প্ল্যানচেট

কথা হয়েছিল এক বছর পরে আসার। কিন্তু তা হলো না। ফিরে আসতে এক বছর পার হয়ে গেল।

গতবার এসেছি বর্ষা আসার মুখে মুখে। দক্ষিণবঙ্গে অসহ্য গরম তখন। কিন্তু এখানে বাতাসের তাপ হালকা হয়ে এসেছিল। এখানে কালচে মেঘ জমতে শুরু করেছিল পাহাড়ের মাথায়। সারাদিন ধরে বোঝা নিয়ে চলা মেঘের সারি, তার নিচে পাহাড়ের সবুজ যেন বৃষ্টির অপেক্ষায় হাত তুলে রয়েছে। পুলকদাই আমাদের টেনে এনেছিলেন এখানে। জায়গাটা চিনিয়েও ছিলেন উনি। এমন কত জায়গা যে আমাদের চিনিয়ে দিয়ে গেলেন তার সত্যিই শেষ নেই।

কিন্তু এ-কথা নিশ্চিত জানতাম পুলকদা থাকলে দ্বিতীয়বারের আসা আমাদের হতো না। কোনো ফিরে আসায় বিশ্বাস ছিল না ওঁর। বেড়ানোর জায়গায় নয়, সম্পর্কেও নয়। এই যে ডুয়ার্সের প্রামেত্ম পাহাড় জঙ্গল আর নদীর ত্রিভুজে ঘেরা একটুকরো ভুটিয়া জনপদ, যেখানে হাতড়ে হাতড়ে গিয়ে পৌঁছলে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়, এ-কথা উনিই একদিন শুনিয়েছিলেন আমাদের। বালুরঘাটের পাড়ার আড্ডাতেই কথা আর শব্দের টানে মেলে ধরেছিলেন ছবিটা। তারপর ফিসফিস করে বলেছিলেন, যাবি নাকি!

আমরা কেউ নেচে উঠিনি। বরং ব্যাগ গুছিয়েছি গোপনে। পুলকদা বলেছেন, এই বেড়ানোটা কিন্তু সকলের জন্য নয়। অন্তত দিপুদাদের জন্য তো নই। (‘দিপুদা’ আমাদের ঠেকের একটি সান্ধ্য ভাষা, যারা বেড়ানো বলতে দিঘা-পুরী-দার্জিলিং বা ওই গোত্রের জায়গাগুলোই শুধু বোঝে।) পুলকদা আরো বলেছেন, তৈরি থাক। যেকোনো দিনই কিন্তু বেরিয়ে যেতে পারি।

দল বলতে খুব ছোট একটা দল। জলজ, অলয়, আমি, সঙ্গে বসুধা। পুলকদার তিন শিষ্য-বন্ধু, সঙ্গে ওর মেয়ে। বসুধার বিয়ে হয়ে গেছে, ওর বর রাউরকেল্লায় উঁচু ইঞ্জিনিয়ার, তবু বাপের সঙ্গে টো-টো করার অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। বেড়ানোর একদিন আগে ও ঠিক এসে হাজির হয়েছিল।

ডুয়ার্সের একটা অ-দরকারি স্টেশন। দূরপাল্লার ট্রেন আর মালগাড়িরা গতি না কমিয়ে ঝমঝম করে বেরিয়ে চলে যায়। সারাদিন এক-দুটো লোকাল ট্রেন দাঁড়ায়। তার জন্য পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে অপেক্ষা করে মানুষ। সকালের শেষদিকে তেমন একটা লোকাল ট্রেনেই এসে নেমেছিলাম আমরা।

স্টেশনের চারপাশে অজস্র সবুজ। দূরে ঝুঁকে থাকা পাহাড়ের ছায়া হাতছানি দিচ্ছে চোখের ইশারায়। অলয় বলে উঠেছিল, পুলকদা আগে কেন নিয়ে আসেননি আমাদের!

রিটায়ারমেন্টের কাছাকাছি পৌঁছে দাদাই যেন আমাদের মধ্যে সব-চাইতে তরুণ। ওঁর ফরসা গাল, টান চেহারা, পিঠের মাঝখানে স্পোর্টস ব্যাগ। রক্তে শর্করা কিছুদিন হলো উঁকিঝুঁকি মারছে, কিন্তু বাইরে তার কোনো চিহ্ন নেই। বেঁচে থাকার টানে সবকিছুকেই অগ্রাহ্য। স্টেশন ছেড়ে নামতে নামতে অলয়ের কথার উত্তরে বললেন, আগে নিয়ে আসিনি যেমন, পরেও কিন্তু আর নয়।

স্টেশন চত্বর ছাড়ালে সংক্ষিপ্ত একটি মোড়। গাছতলা। একটি মাত্র মুদিদোকান। দোকানিই আমাদের জন্য জিপ জোগাড় করে দিলো। সেই দোকান থেকেই তিনদিনের মতো রেশনিং সংগ্রহ। তারপর পাঁচ কিলোমিটার জিপ, ঘণ্টাদুয়েকের হাঁটা, পাহাড়ের ঠিক পায়ের কাছে এসে পৌঁছেছিলাম আমরা।

কিন্তু দু-ঘণ্টার হাঁটায় পুলকদা এই প্রথম বুঝলেন এবড়োখেবড়ো পথে খানিক চললে ওর দমের কষ্ট হচ্ছে। খুব হালকা করে বুকে ব্যথাও। জলজ ওর লাগেজ নিয়ে নিয়েছিল। পুরো পথ বসুধা হাত ধরে ছিল। পথে মাঝেমাঝেই একটি-দুটি সোঁতা। পাহাড়ি জলধারা শান্ত সাপের মতো রাসত্মায় রোদ পোহাচ্ছে। তার একটির পাশে টান হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন পুলকদা। যদিও ঠোঁটে তখনো আলগা একটু হাসি, চোখে ক্লামিত্ম নয়, ভালোবাসার ঝিলিক। বসুধা ঝরনার জল ছুঁইয়ে গিয়েছিল চোখে-মুখে। চুলের ভেতর উদ্বিগ্ন আঙুল। অল্পক্ষণেই উঠে বসেছিলেন পুলকদা। চোখ জঙ্গলের দিকে। সে-চোখে নরম হয়ে ভালোবাসা লেগে ছিল। পুলকদা বিড়বিড় করে বলেছিলেন, পায়রার পাখার এই মুখর হাততালি/ স্থির জলে শিশুটির ছুড়ে দেওয়া ঢিল/ এই ঢেউয়ে ঢেউয়ে ঢল/ তবু নিঃশব্দে অলীক রাত নামে …

আমাদের অনেকবার শোনা। শালবনি বা কুসুমপুরের রাতে এসব তো এসেছে-গেছে অনেক। কবিতা মানেই পুলকদার পুনর্জাগরণ। চাকরিটা ছিল একটা বেসরকারি অফিসের কেরানিগিরিতে। অনিশ্চয়তায় ভরা। পুলকদার ছেলে কলেজ শেষ করে চাকরির খোঁজ পেয়ে নাসিক না কোথায় চলে যায়, তার তখন একুশ-বাইশ, কখনো ফিরে আসেনি। ফোন ছাড়া যোগাযোগ নেই। বউদি খানিকটা রুগ্ণ। আমরা প্রায় ২৫ বছর ধরে দেখেছি আড্ডাই পুলকদাকে বাঁচিয়ে রেখে দিয়েছে। যেটুকু লেখালেখি তা নামমাত্র, নিজের লেখা নিয়ে কোনো উৎসাহ দেখাননি। বরং কবিতায় কথা বলতে ভালোবেসেছেন, যার প্রায় সবই অন্যের কবিতা। ফলে মাটি-পাথরে গা এলিয়ে শুয়ে পড়া পুলকদাকে আরো একবার বিড়বিড় করতে দেখে আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয়। পুলকদা বসুদার হাত ধরে উঠে বসেন। বসেই থাকেন কিছুক্ষণ। গাছ দেখেন, আমাদের থামিয়ে দিয়ে ঝিঁঝিঁ আর পাখির ডাক শুনতে চান। তারপর একসময় উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, কী হলো, চলো হাঁটি! পথ আর খুব বেশি নেই।

তিনটে দিন যে কীভাবে কেটে গিয়েছিল তা আমরাই জানি। সকাল একটু বাড়লে গোড়ালি ডোবানো জলের সোঁতা পার হয়ে বেরিয়ে চলে যেতাম। পিঠে রুকস্যাক, তাতে জল আর অল্প কিছু খাবার। ঘন বনের আলোছায়ার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের পায়ে পায়ে ঘুরতাম। পথজুড়ে ছিল নাম-না-জানা পাখির ডাক, বনমোরগের হঠাৎ মাটি ছেড়ে গাছের মাথায় উড়ে যাওয়া। রাক্ষুসে ঝিঁঝিঁর অবিশ্রান্ত কানে তালা লাগানো শব্দ, আমরা কোথা থেকে কোথায় চলে যেতাম। ফিরে আসতে শেষ-বিকেল।

পুলকদা এই তিনদিনের বেরোনোয় হাঁটলেন না আমাদের সঙ্গে। মানে এই প্রথম হাঁটতে পারলেন না। কিংবা বিশ্রাম নিতে চাইলেন। বসুধাও রয়ে গেল দুদিন। আমরা বিকেলে ফিরে এসে দেখতাম পুলকদা কোনো গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসা অথবা কাছেই ডিমা নদীর
পাড়ে সামান্য হাঁটছেন। মুখ তুলে মৃদু তাকাতেন আমাদের দেখে। সূর্য  ডোবার নরম আলো ঝিলিক মারত ওঁর চোখে। উঁচু আকাশে পাখিদের ঘরে ফেরার ডাক শুনে পুলকদা আবারো একটি-দুটি পঙ্ক্তি বলে ফেলতেন। সে-কবিতা হয়তো সূর্যাস্ত নিয়েই, কিংবা পাকাপাকিভাবে কোনো সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার। টেনিসন বা জীবনানন্দ দাশ। তখন দিন শেষ হয়ে যেত। চরাচর অন্ধকারে ঢাকা। কাঁধে বোঝা নেওয়া হাট-ফেরতা মানুষের মতো পাহাড়েরা চলে যেত অন্ধকারের দিকে। ভুটিয়া ঘরের মোমবাতি আলোয় আমরা একে-একে পানীয়ের গস্নাস হাতে তুলে নিতাম।

নিতান্ত কথার পিঠে কথার মতো আড্ডা শুরু হতো। খানিকটা পেছনে লাগা, খুনসুটি, পাড়ায় রয়ে যাওয়া কোনো দিপুদাকে নিয়ে আলোচনা। কিন্তু ক্রমশ এক-দুই-তিন পেগের পর পুলকদা সব আড্ডাকেই কবিতার দিকে টেনে নিয়ে যেতেন। সেখানে কোনো কবির ব্যক্তিগত জীবন নয়, কবিতার অদ্ভুত উচ্চারণে মদ নেমে যেত মুখ থেকে গলায়। পুলকদার কাছ ঘেঁষে বসুধা বারবার বলছিল, তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো!

নবমীর রাত শেষ হওয়ার মতো সেই তিনদিনও শেষ হলো। আমাদের পাঁচজনের একসঙ্গে বেরোনোর শেষ। আমরা হাসিমুখে ফিরে আসছিলাম। কিন্তু তারপর সবই অন্য রকম হয়ে গেল। চলন্ত ট্রেনে মৃত্যু এলো সেই বুকে ব্যথা হয়েই। মাঝরাতে, মাঝপথে। পুলকদা হাত নেড়েছিলেন, কিছু বলার সুযোগ পাননি। ভোরবেলা পাতা থেকে শিশির পড়ার মতো পুলকদা এভাবেই চলে গেলেন হঠাৎ। ট্রেনের মধ্যে।

দুই

ওঁর লেখা শেষ গল্পটা কি পড়েছিস তোরা? গস্নাসে প্রথম ঠোঁট ছুঁইয়ে জলজের প্রশ্ন।

পুলকদার গল্পের চেষ্টা হাতেগোনা। আমাদের এদিকে মানে বালুরঘাট-রায়গঞ্জের কিছু ছোট পত্রিকা, সেসবেই কখনো-সখনো বেরোনো। কবি হিসেবে তাঁর যেটুকু পরিচিতি গল্প-লিখিয়ে হিসেবে তাও নয়। আমরা যারা কাছের তারাই যা একটু জানি। যদিও শেষের গল্পটার কথা শুনিনি। জলজ বলল, বিষয়টা ভারি অদ্ভুত। একটি দেহাতি পরিবার। তারা অসুস্থ কিশোরী মেয়েটির চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসছে। ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়ার পথে চলন্ত ট্রেনেই মৃত্যু ঘটল মেয়েটির।

প্রথম পেগ থেকে সবারই একটু করে নেওয়া হয়ে গেছে। বাইরে শিশিরের শব্দ। জলজের কথার পর আমরা অনেকক্ষণ চুপ। বসুধা খানিক পরে বলল, জীবনের সঙ্গে গল্পের খানিকটা মিল ওঁর লেখায় এর আগেও এসেছে।

পুলকদার সঙ্গে এসেছিলাম গত বছর বর্ষার মুখে। তখন মেঘ জমছিল পাহাড়ের গায়ে। চারপাশ ঘন সবুজ। পুলকদাকে ছাড়া এলাম যখন, বর্ষা তখন চলে গেছে। আকাশ নীল। ডিমা নদীর জলে নুড়িপাথর দেখা যায়। গাছের সবুজে মিশেছে সোনালির ছোঁয়া। ঠিক একই ভুটিয়া বস্তিতে ফিরে এসেছি আমরা। পুলকদা পুনরুক্তিতে অবিশ্বাসী ছিলেন। তবু খানিকটা বাৎসরিক উদযাপনের মতো ওঁর টানেই আমরা আবার এসেছি। ওঁর পছন্দের পানীয় নিয়েই আমাদের সন্ধেবেলার ঘরটিতে বসা।

এবারে চারজন। শুরুতে অদ্ভুত একটা প্রসত্মাব দিয়েছিল অলয়। বলেছিল, আমরা চার, কিন্তু গস্নাস থাকবে পাঁচটা। প্রত্যেকবার নেওয়ার সময় দাদার নাম করে একটা গস্নাসে ঢালা হবে। সবশেষে ওটাই চারজন মিলে খাওয়া। দাদার প্রসাদ।

প্রসত্মাবটা মনে শুধু নয়, হৃদয়ে লেগে গিয়েছিল। এ যেন পুলকদাকে নিয়ে বসে খাওয়া। বসুধা শুধু বলেছিল, প্রসাদে কিন্তু বিশ্বাস ছিল না ওঁর। তোমরা বরং অন্য কিছু ভাবো।

জলজ বলেছিল, ভাগ করে খাই ভালোবাসা!

আমি চিরকালই দলের পার্টটাইম সঙ্গী। কখনো কোনো আকস্মিক দুপুর বা নির্জন সন্ধেতে পুলকদা হঠাৎ ডাক পাঠাতেন আমাকে। কী করছিস! চলে আয়। তখন সব ব্যস্ততা ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে যেতে হতো। আড্ডা হতো পুলকদার বাড়িতে বা কোনো অদ্ভুত ঠেকে। গল্পগুজব, কবিতা, গান এবং পানও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উধাও হয়ে যেত কীভাবে। কিন্তু অলয় আর জলজ ছিল ছায়াসঙ্গী ওঁর। জলজ কবি, অলয় ঘোরতর অ-কবি। একজন স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক, অন্যজন ফার্নিচারের দোকানদার। কিন্তু কোথাও আমরা সবাই এক। বছরে এক-দুবার পুলকদার বেরিয়ে পড়ার ডাকে আমাদের কাজ থাকত না কোথাও।

প্রথম পেগটা শেষ করে জলজ বলল, ওই বাইরে থেকে ডাক দেওয়ার মানুষটাই জীবনের জন্য দরকারি। আদারওয়াইজ ইউ আর ডেসটাইনড্ টু নো-হয়্যার।

অলয় বলল, তার মানে!

আমি বললাম, তার কোনো মানে নেই। আমরা মিলেছি আজ দাদার ডাকে।

আবছা আলোয় দেখি পুলকদার গস্নাসে জমে ওঠা পেগ টলটল করছে।

কবিতার টানেই যে জলজ শুরুতে পুলকদার দলে জুটেছিল এমন নয়। টানের অন্য গল্প ছিল। অন্য কোথাও। পুলকদার আরেক মেয়ে পিয়া, বালুরঘাট কলেজে পড়ার সময় পিয়া আর জলজের আলাপ। পিয়ার সূত্র ধরেই জলজ একদিন হাজির হয়েছিল পুলকদার কাছে।

দাদারও ভালো লেগেছিল ওকে। সে ভালোলাগা শুধু পিয়ার নিকট বন্ধু বলে নয়। পুলকদা পরে বলেছেন, জলজের ভেতরে উনি নিজের কলেজ আর প্রথম জীবনের ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। পুলকদা লেখেন। জলজ চেষ্টা করে যায়। জলজ প্রেমিক, অথচ কোথাও একটু উদাসী। পুলকদা চির-উদাসীন। পিয়ার চাইতে যেন পুলকদারই কাছের হয়ে ওঠে জলজ।

দ্বিতীয় পেগের পর ইংরেজির মাস্টার বলে, দ্যাট ম্যান অব লাইট অ্যান্ড শ্যাডো হ্যাজ রিয়ালি ডিপার্টেড আস। নাউ দেয়ার ইজ নো হ্যান্ড টু হোল্ড …

জলজের সঙ্গে বিয়ে হয়নি পিয়ার। হয়নি তার কারণ জলজ নয়, পুলকদাও নয়। তার কারণ পিয়া। পিয়া বিয়ে করেনি জলজকে। অনেকদূর এগিয়েও ও কী ভেবেছে, সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে চলে গেছে। আমাদের মফস্বল শহরে সদ্য পাশ করে ফেরা এক এমবিবিএসের সঙ্গে দুদিনের প্রেমে বিয়ে হয়ে গেছে ওর। পুলকদা একেবারে চুপ হয়ে গেছেন। যদিও পুলকদার স্ত্রী মানে আমাদের আরতি বউদি ভীষণ উৎসাহিত ছিলেন সেই বিয়েতে। জলজ কষ্ট পেয়েছে; কিন্তু একদিনও কোথাও প্রকাশ করেনি।

গস্নাস নামিয়ে জলজ সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, আমি একটা জিনিস বরাবর বুঝে এসেছি। পিয়ার জন্য কোনো ক্ষতি হয়নি আমার। একেবারেই নয়। বরং ওর জন্যই দাদার কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছি। সেটাই আমার জীবনের অন্য রকম পাওয়া, অন্য অভিজ্ঞতা।
কথাটা পুলকদাকে অনেকবার বলব-বলব করেছি। কিন্তু পরিস্থিতি তো আসেনি, তাই হয়তো বলে ওঠা হয়নি।

জলজ চুপ করে গেল। তিনজনের হাতে গস্নাস। বসুধার গস্নাসটা সামনে নামানো।

সেই নির্জন ভুটিয়া জনপদে কখনোই কোনো উচ্চকিত শব্দ নেই। দিনে নয়, রাতে তো নয়ই। কখনো আবছা কিছু বাতাসের মতো ঘরে এসে পৌঁছয়। আপাত অর্থহীন নারী-পুরুষের সংলাপ। কিন্তু এই সন্ধের পর সেসবও আর নেই। বাইরে বরং ডিমা নদীর একভাবে বয়ে চলার শব্দ, ছোট নদী চলছে তো চলছেই।

বসুধা তুলে নিয়ে ছোট্ট চুমুক দিলো নিজের গস্নাসে। তারপর নামিয়ে রেখে বলল, জলজদা, তোমার এই প্রাপ্তির কথা আজ অন্তত মনে মনে ওঁকে জানাও। শহর থেকে এত দূরে, যেখানে শেষবার উনি নিয়ে এসেছিলেন আমাদের।

জলজ গস্নাস হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে চলে গেল। বাইরে তখন আধো জ্যোৎস্না খানিক অন্ধকার। আমরা ওকে পিছু ডাকলাম না।

জলজের খাওয়ার ধরন একরকম। অলয়ের আলাদা। শুরু থেকেই জলজ ধীরু ও খানিকটা বিলাসী। কথা বলবে, শুনবে, মাঝে ঠোঁট ছোঁয়াবে একটু। অনেকটা পুলকদার মতো। তুলনায় অলয়ের ধরনই আলাদা। প্রথম পেগটা একটানে খাবে। নেশা হয়ে যাবে চটপট। তারপর ধরে ধরে এগোবে। জলজ অন্ধকারে বেরিয়ে চলে যেতে অলয় সোজা হয়ে বসল। তারপর বলল, আমি কী অবস্থা থেকে দাদার কাছে এসেছি তা তোরা জানিস। আমার তো তোদের সঙ্গে থাকারই কথা নয়।

আমরা চুপ। বাইরে কোনো শব্দ নেই। বসুধা তাকিয়ে অলয়ের মুখে। পুলকদার গস্নাসটা চোখের সামনে তুলে অলয় দেখল কিছুক্ষণ। স্বচ্ছ গস্নাসের ভেতর গাঢ় খয়েরি। মোমবাতির আলোর সঙ্গে যে ছায়া মিশে থাকে তাই গা চুঁইয়ে নামছে গস্নাসের। অলয় বলল, এত তাড়াতাড়ি আমাদের রেখে গিয়ে ভালো করেননি মানুষটা।

বালুরঘাটে আমাদের ছোট নদী আত্রেয়ী। তার ও-পাশের গ্রাম থেকে একটি লোক পুলকদার নতুন ছোট বাড়িতে কাঠের কাজ করতে আসত। সে প্রায় একযুগ আগে, লোকটির সঙ্গে থাকত এক সদ্য যুবক। ঢোলা জামা ফ্যাকাশে প্যান্ট, অনিল মিস্ত্রির ছেলে। বাবার ইচ্ছেয় বাবার সঙ্গেই কাজ শিখতে শুরু করেছিল। বারো ক্লাস পাশ করে কলেজে গেছে। কিন্তু সে আর তার বাবা জানত আদতে লেখাপড়া শিখে কোনো লাভ নেই। অথচ ছেলেটির কলেজের টান প্রবল। তাদের পরিবারে তার আগে কেউ প্রাইমারির গ–ও পেরোয়নি।

সেই অবস্থায় সে বাবার সঙ্গে কাজে আসত পুলকদার বাড়িতে। দরজা-জানালার কাজ। বসার ঘরে ক-টা চেয়ার, পুরনো আসবাবের মেরামতি। বাবার সঙ্গে সকালবেলা আসত। কাজ করত, কাজ শিখত। মাঝে একফাঁকে কলেজে চলে যাওয়া। ফিরতে বিকেল। তখন এসে আবার বার্নিশ লাগাত পুরনো পালঙ্কে।

এই ছেলেটিই একদিন নজরে পড়ে গেল পুলকদার। নজরে পড়ার প্রাথমিক কারণ কলেজের টানে দুপুরবেলা অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া। পুলকদা ওকে ডেকে কথা বললেন একদিন। ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, বাড়ির খবর। কাঠের কাজ শিখেও ওর মনের কোথাও অন্য কোনো বাসনা। খুব আবছা সেই ভাবনার কথা ছেলেটি নিজেও তখন ভালো করে জানে না। পুলকদা শুনলেন সব। কিচ্ছু বললেন না। শুধু নিজের সংগ্রহ থেকে একদিন একটি বই দিয়েছিলেন ওকে। জলধর সেনের হিমালয়

সে-বই পড়ে ছেলেটি অবশ্য পাহাড়ের মতো উঁচু হতে পারেনি। আবার পাথরের মতো শক্তও নয়। কলেজের দু-বছর শেষ করে ও কার-কার বুদ্ধিতে হঠাৎই চলে গেছে সুরাট। সেখানে কাপড়ে জরি বসানোর কাজ শিখবে। পুলকদার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। নিজের বাড়ির সঙ্গেও ক্ষীণ। ও এমন কিছু হয়ে উঠতে পারেনি যে, আমাদের মফস্বল শহর তখনো মনে রাখবে ওকে। জরির কাজ শিখতে গিয়ে সংক্ষিপ্ত স্মৃতি থেকে ছেলেটি হারিয়েই গেল একদিন।

ফিরে যখন এলো তখন ওর চারপাশটাই বদলে গেছে অনেক। পুরনো পাড়া নেই, পুরনো বন্ধুরা নেই। নদীর ও-পাশে ওদের গ্রামেও নগরের ছোঁয়া। ওর বাবা অনিল মিস্ত্রি মারা গেছেন অনেককাল। সে খবর ও সুরাটে থাকতে পেয়েছিল। আসতে পারেনি। ওর মা কোনো দিদির বাড়িতে গিয়ে থাকছে। ফলে ওর মাথাগোঁজার সামান্য জায়গা থাকলেও চারপাশ অন্ধকার। আয়ের ব্যবস্থা তেমন কিছু নেই। চেনাজানা লোক নেই। ফলে ও ভাবছিল সুরাটের দিন-রাতের খাটুনির কাজে আবার ফিরে যাবে কি না।

এই সময় ওর আরো একবার পুলকদার সঙ্গে দেখা। পুলকদা নিজেই ডাকলেন ওকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব শুনলেন। ওর লেখাপড়া শেষ না হওয়ার কথা। ওর সংক্ষিপ্ত জীবনের ইতিহাস। তারপর নিজেই জুড়ে গেলেন ওর সঙ্গে। ওকে দাঁড় করানোর চেষ্টায়।

বাজারের এখন যেটা মডার্ন ফার্নিচার তার মালিক আজকের অলয়। পুলকদার মাধ্যমে আমাদেরও কাছে আসা। বিক্রি হতে যাওয়া খুব ছোট এক চা-দোকান কিনে নিয়ে পাঁচ বছর আগে সংক্ষিপ্ত সূচনা। কেনার টাকা পুলকদারই দেওয়া। তবে অলয় দাঁড়িয়ে গেছে চটপট। টাকাও নাকি শোধ করে দিয়েছে। এখন ভালো চলে দোকান। হাল ফ্যাশনের খাট, ড্রেসিং টেবিল, সোফা। অলয় নিজে প্রায় কিছু করে না। সব কর্মচারী মারফত। দোকানের সামনে ছোট একটা তাকে কাচের ভেতর ও ওর বাবার পুরনো যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রেখে দিয়েছে। যে স্কুলটায় লেখাপড়ার শুরু সেই প্রাইমারিতে গত বছর ছোট বাচ্চাদের বেঞ্চ পাঠিয়েছে ও।

এর বাইরে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। বিয়েশাদি এখনো করেনি। হুটপাট বেরিয়ে পড়ে আমাদের সঙ্গেই। কবিতার আড্ডায় একটিও কথা না বলে চুপ হয়ে বসে থাকে। চুমুক চুমুক মদ খায়। সব শেষ হয়ে গেলে জড়ানো গলায় বলে – এসব আমি ঠিক বুঝি না। আমি বুঝি, ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি, আছে আমাদের পাড়াখানি। দিঘি তার মাঝখানটিতে …

পুলকদার লেখক-বন্ধুরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে। আমরা ওকে জোর করে থামাই। কেউ নিয়ে বাইরে চলে যায়। আর এসবের পরও ও অনাবিল স্নেহ আর প্রশ্রয় পেয়ে গেছে দাদার।

অলয় তিন নম্বর পেগও দেখলাম তাড়াতাড়ি শেষ করে দিলো। পুলকদার গস্নাস জল ছাড়াই অনেকটা ভরাট। জলজ তখনো বাইরে। বসুধা একবার ওকে ডাকার কথা বলেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কেউ উঠে যায়নি। এমনকি বসুধা নিজেও নয়। মোমবাতির আবছা আলোয় অলয় জড়ানো গলায় বলল, আমি লিখি না। খবরের কাগজটাও ঠিক করে পড়ার সময় পাই না। ব্যবসা করি আর পুলকদা বা তোরা যখন ডেকেছিস বেড়াতে চলে গেছি। দাদা শেষ পর্যন্ত তবু সম্পর্ক রেখে গেছেন আমার সঙ্গে। … সন্ধেবেলা হপ্তায় দুদিন তো হবেই আমার দোকানে এসে বসতেন। আমাকে নিয়ে হঠাৎই দোকান শেষের পর হাঁটতে চলে গেছেন নদীর দিকে। তখন একেক দিন বিড়বিড় করে নিজের মৃত্যুর কথা বলতেন। নিচু গলায় খুব আশ্চর্য কিছু কথা। আমার মনে হতো দাদা যেন মৃত্যুকে ভালোবাসতে চান!

বসুধা বলল, পিস্নজ অলয়দা, আজ অন্তত ওই কথাগুলো থাক। অলয় বলল, আজ কেন, কোনোদিনই বলা হবে না সেসব। দাদা তো শুধু আমার সঙ্গেই বলেছেন।

পুলকদা মারা যাওয়ার প্রায় মাসদুয়ের মাথায় একটা স্মৃতিসভা হয়েছিল। যাদের করার কথা ছিল তারা কেউ নয়, আয়োজনে ফার্নিচার দোকানদার। একটা ক্লাবের দোতলায় ছোট দল আমাদের মফস্বলি ভিড়ে উপচে পড়েছিল। পারিবারিক সম্পর্কে নয়, এমনকি লেখালেখি সম্পর্কেরও বাইরে, এমন যে কত মানুষ। আমরা একেবারেই চিনতাম না বা কম চিনতাম এমন অনেকে। সবাই তারা দাদার টানে হাজির। সেই সভায় মাইকে পুলকদাকে নিয়ে একটি কথাও হয়নি। স্মৃতিচারণ নয়, নীরবতা পালনও নয়। অনেকদিন আগে অন্ধকার নদীর ব্রিজে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা খসা দেখতে দেখতে দাদা নাকি এমনই এক স্মরণসভার কথা অলয়কে বলে গেছেন। যেখানে কথা নয়, অল্পকিছু গান হবে। হয়েছিলও তাই। ওঁর প্রিয় গান। লালন, কুবির গোঁসাই, রবিঠাকুর। একদা এলাকায় দাদাগিরি করে বেড়ানো মোটা-তারক ওরফে মনাকে আমরা পেছন দিকে বসে চোখ মুছতে দেখেছি।

পুলকদার গস্নাসটা তুলে নিয়ে অলয় মোমবাতির আলোয় চোখের সামনে দেখল। জল মেশানো হয়নি সেখানে। আর এই সময় জলজ ঢুকে এলো ঘরে। ওর পাত্র খালি। বলল, পাহাড়ের পেছন থেকে এতক্ষণে একফালি চাঁদ উঠে এলো। বনের ভেতর সেই আবছা আলো। দাদা বলতেন, এদিকে এ-সময় হরিণেরা নাকি নদীতে জল খেতে আসে।

বসুধা বলল, আজ রাতে আমরা সেই জল খাওয়া খুঁজতে বেরোব। নাও, ভাগ করো।

অনেকক্ষণ পর বসুধার গলা। ও সবারটা শুনছিল আর একটু একটু করে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছিল। যদিও এর মধ্যে ওর-ও দুটো শেষ। পুলকদা থাকতেও দেখেছি পুলকদার এই প্রিয় মেয়ে আড্ডাতে বেশিটা নীরব। সবারটা শুনবে, অল্প করে খাবে, শেষদিকে হয়তো কিছু বলল বা বলল না।

বেশ ধীরে অলয় দাদার গস্নাসে জমে ওঠা পানীয় চারজনেরটায় ভাগ করে দিলো। খানিক নেশায় খানিক মোম আলোর আবছায়ায়, বাকিটা কোনো না-জানা বোধে বুকের মাঝখানটা কেঁপে উঠল হঠাৎ। বসুধাকে বললাম, আজ অন্তত তুই বাবার কথা একটুখানি বল।

বাইরে খসখসে কোনো শব্দ। এ-শব্দ বাতাসের বা কোনো ছোট প্রাণীর চলে যাওয়ার। বসুধা জলহীন গাঢ় পানীয়টা চোখের সামনে দেখল একবার। ওর আয়ত তীক্ষন চোখে। তারপর একটানে ঢেলে দিলো গলায়। গস্নাস নামিয়ে রেখে নিজেকে সামলাল কিছুক্ষণ। তারপর বলল – কে বাবা?

আমরা চুপ। বসুধা বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ঠোঁটের চারপাশ মুছে নিচ্ছে। কাজুবাদামের একটা দানা ওর বাঁহাতের তালুতে। বলল, বাবা তো আমার এগারো বছর বয়সে মাকে আর আমাকে ফেলে পালিয়ে অন্য কোথাও বিয়ে করে নিয়েছে …।

চকিতে একটা পুরনো অধ্যায় যেন একটুখানি উঁকি দিয়ে গেল। যে-অধ্যায় আমরা জানি, কিন্তু কখনো বলি না। এমনকি ভাবিও না বহু দিন। আমাদের চিন্তার গভীরে বসুধা পুলকদার মেয়েই।

বসুধা ধীরে ধীরে বলে গেল – যিনি পুনর্জন্ম দিলেন তাকেই অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাবা বলে ডেকেছি। যেখানে হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেখান থেকে তিনি হাত ধরে নিয়ে এলেন। আসলে বাবা নন, তিনি আমার বন্ধু। তাঁর ভালোবাসা এখন আমার গলায়।

পুলকদার গস্নাস ভাগ হওয়ার পর সেই ভালোবাসা তখন আমাদের সবার গলায়। অলয় জড়ানো স্বরে কী একটা বলতে চাইছিল। বসুধা ওকে হাত তুলে থামাল। বলল, এই শেষ ভাগটুকু নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকি না কেন! পাতা ঝরার শব্দ শুনি। নদীর জলে নুড়িপাথরের শব্দ। তারপর আবার যদি কিছু ইচ্ছে হয় তো বলি …।

অলয় থেমে গেল। আমরাও। যদিও আমার মাথায় সাদা-কালো বাংলা ছবির মতো কিছু ছবির আঁকিবুঁকি। দশ-এগারো বছরের মেয়ে আর তার মাকে ফেলে শহরের বড়লোক বাড়ির এক লম্পট যুবক পালিয়ে গেছিল একদিন। মা দিশেহারা মেয়েকে নিয়ে কী করে
কোথায় যায়, শেষ পর্যন্ত গেঞ্জি মিলে কাজ করা ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয়। সেখানে থেকে মা লোকের বাড়িতে ঠিকে কাজ করে। কাজ করে মেয়েকে পড়ায়। সেই মেয়ে বড় হয়ে উঠল একটু একটু করে। ক্লাসে মোটামুটি করল। তারপর আর একটু বড় হতে তার চেহারা আর চোখেমুখে এসে পড়ল লম্পট বাবার পরিবারের পুরনো আভিজাত্যের ছায়া। তখন তার দিকে হঠাৎ গোটা এলাকার নজর।

কিন্তু তাদের তো আশ্রয় নড়বড়ে। আশ্রয় নড়বড়ে তাই আত্মরক্ষাও নড়বড়ে। এলাকার গু-া-বদমাশ, নেতার ছেলে, সবাই হাত বাড়াতে চায়। মামা রূপ দেখিয়ে আগাম পার করার জন্য সম্বন্ধ আনে। মাতাল বাবাও খোঁজখবর পেয়ে কোনো মাতাল বন্ধুকে তার ছেলের জন্য কথা দিয়ে দিলো।

এই বিষের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে মেয়েটি কলেজে যায়। আর পরিত্রাণ খোঁজে। এ-সময় পুলকদার সঙ্গে আলাপ। পুলকদার মেয়ে পিয়ার সমবয়সীই সে। সেই সূত্রে কোনোভাবে এসে পড়েছিল।

তারপর বাকি অংশ এক মফস্বলি ইতিহাস। সে-ইতিহাসের মূল চরিত্র দুই অসমবয়সী বন্ধু। একজনের কৈশোর ছাড়িয়ে যুবতী হয়ে ওঠা। অন্যজনের প্রৌঢ়ত্বের পথে যাত্রা। একজন তার রূপ আর ক্রমশ প্রকাশিত গুণের জন্য সবার কাছে চেনা। বসুধা এদিকের নাট্যদলে অবশ্যম্ভাবী মুখ হয়ে উঠল দিনে দিনে। গ্রম্নপ থিয়েটারে তার অভিনয়ের কথা আমাদের শহর ছাড়িয়ে শিলিগুড়ি-বহরমপুরেও পৌঁছয়। অন্যজন মামাবাড়ির গলিঘুঁজির জীবন থেকে বার করে তাকে যিনি আকাশ চিনিয়েছিলেন, পৌঁছে দিয়েছিলেন আলোর পৃথিবীতে, অনন্ত প্রশ্রয়ে তিনি তার হাত ধরে রেখেছিলেন।

বাতাসে গুঞ্জন অবশ্য ছিল। আমরা তখন একটু-একটু করে পুলকদার বন্ধু। বছরে এক-দুবার একসঙ্গে বেড়াতে যাই।
বসুধাও যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে। গোপালপুর থেকে শঙ্করপুর বিচ-ট্রেকিংয়ে জেলেদের খটিতে রাত কাটাই। সেখানে বালিয়াড়ির পূর্ণিমায় সারারাত লালন গায় বসুধা। গাইতে গাইতে নেচে ওঠে। তার ‘বাবা’কে হাত ধরে টেনে নেয়। আর এসব খবর বাতাসের সঙ্গে
ভেসে ভেসে বালুরঘাটেও এসে পৌঁছয়। পথচলতি গুজব প্রথম থেকে ছিলই, পুলকদার বাড়িতেও বাতাস গম্ভীর হয়ে ওঠে। সব থেকে অশামিত্ম করে পিয়া। যার হাত ধরে বসুধা এ-বাড়িতে পৌঁছেছিল। পুলকদার স্ত্রী সন্দেহপ্রবণ। ফলে আগুনে ঘিয়ের ফোঁটা পড়ে তখন। পুলকদা কোনো ক্রমে অশান্ত সাগরে নৌকো বেয়ে যান। আড্ডায় এসে আগের মতোই মুচকি হাসেন আর পছন্দের কবিদের কবিতা শুনিয়ে ফেলেন।

পিয়া আর বসুধার বিয়ে হয়েছিল ছ-মাসের তফাতে। পিয়ার বিয়ে হলো এলাকায়। বসুধা রাউরকেল্লা চলে গেল। বসুধার চলে যাওয়াটা আমাদের সবার কাছেই ছিল বন্ধুবিচ্ছেদের মতো। পুরনো আড্ডাটা যেন খাপছাড়া হয়ে গেল। অবশ্য সময় থাকতে খবর দিলে বছরে ও এক-দুবার আসছিল। যেমন এসেছিল গত বছর এইখানে এবং এবার পুলকদার মৃত্যুবার্ষিকীর বেড়ানোয়।

অলয় পুরোপুরি টাল হয়ে গেছে। জলজ পুলকদার নামে জমিয়ে রাখা পানীয়টুকুসহ সবাইকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইল। মোমবাতির বেশিরভাগটা পুড়ে প্রায় শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। বসুধা আবছা গলায় বলল, বালুরঘাটে এই শেষ আসা আমার। আর কখনোই ফিরব না। তোমাদের সবাইকে তাই কিছু কথা বলে যাই।

এত নেশা, এত নীরবতা, মাথার মধ্যে স্মৃতির নানা এলোমেলো দৌড়। জলজ গস্নাস হাতে বাইরে চেয়ে আধখোলা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমি অলয়কে ঠেলে ঠেলে দাঁড় করাতে চাই। বসুধা ধীর সংলাপের মতো কথা বলে যায়। মোমবাতি পোড়ে।

বসুধা বলে, এতদিন যাকে বাবা বলে ডাকলাম, অন্তত তোমরা যাকে বাবা বলে ডাকতে শুনেছ, তোমাদের সেই পুলকদা আমার বাবা শুধু নন, প্রেমিকও। সবচাইতে ভালোবাসার মানুষ। আমার প্রাণের মানুষ। আর প্রাণের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে তো কোনো বাছবিচার থাকে না। আমাদেরও ছিল না। আমরা রাখতে পারিনি, চাইওনি হয়তো। একাধিকবার আমাদের শরীর সম্পর্কও হয়ে গেছে …

আমরা কথা বলি না। বসুধাকে নিয়ে অলয়কে নিয়ে বাইরে যেতে চাই। যেন জঙ্গল ডাকছে, পাহাড় ডাকছে, রাতের পাহাড়ি নদী আর নুড়িপাথর ডাকছে। বসুধা উঠে দাঁড়ায়। ওর হাতে নিজের গস্নাস নয়। পুলকদার শেষ হয়ে যাওয়া গস্নাসটা। সেটা ধরে রেখেই ও বলে, আমাদের শেষ সম্পর্ক হয় গত বছর। এইখানে। যখন ওঁকে আর আমাকে রেখে তোমরা সারাদিনের মতো বেড়াতে চলে গেলে। তার আগে আসার পথে ওঁর বুকে ব্যথা হয়েছে। উনি কী বুঝেছেন কে জানে। আমাদের শেষ মিলনে মৃত্যু ছায়া ফেলছিল বারবার। উনি ওই সময়ও পাতা ঝরার শব্দ শুনতে চাইছিলেন …।

ঘর ছেড়ে আমরা চারজন বাইরে বেরিয়ে আসি। জঙ্গলে বেরোই। আধো জ্যোৎস্না লাগা জঙ্গল, কুয়াশার ঝোপ, ছোট প্রাণীদের পাতা সরিয়ে চলে যাওয়া। আমরা হেঁটে বেড়াই। জলজ স্থির পায়ে। আমিও মোটামুটি তাই। অলয়কে ধরে রাখতে হয়। বসুধাও হাঁটে, নিঃশব্দে, আঙুল ছুঁইয়ে মাঝে মাঝে গাল থেকে চোখের জল মুছে নেয়।

আমরা নদীর কাছাকাছি আসি। নদী, নুড়িপাথরের নদী। আমাদের পাশে পাশে বয়ে চলেছে সে। যেন আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে হাজার বছর ধরে তার এই চলে যাওয়া। পাহাড়, জঙ্গল, সম্পর্কের ভাঙাগড়া নদী দেখেছে। আরো কত দেখবে কে জানে!