বর্ণপর্দার ধাঁধায় বাঁধা 

জাহিদ মুস্তাফা

 

প্রতিটি বর্ণের আছে আপন বৈশিষ্ট্য। একটির সঙ্গে আরেকটি বর্ণের অন্তর্লীনে নতুন বর্ণপর্দা তৈরি হয়। বর্ণমিলনের এ-প্রক্রিয়া প্রকৃতিতেই বিদ্যমান সৃষ্টির আদি থেকে। বিষয়টা অঁরি মাতিসের মনে ধরেছিল। রঙের বিশেষত্বকে অক্ষুণ্ণ রাখতে তিনি ফবিজমের উদ্ভাবন করলেন। মাতিসের দেখানো পথ ধরে
পৃথিবীর নানাপ্রামেত্মর শিল্পীরা রঙের বিশেষত্বকে অক্ষুণ্ণ রেখে বিস্তর ছবি এঁকেছেন। সময়ের পরিবর্তনে আজ হয়তো পরিপ্রেক্ষিত বদলে গেছে, তবু রঙের বৈশিষ্ট্যকে মাথায় রেখেই  এখনো আঁকছেন অনেকে।

যেমন আমাদের হাতের কাছেই আছেন তরুণ শিল্পী জাহাঙ্গীর আলম। দেশের স্বনামধন্য একটি ইংরেজি দৈনিকের ফিচার বিভাগে কাজ করেন। শিল্পীদের ছবি আঁকা দেখতে দেখতে, প্রদর্শনী নিয়ে লিখতে লিখতে নিজের ভেতরের সুপ্ত শিল্পবোধ দিন দিন একটু একটু করে জেগে উঠেছে। শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়েও শখের বশে ছবি আঁকতে আঁকতে বর্ণপর্দার ধাঁধায় বাঁধা পড়ে গেছেন তিনি। তাঁর চোখ মজেছে প্রাচ্যপ্রকরণের অঙ্কনে, মন মজেছে রঙের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার কৌশল-কলায়। রঙের পিগমেন্ট প্রয়োগ করে বর্ণবৈশিষ্ট্য প্রায় অক্ষুণ্ণ রেখে তিনি ছবি আঁকছেন। রং একটু-আধটু মিলেমিশে যে-রেখা তৈরি করে সেটির অসিত্মত্বও যেন খাপ খেয়ে যায়। এতে নতুন আরেকটি অস্ফুট রূপ দেখা দেয়।

জাহাঙ্গীর আলমের কাজের সঙ্গে আমার চেনাজানার যোগ প্রায় অর্ধযুগের, ওরিয়েন্টাল স্টাডি গ্রম্নপের প্রদর্শনী থেকে। দেখেশুনে এঁকে বুঝে, শিল্পীদের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগে গত কয়েক বছরে বেশ পরিণত হয়েছেন তিনি। তারই নিকাশ করে জাহাঙ্গীরের প্রথম একক প্রদর্শনীর সাহস-সঞ্চয়। নিয়মিত আঁকতে আঁকতে কাজও জমেছে। শিল্পবোদ্ধারাও তাঁর কাজকে দেখছেন সপ্রশংসায়। ভালো লাগে রঙের পিগমেন্ট নিয়ে তাঁর নিরীক্ষার ধরন। যেমন ধরা যাক – ‘নীলের ভেতর নৃত্য’ শিরোনামের চিত্রকর্মের বর্ণ-ব্যবস্থাপনা। এই চিত্রপটটিকে প্রায় বৃত্তাকারে বিভাজন করেছেন নানা বর্ণের পিগমেন্ট প্রয়োগ করে। এর কেন্দ্রে হলুদ আর সবুজের মায়া-জড়ানো আলো, চারপাশে নীলাভ প্রগাঢ়তা দিয়ে মায়াবী বর্ণপর্দার নির্মিতি দর্শকদৃষ্টিকে মোহিত করে।

তাঁর কাজের শিরোনামগুলোও চমকপ্রদ এবং তাঁর ছবি বোঝার সূত্র হিসেবেও এসব শিরোনামের ভূমিকা থেকে যায়। এমন দুটি কাজের কথা বলি, যাতে  শিল্পী পৃথিবী গোলকের ভেতর চারটি নারী অবয়ব স্থাপন করেছেন কয়েকটি রঙের ভিন্নতায়। এর শিরোনাম দিয়েছেন – ‘উত্তর আধুনিক চিত্রের ময়নাতদন্ত’। এগুলো বাংলার সরাচিত্রের মোটিফ নিয়ে আঁকা। অনেকটা শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা তিনকন্যার মতো। সরার গোলাকার ফর্ম নিয়ে পিগমেন্ট দিয়ে তিনকন্যাকে তুলে ধরেছেন তাদের পরিধেয় বস্ত্রসমেত অবয়বের ভিন্নতায়।

জাহাঙ্গীর আলম শুধু শিল্পী হিসেবে নন, তাঁর শক্তির আরো দিক হলো – তাঁর লেখনী, পাঠ, সর্বোপরি দার্শনিক ভিত্তি। তিনি পেইন্টিংয়ের বিষয়ে লিখতে লিখতে এর ইতিহাস জেনেছেন, নন্দনতত্ত্ব বুঝেছেন, আঁকার কৌশল রপ্ত করেছেন। এভাবেই তিনি নিজেকে নির্মাণ করেছেন এবং প্রায় সাত-আট বছর আগে থেকে ছবি আঁকতে শুরু করেন।

জাহাঙ্গীর আলম ফুল নিয়ে অনেক ছবি আঁকেন, যেগুলো ঠিক বাস্তবিক ফুলের মতো নয়, এখানে রং আসে ফুলের মোহনীয় রঙের ইঙ্গিত হয়ে। জলরঙের ওয়াশে এঁকেছেন পাতাঝরা চৈত্রমাসের ডালপালা। চিত্রপটকে মুড়িয়ে সেটি আরো মোহনীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন শিল্পী। প্রদর্শনীতে জলরং ওয়াশ পদ্ধতিতে কিছু কাজ করেছেন; আরো কিছু কাজ করেছেন, তাতে রং ও রেখার চলনে মেঘের রূপ তৈরি হয়েছে। শিল্পের এমন স্তর নিয়ে বেশকটি দৃষ্টিনন্দন কাজ করেছেন শিল্পী।

তাঁর অন্যান্য কাজের শিরোনাম ‘মধ্যরাতের সুর’, ‘নারীর ক্ষমতায়ন’, ‘নীলে নৃত্য’, ‘নীরবতার গান’, ‘সূর্যের গান’, ‘চন্দ্রালোকে’, ‘আত্মা থেকে আত্মা’, ‘স্বর্গনৃত্য’, ‘আত্মার সন্ধানে’, ‘গ্রীষ্মের গান’, ‘বসন্ত বাতাসে’, ‘নিসর্গের গান’ প্রভৃতি। এসবের মধ্যে বেশিরভাগ কাজ তিনি করেছেন কাগজে জলরঙে।

তবে ছবি আঁকা বা গড়ার ইচ্ছাশক্তিকে রূপ দিতে অন্য দক্ষতাও তো দরকার, যেমন অঙ্কনের দৃঢ়তা, রেখার ছন্দময়তা, গঠনকে জম্পেশ জমানো। সে-জায়গাটিতে শিল্পী নজর দিলে তাঁর কাজ আরো মোহনীয় হতে পারে। বিশেষ করে ফিগার ড্রইংয়ের ক্ষেত্রে শিল্পীর আরো অনুশীলন তাঁর দক্ষতাকে পরিপূর্ণতা দিতে পারে। পরিশেষে শিল্পীর প্রথমার জন্য অফুরান শুভ কামনা।

ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে আয়োজিত এ-প্রদর্শনী শেষ হয়েছে গত ১৫ ডিসেম্বর শনিবার। r