ফিরে দেখা কবিতা সিংহ

প্রমিতা ভৌমিক

কবিতা সিংহ তাঁর ‘মহাশ্বেতা’ কবিতায় লিখেছিলেন :

তুমি কেন তিনশ’ বছর আগে

এই ভুল পৃথিবীতে এলে?

(‘মহাশ্বেতা’, হরিণা বৈরী)

কবিতাটি তিনি উৎসর্গ করেন মহাশ্বেতা দেবীকে। এই একই কথা কবিতা সিংহের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। সময়ের অনেক আগেই হয়তো পৃথিবীতে এসেছিলেন কবিতা। তাঁর চিমত্মা-ভাবনা, সাহিত্য রচনা – সবকিছুই সমসময়ের থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিল। এক অদ্ভুত আত্মপ্রত্যয় ছিল তাঁর স্বরে। সমাজের একপার্শ্বিকতাকে ভাঙতে চেয়েছিলেন তিনি। কল্পনা করেছিলেন এক নতুন ভবিষ্যতের। শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে ব্যক্তিসত্তার জাগরণ তিনি আকাঙক্ষা করেছিলেন। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি জুড়ে চলতে থাকে মানুষের আত্ম-আবিষ্কারের পালা। বোধের জগতে, চেতনার জগতে তৈরি হয় এক টানাপড়েন; যেখানে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে নতুন করে, নতুনভাবে।

বাংলা সাহিত্য-সমালোচনার জগতে খুব বেশি আলোচনা হয়নি কবিতা সিংহকে নিয়ে। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল স্বয়ং রচয়িতার। তিনি ‘মহিলা কবি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি সাহিত্যের অঙ্গনে। চেয়েছিলেন কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে। বাংলা কবিতা তাঁর হাত ধরেই প্রথম নারীবাদের ছোঁয়া পেয়েছিল। তাঁর সমসময়ে এবং পরবর্তীকালে মেয়েরা তাঁদের সাহিত্যরচনায় সমাজে মেয়েদের বঞ্চনা, অসহায়তার প্রসঙ্গকে সোচ্চারে, সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন তাঁর হাত ধরেই। এ-প্রসঙ্গে নবনীতা দেব সেনের একটি লেখার উলেস্নখ করা যেতে পারে :

কফি হাউসের দরজায় দীপশিখার মত উজ্জ্বল এবং সহজ সুন্দরী কবিতা সিংহকে সেই প্রথম দেখা মুহূর্ত থেকেই যে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেছিলুম সে চোখ কখনো বদলায়নি। অবাক হয়ে শুনেছিলুম, বিমল রায়চৌধুরীর স্ত্রীর নাম কবিতা সিংহ। সেই পঞ্চাশের দশকে এমনটি হত না। কিন্তু কবিতা সিংহ যে সকল দিক থেকেই একমেবাদ্বিতীয়ম্, বাংলা সাহিত্যে তাঁর কোনো তুলনা নেই। আজকের নারীবাদিনীদের চেয়ে অনেক ক্রোশ বেশি পথ হাঁটতে হয়েছিল তাঁকে। আর এগিয়ে ছিলেন যোজন-যোজন বেশি। জীবন তাঁর সরল ছিল না। না ঘরে, না কর্মক্ষেত্র। হবে কী করে, কবিতাদি যে রণরঙ্গিনী!

রণক্ষেত্রে দেখা হবে সম্মুখ সমরে তীব্র

ইস্পাতের অচিত্র-অঙ্গদে। অমনি তো শিখিনি

মাতা রমণীয় পশ্চাৎপসরণ।

এই অচিত্র-অঙ্গদ নারীর কবিতায় নগ্ন তরবারির মত নারীবাদ যখন ফুঁসে উঠেছে, বর্তমান পশ্চিমী দুনিয়ার আধুনিক নারীবাদ তখনও তেমন করে জেগে ওঠেনি।

(‘শমীবৃক্ষে রমণী হে একা?’, একামত্মর দশম বর্ষ, জানু ১৯৯৯)

কবিতা সিংহের জন্ম ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর, কলকাতায় ভবানীপুরে। ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই তিনি লিখতে শুরম্ন করেন। তাঁর থেকে মাত্র পনেরো বছরের বড়, তাঁর মা অন্নপূর্ণা সিংহকে কবিতা লিখতে দেখতেন তিনি। মাকে দেখেই তাঁর ছবি আঁকতে শেখা। কিন্তু মায়ের মতো পিয়ানো এবং অর্গান বাজাতে শেখেননি তিনি। বাবা শৈলেন্দ্র সিংহ সেতার বাজাতেন। তা-ও শেখা হয়ে ওঠেনি তাঁর। মায়ের উৎসাহে নাচ শেখেন কবিতা। ষোলো বছর বয়স পর্যমত্ম তিনি নাচ শিখেছিলেন। কবিতা সিংহ মনে করতেন, নাচ আর ছবি অাঁকাই তাঁর জীবনে দান করেছে ছন্দ আর বর্ণ। দিয়েছে শরীরের স্ফূর্তি, স্বাধীন বিকাশের আনন্দ। কবিতার জীবনের অনেকখানি, বোধহয় সবখানি জুড়েই ভাস্বর হয়ে ছিল তাঁর মায়ের ছবি, তাঁর জীবনে সবথেকে বেশি প্রভাব ছিল মায়ের।

কবিতা সিংহের মামার বাড়ি আর বাবার বাড়ি – এই দুই বাড়ির দুটি পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। মামার বাড়িতে ছিল প্রবল তন্ত্র এবং গ্রাম্য বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মিশ্রণ। আর বাবার বাড়িতে ছিল অমত্মঃসারশূন্য উন্নাসিক মনোভাব। সেখানে খুব স্বাভাবিক ছিল অ্যালসেশিয়ান, গ্রেট ডেন, ডগ-শো, ড্রেসিং গাউন, মদ্যপান, টমাস মান। বাইরের জীবনযাত্রায় পশ্চিমি আদব-কায়দা। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তাঁরা ছিলেন অত্যমত্ম সংকীর্ণ। চোদ্দো বছরের পর কোনো মেয়েই কুমারী থাকেনি পরিবারে। কবিতা সিংহ ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর বিয়ের পথ আগলে ছিলেন তাঁর মা। সেজন্যে তাঁর পিতৃকুল মৃত্যুর পরেও ক্ষমা করেনি তাঁর মাকে। সিংহ পরিবারে ছেলেদের জন্যে ছিল সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল। আর মেয়েদের জন্যে অতি অনিচ্ছাসত্ত্বে বেলতলা গার্লস। এই বেলতলা গার্লস স্কুলেই পড়তেন কবিতা সিংহ। ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে অসমতার চিত্র দেখেই বড় হন তিনি। তাঁর সাহিত্যের একটা বড় জায়গা অধিকার করে থাকে এই অসাম্যের বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের বীজ হয়তো বপন হয়ে গিয়েছিল অনেক ছোট বয়সেই। আর এ-বিষয়ে কবিতার ওপরে বিশেষভাবে ছিল তাঁর মায়ের প্রভাব, বাবার ওপর প্রবল অভিমান ছিল তাঁর। বাবার বিপুল প্রতাপ, সংকীর্ণ মানসিকতাকে কবিতা কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি।

১৯৪৬ সালে পনেরো বছর বয়সে নেশন পত্রিকায় প্রথম কবিতা সিংহের কবিতা প্রকাশিত হয়। সেটি ‘সম্ভবত একটি ইংরেজি কবিতা।’ [কবিতা সিংহ, (সম্পাদকের প্রশ্নের উত্তর দেন কবিতা সিংহ), স্বনির্বাচিত। কাব্য জীবন : কবিতা সংকলন গ্রন্থ, ১৯৭০] ষোলো বছর বয়সে আনন্দবাজার পত্রিকায় কবিতা সিংহ লেখেন ‘আর্ট ও নারী’। বিজ্ঞাপনে নারীশরীরের ব্যবহার নিয়ে তিনি লিখেছিলেন এই লেখাটি। এর বেশ কয়েক বছর পরে তেইশ থেকে পঁচিশ বছর বয়স পর্যমত্ম এক বিখ্যাত ইংরেজি চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক সিনে অ্যাডভান্সের মেয়েদের পাতা সম্পাদনা করতেন তিনি। তখন তাঁর কাজ ছিল উঠতি চিত্রতারকাদের গস্ন্যামারাস ফটোগ্রাফসমেত প্রতি সপ্তাহে একটি করে চটকদার রচনা লেখা। তাঁর পাপপুণ্য পেরিয়ে (১৯৬৪) উপন্যাসে বাসনা বলে, ‘মেয়েদের পুরম্নষরা নিজেদের ব্যবসায়ে কিভাবে ব্যবহার করে এ নিয়ে ধোঁয়া উঠছে এমন প্রবন্ধ লিখেছিলাম ষোল বছর বয়সে। এখন আমি হচ্ছি মেয়েদের এক্সপস্নয়েট করার ষড়যন্ত্রের অন্যতম অংশীদার। আমি নিজের মাংস নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। নিজের মাংস।’ কবিতা সিংহের লেখক জীবন ও ব্যক্তিগত জীবন কোথাও যেন এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

বেলতলা গার্লস থেকে স্কুলশিক্ষা শেষ করে কবিতা সিংহ ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু বাড়ির অমতে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৯৫১-তে বিমল রায়চৌধুরীকে বিয়ে করায় পড়াশোনায় ছেদ ঘটে। স্বামী বিমল রায়চৌধুরী তখন পড়তেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। দুজনেই বিএসসি পড়তেন। বিয়ে করার ফলে পড়া বন্ধ হলেও বিয়ের সাত বছর বাদে স্বামীর উদ্যোগে আবার পড়াশোনা শুরম্ন করেন কবিতা। বিমলবাবু নিজেও আবার পড়া শুরম্ন করেন। দুজনই গ্র্যাজুয়েট হন। কবিতা সিংহ যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে বোটানিতে অনার্স নিয়ে বিএসসি পাশ করেন। অত্যমত্ম মেধাবী ছিলেন তিনি। ডিস্টিংশন পেয়ে তিনি গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। কবিতা সিংহের স্বামী বিমল রায়চৌধুরী (১৯৩০-৭৬) ছিলেন রংপুরের জমিদার মনীন্দ্র রায়চৌধুরীর ছেলে। তিনি কবিশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনামে গল্প লিখতেন। তিনি ছিলেন গল্পকার এবং সম্পাদক। কবিতা সিংহের সাহিত্যরচনার পেছনে ছিল স্বামীর বিশেষ উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা। তাঁদের বিয়েতে বাড়ির মত না থাকায় দুজনকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কঠিন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। কুড়ি থেকে ঊনত্রিশ বছর – এই সময়টা অত্যমত্ম কষ্টে কেটেছে কবিতা সিংহের। অভিজাত পরিবার, প্রাচুর্যের পরিবেশ ছেড়ে কবিতা চলে আসেন দারিদ্রে্যর জীবনে। এ-সময়ে জীবনের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করতে-করতে চলতে হয়েছে তাঁকে। অমৃতবাজার পত্রিকায় কলমচি হিসেবে কর্মজীবন শুরম্ন হয় তাঁর। অমিতাভ চৌধুরী (নিরপেক্ষ) কবিতা সিংহকে আলাপ করিয়ে দেন অমৃতবাজার পত্রিকার উইলিয়াম ওয়াকারের সঙ্গে। প্রায় চার বছর ওই পত্রিকার পাতায় ‘কবিতা’ ছদ্মনামে ‘অ্যাজ আই সি ইট’ নামে একটি কলাম লিখতেন কবিতা সিংহ এবং অন্যান্য রিপোর্টিংও করতেন, বিচিত্র কর্মমুখর জীবন ছিল কবিতার। তিনি টিউশনি করেছেন, কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা, বিজ্ঞাপনের কপি লেখার কাজও করতে হয়েছে তাঁকে। সকাল থেকে রাত পর্যমত্ম টিউশনি, চাকরি, রাতের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া – এই ছিল কবিতা সিংহের কুড়ি থেকে তিরিশ বছর বয়সের দৈনন্দিন অভ্যাস। টিকে থাকার জন্য জীবনের যুদ্ধে অনবরত

লড়তে-লড়তে এগিয়েছেন তিনি। সমত্মান গর্ভে নিয়ে তাঁকে নাচের স্কুলে মাস্টারি করতে হয়েছে। বিজ্ঞাপনের কপি লিখতে হয়েছে। খবরের কাগজের জন্য ফ্রিল্যান্স রিপোর্টিং, সিনেমার শুটিং কভারেজ, চিত্রতারকার সাক্ষাৎকার নেওয়া, সরকারি অফিসে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের চাকরি, মফস্সলের স্কুলে মাস্টারি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অফিসের

সাব-এডিটারি – বিভিন্ন ধরনের পেশার মধ্যে দিয়ে কেটেছে কবিতা সিংহের এই সময়টা। সাংবাদিকতার জন্য তাঁকে যেতে হয়েছে গ্রামে, বসিত্মতে, যুদ্ধবিধ্বসত্ম বাংলাদেশে, গঙ্গাসাগরে, জাম্বো দ্বীপে, আবার বিলাস-ব্যসনে মত্ত সমাজের ওপরতলায়। ষাটের দশকে আকাশবাণীতে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে যোগ দেন কবিতা। তাঁর জীবনের এই বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা উঠে আসে তাঁর লেখার ভেতরে। তবে এই জীবনসংগ্রামের সময়টা কবিতার কাছে ছিল তাঁর ‘জীবনের সেরা কাল’। কারণ এই সময়টা তাঁর কাছে নিজেকে যাচাই করার, অন্যকে যাচাই করার সময়। এই কালপর্বেই কবিতা সিংহ লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। এ-সময়েই গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরম্ন করেছেন তিনি। ১৯৬৫-তে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে বাংলা কথিকা বিভাগের সহকারী প্রযোজিকা হিসেবে তিনি যোগ দেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে নববইয়ের দশকের গোড়ার দিক পর্যমত্ম তিনি বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন আকাশবাণীর সঙ্গে। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের প্রথম মহিলা অধিকর্তা হন কবিতা। রেডিও সূত্রেই প্রথমবার বিদেশ যাত্রা করেন তিনি। বেতারে উচ্চতর কুশলতার জন্য ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ব জার্মানিতে গিয়েছিলেন। ১৯৮১-তে আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখক ওয়ার্কশপের আমত্মর্জাতিক সম্মেলনে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পশ্চিম জার্মানির ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ারে’ ভারত উৎসবের সময় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন কবিতা সিংহ। পরে বহুবার আমেরিকায় যান কবিতা। তাঁর ছোট মেয়ে পরমেশ্বরী আমেরিকার বস্টনে থাকেন। ছোট মেয়ের কাছে বস্টনেই ১৯৯৮-এর ১৭ অক্টোবর মৃত্যু হয় কবিতা সিংহের। তিনি ছিলেন তিন সমত্মানের জননী। দুই মেয়ে রাজেশ্বরী ও পরমেশ্বরী এবং ছেলে কনাদ রায়চৌধুরী।

পাঁচের দশকের একজন অত্যমত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ কবি কবিতা সিংহ। কবিতার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাসের অঙ্গনেও সমানভাবে পদচারণা করেছেন তিনি। তবে মূলত কবি হিসেবেই তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যের জগতে। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকে কবিতা লিখলেও বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও তাঁর কবিতা অত্যমত্ম প্রাসঙ্গিক। তাঁর কবিতার বিষয়বস্ত্ত, ভাষা, প্রকাশভঙ্গি একেবারেই স্বতন্ত্র। ছয়ের দশকে প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হলেও পাঁচের দশক থেকেই কবিতা লেখার সূচনা। বাংলার ছোট-বড় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অজস্র কবিতা লিখেছেন তিনি। তাঁর সব কবিতা কাব্যগ্রন্থের দুই মলাটের মধ্যে প্রকাশিত হয়নি। কবিতার বইয়ের সংখ্যা তিনটি। ১. সহজসুন্দরী (১৯৬৫), ২. কবিতা পরমেশ্বরী (১৯৭৬), ৩. হরিণা বৈরী (১৯৮৩)। তিনটি কাব্যগ্রন্থের প্রত্যেকটির মধ্যেই প্রায় এক দশকের ব্যবধান। ১৯৮৭-তে প্রকাশিত হয় কবিতা সিংহের শ্রেষ্ঠ কবিতা। তিনটি কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি তাঁর প্রিয়তম কবিতাগুলিকে চয়ন করেছেন শ্রেষ্ঠ কবিতায়। তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন তখনো প্রকাশিত না-হওয়া কাব্যগ্রন্থ বিমল হাওয়ার হাত ধরের কতকগুলি কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত শত কবিতা – রবীন্দ্রনাথের নামের কয়েকটি কবিতা।

কবিতা সিংহের কাব্যের কোনো ঈশ্বর নেই, আছেন ঈশ্বরী। তিনি একা, তিনি নিরীশ্বর। নারী এবং কবিতাকে একইসঙ্গে মিলিয়ে দেন কবিতা সিংহ। কাব্যের দেবী কবিকে দেখিয়ে দেন কবিতার অবয়ব। নারীর গর্ভধারণ এবং কবিতার জন্ম হওয়া কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় কবির কাছে। কবিতা যখন কবির কাছে আসে, তখন কবি যেমন অনেক কিছু পান, তেমনি জীবনের সাধারণ-স্বাভাবিক অনেক কিছু ছাড়তে হয় তাঁকে। তাঁকে পেতে হয় নির্বাসন। তেমনি মেয়েরা যখন প্রাবল্য ধারণ করে, উন্নতির শিখরে উঠে চলে, তখনই তাঁকে মনে করা হয় অশুভের প্রতীক। জ্ঞান-বুদ্ধির শক্তি থেকে বিযুক্ত করা হয় তাকে। আর তাই ‘ঈশ্বরী কাব্যের যিনি, সাকার তমসা তিনি/ তিনি ঘোর অমা!’

(‘আছেন ঈশ্বরী’, বিমল হাওয়ার হাত ধরে)

এভাবেই চিরকাল মেয়েরা বঞ্চিত হয়ে এসেছে। কিন্তু কবিতা সিংহের নারীসত্তা বিদ্রোহ করে ওঠে এর বিরম্নদ্ধে। তাঁর কাছে কবিরা মোজেসের মতো একা। আর সেইসব বুদ্ধিমতী নারী, যাঁরা নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে চান, নিজেদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সেই গভীর কথাকে বলতে পারেন সহজভাবে – তাঁরা আরও অনেক বেশি একা, নিঃসঙ্গ।

কবিতা সিংহের কবিতায় শোনা যায় সমাজের নানাধরনের পীড়নের বিরম্নদ্ধে স্বর। যেমন – দলিত সত্তার প্রতি অবিচারের প্রতিস্পর্ধী স্বর, যৌনতার রাজনীতি-অভিসন্ধির প্রত্যুত্তর, শ্রেণিবৈষম্যের বিরম্নদ্ধে স্বর। সমাজের নারী-পুরম্নষ বৈষম্যের বিরম্নদ্ধে স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি দেখান – দলিত সমাজের মেয়েদের কীভাবে পুরম্নষের থেকে দ্বিগুণ বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। শ্রেণি এবং লিঙ্গ – দুটি পরিচয়ই তাদের রক্তমজ্জায় সঞ্চারিত করে দেয় অশৌচ, জীবনের সহজ, স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তারা। তাদের চাওয়া-পাওয়া – সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা। তারা বোঝে – ‘নিজের আজন্ম পাপ জন্ম অস্পৃশ্যতা।’ (‘ভাঙ্গী রমণীর ক্রোধে’, বিমল হাওয়ার হাত ধরে) এসব অসহায় মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে উচ্চবর্ণের লোকেরা। প্রকাশ্যে তাদের ছোঁয় না; কিন্তু রাতের অন্ধকারে ব্রাহ্মণ পুরম্নষ স্পর্শ করে ‘ভাঙ্গী রমণী’র গোপনতম অঙ্গকে। ভাঙ্গী রমণীর ভিতরে প্রবিষ্ট হতে বাধে না তাদের।

কবিতা সিংহের লেখনী সোচ্চার হয়ে ওঠে কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে। এই নির্মম, পাশবিক ঘটনা হয়ে ওঠে তাঁর কবিতার বিষয়বস্ত্ত। কবির স্বরে এই অনাচার সম্বন্ধে তাচ্ছিল্য আর ব্যঙ্গ ছাড়া কিছুই থাকে না। তিনি লিখতে পারেন :

আমরা ভ্রূণ না ভ্রূণা

জন্ম দিও না মা!

মা আমার জেনে শুনে কখনো উদরে

ধরো না এ বৃথা মাংস

অযাচিত কখনো ধরো না।

(‘ভ্রূণা’, কাব্যনাটক)

কন্যাসমত্মানের এই ‘বৃথা জন্ম’কে মেনে নিতে পারেন না কবিতা। তাই চুপ করেও থাকতে পারেন না। একজন সংবেদনশীল কবির সামাজিক বঞ্চনার বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদের অস্ত্র তাঁর কবিতা-ই। কবিতা সিংহও তাঁর কবিতায় তা করেছেন।

পুরম্নষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা নিতামত্ম পণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। পুরম্নষ এখানে মেয়েদের দেখে কামনার দৃষ্টিতে, ভোগের বিষয় হিসেবে। মেয়েরা শুধুমাত্র কতকগুলো অঙ্গের সমষ্টি সেখানে। তাদের কামনা-বাসনা থাকতে নেই। অধিকার নেই নিজের ইচ্ছা জানানোর, নিজের চাহিদা প্রকাশ করার। চিরকালই মেয়েরা ‘সেক্স অবজেক্ট’। তবে একটি মেয়েরও অধিকার আছে নিজের মতো করে পুরম্নষকে উপভোগ করার, যৌনতাকে উদযাপন করার। কিন্তু সমাজ তাকে সেই স্বীকৃতি দেয় না। কবিতা সিংহের কলমে দেখা গেছে মেয়েদের যোগ্য স্বীকৃতির প্রত্যাশা, পাঁচের দশকে দাঁড়িয়ে যৌনতা নিয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারেন তিনি। কবিতা ছিলেন ‘কৃত্তিবাসে’র কবি। কৃত্তিবাসের কবিদের কবিতায় যৌনতা, যৌনতার অভ্যমত্মরস্থ রাজনীতি একটা বিশেষ স্থান করে ছিল।

পুরম্নষ সমাজে অনুশাসন তৈরি করেছে নিজের সুবিধার্থে। হয়ে উঠেছে আধিপত্যবাদী। আর এটাই প্রতিবাদের জায়গা হয়ে উঠেছে কবিতা সিংহের। তিনি বিশ্বাস করেন – পুরম্নষ-নারীর সম্পর্ক সমান দোসরের, সহযোদ্ধার মতো। অনেকে আতিশয্যবশে এ-কথা ভুলে যান। মনে করেন, পুরম্নষ-বিদ্বেষই নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ। কিন্তু তাদের সেই বেশি প্রতিবাদ কখনো-কখনো দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে। কবিতা সিংহের মধ্যে সে-দুর্বলতা নেই। তিনি তাঁর নারীসত্তাকে প্রকাশ করেননি – এমন ভাবা উচিত নয়। তাঁর সময়ে নারীর পরিসর ছিল সংকীর্ণ। তিনি সেই সংকীর্ণতার কথা বলেন বীরের মতো করে। সেখানে তাঁর মধ্যে কোনো বিনয় নেই। তিনিই প্রথম কবি, যাঁর কবিতায় শোনা যায় পুরম্নষতন্ত্রের বিরম্নদ্ধে এক সুদৃঢ় বিদ্রোহ। মেয়েজন্ম নিয়ে আদৌ কুণ্ঠিত নন তিনি। বরং তিনি উচ্চকণ্ঠে বলতে পারেন :

মা, হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিয়েছি শেষবারের মত

দু’চোখ ছাপিয়ে নামা চোখের জলের বৃথা দাগ

বেণীর মাটিন খুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেছি আমি

অশ্বক্ষুরে ঝন্ঝন্ নারীদের দর্পণ কাটায়ে

খরকরবালে একা পিতার রক্ষিতার মুন্ড এনে দিতে

 

তাই ঘৃণা, দুই চোখ কাজল জানেনি

নারীর শৃঙ্গার ছলা দর্পণের পায়ে পায়ে ক্লিন্ন অধীনতা

কার জন্য এত সাজ? বক্ষ বাঁধা? নীবি?

সমসত্ম পুরম্নষ সেই আদি পিতা, নিষ্ঠুর অশুচি

তোমার সত্মনের থেকে ছিন্ন করে ভুবন ঘোরাবে।…

(‘আজীবন পাথর-প্রতিমা’, কবিতা পরমেশ্বরী)

পুরম্নষশাসিত সমাজের নিষ্ঠরতাকে ‘অশুচি’ বলে চিহ্নিত করেছেন কবি। পাঁচের দশকের কোনো কবির মুখে এই প্রথম শোনা যায় এত সবল উচ্চারণ।

সমাজের একপার্শ্বিকতার বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদ, প্রত্যাখ্যান কবিতা সিংহের কবিতার একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তিনি কেবলমাত্র নারীসত্তার প্রতিষ্ঠার কথা বলেননি, বলেছেন পরিপূর্ণভাবে এক ব্যক্তিসত্তার প্রতিষ্ঠার কথা। তিনি বলেন :

না, আমি হবো না মোম

আমাকে জ্বালিয়ে ঘরে তুমি লিখবে না।

হবো না শিমূল শস্য সোনালী নরম

বালিশের কবোষ্ণ গরম।

কবিতা লেখার পরে বুকে শুয়ে ঘুমোতে দেব না।

আমার কবন্ধ দেহ ভোগ করে তুমি তৃপ্ত মুখ;

জানলে না কাটামু– ঘোরে এক বাসমত্মী-অসুখ

লোনা জল ঝাপসা করে চুপিসারে চোখের ঝিনুক!

(‘না’, সহজসুন্দরী)

মেয়েদেরকে মোমের মতো নরম, পেলবরূপে দেখা পুরম্নষতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। কবিতার প্রথমেই এই মিথকে ভেঙেছেন কবিতা সিংহ। পুরম্নষের নির্মিত আশ্রয়দাত্রী, রহস্যময়ী, পেলব নারীমূর্তিকে ভেঙে দিতে চেয়েছেন তিনি। বের করে আনতে চেয়েছেন প্রকৃত নারীসত্তাকে। তাঁর প্রতিবাদ দৃপ্ত, ক্রুদ্ধ। মেয়েরা সবসময় পুরম্নষের রচনার প্রেরণাদাত্রী হয়ে থাকতে চায় না। ব্যবহৃত হতে দিতে চায় না নিজেকে। তাই অনেক সময় পুরম্নষের সঙ্গে মিলনের মুহূর্তেও একা হয়ে যায় তারা। এভাবেই আমাদের সমাজে বহু মেয়ের প্রেমহীন যান্ত্রিক জীবন কেটে যায়।

কবিতা সিংহ তাঁর কবিতায় দেখান – নারীশরীরকে নানাভাবে কল্পনা করে পুরম্নষ। সেই শরীরে ডুবে তৃপ্ত হতে চায়। কিন্তু কখনো জানতে চায় না, সে-শরীরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা মন কী চায়? তাই তাঁর কবিতার প্রতিবাদী নারী বলতে পারে :

কি নেবে দেহের থেকে? মাংস মেদ বসা?

প্রাগৈতিহাসিক অগ্নি? পোড়া মাংসের ঘ্রাণ, রক্ত-পানীয়

নখ দাঁত চুল কিংবা অন্নপাত্র দিব্য করোটি?

অথবা কি নিষ্কাশন করে নেবে প্রতিভা ও মেশিনের মিশ্র কুশলতা?

অথবা জাদুর টুপি যেভাবে ওড়ায় লক্ষ কুন্দ পায়রা

সেভাবে দেহের থেকে চাড় দিয়ে ক্রমাগত খুলে নেবে শিশু।’

(‘দেহ’, কবিতা পরমেশ্বরী)

এ-খেলায় পুরম্নষ তার ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারে নারীকে। সমসত্ম দেওয়ার পরেও নারীটির মনে তবু সঙ্গোপনে রয়ে যায় ‘এক তিল ফিরোজা সন্দেহ’। লিঙ্গ-পরিচয়ে নারী হওয়ার কারণে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকে বঞ্চিত হয়ে যেতে হয় যুগ-যুগ ধরে। এই লিঙ্গবৈষম্য সম্পর্কে জেহাদ ঘোষণা করেন কবি। কবিতা সিংহের কবিতায় পুরম্নষতন্ত্রের বানিয়ে তোলা ঈশ্বরকে ইভ বলতে পারে :

আমিই প্রথম

বিদ্রোহিনী

তোমার ধরায়

আমিই প্রথম।

 

প্রিয় আমার

হে ক্রীতদাস

আমিই প্রথম

ব্রাত্যনারী

স্বর্গচ্যুত

নির্বাসিত

জেনেছিলাম

স্বর্গেতর

স্বর্গেতর

মানব জীবন

জেনেছিলাম

আমিই প্রথম।’

(‘ঈশ্বরকে ইভ’, কবিতা পরমেশ্বরী)

এরকম প্রত্যয়ের সঙ্গে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা গোটা বাংলা সাহিত্যে বিরল বলে মনে হয়। তাঁর কবিতায় নারী পুরম্নষকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলে :

যুদ্ধরীতি পাল্টানোর কোনো প্রয়োজন নেই

তাই করমর্দনের জন্য

হাত বাড়াবেন না।

আমার করতলে কোনো অলিভচিক্কণ কোমলতা নেই।’

(‘অপমানের জন্য ফিরে আসি’, বিমল হাওয়ার হাত ধরে)

মেয়েদের কোমলতা স্বাভাবিক, আবার তা অনেকটাই সমাজ আরোপিত। মেয়েদের শরীরের নরম, মোলায়েম যে রূপকে সমাজ চিহ্নিত করে দেয়, তাকে ভাঙতে চান কবি। এর পাশাপাশি কবিতা সিংহের উপন্যাসেও দেখতে পাওয়া যায় নারীর প্রতিবাদী ভূমিকা। উনিশ শতকের

নারী-বঞ্চনার ইতিহাসকে তিনি তুলে আনেন তাঁর মোমের তাজমহল (১৯৮৯) উপন্যাসে। সেখানে উনিশ শতকের এক পতিতা অনায়াসে তাঁর ‘বাঁধাবাবু’ অঘোরকৃষ্ণকে বলতে পারে – ‘আজ বুঝলাম আমি নয়, আপনি আমার যোগ্য হয়ে ওঠেননি রাজাবাবু।…’

রক্তাক্ত গম্বুজ (১৯৯৪) উপন্যাসে টিভি চ্যানেলের পদস্থ কর্মচারী দেবী মিত্র তাঁর বিদেশি বান্ধবীকে চিঠিতে লেখেন – ‘আমি পৃথিবীর এমন একটা জায়গা থেকে কথা বলছি, সেখানে তোমাদের ওই ফেমিনিস্ট আন্দোলনকেও একটা অদরকারী বিলাস মনে হবে। আগে তো মানুষের পর্যায়ে আসুক মেয়েরা, অবোলা পশুত্ব থেকে, আমি এমন একটা জায়গা থেকে কথা বলছি যেখানে মেয়েদের মুখের ভিতর সত্যিকার জিভ নেই, কনুয়ের পরে সত্যিকার হাত নেই, হাঁটুর পরে সত্যিকারের পা নেই। এমনকি মাথার খুলির মধ্যেও সত্যিকার মসিত্মষ্ক নেই। আগে সেগুলোর ব্যবস্থা হোক, তারপর অন্য অধিকারের ব্যবস্থা হবে।’

কবিতা সিংহের কবিতায় নারী আপস করে না সামাজিক প্রথার সঙ্গে। পুরম্নষ নারীর শরীরকে ভোগের সামগ্রী বলে ভেবে এসেছে

যুগ-যুগ ধরে। আবার তাকে নিয়ে কাব্য, সাহিত্য, শিল্প রচনা করেছে সেই পুরম্নষই। কিন্তু নারীশরীরের ভেতরে ঢুকে আসল মানুষটাকে কোনোদিন দেখেনি তারা। সেইসব পুরম্নষের কাছে এই নারী জানতে চায় :

তোমার শিরায় থাকে ক্লেদ রক্ত সহাবস্থানে

কাম ঘৃণা কাঁধে কাঁধ, ধাবমান থাকে ধমনীতে।

তুমি কি জানবে কোন রসায়নে নারীর শরীর

দুধ জল চিরে যায়, পরমহংসীর শুদ্ধতায়!

তুমি কি জানবে নারী কীভাবে নিষ্ফলা প্রেম

রাখে তার ধমনীতে

লুকায় প্রসব ব্যথা বসিত্মর মায়াবী হাড়ে, ক্রমবিস্ফারিত?

তুমি কি জানবে নারী কিভাবে ফেরায় অশ্রম্ন

অমত্মঃসলিলে?

 

তুমি কি জানবে নারী কিভাবে শরীরে তার

ঘোরায় সিন্দুর স্রোত, রক্তগুঁড়া – রজস্বলা দিন?

নিখুঁত বানায়ে ভাঙে, নিজের সৃজিত প্রাণ

নিজ অভ্যমত্মরে,

তুমি কি জানবে নারী আপনার অঙ্গে অঙ্গে

কত সম্মানিত!…

(‘ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা হলে’, কবিতা পরমেশ্বরী)

আবার কবিতার সাহসী কলম বলতে পারে-

কিন্তু পুরম্নষ দেখ – ‘অসতী’ নামক শব্দ পুংলিঙ্গহীন

এবং ‘বেশ্যা’ শব্দ, এবং ‘ছিনাল’! (তদেব)

নারী-পুরম্নষের অসম সম্পর্কে নারীর অবস্থানকে বারবার দেখিয়ে দিতে চান কবিতা।

কবিতার পাশাপাশি উপন্যাসেও কবিতা সিংহ তুলে ধরেছেন অসাম্যের প্রতিস্পর্ধী স্বর। পাঁচের দশকেই তাঁর উপন্যাস লেখার সূচনা। বই আকারে প্রথম উপন্যাস সোনারূপোর কাঠি প্রকাশিত হয় ষাটের দশকে (১৯৬২-তে)। যদিও এটি তাঁর লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম লেখা উপন্যাস ছমিরণ। ১৯৫৫-তে লেখা। এই উপন্যাসটির নাম খুব কম পাঠকই জানেন। এরপর বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন কবিতা সিংহ। সব কটি বই-আকারে প্রকাশিত হয়নি। যে-কটি পেয়েছে, সেগুলোও অত্যমত্ম দুর্লভ। বেশিরভাগই অতি অযত্নে রক্ষিত। তবে একথা বলাই বাহুল্য, বাংলা উপন্যাসের ধারায় অন্যতম গুরম্নত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী রচনাকার কবিতা সিংহ। তাঁর বক্তব্য ও প্রকাশভঙ্গি অননুকরণীয়।

সাধারণত কবিতা সিংহের লেখার উৎস ক্রোধ। তাঁর প্রতিবাদী সাহসী লেখনী কোনোরকম আপস ছাড়াই সচল থেকেছে স্বমহিমায়। নতুন-নতুন আঙ্গিকে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই তাঁর কোনো উপন্যাসে এক ধাঁচে লেখা নয়। বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আঙ্গিক আসে সেখানে। আর এই বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে এক উলেস্নখযোগ্য স্থান অধিকার করে থাকে বাসত্মব ঘটনা। তিনি বলেছেন – ‘লেখালেখিতে আমি সচেতনভাবেই বলুন বা অচেতনভাবেই বলুন বক্তব্যে বিশ্বাস করি। লেখার আনন্দে লেখা। আর্টস ফর আর্টস সেক্ ঠিক আছে। যিনি সেজন্যই লেখেন তাঁরও বলার কিছু থাকে। লেখালেখির ব্যাপারে আরও বিশ্বাস করি বাসত্মবের এক কেন্দ্রবিন্দুকে। হয়ত আমার লেখা যখন পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে সেই বিন্দুটিকে সেভাবে দেখা যায় না। কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাই। আমি তো জানি কি থেকে কি হয়ে উঠেছে…’ [কবিতা সিংহ, ‘কি লিখি কেন লিখি’ (প্র.), একামত্মর, ক্রোড়পত্র : কবিতা সিংহ, ১০ম বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা, ১৯৯৯]

কবিতা সিংহের উপন্যাসগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য – সোনা রূপোর কাঠি (১৯৬২), পাপ পুণ্য পেরিয়ে (১৯৬৪), মরমা (১৯৬৭), খুনের সংখ্যা এক (১৯৭০), চারজন রাগী যুবতী (১৯৭৩), পতনের বিরম্নদ্ধে (১৯৭৮), নায়িকা প্রতিনায়িকা (১৯৭৯), বাঁচার জন্য নির্বাচিত (১৯৮৩), পৌরম্নষ (১৯৮৪), মোমের তাজমহল (১৯৮৯), রক্তাক্ত গম্বুজ (১৯৯৪) ইত্যাদি।

কবিতার উপন্যাসে দেখা যায় পোড়-খাওয়া মানুষদের নতুন করে বেঁচে ওঠার কথা। সমাজে বঞ্চিত, অবহেলিত, হেরে-যাওয়া মানুষের মুখে অত্যমত্ম সবলভাবে প্রতিবাদের ভাষা জোগান তিনি। তাঁর উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে পুরম্নষশাসিত সমাজের একপার্শ্বিকতা। উপন্যাসের পাতায় বঞ্চিত মানুষেরা নিজেদেরকে স্বীকৃতি দিতে চায়। প্রতিবাদ করতে চায় সমসত্ম অন্যায়, সমসত্ম পতনের বিরম্নদ্ধে। নারীর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, ওঠা-পড়া, ভালোবাসা, যৌন-আকাঙ্ক্ষা, প্রতিশোধস্পৃহা, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সংযম – এই সবকিছুকে অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক কবিতা সিংহ। কখনো সম্পর্ক ভাঙার কথা বলেন না তিনি। শুধু দেখিয়ে দেন ভাঙনের শিকড়গুলোকে। কিন্তু তার ভেতরেও কোথাও যেন থেকে যায় জোড়া লাগার আকাঙ্ক্ষা সমসত্ম লাঞ্ছনাকে পেরিয়ে নতুনভাবে সূচনার কথা বলেন তিনি।

কবিতা, উপন্যাসের পাশাপাশি বাংলা ছোটগল্পের ধারাতেও অত্যমত্ম বলিষ্ঠ একজন রচয়িতা কবিতা সিংহ। অথচ তাঁর গল্পের পাঠকসংখ্যা উলেস্নখযোগ্যভাবে কম। তাঁর গল্প বিষয়ে আলোচনাও খুব বেশি নেই। নেই তাঁকে জানার প্রয়াস। তা নিয়ে আক্ষেপ ছিল কবিতা সিংহেরও। তিনি লিখেছেন – ‘…বাংলা সাহিত্যে কজনই বা আমাকে জানেন? কজনই বা আমার একটি দুটির বেশি লেখা পড়েছেন? এতসব জেনেও আমি লিখি। নিজের দুর্ভাগ্যকে একেবারেই দোষ দিই না। নিজের বিফলতাকেই দায়ী করি। এবং জীবনানন্দ দাশের উলেস্নখিত নিজেরই মুদ্রাদোষে – লিখি, লিখি এবং লিখি।’ [কবিতা সিংহ, ‘কি লিখি কেন লিখি’ (প্র.), একামত্মর, ক্রোড়পত্র : কবিতা সিংহ, দশম বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা, ১৯৯৯]

কবিতা সিংহের গল্পগ্রন্থের সংখ্যা দুই। তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। এরপর ১৯৮৮-তে বেরোয় আরও একটি সংকলন ‘একদিন আশালতা’। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবিতা সিংহের পঞ্চাশটি গল্প (জানুয়ারি, ২০১৩)। কবিতা সিংহের ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ (জানুয়ারি ২০১৩)। তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৪)-এর ভূমিকায় সমরেশ বসু লিখেছেন – ‘ক্রোধ যে কেবলমাত্র একটা ভঙ্গিমাত্র না, ক্রুদ্ধ যুবতীদের কথা লিখতে গেলে যে কেবল বিকৃত অভিব্যক্তি প্রকাশের দ্বারা ফুঁসে ওঠা বোঝায় না, মাত্রাহীন অশ্রাব্য এবং ভুলে ভরা শব্দ ও বাক্য বিন্যাসের অযথা জটিলতার প্রশ্রয় দেওয়া না, বাংলা গল্পের নতুন চরিত্রদের আমাদের সামনে উপস্থিত করতে গিয়ে, তিনি, অনায়াসেই পাঠকদের তা বুঝিয়ে দেন। স্বাভাবিক। কারণ, ক্রোধের গভীরে যে অপমান, লাঞ্ছনা, বেদনা অমত্মর্নিহিত রয়েছে, সেই মর্মামিত্মক সত্য সন্ধানই তাঁকে কথাশিল্পী করে তুলেছে।’

[সমরেশ বসু, ‘একজন পাঠকের কথা’, কবিতা সিংহের শ্রেষ্ঠ গল্প, ১৯৮৪, প্রমা প্রকাশনী]

কবিতা সিংহ তাঁর গল্পের ভেতরে খুঁজতে চেয়েছেন  জাতি-শ্রেণি-লিঙ্গভেদে অসাম্যের নানা মাত্রা। সমাজের লিঙ্গগত নিপীড়ন যে কত চরম আকার নিতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি। তবে একটা কথা অনায়াসেই বলা যায় যে – ‘তিনিই সেই মহিলা লেখিকা, যিনি চিমত্মায় ভাবনায় অনুভূতিতে, নিজেকে কখনও মহিলা পুরম্নষের ভাগাভাগিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর শিল্পীসত্তা তাঁকে সেই সীমা থেকে মুক্ত রেখেছে।’ (তদেব) এর পাশাপাশি তাঁর গল্পে কখনো উঠে আসে আমাদের মূল্যবোধ ভেঙে যাওয়ার কাহিনি, কখনো উঠে আসে সমত্মানের মনে দেহজীবী মায়ের স্মৃতি, আবার কখনো বা দাম্পত্যের সংকট। আসলে ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তাঁর গল্পগুলোকে নিয়ে চলে আসে একেবারে মাটির কাছাকাছি। আর তার মধ্যে দিয়েই গল্পের ভেতর ঘোরাফেরা করে আমাদের চেনা মানুষেরা। দেখা যায় বিচিত্র চরিত্রের আনাগোনা। গল্পের বিন্যাস, বিষয়-নির্বাচন, চরিত্র চিত্রণ, বর্ণনাভঙ্গি – সবকিছুতেই একধরনের স্বকীয়তা ছিল কবিতা সিংহের। সমাজের হেরে-যাওয়া মানুষেরা মাখা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তাঁর গল্পে। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারে তারা। তাঁর গল্পের দৃপ্ত ভাষা বক্তব্য বিষয়কে আরও সজীবভাবে তুলে ধরতে সাহায্য করে। তবে বাংলা সাহিত্য-সমালোচনার জগতে কিছুটা ব্রাত্যই রয়ে গেছেন কবিতা সিংহ। তাঁর নিজের ভাষায় – ‘নিজের কথা বলতে গিয়ে বৈষ্ণবী বিনয় করা আমার স্বভাববিরম্নদ্ধ। অমনোযোগী, পলস্নবগ্রাহী এবং শ্রদ্ধাহীন পাঠককে আমি তৃণ জ্ঞান করি। কারণ বাংলাদেশ আমাকে স্বীকার করে নেবার আগে… একবারে আমার আবেদন মঞ্জুর করেনি। বারবার অন্যায়ভাবে বাজিয়ে নিয়েছে।… অনেকেরই ধারণা কবিতা সিংহ, ছদ্মনামে কোনো পুরম্নষ, কুদর্শন বা স্বামীপরিত্যক্তা কিংবা বিধবা, কারণ তাদের চেতন বা অবচেতন মনে কাজ করে যাচ্ছে যে, এইসব গুণাবলীসম্পন্ন অসাধারণ মহিলারাই মাত্র সাহিত্যকে অবলম্বন করে থাকেন। কেউ কেউ বলেন আমার স্বামী বিমল রায়চৌধুরী নাকি আমার সব লেখা লিখে দেন।’ (যে রচনা থেকে এই অংশ উদ্ধৃত তা প্রকাশিত হয় – প্রথম বেলা অবেলায়। পরে পুনর্মুদ্রিত হয় সিংহাসন-এ)

[কবিতা সিংহ, ‘বিলু ও ছটি মরচেপড়া আলপিন’ (প্র.), দেশ পত্রিকা, সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৮৩]

জীবনের শেষ দিন পর্যমত্ম এ-ধরনের আফসোস থেকে গিয়েছিল কবিতা সিংহের মনে। সত্যিই এ- আক্ষেপ বেদনাদায়ক। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় নতুন করে ফিরে দেখার প্রয়োজন আছে বিশ শতকের অত্যমত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ সাহিত্যিক কবিতা সিংহের দিকে।

ব্যক্তিগত জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ওঠা-পড়ার মধ্যে দিয়ে পথ হেঁটেছেন কবিতা। কিন্তু কোনোদিন হার মানেননি জীবনের কাছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররাও পরাজয় স্বীকার করে না কখনো। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর আবার সামনের দিকে এগোনোর কথা ভাবে তারা। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্ত্তত থাকে জীবনের নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে। এক অদ্ভুত জীবনীশক্তি ছিল কবিতা সিংহের ভেতরে। এ-প্রসঙ্গে স্মর্তব্য হয়ে ওঠে স্বয়ং কবিতা সিংহের বলা কথা :

আমার জীবনে দুটি সঞ্জীবনী কাহিনী আছে। তা আজও সব অভিজ্ঞতা ভেদ করে উঠে দাঁড়ায়। একটি সাহিত্যের। একটি জীবনের। ‘জাগরী’ উপন্যাসে ফাঁসীর আসামী বিলু শুধু একটি ছোট্ট চারার পাতা আর টসটসে শরীর দেখে বেঁচে থাকার প্রেরণা পেত। একথা ভুলতে পারি না। আর জীবনের সেই কাহিনীটি। ফরাসী বিপস্নবের পর ব্যারন তাঁর স্ত্রীকে ছটি মরচেপড়া আলপিন এক হীরের মালায় বাঁধিয়ে উপহার দিয়েছিলেন। স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলে তিনি এক চমকপ্রদ কাহিনী বলেন। তাকে বন্দী করে এক অন্ধকার সেল-এ নিক্ষিপ্ত করে বিপস্নবীরা। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি দেখেন অন্য বন্দীরা আত্মহত্যা করছেন কিংবা পাগল হয়ে যাচ্ছেন। ঐ ভয়ঙ্কর নিয়তির হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি তাঁর পকেট থেকে ছটি আলপিন বের করে ছুঁড়ে দেন অন্ধকারে। বছরের পর বছর ধরে অন্ধকারে শুধু তাদের ছুঁড়ে দেওয়া আর কুড়িয়ে আনার কাজে তিনি সময় কাটান। ওরাই তাঁকে বাঁচিয়ে দেয়। সুস্থ রাখে। আমার কাছে আমার লেখা ওই ছটি মরচেপড়া আলপিন। ওই ফাঁসীর সেলের পাশের চারাগাছ ওই সামান্য কটি উপকরণ আমাকে আত্ম-বিনাশ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। আর পাঠক সাধারণের কাছে? সাগরবাবু, যদি হাতে সোনার কলম না থাকে তাহলে হাজার বিজ্ঞাপন, ঢক্কা নিনাদ, আর প্রকাশক সম্পদকের আনুকূল্যেও কোনো দায়িত্বের স্বর্গে আমার ঠাঁই কেউ করে দিতে পারবেন না। আর সোনার কলম থাকলে সব ব্যতিরেকেই সব হবে।

[কবিতা সিংহ, ‘বিলু ও ছটি মরচেপড়া আলপিন’ (প্র.), দেশ সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৮৩]

সোনার কলম হাতে নিয়েই এসেছিলেন কবিতা সিংহ। জীবনের কোনো প্রতিকূলতার কাছেই তিনি মাথা নত করেননি। তাঁর আপসহীন লেখনী থেমে থাকেনি কখনো। কিন্তু তাঁকে নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে এ-পর্যমত্ম। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন তাঁকে, খুঁজে দেখা প্রয়োজন তাঁর সাহিত্য-ভুবনকে। তাঁর মতো প্রতিবাদী, প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর বাংলা সাহিত্যে অত্যমত্ম দুর্লভ। তাঁর লেখা একুশ শতকের মানুষকেও আরো একবার দাঁড় করিয়ে দিতে পারে এক আয়নার সামনে। আর সেখানে সে দেখতে পাবে চেনা মুখকে, অচেনা মুখোশকে। হয়তো বা সে-সুযোগে খুলে যাবে এক আত্মবিশেস্নষণের পথ।