ফাঁদ

আহমাদ মোস্তফা কামাল

বউয়ের কাছে ক্রমাগত অপদস্থ হতে হতে একসময় জামানের মনে হতে থাকে – এই ভোগান্তির জন্য সে নিজেই দায়ী, কিংবা তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অপটুতা দায়ী। সিদ্ধান্তটি ছিল শায়লাকে বিয়ে করা। তার দূরদৃষ্টি নেই, ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে সে-সম্পর্কেও কোনো আগাম ধারণা করতে অসমর্থ, ফলে বিয়ের আগে থেকে শায়লাকে চিনলেও এবং বহু ঘটনায় তার স্বভাবের পরিচয় পেলেও জামান বুঝে উঠতে পারেনি যে, এই স্বভাবগুলোই একদিন তার জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলবে। মানুষ সম্বন্ধে শায়লার সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক। খুঁত ধরার ব্যাপারে তার জুড়ি নেই, সেই খুঁতকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রমাণ সাইজের করে তুলতেও জুড়ি নেই, এমনকি একসময় সেই মানুষকে ঘৃণার যোগ্য বলে চিহ্নিত করতেও তার জুড়ি মেলা ভার। ফলে চারপাশের প্রায় সব মানুষকে শায়লা
ইতিমধ্যেই ঘৃণা করতে শুরু করেছে। ওইটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলেও হয়তো চলতো, কিন্তু শায়লা শুধু নিজে ঘৃণা করে সন্তুষ্ট নয়, জামানও কেন তাদেরকে ঘৃণা করছে না, কেন তাদের নিন্দা-মন্দ করছে না – এ নিয়েও তার অভিযোগের অন্ত নেই। যেহেতু জামান ঘৃণা করছে না, বরং সুযোগ পেলেই তাদের সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা তার মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ছে, অতএব সেও যে ওই একই ধরনের মানুষ, অর্থাৎ ঘৃণা করার মতো মানুষ – এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হয় না শায়লা। জামান বুঝে উঠতে পারে না – তার অপরাধটা কী! কেন কথায় কথায় তাকে অপদস্থ করে মেয়েটা? সে নিরীহ-শান্ত-গোবেচারা টাইপের মানুষ, মানুষ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতিবাচক – এত খুঁত ধরা, এত দোষত্র“টি খুঁজে বেড়ানো তার স্বভাবে নেই – ঝগড়া ব্যাপারটা তার আসেই না, শায়লা যখন উচ্চৈঃস্বরে হিসহিস করে তার ঘৃণা ছড়ায়, সে তখনো নীরবই থাকে। কোনো কথারই জবাব দেয় না বলে শায়লার রাগ আরো বাড়ে, সে প্রায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, কতটুকু বললে কথাগুলো শোভনীয়তার সীমা অতিক্রম করে যাবে না – সেটুকুও মনে থাকে না। ফলে এমন অনেক কথাই সে বলে ফেলে যা তাদের দাম্পত্য জীবনটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে, এবং সেটি করতে করতে তাদের সম্পর্কের ভেতরে এখন আর প্রেম বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। জামান আগে ভাবতো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। হয়নি, কিছুই ঠিক হয়নি। অবিরাম আক্রমণে বিধ্বস্ত-ক্লান্ত হয়ে একসময় জামান ভাবতে থাকে – কোনো এক অজানা ভুলে শায়লাকে বিয়ে করেছিল সে, যার প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে সারাজীবন। জীবনের কোন পর্যায়ে কোন ভুলের কারণে তার মতো নির্বিরোধ একজন মানুষ এরকম এক মুখরা রমণীর জালে আটকা পড়লো সেটির খোঁজ করার জন্য জামান এবার পেছনের দিকে হাঁটে। বিয়ের সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল কেন? কারণ তার আগে প্রেম হয়েছিল তাদের। প্রেম হলেই যে বিয়ে হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, পৃথিবীর বহু প্রেম ভেঙে যায়, বহু প্রেম মরে যায়, বস্তুত প্রেম জন্মায় মরে যাওয়ার জন্যই, সেই মৃত্যু বিয়ে ছাড়াও ঘটতে পারে, বিয়ের পরেও ঘটতে পারে। তাদেরটা ঘটেছে বিয়ের পর, আগেই ঘটলে এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। কিন্তু প্রেমের আগেই তো পরিচয় হয়েছিল। পরিচিত সবার সঙ্গে তো আর প্রেম হয় না, বরং অধিকাংশ পরিচিত মানুষই চিরকাল কেবল ‘পরিচিত’ই থেকে যায়, গুটিকয়ের সঙ্গে হয় বন্ধুত্ব, কারো কারো সঙ্গে প্রেম। প্রেমটা আসলে খুব দুর্লভ ঘটনা। তার জীবনে যদি সেই দুর্লভ ঘটনাটি না ঘটতো তাহলে শায়লাও রয়ে যেত পরিচিত মানুষের তালিকায়, হয়তো একদিন তালিকা থেকে তার নামটি মুছেও যেতে পারতো, যেভাবে পরিচিত মানুষরা একসময় বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায়, সেভাবে। কিন্তু পরিচয়েরও তো একটা সূত্র থাকে। জগতের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে একজন মানুষ কতজনের সঙ্গেই বা পরিচিত হয়? খুব কম, খুবই কম। হাতেগোনা কয়েকশো, বা কয়েক হাজার পরিচিত মানুষের বৃত্তেই তার জীবন কাটে। অসংখ্য মানুষের ভেতর থেকে কারো কারো সঙ্গে এই পরিচয় হয়ে ওঠার জন্য ঘটনা পরম্পরা লাগে, লাগে সংযোগসূত্র। শায়লার সঙ্গে সেই সংযোগসূত্রটি স্থাপন করেছিল তার সহপাঠী-বন্ধু হাসিব। শায়লা হাসিবের চাচাতো বোন। বন্ধুর চাচাতো বোনের সঙ্গে পরিচয় হতেই পারে, কিন্তু সব বন্ধুর বেলায়ও সেটি হয় না। কেবল ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের পরিবারের সঙ্গেই পরিচয় ঘটার সুযোগ থাকে। হাসিব তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ছিল। এই ঘনিষ্ঠতা না-ও হতে পারতো। সহপাঠী অনেকেই থাকে, তাদের সকলের সঙ্গে এক ধরনের বন্ধুত্ব বা বন্ধুসুলভ সম্পর্কও থাকে, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুতা হয় কারো কারো সঙ্গে। কেন হয়, সেটি সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। স্বভাবের মিল, চিন্তার মিল, দৃষ্টিভঙ্গির মিল ইত্যাদি কারণকেই সচরাচর ঘনিষ্ঠতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এর ব্যতিক্রমও হরহামেশা চোখে পড়ে, অর্থাৎ বিপরীত স্বভাবের মানুষদের ভেতরেও কখনো-কখনো ঘনিষ্ঠতা জন্মাতে দেখা যায়। হাসিবের সঙ্গে যদি তার ওই ধরনের বন্ধুত্ব না হতো তাহলে শায়লার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কমে যেত। অবশ্য পরিচয়টি হয়েছিল একটা কাজের সূত্রে। জামান তখন একটা টিউশনি খুঁজছিল, কারণ সে তখন বেশ আর্থিক সংকটে ভুগছিল, আর সেটি জানতে পেরে হাসিব স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাকে চাচার বাসায় নিয়ে গিয়েছিল এবং সে নিযুক্ত হয়েছিল শায়লার গৃহশিক্ষক হিসেবে। বেশ কয়েক বছর ধরে শায়লাকে পড়ানোর সুবাদে তাদের ভেতরে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, পরিচয় থেকে প্রেম হওয়ার সেটিও হয়তো একটি কারণ। কিংবা প্রেমের কারণটি আসলে সবসময়ই অজানা থাকে, কেউ এটাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না, মানুষ খামোকাই ব্যাখ্যার চেষ্টা করে, সুতরাং এই প্রেমের কারণ নিয়েও সে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না। তবে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত না হলে, অনেকদিন ধরে কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ না ঘটলে, পরস্পরের ভেতরে সহজ সম্পর্কটি গড়ে না উঠলে কেবল বন্ধুর চাচাতো বোনের পরিচয় থেকে প্রেম হয়ে ওঠা বেশ দুষ্কর ব্যাপারই হতো। দীর্ঘ সময় ধরে দেখার সুযোগ ঘটেছিল বলেই সে তখনই মানুষ সম্পর্কে শায়লার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পেয়েছিল। এদিক থেকে দেখতে গেলে দুজনের স্বভাব বিপরীতধর্মী। জামান বিষয়গুলোকে একটু সহজভাবে দেখতে চায়। মানুষ অন্যায়-অপরাধ করে এবং যারা এর শিকার হয় তারা নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া না গেলেও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইনকানুন আছে, সামাজিক রীতিনীতি আছে, এবং সেগুলোর প্রয়োগও আছে। একইভাবে মানুষ ভুলও করে, যারা সেই ভুলের শিকার হয় তারা অবশ্যই আহত হয়, কিন্তু এও সত্য যে, ভুল করার পর কেউ কেউ অনুতাপদগ্ধ হয়, ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়াই ভালো। জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় অভিজ্ঞতা হলো মানুষকে ক্ষমা করতে পারা – মন হালকা হয়ে যায়, হৃদয় শুদ্ধ হয়, জামান সেই আনন্দ পেতে ভালোবাসে, কিন্তু শায়লার অভিধানে ক্ষমা শব্দটি নেই। বছরের পর বছর ধরে সে অন্যের ভুলগুলো ধরে বসে থাকে, ফলে সেগুলো যত বড়ো ভুল নয় তারচেয়ে অনেক বড়ো হয়ে তার সামনে হাজির হতে থাকে, তার মন ক্রমশ কলুষিত হয়, এবং সেখানে ঘৃণার জন্ম হয়। এত ঘৃণা, এত বিদ্বেষ নিয়ে মনটাকে ভারি করে তুলে একজন মানুষ কীভাবে এত স্বচ্ছন্দে বেঁচে আছে জামান ভেবে পায় না। এই গল্পটি শুনতে শুনতে যারা ভাবছেন – নিতান্তই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরো ব্যাপারটিকে দেখা হচ্ছে, তারা শায়লা এবং জামানের অবস্থান পরিবর্তন করে, অর্থাৎ জামানের জায়গায় শায়লাকে এবং শায়লার জায়গায় জামানকে বসিয়েও দেখতে পারেন – ঘৃণা ও ক্ষমা সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গির কোনো হেরফের হচ্ছে কী না! যা হোক, জামান তার ভুলের সূত্র সন্ধান করতে গিয়ে নানা ভাবনায় খেই হারিয়ে ফেলে আবার পুরনো ভাবনায় ফিরে আসে। শায়লার সঙ্গে বিয়ে-প্রেম-পরিচয়ের সূত্র হিসেবে সে হাসিবের সঙ্গে তার বন্ধুতার কারণটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। কিন্তু ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব দূরের কথা, পরিচয়ই হতো না যদি না তারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিষয়ে পড়তে আসতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক, যেন এখানে পড়ার সুযোগ পাওয়াই একটা মিরাকল, এমনকি পরীক্ষার খাতায় একটা প্রশ্নের ভুল উত্তরও একজনকে ঠেলে দিতে পারে মাঠের বাইরে। এখানে নিজের পছন্দমতো বিষয়ে পড়তে পারাটাও আরেক মিরাকল। ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ওপরে ভিত্তি করে সবসময় ভর্তি করা যায় না, সংশ্লিষ্ট বিভাগে আসন খালি থাকা-না-থাকাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হিসেবে কাজ করে। জামান এবং হাসিবের নিশ্চয়ই এগুলো মিলে গিয়েছিল, নিশ্চয়ই তাদের প্রাপ্ত নম্বর খুব কাছাকাছি ছিল, যদি একটু এদিক-ওদিক হতো তাহলে দুজন পড়তো দুই বিষয়ে। আরেকটু এদিক-ওদিক হলে হয়তো একজন পড়ার সুযোগ পেতো, আরেকজন আদৌ পেতো না। ঠিক এই পর্যন্ত এসে জামান নিয়তিতাড়িত মানুষদের কথা ভাবতে থাকে। এগুলো কাকতাল হয়তো, কিন্তু তার মনে হতে থাকে – এতে নিশ্চয়ই নিয়তির হাত আছে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এই ভোগান্তির জন্য নিজের কোনো দায় থাকে না, ভুলের বোঝাও নিয়তির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া যায়! কিন্তু আরেকটু পেছনে তাকিয়েই সে বুঝতে পারে, এই নিয়তিকে এড়ানোর সুযোগ তার ছিল। যেমন, সে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করতে পারতো। সেখানে গেলেও নিয়তিই তাকে অন্য কোনো এক বাস্তবতায় নিয়ে ফেলতো, বলা বাহুল্য, কিন্তু সে এখন ভাবছে বর্তমানের বিভীষিকাময় বাস্তবতা নিয়ে। এর কার্যকারণ খুঁজে হয়রান হচ্ছে সে। নিয়তিকে এড়ানোর সুযোগ তার জীবনে এর আগেও এসেছিল। এইচএসসি পরীক্ষার কয়েকদিন আগে আকস্মিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা মারা যান। সেটি ছিল তার জীবনে দেখা প্রথম আপনজনের মৃত্যু এবং ঘটনার আকস্মিকতায় সে ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল এবং তার পরীক্ষার প্রস্তুতি দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। মা এবং ভাইবোনেরা বলেছিল, ওই বছর পরীক্ষা না দিয়ে পরের বছর দিতে। সে কারো কথা শোনেনি। বুকে পাথর চেপে, খানিকটা জেদ করেই সে পরীক্ষা দেয় এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো ফলাফল করে। যদি পরীক্ষা না দিতো তাহলে সে এক বছর পিছিয়ে পড়তো, পরের বছর পরীক্ষা দিয়ে এই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে ভর্তি হলেও হাসিবের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হতো না, সম্পর্কটি হতো সিনিয়র-জুনিয়রের, হাসিবকে সব কথা বলার সুযোগই থাকতো না তার এবং হাসিবও তাকে নিয়ে চাচার বাসায় যেত না। নিয়তির এই খেলাধুলা তার সঙ্গে এর আগেও চলেছে। সে যখন প্রাইমারি স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে হাইস্কুলে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছে তখন একবার ভীষণ অসুখে পড়ে। শুরুতে অবশ্য সেটি সামান্য জ্বর ছিল, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে জ্বরটি প্রায় পাঁচ মাস স্থায়ী হয়। জুনের শুরুর দিকে যখন সে একটু উঠে দাঁড়ায় তখন শিক্ষাবর্ষের প্রায় অর্ধেকটা পার হয়ে গেছে। সে স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে বাবা তাকে বলেন, এখন তোকে কোন স্কুল নেবে? পরের বছর থেকে শুরু করিস। কিন্তু সে নাছোড়বান্দার মতো ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকে। পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার এই সুবর্ণসুযোগ পেয়েও সে যে স্কুলে যাওয়ার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে ওঠে তার কারণ তার শিক্ষানুরাগ নয়, তার দুই চাচাতো ভাই একই ক্লাসে পড়তো, এক বছর বিরতি দিলে ওরা ওপরের ক্লাসে উঠে যাবে, এবং সারাজীবন ওপরের ক্লাসেই থাকবে, সে পড়ে থাকবে নিচে – এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। তার কান্নাকাটিতে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক ধরাধরি-চেষ্টাচরিত্র করে বাবা তাকে একটা মাঝারি মানের হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। তার মানে দাঁড়ায় – নিয়তি তাকে সেই ছোটবেলাতেই সুযোগ করে দিয়েছিল যেন হাসিবের সঙ্গে দেখা না হয়! কিন্তু সে সেই সুযোগ গ্রহণ না করে বরং বিরোধিতা করেছে। সেখানেই শেষ নয়। তারও আগের ঘটনাসমূহের দিকে চোখ ফিরিয়ে সে দেখতে পায় – যে চাচাতো ভাইদের নিচের ক্লাসে পড়বে না বলে সে জেদাজেদি করছিল, তারা আসলে তার চেয়ে বয়সে বড় এবং তাদের ওপরের ক্লাসেই পড়ার কথা। কিন্তু মা তার নিজের ছেলেমেয়েদের অতি অল্প বয়সে স্কুলে পাঠানোর বিরোধী ছিলেন বলে বাড়িতেই পড়াতেন, তারপর স্কুলে গিয়ে একটু উঁচু ক্লাসে ভর্তি করতেন। তাকেও সরাসরি ক্লাস টুতে চাচাতো ভাইদের সঙ্গে ভর্তি করেছিলেন। সেটা না করে যদি তাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করা হতো, তাহলেও সে বরাবর এক বছর পিছিয়ে থাকতো, বড় হয়ে কোনো এক কুক্ষণে হাসিবের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতো না, শায়লার সঙ্গে পরিচয় হতো না, প্রেম বা বিয়েও হতো না। যেন সবকিছু সাজানো-গোছানো, যেন ভবিষ্যৎ-জীবনের এই ভোগান্তির জন্য বহু আগে থেকেই ছক কেটে রাখা হয়েছিল। নিখুঁত ছক, কোথাও কোনো ফাঁক-ফোকর নেই, এমনকি দুর্ঘটনাবশতও ছক-পরিকল্পনায় কোনো ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়নি। কিন্তু এতসব ভেবেও জামান স্বস্তি পায় না, কোথায় তার ভুলটি হলো, তার কী দায় ছিল – ভেবে মরে সে। আর তখন তার মনে হয় – পুরো ব্যাপারটি এভাবে দেখলে ভুল হবে, হয়তো বিয়েটা তার জীবনে একটি দুর্ঘটনা, হঠাৎ ঘটে গেছে। আর এ-তো জানা কথাই, দুর্ঘটনা সর্বদা হঠাৎই ঘটে, কিন্তু তা জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। এই নতুন ভাবনার পক্ষে সে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করায় তার জন্ম নেওয়ার ব্যাপারটাকে। বাবার লাখ লাখ শুক্রাণুর ভেতরে মাত্র একটি শুক্রাণু মায়ের ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করেছিল বলেই তার জন্ম হয়েছিল, যেমনটি সবারই হয়ে থাকে। ওই নির্দিষ্ট শুক্রাণুটি বিজয়ী না হয়ে যদি অন্য কোনোটি হতো তাহলে অন্য কারো জন্ম হতো, তার নয়! অর্থাৎ জন্মও নেই, জীবনও নেই, ভোগান্তিও নেই। তার মানে, জন্মটাই একটা কাকতাল মাত্র। এই পর্যন্ত ভেবে সে যেন মায়ের গর্ভের উষ্ণতার সন্ধান পেল আর মনে পড়লো মিলান কুন্ডেরার সেই বিখ্যাত উক্তি – ‘আমরা সর্বদা জেনে এসেছি, জীবন একটা ফাঁদ। আমরা আদৌ জন্মাতে চাই কী না সেটি জিজ্ঞেস না করেই আমাদের জন্ম দেওয়া হয়েছে, আমাদের এমন একটা শরীরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে যা আমরা নিজেরা বেছে নিইনি, এবং আমাদের জন্য অবধারিত করে রাখা হয়েছে মৃত্যু।’ জন্ম এবং জীবনের ঘটনাসমূহ কাকতাল হতে পারে, দুর্ঘটনাও হতে পারে, কিন্তু অন্তত একটি অবধারিত সত্য আছে মানুষের জন্য। মৃত্যু। সেটি আসবেই, তখন সব ভোগান্তির অবসান ঘটবে। সব যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটবে, সেই অনিবার্য সুন্দরের জন্য অপেক্ষা করাই ভালো। এই কথা ভেবে সে এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এবং মাতৃগর্ভের উষ্ণতার কল্পনায় তার ঠোঁটে এক টুকরো মৃদু-মিষ্টি হাসি ঝুলে থাকে।