বহুদর্শী মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ছিলেন একজন বহুদর্শী মানুষ। তিনি অধ্যাপক ছিলেন, ছিলেন গবেষক, লেখক, গ্রন্থ-রচয়িতা, সম্পাদক, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাণ্ডারি, টিভি উপস্থাপক-সংগঠক ইত্যাদি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক উদার হৃদয়ের গণতান্ত্রিক চেতনাধারী প্রাণোচ্ছল মানুষ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই মানুষটির ছাত্র হওয়ার।

অনেকেই পড়ান, কিন্তু সবাই শিক্ষক নন। শিক্ষক শব্দের সঙ্গে ‘শিক্ষি’র সংযুক্তি আছে, যার অর্থ শেখানো। যিনি শিষ্যের অন্তরলোকে জ্ঞানের আলো জ্বালানোর শক্তিটি সঞ্চার করতে পারেন, প্রাচীনকালে তিনিই গুরু হিসেবে সম্মানিত হতেন। প্রকৃত শিক্ষকও তাই। তিনি ছাত্রের মনোরাজ্যে জ্ঞানের দীপাবলি আনবেন, তাকে তার মতো এগিয়ে যাওয়ার পথনির্দেশ করবেন। আমি ধন্য মানি নিজেকে, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম শিক্ষক হিসেবে আমাকে আমার মতো হয়ে ওঠার চেতনা সঞ্চার করেছেন – তাঁর ‘অনুচর’ বানাননি। শিক্ষকদের মধ্যে অনেককে যখন দেখি, তারা ছাত্রদের প্রকৃত শিক্ষা দেওয়ার নামে ‘অনুচর’ বানানোতে ব্যস্ত, তখন এই মহাত্মা শিক্ষকের প্রতি মাথা আরো নত হয়ে আসে। তাঁর ক্লাস করেছি পুরো দুটো বছর, আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শ্রেণিপাঠ আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছি। তিনি আমাদের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়াতেন আধুনিক বাংলা কবিতা, অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশ, সমর সেন প্রমুখকে। আর স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের বাংলা উপন্যাস। তিনি পড়াতেন না কি ‘পারফর্ম’ করতেন এবং আত্মজাগরণের উপলব্ধি সঞ্চার করতেন, তাৎক্ষণিকভাবে বলা যেত না। শুধু বুঝতাম, তিনি অন্য শিক্ষকদের থেকে আলাদা। আমাদের শ্রেণিতে ছেলেমেয়ে মিলিয়ে ছিল মাত্র সাতাশজন – এই সাতাশজনই তাঁর ক্লাসশেষে জীবনবোধের নতুনত্বে স্নাত হতো। আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠটি আমি তাঁর কাছ থেকে নিয়েছিলাম বলে জীবনানন্দ থেকে সমর সেন – আধুনিক এই কবিতাদ্বীপের সন্ধান ও বৈশিষ্ট্য অবগত হওয়া আমার জন্য সহজ হয়েছিল। সে-সময়ের নম্বরখরাকালে আমি মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যারের কোর্সে শতকরা ৬৭ নম্বর পাওয়ায় কারো কারো ঈর্ষার পাত্রও হয়ে উঠেছিলাম। উনিশ শতকের উপন্যাস বা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসধারা পঠনে তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছিলাম নতুন মাত্রা। সাহিত্যেও সুতো বেয়ে তিনি আমাদের পৌঁছে দিতেন ইতিহাসের অন্দরমহলে, শিল্পরসের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দিতেন আত্মপরিচয়ের ভিন্নপাঠ। আমাদের মধ্যে যারা উপন্যাসগুলো আগে পড়ে আসত তারা প্রতিটি আলোচনায় পেত নবতর ইঙ্গিত। বর্জন তো নয়ই, বঙ্কিমচন্দ্র কেন অত্যাবশ্যক; রবীন্দ্রনাথ কী করে কথাসাহিত্যে বারবার বাঁকবদল ঘটিয়েছেন – আজো সেই ব্যাখ্যাগুলো স্মৃতির পাতায় ভাসে। আমি দুজন শিক্ষকের পাঠদানরীতিকে এখনো অনুসরণ করি; তাঁদের একজন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। তিনি প্রতিটি শ্রেণিপাঠ দিতেন ‘নোট’ বা ‘টোকা’ সামনে নিয়ে। শিক্ষক হিসেবে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেই যা-খুশি তাই পাঠ প্রদান বা ‘লেকচার’ দান ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি নির্দিষ্ট পাঠের ‘নোট’ বা ‘টোকা’ সামনে রেখে আমাদের পাঠ প্রদান করতেন বলেই পাঠদানের সময় বৃন্তচ্যুত হতো না তাঁর বক্তৃতার ফুল। কথামালার এই ধারাবাহিকতা থাকায় আমরা শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর বক্তৃতা খুব পছন্দ করতাম। আমি এখনো দেখি, যেদিন ‘নোট’ বা ‘টোকা’ সামনে থাকে, শ্রেণিকক্ষে আমার পাঠ প্রদানে সেদিন নিজেই মহাসন্তুষ্ট হয়ে যাই। স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অভিসন্দর্ভ রচনা করার নম্বরের শর্তপূরণ হওয়ার পর শিক্ষকদের ‘অ্যাকাডেমিক কমিটি’র সভায় মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার আমাকে নিজের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তৎকালীন বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক এইচইউএম শামসুন নাহার পরে আমাকে এই কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাকে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার ব্যক্তিগতভাবে জানেন, এটি তোমার জন্য অতিগর্বের।’ ‘গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন’ শিরোনামে আমি সেই অভিসন্দর্ভ রচনা করেছিলাম এবং পরে তা কলকাতা থেকে গ্রন্থাকারে বের হয়েছিল। গবেষণা-সূত্রে স্যারের ইন্দিরা রোডের ‘আকাশপ্রদীপ’ নামের বাড়িতে বহুবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি সে-সময়ই শিখেছিলাম, পরীক্ষা-পাশের নোট তৈরি আর গবেষণাপত্র রচনার পার্থক্য কী; তথ্যনির্দেশ কী করে তৈরি করতে হয় আর ‘কোথায় থামতে হয়’। আমরা চলতেই জানি শুধু, থামতে জানি না – তা কথায়, লেখায়, বলায় – সর্বক্ষেত্রে। তিনি আমাকে ‘থামতে’ শিখিয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন পরিমিতিবোধ। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর পিএইচ.ডি গবেষণার জন্য আমি যখন ভারত সরকারের শিক্ষাবৃত্তির আবেদন করি, সেই আবেদনপত্রের সঙ্গে দুজনের ইংরেজি ভাষায় প্রত্যয়নপত্র সংযোজনের প্রয়োজন হয়। মুস্তাফা স্যার আমাকে একটি প্রত্যয়নপত্র সেদিন দেবেন – এমনই কথা। কিন্তু দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মাইক্রোবাসটিতে তিনিও আসেন, তাঁর নিয়মিত আসনটি শূন্য। গাড়ি থামার পর সেখান থেকে এক এক করে বাইরে আসছেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমান প্রমুখ। হঠাৎ চালক আমাকে একটি মুখবন্ধ খাম হাতে দিলেন। খুলে দেখি সেখানে মুস্তাফা স্যার একটি চিরকুট পাঠিয়েছেন, তাতে লেখা : ‘গতরাতে আমার এক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু ঘটেছে। আগামী সপ্তাহে কাগজটি পাবে।’ পরে পত্রিকায় জানলাম, তাঁর ছোটভাই এমআর আখতার মুকুলের স্ত্রীবিয়োগ ঘটেছে সে-রাতে! পরে নির্দিষ্ট সময়েই স্যারের কাছ থেকে সেই প্রত্যয়নপত্র পেয়েছিলাম এবং আমার শিক্ষাবৃত্তিও জুটেছিল। কিন্তু আমি অভিভূত হয়েছিলাম তাঁর দায়িত্বজ্ঞানের পরিধি অনুধাবন করে : অতি নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর পরও একজন অপেক্ষমাণ স্নাতকোত্তর সামান্য ছাত্রকে নিজের অনুপস্থিতির কারণ চিঠি লিখে তিনি অবগত করেছিলেন। এ-যুগে আমরা কি মনের এহেন অবস্থায় এমন দায়িত্বশীলতার পরিচয় সত্যি দেবো! রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি গবেষণাকালেও আমাদের যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিল। তখনো আমার পিএইচ.ডি ডিগ্রিপ্রাপ্তি হয়নি – ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর; স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে চাকরি-পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঢাকায় এক রাত অবস্থান করার ফাঁকে ভাবলাম বিকেলে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যারের সঙ্গে দেখা করে নিই। করলামও তাঁর আকাশপ্রদীপ বাড়িতে। নানা বিষয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো। স্যারকে জানালাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। মনে পড়ে, তিনি বেশ নির্লিপ্ততার সঙ্গে আমার কথা শুনেছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে আমি পরীক্ষাকক্ষে উপস্থিত হই। ওমা! পরীক্ষা বোর্ডে দেখি অন্যতম সদস্য হিসেবে স্যার বসে আসেন। তাঁর ঢাকার বাড়িতে কথা হলো নানা বিষয়ে,

চা-বিস্কুট খাওয়ালেন; কিন্তু ঘুণাক্ষরেও আমাকে বুঝতে দেননি তিনিও পরীক্ষা-কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে বোর্ডে থাকবেন। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে ডাকযোগে নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না যে চাকরিটি আমার হয়েছে কিনা! তিনিও আমাকে জানাননি, আমারও তাঁকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি – এরকম মূল্যবোধের ব্যাপ্তি ছিল।

অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম নামটি আমি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই জানি, দৈনিক সংবাদ পত্রিকা নিয়মিত পাঠের কারণে। সেই তরুণ যৌবন থেকেই বাংলা ও বাঙালিত্ব নিয়ে আমি আগ্রহী। সে-সূত্রে ভিপি ডাকযোগে আমি ক্রয় করি মুস্তাফা নূরউল ইসলাম-সম্পাদিত জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র-প্রকাশিত আমাদের মাতৃভাষা-চেতনা ও ভাষা আন্দোলন (ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪) গ্রন্থটি। এপ্রিল মাসের আট তারিখে গ্রন্থটি ঢাকা থেকে আমার হাতে আসে; তখন আমি শেরপুর জেলা সদরের বাসিন্দা। আজো চেয়ে দেখি দিনাঙ্ক লেখা সেই বই। বইটি পাঠ করে সে-বয়সেই আমি পেয়ে গিয়েছিলাম বাংলা ও বাঙালি ‘হয়ে ওঠা’র ঠিকুজি। দুশো ষোলো পৃষ্ঠার মধ্যে বাংলা ভাষা, লিপি, সাহিত্যের ইতিহাসের সঙ্গে বাঙালি নানা মনীষীর ভাষাচিন্তা গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত আছে। সত্যি, তরুণ যৌবনে এ-বইটি আমার চোখ খুলে দেয়। পরে তো এই সম্পাদকের কাছে লেখাপড়া করার সুযোগ আসে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে! তখন তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বহু গ্রন্থ পাঠ করেছি। প্রাসঙ্গিকভাবে তাঁর গ্রন্থাবলির একটি তালিকা উল্লেখ করা যাক : মুসলিম বাংলা সাহিত্য (১৯৬৮), মুন্সী মহম্মদ মেহেরুল্লা (১৯৭০), ইবহমধষর গঁংষরস চঁনষরপ ঙঢ়রহরড়হ (১৯৭৩; গ্রন্থটি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে করা তাঁর পিএইচ.ডি গবেষণা অভিসন্দর্ভ অবলম্বনে রচিত), সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত (১৯৭৭), সমকালে নজরুল ইসলাম (১৯৮৩), উচ্চশিক্ষায় এবং ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষার প্রয়োগ (১৯৭৬), বাংলাদেশ : বাঙালী আত্মপরিচয়ের সন্ধানে (১৯৯০), নজরুল ইসলাম : নানা প্রসঙ্গ (১৯৯১), আবহমান বাংলা (১৯৯৩), আমাদের বাঙালিত্বের চেতনার উদ্বোধন ও বিকাশ (১৯৯৪), সময়ের মুখ : তাঁহাদের কথা (১৯৯৭), আপন ভুবন (২০০১), নিবেদন ইতি (২০০৫-০৬) ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও শিখাসহ বেশকিছু পত্রিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচিত রচনার সংকলন তিনি করেছেন। আমার আত্মশ্লাঘার ব্যাপার হলো এই, ২০১২ সালে স্যার ও আমার যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর নামে বিশালায়তনের একটি গ্রন্থ, যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নানা মাত্রায় অবলোকন করা হয়েছে। আসলে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যারের গ্রন্থ-রচনার পেছনে ছিল জাতীয়তাবাদী এক মহান দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথম জীবনে মুসলিম-স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্যানুসন্ধান মূলত এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিবেচ্য। তিনি বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অধিকার-সচেতনতা ও আত্মজাগরণের জন্য লেখনী ধারণ করেছিলেন। পরে শুধু মুসলমান পরিচয় নয়, বাঙালি পরিচয়টি নিয়ে গর্ব করার পথ দেখিয়েছিলেন এবং সবশেষে বাঙালির একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে-ধারাবাহিকতাতেই তিনি নিজে ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন; বাঙালির স্বাধিকার-সংগ্রামে অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের অন্যতম কারিগরের ভূমিকা নেন তিনি। তাঁর চিন্তা, কর্ম, রচনা সবই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোহনায় মিলেছে। আর সে-সূত্রেই এসেছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদার গণতান্ত্রিক চেতনা।

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম নামটি সম্পাদক হিসেবেও আমাদের ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হবে। কারণ তিনি দুটো গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘজীবী সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৩৬৭ বঙ্গাব্দে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও তাঁর যুগ্ম সম্পাদনায় রাজশাহী থেকে প্রকাশ পায় পূর্বমেঘ নামে ত্রৈমাসিক আর ১৩৯৩ বঙ্গাব্দে ঢাকা থেকে তাঁর একক সম্পাদনায় বের হয় সুন্দরম নামে ত্রৈমাসিক। দুটো পত্রিকাই বাঙালির জ্ঞানরাজ্যে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রাজশাহীর মতিহারে ছিল পূর্বমেঘের কার্যালয়। প্রকাশক হিসেবে নাম ছাপা হতো ড. এআর মল্লিকের। বাংলা বছরের আষাঢ়, আশ্বিন, পৌষ, চৈত্র মাসে বের হতো এই ত্রৈমাসিক। ওপরে লেখা থাকত : ‘শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিমূলক ত্রৈমাসিক পত্রিকা’। এর প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল এক টাকা, সডাক বার্ষিক সাড়ে চার টাকা। প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন মুস্তাফা শওকত কামাল। ছাপা হতো রাজশাহীর ইন্টারন্যাশনাল প্রিন্টিং ফার্ম থেকে। প্রকাশের পরই আকর্ষণীয় লেখা মুদ্রণ ও নিয়মিত প্রকাশনার কারণে সারাদেশের উৎসাহী মানুষের আগ্রহে পরিণত হয় সাময়িকীটি। পরে অবশ্য ত্রৈমাসিকটি খানিকটা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী অক্সফোর্ডে চলে গেলে পত্রিকা কার্যত একাই সম্পাদনা করেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। পূর্ব পাকিস্তানের এক প্রান্তে অবস্থিত রাজশাহী থেকে পত্রিকাটি বের হতো বটে, কিন্তু সেটা কোনো আঞ্চলিক পত্রিকা ছিল না। এ-পত্রিকার তৎকালীন পাঠক, এখন যাঁরা পরিণতজন, আমি তাঁদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি, পূর্বমেঘ পাঠ করার জন্য খোদ ঢাকা বা দেশের অন্য অঞ্চলে বসেও প্রতীক্ষারত থাকতেন তাঁরা। পত্রিকায় কোনো ‘সম্পাদকীয়’ রচনা বের হতো না। তবে দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে অন্যতম সম্পাদক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ১৩৭০ বঙ্গাব্দে পত্রিকার চতুর্থ বর্ষারম্ভ সংখ্যায় একটি চিঠি লিখেছিলেন এবং তা পূর্বমেঘে প্রকাশ হয়েছিল। সেখান থেকে জানা যায়, এই পত্রিকা ‘নতুন উঠতি লেখকদের উপর নজর’ রেখেছে, তাঁদের ‘মত বা রাজনীতি কি’ তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে রচনার উৎকর্ষ বিচার করে ছেপেছে। আর বাংলা সাহিত্যের সীমানা পাকিস্তানের সংকীর্ণ অর্থে নয়, ‘ব্যাপক’ অর্থে বুঝেছে পূর্বমেঘ এবং বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে জুড়ে দিতে চেয়েছে; কিন্তু অবলম্বন পূর্ববাংলার বাংলা সাহিত্য। আসলে তখনো পূর্ববাংলার বাংলা সাহিত্যের পৃথক কোনো প্রবণতা নির্দিষ্ট হয়নি। পূর্বমেঘ সেই প্রবণতা নির্দিষ্টকরণে তৎপর ছিল। এ-পত্রিকায় যাঁরা কম বয়সে লিখেছিলেন তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে স্বনামে খ্যাত হয়েছেন। সনৎকুমার সাহা, রফিক আজাদ, হায়াৎ সাইফ, মাযহারুল ইসলাম, সিকদার আমিনুল হক, আবদুল হাফিজ, বদরুদ্দীন উমর, আলী আনোয়ার, জিয়া হায়দার, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, হায়াৎ মামুদ, খোন্দকার সিরাজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক, সানাউল হক, ওমর আলী, সুব্রত বড়–য়া, এবনে গোলাম সামাদ, ছদরুদ্দীন আহমেদ – এ নামগুলো দৈবচয়নের মাধ্যমেই তুলে নিলাম। এঁদের অনেকে পেশায় প্রবেশ করেছিলেন বটে; কিন্তু বয়সে ছিলেন যুবক। অশোক সৈয়দ নামে আবদুল মান্নান সৈয়দের অনেক লেখা এই পত্রিকায় ছাপা হয়। প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, নাটক, অনুবাদ – সব ধরনের লেখাই মুদ্রিত হয় এখানে। লেখকের নাম ছাপা হতো লেখার নিচে, শিরোনামের নিচে নয়। এই পত্রিকায় বদরুদ্দীন উমরের যে-প্রবন্ধগুলো ছাপা হয়, তাতে তিনি পাকিস্তানে অবস্থান করে রাষ্ট্র পাকিস্তানের অসারত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ৬-দফা আন্দোলনের আগেই চমৎকার করে তুলে ধরেছিলেন। বাঙালি শিক্ষিতজনেরা এই লেখাগুলো পড়ে বুঝতে পারেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের জাতিভাষ্য আসলে মিথ্যা। পাকিস্তানেই পাঁচ জাতি বাস করে, বাঙালি এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। পরে বদরুদ্দীন উমরের সাম্প্রদায়িকতা গ্রন্থে প্রবন্ধগুলো স্থান পায়।

পূর্বমেঘ পাকিস্তান আমলেই বন্ধ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুস্তাফা নূরউল ইসলাম নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন। ততদিনে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দিয়েছেন। এ-সময় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যবিষয়ক ত্রৈমাসিক হিসেবে ১৩৯৩ বঙ্গাব্দের ভাদ্র-কার্তিক; ১৯৮৬ সালের আগস্ট-অক্টোবর মাসে সুন্দরম নামে নিজ সম্পাদনায় তিনি একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। পূর্বমেঘ নামটি নিয়েছিলেন মহাকবি কালিদাসের বিখ্যাত গ্রন্থ মেঘদূত থেকে; কিন্তু তাতে পূর্ববাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রকাশের ভিন্ন অর্থদ্যোতনা ছিল। আমাকে ব্যক্তিগত আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, সুন্দরম নামটি তিনি গ্রহণ করেছেন সুবোধ ঘোষের একটি গল্পনাম থেকে, যে-গল্পে একটি নবজাতকের মুখদর্শনের বিস্ময় ও আনন্দ আছে। বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য যে ততদিনে জীবন পেয়ে ভূমিষ্ঠ হতে পেরেছে – এই ইঙ্গিতই সাময়িকীর নামকরণে হয়তো ছিল। সুন্দরমের সংখ্যানাম ছিল ঋতুভিত্তিক; যেমন, গ্রীষ্ম সংখ্যা, শরৎ সংখ্যা, শীত সংখ্যা, বসন্ত সংখ্যা। এর প্রচ্ছদ রেখাঙ্কন করেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান; প্রকাশ-ঠিকানা ছিল সম্পাদকের বাড়ি : আকাশপ্রদীপ, ৫২/৩ ইন্দিরা রোড, ঢাকা-১৫। পূর্বমেঘের সঙ্গে সুন্দরমের দৃষ্টিভঙ্গিগত তেমন পার্থক্য ছিল না। এখানেও কোনো সম্পাদকীয়-ভাষ্য প্রকাশ পেত না, লেখকদের রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য ছিল না; বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির গভীরতর অনুসন্ধানের দিকটিই ছিল প্রধান। সুন্দরমের প্রথম সংখ্যার প্রথম লেখাটিই ছিল সৈয়দ আলী আহসানের; তৎকালীন স্বৈরশাসকের সঙ্গে সখ্য থাকার অভিযোগ ছিল যাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু সেদিকটি সম্পাদক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বিবেচনায় নেননি। নজরুল ইসলামের ওপর একটি ভালো প্রবন্ধ লিখেছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। সৈয়দ শামসুল হকও তৎকালীন লেখককুলের বৃহদাংশের কাছে খানিকটা প্রশ্নবোধকের নিচে। অথচ, এসবের তোয়াক্কা না করে পত্রিকার দ্বিতীয় লেখাটি প্রকাশ করা হয় তাঁর : ‘গল্পের কলকব্জা’। এরপর আছে ওয়াহিদুল হক, অজয় রায়, সালাহ্উদ্দীন আহমদ, মুনতাসীর মামুন, আতাউর রহমান, কামরুল হাসান, খান আতাউর রহমান, আলী যাকের, রামেন্দু মজুমদার, চিন্ময় মুৎসুুদ্দী, বশীর আলহেলাল প্রমুখের নাম। এই সাময়িকীতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান লেখকদের প্রায় সবাই লিখেছেন। কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, আজিজুর রহমান মল্লিক, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আবুল হাসনাত, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আনু মুহাম্মদ, এমএম আকাশ প্রমুখের নাম এখানে উল্লেখ করা যায়। পূর্বমেঘে কবিতা ও নাটক বা একাঙ্কিকা প্রকাশিত হয়, সুন্দরম ছিল সর্বাংশে আলোচনা ও প্রতর্কমূলক গদ্যসাময়িকী। তবে ‘ললিতকলা : অনুষ্ঠানমালা’ বা ‘গ্রন্থভুবন’ শিরোনামে অনুষ্ঠান-আলোচনা বা কবিতার বইয়ের সুসমালোচনা এখানে সমাদৃত হতো। পূর্বমেঘে নবীন লেখকদের যেমন সমাদর করা হতো, সুন্দরমে তরুণ লেখকদের চেয়ে আসন পেতেন প্রথিতযশা লেখককুল। আমি তরুণ বয়সে ‘গ্রন্থভুবন’ কলামে কয়েকটি গ্রন্থ-সমালোচনা করার সুযোগ পেয়ে বর্তে গিয়েছিলাম। সুন্দরমে লেখা প্রকাশ ছিল অতিমর্যাদার ব্যাপার। দীর্ঘদিন চালু রাখার পর অবশেষে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সাময়িকীটি বন্ধ করে দেন। কয়েকজন অধ্যাপকের নাম উল্লেখ করে তিনি আমাকে বলেছিলেন, লেখার খরা চলছে। ভালো মানের লেখা না পেলে পত্রিকা প্রকাশ করে আনন্দ নেই। লেখা দিতে বললে, অমুক উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থের বিষয় আর প্রকরণ ছাড়া তাঁরা যেন লিখতেই পারেন না! মুুস্তাফা নূরউল ইসলাম নাম প্রচারের জন্য সাময়িকী সম্পাদনা ও প্রকাশ করেননি; করেছিলেন দেশ ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্ব থেকে। তাই যখন বুঝলেন এ-দায়িত্ব পালন করা যথাযোগ্যভাবে হচ্ছে না, তখন তিনি সুন্দরম প্রকাশ বন্ধ করে দিলেন। সুন্দরমের আসলে দুটো পর্যায় : ১৯৮৬ থেকে ২০০০ সাল এবং এরপর। প্রথম পনেরো বছরের সুন্দরমে যে-লেখাগুলো প্রকাশ পেয়েছে তার সার্বিক মূল্য অসীম। এর অর্ধেকই পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, এরশাদ সরকারের পতনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রশ্নে সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক তর্ক-প্রতর্ককালে সুন্দরম বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটানোর কাজটি সুন্দরম ঠিকঠাকভাবে করেছিল। ২০০০ সালের পর সুন্দরম সৌন্দর্য হারাতে থাকে মূলত ভালো লেখার অভাবে।

মুুস্তাফা নূরউল ইসলামের আরেকটি পরিচয়, তিনি টেলিভিশনের আলাপ-অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও সংগঠক। সংগঠক বলব এ-কারণে যে, তাঁর আগে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী টেলিভিশনের ধারাবাহিক ও দীর্ঘ অনুষ্ঠানের দৃষ্টান্ত ছিল না। আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনই (বিটিভি) ছিল ক্ষেত্র, পরে বেসরকারি চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানেও তিনি ছিলেন সমানভাবে উপস্থিত। বিটিভিতে প্রচারিত তাঁর ‘মুক্তধারা’ নামে একটি আলাপ-অনুষ্ঠানের আমি ভক্ত হয়ে যাই গত শতকের আশির দশকে। রাত দশটার বিটিভির ইংরেজি সংবাদ সাড়ে দশটা নাগাদ শেষ হলে নির্দিষ্ট দিনে ‘মুক্তধারা’ অনুষ্ঠান হতো। প্রতি অনুষ্ঠান ছিল ভিন্ন বিষয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের টিভিরুমের এক-দুজন দর্শকের মধ্যে আমি ছিলাম নিয়মিত। পরে জেনেছি, শুধু আমি নই, অনেকেই ছিলেন এই অনুষ্ঠানের ভক্ত। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে নজরুল-সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম আমার সামনে মুস্তাফা স্যারের প্রশংসা করে বলেছিলেন, তিনি চোখে পড়ামাত্র ‘মুক্তধারা’ শেষ না করে উঠতেন না। পরে এটিএন বাংলা টেলিভিশনে তিনি ‘কথামালা’ ও বিটিভিতে ‘বাঙালির বাংলা’ নামে আলাপ-অনুষ্ঠান করেছেন। মৃত্যুর আগেও তাঁর এ-অনুষ্ঠানদুটো অব্যাহত ছিল। তিনি এ-অনুষ্ঠানগুলোকে বলতেন : ‘টিভি সেমিনার’। শিক্ষা ও চিত্তজাগরণমূলক বিষয় নিয়ে হতো তাঁর অনুষ্ঠানগুলো। তিনিসহ দুজন অতিথি সাত-আট মিনিট করে প্রত্যেকে নির্দিষ্ট বিষয়ে বলতেন। বিটিভির ‘বাঙালির বাংলা’ অনুষ্ঠানের কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ছিল বাঙালির ঐতিহ্যানুসন্ধান ও ভবিষ্যতের পথনির্মাণবিষয়ক। তাই এ-অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর কথা বারবার আসত। আর এটিএন বাংলার অনুষ্ঠানের আলোচনার কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ছিল দার্শনিক বিষয়। আমি সৌভাগ্যবান : তাঁর অনুষ্ঠানে আমি যে-কতবার অতিথি হয়ে অংশগ্রহণ করেছি, সে হিসাব নেই। জীবনের শেষ কয়েকটি বছর স্মরণশক্তি তাঁকে সহায়তা না করলে তিনি আমাকে মনে করতেন, ফোনে কথা বলতেন। আমার প্রতি স্যারের এই নির্ভরতা আমার জীবনের বড় পুরস্কার। তারিখ হলেও এটিএন বাংলায় তাঁর শেষ অনুষ্ঠানটি আর ধারণ করা যায়নি। সেটাতে আমারও অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তিনি বিষয় দিয়েছিলেন : ‘অন্ধকারের যতো রূপ’। সে-রূপ বিশ্লেষণের আগেই মহাকালের গভীর অন্ধকারের আহ্বানে সাড়া দিলেন বহুদর্শী মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। কিন্তু রেখে গেলেন অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, শুভানুধ্যায়ী, দর্শক, গ্রন্থ ও পত্রিকার পাঠক-লেখক এবং স্বাধীন বাংলাদেশ – যে-দেশের স্বপ্নদ্রষ্টাদের মধ্যে ছিলেন তিনিও একজন।