ফেরদৌসীর শাহনামা ও মনিরউদ্দীন ইউসুফ ছয় খন্ডে এক মনন-উজ্জ্বল কর্ম

ফেরদৌসীর শাহনামা ও মনিরউদ্দীন ইউসুফ

ছয় খন্ডে এক মনন-উজ্জ্বল কর্ম

আমিনুর রহমান সুলতান

 

 

ফেরদৌসীর শাহানামা

অনুবাদ : মনিরউদ্দীন ইউসুফ

বাংলা একাডেমী

ঢাকা, ২০১২

ছয় খন্ড ২৭০০ টাকা

মনিরউদ্দীন ইউসুফ সাহিত্যের বেশকটি শাখায় যেমন – কবিতায়, নাটকে, প্রবন্ধে ও উপন্যাসে বাঙালির জীবন, সমাজ, সংস্কৃতির জিজ্ঞাসা এবং সম্পর্কসূত্র খুঁজে নিয়ে নিজস্ব একটা শিল্পবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অনুবাদকর্মের সাফল্যে নিজেকে তিনি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন বিশ্বসাহিত্যের মহাকাব্যের ধারায়।

তিনি অনুবাদ করেছেন ইরানি কবি ফেরদৌসীর শাহনামা। যদিও অনুবাদের তাগিদটা এসেছিল বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে। তারপরও নিজের ভেতরে তাড়না না থাকলে তা সম্ভব হতো না। অনুবাদকাজে যুক্ত হওয়া সম্পর্কে তিনি তাঁর আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা গ্রন্থে যে-বর্ণনা দিয়েছেন তা উল্লেখ করা হলো :

বাংলা একাডেমীর তখনকার ডাইরেক্টর সৈয়দ আলী আহসানের অনুরোধ নিয়ে ১৯৬৩-এর কোনও একদিন আবু জাফর শামসুদ্দীন সাহেব ও কবি ফররুখ আহমদ আমাকে বাসায় গিয়ে ধরলেন যে, ফেরদৌসীর মহাকাব্যটি আমাকে তরজমা করতে হবে। ‘শাহনামা’ আমার ঘরেই ছিল। ওটি বের করে এনে কবি ফররুখ আহমদ ও শামসুদ্দীন সাহেবকে দেখিয়ে বললাম, এই দেখুন এর কলেবর। ফেরদৌসী ত্রিশ বছরে এটি শেষ করেছেন। আমার কম করেও তো বারো বছর লাগবে। অন্য কাউকে দিয়ে করান, আমাকে মাফ করুন। কবি ফররুখ আহমদ বললেন, ‘না। ফারসি জানা অধ্যাপকরা আছেন কিন্তু তারা তো কবি নন, তরজমা আশানুরূপ হবে না।’ আবু জাফর শামসুদ্দীন বললেন, ‘দেখুন, চিত্রকল্পগুলো তো অন্তত তরজমায় আসতে হবে। আপনিই দায়িত্ব নিন।’ ওদের কথায় একদিন একাডেমীতে সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের কামরায় বসে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিয়ে এলাম’। (পৃ ১৭৫-৭৬)

যে-শাহনামা লিখতে ফেরদৌসীর সময় লেগেছিল ৩০ বছর, সে-শাহনামা অনুবাদ করতে মনিরউদ্দীন ইউসুফের সময় লেগে যায় ১৭ বছর। ছয়টি খন্ডে  তিনি সম্পূর্ণ শাহনামা অনুবাদ করেন। তবে তাঁর জীবিতকালে সবকটি খন্ড প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৭ ও ১৯৭৯ সালে দুটি খন্ড প্রকাশিত হয়েছিল। শাহনামা রচনার সহস্র বার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে ছয়টি খন্ড প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ইউনেস্কো ও ঢাকার ইরানি দূতাবাসের সহযোগিতায় ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বাংলাদেশে ‘শাহনামা উৎসব’ পালন করেছিল। ইউনেস্কো আন্তর্জাতিকভাবেই উৎসব পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।

শাহনামার ছয়টি খন্ড বাংলা একাডেমী পুনর্মুদ্রণ করেছে, যার প্রকাশকাল জুন, ২০১২।

পুনর্মুদ্রণে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান শাহনামার প্রকাশনা সম্পর্কে ভূমিকায় যথার্থই বলেছেন :

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে শাহনামার একটি পান্ডিত্যপূর্ণ সংকলন প্রকাশিত হয় ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে। এটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন টি. ম্যাকান। সতেরোটি পান্ডুলিপির তুলনামূলক যৌগিক সম্পাদনার মাধ্যমে এটি প্রস্ত্তত করা হয়। ফ্রান্স, রাশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে শাহনামার বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন প্রকাশিত হলেও ভারতবর্ষের অন্য কোনো অঞ্চলে এর পূর্ণাঙ্গ, সুসম্পাদিত সংকলনের খবর আমরা পাইনি। তবে মুঘল সম্রাটরা এ বইটি গুরুত্বের সঙ্গে পড়তেন, তার প্রমাণ আছে বাবর, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান প্রমুখের  শাহনামার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর শাহনামা থেকে কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করেছিলেন। বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁও শাহনামা পাঠ করে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন এমন সংবাদ জানা যায়। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে শাহনামা বিষয়ে কোনো কোনো বই প্রকাশিত হলেও এই মহাগ্রন্থের কোনো সম্পূর্ণ সংকলন ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়নি। সেদিক থেকে বাংলা একাডেমী এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। এই বইয়ের পূর্ণাঙ্গ সংকলন বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করায় একাডেমীর সাবেক পরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।…

আমরা এই মহাগ্রন্থের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয়ের ধারাবাহিকতাকে অব্যাহত রাখার লক্ষ্যেই এই বিশাল গ্রন্থের বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ পুনর্মুদ্রণ সম্পন্ন করেছি। নতুন মুদ্রণ পদ্ধতিতে অতিযত্নে কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে। আশা করি, সাহিত্যমোদী পাঠক এই গ্রন্থটি পাঠ করে ঐতিহ্যপ্রীতি, ইতিহাস ও বিশ্ববোধ এবং মানবিক চেতনায় উদ্দীপ্ত হবেন।

ফেরদৌসীর শাহনামা অনুবাদ করার পাশাপাশি শাহনামা সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণও করেছেন মনিরউদ্দীন ইউসুফ। মূল্যায়নটি ভূমিকা হিসেবে প্রথম খন্ডেই প্রকাশিত।

শাহনামা যেহেতু সতেরো বছর ধরে অনুবাদ করেছেন, সেহেতু শাহনামার বিষয়-আশয়, পরিবেশ-প্রতিবেশ, সময়, ঐতিহাসিক চরিত্র-ঘটনা – এসব মনিরউদ্দীন ইউসুফের পাঠ-অভিজ্ঞতায় নিখুঁতভাবে সঞ্চিত। তাই শাহনামা সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নের ভূমিকা-অংশটিও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে শাহনামা সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নও গুরুত্ববহ।

শাহনামা রচনাকালে ইরানের সংকটময় সময় চলছিল, যা শাহনামার পটভূমি প্রসঙ্গে ফেরদৌসী উল্লেখ করেছেন এবং অনুবাদকও তা ভূমিকার শুরুতেই তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, ফেরদৌসী শাহনামা লিখে যে ইরানকে পুনরুজ্জীবিত করার কঠিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এ-বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। লেখকের অনুবাদ-অংশটি এরকম :

দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে বহু পরিশ্রমের পর এই পারসী গ্রন্থ দ্বারা আমি ইরানকে পুনরুজ্জীবিত করে গেলাম।

ঘটেও ছিল তাই। ‘ইরানীয় জাতীয়তার উজ্জীবনের কাব্য’ হয়ে ওঠে শাহনামা। শাহনামা রচনার পেছনে প্রেরণা হিসেবে উৎস-প্রসঙ্গটিও অনুবাদক স্পষ্ট করেছেন গ্রহণযোগ্য বিশ্লেষণে। অনুবাদকের ভূমিকাংশের উদ্ধৃতি :

শাহনামা রচনা যখন শেষ হয়, তখন কবির বয়স আশি বছর। ত্রিশ বছর ধরে তিনি ‘শাহনামা’ রচনার কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলে দেখা যায়।… ‘শাহনামা’ শেষ হয়েছিল ১০১০ সালে; ত্রিশ বছর আগে যদি তার রচনা শুরু হয়ে থাকে, তবে সেই সূচনা ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি কোন সময়ে হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। অথচ যে সুলতান মাহমুদ সিংহাসনারোহণ করেন ৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে, তাঁর আদেশে ৯৮০ সালে ‘শাহনামা’র রচনা শুরু হয়েছিল, এমন ভাবা যুক্তিযুক্ত বোধ হয় না।

জানা যায় যে, কবি যৌবনেই তাঁর জন্মভূমিতে ইরানের প্রাচীন রাজা-বাদশাহের এক কাহিনী লিখতে শুরু করেন গদ্যে এবং সম্ভবত তা সম্পূর্ণও করেন। তারপর কবি দাকীকীর অনুবর্তিতায় ফেরদৌসী তাঁর কাহিনীকে ছন্দোবদ্ধ করার অনুপ্রেরণা লাভ করেন। দাকীকীর ‘শাহনামা’ অধিকতর অগ্রসর হওয়ার পূর্বে যৌবনেই তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন। ফেরদৌসী যে ‘শাহনামা’ গদ্য রচনা করেছিলেন অথবা তার খসড়া তৈরি করেছিলেন তা সম্ভবত (‘আলেফলায়লা’র আরব্যোপন্যাস) ছাঁচে পরিকল্পিত হয়েছিল। সুতরাং দাকীকীর থেকে ‘আলো লাভ করে’ কবি স্বীয় জন্মভূমিতে বসেই বর্তমান  ‘শাহনামা’ রচনায় হাত দেন এ কথা নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়া যায়।

ভূমিকার আরেকটি অংশে অনুবাদক বিশ্বসাহিত্যের অন্যান্য মহাকাব্যের ধরনের সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছেন যে, স্থান নয়, কালই নিয়ন্ত্রণ করেছে শাহনামাকে। অনুবাদকের মূল্যায়ন এক্ষেত্রে তুলে ধরছি :

‘ইলিয়ড’-‘ওডিসি’ ও ‘রামায়ণ’-‘মহাভারত’-এর নিয়ামক শক্তি কাল নয় – স্থান; সেখানে গ্রীস ও ট্রয়, অযোধ্যা ও লঙ্কা, হস্তিনাপুর ও কুরুক্ষেত্রকে কেন্দ্র করেই ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। একের পতনে অন্যের মহিমা সেখানে ভাস্বর। অন্যপক্ষে শাহনামাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে মহাকাল। যে-কালের বহমান স্রোতে ঘটনা ও স্থান মুহূর্তের জন্যে উদ্ভাসিত হয়ে বিলীন হয়ে যায়, – সেখানে রাজা ও রাজবংশের উত্থান-পতনে, বীরের শৌর্যে ও সম্রাটদের মহানুভবতায় এক মূল্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে, এবং শেষ পর্যন্ত তা মানুষের হাতে আসছে উত্তরাধিকারসূত্রে ইতিহাসেরই শিক্ষা হয়ে।

অবশ্য শাহনামা প্রধানত ইরানের কিংবদন্তি, পৌরাণিক, বীরত্বব্যঞ্জক এবং ঐতিহাসিক যুগসমূহের কীর্তিগাথাকে সমন্বিত করে রচনা করা হলেও শাহনামা যে ইতিহাস নয়, কাব্যই, এ-বিষয়টিকেও অনুবাদক ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে প্রতিভাত করেছেন। শামসুজ্জামান খান এ-প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন :

ফেরসৌসী ইতিহাসনিষ্ঠ কাব্যনির্মাতা। পাঠকেরা তাঁর বইয়ে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা উদ্দেশ্যহীনভাবে পড়ে যাবেন এমনটি তিনি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পাঠকেরা তাঁর বইয়ের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ জটিল ও বহুমুখী ধারাপ্রবাহ সতর্কতার সঙ্গে অনুধাবন করবেন এবং রাজা-রাজবংশ-ব্যক্তি বা কোনো রাষ্ট্রের কেন পতন ঘটে তা-ও তাঁর এই মহৎ গ্রন্থ থেকে বুঝে নেবেন। এবং এর মধ্য দিয়ে বিশ্বসভ্যতার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে একটি নতুন পৃথিবী নির্মাণে প্রয়াসী হবেন। তিনি যে জায়গাটায় জোর দিয়েছিলেন তা হলো, পৃথিবী চলমান এবং এই পৃথিবীতে মানুষ ইতিহাসের পথে যুগ-যুগান্তরের পথপরিক্রমায় আসে আর যায়। সেজন্যই তাদের বিজ্ঞতার সঙ্গে নিষ্ঠুরতা, মিথ্যাচার এবং সমস্ত অশুভ কল্পনা বর্জন করে সুবিচার, সত্য, ন্যায়, শৃঙ্খলা এবং অন্যান্য গুণ অর্জন বিশ্বসভ্যতায় তার ছাপ রেখে যাবে।

অনুবাদক শাহনামার ঐতিহাসিক পটভূমি বিবেচনার পর ফারসি ভাষার উৎপত্তি ও তার ধর্মীয় চিন্তার বিবর্তন সম্পর্কে দিকনির্দেশ করেছেন। কারণ, শাহনামা ফারসি ভাষায় রচিত। অনুবাদক ভাষা ও ধর্মচিন্তার বিষয়টিকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মন্তব্যটি উল্লেখ করা হলো :

ভাষার মধ্যে একটি জাতির পরিচয় যেমন সুপ্ত থাকে তেমনই তার ধর্মচিন্তার মধ্যেও থাকে তার প্রাণরস ও সংস্কৃতি সঞ্জীবনী শক্তির পরিচয়। প্রাগ্রসর-মানুষ তার ভাষা ও ধর্মীয় চিন্তায় নতুন অনেক কিছু যোগ করে, কিন্তু ঐতিহ্যের খাত রেখেই যে তার চলা অব্যাহত থাকে, ‘শাহনামা’ কিংবা তেমন যে কোন জাতীয় কাব্য এ সত্যকে শক্তির সঙ্গে প্রকাশ করে থাকে।

ষাট হাজার শ্লোকের মহাকাব্য শাহনামার কাহিনি শুরু হয় ইরানের প্রথম বাদশা কায়ুমরস দ্বারা। আর শেষ হয় অনাগত ভবিষ্যতের মুখের দিকে চেয়ে। ইয়াজদেগুর্দ অত্যন্ত নৃশংসভাবে মাহুয় নামক তুরানের হাতে নিহত হলে সেই নৃশংসতার প্রত্যুত্তরে বীর সেনাপতি বেঝনের হাতে মাহুয়ও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আত্মহত্যায় প্রাণত্যাগ করে।

শাহনামা একটি নির্দিষ্ট ভূগোলের ভৌগোলিক প্রতিবেশের মানুষের বহুবিচিত্র কাহিনি নিয়ে সৃষ্টি। মহাকাব্য হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ করে ইরানের কিংবদন্তি থেকে, পুরাণ থেকে ইতিহাস গ্রহণ করে। যে-ইতিহাস তার শৌর্য-বীর্য থেকে সৌন্দর্যপিয়াসী মানব-হিতৈষণার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে ইরানের জাতিসত্তার বিপুল জাগরণে সাহায্য করেছিল।

শাহনামা অনুবাদের জন্য গদ্য মাধ্যমই বিবেচিত ছিল। তবে অনুবাদের ক্ষেত্রে মনিরউদ্দীন ইউসুফ কিছুটা স্বাধীনতা গ্রহণ করেছেন। গদ্যে লিখলেও তা টানা গদ্যে রাখেননি। কবিতার আদলে অসম চরণ বিন্যাসে সাজিয়েছেন। এক্ষেত্রে অনুবাদকের ‘গ্রন্থের ভিত্তি স্থাপন প্রসঙ্গে’র শেষ অংশটুকু নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা হলো :

এক পাহ্লবী গাথা তুমি রচনা কর আমার জন্যে,

আমি তোমার সামনে এনে উপস্থিত করছি আগের দিনের

সকল গীতিকা।

তুমি মুক্ত-রসনা ও নব-যৌবনশালী,

বীররসমূলক কাব্য-বাণী কর উৎসারিত।

বাদশাহের প্রাচীন কীর্তি আবার তুমি নতুন করে কর

উজ্জীবিত,

এবং তদ্দ্বারা সম্মানিতগণের কাছ থেকে লাভ কর সম্মান ও

মর্যাদা।

এইভাবে সেই গাথা যখন আমার সামনে এলো,

তখন সহসা উদ্দীপ্ত হলো আমার প্রাণের অন্ধকার গুহা।

অসম চরণে সাজিয়ে বঙ্গানুবাদ করার মুনশিয়ানাকে অনেকে স্বাগত জানিয়েছেন। বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত শাহনামার প্রসঙ্গকথায় একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক মাহমুদ শাহ্ কোরেশীর মূল্যায়ন এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক –

মনিরউদ্দীন ইউসুফ বাংলায় ‘শাহনামা’র অনুবাদ করেছেন গদ্যে, তাঁকে তাই করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ গদ্য এ নয়। এতে মুক্ত কবিতার বা ফ্রি ভার্সের প্রবাহ ও ছন্দ বয়ে চলেছে। তাই তিনি তাঁর অনুবাদকে টানা গদ্যের মতো না সাজিয়ে সাজিয়েছেন অসম চরণে। মূল ‘শাহনামা’র মতোই সাবলীল এই অনুবাদ। কাব্য নয়, কিন্তু কাব্যের ফল্গুধারা যেন বয়ে চলেছে। মনিরউদ্দীন ইউসুফ ছিলেন অন্তরে চির-কবি, সেই সঙ্গে দক্ষ গদ্য-শিল্পী।

শাহনামার অনুবাদ সম্পর্কে মনিরউদ্দীন ইউসুফের মন্তব্যও উল্লেখযোগ্য :

কাব্যের ভাষান্তর সহজ নয়। কারণ কবির ভাব ও বর্ণনা প্রধানত শব্দকে আশ্রয় করে থাকে। এ কথা গীতি-কাব্যের বেলায় যেমন সত্য, বর্ণনামূলক মহাকাব্যের বেলায়ও তেমনিই। ‘শাহনামা’ এক বিশ্ব-বিশ্রুত মহাকাব্য, তার শব্দ ও ছন্দ-মাধুর্য অনুপম। আমার ধারণা, এসব ক্ষেত্রে অনুবাদকের উচিত, নিজের মধ্যে মূল কাব্যের ভাব-বস্ত্তর পুনঃনির্মাণ দ্বারা যে ভাষায় অনুবাদ তা করতে হবে তার গোটা শব্দ সম্পদকে কাজে লাগাবার প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা। অনুবাদ গদ্যে হোক কিংবা পদ্যে, এ ছাড়া গত্যন্তর নেই।

বর্তমান অনুবাদে আমি প্রতিটি শ্লোক ধরে তেমনভাবে অগ্রসর হতে চেষ্টা করেছি।… অনুবাদে মূলের প্রতিটি শ্লোককে দু পঙ্ক্তিতে সাজিয়েছি; তবে কদাচিৎ অর্থের সংহতির জন্য একটি শ্লোককে চারটি পঙ্ক্তিতে কিংবা দু’টি শ্লোককে দু’টি পঙ্ক্তিতে বিন্যস্ত করেছি; কিন্তু এমন উদাহরণ খুব কম।

শাহনামার বিচিত্র কাহিনির চরিত্রগুলো সম্পর্কে অনুবাদকের  যে-মূল্যায়ন তা সমর্থনযোগ্য। তিনি বলেছেন :

ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের পতন – এই মূল্যবোধের সচেতন প্রয়োগ যে ‘শাহনামা’র কোন চরিত্রকেই মানবিক দিক থেকে এতটুকু খাটো করেনি, কবির অসীম শক্তিমত্তা তারই নিদর্শন। গ্রীক মহাকাব্যের নিয়তি ও অলিম্পোয়ান দেবতাদের ইচ্ছার স্থান দখল করেছে ফেরদৌসীর মূল্যবোধ। এখানে বাইরের হস্তক্ষেপের কোন প্রয়োজন হয়নি, চরিত্রের দুর্বলতাই নায়ক নায়িকার অন্তরে তাদের সর্বনাশের বীজ উপ্ত করেছে, তাকে টেনে নিয়ে গেছে মহতী বিনষ্টির দিকে। শক্তিমান চরিত্রগুলোরও পতন তখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এখানে ফেরদৌসীকে সফোক্লিস ও সেক্সপীয়ারের সমগোত্রীয় প্রতিভা বলে মনে হয়। কোন চরিত্রের প্রতিই কোন পক্ষপাতিত্ব নেই – স্রষ্টার মমত্ববোধ ও সহানুভূতি নিয়েই তিনি তাদের অনুসরণ করেছেন।…

দু-একটি চরিত্রের বর্ণনা অনুবাদকর্মের ভেতর দিয়ে অনুবাদক যথার্থভাবে প্রতিভাত করেছেন। শাহনামার মহানায়ক রুস্তমের যুদ্ধক্ষেত্রে যে-বীরত্ব, তাকে মনিরউদ্দীন ইউসুফ যেভাবে তাঁর অনুবাদে তুলে এনেছেন, তাতে বর্ণনার পুরো শরীর কাব্যময় না হলেও যে-কাব্যস্পর্শী ভাষা প্রয়োগ করেছেন, সাধারণ বাঙালি পাঠকের অনুভূতিতে তা নাড়া দিয়ে ওঠে। তাছাড়া মনে হবে যেন কোনো বাঙালি মহাকবির কাব্যপাঠ করছি আমরা। যুদ্ধক্ষেত্রে রুস্তমের শক্তিমত্তার একটি উদাহরণ দেওয়া হলো :

রুস্তমের হাতে ধরা রয়েছে, গোমুখাঙ্কিত প্রহরণ,

তা দিয়ে তিনি অনুরঞ্জিত করে চলেছেন ধরণীবক্ষ।

যেদিকেই তিনি ধাবিত করছেন তাঁর অশ্ব

সেদিকে ঝরে পড়ছে প্রতিপক্ষের শির হেমন্তের শুকনো

পাতার মতো।

যখনই তিনি কোন বীরের মস্তকে তরবারির আঘাত

হানছেন,

তখনই পর্বতশীর্ষ-সমান উন্নতমস্তক অবনত হয়ে পড়ছে।

বীরগণের রক্তে মাটির ময়দানে

বয়ে যাচ্ছে শোণিতের ঢেউ।

(শাহনামা, প্রথম খন্ড, পৃ ৪১৫)

যুদ্ধক্ষেত্রে বাবা রুস্তমকে খুঁজে পাবার আকুতি ও যে-অনুসন্ধিৎসা সোহরাবের ছিল, তাকে প্রাণস্পর্শীরূপেই অনুবাদ করেছেন মনিরউদ্দীন ইউসুফ। তা যেন বাঙালির সকল সন্তানসহ বিশ্বের সকল সন্তানেরই প্রতিরূপ। রুস্তমের হাতে সোহরাব নিহত হওয়ার আগে কামনা করেছেন – ‘পিতার সঙ্গে যেন আমার যুদ্ধ না হয়ে যায়।’ যুদ্ধ হলে তার দুঃখ ও অনুতাপের আর পরিসীমা থাকবে না। আর এজন্যেই সোহরাব উচ্চারণ করেছেন –

তাহলে আবার প্রভুর সামনে আমি লজ্জিত হবো,

এবং কালো মুখ নিয়ে আমাকে বিচরণ করতে হবে

ধরণী-তলে।

রাজ-রাজড়াদের সামনে আমার মুখ কলঙ্কিত হবে,

ইরান ও তূরানের সৈন্যদের সামনে আমি হবো হতমান।

আমার দুর্নাম ছাড়া তখন আর কিছুই কীর্তিত হবে না,

ইহ-পরকালে কোথাও আমি সফলকাম হতে পারব না।

পরকালের সকল আশাও আমার মাটি হয়ে যাবে,

সুতরাং পিতার সঙ্গে যেন আমার যুদ্ধ না হয়।

রুস্তমের তরবারি দ্বারা বুকে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পরও পিতার কথা ভুলে যাননি। তার উচচারণ :

তাকে আমি খুঁজেছি, কিন্তু তার দেখা পেলাম না

আহা, সেই কামনা অন্তর নিয়েই বিদায় হচ্ছি।

হায়, আমার অন্বেষণের বেদনা তার পরিণাম দেখতে

পেলো না,

পিতার মুখ সন্দর্শন আর ঘটলো না আমার ভাগ্যে।

তুমি যদি নদীতে মৎস্য হয়ে কিংবা রাত্রির বুকে অন্ধকার

হয়েও লুকাও,

কিংবা প্রয়াণ করো সুদূর নক্ষত্রলোকে, কিংবা সূর্যমন্ডলে

অন্তর্ধান করো,

তবু আমার পিতা তোমার থেকে গ্রহণ করবেন আমার প্রতিশোধ যে-আমাকে তুমি প্রস্তর-সিথানে শায়িত

করেছ।

(শাহনামা, প্রথম খন্ড, পৃ ৬৬৪)

আবার রুস্তমের আত্মমর্যাদাবোধ বিষয়টিকেও অনুবাদক শিক্ষাসম্মতভাবে উঠিয়ে এনেছেন। এই আত্মমর্যাদাবোধের কারণেই মূল্যবোধের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় রুস্তমকে। রুস্তম যদি সোহরাবের শৌর্যের সামনে আতঙ্কিত হয়ে অহঙ্কার না জাগিয়ে আত্মপরিচয় দান করতেন, তাহলে রুস্তম পুত্রের হন্তারক হতেন না। এই যে নিয়তির খেলা, এ-খেলা চিরায়ত বাঙালির নিয়তি যেন আর এজন্য রুস্তমকেও মাশুল দিতে হয়। রুস্তমও তার বৈমাত্রেয় ভাই বাখশতোর চক্রান্তের শিকার হয়ে নিহত হন। শাহনামার যে-ইতিহাস তা পৃথিবী সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে সপ্তম শতাব্দীতে পারস্যের মুসলিম বিজয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত। রাজা-বাদশাহদের যুদ্ধের কাহিনি, জীবনকাহিনি শাহনামায় যে-মহাকাব্যিক পরিসর এনে দিয়েছে তার মধ্যেও প্রকৃতিপ্রেম ও মানব-মানবীর প্রেমের চিরায়ত রূপটি মানবিক গুণাবলিসমৃদ্ধ হয়ে সহানুভূতিতে সমুজ্জ্বল। ভূমিকায় মনিরউদ্দীন ইউসুফ এ-সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেছেন তা মানবিক জয়গানকেও প্রতিভাত করে এবং এসব নারী শতবাধাকেও অতিক্রম করতে প্রয়াসী হন।

ইরানের রাজকন্যা ও অভিজাত কন্যাগণ প্রায়শই প্রেমময়ী হতেন; তারা পবিত্র অপাপবিদ্ধ।

আবার যেসব নারী কুটিল ও দুশ্চরিত্র তারা শাস্তি ভোগ করেন ইহলোকেই। শাহনামায় সাধারণ মানুষেরও উপস্থিতি রয়েছে, তারাও মানবীয় দোষ-গুণে গড়া।

ইরানের সঙ্গে হিন্দুস্থানের একটি সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করা গেছে। আর তাতে কখনো বিরূপ সম্পর্কের ইঙ্গিত আমরা পাই না। বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের দেশ বলে ইরানের কাছে হিন্দুস্থান গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ – এই মানবিক স্লোগানটির জন্ম আধুনিক সভ্যতার যুগে। অথচ ইরানের কিংবদন্তি ও ইতিহাস নির্ভর               রাজা-বাদশাদের নবম শতাব্দীতে ফেরদৌসী শাহনামার ভেতর দিয়ে সোহরাবের কণ্ঠে যুদ্ধ থেকে বিরত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলিয়েছেন। মানবিক আবেগ প্রকাশ ও সম্প্রীতির বন্ধনের আহবান শাহনামায় বিশ্ববাসীর  সামনে মাইলফলক হয়ে আছে। এতে শান্তির প্রেরণার উৎসও নিহিত রয়েছে।

রস্তমকে দেখেই সোহ্রাব মৃদুহাস্যে জিজ্ঞাসা করলেন, –

মনে হলো তাঁরা যেন সম্প্রীতির সঙ্গে বিগত রাত্রি একত্রে

যাপন করে এসেছেন –

রাত্রি যেমন ছিল, তেমনি স্বাভাবিকভাবে দিনের উদয়

হয়েছে,

কেন তবে আমরা যুদ্ধে মেতে উঠবো?

পরিত্যাগ করুন ধনুঃশর ও জিঘাংসা-মত্ত তরবারি,

অকরুণ বীণা ছুঁড়ে মারুন কঠিন মৃত্তিকায়।

চলুন, নিরস্ত্র হয়ে আমরা উপবেশন করি,

ও সুরাপানে বিশুষ্ক অন্তরে দান করি সজীবতা।

চলুন বিশ্ব-প্রভুর সামনে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই,

ও সংগ্রাম থেকে লজ্জিত হয়ে প্রত্যাবর্তন করি শান্তির

দিকে।

(শাহনামা, প্রথম খন্ড, পৃ ৬৫৭)

শাহনামার অনুবাদে মনিরউদ্দীন ইউসুফের অনন্য কৃতিত্ব হচ্ছে বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতির অভিধায় চিত্রকল্প নির্মাণে। সিয়াউশের বিমাতা সওদাবা সিয়াউশের প্রতি প্রেমাসক্ত ও কামাসক্ত হলে সওদাবার মনের গভীরে যে-প্রতিবাদ সৃষ্টি হয় তার যে-চিত্রকল্প ফেরদৌসী সৃষ্টি করেন তা তাঁর দেশের মানুষের চরিত্রের অভিজ্ঞতার আলোকে করলেও সওদাবার মতো নারীর উপস্থিতি পৃথিবীব্যাপী সব দেশেই রয়েছে। মনিরউদ্দীন ইউসুফ কবি বলেই সওদাবার মতো নারীর মনোবিকলকে চিত্রধর্মিতা নয়, চিত্রকল্পের মধ্য দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন –

সওদাবা সিয়াউশকে দেখেই বিমনা হয়ে গেলেন,

তাঁর অন্তরে কামনার ঢেউ উঠলো।

যেন রঙিন সূত্রে মনের জমিনে বোনা হয়ে চললো ফুল ও লতাপাতা,

অথবা যেন জলের নিকটবর্তী হলো অগ্নি।

(শাহনামা, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ ১৫)

এ-রকম প্রচুর চিত্রকল্প রয়েছে, যা পাঠককে শিল্পরসে জারিত করে।

শাহনামা বাঙালি পাঠক ও বাংলা সাহিত্যে প্রাসঙ্গিক কেন এ-বিষয়টিকে অনুবাদক ইতিহাসের আলোকে বর্ণনা করেছেন ­-

ফারসী ও ভাষা ভারতের রাজভাষার মর্যাদা পেয়ে প্রায় চার হাজার মাইলব্যাপী এক বিরাট এলাকার মানুষের সাহিত্য-সৃষ্টির প্রধান উপকরণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। ফলে ইরান থেকে এতদূরে অবস্থিত যে-বাংলাদেশ, ইরানের অন্যান্য কাব্যের সঙ্গে ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ও সেখানে পল্লীর ঘরে ঘরে পঠিত ও আলোচিত হতো। তার প্রভাবে পল্লীর কবিদের দ্বারা ‘সোহরাব রুস্তমের’ মর্মন্তুদ কাহিনী পরিবেশিত হতে থাকে বাংলার ঘরে ঘরে। মধ্যযুগের বাংলা-সাহিত্যে যে মানবিক রসের উদ্বোধন হয়, তাতেও পড়ে ফারসী সাহিত্যেরই সরাসরি কিংবা অন্যবিধ প্রভাব। বাঙালি মনে ‘শাহনামা’র আবেদন যদি এমনভাবে ঐতিহ্যগত হয়ে না থাকতো, তবে সম্ভবত বর্তমান অনুবাদের তেমন কোন আবশ্যকতা অনুভূত হতো না। ফারসী সাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ শত শত বছর ধরে পরিচিত।

যে-কোনো উন্নত ও মহৎ সাহিত্যে শিল্পী ব্যক্তিত্বের স্বরূপ ফুটে ওঠে। আর সে-ব্যক্তিত্ব যদি মহাকাব্যের অভিযাত্রী হয় তাহলে শিল্পী ও শিল্পের মূল্যায়ন দেশকালের সীমানা ও মানদন্ড অতিক্রম করে যায়।

ফেরদৌসী শাহনামা রচনা করে যেমন ইরানের শিল্পসম্পদে পরিণত করেছেন, তেমনি মনিরউদ্দীন ইউসুফ শাহনামা অনুবাদ করে বাংলাদেশের শিল্পসম্পদকে সমৃদ্ধ করেছেন।

বাংলা সাহিত্যে ‘ফেরদৌসী’, শাহনামা ও ‘মনিরউদ্দীন ইউসুফ’ দূরবর্তী প্রজন্মের সমকালেও সমুজ্জ্বল থাকবে। r

 

স্বপ্ন-বাস্তবের রেখা পেরিয়ে

নতুন প্রেমময় আখ্যান

সুদর্শনা চক্রবর্তী

সিসেম দুয়ার খোলো

 

নাসরীন জাহান

প্রথমা

ঢাকা, ২০১৩

১৫০ টাকা

 

সে  এক আজব ফাল্গুনের হাওয়া বইছিল হলুদ হলুদ সবুজ সবুজ গ্রামটিতে। প্রান্তরের পর প্রান্তর দৌড়াত কিশোর-কিশোরী। ওরা আশ্চর্য সব স্বপ্নের কথা বলত, যা ওরা দুজন ছাড়া কেউ বুঝত না। মতিবিবি। কুদ্দুস।

ট্রিগারে চাপ দেয়। গুলির প্রতিটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সে বিস্ফারিত হয়ে উঠতে থাকা ইসকান্দারের চোখ দেখে, মৃত্যু আলোয় যেন স্পষ্ট দেখতে পায় সে, মুনতাসির, তুই?

আজব ফাল্গুনের হাওয়া গায়ে মেখে নাসরীন জাহানের সাম্প্রতিকতম উপন্যাস সিসেম দুয়ার খোলো এক প্রেমের আখ্যান হয়ে উঠতে পারত। নারী-পুরুষের প্রেমকে বড় মায়ায় এ-উপন্যাসে বেঁধেছেন নাসরীন। চন্দ্রাবলী-জয়ানন্দের ছায়ায় তৈরি মতিবিবি-কুদ্দুস, মুনতাসির-শশীকলা, মুনতাসির-পুষ্পিতা, রঘুকাকা-রঘুকাকার স্ত্রী – এই উপন্যাসের প্রতিটি মানব-মানবীর ভালোবাসা পাঠকের হৃদয়ের কোনো এক বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ে।

কিন্তু না, শুধু তো প্রেম নয়। এ-উপন্যাস দেয়ালে পিঠ ঠেকে-যাওয়া এক মানুষের স্বপ্ন-বাস্তবের মাঝামাঝি হেঁটে গিয়ে ভীরুতা অতিক্রম করে অন্তত একবারের জন্য হলেও প্রতিবাদী হয়ে ওঠার গল্প শোনায়। যে-গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় এমন একজনকে যাকে সে আজন্ম চিনেছে পিতৃপরিচয়ে। কারণ? তার এমন এক অন্যায়, দুর্নীতি যা বদলে দিয়েছে এ-উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের নিয়তি।

সিসেম দুয়ার খোলো এমন এক উপন্যাস, যেখানে নাসরীন জাহান তাঁর লেখার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই অনেক বেশি আগ্রাসী; অ্যাগ্রেসিভ শব্দটি বোধহয় আরো উপযুক্ত হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা, বিত্ত, সামাজিক উচ্চপদ ব্যবহার করে যারা প্রতিনিয়ত কোণঠাসা করে ফেলে তার তুলনায় দুর্বলদের, সুযোগ নেয় কারো নিষ্পাপ মনের, তাদের প্রকৃত রূপ এ-উপন্যাসের প্রথম থেকেই নির্মমভাবে পাঠকের সামনে পেশ করতে থাকেন ঔপন্যাসিক। যে-চরিত্রগুলোকে আমাদের মনে হচ্ছিল তারা হয়তো শুধুই দমবন্ধকরা পরিস্থিতির শিকার, তাদেরই ঘুরে দাঁড়ানো আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। নিদারুণ অত্যাচার যে এক আদ্যোপান্ত রোমান্টিকের হাতেও তুলে দেয় অগ্নেয়াস্ত্র, তা এই কঠিন সময়ে কোথায় যেন শক্তি জোগায়।

নাসরীন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই এ-উপন্যাসে তৈরি করেন এক মায়াজগৎ। বাস্তবের ঘোরতর অাঁধার কখনো সে-জগতে আরো নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে, কখনো বা তা যেন শোনাতে চায় শান্তির কিছু কথা। এ-উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট মুনতাসির এক স্বপ্ন-দেখা পুরুষ। না, সেই স্বপ্ন সুন্দর নয়, তা তাকে দেখায় এমন দৃশ্য, নিয়ে যায় এমন অবাস্তবের রাজ্যে যা তাকে কেবল বিব্রতই করে। শিশুকালের অভিশাপ সে বয়ে বেড়ায় বহুদিন, যা থেকে তার মুক্তির ইঙ্গিত পাঠক পায় এ-উপন্যাসের শেষে।

মুনতাসির এক স্মৃতিভ্রংশ বালক। সে যত বড় হয় ততই তার এই অসুখ তাকে একা ও বিপন্ন করে তোলে। কিন্তু যেভাবে সে স্বপ্ন আর বাস্তবের বিভেদরেখা অতিক্রম করে এই দুই জগতে বাঁচে তা তার চরিত্রটিকে আরো মায়াময় করে তোলে। এমনকি যখন এই দুই জগতের বিভ্রমে মুনতাসির তার একলা বেঁচে থাকার একমাত্র সঙ্গী পুষ্পিতাকে হত্যা করে, তখনো তার দুর্বলতায় করুণাই হয়, ঘৃণা নয়। উপন্যাসের শুরুতে এই বিভ্রমের হাত ধরেই তো তার হারিয়ে যাওয়া রঘুকাকার সঙ্গে সাক্ষাৎ, ফের তাকে হারিয়ে ফেলা আর আবার নিজের উদ্ভ্রান্ত স্মৃতিতে ভর করে রঘুকাকার পলেস্তারা খসা, বিরানবাড়িতে প্রবেশ। দেখা শশীকলার সঙ্গে।

পরবর্তীকালে এ-উপন্যাসে যা কিছুই ঘটে চলে তা কখনো আমাদের চেনা পৃথিবীর অংশ, কখনো মায়াজগতের। চিরকালের চেনা ধনী, চরিত্রহীনদের হাতে দুর্বলের, নারীর শোষণ, ক্ষমতার অপব্যবহারে নৃশংসতম অত্যাচার, কয়েকটি নিরপরাধ মানুষের জীবন সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যাওয়া – এসব নাসরীন পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন নির্ভুল ডিটেইলিংয়ে। খবরের কাগজে, টেলিভিশনের পর্দায় যে-খবরগুলো আমাদের নিশ্চিন্ত জীবন কাঁপিয়ে দেয়, তা  এ-উপন্যাসের পরতে পরতে আমাদের সামনে প্রায় এক থ্রিলারের কায়দায় উন্মোচিত হয়। ঔপন্যাসিকের সার্থকতা এখানেই যে, তিনি সাহস করে এ-উপন্যাসের সবচেয়ে কালো চরিত্রটিকে এক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দেখাতে পেরেছেন, এমন এক চরিত্র যার পক্ষে  যে-কোনো অন্যায়ের পরও বুক ফুলিয়ে পুরুষতন্ত্রের দামামা বাজানো সহজ।

সিসেম দুয়ার খোলোর সার্থকতা এখানেই যে, এ-ধরনের একটি আপাত সামাজিক-রাজনৈতিক প্লটের সঙ্গেও সাবলীলভাবে বুনে যায় নানা বয়সের মানুষের সরল, জটিল সম্পর্ক। মুনতাসিরের মতো বিভ্রান্ত যুবা, রঘুকাকার মতো সব-হারানো অথচ শক্ত ধাঁচের মানুষ আর শশীকলার মতো রোমান্টিক অথচ নিজেকে আড়ালে রাখা এক পরিপূর্ণ নারী কার এক অমোঘ নির্দেশে জড়িয়ে যায় পরস্পরের সঙ্গে। নাসরীন জাহান সহজাতভাবেই পছন্দ করেন মানুষের মধ্যেকার সম্পর্কের পরতগুলো সযত্নে খুলতে। তাই তো এরা যখন ক্রমশ পরস্পরের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, তখন কোথাও যেন পাঠক হিসেবেও স্বস্তি জাগে। একই রেখায় হাঁটা মানুষগুলো অন্তত একসঙ্গে যুঝছে।

একদিকে যদি থাকে লোভ-লালসা-নিষ্ঠুরতা, তাহলে অন্যদিকে মানবিকতা, রুখে দাঁড়ানোর ইচ্ছা, যা এখনো হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম আশা জাগায়, তার ছবি। তাই উপন্যাসের শেষে হাসানুল্লা যখন মুনতাসিরকে বলে, ‘আমি সব সামাল দিমু, আপনি যান, চইলা যান’ তখন, কিংবা শশীকলা যখন ‘মুনতাসিরকে কখনো মাতৃছায়া, কখনো প্রেমিকার ভরসা, কখনো… কী যে দেবে ভেবে উঠতে পারে না’ বা রঘুকাকার ‘ঢাল-তলোয়ারহীন পরাজিত মানুষে’র রূপ দেখে বিচলিত হয়ে ওঠে মুনতাসির অথবা নিজের জীবনের সত্যের সামনে দাঁড়ানো বিপর্যস্ত মুনতাসিরকে আগলে রঘুকাকা যখন বলেন, ‘চলেন ছোটবাবু, এই তো আমি আছি। আমারে ধরেন, কেউ আপনারে কিচ্ছু করব না, কেউ কিছু জানব না’ – তখন যেন ভরসা জাগে, ইসকান্দর আলি, প্রাণেশ, মতিবিবির ডাকাত স্বামী এরা যেমন আছে তেমনি তো এমন মানুষও আছে, যারা পাশে থাকে চরম দুর্বিপাকেও, সত্যের সামনে দাঁড় করায়, সাহস জোগায়, জীবনের নতুন রূপ চেনায়।

আর এ-উপন্যাসে আছে সব ছাপানো প্রেমের উদ্ভাস। চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের ভালোবাসার উপাখ্যান এ-উপন্যাসকে স্নিগ্ধ হাওয়ার মতো জড়িয়ে থাকে। মুনতাসিরের বিভ্রান্ত, বিপন্ন অস্তিত্বকে প্রথম প্রেমে জড়িয়ে নেয় পুষ্পিতা, যাকে হারিয়ে ফেলেও ঘৃণা আর প্রেমের মাঝের পথ অাঁকড়ে থাকে মুনতাসির, শেষে ফিরে আসে সেই প্রেমকে ফিরে পাওয়ার আকুল আর্তি। মতিবিবি-কুদ্দুসের প্রেম যেন সেই জান-কবুল প্রেমের রূপ, যা নানা সময়ে আমাদের প্রেমে পড়ার, প্রেমকে ফিরে পাওয়ার মায়াবী হাতছানি দেয়। শৈশবের প্রেম যা চরম বিপদ পেরিয়ে এক হয়, থিতু হয় আর পরমুহূর্তেই তলিয়ে যায় চিরবিচ্ছেদের অতলে। যতই হিংসায় ছাওয়া হোক সে-বিচ্ছেদ, তা তাদের প্রেমকে চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের বিরহবিধুর প্রেমের উচ্চতায় নিয়ে যায়। আখ্যান আর বাস্তব মিলেমিশে যায় শুধু প্রেমের আহবানে।

শশীকলা এমন একটি চরিত্র যাকে নাসরীন বড় স্নেহে, বড় মমতায় এঁকেছেন। সে যেন এক চিরন্তন নারী, যার মধ্যে অদেখা এক প্রেমিকের প্রতি সবটুকু উজাড় করে দেওয়া ভালোবাসা তাকে নিজের লুকিয়ে থাকার, শান্ত থাকার উপায় বলে দেয়। মুনতাসির যখন আসে সেই প্রেমের রক্তমাংসের রূপ ধরে, তখন সে বিহবল হয়, কিন্তু বোঝে এই আত্মভোলা, ভিন্ন মানুষটিকে সে জাগতিক প্রেমে পেতে পারবে না। তাই তাকে স্থিত রাখার, বাস্তবে ধরে রাখার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নেয় সে, নিজের শরীর, মনের ডাক উপেক্ষা করে। শশীকলা কিন্তু হেরে যাওয়া নারী নয়। জীবনের ঘা খেয়ে শক্ত হওয়া এমন মানুষ যে একাকী গ্রামের প্রান্তে অশরীরীর মতো মিলিয়ে থাকতেও ভয় পায় না। মুনতাসিরকে যখন সে বলে তার সঙ্গে একাত্মতার কারণ সেও অনেকটা মুনতাসিরের মতো, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই মেয়ের মধ্যেও রয়েছে স্বপ্নের হাতছানি।

কিন্তু শশীকলার স্বপ্ন তাকে মুনতাসিরের মতো অস্থির করে না। এ যে কোনো এক অচিন দেশের অজানা জনের স্বপ্ন, পালা গাইবার স্বপ্ন, নিজের মতো বাঁচার স্বপ্ন। মুনতাসিরের শশীকলার প্রতি কোনো প্রেমের প্রকাশ সারা উপন্যাসে নেই। কিন্তু শশীকলার সান্নিধ্যে তার যে শান্তি, স্বস্তি, সে আনমনা হলে মুনতাসিরের যে-চিন্তা, তাকে ছাড়া যে নিরাপত্তাহীনতা সেটা তবে কিসের ইঙ্গিত দেয়? থাক না কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা।

এ-উপন্যাসের বড় প্রাপ্তি মতি-কুদ্দুস পালায় বা তাদের কথোপকথনে নাসরীনের নিজের রচিত পদ। এক্ষেত্রেও তিনি যে সফল তাতে সন্দেহ থাকে না। ‘অাঁখিতে শরম ভরি ময়ূরের পাখা/ রক্তজবা অঙ্গ দেইখা বক্ষ পুইড়া খাঁ খাঁ/ ছুঁইবার গিয়া ডরাই কইন্যা মাখন গইলা যায়/ কামনার তুলপাড়ে পরান হায় হায়!’ ‘অনেক দিয়া সাগর পাড়ি পাইলাম তোমার বক্ষ স্বামী/ তৃণশয্যা পানি তাতে/ ধান্য দূর্বা দুধে-ভাতে/ জীবন য্যান তেপান্তর হয় ওগো অন্তর্যামী…।’ এই পদগুলো প্রমাণ করে তাঁর চর্চা ও দক্ষতা।

নাসরীনের অন্যান্য উপন্যাসের মতোই পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া কিছু উপাদান তো অবশ্যই আছে। এখানে প্রকৃতির যে-বর্ণনা তা যেন পাঠককে এক ঘোরলাগা ভালোলাগা কিংবা বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দেয়। বহুদিন পরে জ্যোৎস্নারাতের চাদরে জমাটবাঁধা ঘিয়ের বাটি যা থেকে জ্যোৎস্না নামছে ফাঁকা গ্রামের গায়ে তা এক অদ্ভুত মন-কেমন-করা এনে দেয়। রয়েছে ছোট ছোট চরিত্রের মাধ্যমে খুব প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়কে ছুঁয়ে যাওয়া। যেমন ইসকান্দরের স্ত্রী সেসব নারীর প্রতিভূ, যারা স্বামীর সব অন্যায় জেনেও চুপ করে থাকেন শুধু ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই বলে, শেষে যারা করুণা আর ঘৃণার পাত্রী হয়ে ওঠে অথবা স্বর্ণবালা যে-কোনো কিছুর পরোয়া না করে শিল্পের জন্য গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দেয়। এ-উপন্যাসে দুটি ধর্ম কোথায় যেন মিলেমিশে যায়। বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ, ভালোবাসা যে মানুষকে কখনো ধর্ম থেকে দূরে নিয়ে যায়, তা তখন হয়ে যায় অর্থহীন, আবার কখনো সে-বিশ্বাসেই মেলে শান্তি, তা নানা চরিত্রের যাপনে স্পষ্ট হয়ে যায়।

মুনতাসির আটকেপড়া গুহার বন্ধ দরজা খোলার মন্ত্র ভুলে গিয়েছিল যেনবা। একটু একটু করে পিছু হটেও শেষের আঘাত করতে পেরেছিল সে। আবার নেমে এসেছিল পথে। বিশ্বাস আর প্রেম তাকে আবার আগলে নেয় ভরসার হাত বাড়িয়ে। এ যে জীবনেরই হাত। মুনতাসিরের মতো স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝে তো বিচরণ আমাদেরও। এই অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের শুধু সাহসে বুক বেঁধে লড়াইটা লড়তে হবে, বলতে হবে, সিসেম দুয়ার খোলো, অদ্ভুত ঝাঁকড়া চুলের এক বৃদ্ধ হয়তো রয়েছে আমাদেরই অপেক্ষায়। r

কামাল চৌধুরীর মুক্তি ও স্বাধীনতার কবিতা

সরকার আবদুল মান্নান

 মুক্তি ও স্বাধীনতার কবিতা

 

কামাল চৌধুরী

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স

ঢাকা, ২০১২

100 টাকা

কলকাতার একটি স্কুলে ক্রাফ্ট পড়াতেন কমলকুমার মজুমদার। একদিন তিনি শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করলেন – বাঁকুড়ার ঘোড়া দেখেছিস কেউ? বাঁকুড়ার ঘোড়া? কিছু হাত ওঠে। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করলেন, এইসব ঘোড়া যারা বানায়, কুমোররা, তারা দেখবি ভোর ভোর উঠে লাইন বেঁধে, মাঝে মাঝে মাঠের আলপথ ধরে কোথায় চলেছে। বল তো কোথায় যায়? কেউ বলতে পারে না। কমলকুমার বললেন, পারলি না? ওরা মাটি খুঁজতে যায়। মাটির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা মাটি খোঁজে। কমলকুমারের বক্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে বলা যায়, একজন কবি দীর্ঘ কবিতার পথ হেঁটে হেঁটে প্রতিনিয়ত খোঁজেন তার নিজস্ব কবিতা। খোঁজেন কবিতার বিষয়, কবিতার ভাষা।

কামাল চৌধুরী তিন দশক ধরে কবিতা অন্বেষণের নিরন্তর অভিযাত্রায় খুঁজে বেড়িয়েছেন প্রিয় দেশমাতৃকাকে। কোন সে দেশ? বিপ্লব-বিদ্রোহের দেশ, আন্দোলন-সংগ্রামের দেশ। তাই  ১৯৮১ সালে যখন তাঁর মিছিলের সমান বয়সী নামে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তখনই আমরা বুঝে যাই যে, কামাল চৌধুরী রোমান্টিকতার বেনোজলে গা ভাসিয়ে দেবেন না – পুকুরতলের এঁদো মাটি তাঁর অন্বিষ্ট নয়। তিনি সেই বাংলাকে খুঁজছেন – শত-সহস্র বছর ধরে যার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে মুক্তির নেশা, বিপুল উদ্যম আর প্রাণশক্তিতে যার সন্তানেরা জেগে থাকে সর্বক্ষণ। তারপর টানাপোড়েনের দিন (১৯৯১), এই পথ এই কোলাহল (১৯৯৩), এসেছি নিজের ভোরে (১৯৯৫), এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা (১৯৯৭), ধূলি ও সাগর দৃশ্য (২০০০), রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল (২০০৩), হে মাটি পৃথিবীপুত্র (২০০৬), পান্থশালার ঘোড়া (২০১০) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের ভেতর দিয়ে কামাল চৌধুরী তাঁর অভিযাত্রাকে মহিমান্বিত করে তুলেছেন। আর সেই যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে বারবারই ফিরে তাকিয়েছেন দেশমাতৃকার পানে। মুক্তি ও স্বাধীনতার কবিতা (২০১২) তাঁর সেই অনন্য জীবনতৃষ্ণার সর্বশেষ মহার্ঘ্য।

কামাল চৌধুরী কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি বাঙালির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সেই মহান ব্যক্তিত্বকে সামনে রেখে পরম শ্রদ্ধায়, তিনি  লিখেছেন চারটি চরণ :

বীরের এ রক্তস্রোত চিরকাল তীব্র বেগে ছোটে

সেই রক্ত মিশে যায় ঢেউয়ে ঢেউয়ে গঙ্গা যমুনায়

সেই রক্তে ফুল ফোটে – তার ঘ্রাণে ব-দ্বীপ প্লাবিত

তোমার রক্তের  ঋণে এই সত্য জেনেছে সবাই।

মূলত এই চেতনার ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে মুক্তি ও স্বাধীনতার কবিতা শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের ৩৯টি কবিতা। জাতীয় জীবনে অসাধারণ ও অবিস্মরণীয় ঘটনার অপ্রতিরোধ্য চাপ শিল্পীমাত্রকেই সৃষ্টির প্রেরণায় অভিভূত করে তোলে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হাজার বছরের ইতিহাসে অনন্যসাধারণ এক ঘটনা। ফলে অনিবার্যভাবেই গড়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যে আলাদা একটি সাহিত্য-শাখা (Literary genre)। মুক্তি ও স্বাধীনতার কবিতা এ-ধারায় অসাধারণ সংযোজন। ১৯৭৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪ বছরের মধ্যে রচিত কবিতাগুলো কবির মুক্তিযুদ্ধ ও এর চেতনার বিচিত্র রঙে রূপময় হয়ে উঠেছে এবং সেই রূপায়ণের একটি বিবর্তন ও বিকাশ লক্ষ করা যায় কবিতাগুলোর পর্যায়-সারণিতে। এমনকি ‘শহীদ জননী’, ‘সুফিয়া কামাল স্মরণে’, ‘শামসুর রাহমান স্মরণে’ প্রভৃতি কবিতায়ও মুদ্রিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ভিন্ন এক রক্তক্ষরণের ইতিহাস। আর এসব সঙ্গ-অনুষঙ্গের আলোকে, বিচিত্র প্রতীক, রূপকল্প ও চিত্রকল্পের আলোকে কিংবা গল্প এবং গল্পের ছায়া-প্রচ্ছায়ার আলোকে কবি যে পঙ্ক্তিমালা নির্মাণ করেছেন তা দেশমাতৃকার প্রতি শুধু ভালোবাসার অঙ্গীকার, জনেমর ঋণ, জন্মের প্রার্থনা।

প্রারম্ভের ‘জন্মের প্রার্থনা’ কবিতায় ‘কবরের প্রতীক্ষায় থাকা একজন বৃদ্ধ’, ‘খনি আর তাঁতকল ফেরা একজন শ্রমিক’, তারুণ্যের মিছিল, ‘পাড়াগাঁও বধূ’, ‘একজন মাঝি’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ‘মৃত্যু ও বারুদের ঘ্রাণ’ ইত্যাকার প্রতীকের ভেতর দিয়ে বাংলার একটি চিরায়ত মুখাবয়ব অাঁকা হয়েছে। আর কবি প্রার্থনা করেছেন ভালোবাসা। এই বাংলার মানুষের ভালোবাসা যদি তিনি অর্জন করেন তাহলে কবির বিনম্র স্বীকারোক্তি :

আমি সেদিন বলব

সমস্ত প্রার্থনা আজ শেষ হয়েছে

জন্মের ঋণ আমি স্বীকার করেছি।

কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার মধ্যেই কবি জন্মের ঋণ স্বীকার করেছেন। আপ্লুত হয়েছেন গভীর ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায়।

‘মুগ্ধ কিষাণের কাছে মাটির মমতা’ হওয়ার অঙ্গীকারে কবি কামাল চৌধুরীর কবিতা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। এ-অঙ্গীকার তাঁর ভালোবাসার অঙ্গীকার। এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, লোকজ জীবন ও সংস্কৃতি, খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন, বিপ্লব, বিদ্রোহের ঐতিহ্য, সৃষ্টিশীল জীবনচর্চার প্রত্যয়-প্রতিজ্ঞা এবং অবিচ্ছিন্ন সৌহার্দ্য ও শান্তির প্রতি গভীর আস্থায় তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ ও শব্দবন্ধ আশ্চর্য ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। জন্মদিনের কবিতায় কবি লিখেছেন :

প্রিয় বোন, প্রিয় ভাই

আমি শুধু জন্মের কাছে ঋণী, শেকড়ের কাছে ঋণী

ভূমিষ্ঠ শিশুর গানে নৈঃশব্দ্য বিদীর্ণ হলে

আমি ঘুম চোখে একা জেগে উঠি, কথা বলি

কবিতায় কথা বলি, হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলি

যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলি, মৃত্যুর বিরুদ্ধে কথা বলি

এই মাটি মৃত্যুহীন হোক সেই কথা বলি।

১৯৮১ সালে মিছিলের সমান বয়সী শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি কামাল চৌধুরীর যে আবির্ভাব ঘটে তার প্রেরণার কেনদ্রবিন্দুতে ছিল দ্রোহ এবং দেশমাতৃকার অন্য এক জাগরণের জন্য দুর্নিবার আকুলতা। কবি তাঁর কাব্যভাষার মধ্যে অফুরন্ত প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়ে জাগরণের সে-প্রত্যয়কে প্রবল করে তুলেছেন। তৈরি করেছেন তিনি নিজস্ব এক ভাষাবৈভব। ‘ক্রাচের যুবক’ থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করি :

ধর্ষিতা বোনের শাড়ি অকস্মাৎ রাইফেল হয়ে যায়

ইতিহাস কেঁপে ওঠে রক্তে, বীর্যবান সুদৃঢ় বাহুতে

জেগে আসে বাংলাদেশ, সাত কোটি মানুষের প্রেম।

কামাল চৌধুরীর কবিতায় এভাবে একটি দেশ তার সকল ত্যাগ ও তার বিস্ময়কর রক্তক্ষরণসমেত একটি সশস্ত্র প্রতিরোধের মূর্তমান প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘ধর্ষিতা বোনের শাড়ি অকস্মাৎ রাইফেল হয়ে যায়’ – এই চিত্রকল্প, এই চিত্রকল্পের চেতনার জগৎ, এর রূপাবয়ব এবং এর শক্তির সৌন্দর্য কামাল চৌধুরীর কবিতাকে চিরায়ত শিল্পের মহিমায় উত্তীর্ণ করে। এবং একটি  দেশ কবিতা হয়ে ওঠে একটি কবিতা হয়ে ওঠে দেশ।

জন্মাবধি বিক্ষুব্ধ এক বাংলাদেশে কবি কামাল চৌধুরীর বেড়ে ওঠা। ফলে চিরকালই যিনি অতৃপ্ত-গোপন এক দাহ সংক্ষোভ আর সন্তাপ তাঁর কবিতার প্রাণ আর সেই ক্ষুব্ধতার মধ্যে সংগোপনে লুকিয়ে থাকে প্রণয় – দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা। ‘রক্তাক্ত পঙ্ক্তিমালা’ কবিতায় কবির এই বহুবিচিত্র ভাবনা-অনুভাবনার অসাধারণ এক ঐকতান লক্ষ করা যায়। পত্রকাব্য নয় এটি, কিন্তু কবি বলেছেন, ‘তুমি পড়বে না জানি, তবু এই চিঠিখানি পাঠিয়ে দিলাম।’ এ-চিঠি পৌঁছানোর কোনো ঠিকানা নেই। প্রেরকের ঠিকানাও নেই। মনে হয়, ষোলো কোটি মানুষ  এই চিঠির প্রেরক ও প্রাপক। এদেশের সকল মানব-মানবীর ঘর, ক্ষেত-খামার, নদ-নদী, নগর-বন্দর, পাহাড়-পর্বত এই চিঠির ঠিকানা। চিঠির ভূমিকায় কবি লিখেছেন :

আমার জন্মের সাথে যে শিশুর কান্না শোনা গেছে

এ-মাটি শুনেছে যার অসহায় অবুঝ চিৎকার

আমি সেই ক্ষুব্ধ শিশু ক্রমান্বয়ে বিশেষ যুবক

অতৃপ্ত চরণে আজ লিখে দেব পিতৃ-মাতৃ ঋণ

কিছুটা জন্মের ক্ষোভ, শোক, দাহ – কবির প্রণয়।

আশির দশকের বিক্ষুব্ধ সময়ে লেখা এ-কবিতাটির পাঁচটি পর্বের মধ্যে কবির বোধের বিচিত্র পরত উন্মোচিত হয়েছে। মধ্য সত্তর থেকে আশির দশক পর্যন্ত রক্তেভেজা এক মুমূর্ষু জনপদে বসে কবিতা লিখছেন কবি কামাল চŠধুরী। সহস্র মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়ে যায় তাঁর। তিনি ভয়হীন দীপ্রবর্ণ অনার্য যুবক। অনায়াসে ছিন্ন করেন হাতকড়া ‘আধারনীলিমা’; কিন্তু কে চেনে তাঁকে? কবিকে? শব্দে শব্দে যিনি গড়ে তোলেন অলৌকিক নদী ও প্রাসাদ, সবুজ শস্যের গ্রাম যার শব্দে রূপময় হয়ে ওঠে, সহস্র মৃত্যুর মধ্যে যিনি রচনা করেন অবয়ের অকুণ্ঠ পঙ্ক্তিমালা – তাঁকে চেনে কে? কবি ক্ষোভের সঙ্গে তাই রচনা করেন অবিস্মরণীয় শব্দবন্ধ – ‘নিসর্গ আমাকে চেনে চক্ষুষ্মান মানুষ চেনে না’।  কিন্তু কবির ক্ষোভ শুধু চক্ষুষ্মান মানুষের এই দৃষ্টিহীনতার জন্যই নয় – ক্ষোভ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, বাঙালি জাতির বিস্মৃতিপ্রবণতার বিরুদ্ধে বিস্ময়কর এক জাগরণ ও যুদ্ধশেষে স্বাধীন দেশের নাগরিকদের পরাজিত শক্তির কাছে পরাভব মানার বিরুদ্ধে। কয়েকটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করি যার মধ্যে কবির এই ক্ষোভ অগ্নিমূর্তি লাভ করেছে।

সমাজ সংস্কার যুদ্ধ রাষ্ট্রসংঘ অস্ত্রের আড়ত

আমার বাহুতে শুধু বেঁধে আনে ঘৃণার প্রকোপ

হাজার হাজার ঘুণ একসঙ্গে খেয়ে যায় স্মৃতি

ঐতিহ্য ভুলেছে লোকে চেনে শুধু টাকার গুদাম

ক’জন কেঁদেছে মনে একুশের শোকার্ত প্রভাতে?

শোকসভা, সেমিনার, হাস্যকর শহীদ স্মরণ!

বিজয় পতাকা হাতে যাঁরা আসে স্বদেশ মাটিতে

তাঁদের দেখি না কেন? তাঁরা আজ কোন জনপদে

হতশ্রী জীবন রাখে কাষ্ঠখন্ড ক্রাচের শরীরে?

তাদের গিয়েছে কেউ ভালোবেসে ফুল তুলে দিতে?

পিচের শহরজুড়ে জেগে থাকে ভুল ভালোবাসা

ব্যথিত জন্মের ক্ষোভ অসহায় দিবস রজনী।

আশির দশকে লেখা এসব পঙ্ক্তির মধ্যে একটি বিপর্যস্ত সময়ের স্মারক খুঁজে পাওয়া যায়। সংক্ষোভের ভাষায় ছন্দ থাকতে পারে, কিন্তু মেদ-চর্বি থাকতে নেই। আড়াল-আবডাল থাকতে নেই, রহস্যমতাও নয়। কামাল চৌধুরীর এই সব কবিতায় তীক্ষ্ণ-তীব্র শব্দ ও শব্দবন্ধ পরিলক্ষিত হয়, যার উদ্দেশ্য চেতনায় আঘাত হানা কিংবা মিথ্যার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসুন্দরের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেখানে উত্তাপই শেষ কথা নয়, আলোও আছে – আলোকিত হওয়ার প্রেরণা ও প্রত্যয় আছে। কামাল চৌধুরী নৈরাশ্যবাদী কবি নন। ক্ষুব্ধতা ও হতাশাচ্ছন্নতা তাঁর কবিতার পরিণতি নয়, বরং তিনি পরিবর্তনের কবি, প্রগতির কবি। সমাজ সংগঠনের বুনন-বিন্যাসে বিপুল অরাজকতা থেকে মুক্তির জন্য তিনি দ্রোহে বিশ্বাসী; প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও আন্দোলনে বিশ্বাসী। একই কবিতার সমাপ্তিতে তিনি আহবান করেন :

পাথরে আঘাত করো, খুলে ফ্যালো বেনির জড়তা

ভেঙে ফেলি রাষ্ট্রসংঘ তন্ত্রমন্ত্র সামাজিক শ্রেণি

নতুন বিন্যাসে এসো তুমি আমি পৃথিবী বানাব।

এ-কাব্যগ্রন্থের প্রায় সমস্ত কবিতার মধ্যেই আছে বঙ্গবন্ধুর চেতনার জগতের বিচিত্র ছায়া-প্রচ্ছায়া, ধ্বনি-ধ্বনিপুঞ্জ, চিত্র-চিত্রকল্প, রূপকল্প। আবার কিছু কবিতা আছে, বিভিন্ন শিরোনামে যেগুলো বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাঙালি জাতির ভাবনার শেষ হবে না কখনোই। এই ভাবনা শুধু জাতিগত নয়, ব্যক্তিমানুষের আনন্দ-বেদনা ও গোপন রক্তক্ষরণের সঙ্গেও এই মহান মানুষটির সম্পর্ক নিত্যদিনের। সেই ব্যক্তিমানুষটি যদি হন একজন সৃজনশীল মানুষ – একজন কবি, তাহলে বোধের অন্য এক মাত্রায় উন্মোচিত হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। কামাল চেŠধুরীর কবিতায় অনন্য সেই বোধের সঙ্গে আমাদের পরিচয় মেলে। কাব্যগ্রন্থটিতে  এ-ধরনের কবিতা আছে চারটি : ‘সেই মুখখানি কবিতার বড় ছিল’, ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’, ‘তোমার মৃত্যুর কথা মনে হলে’ এবং ‘১০ জানুয়ারি ১৯৭২’।

এসব কবিতায় বঙ্গবন্ধুর অনন্য এক অস্তিত্বের জগৎ রচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর একজীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালির মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। ফলে অনিবার্যভাবেই প্রেমে-দ্রোহে তাঁর জীবন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। আর প্রত্যেক বাঙালির মনে-মননে এবং চেতনায়-চৈতন্যে তিনি হয়ে উঠেছেন চিরকালের প্রমিথিউস। কামাল চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সেই অবিনাশী শক্তির প্রত্ন-ইতিহাস তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়। আর বয়ন করেছেন নির্মমভাবে বিদায় নেওয়া এক মহাযাত্রিকের আলেখ্য – কবির হৃদয়ের রক্তক্ষরণের দুর্বহ যন্ত্রণা। কামাল চৌধুরী লিখেছেন :

তোমার মৃত্যুর কথা মনে হলে

তোমার জন্মের কাছে ঋণী হয়ে যাই।

আমি এক ব্যথিত কুমার

তোমার মৃত্যুর নামে আজীবন বেদনাতাপিত থাকি

অন্তঃস্থ হৃদয়জুড়ে নেমে আসে লাল স্রোত

রক্তক্ষরণের মতো তীব্র এক বিক্ষুব্ধ ধারায়

সে বেদনা কান্না হয়।

কিন্তু কান্নার মধ্যেই শেষ নয়। কবি প্রতিশোধ নিতে চান। পাঁজরের হাড়ে আগুন জ্বালিয়ে কত কাল আর প্রতিশোধের অপেক্ষায় থাকা যায়? কতদিন আর ঘাতকের হাতে দন্ডের দায়ভার অর্পণ করে স্বপ্নের মহাকালকে শূলে চড়ানো যায়? সুতরাং কবির অঙ্গীকার :

অনেকের চোখে বনভোজনের নেশা

ভুলে যেতে চায়, আমি তবু ভুলব না

এই পথ ছেড়ে যারা যারা যাবে – যায় থাক

একা হয়ে যাব নিঃস্ব হব না তবু

ছাড়ব না আমি কিছুতেই ছাড়ব না।

এক জীবনে যদি বা ব্যর্থ হই

এই তলোয়ার পুত্রকে দিয়ে যাব।

এই কাব্যগ্রন্থে কয়েকজন অগ্রজ কবি, প্রগতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীনতার কুশীলবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পরিচয় আছে। তাঁরা হলেন হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামাল ও শামসুর রাহমান। বাঙালি জাতিসত্তা বিনির্মাণে এঁদের অসাধারণ ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। এঁরা তাঁদের সৃষ্টির ভেতর দিয়ে, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এঁদেরই উত্তর-সাধক কবি কামাল চৌধুরী গভীর ভালোবাসা ও ভক্তির সঙ্গে স্মরণ করেছেন পূর্বতনদের মহান কৃতি ও ঐশ্বর্যকে, তাঁদের মহিমা ও মৃত্যুঞ্জয়ী সৃষ্টিকে। হাসান হাফিজুর রহমান স্মরণে কবি লিখেছেন :

মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের সাহসের সঙ্গী হয়ে

একুশের ভোরের আলোয়

একদিন তুলেছেন শোকার্তের ক্ষুব্ধ তরবারি

সেই ক্ষোভ বুকে নিয়ে বাংলার শ্যামল মাটিতে

মানচিত্র খুঁজে খুঁজে অন্তহীন স্বপ্নে

যারা মেতে উঠেছিল

সেই স্মৃতি সেই সব মানুষের মুখ

আপনি তো চেয়েছেন এঁকে যেতে জীবন-সন্ধ্যায়

এই মৃত্যু – একি তবে স্বপ্ন অবাসান?

পূর্বতনদের প্রত্যয় নিয়ে কামাল চৌধুরীর এই সংবেদনা, এই কৃতজ্ঞতা নিঃসন্দেহেই মহার্ঘ্য। এক্ষেত্রে বিনয়, ভালোবাসা ও দ্রোহ মিলেমিশে তাঁর কবিতাকে অন্য এক মাত্রায় উন্নীত করেছে।

কামাল চৌধুরী জনমানবের কবি, আন্দোলন-সংগ্রামের কবি। তাঁর কবিতায় প্রেম আছে, কিন্তু সেই প্রেম কদাচিৎ নারী-পুরুষের প্রেম, সেই প্রেম দেশপ্রেম, মানবপ্রেম। ফলে অনিবার্যভাবেই অনন্য এক ভাষাসৌষ্ঠব নির্মাণ করতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর সেই কাব্যভাষা সরাসরি জীবনসংশ্লিষ্ট। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপকল্প, চিত্রকল্প এবং আলো-আঁধার ও রঙের ব্যবহারে সেই ভাষা সংগ্রামী মানুষের চেতনার ভাস্কর্য হয়ে উঠেছে। মেদবর্জিত একধরনের প্রত্যক্ষতা তাঁর কাব্যভাষার অনন্য বৈশিষ্ট্য। আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতার অভিযোগ কামাল চৌধুরীর ক্ষেত্রে কখনোই খাটে না। এমন এক প্রত্যক্ষ জীবন ও জগতের নির্মাতা তিনি যেখানে রহস্যময়তা ও দুর্বোধ্যতার কোনো স্থান নেই। দ্রোহের কবিতায়, বিপ্লবের কবিতায়, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার কবিতায় কবির এই অনন্য কাব্যভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। এবং সেই ভাষাসৌষ্ঠব ও জীবনবোধের আলোয় আমরা আলোকিত হতে পারি।

 

কুলিমানুর আশ্চর্য ঘুম

আহমেদ বাসার

কুলিমানুর ঘুম

 

শুভাশিস সিনহা

অ্যাডর্ন পাবলিকেশন

ঢাকা, ২০১২

১৫০ টাকা

 

সূচনালগ্নে বাংলা উপন্যাস উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনচিত্রণে উৎসাহী হলেও ধীরে ধীরে নিম্নবিত্ত ও ছিন্নমূল মানুষের জীবনযাত্রার দিকেও তার দৃষ্টি প্রসারিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের ঘটনাবহুল জমজমাট কাহিনি শোনাতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের অন্তর্জগতে উঁকি দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন ঘটনাহীন জীবনেও বলার মতো অন্তহীন ঘটনা থাকে। তিরিশের দশকে মানিক-বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর – তিন বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তজ শ্রেণির জীবনকে বৈচিত্র্যময় প্রেক্ষণবিন্দু থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। এরপর বাংলা উপন্যাস প্রান্তিক মানুষের সাবলীল উপস্থিতিতে ভিন্নমাত্রা লাভ করে। তরুণ ঔপন্যাসিক শুভাশিস সিনহা কুলিমানুর ঘুম উপন্যাসে নিঃস্ব অথচ আত্মগর্বী ও ব্যক্তিত্ববান এক চরিত্র কুলিমানুকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। কুলিমানুর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন – ‘অনেক কাল আগে এই দেশে নদনদী তেপান্তর পার হয়ে কিছু লোক এসেছিলো, সেই গৌণ লোকগুলোরই একজন কুলিমানু। মানুষকে তারা মানু বলে।’ এই ‘গৌণ মানুষ’ কুলিমানুর ভেতর ও বাহিরকে শুভাশিস অবলোকন করেছেন গভীরভাবে।

অবাঙালি অথচ বাংলায় পারঙ্গম কুলিমানুর সহায়-সম্বল বলতে একমাত্র তার শরীর। পরিশ্রম করেই তাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। শিল্পী এসএম সুলতানের চিত্রের পেশিবহুল মানুষের মতো কুলিমানুর শরীরের গড়ন। লেখকের ভাষায় – ‘কুলিমানুর শরীর এখানকার মাটির চেয়ে চৌদ্দগুণ শক্ত; তবে হঠাৎ করে তার বড় একটা সমস্যা দেখা দেয়। সেই সমস্যার নাম – ঘুম, লেখকের ভাষায় ‘ঘুমরোগ’।

ঘুম মানুষের অতীব প্রয়োজনীয় ও স্বাভাবিক একটি দৈনন্দিন কর্ম। কিন্তু সেই ঘুমের যদি স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞান লোপ পায় তাহলেই সমস্যা। আর সেটা যদি হয় কুলিমানুর মতো খেটে-খাওয়া মানুষের ক্ষেত্রে তাহলে তো তাকে মহাসমস্যাই বলতে হয়। লেখক কুলিমানুর সমস্যাকে এভাবে চিত্রিত করেছেন – ‘বসলেও ঘুম পায়, দাঁড়ালেও ঘুম পায়। কারো সঙ্গে কথা বলছে, এমন হলো যে টানটান ক্লাইমেক্স, তারই মধ্যে হারামির ঘুম এসে চোখ অাঁধার করে ফেলল। লজ্জার আর শেষ নেই’।

তবে কুলিমানুর ক্ষেত্রে এটি যতটা না লজ্জার, তার চেয়ে বেশি শঙ্কার। কারণ কুলিমানু সমাজের এমন একশ্রেণির মানুষ, যাদের কাছে ঘুমই এক ধরনের বিলাসিতা। দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রমই যাদের নিয়তি।

কুলিমানুর এই সমস্যাকে আমরা অন্যদিক থেকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারি। মানসিক অবদানও মানুষের মধ্যে ঘুমের অনুভূতি সৃষ্টি করে। কুলিমানুর সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাও অবসাদ সৃষ্টির অনুকূল ছিল। একদিকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে ছোট মেয়ে রানীর মৃগীরোগ ও বড় মেয়ে রত্নার বিবাহ-সমস্যা তাকে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। রানীর ওষুধের জন্যই মাসে নয়শো টাকা খরচ। দিনরাত পরিশ্রম করে ও জমি বন্ধক রেখে সে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করে।

দুই

কুলিমানু চরিত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ঐতিহ্য-সচেতনতা। মনিপুরী ঐতিহ্য ও পূর্বপুরুষদের কীর্তি তাকে হীনমন্যতা থেকে রক্ষা করে। ‘মণিপুরী মণিপুরী বলে একটা গর্বভাব তার হয়। কারণ সে মনে করে তারা অর্জুনের বংশধর। ইতিহাসে ও নাকি লেখা আছে।’ নিজস্ব সবকিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত থেকে চন্দ্রকুমার নামে একজন ইশালপা এলে সবাই যখন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন কুলিমানু বিরক্ত হয়। কারণ তাদের হরিণারায়ণ গোপীচালই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মণিপুরের একটা সমৃদ্ধ ছবিও তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে – ‘ওখানে সোনা মাণিক্য আর মণিমুক্তা আছে বলেই তো মণিপুর নাম’।

হরিচরণ কুলিমানুকে কৃষিকাজ ছেড়ে রিকশা চালানোর পরামর্শ দিলে সে রেগে যায়। তার ভেতর জেগে ওঠে প্রবল জাত্যাভিমান। এছাড়া মণিপুরি রক্ত শরীরে নিয়ে হরিচরণ কীভাবে ঘুষ খায়, অপকর্ম করে তা ভেবে কুলিমানু বিস্মিত হয়। তার ভাষায় – ‘আরে তোরা জাতটার দিকে একবার তাকাবি না? কতো বড় সম্মান নিয়ে আমরা ছিলাম। আজ সব গিয়ে এক কাতারে শামিল হবার তোড়জোড়। ঘুষ খেতেও বাঁধছে না।’

এই ঐতিহ্যচেতনাই তাকে দুঃসময়ে শক্তি ও সাহস জোগায়। বাতরোগগ্রস্ত স্ত্রী, মৃগী আক্রান্ত মেয়ে রাণী, নিজের ঘুমরোগ আর বড় মেয়ে রত্নার বিবাহ-সমস্যায় ও কুলিমানু পূর্বপুরুষদের কীর্তি স্মরণ করে গর্বিত হয়, ফিরে পায় বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় প্রেরণা।

তিন

কুলিমানু চরিত্রের অন্তর্লোকেও লেখক দৃষ্টিপাতের অবকাশ পেয়েছেন। অবদমিত আকাঙ্ক্ষার স্ফুলিঙ্গ ভেতরে ভেতরে বয়ে বেড়ায় সে। রামকানাইয়ের স্ত্রী রূপসী বউদির প্রতি কুলিমানুর আদিম আকর্ষণ খুব স্পষ্ট। ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছে তার; কিন্তু ভরাট বুক আর আকর্ষণীয় শরীরী উন্মাদনা নিয়ে রূপসী বউদি কুলিমানুর স্বপ্নে এসে হানা দেয়। ইশারা-ইঙ্গিতে তাকে আকর্ষণ করে, বলে – ‘ঠেইপঙ আগ ছিবে দিয়াতা’ অর্থাৎ ‘একটা কাঁঠাল পেড়ে দিয়ে যাও’।

কুলিমানু জানায়, এখন সে কাঁঠাল পাবে কোথায়? রূপসী বউদি তখন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে থাকে। কুলিমানু সেই হাসি ও কথার রহস্য উন্মোচন করতে চায়। কিন্তু তার আগেই মশা ও স্ত্রী তপতী এসে স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটায়।

স্ত্রী তপতীর কঙ্কালসার শরীর কুলিমানুকে তৃপ্ত করতে ব্যর্থ হয়। স্নান করতে গিয়ে তপতী অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে সে বিরক্ত হয়। তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয় – ‘গায়ে তো হাড্ডি আর চাম ছাড়া কিছু নেই। আগে পেটে খানিকটা মেদ ছিলো, তার মাঝখানে নাভিটা কুচকুচ করে বেশ একটা ছিলো… দেখলে দুবার তাকাতে ইচ্ছে করতো, এখন পেটটাও সামনে পিছে আলাদা করা যায় না কিছু, বুকের দিকে তাকালে পিঠ দেখা যায়… শরীরের কাঠামোই যখন বলে দিচ্ছে এইটা আর শরীর নেই, শরীরের ভাব ধরে আছে, তখন কী দরকার তাকে ঘষে মেজে চামড়া সুদ্ধা তুলে ফেলার।’ তারপরও সামান্য আনন্দের জন্য এই শরীরটাকেই জাপটে ধরতে হয়। কারণ – জীবন যদি তাদের শরীরের ভেতর বাঘ-সিংহ পুরে বাইরে ইঁদুরের ঘর বানিয়ে রেখে দেয়, তাহলে চলবে কী করে।

চার

কুলিমানু চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তোলার উপযুক্ত ভাষাভঙ্গিও শুভাশিস নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন। উপন্যাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মণিপুরি শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার। পাঠকের সুবিধার্থে তার অনুবাদও লেখক অধিকাংশ ক্ষেত্রে জুড়ে দিয়েছেন। কুলিমানু অন্ত্যজ শ্রেণির জীবন-যন্ত্রণায় যতটা না বিপর্যস্ত, তারচেয়ে বেশি বিস্মিত। লেখক তার যন্ত্রণায় কিছুটা হাস্য-রসাত্মক আবহ তৈরির চেষ্টা করেছেন। কুলিমানু চোখে আধা ঘুম নিয়ে যখন মাঠে যায়, তখন ষাঁড় আর বলদগুলোকে তার ছাগল-কুকুর মনে হয়। একবার চাষ করতে গিয়ে সে হঠাৎ ঘুমে ষাঁড়ের ওপর ঢলে পড়েছিলো। এ-ঘটনার পর স্ত্রী তার সঙ্গে দুই দিন কথা বলেনি। গাঁয়ে তার সম্মানহানিও ঘটেছিল। ছোট মেয়ে রাত্রীর মৃগীরোগে বিরক্ত হয়ে কুলিমানুর ভাবনাও হাস্যরস তৈরি করে, যদিও বাস্তবতা তার বিপরীত – চড়-থাপ্পড় মারলে রোগ যদি দূর হতো তাহলে মেয়েটাকে আচ্ছা করে দু-চারটা থাপ্পড় সে লাগাতই। যেখানে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগানোর নিশ্চয়তা নেই, সেখানে মেয়ের মৃগীরোগে কুলিমানুর ভাবনা আর কী-ই বা হতে পারে।

কুলিমানু বাংলা সাহিত্যে মৌলিক কোনো চরিত্র না হলেও শুভাশিস অভিনব ভঙ্গিতে চরিত্রটি রূপায়িত করেছেন, যা সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। r

 

সাহিত্য-সম্রাটের জীবন ও সাহিত্যের গ্রন্থন

মেহেদী উল্লাহ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

 

ড. খন্দকার শামীম আহমেদ

কথাপ্রকাশ

ঢাকা, ২০১৩

৭০ টাকা

সাহিত্য-সম্রাটখ্যাত বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনীগ্রন্থ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনায় জীবনীকার ড. খন্দকার শামীম আহমেদ বহুবিচিত্র তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন আর গভীর মনোসংযোগে প্রবেশ করেছেন বঙ্কিমমানসে। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন ও সাহিত্যের ষোলোকলা উপস্থাপনই যেন প্রাবন্ধিকের অন্বিষ্ট। অবাক হতে হয়, কতটা পরিকল্পিত উপস্থাপন ক্ষমতা আর বঙ্কিম-পর্যবেক্ষণদৃষ্টির মুনশিয়ানা থাকলে এত স্বল্প পরিসরেও, মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠায়, সমগ্র বঙ্কিমচরিত মানস প্রস্ফুটিত হয়। তাই পাঠক খুব একটা সময় খরচা না করেই পেয়ে যাবেন বঙ্কিমজীবনের পূর্ণাঙ্গ পাঠ।

জীবনীগ্রন্থটি প্রাবন্ধিক সাজিয়েছেন এভাবে – জন্ম ও বংশ পরিচয়, শিক্ষাজীবন, সংসারজীবন, কর্মজীবন, সাহিত্যজীবন, শেষজীবন ও মৃত্যু। সাহিত্যজীবন আবার বিধৃত – কবিতাচর্চা, ইংরেজি উপন্যাস, বাংলা উপন্যাস, ইংরেজি প্রবন্ধ, বাংলা প্রবন্ধগ্রন্থ ও সাময়িকপত্র সম্পাদনা। পরিশিষ্টে স্থান দিয়েছেন একনজরে বঙ্কিমজীবনী ও একনজরে বঙ্কিমগ্রন্থপঞ্জি।

গ্রন্থ-রচনায় জীবনীকারের পরিশ্রমনিষ্ঠ মনোভাব ও তথ্য-সংযোজনের আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। সবচেয়ে বড় কথা, বইটি লিখতে গিয়ে প্রাবন্ধিকের যে-বিস্তর খাটুনি গেছে তা সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকার তালিকা দেখলেই পাঠকমাত্র অনুমান করতে পারবেন। বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে তালিকায় উপস্থিত এমন কয়েকটি মৌলিকগ্রন্থের নাম করা যাক – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের বঙ্কিমজীবনী ও বঙ্কিমসাহিত্য, অরবিন্দ পোদ্দারের বঙ্কিমমানস, ক্ষেত্রগুপ্ত-সম্পাদিত বঙ্কিমচন্দ্র : আধুনিক মন, ভবতোষ দত্তের চিন্তানায়ক বঙ্কিমচন্দ্র, ভবতোষ চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্কিমচন্দ্র : সৃজন ও বীক্ষণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বঙ্কিমচন্দ্র, মনি বাগচির বঙ্কিমচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী, পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্কিমচন্দ্রের বাল্যশিক্ষা, গোপালচন্দ্র রায়ের বঙ্কিমচন্দ্র (জীবন ও সাহিত্য) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া যোগেনচন্দ্র বাগল-সম্পাদিত বঙ্কিম রচনাবলী। এতসব আয়োজন দেখে বোঝা যায়, জীবনীকার নিজেই একজন বঙ্কিমভক্ত ও তাঁর প্রতি কতটা অনুরক্ত!

গ্রন্থের শুরুতে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম ও বংশপরিচয় দিতে গিয়ে বংশলতিকার ছক ব্যবহার করে সুস্পষ্ট করেছেন বঙ্কিমের পূর্বপুরুষের ‘মাথা’ গিয়ে ঠেকেছে গঙ্গানন্দ চট্টোপাধ্যায়ে। বঙ্কিমের বাবা, বাবার বাবা, তাঁর বাবা এভাবে হিসাব করলে তিনি বঙ্কিমবংশের পাঁচ পুরুষের ইতিবৃত্তের প্রথম পুরুষ। এই অংশে বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মা দুর্গাসুন্দরী দেবীর পরিচয়ও জানা যায়। বঙ্কিমের শিক্ষাজীবনের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে প্রাবন্ধিক তাঁর হুগলী কলেজে অধ্যয়নকালের বিবরণ উপস্থাপন করেন। এই অংশে আরো তথ্য পাওয়া যায়, ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৫৩-এর জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। হুগলী কলেজ ও তার অধীন বিদ্যালয়সমূহ থেকে সে-বছর মোট ৭৩ জন ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থান লাভ করেন। এই পরীক্ষায় মোট সাতটি বিষয় ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র ছয়টিতেই সর্বোচ্চ নম্বর পান; অনুবাদ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন। প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্রসহ যে-সাতজন ছাত্র সরকারি বৃত্তি লাভ করেছিলেন তাঁদের প্রাপ্ত নম্বরপত্রের চিত্রও স্পষ্ট করেছেন। এছাড়া আছে পরীক্ষার সিলেবাসের নমুনা। একইভাবে সিনিয়র স্কলারশিপের নম্বরপত্রও সংযোজন করেছেন জীবনীকার। আছে হুগলী কলেজ ছেড়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন নিয়ে পড়ালেখা করতে যাওয়ার বিস্তারিত তথ্যও।

সে কালে অল্প বয়সে বিয়ের রেওয়াজ থাকায় মাত্র দশ বছর আট মাস বয়সে বিয়ে করেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর প্রথম স্ত্রী মোহিনী দেবী। তাঁর বয়স ছিল পাঁচ বছর। কিন্তু তাঁর সঙ্গে বেশিদিন সংসার স্থায়ী হয়নি। এর আগেই মাত্র ষোলো বছর বয়সে জগৎ-সংসার ত্যাগ করেন মোহিনী। সে-সময়ই বঙ্কিমের লেখালেখির সূত্রপাত। এরপর পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের অনুরোধে তিনি পুনরায় বিয়ে করেন রাজলক্ষ্মী দেবীকে। প্রাবন্ধিক এসব তথ্য দেন সংসারজীবন অংশে। এছাড়া আছে মোহিনী ও রাজলক্ষমীর বিস্তারিত পরিচয়।

কর্মজীবন অংশে ছক এঁকে প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন কোথায় কোন পদে চাকরি করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। এছাড়া আছে নিয়োগের তারিখ ও ছুটির বিবরণ। বঙ্কিম ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯১ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন, এমন গুপ্ততথ্যও প্রকাশ করেছেন জীবনীকার।

সাহিত্যজীবন অংশটি বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। প্রাবন্ধিক বঙ্কিমের বিভিন্ন সময়ে রচিত সাহিত্যকর্মে আলো ফেলেছেন এখানে। তথ্য ও বিশ্লেষণী পারঙ্গমতায় উপস্থাপিত হয়েছে সাহিত্যজীবন। শুরুতে প্রাবন্ধিক তথ্য দেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘পদ্য’ – একটি কবিতা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত সাহিত্য-নিদর্শন। আরো তথ্য দেন, সমগ্র জীবনে  মোট ৪২ বছর সাহিত্য-সাধনায় রত ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। কবিতাচর্চা, ইংরেজি উপন্যাস, বাংলা উপন্যাস, প্রবন্ধ-রচনা, সাময়িকপত্র সম্পাদনা প্রভৃতিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তিনি গভীরভাবে। জীবনীকার এই পর্যায়ে সাহিত্যজীবনের আলোচনায় বিভিন্ন ভাগে আলোচনাকে ভাগ করে নিয়েছেন। তিনি তথ্য পরিবেশন করে বুঝিয়ে দেন বঙ্কিমের কবিতাচর্চার আত্মনিবেদনের প্রসঙ্গ। এই অংশে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিরলে বাস’ কবিতাটি কবি উইলিয়াম ড্রামন্ডের একটি কবিতার অনুবাদ। প্রাবন্ধিক দুটি কবিতাই উল্লেখ করেছেন। এছাড়া আছে সংবাদ প্রভাকরসহ বিভিন্ন পত্রিকায় বঙ্কিম যেসব কবিতা লিখেছিলেন তার পরিবেশনা। একটি তালিকায় পত্রিকার নাম, কবিতার নাম, প্রকাশের তারিখসমেত বঙ্কিমের ছাপা হওয়া কবিতাতথ্য দিয়েছেন জীবনীকার। এভাবে জীবনীকার ধারাবাহিকভাবে বঙ্কিমের প্রথম কাব্যগ্রন্থ; ইংরেজি উপন্যাস যেমন – রাজমোহন’স ওয়াইফ; বাংলা উপন্যাস যেমন – দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুন্ডলা, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়, চন্দ্রশেখর, রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ,  দেবীচৌধুরাণী, রাধারাণী, সীতারাম; বিভিন্ন ইংরেজি প্রবন্ধ ও বাংলা প্রবন্ধগ্রন্থ যেমন – লোকরহস্য, বিজ্ঞানরহস্য, কমলাকান্তের দপ্তর, বিবিধ সমালোচনা, সাম্য, মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত, কৃষ্ণচরিত্র, বিবিধ প্রবন্ধ, শ্রীমদ্ভগবদগীতা; সাময়িকপত্র সম্পাদনা নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। এসবে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন রচনাকাল, প্রকাশকাল, প্রকাশস্থান, চরিত্র, প্লট ইত্যাদি প্রসঙ্গকে।

শেষজীবন ও মৃত্যু অংশে বঙ্কিমের জরাগ্রস্ত জীবনেরই পরিচয় প্রদান করেছেন জীবনীকার। বঙ্কিমের ডায়াবেটিস রোগের কথা জানা যায় এ-পর্যায়ে। আরো তথ্য পাওয়া যায়, জরাগ্রস্ত হলেও বঙ্কিম কর্মমুখর ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আর চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পর থেকে মৃত্যু অবধি তিনি বিভিন্ন কাজে মুখর ছিলেন। এ-সময়ের মধ্যে তিনি যেসব নতুন সংস্করণরূপে গ্রন্থ বের করেন আছে তারও পরিচয়। এছাড়া, জীবনের শেষবেলাতেও নব্য সম্পাদকদের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের একটি লেখাপ্রাপ্তি বিশেষ আরাধ্য বস্ত্ত ছিল। সমকালে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ আর অবধারিত হয়ে ওঠেন বঙ্কিমচন্দ্র। অবশেষে ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ এপ্রিল বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন। এই তথ্য দিয়ে বঙ্কিমজীবনের ইতি টানেন জীবনীকার। আর পাঠকের মনে হতে থাকবে, গ্রন্থটি পাঠ করে এই মৃত্যুসংবাদ পর্যন্ত এসে নিজের  মন-মানসে বঙ্কিম বুঝি আবার জীবিত হয়ে উঠলেন। মূলত বঙ্কিমচন্দ্রকে পাঠকের মনে জাগ্রত রাখতেই যেন ড. খন্দকার শামীম আহমেদের এই আয়োজন। এভাবেই বঙ্কিমচরিতকে অমৃত করে তুলেছেন তিনি।