উপস্থাপনা করে পাঠকদের বিমোহিত করে তুলেছেন কবি। কবিতার মানদ- ও মেরম্নদ- নতুন চিমত্মার বক্তব্যপ্রধান শব্দব্রহ্ম দিয়ে প্রচলিত, প্রমাণিত ও বিবেচিত হয়। যে-শব্দাবলি কবি প্রকৃতি, মানুষ, জীবজন্তু, মাছ-পাখি, কীট-পতঙ্গ, প্রতিবেশ-পরিবেশ-পরিসর, স্থান-শূন্যতা আর রোদ-বৃষ্টি-মেঘমালা দিয়ে রচনা করে থাকেন বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাধীনতাযুদ্ধকে নিয়ে মূলত নিজের অভাব-দৈন্যকে পূরণ করতে, পরবর্তী পরিক্রমায় তা হয়ে ওঠে সবার, সব মানুষের। প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান, হাসি-কান্না, দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা-হন্যমান, অপমান-অবমূল্যায়ন সব পারস্পরিক সম্পর্কজাত এক মানবিক মিথস্ক্রিয়ার রূপান্তর ও রূপার্ঘ্য হয়ে কবির দ্বারা সুনির্বাচিত, সুবিন্যাসিত ও সুগঠিত শব্দাঞ্জলিই কবিতা হয়ে ওঠে। মানুষের বোধ, অনুভব জীবনের সীমানা ও সীমায় অবিরত প্রচলিত ও ঘূর্ণায়মান।

কবি রফিক আজাদ অনায়াসলব্ধ অবলীলায় সেগুলো ধারণ করে তাঁর পাঠক-অনুরাগীদের উপহার দিতেন এবং তিনি সেসব পাঠককুলের কথামালাকে কবিতার অনন্য শব্দে তাদের কাছেই তাদের হয়ে ফিরিয়ে দিতেন। সেই কারণে তিনি কবিতাকে শাসন করে তাঁর কবিতার সাম্রাজ্যে এক নিজস্ব কবিতাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। নিজে যেমন ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন, তেমনি কবি, গদ্যশিল্পী ও নাট্যকারদেরও তৈরি করেছিলেন। কারো লেখা ভালো লাগলে অকুণ্ঠ স্বরে তাকে উৎসাহ ও বাহবা দিতেন এই প্রশংসাবিমুখ সমাজে। এমনকি কবি-লেখকদের আকর্ষণীয় ও চমকপ্রদ নামও তিনি বেছে দিতেন। গদ্যশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি নাট্যকার সেলিম আল দীনেরও। তাঁর সেই বিখ্যাত কথন – বেটা শোন, তৃতীয় ধারার কবি হওয়ার চেয়ে তুমি সেলিম আল দীন নামে প্রথম শ্রেণির নাট্যকার হও। তারপর তা ইতিহাস হয়ে আছে। সেলিম আজ আমাদের জগতে নেই কিন্তু মিলনের মতো তিনি সারাজীবন রফিককে বাবা হিসেবে দেখেছেন। এমন ছিল কবি রফিক আজাদের পিতৃসুলভ অটুট স্নেহের বন্ধন। যেমন করে কবি রফিক আজাদ কবিতা, কবি বা লেখক তৈরি করেছেন, তেমন করে কবিতা ও সাহিত্যপত্রিকাও লালন করেছেন, যেমন স্বাক্ষর বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার, ইত্তেফাক গ্রম্নপের রোববার, ঘরোয়া প্রভৃতি। তাঁর সম্পাদনায় এসব পত্রিকায় কোনো লেখা ছাপা হলে সেই লেখক বা কবি সবার কাজে একটি সম্মানজনক স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতা পেতেন। তাঁর সম্পাদনার এমনই সাহিত্যমূল্য ছিল।

কবি হিসেবে তাঁর সৃষ্টিশীলতা যেমন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তেমনি সৃজনশীল সম্পাদক হিসেবেও। পত্রিকা-সম্পাদনের ভেতর দিয়ে তিনি অনেক প্রতিষ্ঠিত কবি-লেখক বাংলা সাহিত্যে উপহার দিয়েছেন। এখানে উলেস্নখ্য যে, তাঁর সম্পাদিত কোনো পত্রিকায় তিনি কোনো সময় নিজের লেখা প্রকাশ করেননি একজন প্রকৃত সম্পাদকের মতো। এই বিষয়ে তাঁকে উলেস্নখ করা যেতে পারে বুদ্ধদেব বসু, সিকান্দার আবু জাফর, আহসান হাবীব, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, বেলাল চৌধুরী এবং আবুল হাসনাতের সঙ্গে।

কবি রফিক আজাদ একজন সংগঠক হিসেবেও কীর্তি রেখে গেছেন। কবি আবু জাফর ওবায়দুলস্নাহ, কবি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে পদাবলী – যে প্রতিষ্ঠান ও পত্রিকার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম অর্থের বিনিময়ে টিকিট দিয়ে কবিতানুরাগীরা কবিকণ্ঠে কবিতা শুনতে হাজির হয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর এবং এরপরে সেনাশাসক এরশাদের অবাঞ্ছিত কবিতা ও কবিশাসন ব্যবস্থার প্রতিবাদে ১৯৮৭ সালে কবি সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমান, ছড়াশিল্পী-সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, কবি বেলাল চৌধুরী প্রমুখ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, যা এ-বছর ৩০তম জাতীয় কবিতা পরিষদ ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ হিসেবে উদ্যাপিত হলো বরাবরের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের হাকিম চত্বরে, তিনি এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি কবির দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

কবি রফিক আজাদ তাঁর ভিন্নধর্মী কবি-চরিত্র দিয়ে কবির অবদানে কবিতার রাজ্যকে মর্যাদাসম্পন্ন, মহিমান্বিত এবং রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে সম্মানিত এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন। সেইসঙ্গে ব্যতিক্রমী, কবিসুলভ আকর্ষণীয় ও অভাবনীয় কিছু কর্মকা-ও এ-প্রসঙ্গে উলেস্নখ করা যায়। সে-সময়ের পাঠকপ্রিয় বিচিত্রা পত্রিকায় ‘একটি চুমুর বিনিময়ে একটি কবিতা শোনানো হবে’ বা নারীদের অত্যাচার ও ভালোবাসাহীন দুঃখ-কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য ‘পুরম্নষ রক্ষা সমিতি’ গঠন খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এসবের মূলে ছিলেন কবি রফিক আজাদ। কোনো একজন কবি এর সমালোচনা করলে তিনি তাঁর এক বিখ্যাত কবিতায় এর জবাব দিয়েছিলেন – বিষম ভুল করে ভুল জলে বালক অগভীর জলে নেমেছে, যে জীবনের বানান জানে না, জীবনে পড়েনি কোনো মূল বই – এরকম তির্যক ভাষায় তিনি বলতেন, শ্রেণিকক্ষে যা শিখেছেন তার বেশি আড্ডায় শিখেছেন। কবি রফিক আজাদ পরিবারপ্রিয়, স্ত্রী-সমত্মানপ্রিয়, বন্ধুপ্রিয় ও যে-কোনো আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন এবং শুধু কবিতা দিয়ে আলোড়ন, উন্মাদনা ও চমক সৃষ্টি করেছেন। কোনো কবির দ্বারা এরকম মনোহর কোনো কবিকীর্তি আর দেখা যায় না। রাইফেল-হাতে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধাস্ত্র যেমন পাক শত্রম্নদের বিরম্নদ্ধে ব্যবহার করেছেন, কবিতার যুদ্ধক্ষেত্রেও শব্দাস্ত্র ছুড়ে জঙ্গিবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপরীতে ব্যবহার করেছেন নিঃশঙ্কচিত্তে সাবলীলভাবে।

প্রচ- আত্মসম্মান-সচেতন এক কবি আমলার বিরূপ ও বিজাতীয় হামলার কারণে কয়েক মাস মাত্র বাকির অবসরভাতা গ্রহণের আগে বাংলা একাডেমির চাকরি ত্যাগ করা এই কবি সুতোর ওপারে যেমন চলে গেছেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার মুখে থুতু ও মুতে দিয়ে, অবলীলায় গালাগালি শুয়োরের বাচ্চা, হারামজাদা, বেশ্যার বিড়াল ব্যবহার করেছেন কবিতার শক্তি দিয়ে, তেমনি ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ সবুজ নিসর্গ সীমিত পরিকীর্ণ পরিবেশে সেই নেত্রকোনা-বিরিশিরির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী একাডেমি পরিচালনাকালীন বা জাতীয় গ্রন্থ প্রতিষ্ঠানের সময়ে মানুষ ও প্রকৃতির দূষণক্রিয়ায় মর্মাহত হয়েছেন। দেয়ালের লিখন ‘ভাত দে হারামজাদা’ দিয়ে যেমন কবিতা নির্মাণ করতে সচেষ্ট ও বিব্রত হয়েছেন, সেরকম একজন প্রকৃত কবির মতো বঙ্গবন্ধু দেহনিঃসৃত রক্তের ধারাকে ধানম–র ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়ি থেকে সারা দেশের সবুজ বুকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে দিয়ে বঙ্গোপসাগরের প্রবহমান জলে মিশিয়ে দিয়েছেন। কবিতায় এরকমভাবে একটি সিঁড়ির প্রতীকী ব্যবহার করে। রক্তের ধারা ও সাগরের জল নিয়ে একীভূত যাত্রার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান এবং একই সঙ্গে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের বিরম্নদ্ধে বিষণ্ণ ও দৃঢ় প্রতিবাদ আর কোনো কবির কবিতা দ্বারা এরকম হৃদয়ছোঁয়া হয়ে ওঠেনি; বিশেষ করে, বাংলাদেশের নিজস্ব কবিতাভুবনে। এই দিক দিয়ে কবি রফিক আজাদ অমস্নান, অভিন্ন ও অনন্য।

রফিক আজাদের কবিতা-নেশার মতো অন্য নেশার প্রতি আসক্তি এবং মানবিক ভালোবাসার বহু স্মরণীয় আকুতিমাখা পঙ্ক্তির শক্তি অনেকের মতে কিংবদমিত্ম হয়ে আছে। রোমান লেখক পিস্ননি দি এল্ডার বলেছেন, মাদকতায় রয়েছে সত্যসুধা, জলে আছে স্বাস্থ্যস্নেহ। কবি রফিক আজাদ ভালোবাসা ও মাদকতার শক্তি সত্য হিসেবে কবিতায় রূপ দেওয়ার বিরল ক্ষমতা দেখিয়েছেন, যা সবাই পারেন না এবং ঢালাওভাবে উৎসাহিতও করা যায় না। একটি পানশালায় তাঁর নির্ধারিত চেয়ার-টেবিলটি এখনো প্রদর্শিত হয়, যেমন মস্কো শহরের এক পানশালায় কবি পুশকিনের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত নিদর্শন সামগ্রী পর্যটকদের এখনো আকৃষ্ট করে।

তাই কবি রফিক আজাদ বৈচিত্র্যপ্রয়াসী এবং অবিচ্ছিন্ন প্রকৃতির প্রকৃত কবিসমত্মান। তিনি নিজেই নিজের সঙ্গে প্রতিসরিত, প্রতিবিম্বিত ও প্রতিতুলনীয়। তাই তিনি তাঁর একটি কবিতায় বলেন, ‘কুড়িয়ে-পাতিয়ে, পাওয়া টুকরো-টাকরা ঘুমগুলো/ আমি জোড়াতালি দিয়ে সেলাই করে একটা/ মালা বানিয়ে গলায় পরে গভীর ঘুমাব।’ তিনি কবি রফিক আজাদ, আমার ও সবার প্রিয় বন্ধু কবি এখন নিরবচ্ছিন্নভাবে গভীর ঘুমে। কোনো কিছুতেই আর কবির ঘুম ভাঙবে না, কোনোদিন আর জেগে উঠবেন না, তবে রইবেন সবার সঙ্গে।