বংশীধরের বিপদ

বংশীধর থানায় যতই ডাকসাইটে সিংহমার্কা দারোগা হোক বাড়িতে কিন্তু মিউমিউ মিনি বেড়াল। ঠাকুরঘরে চটি পরে ঢুকলে, কোনোদিন ছোট মাছ না খেতে চাইলে, করলাসেদ্ধ থালার তলায় রেখে দিলে, বা ঠাকুর নমস্কার না করে বাড়ি থেকে বেরোলে, কদিন আগেও দু-চারটে কানমলা, চাঁটি, হাতপাখার ধপাধপ পড়তই। কুচুটে লোকে বলে, কিছুদিন আগেও বংশীধরকে বারান্দায় এক পায়ে বা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে, সেটা যোগব্যায়াম না শাস্তি কেউ জানে না। দুর্জনে বলে, সন্ধেবেলা আবছায়ায় দেখেছে কেউ নাকি নিলডাউন হয়ে বারান্দায়। ঠিক এই কারণেই থানার কাছে কখনো বাড়ি নেননি। থানার লোকজন, চোর-বদমাশ দেখলে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা মুশকিল হতো। দু-চারবার পছন্দ না হলে হাত কচলে, মাথা চুলকে কিছু বলার চেষ্টা করে দেখেছেন কোনো ট্যাঁ-ফোঁ চলবে না, বাড়িতে মায়ের কথাই শেষ কথা। মা সর্বসময় একই কথা – ‘আমি না থাকলে ঠ্যালা বুঝবি। সংসার খুব কঠিন জায়গা খোকা, প্রতি পদে বিপদ। শক্ত হাতে ধরে রাখতে হয়।’
তবে আসতে-যেতে বংশীধরের মায়ের সুরেলা, মিঠে গানের গলা শোনা যেত রাস্তা থেকে। খাসা গলা, ভর সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার সময় গানের সুরে মোহিত হয়ে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া আসেত্ম হয়ে যেত অনেকের। মা-ছেলের সংসার দিবিব চলছিল, হঠাৎ গোল পাকাল যখন দুদিনের জ্বরে মা চলে গেলেন বংশীধরকে পথে বসিয়ে। কদিন হা-হুতাশ করে কাটানোর পরে একবার ভাবলেন দারোগাগিরি ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে চলে যাবেন, কিন্তু বন্ধুরা বাধা দিলো। আজকাল নাকি আর সেই দিন নেই যে পছন্দমতো গুহা দেখে বসে পড়া যাবে। ভীষণ ভিড়, গুহা কোনো খালিই পাওয়া যায় না, তার ওপর ফলমূলও তেমন মেলে না। ঢিল ছুড়ে ছুড়ে ফল পেড়ে খেতে হয়। তার চেয়ে থানাই ভালো; একজন ভালো কাজের লোক দেখে নিলেই হবে। থানায় ডিউটিতে জয়েন করেছেন, কিন্তু মন মাঝে মাঝেই পথহারা হচ্ছে। কী যে হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারছেন না। কী যে হচ্ছে তিনি নিজে বুঝতেই পারছেন না। মা চলে যাওয়ার পর তাঁর স্মৃতি হঠাৎ হঠাৎ করে কাজে-অকাজে চলে এসে ওনার প্রেস্টিজ একেবারে হালুয়া করে দিচ্ছে। ঝুনঝুনি গ্রামে বংশীধরের প্রবল প্রতাপে বাঘে-মানুষে কাঁপতে কাঁপতে হাপুস-হুপুস করে এক ঘাটে জল খেত সকাল-বিকেল, সেখানে মাঝে মাঝেই তাল কেটে যাচ্ছে। আগে ভাবটা ছিল এমন যে, ‘মাকে ছোড়কে কোই নেই ডরনে কে লিয়ে।’ আর এখন মায়ের স্মৃতিই ভয়ের কারণ হয়ে তাড়া করে ফিরছে। মা চলে যাওয়ার পর ঘরে টেকাটাই মুশকিল। মায়ের অস্তিত্ব সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তার সঙ্গে প্রিয় হারমোনিয়াম। সবসময় কানে বাজে মায়ের গাওয়া গানের সুর। আহা! আহা! মন যেন জুড়িয়ে যেত। আর এইটাই কাল হয়েছে। মা যে কীভাবে লেজেগোবরে করে দিচ্ছেন সে তো হাতেনাতে প্রায়ই দেখতে পাচ্ছেন। এই সেদিন সন্ধেয় বাজারে যাত্রার মাঝে হাতেনাতে ধরেছেন এক পকেটমারকে, হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন বুক ফুলিয়ে। সবে বাজারের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন, আর তখনি বিনোদিনী দাসী গান ধরেছে স্টেজে –
আমি ভবে একা, দাও হে দেখা,
প্রাণসখা রাখো পায়,
হরি মন মজায়ে লুকালে কথা।
আসলে এই গানটার জন্যই দাঁড়িয়েছিলেন যেতে যেতে। কী গান, আর কী সে-সুর! শুনতে শুনতে বংশীধরের প্রাণ হুহু করে উঠল। তাই তো! তিনি তো একাই এখন সংসারে। এসব কী করছেন? হায় হায়, শুধু শুধু সময় চলে যাচ্ছে। এসব বাজে কাজ ফেলে সবে প্রভুর পায়ে কীভাবে নিজেকে সমর্পণ করবেন ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছেন। অমনি হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল পকেটমার, ব্যাটা বোধহয় ভেবেছিল দেখি একটা চান্স নিয়ে। এমন সময় পাশের কনস্টেবলটা একটু পিছিয়ে এসে ধরেই ফ্যালে, বলে – ‘স্যার চলুন, দাঁড়াবেন না, এখানে দাঁড়ালে এদের দলবলও চলে আসতে পারে।’ ছলছল চোখে সম্বিত ফিরে পেয়ে লাঠি মাটিতে ঠুকে গটমট করে থানার পথ ধরেন, কিছুটা লজ্জা পেয়ে পকেটমারের ওপর রাগটা চড়ে যায়। ‘চল তোর আঙুলগুলো সোজা করি, পকেট মারা তো ছার, বাকি জীবনটা তোকে খাইয়ে দিতে যদি না হয় আমার নামে কুকুর পুষিশ।’
আর নিত্যহরির ব্যাপারটা একটা বিশ্রী লজ্জাজনক কেস। থানায় বসে ক্যামেরা রেকর্ডিংয়ে নিত্যহরিকে পরিষ্কার দেখা গেছে শাবল দিয়ে দোকানের তালা ভাঙছে। শাটার তুলে বাজারের দোকানে ঢুকছে এক সাগরেদ নিয়ে। নিত্যহরির নিত্যচুরির ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করতে বাড়িতে সাতসকালে হানা দিয়েছেন। পুলিশ দেখে বাড়ির লোকজন সন্ত্রস্ত। নিত্যহরির মা-বাবা-ভাইয়ের অনেক কাকুতি-মিনতি কিছুই টিকল না। আজ ব্যাটাকে গরাদের ওপারে না পাঠালেই নয়। উঠোনে দাঁড়িয়ে বাজখাঁই গলায় হাঁক পাড়েন বংশীধর – ‘বেরো নিত্য। আমার মাথা গরম হবার আগে বেরিয়ে আয়। ব্যাটা ছুঁচো, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। তুই না বেরোলে আমি কিন্তু দরজা ভাঙব।’
কে যেন ফুট কাটে – ‘ভিতরের ঘরে গান শুনছে দাদা।’
পাড়া-কাঁপানো হুংকার ছাড়েন বংশীধর – ‘এই সাতসকালে গান শুনছে? চালাকি হচ্ছে? গান বার করছি। শালা চোর ছিলি, এখন ডাকাতিতে নাম লেখানো হয়েছে?’ ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘গান তো এবার আমি গাইব। তোরা সবাই শুনবি। শুনবি আর কাঁদবি।’ ভাইকেই দাবড়ান, ‘ডাক, ডাক আমার মটকা গরম করিস না।’ শেষমেশ নিত্যহরির উদ্দেশে বলেন, ‘আয় আয়, চলে আয়। আমাকে আর দরজা ভাঙতে বলিস না।’ শেষমেশ বংশীধর উঠে পড়েন দাওয়ায়।
হালকা গুনগুন সুর একটা ভেসেই আসছিল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই গানের সুর ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। নিত্যহরি খাটে বসে। চোখ বুজে গান শুনছে ও গাইছে গলা ছেড়ে – ‘মন চল নিজ নিকেতনে/ সংসার ও বিদেশে, বিদেশির বেশে ভ্রম কেন অকারণে …।’
খানিক দাঁড়িয়ে প্রথম মনে হলো, এটা কে? এটাই কি আমাদের নিত্যহরি? হায় হায় কাকে তিনি ধরতে এসেছেন? দাঁড়িয়েই পড়লেন। আহা গানটির সুর ভারি সুন্দর। গলাটিও বেশ মিঠে। কোথায় যেন শুনেছেন? কোথায় যেন শুনেছেন? মনে পড়েছে – এ তো সেই গান। তাই কেমন অবশ ভাব লাগছে। মা কি গাইত গানটা। চোখ বুজলে মনে হতো স্বামীজি নিজেই গাইছেন। প্রথম বুক ভার পরে গলা ভার। এই খাকি প্যান্ট-জামা-টুপি বেশ তো বিদেশিরই বটে। এসব কী করছেন এখানে? কবে এসব থেকে মুক্তি হবে? পাঁজর মুচড়ে গলা ধরে চোখে খানিক জল এসেও গেল। শেষ পর্যন্ত টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন গানের শেষ অবধি। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে একদম লেজেগোবরে মাখামাখি অবস্থা হতো। দরজা থেকেই চলে এসেছিলেন বংশীধর। ভাগ্যিস থানার কেউ দেখেনি, তাহলেই চিত্তির হতো। নিত্যহরিও জানতে পারেনি। কিন্তু কী করে যেন বংশীধরের দুর্বলতা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরে চোর-ছ্যাঁচড় মহলে। ঠিক করে ফেলেন আর কোনো ধর্মীয় সভা, যাত্রার কোনো অনুমতি দেবেন না। এমনকি পালা-কীর্তন অবধি বন্ধ। তাতেও গ্রামের ভক্তিভাব এড়ানো গেল না।

কেলেঙ্কারিটা শেষে থানাতেই ঘটল, একদম সবার সামনে। গঙ্গাধর ডাকাতকে ধরে থানার গরাদে পুরেছেন। বাকি স্যাঙাতদের খবর বার করার জন্য সবে দরজা খুলে সেলের সামনে দাঁড়িয়েছেন একটু পেড়ে ফেলে গামছাকাচা করতে। বংশীধর গঙ্গাধরের সেলে ঢোকার পর থানার কনস্টেবলরা তটস্থ হয়ে ওঠে – আজ গঙ্গাধরের গঙ্গাপ্রাপ্তি আর কে আটকায়? কোণঠাসা হয়ে ইষ্টনাম জপতে থাকে গঙ্গাধর চোখ বুজে, আর ঠিক তখনই থানার এক সেপাইয়ের টেবিলের সামনে রাখা রেডিওতে ৯২.৭ এফএমে বেজে উঠল –
দোষ কারো নয় গো মা
আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা … \
আবার সেই মায়ের গাওয়া গান। এ যেন পস্ন্যান করে ডোবানো। কেমন অবশ হয়ে এলো শরীর। মায়ের বড় প্রিয় ছিল গানটা। মায়ের স্মৃতি আবার বিপদ ডেকে আনে। দাঁড়িয়ে পড়েন বংশীধর, গানের সুরে শরীর অবশ হয়ে আসে। বংশীধরকে দেখে গঙ্গাধরও থতমত। দারোগা হবে হাবেভাবে সিংহ। চলাফেরায় হবে রাজার ভাব। এক হুংকার প্যান্ট হলুদ করে দেবে। আর এ কী উদাস ভাব! এ তো সন্ন্যাস ভাব! একটু পরে দারোগার ভক্তিরস পাগলপারা ভাব দেখে শেষে সাহস করে চোখে চোখ রেখে বলেই ফেলে গঙ্গাধর – ‘স্যার, আপনার কি শরীর ঠিক আছে? মারবেন না? খারাপ লাগছে?’
সম্বিত ফিরে পেয়ে রুল নামিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে যান বংশীধর। গঙ্গাধরের সে-যাত্রা আর গঙ্গাযাত্রা হয় না। বংশীধর সেদিনই ঠিক করে ফেলেন এখানে আর নয়। এখানে মায়ের স্মৃতি সব জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, তাই পদে পদে সেই স্মৃতি বারবার বিপদ ডেকে আনছে। পরদিনই ট্রান্সফারের আপিল করবেন।

দুই
হৃদয়পুর গ্রামটা এমনিতে বেশ শান্ত। কেউ কক্ষনো বলতে পারবে না, এখানে দু-চারটে ছিঁচকে চোর ছাড়া বড় কোনো ডাকাতি হয়েছে ইদানীংকালে। বংশীধর আগেই খবর নিয়েছেন। ওটা কোনো ব্যাপার নয়। গ্রাম থাকলে দু-চারটে চোর থাকবেই। আর চোর ধরার ব্যাপারে তার ব্যাপক হাতযশ। হৃদয়পুর নাম শোনা থেকে তিনি আসার জন্যে মুখিয়ে আছেন। নামটাও বেশ হৃদয়ের কাছাকাছি। একটু শামিত্মতে কাটবে এখানে। কাল বাদ দিয়ে পরশু জয়েন করবেন। নিজের বাক্স, বিছানা, খাট-আলমারি নিয়ে আসার সময় হৃদয়পুর থানার হেড কনস্টেবল দ্বারিকবাবু বারবার আয়না দিয়ে বংশীধরকে দেখছেন। দেখে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘কী দেখেছেন বলুন তো? আমাকে চেনেন নাকি?’
দ্বারিকবাবু বলেন, ‘স্যার আপনার সঙ্গে এ-গ্রামের কার যেন খুব মিল আছে, কিন্তু বুঝতে পারছি না।’
গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা পথ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, চাঁদিফাটা গরমেও বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে হৃদয় জুড়িয়ে উদাস হয়ে গেল – বুঝদার গাম্ভীর্য এনে বলেন, ‘হয় হয়। বুঝলে, অনেকে বলে সবারই নাকি ডুপিস্নকেট হয় সংসারে, কোনো কোনো সময় শোনা যায় একই রকম তিন-চারজন মানুষ নানা দেশে ছড়িয়ে থাকে।’ দ্বারিকবাবু চুপ করে যান। প্রথমদিন হৃদয়পুরকে ভালোভাবে দেখেশুনে নিতে হবে, তাই বংশীধর ঠিক করেন আজ সম্রাট আকবরের মতো পরিচয় বিনা গ্রাম ঘুরে দেখবেন। তবেই তো মানুষজনকে জানা যাবে, তাদের প্রয়োজন বোঝা যাবে। নিজের বুদ্ধিকে নিজেই তারিফ করে বিকেলে রাস্তায় নেমে পড়লেন।
সরু সরু মেঠো রাস্তা, প্রচুর খালবিল গাছগাছালিতে ভর্তি। আশপাশে দেখা যাচ্ছে প্রচুর ধানক্ষেত। প্রথমদিন রাস্তায় নেমে বিশেষ লোকজনও রাস্তায় দেখতে পান না। কিন্তু গ্রামটাকে বেশ ভালোই লেগে গেল। বেশ চেনা চেনা। বুকভরে নিশ্বাস নিলেন বংশীধর, এবার আর দিনভর চোর-ডাকাত পিটিয়ে কাটাতে হবে না। তবে এবার ঠিক করে নিয়েছেন প্রথম থেকে শক্ত হতে হবে। ধর্মীয় কোনো যাত্রাপালা নয়, গানের আসরও বেছে বেছে। কত গান আছে, বাউল আছে, রবীন্দ্রসংগীত আছে, কালোয়াতিও চলবে, প্রাণ খুলে এগুলো গা, কিন্তু স্বদেশি গান, শ্যামা সংগীত, কীর্তন এসব চলবে না। যে করে হোক রুখবেন। আর তাহলেই কেল্লাফতে, হৃদয়পুরের হৃদয় তিনি জয় করবেনই। হঠাৎ করে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল এই ভেবে যে, হৃদয়পুর জানেই না তার নিজের হৃদয়পুরের দুর্বলতাটা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখে ‘ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, সামনে উতলা ধরণী-তল’ আবৃত্তি করতে করতে রাস্তায় চলেছেন। কিছুদূর আসতে আসতে রাস্তায় লাঠি হাতে এক কুঁজো বুড়ির সঙ্গে দেখা। টুকটুক করে রাস্তা পার হচ্ছিল, কাছে এসে চোখ-মুখ কুঁচকে বংশীধরকে আগাপাশতলা দেখে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে – ‘কত কিছু দেখাবি তুই! এত জামাকাপড় কোথা থেকে হাতালি?’
‘দিদিমা আপনি আমাকে চেনেন?’ – খানিক অবাক হয় বংশীধর।

  • ‘ও বাবা, তোকে চিনব না তা কী হয়? তোকে তো চিনে রাখতেই হবে। তবে এমন বেশে তো আগে দেখিনি তোকে।’ বুড়ি আর দাঁড়ায় না। বলতে বলতে যায়, ‘যাই দেখি বাইরের দাওয়ায় কী কী পড়ে আছে।’
    বংশীধর দাঁড়িয়ে পড়েন। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। এই সন্ধের মুখে রাস্তায় আলো কম, অন্য কারুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে বুড়ি – এই ভেবে সামনে পা বাড়ান। পুকুর আর রাস্তার মাঝে কিছু না জানিয়েই গাছ থেকে চড়াইয়ের মল জামায় এসে পড়ে। জামার হাতাটা এক নিমেষে হলুদ হয়ে যায়। জামাটা খুলে ঘাটে রেখে হাত ধুয়ে আঁজলা ভরে জল এনে হতভম্ব হয়ে যান। গেল কই জামাটা? এদিক-ওদিক কাউকেই দেখা যায় না। একটু এগিয়ে দেখেন দূরে একটা মানুষ জামা হাতে রাস্তায় বাঁক নিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ‘অ্যাই! অ্যাই!’ করতে করতে পড়ি কি মরি করে দৌড় লাগান। চিৎকার করেন – ‘দে দে ব্যাটা জামা দে। সাহস বলিহারি!’ কিছুটা এগিয়ে আর খুঁজে পান না। আচমকা আতিপাতি করে দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে
    হাতে-পায়ে মাটি লাগে। চুল উস্কখুস্ক হয়ে যায়, গেঞ্জি পরা শরীর ঘেমে-নেয়ে একশা হয়। মনে মনে পাজি, ছুঁচো, উজবুক নানা গালি দিতে থাকেন। ক্লান্ত বংশীধর রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ান। তাকে দেখে দোকানমালিক রাধু বিরক্ত হয় – ‘দেখছিস ভরসন্ধেতে ধুপধুনো দিছি আর এখুনি এসে দাঁড়ালি অপোগ-? কোনো কি কা-জ্ঞান হবে না আর? যা যা পরে আসিস।’
    বংশীধর আবারো অবাক হয়। এও চেনে? কিন্তু কী করে? এই গ্রামে তো সে কখনো আসেইনি। যদিও গ্রামটা চেনা চেনা লাগে। ব্যাপারটা বুঝতে হচ্ছে। বেশ রহস্যের গন্ধ পান।
  • চা হবে দাদা?
    রাধু মুখ বেঁকায় – ‘বাবা, কী হলো রে তোর! দাদা বলছিস? পয়সা দিবি?’
  • ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ দেবো।’ বংশীধর নরম স্বরে উত্তর দেয়।
    ‘তোকে কিছু বিশ্বাস নেই। ঘাড় ঘোরালেই পয়সা না দিয়ে পালাতে পারিস।’ কেটলিতে জল বসিয়ে ধুনো দিতে দিতে রাধু বলে – ‘খুব দাঁও মেরেছিস মনে হচ্ছে? তা কার কপাল পুড়ল রে?’
    লজ্জার ভাব দেখিয়ে বংশীধর রাস্তার দিকে চেয়ে বলেন, ‘না না তেমন কিছু না।’ বংশীধর ভাবেন, ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হবে কাল থানায় জয়েন করে। চা করতে করতে রাধু বলে, ‘কী রে, ছেড়ে দিলি নাকি তোর লাইন? এই ভরসন্ধেতে দোকানে বসে চা খাচ্ছিস? এভাবে আর কতদিন চলবে রে? নিজের ঘরের থেকে শ্রীঘরেই তো তোর দিন কাটে বেশি। ছেড়ে দে ছেড়ে দে। বয়েসও তো হচ্ছে।’ বসার টেবিলে চায়ের ভারটা রেখে উঠে রাস্তায় নামে বংশীধর। রাধু ঝাঁটা হাতে উঠান ঝাড় দিতে দিতে বলে, ‘বেশ গম্ভীর ভাব এনেছিস দেখছি। দিনের বেলা তো বেশ আছিস; কিন্তু রাত্রি হলে তোর যে কী হয় কে জানে।’
    একটু এগোতেই – ‘আরে! আরে! লেগে যাবে তো। চোখের মাথা খেয়েচ নাকি? একটু দেখে চলো।’ গলির মোড় ঘুরতেই লোকটার সঙ্গে ভুঁড়িতে ভুঁড়িতে ধাক্কা লাগে লাগে।
    লোকটাও ট্যারাবাঁকা, খেঁকিয়ে ওঠে – ‘আপনিও তো কিছু কম নয়।’ এবার মুখের দিকে তাকিয়ে বংশীধর তাজ্জব, মনে হয় কেউ একটা আয়না সামনে রেখে গেছে। শুধু প্রতিবিম্বের গায়ে তারই জামা। আর নিজের গায়ে গেঞ্জি, –
    ‘অ্যাই কে তুই?’ নিজের থতমত ভাব লুকোতে হাঁক পাড়েন বংশীধর।
    লোকটারও ভ্যাবলা কার্তিক অবস্থা। এত মিল? একই রকম দেখতে সামনে দাঁড়িয়ে আরেকজন বলে, ‘আজ্ঞে আমি পাঁচু।’
    বংশীধর আগাপাশতলা মেলাতে গিয়ে অবাক। ভুঁড়িটাও প্রায় একই রকম। গালের আঁচিল, তাও। শুধু মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। চোখটা কোটরে ঢুকে গেছে। হাতে জামা, নিচে আধময়লা ধুতি। ধরা পড়ার ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।
    চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করেন – ‘ওটা কী?’
    পাঁচু বলে, ‘কী আর? শার্ট।’
  • নিচে ওটা?
    হাস্যরস আছে বলতে হবে, মাথা চুলকে হেসে বলে, ‘ওটা শুনেছি বাবারও ছিল।’
    হেসে বংশীধর বলে, ‘ভুঁড়িওয়ালা চোর আমি আগে দেখিনি।’
    ‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! কী যে বলেন।’ আসেত্ম করে বংশীধরের নোয়াপাতির দিকে আঙুল দেখায়।
    এবার কঠিন স্বরে বলেন – ‘জামা দে।’
  • এটা আমার জামা।
  • জামাটা তোর?
    গর্জে ওঠেন বংশীধর, ‘ব্যাটা চোর। আমার জামা চুরি করে এখন বলছিস তোর?’ প্রায় মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছিল, ‘আমি কে জানিস?’ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলেন, ‘দিবি কিনা বল?’
    পাঁচু এদিক-ওদিক চেয়ে পালাবার পথ খোঁজে। এই ফাঁকে পাঁচুকে ধরে ফেলে এক জুজুৎসু প্যাঁচে চিৎপাত করে মাটিতে ফেলেন বংশীধর। তারপর সেই নিজের আবিষ্কৃত নরম ধোলাইটা প্রয়োগ করেন। কাতুকুতুতে যখন মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে পাঁচু, তখন অনায়াসে জামাটা খুলে নেন। মাটিতে পড়ে হাসতে হাসতে পাঁচু চিৎকার করে, ‘এটা ভালো হলো না, ভালো হচ্ছে না কিন্তু।’ কিন্তু জামা ততক্ষণে বংশীধরের হাতে।
  • ব্যাটা চোর। তুই আমার জামা চুরি করেছিস? যা যা আজ প্রথম দিন বলে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু যদি শুনেছি তুই আর কোথাও দাঁও মেরেছিস তাহলে এ তো কিছুই নয়, তোকে ধরে বেঁধে বিছুটি পাতা ঘসে দেবো সারাশরীরে। সারাজীবন জেলের ঘানি টেনে টেনে তোর আঙুল বেঁকে যাবে, হাত খুলে আসবে।
    ধুলো ঝেড়ে পাঁচু উঠে পড়ে। কঠিন দৃষ্টিতে বংশীধরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। বাটপাড়ি করে বাঁচবি তুই? দ্যাখ তাহলে’ – বলে সুরুত করে মাথা নিচু করে সরে যায় তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে ‘চোর চোর, ধর, ধর’ বলতে বলতে। বংশীধর থতমত খেয়ে যান। হলো কী ব্যাপারটা? ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতে আশেপাশের বাড়ি থেকে হুড়মুড় করে কাকা, পিসে, খুড়ো এক-এক করে চড়াও হয়। কিছু বলতে দেওয়ার আগেই অনেকগুলো হাতের চড়-থাপ্পড় পিঠে, মাথায়, হাতে পড়তে থাকে, কেউ কেউ আবার বলতে থাকে, ‘অনেক জ্বালিয়েছে, আজ মেরেই ফ্যাল পাঁচুকে।’ বংশীধর কোনোরকমে উবু হয়ে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে যুঝতে থাকেন। হাটুরে মারের কোনো আগল নেই। যে যার হাতের সুখ করতে থাকে। কেউ বলে ওঠে – ‘এই তো আমার হারিয়ে যাওয়া জামা কদিন তাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না’, এই বলে ভিড়ের মধ্যে জামাটা কেউ সুরুত করে টেনে নেয়। প্রথম চোট কেটে যাওয়ার পর কিছু জ্ঞানবৃদ্ধ মানুষের সহায়তায় উঠে দাঁড়ান বংশীধর। তাকে দেখে এগিয়ে আসে থানার দ্বারিকবাবু, ‘স্যার এ কী হাল হয়েছে আপনার?’ ব্যথায় কিছুই বলতে পারেন না। দ্বারিকবাবু এদিক-সেদিক বলে, থানায় নিয়ে যাচ্ছি বলে সরিয়ে নিয়ে আসে। বংশীধর বেঁচে যান সে-যাত্রা। দ্বারিকবাবু কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এখানে কী করে স্যার আপনি? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। কী হয়েছিল একটু বলবেন।’ বংশীধর চুপ দেখে বলে, ‘চলুন চলুন আগে হাসপাতালে যাই।’
  • দরকার হবে না। চলুন থানার দিকে যাই।
    মুখটা মারের চোটে কেমন ফুলে লাল কালো চকরা-বকরা হয়ে গেছে। হাত-পা ভালো করে নাড়াতে পারছেন না। আঙুলগুলো ব্যথায় নীল হয়ে গেছে। অবসাদ আর অপমান মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে গেছে। দ্বারিকবাবু পেছন পেছন বারবার বলতে বলতে আসছেন – ‘এটা কী হলো বলুন তো? স্যার আপনি কেন নিজের পরিচয় দিলেন না? তাহলেই তো আর কোনো সমস্যা হতো না। ছি, ছি, প্রথম দিন হৃদয়পুরে আপনার কী বিশ্রী কা- ঘটল।’ বংশীধর চুপ। বলতে পারছেন না তিনি সম্রাট আকবর হতে গেছিলেন।
    হাঁটতে হাঁটতে বারবার থামতে হচ্ছে। উপায় নেই, পা টেনে টেনে হাঁটতে হচ্ছে। রাস্তার ধারে একটা বড় মাঠ। সেখানে দাঁড়িয়ে বংশীধর জিজ্ঞেস করেন – ‘এটা কি তোমাদের খেলার মাঠ?’
  • না স্যার, এটা হৃদয়পুরের মেলার মাঠ।
    আবার বুকে হাতুড়ির আঘাত। ‘কী বললে?’ আর্তচিৎকার করে ওঠেন সব ব্যথা ভুলে।
    অবাক হয়ে যায় দ্বারিকবাবু, ‘হ্যাঁ স্যার, হৃদয়পুরের মেলার মাঠ। কী হলো আবার আপনার?’
    হাউমাউ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। এবার কী হবে আমার? কী কুক্ষণে এখানে এসে পড়লাম। মনে পড়ে গেছে, মা বলেছিলেন, ছোটবেলায় হৃদয়পুরের মেলার মাঠেই যমজ ভাই হারিয়ে গিয়েছিল। মেলার ভিড়ে কেউ হয়তো চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক খুঁজেও তখন তাকে পাওয়া যায়নি। পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকেন বংশীধর – ‘আমার খুব বিপদ দ্বারিকবাবু। ভীষণ বিপদ! কে বাঁচাবে আমাকে?’
    আফসোস হতে থাকে, কেন মায়ের এই কথাটা মনে পড়ে গেল? এখন কী হবে? চোখ দিয়ে দু-চার ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ে। আধা অন্ধকার গ্রামের রাস্তায় দ্বারিকবাবু সরলমনে সান্তবনা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকে, ‘স্যার এখানে কোনো বিপদই নেই। আপনি একদম চিমত্মা করবেন না, কিছু হলে তো আমরা আছি। চোর-ডাকাত তো তেমন কিছুই নেই। আপনি হাতের সুখ করবেন যে তেমন ছিঁচকেও চোখে পড়ে না।’ বংশীধর তো কাউকেই বলতে পারবেন না ভীষণ বিপদটা কী। আর তাকে সামলাবেনই বা কী করে। সারা পুলিশ জীবনে এমন বিপদে কেউ পড়েছে বলেও শোনেননি। কাঁদো কাঁদো স্বরে বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘ওরে পাগলা তোদের কী করে বোঝাই, কোথায় মা আমাকে কী বিপদে ফেলে গেছেন। এখন হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদা ছাড়া আর কিছু করার নেই।’