প্রেম ও পটভূমি

দরজাটা বন্ধ করতেই কী রকম একটা অদ্ভুত আওয়াজ, লোহা-কাঠের ক্যাঁচক্যাঁচানি নয় – বড় একটি

মচমচে ভাজা মাছ মাঝখান থেকে ভাঙলে যেমন শব্দ হতে পারে, শব্দটা অনেকটা সে-রকম। দু-এক মুহূর্ত পরই তার দৃষ্টি গেল দরজার ওপরের চৌকাঠের দিকে। এ কি –

একেবারে ঠিক গলা থেকে দু-টুকরো, ধড়টা নিচের দিকে ঝুলে আছে, আর মাথাটা সম্পূর্ণ থেঁতলে গিয়ে আটকে আছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খানিকটা কালচে রক্তের মতো তরল গড়িয়ে পড়ল মেহগনি কাঠের ধুলোপড়া পাল্লা বেয়ে। এতদিন সে জানত

টিকটিকির রক্ত সাদা, তাহলে এই কালচে লাল এলো কোত্থেকে। তবে এটাকে সে কোনো ভুতুড়ে কা- ভাবল না। মাঝে মাঝেই নির্জন পড়ে থাকে মফস্বলের সরকারি কলেজের শিক্ষকদের এই ডরমিটরি, অনেকটা বিরান এই ভূমিতে একা রাত কাটাতে কেউ কেউ ভূতের ভয়ও পেয়েছে। এই গৈ-গিরামে কলেজ সরকারি করার আদৌ দরকার ছিল কি? ব্যাপারটাতে শিক্ষাভাবনা থাক-না-থাক

রাজনৈতিক ফায়দা ষোলো আনাই ছিল। যেখানে রাজধানীর অনেক বিস্তৃত ও জনবহুল অনেক এলাকায়ও একটা সরকারি কলেজ নেই। যাই হোক, এ নিয়ে তার কিছুই করার নেই, এই ভাবনাটাই অবান্তর। সে যে বিবর্ণ ভবনে অবস্থান করছে গোটাকতক ছেয়ে রঙের

দৈত্যাকৃতি টিকটিকি বেশ ভালোই সংসার পেতেছে তার চারটা-পাঁচটা কামরাজুড়ে। পাশের ঘরটি খালি পড়ে আছে, প্রিন্সিপালের স্টোররুম হয়তো। ঢাকা থেকে আসা রসায়নের প্রভাষক আসিফ একটিতে,

খুলনার জায়েদ আর নাটোরের তৌসিফ থাকে অন্য দুটি কামরায়।

পাঁচদিন ক্লাস বন্ধ পেয়ে সবাই এখন পরিবার-পরিজনের কাছে।

তৌসিফ ভেবেছিল সেও কোনো জায়গা থেকে ঘুরে আসবে – কুয়াকাটা

কিংবা সুন্দরবন। কিন্তু শরীরটা ঠিক সায় দিচ্ছিল না একা-একা দূরের পথ পাড়ি দিতে। তাছাড়া কদিন আগেই সে ঘুরে এলো ঢাকা থেকে, অন্য একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। টানা প্রায় তেরোটা বছর পেরিয়েছে তার ওই মানুষ-কিলবিল চাতুর্যগ্রস্ত শহরে, অবশ্য তখন সময়টা যে খুব খারাপ কেটেছে তা নয়, বেশ মানিয়ে নিয়েছিল। অথচ আজ সেখানে গেলে সামান্যতেই তৌসিফ ক্লান্ত, বিরক্ত আর বিধ্বস্ত বোধ করে। যতক্ষণ সে ওই মূত্রের গন্ধযুক্ত

ফুটপাতবিশিষ্ট তিলোত্তমা মেগাসিটি থেকে পালাতে না পারছে ততক্ষণ নিশ্বাস নিয়েও স্বস্তি নেই। একদিক থেকে ভাগ্য তার

ভালো, ওই শহর তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রথম পোস্টিংটা একটু বড় শহরে হলেও দু-বছরের মাথায় বদলি হয়ে দেশের প্রান্তভূমির এই

ডরমিটরিতে সে এখন আপাতত একা। ভালো পদায়নের জন্য যে দৌড়ঝাঁপের দরকার তাতেও রুচি নেই। আক্ষরিক অর্থেই

একেবারে স্বজনহীন নিস্তরঙ্গ কাটছে তার তিনটে-চারটে বছর। অথচ

বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবছরের জুনিয়র মৌমিতাকে স্বপ্নময়ী নারীই মনে হয়েছিল তার। ওর নীল শাড়ি, গালের তিল, খোঁপায় গোঁজা কৃষ্ণচূড়া, মৃদুকণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীত একেবারে মুছে যায়নি মন থেকে। ওর সঙ্গে দুটো বছর একই ছাদের তলায় কেটেছে, একটি কন্যাসন্তানও জন্ম নেয় তাদের। কিন্তু ওই দুবছর তৌসিফ তার চারপাশে কেবল

জীবনের বিভীষিকাময় রূপই দেখেছে, সেই সময়ের দিকে তাকালে এখনো সে ঘরজুড়ে দুরাত্মা প্রেতের ছায়া দেখতে পায়। বিষের ভেতর অমৃত যেটুকু ছিল তা গাঢ় ও বিস্তৃত অন্ধকারে পথ-হারানো নিঃসঙ্গ

মৃদুপ্রাণ জোনাকির আলোর মতো ক্ষীণ। দাম্পত্য জীবন যে নিরন্তর সুখের নয় সে ধারণা তার আগেই ছিল, তাই বলে এতটা তীব্র নরক তা কে জানত – এতখানি আশংকা থাকলে তো বন্ধনহীনই থাকত চিরকাল। রাত হলে বিশাল ফুটবল মাঠের পুবদিকে পুকুর পাড়ের সুপারি গাছবেষ্টিত ডরমিটরির নিস্তব্ধতা ঘন হতে থাকে। তখন নিকট ও দূর-অতীত বায়বীয় আয়না হয়ে খেলে বেড়ায়, ছুটে বেড়ায় তার চোখের সামনে দিয়ে। সেই অবসরে একটি সচল আয়নায় দেখা যাচ্ছিল এই অল্পদিন আগের কিছু দৃশ্যাবলি। বহুদিন যোগাযোগ ছিন্ন বলে ব্যাপারটা নিয়ে তার বিশেষ আশা ছিল না, আকাক্সক্ষাটা অবশ্যই ছিল। তাই ওই চেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সাক্ষাৎকারের চিঠিখানা পুরনো ব্যাগে পুরে নির্লিপ্ত বদনে সে রাজধানীর দিকে রওনা হলো। আশার মধ্যে এটুকু যে, এমএতে সে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছিল, আর বিভাগের একজন গ্রহণযোগ্য শিক্ষক সাজিদ হোসাইন ফোনে

বলেছেন, ‘তুমি এসো তো, ভাইভাটা দিয়ে যাও। দেখা যাক এবার কী হয়।’ প্রফেসরের কথায় বেশ আত্মবিশ্বাস। তৌসিফ আগেও একবার ভাইভা দিয়েছিল বলে সাজেদ স্যার এভাবে কথাটা বললেন।

তৌসিফের বন্ধু বিভাগেরই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর মাজেদ বলেছিল, ‘তুমি অমুক অমুকের সঙ্গে আগেই দেখা করো, না হলে চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা জিরো। এর মধ্যে বিশেষ করে ডিপার্টমেন্টের

সিনিয়র প্রফেসর আ স ম ফকরউদ্দিনের পদধূলি না নিলেই নয়, জানো তো তিনি শাসকদলের খুব পছন্দের মানুষ। ডেইলি নিউ ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় নিয়মিত সরকারের বন্দনাসূচক কলাম লেখেন।’

তৌসিফ বলে, ‘না, আমার এসব জানা নেই।’

‘শোনো, আমাদের এখানে তো বেশ ভালোই আছে; এখনো মন্ত্রী-এমপির পেছনে ছুটতে হয় না। তোমাদের ওদিকে শান্তিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি এসব মেকানিজমের পাশাপাশি বড় অংকের টাকাও লেনদেন হয়।’

তৌসিফ শুধু বলে, ‘আমার সে-সব জানা নেই, ওই

বিশ্ববিদ্যালয়েরও কোনো খবর আমি রাখি না।’ তৌসিফ এ-পর্যন্ত

গোটাচারেক ভালো চাকরি পেয়েছে। এর জন্য কারো সঙ্গে দেখা করতে হয়নি, পদধূলিও আবশ্যক হয়নি, অর্থ-প্রসঙ্গ অবান্তর। বর্তমান পটভূমি স্বতন্ত্র হলেও সে মনস্থ করে এবারো কারো সঙ্গে দেখা করবে না, বিশেষ করে এতদিন পরে প্রফেসর ফকরউদ্দিনের কাছে গেলে তিনি আহ্লাদে গলা জড়িয়ে ধরবেন এমন নয়, বরং তার মনে যা আছে তিনি তা-ই করবেন।

ভাইভাতে তৌসিফ বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত। ভিসি মানুষটির গায়ের রং কুচকুচে কালো হলেও বেশ মিষ্টভাষী, এসি ঘরে খুব

রিল্যাক্সড মুডে। তিনি জিজ্ঞেস করেন নানা কথা। বললেন, ‘তোমার রেজাল্ট তো দেখছি খুব ভালো। পিএইচ.ডি করছ না?’

‘না, স্যার। রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি এখনো।’ তৌসিফ বলতে পারে না যে, লেকচারারের চাকরির জন্য পিএইচ.ডি আবশ্যক নয়, সে প্রথম হয়েও বারবার প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। বাড়তি ডিগ্রি দিয়ে কী হবে?

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে গেলে তো ডিগ্রিটা দরকার।’

তৌসিফ নিরুত্তর থাকে।

‘আচ্ছা তোমার পেপারসের একটা সেট আমি রাখছি’ বলে তিনি তার অফিস সহকারীকে দেন জেরক্স করার জন্য। বিষয়টা

তৌসিফের কাছে ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক বলেই মনে হয়।

চেয়ারম্যান ভদ্রমহিলাও বিষয় নিয়ে কতক কথা জিজ্ঞেস

করলেন। তৌসিফ তার মতো করে জবাব দিলেও সে বুঝল উত্তরের অনেকগুলোই চেয়ারম্যানের মনঃপূত হয়নি। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তৌসিফের মনে পড়ছিল, সে যখন প্রথম বর্ষের ছাত্র এই চেয়ারম্যান তখন আমেরিকা ফেরত তরুণী সহকারী অধ্যাপক। চঞ্চলা ক্ষীণকোটি সেই নারী জর্জেটের শাড়িতেই দারুণ মানানসই ছিলেন। এরই মধ্যে তিনি কত বদলে গিয়েছেন, আপাদমস্তক কেমন বার্ধক্যের ছাপ। সময়টাও তো একবারে কম নয়, প্রায় দেড় যুগ। সময়ের শীতলতায়-উত্তাপে তৌসিফ নিজেও কম বদলায়নি।

সাক্ষাৎকার-কক্ষ থেকে বেরিয়ে তৌসিফ সাজেদ হোসাইনকে ফোন দিলো, ‘স্যার, আমার ভাইভা শেষ, আমি চলে যাচ্ছি।’

‘চলে যাবে? খুব জরুরি কাজ না থাকলে বরং ডিপার্টমেন্টের দিকে এসো একবার।’

তৌসিফ তাই প্রশাসনিক ভবন ছেড়ে কলাভবনের দিকেই এগোয়। বিভাগে ঢুকে সে খেয়াল করে এই ক-বছরে অফিস ও শিক্ষকদের বসবার ঘরগুলোর চাকচিক্য বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের চেহারার তৈলাক্ত ভাবও অনেক বেড়েছে।

সাজেদ হোসাইন বললেন, ‘আমি শাওন ও রিয়াজকে চলে যেতে বলেছি। তুমি রেজাল্টটা ক্যাম্পাস থেকে জেনেই যাও,

এজন্যই একটু দেরি করতে বললাম।’

স্যারের কথায় আশার ইঙ্গিত – যদিও কোনো কোনো আশাবাদ তার কাছে ছোটলোকি বলে মনে হয়। কক্ষের দেয়ালঘড়িতে যখন বেলা পৌনে দুটো, পিওন এসে সাজেদ হোসাইনকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার কি বাসায় যাবেন, নাকি খাবার নিয়ে আসতে হবে? এর পরে গেলে ক্যাফেতে কিছু পাওয়া যাবে না।’

স্যার বলেন, ‘কজন আছে ওদিকে?’

পিওনটা মনে মনে হিসাব করে বলে, ‘আপনাদের দুজনসহ আটজন।’

সাজেদ হোসাইন হিপ পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করতে যাচ্ছিলেন। তখনই তৌসিফ বলল, ‘স্যার যদি অনুমতি দেন – বিলটা আমি দিতে চাই।’

‘দেবে? আচ্ছা দাও।’ সাজেদ হোসাইনের নির্লিপ্ত সরল সম্মতি।

আধঘণ্টা পর টিচার্স লাউঞ্জে খাবার সাজানো টেবিলের

চারিদিকে ছয়জন বসা হলো। খানিক পরে প্রফেসর ফকরউদ্দিন ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসে প্লেট টেনে বসলেন। এর মিনিট দুই বাদে পিওন এসে তৌসিফের বাম হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, ‘স্যার একশ তিরিশ টাকা ফিরেছে।’

ব্যাপারটা খেয়াল করে সাজেদ, ‘লাঞ্চের টাকা কে দিয়েছে?’ বলতে বলতে আ স ম ফকরউদ্দিন এমনভাবে চড়াৎ করে উঠে দাঁড়ালেন যেন তার পাছায় হুলটুল কিছু ফুটেছে। কিংবা খাবারের প্লেটে বিষাক্ত কিছুর অস্তিত্ব টের পেয়েছেন।

‘ফকর ভাই, তৌসিফ দিয়েছে, আমি অনুমতি দিয়েছিলাম।’

‘কেন তুমি আগে বলোনি কথাটা?’ তিনি পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করলেন। কাছেই দাঁড়ানো ভয়-পাওয়া পিওনকে বললেন, ‘এই নে আমার টাকাটা রাখ।’

টেবিলে সবাই খুব বিব্রত, কারো মুখেই খাবার উঠছিল না। দু-একজন সন্তর্পণে অন্যদের মুখভঙ্গিমা বোঝবার চেষ্টা

করছিল। তৌসিফ বুঝতে পারে তার অর্থে আপ্যায়িত হতে আ স ম ফকরউদ্দিনের আপত্তি। কিন্তু তার এই প্রবল ক্ষিপ্ততায় সে অবাক না হয়ে পারে না। এই ভদ্রলোকের কাছেই তো সে

পোস্টমডার্নিজমের নানা দিকের তুলনামূলক আলোচনা ও বিশ্লেষণের

অ আ ক খ শিখেছিল,  সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ে তার শেখানো কথাগুলো

অবিকৃতভাবে খাতায় লিখে ওই কোর্সের টিউটোরিয়াল ও চূড়ান্ত পরীক্ষায়

তৌসিফই সবসময় সর্বোচ্চ নম্বর পেত। অথচ কেন কীভাবে সে এই

ভদ্রলোকের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠল তার কিছু দিক মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে মনে মনে অন্বেষণ করতে থাকে সে। তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষিত হয়নি এই অপরাধ ছাড়া আর কোনো পাপের সন্ধান তৌসিফ পায় না।

খাওয়ার খানিক পরে সিগারেট ধরিয়ে সাজেদ হোসাইন ওয়াশরুমে গেলে তৌসিফ করিডোরে পায়চারি করছিল।

ফকরউদ্দিনের উচ্চকণ্ঠ শুনে পর্দার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি চলে গেল ঘরের ভেতর। তিনি ভীষণ উত্তেজিত ভঙ্গিতে ল্যান্ডফোনে কথা বলছেন, ‘শুনুন ছেলেটি একজন কবির ছোটভাই। সে আমার সন্তানতুল্য, সকালে আমাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ভাইভা দিতে গিয়েছে। একজন ক্যান্ডিডেটের রেজাল্টই সব নয়, তার কেসটা স্পেশাল, দেখতেও হবে সেভাবে।  শুনুন, তারেকের নিয়োগ কনফার্ম না করে এই ফকরউদ্দিন ক্যাম্পাস ছাড়বে না। প্রয়োজনে সারারাত থাকব।’

বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সাজেদ স্যার বাসায় ফেরার আগে জানালেন, ‘পজিটিভ নিউজ পেলেই আমি তোমাকে ফোন করব।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল মসজিদে যখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে তখন সাজেদ স্যারের ফোনে কল করে সুইচ অফ পাওয়া গেল। চেয়ারম্যান ম্যাডামকে অবশ্য পাওয়া গেল। তার কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো, ‘বোর্ড শেষ, আমি বাসায় ফিরছি। তোমার হয়নি, আর আসলে ভাইভাটাও ভালো হয়নি তোমার।’ অর্থাৎ তিনি অনেকাংশে বোঝাতে চাইলেন ভাইভা ভালো-মন্দের ওপরেই যেন এখানকার চাকরিটা হয়। তৌসিফ ক্যাম্পাসের গেটে টং দোকান থেকে গোদুগ্ধ মিশ্রিত এককাপ চা খেয়ে দূরপাল্লার পরিবহন থামিয়ে পেছনের সারিতে একটা সিট পেয়ে গেল।

এই দৃশ্যগুলো আপাতত আর দেখতে চায় না তৌসিফ। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ঘরটা গুমোট হয়ে ওঠে। জানালার ফাঁক দিয়ে মেঝেতে মৃদু আলো এসে জানান দিচ্ছে বাইরে জ্যোৎস্না। সুতি

ট্রাউজারটার ওপর একটা ফিনফিনে পাঞ্জাবি চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে তৌসিফ, খানিক হেঁটেই পুকুরপাড়। জ্যোৎস্নার আলোয় বোঝা যাচ্ছে অনেকটা ঝিলের মতো পুকুরের ওইদিকটায় কতক লাল শাপলা ফুটে আছে। দূরে যেন কোথাও বাঁশি বাজছে, বাতাসের গতি সামান্য বাড়লে

সুরটা আরো স্পষ্ট হয়। তৌসিফের একসময় বাঁশির খুব শখ হয়েছিল। একজন ওস্তাদ ধরে বেশ এগিয়েও যায়। মৌমিতা ওর বাঁশির সুর  ভালোবাসত। আর সেই মৌমিতা আজ নিতান্তই এক অস্পষ্ট ছায়ার মতো নারীর নামমাত্র। শুনতে পেয়েছে, ওদের মেয়েটা এবার স্কুলে ভর্তি হলো। মেয়েটাকে শেষ কবে দেখেছে, মনে নেই ঠিক; তবে তখন কেবল হাঁটতে শিখেছে। তৌসিফ মাথা উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকালে তার দুই চোখ জলে ভর্তি হয়ে যায়, জোৎস্নাটা তখন ঝাপসা হয়ে আসে। সে জানে, এই মেয়ে তার জনককে দেখলে চিনবে না আজ, উটকো লোক ভেবে ভয়ে ছুটে পালাবে; হয়তো কেউই বলে না তার পিতার কথা। তৌসিফ একটা মাটির ঢেলা নিয়ে জলে ছুড়ে মারে, তারপর আর একটা, আরো একটা। তাতে জলের মৃদু তরঙ্গে কতক শাপলা জ্যোৎস্নার আলোয় দুলে ওঠে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এবার বাতাসের আয়নায় ভেসে ওঠে কুড়ি-একুশ বছর বয়সী এক তরুণীর চলাফেরা, অঙ্গভঙ্গির নানান ছবি। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রঞ্জনা এভাবে কথা বলে কেন তার সঙ্গে? অবশ্য দোষ পুরোটা ওই মেয়েটির নয়, তৌসিফই কথা প্রসঙ্গে বলে

ফেলেছিল তার একাকিত্বের কথা। রঞ্জনা একদিন অনেক রাতে ফোন করে বলে, এমনকি শূন্যপদ পূরণে আগ্রহ রয়েছে তার। তৌসিফ সিরিয়াসলি নেয়নি, নেওয়ার মতোও নয়। এমনও হতে পারে তাকে একটু বাজিয়ে দেখার, কিংবা মজা করার জন্য অন্য কেউ রঞ্জনাকে দিয়ে ফোনটা করাচ্ছে। তৌসিফ বলেছে, ‘তুমি আমার চেয়ে কত বছরের ছোট জানো?

‘খুব জানি। বড়জোর দেড় যুগ।’

‘তোমার বাবা-মা?’

‘তাদের আপত্তি নেই। আমি যা বলব তাই। তাছাড়া আপনার মতো কাউকে তারা সারাদেশ ঘুরেও এনে দিতে পারবে না। দু-বছরে এখানে আপনার অনেক নামযশ ছড়িয়েছে, আমার বাবাও সেটা জানেন। আর আপনি তো সাধারণ কেউ নন, আপনার সঙ্গে কথা বললে যে-কেউ মুগ্ধ হবে।’

তৌসিফ এরপর থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে, আরো সাবধানী হতে হয়েছে কথাবার্তায়। বিশেষত এটা ছোট্ট মফস্বল, এখানকার লোকেদের প্রিয় কাজ কারণে-অকারণে অন্যের বিষয়ে নাক গলানো। তাছাড়া মৌমিতাও তো একসময় মুগ্ধ

হয়েছিল, কিন্তু সেই অমৃত-মুগ্ধতা বিষে পরিণত হতে বেশি

সময় লাগেনি। তৌসিফ বোঝে এ-দোষ একা মৌমিতার নয়, বরং বেশিরভাগই তার নিজের। কিন্তু সে তো পারেনি শুধরাতে, জানে পারবেও না নিজের সব সীমাবদ্ধ প্রাচীর ভাঙতে। এরপর জেনে-শুনে আরো একটা

ভুলের জালে জড়ানো ঠিক হবে না – রঞ্জনা যা-ই বলুক। বরং এই ভালো আছে সে। খানিক পরে মনে হয়, আসলেই ভালো আছে কি? নেই, এটা সান্ত¡না মাত্র। তা হোক, আত্মপ্রবোধ ছাড়া বাঁচা কঠিন।

দূর থেকে বাঁশির আওয়াজটা আবার আসছে কানে। তার ঘরেও তো বাঁশের বাঁশি রয়েছে একটা, অনেক দিন ফুঁ পড়েনি তাতে। তৌসিফ ঘরের দিকে পা বাড়াল। টেবিলের ড্রয়ার থেকে বাঁশিটা বের করে ভালো করে ধুলো মুছে ছিদ্রে ঠোঁট রেখে ফুঁ দেয়, না ঠিকই আছে তো। হাঁটতে হাঁটতে আবার গিয়ে বসে ঝিল-পুুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে। কিন্তু সুর তুলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে, বাতাসে খানিক দম নিয়ে আবার বাজায়। হ্যাঁ, এবার সে পরিষ্কার বাজাতে পারছে – পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে। বাজাতে বাজাতে মনে হয়, বাহ্ নিজের ভেতরে ফুসফুসের বায়ুপ্রবাহ অনেক স্বাভাবিক, ভেতরে গুমোট মেঘটা কাটাতে পারছে এই সুর। সে নির্বোধের মতো এতদিন বাঁশিটা শুধু শুধু ফেলে রেখেছে, অথবা ভুলে রয়েছে এতকাল। এবার সে অন্য একটা সুর তোলে – নদীর নাম সই অঞ্জনা, ডাকে তীরে খঞ্জনা সই।

গভীর রাতে ঘুমানোর আগে মনে হয় ইন্টারনেট, ফেসবুকে চ্যাটিং তার নির্জনতা দূর করতে পারে না। বরং এই বাঁশিই ভালো। ওকে এভাবে আর ফেলে রাখা নয়।

‘শুভ জন্মদিন, স্যার।’

ঘুমটা খানিক আগেই হালকা হয়েছে। জানালার পর্দা আর

কাচের ওপারে চোখ যায় নারীকণ্ঠ শুনে। শুধু ঝালর লাগানো

লালরঙের ওড়নার খানিকটা অংশ দেখা যায়। তৌসিফের বুঝতে বাকি থাকে না ওপারে কে। সে প্রথমে বিরক্ত হয়। ভাবে দরজা না খুলে ভীষণ বকা দিয়ে ফিরিয়ে দেবে – সাতসকালে বিনা নোটিশে কোন সাহসে? কিন্তু দ্রুত কী ভেবে মনের গতি ঘুরিয়ে বলে, ‘মাত্র জাগলাম। ফ্রেশ হতে পনেরো মিনিট। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সঙ্গে কেউ আছে?’

‘ঠিক আছে, সঙ্গে কেউ নেই।’

নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে তৌসিফ দরজা খুলেই গোলাপ ও রজনীগন্ধার সৌরভ পেল, ফুলের গোছাটা এগিয়ে দিয়ে আবার  শুভেচ্ছা জানায় রঞ্জনা।

‘আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি না, বরং তোমার সাহসের তারিফ করছি। এত্তোটুকু মেয়ে একা এই নির্জন ডরমিটরিতে? এই গেঁয়ো ছোট্ট শহরটা এসব পছন্দ করে না। জানা নেই তোমার?’

‘আছে, কারণ এটা আমারই জন্মস্থান। আর আপনি একটু ভীতু বলে আমাকে একটু বেশি সাহস দেখাতে হলো। যদিও স্টুডেন্টরা আপনাকে ভয় পায়।’

তৌসিফ এ পর্যন্ত মেয়েটিকে খেয়াল করে দেখেনি। দু-পলক ভালো করে তাকালে ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে – রঞ্জনা অবজ্ঞা করবার মতো কোনো মেয়ে নয়। রূপবতী, প্রাণবন্ত, বেপরোয়া – সব মিলিয়ে দুর্দান্ত এক নারী সে, এই প্রান্তিক জনপদে অভাবনীয় প্রায়। হঠাৎ তৌসিফের কী মনে হয় – ভাবে,

জীবনটাকে সে তো এ-যাবত খুব বেশি সিরিয়াসলি নিয়েছে। গম্ভীর সব হিসাব-নিকাশ জীবনটাকে দুর্বহ করে তুলেছে। আর নয়, ভাঙতে হবে সব সুকঠিন পাথুরে বেষ্টনী; এ-মুহূর্ত থেকে সে সবকিছু লঘু করে ফেলবে, শরতের মেঘ হবে তার ভাবনারাশি। তবু সে বাহ্যিক গাম্ভীর্য কাটাতে পারে না। বলে, ‘ঠিক আছে, তোমার কথা শেষ হলে আসতে পারো।’

‘শেষ কী – কথা শুরু করব স্যার, আপনার সঙ্গে রিকশায় ঘুরব টানা দুঘণ্টা। আমি ব্যাটারিচালিত রিজার্ভ রিকশা সঙ্গে করে এনেছি। ও খুব আস্তে আস্তে চালাবে।’

তৌসিফ রঞ্জনার কথায় হতভম্ব হলেও তাকে এ-মুহূর্তে

রীতিমতো এক যোদ্ধা নারী বলে মনে হয় – যার বাহন তেজি আরবি ঘোড়া, হাতে তীক্ষè তরবারি, যে বীরদর্পে যুদ্ধক্ষেত্রে উদ্ধার করতে এসেছে এক আহত রক্তাক্ত পুরুষকে। চেতন-অবচেতনের মাঝখানে নিজেকে সমর্পণ করতে ভালো লাগে ওই অশ্বারোহী বীরাঙ্গনা নারীর কাছে।

কথা বলতে বলতে দরজায় এঁটে থাকা নিহত টিকটিকিটার দিকে তৌসিফের নজর যায়। ওটা সামান্য শুকিয়ে উঠেছে, পিঁপড়ের সারির লক্ষ্যবস্তু এখন। একটা বাতিল কাঠের স্কেল নিয়ে খোঁচা দিয়ে

টিকটিকিটাকে নামায় তৌসিফ।

এসব খেয়াল করে রঞ্জনা বলে, ‘স্যার, আপনি এ কী করছেন? ছি! – টিকটিকিতে আমার খুব অ্যালার্জি আর ঘেন্না, কী বিচ্ছিরি আকৃতি!’

‘না, এটা বাইরে ফেলে দিচ্ছি। এত বড় টিকটিকি দেখেছো কখনো? কালই দরজায় চাপা পড়ে মরল।’

‘স্যার আপনাকে কিন্তু গোসল করে আসতে হবে। নইলে আমার গা ঘিনঘিন করবে।’

স্নানঘরে ঝরনার জল বেশ জোরালো। সেটা চালিয়ে দিয়ে গুনগুন করে গান গাইবার চেষ্টা করে তৌসিফ। তখন ছোট্ট ওই ঘরটার ভেতর আবার একটি আয়না চালু হয়ে যায়। সেখানে প্রথমে ভাসে পিতা-মাতার করুণ প্রস্থান – জ্বলন্ত আগরবাতি, সাদা কাফন ও টাটকা কবর। অতঃপর মৌমিতার বিবর্তন, শিশুকন্যার গালের গোলাপি আভা, ফকরউদ্দিনের কপালের ভাঁজ, সাজেদ

হোসাইনের নির্লিপ্ত উদার ভঙ্গিমা, ঝিল-পুকুরে শাপলার লালিমা, জ্যোৎস্নার কোমলতা, টিকটিকির বাসি মরদেহ প্রভৃতি ছবি খাপছাড়া ভাসতে থাকে। তখন সারা গায়ে সাবানের ফেনা, চোখটা জ্বলছে সামান্য, চোখে-মুখে এক ঝাপটা পানি দিতে দিতে তৌসিফ ভাবে, আচ্ছা রঞ্জনার গালে একটা তিল আছে মনে হলো, ডান না বাম গালে? সে দ্রুত স্নান শেষ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।