বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশ এই ভুবনের একমাত্র দেশ, যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আর তার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে যেখানে আমরা বাংলায় কথা বলি তাদের এক ঋণ হয়ে আছে তাঁর কাছে। তাঁর জন্মশতবর্ষ সেই ঋণ স্বীকারের এক সুসময়। সেইসঙ্গে, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে যে-লক্ষকোটি পূর্ববঙ্গবাসী বাঙালি রক্ত দিয়ে তাঁদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন এবং বাংলা ভাষাকে সার্বভৌম করে তুলেছেন, ঋণ আমাদের তাঁদের কাছেও। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ সেই ঋণ স্বীকারেরও এক সুসময়। একাত্তর আমাদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তার অনেক দলিল আছে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার যেমন বিবরণ, দিনলিপি, জবানবন্দি, সালতামামি, তেমনি উদ্গত সত্যসন্ধান, উপগত কল্পরূপ। এমনি এক দলিল সদ্য শতবর্ষ-অতিক্রান্ত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রিপোর্টাজ ক্ষমা নেই। একাত্তরের ডিসেম্বরে তিনি যশোর-খুলনার কোনো কোনো অঞ্চলে গিয়েছিলেন। শত্রুসেনা ও তাদের সাগরেদদের নৃশংসতা-বর্বরতা, নরমেধযজ্ঞ, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রমাণও পান। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর সাহসিকতা ও মানবিকতারও তিনি সাক্ষী হয়ে ওঠেন। তাঁর এই রিপোর্টাজের শেষ কিস্তি থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করতে চাই :

প্রিয় অপু আর তপু,

আজ নয়, পরে বড় হয়ে কোনো একদিন এ চিঠি তোমরা পড়বে – সেই আশায় লিখছি।

যে বয়সে তোমরা কলকাতায় এসেছিলে তখনকার দেখা দিনগুলোর কথা বড় হয়ে কি তোমাদের মনে থাকবে? হয়ত মনে নাও থাকতে পারে। কিংবা হয়ত থাকবে। …

কত কা- করে মা-র সঙ্গে তোমরা কলকাতায় এলে। এ তো আর ঢাকা থেকে গাড়িতে বা প্লেনে হুস করে কলকাতায় আসা নয়। তোমাদের পালাতে হয়েছিল দেশের শত্রুদের চোখে ধুলো দিয়ে – বনজঙ্গল ভেঙে নদনদী পেরিয়ে। অতশত না বুঝলেও পরে হয়ত একটা গা-ছমছমে ভয় আর পথের কষ্টের স্মৃতি মনে পড়তে পারে। সঙ্গে আব্বা ছিল না।

আব্বা তো তখন কলকাতায়। তোমাদের পথ চেয়ে আশায় আশায় ভয়ে কাঁটা হয়ে জহির দিন গুনছিল। …

তারপর তো তোমরা এলে। প্রিন্স আনোয়ার শা রোডের একতলার ঘর ছেড়ে তোমাদের জন্যে জহির লেক গার্ডেনে তিনতলায় খোলামেলা একটা ফ্ল্যাট নিল। …

আব্বাকে তোমরা কতক্ষণই বা বাড়িতে পেতে? … বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী লেখক শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সে ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং সবচেয়ে কাছের মানুষ। তাদের যাবতীয় মুশকিলের আশান তাকেই করতে হত। …

একটা বছর বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে কী ঝড় গেছে, সে সব তোমরা বড় হয়ে বুড়োদের কাছে শুনবে কিংবা ইতিহাসের বইতে পড়বে। সেইসঙ্গে একটা ছবি দেখো। ছবিটি পাবে পুরনো চলচ্চিত্রের মহাফেজখানায়। নাম ‘স্টপ জেনোসাইড’- ‘গণহত্যা বন্ধ করো’।

এ ছবি তুলেছিল জহির রায়হান। তোমাদের আব্বা। এ ছবি দেখে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। তোমাদের কী মনে হবে জানি না। তাতে হানাদারবিধ্বস্ত শৃঙ্খলিত সেই বাংলাদেশকে পাবে, যার সঙ্গে তোমাদের আমলের বাংলাদেশের কোনো মিল নেই। এ ছবি জহির তোমাদের জন্যে তুলে রেখে গেছে যাতে তোমরা হুঁশিয়ার হও – যাতে কখনও কোনদিক থেকে বাংলাদেশের এই হাল আর না হয়।

অপু-তপু, আব্বা তোমাদের জন্যে কী রেখে গেছেন সেটা আজ না জানলেও কাল তা জানতে পারবে। সাত রাজার ধন এক মানিকের চেয়েও তা বড়। তোমাদের হাতে জহির দিয়ে গেছে স্বাধীনতা আর সমাজতন্ত্রের জয়পতাকা। তোমরা তাকে চোখের মণির মত রক্ষা ক’রো।

জহির রায়হান ঢাকা ফিরে গিয়ে তাঁর দাদা শহীদুল্লা কায়সারের মতোই ‘নিখোঁজ’ হয়ে গিয়েছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ‘দাদার খোঁজে ভাই’কে নিয়ে যে-ছবি করতে বলেছিলেন তা আর করা হয়ে ওঠেনি।

একাত্তরের সূত্রপাত, আমরা জানি, ১৯৪৮-এই যখন নবগঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে উর্দুর পাশাপাশি বৃহত্তর জনসংখ্যার ভাষা হিসেবে বাংলার দাবি তোলেন কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সেই দাবি নিয়ে যে-দীর্ঘ লড়াই শুরু হয় তার, এবং তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্ভিন্ন নেতৃত্বের ইতিহাসও আমরা জানি। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই লড়াইয়ের দিনানুদিন বিবরণও আমরা পড়েছি। যেমন ভাষার অধিকার, তেমনি পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনও। বাহান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি যখন মাতৃভাষার জন্য প্রথম রক্ত দিলো বাঙালি তখন তিনি জেলে। কতবার যে তিনি জেলে গেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কখনো কখনো ছাড়া পেয়ে আবার জেলগেটেই ধরা পড়েছেন, তথাকথিত নিরাপত্তা আইনে। একবার তো জেলে অনশন করে তিনি মরণাপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর দেশপ্রেম যে কত খাঁটি ছিল তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাই তার প্রমাণ। ‘বন্দিদের মুক্তি চাই’-এর সঙ্গে সঙ্গে ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ স্লোগানও তো মাঝে মাঝে শোনা গিয়েছে। অথচ কোনো ব্যক্তিপ্রাধান্যের চিহ্ন তাঁর মধ্যে ছিল না। এমনকি যে-দ্বিধা তাঁর অগ্রগামী নেতাদের মধ্যে হঠাৎ কখনো দেখা যেত, তার আভাসও তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি। আশ্চর্য মানুষ, এত কাছের অথচ এত বড়। সত্যিকার জননেতা বলতে যা বোঝায় তা-ই ছিলেন তিনি। সর্বসাধারণকে ভালোবাসতেন। এবং দেশের স্বার্থে সর্বসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। তাঁর কোনো কোনো বক্তৃতা আজ ইতিহাস।

বাংলাদেশ নামটাও তাঁর। বস্তুত আর কী নাম হতে পারত স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের? বিশ্বাসহন্তা স্বৈরাচারী পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তিই ছিল তাঁর লক্ষ্য। এবং সেই লক্ষ্যে অনড় থেকে একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে – কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর সেই ২৫ মার্চ – তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে ইতিহাস রচনা করলেন। ভূমণ্ডলে আরো এক দেশের জন্ম হলো। সেই জন্ম সার্থক করে তুলতে যে-রক্ত ঢালতে হলো বাংলাদেশকে, ন-মাসজুড়ে, তার তুলনা নেই। ‘এত রক্ত মধ্যযুগ দেখেছে কখনো?’ আর এই ন-মাস পাকিস্তানের জেলে চরম দণ্ডের আশঙ্কায় দিন কাটছে বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের। দণ্ডাদেশ হলোও, যদিও আন্তর্জাতিক চাপে তা বলবৎ করা গেল না – মুক্তি দিতে হলো তাঁকে। সগৌরবে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন, পথে লন্ডন ও দিল্লি। শুনেছি লন্ডনে নেমেই যে প্রথম ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন তা শ্রোতারা উত্তেজনাবশত লিপিবদ্ধ করে রাখতে ভুলে যান।

সবই এ-সব সর্বজনবিদিত। এ-ও সকলের জানা যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হবার পরে তার সাধারণ পরিষদে তিনি বাংলায় বক্তৃতা করেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা যে তাতে কত বেড়ে গিয়েছিল তা বলবার নয়। (তারিখটা ছিল ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন বেঁচে থাকলে ‘ভাষা, কবিতা ও মনুষ্যত্বে’র লেখক বুদ্ধদেব বসু তাঁকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতেন।) বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তাঁকে অর্ঘ্য জানাবার আর কী সম্বল আছে আমার – ইতিহাস বিহনে? ১৯৭৫-এর পনেরোই আগস্ট যে-কলঙ্ক লেপন হলো এই ইতিহাসে তার কথা আর তুলছি না, শুধু বলছি তিনি অমর হয়েই রইলেন। বাংলাদেশের জনক। ব্যক্তিগত একটা কথা। বাংলাদেশ না হলে কি আমি ছেষট্টি বছর পরে আমার জন্মভূমি সিলেটে যেতে পারতাম – সেই সিলেট যেখানে আমার ছেলেবেলা কেটেছিল? বঙ্গবন্ধুর কাছে আমার এ ঋণ। আর এই যে এখন প্রত্যহ রবীন্দ্রসংগীত শুনি তার কোনোটা কোনোটা যে বাংলাদেশের বাতাস আমার কাছে বয়ে আনে, সেই ঋণও কি ভুলবার?