বাংলাদেশের ছড়ায় গণচেতনা

বিশ্বজিৎ ঘোষ

সাহিত্যের বহুমুখী ও বৈচিত্র্যময় শাখাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শাখা হচ্ছে ছড়া। ছড়াসাহিত্যের ইতিহাস সুপ্রাচীন। বাংলা ছড়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসের পথ ধরেই বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ। বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্যের ধারায় ছড়াসাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পশাখা হিসেবে স্বীকৃত। অতীতে ছড়া রচিত ও বিকশিত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে – কালের গ্রাস থেকে এগুলো রক্ষিত হয়েছে মানুষের স্মৃতিকোঠায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের লোকসাহিত্য হিসেবে আদিছড়ার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সে-কালের ছড়া ছিল কেবলই শিশু-মনোরঞ্জনের বিষয়। ফলে সাহিত্যের শাখা হিসেবে ছড়া তখন সে-অর্থে স্বীকৃতি পায়নি। যাঁরা ছড়া নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরাও লোকসাহিত্য হিসেবে ছড়াকে বিবেচনা করেছেন, এবং দাঁড় করিয়েছেন এরকম ব্যাখ্যা – ‘ছড়ার রাজ্যে বুদ্ধি ও বিচারের অধিকার নেই। শিশুদের কাছে বুদ্ধি ও বিচার অপেক্ষা রসের মূল্য বেশি, মস্তিষ্ক অপেক্ষা হৃদয় বড়’ (কাসিমপুরী, ১৯৬২ : ৬)। কিন্তু বর্তমান কালের ছড়াসাহিত্যের আলোকে উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা যে আর যথার্থ নয়, তা লেখাই বাহুল্য।
উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ছড়ার কোনো লিখিত সংকলন প্রকাশিত হয়নি। ছড়া মুখে-মুখে রচিত হবে, পঠিতও হবে মুখে-মুখে – এমনই ধারণা ছিল সেকালের সাহিত্যবোদ্ধাদের। এ-কারণেই লোকছড়া বা আদিছড়ার কোনো রচয়িতার নাম পাওয়া যায় না। কিন্তু ছড়া বর্তমানে লিখিত সাহিত্য। ফলে নানা দিকেই অতীতের ছড়ার সঙ্গে বর্তমান কালের ছড়ার অনেক পার্থক্য ঘটে গেছে। এখনকার ছড়া শিশুদের ঘুম পাড়ায় না, বরং মানুষের ঘুম তাড়ায়। ছড়া এখন ঘুম-ভাঙানিয়া শিল্প, জনচেতনাকে জাগিয়ে তোলাই একালের ছড়াসাহিত্যের মূল অন্বিষ্ট। শিশুর মনোরঞ্জন একেবারে বাতিল হয়নি, তবু একালের ছড়াসাহিত্যের কেন্দ্রীয় শিল্প-উপাদান হিসেবে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক নানা অনুষঙ্গই প্রাধান্য পেল। ফ্যান্টাসি আর হাস্যরসের পরিবর্তে আধুনিক ছড়ায় এলো একধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদনা, এলো সুস্পষ্ট বক্তব্য। ছড়া সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ-কথিত ‘উচ্ছৃঙ্খল অদ্ভুত পদার্থে’র মধ্যে এলো অর্থ-ব্যঞ্জনা, এলো প্রগত মানবকল্যাণচেতনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ছড়া ছিল একান্তই শিশুতোষ এক শিল্প-উপাদান। শিশুরঞ্জিনী বলেই, বোধ করি, সাহিত্যের আসরে ছড়ার মর্যাদা ছিল অস্বীকৃত। কিন্তু ১৯৪০-এর পর থেকে এ-ধারণার পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করে। ১৯৪০-পরবর্তী বাংলা ‘ছড়া শুধু সমাজ-সংসার নিয়েই কথা বলে না – দেশ ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বলে।… ছড়াও কালের সঙ্গে অনবরত তার রূপ বদলায়’ (সিদ্দিকী, ১৯৮৭ : ৫১)। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক সমস্যা, দেশের সমাজ-রাজনৈতিক নানা বিষয় ছড়াকাররা তাঁদের রচনায় তুলে ধরার আন্তরপ্রেরণা উপলব্ধি করলেন চল্লিশের দশকের মধ্যপাদ থেকে। কবিতা বা অন্য সাহিত্য-মাধ্যমে যা বলতে অনেক সময় ও আয়োজন লাগে, ছড়ায় তা অল্পকথায় সহজেই বলা যায় বলে ক্রমে ছড়াসাহিত্য সৃষ্টিশীল লেখকদের মনোযোগ আকর্ষণ করলো। এভাবে ছড়া হয়ে উঠলো সমাজ-রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশের অন্যতম উপায়। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় রোকনুজ্জামান খানের এই মন্তব্য –
কবিতার বক্তব্য বুঝতে একটু চিন্তা করতে হয়। কিন্তু ছড়া-পাঠের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। ছড়ার রস আস্বাদন করতে পাঠককে খুব গভীরে যেতে হয় না। এর মানে এই নয় যে, ছড়ায় চিন্তার খোরাক থাকে না। থাকে, তবে তা সহজ-স্বচ্ছ, জটিল নয়। (খান, ১৯৮৮ : ৬)
১৯৪৭-উত্তরকালে, বিগত ৬০ বছরে, বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাবো, এ-সময়ের ছড়া বিকশিত হয়েছে মূলত দ্বিবিধ ধারায়। ধারাদ্বয় হচ্ছে – লোকছড়া ও আধুনিক ছড়া। লোকছড়া বা আদিছড়া মূলত সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছড়ার সংগৃহীত ভাণ্ডার। বিভাগোত্তর কালে মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন কাসিমপুরী, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, আলমগীর জলিল, রওশন ইজদানী, খোদেজা খাতুন, আশরাফ সিদ্দিকী, জীবন চৌধুরী, বদিউজ্জামান, ওহীদুল আলম প্রমুখ গবেষক লোকছড়া সংগ্রহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। লোকছড়া মূলত শিশু-মনস্তত্ত্বের দিকে লক্ষ রেখে রচিত হলেও তাতে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির নানা চিত্রও পাওয়া যায়। শিশুমনের সীমানা ছাড়িয়ে লোকছড়ায় বাংলাদেশের বৃহত্তর জনজীবনের নানা সমস্যা ও সংকটও রূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর জীবনধারার প্রকৃত পরিচয় পেতে হলে বাংলা লোকছড়াসমূহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। লোকছড়া অনুশীলন করলে সমাজব্যবস্থা বা সমাজকাঠামো, সমাজের বাস্তবভিত্তি বা উপকরণ, সমাজ-পরিবর্তনের গতি – এসব সমাজতাত্ত্বিক প্রত্যয় সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। লোকছড়ায় বাংলাদেশের কৃষকজীবনের ছবিও চমৎকার ফুটে উঠেছে। এদেশের কৃষিব্যবস্থার অতীতের রূপ ও রূপান্তরের তথ্য-উৎস হিসেবে বাংলা লোকছড়াসমূহ অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। লোকছড়ায় বৃহত্তর জীবন ও সমাজসত্য কীভাবে লুকিয়ে থাকে, নিচের উদ্ধৃতিদ্বয় থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায় –
ক. খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?
ধান ফুরুল পান ফুরুল
খাজনার উপায় কি?
আর কটা দিন সবুর করো
রসুন বুনেছি।

খ. খোকামণির বিয়ে দেব হটমালার দেশে
তারা গাই বলদে চষে।
তারা হীরেয় দাঁত ঘষে
রুই মাছ পালঙের শাক ভারে ভারে আসে।

– প্রথম ছড়াটিতে নবাব আলীবর্দী খাঁর শাসনামলে, ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে, বর্গীদের হামলা ও লুটতরাজের কথা প্রকাশিত হয়েছে। ছড়াটি যদিও শিশুদের ঘুম-পাড়ানোর উদ্দেশ্যে রচিত, তবে এখানে বাংলার সমাজ-ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায়ও সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ছড়াংশটিতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থার ছবি।
লোকছড়ার চারিত্র্য থেকে বাংলা ছড়াকে প্রথম আধুনিক মাত্রায় অভিষিক্ত করেন মনস্বী অন্নদাশঙ্কর রায়। দেশ-বিভাগের ডামাডোলের মধ্যে রাজনীতিবিদদের সংকীর্ণ স্বার্থচেতনা ও ভেদনীতিকে তীব্রভাষায় আক্রমণ করে অন্নদাশঙ্কর লিখলেন –
তেলের শিশি ভাঙলো ব’লে
খুকুর ’পরে রাগ করো,

তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো –

তার বেলা, তার বেলা?

– স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এ-ছড়ার পেছনে ক্রিয়াশীল আছে একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই ছড়াটির সূত্রেই চল্লিশের আধুনিক ছড়া সম্পর্কে গবেষক লিখেছেন – ‘যে ছড়া ছিলো শুধুমাত্র গ্রামীণ লোকজ জীবন-ধারণের অন্যতম প্রকাশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে দেশবিভাগ সেই ছড়াসাহিত্যকে গ্রামীণ জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে। ছড়ার ভাষা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার’ (নাগরী, ১৯৮৬ : ১১)। অন্নদাশঙ্করের উত্তরহীন জিজ্ঞাসা থেকেই আধুনিক বাংলা ছড়ার বিভাগোত্তর কালের বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যের কেন্দ্রীয় প্রবণতা। দীর্ঘ ৬০ বছরে আমাদের ছড়াসাহিত্য মূলত রাজনৈতিক বক্তব্য ও গণচেতনাকে প্রবলভাবে অঙ্গীকার করে সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। বাংলাদেশের আধুনিক ছড়া, প্রকৃত প্রস্তাবে, গণচেতনার ছড়া। আধুনিক ছড়া যে ঘুম পাড়ায় না, বরং ঘুম ভাঙায়, বিগত ৬০ বছরের বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্য তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
বিভাগোত্তর কাল থেকে পরবর্তী ষাট বছরে বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যের মৌলভাব গৃহীত হয়েছে প্রধানত এদেশের সমাজ-রাজনীতির অঙ্গন থেকে। অলৌকিক দৈত্য-দানো আর ভূত-প্রেত নয়, নয় পরোক্ষ প্রকাশ – এসময় ছড়া সরাসরি অঙ্গীকার করলো আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবন। সাতচল্লিশের দেশবিভাগ, বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা-পরবর্তী বিপন্ন পরিস্থিতি, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড, সামরিক শাসন, হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সীমাহীন দুর্নীতি – সবকিছুই একালের ছড়াসাহিত্যে প্রত্যক্ষভাবে চিত্রিত হয়েছে। বস্তুত, আলোচ্য কালখণ্ডের ছড়াসাহিত্যে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ মুখর হয়ে আছে। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, গণচেতনাকে উজ্জীবিত করাই একালের ছড়াকারদের প্রধান লক্ষ্য, তাই তাঁদের সৃষ্টিকর্মে গণচেতনার কথা এসেছে সরাসরি, প্রত্যক্ষভাবে – পূর্বতন ধারার মতো রূপক বা আবরণের আশ্রয়ে নয়।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – এই সিকি-শতাব্দীতে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহ আমাদের ছড়াকাররা অসামান্য ব্যঞ্জনা এবং দুর্মর সাহসের সঙ্গে শব্দে আর ছন্দে ধারণ করেছেন। প্রাক্-মুক্তিযুদ্ধ পর্বের দুটো প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা ভাষা-আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যে উজ্জ্বলভাবে চিত্রিত হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনে ভাষা-আন্দোলনের মতো প্রভাবসঞ্চারী কোনো অনুষঙ্গ নেই। ভাষা-আন্দোলনের প্রেরণায় রচিত ছড়াসমূহের দিকে তাকালেই আমরা একথা সম্যক উপলব্ধি করতে পারি। অনেক কবি এবং ছড়াকার ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছড়া লিখেছেন, গণচেতনাকে জাগ্রত করে মুক্তির সড়ক নির্মাণই যার মৌল উদ্দেশ্য। ভাষা-আন্দোলনের প্রেরণায় রচিত উজ্জ্বল কিছু ছড়া নিচে উদ্ধৃত হলো –
ক. ফেব্র“য়ারীর একুশ তারিখ/ দুপুরবেলার অক্ত/ বৃষ্টি
নামে, বৃষ্টি কোথায়?/ বরকতেরই রক্ত।/…
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে,/
বাংলা আমার বচন, আমি/ জন্মেছি এই
বঙ্গে। (আল মাহমুদ, ‘একুশের ছড়া’)

খ. পাকিস্তানের জিন্না/ রাষ্ট্রভাষা বাংলাটারে/
কইরাছিলেন ঘিন্না/ তেনার পরে লাট বেলাটে/
দেশটা নিলেন কিন্যা/ পঁচিশ বছর পাঁকের পাকে/
মানুষ গেছি চিন্যা,/ অহন ঘুমের দিন না/
স্বাধীনতার বাইদ্য বাজাও/ নাচো তা ধিন
ধিন না। (মাহবুব তালুকদার, ‘অন্তর মন্তর’)

গ. ফেব্র“য়ারীর একুশ মানে আগুন -/ ডাক দিয়ে যায়
বীর জনতা জাগুন।/ ফেব্র“য়ারীর একুশ মানে নদী -/
ভাসায় স্রোতে ব্যর্থ রাজার গদী/ ফেব্র“য়ারীর
একুশ মানে ফুল -/ সাজাই আমার বোনের
মাথার চুল/ ফেব্র“য়ারীর একুশ মানে ধরো -/
আলবদরের গুষ্টি নিপাত করো…।
(ফারুক নওয়াজ, ‘একুশ সংক্রান্ত’)

ঘ. আমার, তোমার/ কোটি জনতার/ চোখের
মণির আগুনের প্রিয় : / অমর একুশে/ খোঁজে
অনিবার/ গণসংগ্রাম : কল্যাণীয়।
(দিলওয়ার, ‘একুশ’)

ঙ. কেমন করে খবরটা ভাই/ পারলো সবাই জানতে/
হা রে-রে-রে বিদ্রোহটা/ লাগলো দেশের প্রান্তে;/
বলেন রাজা, হায় হায় হায়/ প্রজারা সব ক্ষুব্ধ;/
কণ্ঠ ওদের কেমন করে/ করবো এখন রুদ্ধ,/
ভাষাটাকেই নিন না কেড়ে/ বুদ্ধি দিলেন মন্ত্রী,/
হেঃ হেঃ হেঃ একেই বলে/ আসল গণতন্ত্রী।
(মাহমুদ উল্লাহ, ‘ভাষাটাকে নিন না কেড়ে’)

– উপর্যুক্ত পাঁচটি ছড়াতেই ভাষা-আন্দোলন আমাদের ছড়াকারদের চেতনায় কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, জাগ্রত করেছে এদেশের গণচেতনাকে, তার পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। ভাষা-আন্দোলনের পথ বেয়েই যে এদেশের মানুষ নতুন একটা দেশের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছে, ছড়াগুলোতে তার চিত্র ফুটে উঠেছে, যেমন ফুটে উঠেছে নির্মলেন্দু গুণের এই অসামান্য ছড়াটিতে –

তোমরা না হয় সুখেই আছো
খাচ্ছো বসে বাংলাদেশের টাটকা ঘি,
কিন্তু যাদের দিনের শেষে
ভাত জোটে না তাদের কি?

দোষ হবে কি কেউ যদি এ
অবস্থাটার শেষ চায়?
ভাত না পাওয়া মানুষগুলি
আবার যদি একটি নতুন দেশ চায়?
(নির্মলেন্দু গুণ, ‘যদি’)

বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের মতো ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানও বাংলাদেশের ছড়াকারদের চেতনায় তোলে প্রগাঢ় সংবেদনা। ফলে এই অভ্যুত্থান নিয়ে রচিত হয় অনেক শিল্প-সফল ছড়া। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান গোটা বাংলাদেশকেই কাঁপিয়ে দেয়, কাঁপিয়ে দেয় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতার ভিতকে। ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ছড়াশিল্পীরা এসময় অনেক ছড়া লিখেছেন – যেসব ছড়ার শরীরে ও সত্তায় জড়িয়ে আছে মহান গণঅভ্যুত্থানের আবেগ আর উত্তাপ। উদ্ধৃত ছড়াগুচ্ছে আমরা ঊনসত্তরে বাঙালির ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশাল জাগরণের ছবি প্রত্যক্ষ করি –

ক. ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/
দুয়োর বেঁধে রাখ।/ কেনো বাঁধবো দোর জানালা/
তুলবো কেনো খিল?/ আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/
ফিরবে সে মিছিল।/ ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ ট্রাকের
মুখে আগুন দিতে/ মতিউরকে ডাক।/ কোথায় পাবো
মতিউরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে।/ তোরাই তবে সোনা-
মানিক/ আগুন জ্বেলে দে।
(আল মাহমুদ, ‘ঊনসত্তরের ছড়া’)

খ. তারা থাকে কভু জলে, কভু খোঁজে ডাঙ্গা,/ রাজনীতি
নিয়ে তারা সাজে মাছরাঙ্গা/… কভু তারা বাণী
বেচে জনতার পক্ষে,/ বয় কতো জলধারা ফোলা
ফোলা চক্ষে।/ এইসব লোকগুলো সুযোগের শিকারী,/
ভরা পেটে হাঁক ছাড়ে :/ আমি দীন-ভিখারী।
(দিলওয়ার, ‘ঊনসত্তরের ছড়া’)

গ. এ ফুল বনে আগুন জ্বালে/ আকাশটা লাল করে/
পথে এ ফুল রক্ত ঝরায়/ প্রাণকে দীপ্ত করে।/
এ ফুল সবার বুকের মধ্যে,/ নিত্য এ ফুল ফুটুক/
ঘরে-বাইরে শীত কেটে যাক/ দমকা হাওয়া
ছুটুক।
(নিয়ামত হোসেন, ‘ঊনসত্তরের ছড়া’)

ঘ. কাঁধ থেকে আর নামছি না তো/ নেইকো তাড়াহুড়ো।/
মাথায় নিয়ে নাচো সবাই,/ গানটি সাথে জুড়ো।/
এই না বলে ঢুলতে থাকে/ সাত সাগরের বুড়ো,/
হিশেব কষে দেখছি হলো/ হাজার বছর পুরো।
(শামসুর রাহমান, ‘ঊনসত্তরের ছড়া’)

ঙ. এক দুই তিন/ উঁচু সঙ্গীন।/ চার পাঁচ ছয়/ দেশ জুড়ে
ভয়।/ সাত আর আট/ ভয়ে কেনো কাঠ?/ নয়
দশ এগারো/ বশ নই কারো।/ বারো তেরো
চোদ্দ,/ ভেবে কেনো হদ্দ?/ পনের আর ষোল/
জোর দাবী তোল।/ সতেরো আঠারো/ আরো রক্ত,
আরো -/ উনিশ আর কুড়ি/ (ওরা) – ভয়ে
জুজুবুড়ি।
(শাহরিয়ার কবির, ‘ঊনসত্তরের ছড়া’)

চ. দুষছে তবু দুষছে/ শহর ঢাকা রক্তরাঙা/ যখন
দারুণ ফুঁসছে/ আহাম্মকের স্বর্গে বসে/ দুষছে তবু
দুষছে।/ ফুঁসছে ফুঁসছে/ পিণ্ডি লাহোর খুলনা
যশোর/ দারুণ ক্রোধে ফুঁসছে।/ কী নির্বোধ,
ছুঁড়ছে তবু বুলেট ও গ্যাস ছুঁড়ছে/ কথায় কথায়
বর্বরতার সঙ্গীন-ফলায় ফুঁড়ছে/ কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্তের
হত্যাযজ্ঞ জুড়ছে;/ ছুঁড়ছে গুলী ছুঁড়ছে/ কর্মী-নেতা
নির্বিচারে/ জেলখানাতে পুরছে/ আহাম্মকের স্বর্গে
বসে/ নিজের কবর খুঁড়ছে।
(শুভ রহমান, ‘স্বর্গবাসীকে’)

ছ. এদেশের পাট বেচে/ ওদের পানি ছেঁচে/ পেলাম
মালা গলে/ মালা নাকি ফাঁস হবে ভাই/
দুষ্ট লোকে বলে।/ দেশের সিন্দুক খুলে/ পরকে
দিলাম তুলে/ তাইতে খয়ের খাঁ/ সবাই এখন
তেড়ে আসে/ দেশ থেকে তুই যা।
(সরদার জয়েনউদ্দীন, ‘ঊনসত্তরের ছড়া’)

জ. ভাবতে ভাবতে যখন চোখে/ কাটলো ধুলোর বাধা/
চিনলো সবাই, বন্ধু বেশে/ কালকেউটের দাদা/
কিংবা বিকট হালুম-দেঁতো/ মানুষ খেকোর খুড়ো/
ঠাঁই নিয়েছে কাঁধে যেমন/ সিন্দাবাদের বুড়ো।/ জিন-
খ্যাদাবার মন্ত্রপড়া এখন মরিচ-গুঁড়ো/ হাজার
হাজার ভাঙা কুলোয়/ উড়ো সবাই উড়ো।
(সিকান্দার আবু জাফর, ‘ঊনসত্তরের ছড়া’)

ঝ. হারাধনের দশটি ছেলে দেশের কথা কয়/ একটি
গেলো দ্বীপান্তরে রইলো বাকী ৯ -/… হারাধনের
চারটি ছেলে চাইলো নতুন দিন/ একটি গেলো
সূর্যোদয়ে রইলো বাকী ৩ -/ হারাধানের তিনটি
ছেলে তুলতে গেলো যুঁই/ একটি ম’লো সাপের
বিষে রইলো বাকী ২ -/ হারাধনের দুইটি ছেলে
বলে ‘সাহস দ্যাখ’/ একটি গেলো আগুন জ্বেলে
রইলো বাকী ১ -/ হারাধনের একটি ছেলে একলা
লড়াই করে/ লক্ষকোটি ভাই আছে তার আলোক-জ্বালা
ঘরে॥
(সৈয়দ শামসুল হক, ‘হারাধনের দশটি ছেলে’)

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিস্রোতে øাত হয়ে এদেশের ছড়াকারেরা আরো অনেক ছড়া রচনা করেছেন। ওপরে উদ্ধৃত ছড়াসমূহে ঊনসত্তরের মহান অভ্যুত্থানের নানামাত্রিক ছবি ফুটে উঠেছে। আল মাহমুদের ছড়ায় আছে গণঅভ্যুত্থানের নায়ক আসাদ ও মতিউরের কথা, পক্ষান্তরে শাহরিয়ার কবিরের ছন্দোবদ্ধ শব্দগুচ্ছে আছে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের অগ্নিগর্ভ দিনের কথা, আছে বাঙালির সম্মিলিত জাগরণে ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকদের দুশ্চিন্তার কথা। শুভ রহমানের ছড়ায় আছে সামরিক শাসকদের অত্যাচার আর নির্যাতনের কথা এবং একই সঙ্গে ওই অপশক্তির আসন্ন পরাজয়ের পূর্বাভাস। সরদার জয়েনউদ্দীনের ছড়ায় উন্মোচিত হয়েছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আঁতাতকারী এদেশীয় দালালদের প্রকৃত চেহারা। সৈয়দ শামসুল হক যোগীন্দ্রনাথ সরকারের লোকছড়া ভেঙে বাঙালির সমুত্থিত জাগরণকে অসামান্য ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন। সৈয়দ হক তাঁর শেষ চরণটির মাধ্যমে বাঙালির অভীকসত্তাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন, নির্মাণ করেছেন বাঙালির সংঘচেতনার চিরায়ত শব্দধ্বনি। শামসুর রাহমানের ছড়ায় ফুটে উঠেছে হাজার বছর ধরে শোষিত-নির্যাতিত বাঙালির দুঃখের কথা। নিয়ামত হোসেনের ছড়ায় আছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের রক্তধারায় øাত সমবেত বাঙালির রক্তিম উজ্জীবনের ছবি। তিনি প্রত্যাশা করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সমবেত বাঙালির রক্তিম অভ্যুদয় – আকাক্সক্ষা করেছেন রক্তদানের মহোৎসবের মিছিল। সিকান্দার আবু জাফরও জেগে ওঠেন শব্দের আয়ুধ হাতে, জাগাতে চান মিলিত বাঙালিকে। তাই তিনি ঔপনিবেশিক শক্তির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সকলকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান, উচ্চারণ করেন কোটি বাঙালির এই মিলিত সংক্ষোভ – ‘উড়ো সবাই উড়ো’।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব কালখণ্ডেই আমাদের ছড়া লোকছড়ার চারিত্র্য অতিক্রম করে ক্রমশ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক। এদেশের অনেক ছড়াকার লোকছড়ার টুকরো স্মৃতির মধ্যেই নিয়ে আসেন রাজনৈতিক বক্তব্য। এ-ধারায় চারজন ছড়াকারের কথা বিশেষভাবে মনে আসে, তাঁরা হচ্ছেন – ফয়েজ আহমদ, সরদার জয়েনউদ্দীন, রফিকুল হক এবং এখলাসউদ্দিন আহমদ। লোকমানসে গণচেতনা সঞ্চারের লক্ষ্যে এইসব শিল্পী লোকছড়ার মধ্যেই প্রগত রাজনৈতিক ভাষ্য উপস্থাপন করেন এবং তা লাভ করে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা। নিচের উদ্ধৃতি-চতুষ্টয়ে আমরা লক্ষ করবো লোকছড়া কীভাবে পরিণত হচ্ছে রাজনৈতিক চেতনাঋদ্ধ আধুনিক ছড়ায় –
ক. বলল সবে : রাজার গাড়ি
বেজায় আড়ি করে
না নড়ে যে পথের মোড়ে
সাড়ে সাত দিন ধরে।
এলাম দেখে সত্যি তারে
রাগ করে এক ভীষণ ষাঁড়ে
রেখেছে পথ আগলে।
রাজা কাঁদে : কেমন হবে
বাঘটা এখন রাগলে।
(ফয়েজ আহমদ, ‘রাজা কাঁদে’)

খ. এদেশটারে বেচে
গান গেয়ে আর নেচে
পেলাম একটা নরুণ
নাকটা গেলো কি আসে যায়
ভাই ভাতিজা ধরুন।

চালধান সব লুকিয়ে
দেশবাসীরে শুকিয়ে পেলাম কিছু-হাসি
ঘরে এসে দেখছিরে ভাই
হাসি নয় সে কাশি।
(সরদার জয়েনউদ্দীন, ‘ঊনসত্তুরের ছড়া’)

গ. ছেলে ঘুমুলো বুড়ো ঘুমুলো
ভোলা দ্বীপের চরে
জেগে থাকা মানুষগুলো
মাতম শুরু করে।
ঘুমো বাছা ঘুমোরে
সাগর দিলো চুমুরে
খিদে ফুরুলো জ্বালা জুড়ুলো
কান্না কেনো, ছি!
বাংলাদেশের মানুষ, বুকে
পাষাণ বেঁধেছি।
(রফিকুল হক, ‘গর্কি ’৭০’)

ঘ. আতা পাতা ঘি চাপটা
ধর প্যায়দার কানটা
যখন তখন ইচ্ছে মাফিক
নিচ্ছে লুটে ধানটা;
ঢ্যাম কুড়কুড়ে ঘোরাও লাঠি
বাজাও ঝাঁঝর বাদ্যি,
আদ্যিকালের দেখিয়ে চোতা
ধান লোটে কার সাধ্যি।
(এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ, ‘বাজাও ঝাঁঝর বাদ্যি’)

– ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন – ‘[ছড়ার] মধ্যে ভাবের পরস্পর সম্বন্ধ নাই,… কতকগুলি অসংলগ্ন ছবি নিতান্ত সামান্য প্রসঙ্গসূত্র অবলম্বন করিয়া উপস্থিত হইয়াছে।… গাম্ভীর্য নয়, অর্থের মারপ্যাঁচ নয়, সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণ।… ছড়াগুলিও ভারহীনতা অর্থবন্ধনশূন্যতা এবং চিত্রবৈচিত্র্যবশতই চিরকাল ধরিয়া শিশুদের মনোরঞ্জন করিয়া আসিতেছে’ (ঠাকুর, ১৯৮৭ : ২৩)। ছড়া সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি চতুষ্টয়ের ক্ষেত্রে সর্বাংশে প্রয়োগ করা যায় কি? উদ্ধৃতিসমূহে পাওয়া যায় সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য, লোকছড়ার অসংলগ্নতা কিংবা অর্থহীনতার অভিযোগ থেকেও ছড়াংশগুলো মুক্ত। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তীকালেই বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্য এই গণচেতনার ধারায় বিকশিত হয়েছে, উত্তরকালে যা অর্জন করে নতুন-নতুন মাত্রা।
স্বাধীনতার সোনালি প্রভায় আমাদের মন আর মননে যে নতুন চেতনা জাগ্রত হয়েছে, সাহিত্যে তার প্রতিফলন ছিল একান্তই প্রত্যাশিত। স্বাধীনতাচেতনা বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের পুনর্জাত করেছে নতুন মূল্যবোধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে তাঁরা অনেকেই হতে চেয়েছেন একেকজন নতুন মুক্তিযোদ্ধা। এই সময়খণ্ডে সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে আমাদের সাহিত্যিকরা শাণিত হাতে বেছে নিলেন শিল্প-আয়ুধ। বাংলাদেশের ছড়াকাররাও এর ব্যতিক্রম নন। ১৯৭১-উত্তর কালে মুক্তিযুদ্ধকে মৌল ভরকেন্দ্রে রেখে রচিত হয়েছে অনেক ছড়া। চকিতে চয়ন করা এমন কিছু ছড়াংশ নিচে উদ্ধৃত হলো –

ক. ফিরলো না আর জোয়ান পুত
লড়তে গিয়ে সেই বছর,
পড়তে গেলে চন্দ্রমুখী
দস্যু সেনা দেয় কবর।

ওদের বাবা বুড়ো মানুষ
সেও চোখের শূল হলো
পোড়ালো গ্রাম ছুড়লো গুলি
সেই দিনেতে সেও ম’লো।
(নূরুল আবসার, ‘একাত্তরের ছড়া’)

খ. হুজুর আপনি কে ভাই?
: টিক্কা মেরা মে ভাই;
ইচ্ছে হলেই বঙ্গবাসীর
জীবন প্রদীপ নেভাই।

মিথ্যা মাথা ঘামাই –
আমি কিন্তু বাংলাদেশী
ইয়াংকিদের জামাই।
(ফারুক নওয়াজ, ‘জামাই’)

গ. দেখিনি হায়েনা-হানাদার, আর
দেখিনি শহীদ ভাইকে আমার
দেখিনি কিভাবে শহরে-নগরে
বয়েছে রক্তবন্যা,
জীবন দিয়েছে তিরিশ লক্ষ
স্ত্রী-পুত্র-কন্যা।

সারা পৃথিবীর ঘড়িগুলো যদি
আবার উল্টো ঘোরে,
ঠিক ঠিক যাবো মুক্তিযুদ্ধে
কোনো একদিন ভোরে।
(শাহাবুদ্দীন নাগরী, ‘মুক্তিযুদ্ধ’)

ঘ. কনতো দেহি আইজকা দ্যাশে
সবচে শরীল তাজা কার?
– যেই শালারা রাজাকার।

পাইল্টে লেবাস কোন ব্যাটারা
আইজ সমাজে পায় কদর?
– যেই শালারা আল-বদর।

গদির পাশে বইছে ক্যাডা?
কইরা হারাম হালালরে।
– একাত্তুরের দালাল রে।
(লুৎফর রহমান রিটন, ‘প্রশ্নোত্তর’)

ঙ. ফিরছে আবার গুটিগুটি পা-য় তারা
একাত্তরে ছিল প্রভুর পা-য় তারা।
আজকে দেখি আবার তারা ফিরছে
নতুন প্রভুর পায়ের তলায় ভিড়ছে।
এবং আরো করছে তারা পাঁয়তারা,
চাঁদ-তারাতে তুলতে নিশান চায় তারা।
(শুচি সৈয়দ, ‘পাঁয়তারা’)

চ. ধর রাজাকার ধর
ছালার ভেতর ভর
ইচ্ছেমতো মাসুল দিয়ে
বাংলা ছাড়া কর।…
সব রাজাকার আটকা
দেশের বুকে মৌলবাদরে
কবর দেবো টাটকা।
(সৈয়দ এনাম-উল আজিম, ‘ধর রাজাকার’)

ছ. আমার আছে স্বাধীনতা
সোনার বরণ দেশ,
একাত্তরের স্মৃতিগাথায়
মুক্ত পরিবেশ।
আমার আছে স্বাধীনতা
কণ্ঠে মধুর গান
লাল সূর্য সবুজ জমিন
বাংলাদেশের প্রাণ।
(আলম তালুকদার, ‘আমার আছে স্বাধীনতা’)

জ. কায়দে আজম আব্বা আমার
গোলাম আযম চাচ্চা
ভাইয়া আমার আল বদর আর
রাজাকারের বাচ্চা।
(আসলাম সানী, ‘নব্য রাজাকার’)

ঝ. একাত্তুরের খুন খারাপি
সব-ই ছিল হালাল
খান সাহেবের মুখের ভাষায়
মুক্তিরা সব দালাল!

খান সাহেবের যাদুর ফানুস
উড়িয়ে দেবেই দেশের মানুষ।
(সিরাজুল ফরিদ, ‘লাগাম টেনে ধর’)

– উদ্ধৃত নয়টি ছড়াংশেই ছড়িয়ে আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নানামাত্রিক অনুষঙ্গ। নূরুল আবসারের ছড়ায় পাওয়া যায় একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার ছবি; পক্ষান্তরে ফারুক নওয়াজের ছড়ায় আছে হানাদার বাহিনীর প্রতি স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের মুগ্ধতার কথা। লুৎফর রহমান রিটন, সৈয়দ এনাম-উল আজিম, শুচি সৈয়দ, আসলাম সানী প্রমুখের ছড়ায় উচ্চারিত হয়েছে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা। আলম তালুকদারের ছড়াতেও আছে একাত্তরের স্মৃতি। সিরাজুল ফরিদ যেখানে কামনা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের আসন্ন বিজয়, সেখানে শাহাবুদ্দীন নাগরী ঘড়ির কাঁটা উলটে দিয়ে নিজেই হতে চেয়েছেন সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ছড়াকাররা অনেক ছড়া লিখেছেন। আমরা এখানে তার কয়েকটা উদ্ধৃত করেছি মাত্র। উচ্চারিত-অনুচ্চারিত সেইসব ছড়ার আলোকে একথা বলা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর কালখণ্ডে বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্য অর্জন করেছে স্বতন্ত্র এক মাত্রা। আমাদের ছড়া এখন ক্রমশ হতে চেয়েছে মৃত্তিকাসংলগ্ন, দেশকাল-সম্পৃক্ত। অলৌকিকতা, যুক্তিহীনতা আর স্থূল আনন্দের পরিবর্তে সেখানে এসেছে রাজনৈতিক চেতনা, এসেছে সুস্পষ্ট বক্তব্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যুদ্ধোত্তরকালে লেখা হয়েছে অনেক ছড়া। এসব ছড়ায় বঙ্গবন্ধুর সাহস, সংগ্রাম, ত্যাগ আর তাঁর ট্র্যাজিক পরিণতির চিত্র শিল্পিত হয়েছে। ছড়াকাররা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছড়া লিখে প্রকাশ করেছেন তাঁদের জাতীয়তাবাদী চেতনা, উচ্চারণ করেছেন হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে তাঁদের তীব্র সংক্ষোভ। বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর আহ্বানে কীভাবে জেগে উঠেছিল সারা দেশ, সেকথা ব্যক্ত হয়েছে শাহাবুদ্দীন নাগরীর ছড়ায় – ‘স্বাধীন করো – শেখ মুজিবের/ এইটুকু নির্দেশে,/ যার যা ছিলো তাই নিয়ে সব/ জাগলো সারা দেশে’ (শাহাবুদ্দীন নাগরী, ‘স্বাধীনতার ছড়া’)। বঙ্গবন্ধুই যে আমাদের স্বাধীনতার প্রধান স্থপতি, ‘মুজিব’ নামটাই যে স্বাধীনতার সমার্থক সে-কথা ব্যক্ত করেছেন নির্মলেন্দু গুণ এভাবে – ‘মুজিব অর্থ আর কিছু না/ মুজিব অর্থ মুক্তি;/ পিতার সাথে সন্তানের সে/ না লেখা প্রেম চুক্তি।/ মুজিব অর্থ আর কিছু না/ মুজিব মানে শক্তি,/ উন্নত শির বীর বাঙালির/ চিরকালের ভক্তি’ (নির্মলেন্দু গুণ, ‘মুজিব মানে মুক্তি’)। ১৯৭৫ সালে আগস্ট-ট্র্যাজেডির পর অনেক ছড়াকারই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন, কেউবা হত্যাকারীর বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন তীব্র ক্ষোভ। সেই বিরুদ্ধ সময়ে আমাদের কয়েকজন ছড়াকার পালন করেছিলেন সাহসী ভূমিকা। নিুে এমন কিছু সাহসী উচ্চারণ উপস্থাপিত হলো –

ক. শরম লাগে শরম
‘বঙ্গবন্ধু’ নামটা নিতে
দারুণ লাগে শরম।

ছি ছি ছি ছি
বলছো এসব কি
কবে আমি ‘জয়বাংলা’
শ্লোগান দিয়েছি?
ঢাকতে শরম মক্কা থেকে
বোরখা এনেছি।
(আবদুল আজিজ, ‘শরম লাগার ছড়া’)

খ. যেই ছেলেটা শিখিয়ে ছিলো
কেমোন করে বাঁচতে হয়
অস্ত্র দেখে ভয় না পেয়ে
মুক্তি নেশায় নাচতে হয়…

যেই ছেলেটা আলোর শিখা
দেখিয়ে ছিলো অন্ধকারে
সেই ছেলেকেই করলো কে খুন
কোন সে ঘাতক, খন্দকারে?
(লুৎফর রহমান রিটন, ‘একটি ছেলের কথা’)

গ. কীর্তি তোমার ধুয়ে মুছে কেউ
পারবে না কভু করতে শেষ
মিছিলে মিছিলে দীপ্ত শপথে
বাহু বলো আজ জঙ্গী কার?
জাতির পিতার ভাবমূর্তিকে
মুছে ফেলে যারা বারে বারে
কতকাল তারা ধোঁকাবাজী দেবে
এই জনতার দরবারে?
হাতে-হাতে আজ তোমারই পতাকা
মুখে যে তোমারই অঙ্গীকার।
(আলতাফ আলী হাসু, ‘অঙ্গীকার’)

ঘ. ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি কুতুর কুতুর ছা,
টুঙগি পাড়া শেখের বাড়ি উইড়া সেথায় যা।
সেইখানেতে রাখাল রাজার ছোট্ট কবরখানি,
সন্ধ্যে সকাল ঝরায় কেবল লক্ষ চোখের পানি।
(খালেক বিন জয়েনউদ্দীন, ‘রাখাল রাজার জন্যে’)

– উদ্ধৃত চারটি ছড়াংশেই প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা আর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সংক্ষোভ। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী সমাজ যখন প্রবলভাবে আত্মবিবরবাসী, তখন বাংলাদেশের নবীন ছড়াকাররা হয়ে উঠলেন সংক্ষোভের মূর্ত প্রতীক। পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডির পর বঙ্গবন্ধুর নামটাই রাজনীতিবিদদের কাছে ছিল নিষিদ্ধ এক বস্তু। আবদুল আজিজের ছড়ায় ধরা পড়েছে সে-সময়ে রাজনীতিবিদদের শরম লাগার কৌতুককর বৃত্তান্ত। ১৯৭৫-এ খন্দকার মোশতাক আহমদ চক্রের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা ব্যক্ত হয়েছে লুৎফর রহমান রিটনের ছড়ায়। আলতাফ আলী হাসুর ছড়ায় উচ্চারিত হয়েছে সমস্ত ষড়যন্ত্রের মুখেও বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী অঙ্গীকারের কথা। খালেক বিন জয়েনউদ্দীন লোকছড়াকে ভেঙে নির্মাণ করেছেন নতুন ছড়া, সেখানে রূপায়িত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্য লক্ষ মানুষের ভালোবাসা ও অশ্র“-বিসর্জনের চিত্র।
ঔপনিবেশিক আমলে দেশের মুক্তি এবং মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সংগ্রামী এই জননেতাকে নিয়েও ছড়াকার পঙ্ক্তি সাজিয়েছেন – ‘এলো ফিরে স্পন্দন ঝিঁঝিঁ ডাকা গ্রামে/ ভাসানীর রথ যবে সন্তোষে থামে/… মহাজনে সুদ-জাল পেতে ফেলে ফাঁদে/ চড়া সুদে কৃষকের সুখটাকে বাঁধে/ ফড়িয়াতে ছেয়ে যায় আকাশের কোণ/ ভুখানাঙা মানুষের আহাজারি সেই/ দূর করা সহৃদয় কারো দেখা নেই/ মমতার হাত মেলে দাঁড়ালেন তিনি/ জননেতা মজলুম যাঁকে বলে চিনি’ (হুমায়ুন তালুকদার, ‘জননেতা মজলুম’)। ইতিবাচক রাজনীতির পাশাপাশি স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদের স্বরূপ উন্মোচনেও ছড়াকাররা মুখর। ভোটের সময় জনবিচ্ছিন্ন অসৎ রাজনীতিবিদের ছবি শিল্পিতা পেয়েছে ত্রিদিব দস্তিদারের ছড়ায় –

আবার নাকি ভোট আসছে
আসছে মাছের টোপ
জনগণের মাথায় এবার
কুড়োল দেবে কোপ।
আবার নাকি ভোট আসছে
আসছে বেচা-কেনা
মুখোশ পরে মুখ ছুটেছে
যায় না তাদের চেনা।
(ত্রিদিব দস্তিদার, ‘চলতি ছড়া’)

ভোটের সময় যেনতেন করে জয়লাভের আশায় রাজনৈতিক আদর্শবর্জিত জোটের জন্ম হয়, কখনো আদর্শগত দিক থেকে বিপরীতধর্মী দুই দল একই জোটে আবদ্ধ হয়। জনগণকে অন্ধকারে রেখে রাজনীতিবিদের এমন অপচেষ্টা আমাদের ছড়াকারদের পঙ্ক্তিমালায় উন্মোচিত হয় এভাবে – ‘আন্দোলনের/ বইলো জোয়ার/ আমাদের এই দেশটাতে,/ ইঁদুর বিড়াল/ জোট বাঁধিল/ টিকবে কি তা শেষটাতে’ (এম. এ. ছাত্তার উকিল, ‘জোট’)। আখতার হুসেনের ছড়ায় আছে মন্ত্রীদের উপদেশদানের উদারতার ছবি – ‘ছিঃ ছিঃ ছি/ স্ট্রাইক, প্রোসেশন/ এইসব কি?/ তার চেয়ে হও বাবা/ সি-এস-পি’ (আখতার হুসেন, ‘একজন মন্ত্রীর ভাষ্য’)।
স্বাধীনতার পর দেশজুড়ে নেমে আসে অরাজকতা-অস্থিরতা, ঘুষ-দুর্নীতি-সন্ত্রাসে ছেয়ে যায় দেশ। সচেতন ছড়াকার এ অবস্থায় হয়ে ওঠেন সরব, তাঁরা শব্দের আয়ুধ নিয়ে এগিয়ে আসেন সামূহিক বিপন্নতা ও বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে। রাজনীতি-ক্ষেত্রে আদর্শ উবে যায়, দেখা দেয় ধামাধরা ব্যক্তিদের দৌরাত্ম্য। হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ প্রসঙ্গত লিখেছেন – ‘তিনি নাকে নস্যি পোরেন/ ইনি তাতেই হ্যাঁচ্চো করেন/ তিনি পোলাও কোর্মা খেলে/ ইনি চোয়া ঢেঁকুর তোলে।/ তিনি যখন নৌকা ভাসান/ ইনি তোলেন পাল,/ ইনি যখন বৈঠা মারেন/ তিনি ধরেন হাল’ (হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ, ‘ইনি এবং তিনি’)। ঘুষ-দুর্নীতি-চোরাকারবারের ছবি চিত্রিত হয়েছে দীপঙ্কর চক্রবর্তীর ছড়ায় – ‘নাম কিনেছেন বাজারে খুব/ চোরাই মালের কারবারে/ এস. এস. সিতে পাশ করেছেন/ এক, দুই, তিন – চারবারে।/ নিত্য নতুন হাঁকান গাড়ি,/ ইচ্ছে হলেই বিদেশ পাড়ি,/ সময় সুযোগ বদলে গেলে/ ভোল বদলায় বারবার-এ’ (দীপঙ্কর চক্রবর্তী, ‘ছড়া’)। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিরুদ্ধ সময়ের ছবি ফয়েজ আহমদ রূপ দিয়েছেন এভাবে – ‘হাতে পেলে অস্ত্র/ তবেই সশস্ত্র!/ হাতে পেলে বন্দুক/ লুণ্ঠনে কি যে সুখ!/ হাতে পেলে অর্থ -/ তুচ্ছ এ মর্ত্য।/ হাতে পেলে রাজ্য/ জনগণ ত্যাজ্য’ (ফয়েজ আহমদ, ‘পঞ্চমন্ত্র’)। দেশের এই সামূহিক অব্যবস্থা আর সাধারণ মানুষের চরম অসহায়তা নিয়ে ছড়া লিখেছেন তপংকর চক্রবর্তী – ‘সারাদিন খেটে যদি খাটুনির দাম চাও/ হুজুরের চোখ লাল, তেড়ে আসে চামচাও,/ হুজুরেরা আজকাল বিনা কাজে নাম চায়/ তাই দেশ ভরে গেছে চাটুকার-চামচায়।/ জীবনের দাম নেই এক কানা কড়িও/ এর চেয়ে বেশি দামি কলস আর দড়িও,/ অফিসে ও আদালতে তোঘলকী কারবার/ এক কাজে ঘুষ দাও অন্তত চারবার’ (তপংকর চক্রবর্তী, ‘বর্তমানের ছড়া’)। দেশের সামূহিক অব্যবস্থা ও বিপন্নতা এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ছড়াকার এতোই বিক্ষুব্ধ যে, তাঁর শব্দস্রোতে ধ্বনিত হয় এই দ্রোহী ভাবনা –

ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা
রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা!…
বাঁচতে চেয়ে খুন হয়েছি বুলেট শুধু খেলাম
উঠতে এবং বসতে ঠুঁকি দাদার পায়ে সেলাম!
(আবু সালেহ, ‘স্বাধীনতা’)

বাংলাদেশের ছড়াকাররা কেবল দেশের ভূগোলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন, বৈশ্বিক ভাবনাতেও তাঁরা কখনো কখনো মুখর হয়ে উঠেছেন। আমীরুল ইসলামের ছড়ায় পাওয়া যায় এমন এক বৈশ্বিকচেতনার ছায়াপাত। পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে এভাবে – ‘কেনো বা যুদ্ধে পৃথিবী মত্ত,/ কোনটা মিথ্যে কোনটা সত্য?/ জেনেও আমরা আজকে ক্রুব্ধ/ মরছি তবুও করছি যুদ্ধ।/… পারমাণবিক বোমাতে বোমাতে/ যুদ্ধ চলছে আমাতে-তোমাতে।/ কেউ বা সিংহ কেউ বা বিচ্ছু/ কি লাভ যুদ্ধে বুঝি না কিচ্ছু/ খাদ্য নেইকো, নেইকো বস্ত্র/ দুঃখ কি তাতে বানাই অস্ত্র’ (আমীরুল ইসলাম, ‘যুদ্ধ’)।
প্রতিবাদীচেতনা বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। বিভাগ-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের ছড়ায় এই প্রতিবাদীচেতনা কৌতূহলী পাঠককে নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করবে। পাকিস্তান আমলে যেমন, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের ছড়াকাররা প্রতিবাদে মুখর, দ্রোহিতায় শাণিত। ঔপনিবেশিক শাসক আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এমন কিছু পঙ্ক্তি রচিত হয় এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদের হাতে – ‘হরতাল -/ আজ হরতাল/ পেটা ঢাক ঢোল/ ছোঁড় সড়কি/ আন বল্লম/ ধর গাঁইতি/ ধর বর্শা/ দাও হাতে হাত/ এই কাঁধে কাঁধ/ তোল ব্যারিকেড/ গড়ো প্রতিরোধ/ কালো দস্যির/ ভাঙো বিষ দাঁত/ ধরো হাতিয়ার/ করো গতিরোধ/… খোল করতাল/ আজ হরতাল’ (এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ, ‘হরতাল’)। উত্তরকালের ছড়াকারদের সৃষ্টিতেও আমরা অভিন্ন চেতনার প্রকাশ লক্ষ করি –

ক. ছুঁড়লো টিয়ার গ্যাসের শেল্
ছুঁড়লো পুলিশ গুলি,
ব্যাপার স্যাপার কেমন তরো
উড়িয়ে দিলো খুলি।
সেই খুলিটি কার?
মানে না যে হার –
তার তার তার।
(আইউব সৈয়দ, ‘ছড়া : ১৯৮৭’)
খ. হই চই পড়ে গ্যাছে ননীদের বাসাতে
সে যে হায় নিদারুণ, কমলের ভাষাতে;
ননী পাল কাজ করে জুট মিলে ঢাকাতে
তার গোটা দেহখানা পিষে গেছে চাকাতে।
বাড়িময় কান্নার রোল ওঠে ভাই রে –
আমাদের ননী পাল আর বেঁচে নাই রে!
এইভাবে শত শত ননী পাল মরছে
মেহনতি মজদুর হরতাল করছে।
(ফারুক নওয়াজ, ‘হরতাল-২’)

গ. দশ-ই নভেম্বর আহা দশ-ই নভেম্বর
কে হয়েছে আপন যে তাঁর কে হয়েছে পর
নূর হোসেনের পিতার কাছে
দেশের খবর জানা আছে;
লোকের কাছে প্রশ্ন করেন –
এখন কেনো ওঠে না আর নভেম্বরী ঝড়
দশ-ই নভেম্বর আহা দশ-ই নভেম্বর।
(সিরাজুল ফরিদ, ‘দশ-ই নভেম্বর’)

ঘ. বুলেটবিদ্ধ গণতন্ত্র পিচঢালা পথ লাল
দশই নভেম্বর সকালে চলছিলো হরতাল।…
উঠলো কেঁপে জিপিও মোড়, জিরো পয়েন্ট জিরো
উদোম গায়ে এগিয়ে এলো দুরন্ত এক হিরো।…
বুকে পিঠে শ্লোগান লেখা জীবন্ত পোস্টার
এমনতরো কাণ্ড দেখে অবাক স্বৈরাচার –
দিনদুপুরে গণতন্ত্র হুমড়ি খেয়ে পড়ে
জীবন্ত পোস্টারের ছবি পাভেল তুলে ধরে।
বন্ধু আমার, সাথী আমার, নূর, সাহসী বীর
গণতন্ত্রের প্রতীক তুমি, উঁচু তোমার শির।
(লুৎফর রহমান রিটন, ‘বুলেটবিদ্ধ গণতন্ত্র’)
– উপর্যুক্ত প্রতিটি ছড়াতেই পাওয়া যাবে অত্যাচার-শোষণ- স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ প্রতিবাদের ছবি। এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদের ছড়ায় আছে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা; পক্ষান্তরে আইউব সৈয়দ, ফারুক নওয়াজ, সিরাজুল ফরিদ এবং লুৎফর রহমান রিটনের ছড়ায় অনুভূত হয় আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের উত্তাপ। বিশেষত, সিরাজুল ফরিদ এবং লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের বীর নায়ক শহীদ নূর হোসেনের স্মৃতিকে ধারণ করে হয়ে উঠেছে স্মরণীয় সৃষ্টি।
শাসক ও উচ্চবিত্তের শাসন-শোষণের পাশাপাশি বাংলাদেশের ছড়াশিল্পীরা নিুবর্গের জীবনচিত্রণে বিশেষ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের পঙ্ক্তিমালায় নিুবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রামের নানামাত্রিক ছবি উদ্ভাসিত। বোঝা যায়, সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ছড়াকাররা নির্ভর করতে চেয়েছেন শ্রমজীবী নিুবর্গের মানুষের ওপর। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় নিুোক্ত ছড়াংশগুচ্ছ –
ক. কলুর বলদ সারা জনম
চিনির বস্তা টানি
ঘামের দামে জীবনটাকে
করলাম শুধু পানি।…
যন্ত্রণাতে কুঁকড়ে মরি
কলুর বলদ আমি
আমার ঘামের দামের চেয়ে
চিনি নাকি দামী।
(জাহাঙ্গীর হাফিজ, ‘কলুর বলদ’)

খ. ট্রেন যায় হিশ-হিশ,
বায়ু যায় ফিশ-ফিশ,
চোর যায় চুপ-চাপ,
ট্রাক যায় ধুপ-ধাপ,
গরীবের দিন যায়
কী করে?
কী করে?
কী করে?
জানিবার সাধ হলে
হাত দাও শিকড়ে
শিকড়ে
শিকড়ে
শিকড়ে…।
(আসাদ চৌধুরী, ‘জ্ঞানতত্ত্ব’)

গ. টোলুরাম সুইপার
দেহ তার সম্বল
মোটে নেই ভূঁই তার।…
শত শত টোলুরাম
দাম নেই জীবনের
দেহ থেকে ঝরে ঘাম।
(সিরাজুল ফরিদ, ‘সুইপার’)

ঘ. অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতোগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।

রেশনের পচা চাল
টলটলে বাসী ডাল
থালটাও ভাঙা চোরা
বাটিটাও লিক আছে
খেতে বসে জানালেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
(সুকুমার বড়–য়া, ‘ঠিক আছে’)

ঙ. তিন শেয়ালে মহানন্দে
করছে সভা গোয়ালন্দে।
প্রথম শেয়াল দেখতে তাজা,
বোধহয় তিনি পালের রাজা।…
শেষের শেয়াল শুকনো সোজা
সে বেচারী গরিব প্রজা।
(হোসেন মীর মোশাররফ, ‘তিন শেয়াল’)

– উপরিউক্ত ছড়াগুচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমজীবী নিুবর্গের বহুমাত্রিক দুরবস্থা এবং বিপন্নতার ছবি চিত্রিত হয়েছে। জাহাঙ্গীর হাফিজ ও হোসেন মীর মোশাররফের ছড়ায় অসহায় দরিদ্র প্রজারা যে শক্তিধরের হাতে খেলার পুতুল, সে-কথা রূপায়িত হয়েছে। সুকুমার বড়–য়ার ছড়ায় আছে দরিদ্র মানুষের নিত্যদিনের বিড়ম্বনার কথা। অতিথি এলে দরিদ্র মানুষ খুশি হয় না, হয় বিরক্ত, কেননা অতিথিকে আপ্যায়ন করার মতো তার ঘরে কোনো ব্যবস্থা নেই। নিুবর্গের মানুষকে সম্যক জানার আহ্বান আছে আসাদ চৌধুরীর ছড়ায়। সিরাজুল ফরিদ ছড়া লিখেছেন সুইপারের জীবনকে কেন্দ্র করে।
বাংলাদেশের আদি নৃগোষ্ঠীর জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে বেশ কিছু ছড়া লিখেছেন আদিবাসী ছড়াশিল্পীরা। এসব ছড়া বাংলাদেশের ছড়ায় গণচেতনার ভিন্ন এক মাত্রা। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী কেন্দ্রবিচ্যুত, কেন্দ্রপীড়িত, কেন্দ্রলাঞ্ছিত। বাঙালি জনগোষ্ঠীর নানামাত্রিক নির্যাতনে তাদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। নিচের ছড়াংশসমূহে আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনসংগ্রামের ছবি ভাষারূপ পেয়েছে –
ক. ও সেই দু’টো কর্মী হাত
আমি ভালোবাসি॥…
হাতে তার হেং গরং
মানুষের কথা গায়;
হাতে তার শিঙা
বুকটা কাঁপিয়ে দেয়;
ও সেই দুটো প্রিয় হাত
আমি ভালোবাসি॥
(কবিতা চাকমা, ‘দিয়ান হাত’)

খ. আমি মিশে যাবো পার্বত্য মাটিতে
সকল পাহাড়ি হৃদয় অনুরাগের কলিতে
অধিকার প্রতিষ্ঠার ন্যায্য-দাবি প্রতিজ্ঞা ছুঁয়ে
আমার দেহ আর মন মিশে যাবে
পার্বত্যবাসীর হৃদয়ের মাঝে।
(এম.এ.নু, ‘আমার পার্বত্য মাতৃভূমি’)

গ. মিনিই মিনিই ববয়ৈ
রিনাই নাগিরি কানতিয়ৈ
বরো থাংতি নুং?
য়েসু ঝরা রিনাই তিসাগই
পিতলনি গলা খেপতিয়ৈ
বাসাক নারা ইষাং ইষাং
ব রাজ্যগ থাং?
(কাবেরী ত্রিপুরা রীতা, ‘ব রাজ্যগ ধাও?’)
(বঙ্গানুবাদ : শোনো সখী শোনো/ যাও তুমি কোন দিকে/ রিনাই পরে মুচকি হেসে/ কোন দেশেতে যাও? কাঁখে তোমার কলসি/ কোমরে রুপোর বিছা/ মুচকি হেসে হেলে দুলে/ কোন পাহাড়ে ধাও?)

ঘ. প্লংকেন নঙ্গেঙ তুম আঙ পুং
পুং রাম্মা হর ত প্লাই আঙ দিয়া
পুং দোয়া কিকুন সুন আঙ তম্মা
পুং দুব্ পুং।
(সিংইয়ং ম্রো, ‘ছড়া’)

(বঙ্গানুবাদ : ধান ফড়িং বাঁশি বাজাও/ পাতা ফড়িং নাচ দেখাও/ মেটে ফড়িং ঢোল বাজাও/ তাক ডুমা ডুম ডুম।)

ঙ. সুই দেগিলুং
ম’ আদাম আর আগ ধক্কে নেই
গরমে উর গুন্যা ওই আঘে
নিত্য আঘে দর দর থর থর
চিত খিলে ইত্তুক, পরান।
পেগ-ঝাক আর নেই
তারা হিজিক হাজাক থামেই দোন
ভালক দিন ওই গেল।
(রিপ রিপ চাকমা, ‘ধন্দুক’)
(বঙ্গানুবাদ : আমি দেখলাম/ আমার গ্রাম আগের মতো নেই/ উত্তপ্ত উন্মাদনায় ভরে আছে/ প্রতিটি মুহূর্ত ত্রস্তে/ সাহস ভরে গেছে সংকীর্ণতায়/ পাখিদের ঝাঁক আর নেই/ তাদের কোলাহল থেমে গেছে/ বহুদিন আগে।)

– উল্লিখিত পাঁচটি ছড়াংশে বাংলাদেশের আদিবাসী জীবনের বহুমাত্রিক ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ‘ক’সংখ্যক ছড়ায় চাকমা জনগোষ্ঠীর কর্মিষ্ঠ সত্তার পরিচয় তুলে ধরেছেন কবিতা চাকমা; পক্ষান্তরে এম.এ. নু-র ছড়ায় আছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার-সচেতনতার কথা। রিপ রিপ চাকমার ছড়ায় আদিবাসীদের জীবনে নেমে আসা ভয়াবহ বিপর্যয় ও বিপন্নতার ছবি রূপ পেয়েছে। এ-ছাড়ার মাধ্যমে প্রান্তের ওপর কেন্দ্রের দাপটের প্রসঙ্গও লেখক অসামান্য নৈপুণ্যে তুলে ধরেছেন।
উপর্যুক্ত আলোচনায় বিভাগ-পরবর্তী কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের ছড়ায় গণচেতনার স্বরূপ সম্পর্কে আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা লক্ষ করেছি, পঞ্চাশের দশকের শেষে এসেই বাংলাদেশের ছড়া লোকচারিত্র্যকে অতিক্রম করে ক্রমশ জনজীবনসংলগ্ন এবং জনমুখী হতে আরম্ভ করেছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে এই প্রবণতা হয়েছে আরো বেগবান। রাজনীতি-সচেতনতা আর জনমূলসংলগ্নতাই বাংলাদেশের ছড়ার এখন কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য।

গ্রন্থ ও প্রবন্ধপঞ্জি
আশরাফ সিদ্দিকী, আবহমান বাংলা (ঢাকা : বাংলাদেশ ফোকলোর পরিষদ, ১৯৮৭)।
মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী, লোকসাহিত্যে ছড়া (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৬২)।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লোকসাহিত্য (কলকাতা : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৮৭)।
রোকনুজ্জামান খানের সাক্ষাৎকার, শাপলা দোয়েল (বিশেষ ছড়া সংখ্যা, দৈনিক খবর, ১৬ জানুয়ারি, ১৯৮৮, ঢাকা)।
শাহাবুদ্দীন নাগরী, ‘শামসুর রাহমান : তাঁর শৃঙ্খলিত শিশুসাহিত্য’, মহাকালের বাতিঘর, (চট্টগ্রাম, ১৯৮৬)। 