বাংলাদেশ : গতকাল, আজ, আগামীকাল শুদ্ধচিন্তার মানুষ : সনৎকুমার সাহা

শহিদুল ইসলাম

হাসান আজিজুল হক কথার কারিগর। তাঁর দীর্ঘ ষাট বছরের বন্ধু সনৎকুমার সাহাকে বুঝতে এবং অন্যকে বোঝাতে যদি ব্যর্থ হন, তাহলে বোঝা যায় সনৎ একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ। হাসানের কথায় ‘মহীরুহের বিরাটত্ব বিশালত্ব মহত্ত্ব এক নিঃশ্বাসে বর্ণনা হয়তো করা যায়, ঠিক চেনানো যায় বলে মনে হয় না।’ বইটির প্রথম প্রবন্ধে হাসান এ-কথা বলেন। ১৯৫৮ সালে হাসান ‘দুস্থ সহায়হীন’ অবস্থায় কোনোরকমে রাজশাহী কলেজে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পরিচিত সনতের একটি চেহারা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মাঝখানে বছর বারো বিচ্ছেদের পর ১৯৭৩ সালে হাসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে বিয়ালিস্নশ বছরের কাছাকাছি তাঁরা একসঙ্গেই আছেন। এখনো। অবসরে যাওয়ার পর দুজনই ‘বিহাসে’র নির্জন-শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে একসঙ্গে বাস করেন। হাসান তাঁর নিজের বাড়ি ‘উজানি’তে। আর সনৎ ভাড়ায়। ভাড়ায় কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষকই অবসর জীবনযাপনের জন্য একটা মাথা গোঁজার স্থান করে রাখেন। সনৎ তা করেননি। পদ্মাপারের বড়কুঠি যেতে হাতের বাঁয়ে সনতের পৈতৃক বাড়ি। সম্ভবত সেটাও বেহাত হয়ে গেছে। হাসান সম্পদের প্রতি সনতের এই নির্লিপ্ততা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তুলে ধরার চেষ্টা করেন অতিসাধারণ জীবনযাপনের এক জীবন্ত চিত্র। ইহজাগতিক সুখ-সুবিধার প্রতি সনতের বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা যায়নি কখনো। এখনো নেই। সনতের সঙ্গে আমারও পরিচয় ১৯৬৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত। হাসান যা বলতে চান, তা কিন্তু পারেন না, আমারও সে-অভিজ্ঞতা রয়েছে। সনৎ সবার আগে পৈতৃক বাড়ি থেকে অর্থনীতি বিভাগে আসতেন এবং রাতে ফিরতেন। দুপুরে আগে কোথায় খেতেন কী খেতেন না, তা বলতে পারব না। কিন্তু ১৯৬৭ সালে আমি যখন জুবেরি ভবনে উঠে আসি, সনৎ তখন থেকে আমাদের ‘জয়নালের মেসে’ খেতে আসতেন। সেরকমই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এসে সোজা আমার ঘরে বসতেন। দেড়টা থেকে দুটো পর্যন্ত আমার তিন ব্যান্ডের জাপানি ‘প্যানাসনিক’ রেডিওতে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত রাগসংগীতের রসটা সংগ্রহ করে আমরা জয়নালের মেসে যেতাম। আমার ঘরের ঠিক উলটোদিকে। মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ-ব্যবস্থাই চলছিল। সনৎ আমার বছরদুয়েকের ছোট হবেন কিন্তু জ্ঞানে বৃদ্ধ। তাই আমি প্রথম থেকেই তাঁকে ‘সনৎদা’ বলে ডাকি। এখনো। পাঠকের সামনে সনৎকে তুলে ধরার ক্ষমতা আমার নেই। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী হাসানই যখন এ-কথা বলেন, তখন বুঝতে হবে, কোনো কথা দিয়েই সনৎকে বোঝা যায় না – বোঝানো যায় না। তাঁর অনেক ছাত্রই তাঁকে ‘দেবতাতুল্য’ শিক্ষক বলে উল্লেখ করেন। দেবতারা কেমন আমি জানি না, কিন্তু সনৎ দেবতাদের মতো নন – সনৎ সনতের মতো। ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয় আর একটি সনৎ তৈরি করা যায় না – যাবে না। কোনো কিছুর প্রতি এমন নির্লিপ্ততা আমি আর কারো মধ্যে দেখিনি। কিন্তু তিনি সবার ভালো চান। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে। বিনোদপুর-কাজলার কজন রিকশাওয়ালা প্রয়োজনে তাঁর কাছে আসতেন। সনৎ তাঁদের সাহায্য করতেন। তাঁরা সনৎকে কী রকম শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন, তার প্রমাণ পাই ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল যখন আমরা একসঙ্গে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিই।

নির্মোহ সনতের সম্পদের প্রতি নির্লিপ্ততা প্রবাদের মতো। নাম-ডাকের প্রতিও তাঁর একই রকম মনোভাব। সেটা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় তাঁর প্রথম প্রবন্ধ-সংকলন সমাজ সংসার কলরব প্রকাশের সময়। তাঁর ঘনিষ্ঠজন যখন তাঁর কাছে এই প্রস্তাব দেন, তখন সনৎ তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিতে তা উড়িয়ে দেন। ‘ওগুলো কি লেখা? ওসব ছাই-ভস্ম কে পড়বে?’ কিন্তু আনিসুজ্জামান মানিক নামের দর্শনের এক ছাত্রের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সেটা সম্ভব হয়। মানিক এখন দর্শন বিভাগের শিক্ষক। তারপর একে-একে বের হয় আকাশ পৃথিবী রবীন্দ্রনাথ, কথায় কথার পিঠে, অর্থনীতির ভাবনা, কবিতা অকবিতা রবীন্দ্রনাথ, ফিরে দেখা রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি। এ-কথা জোর দিয়েই বলা যায়, সনতের অনেক প্রবন্ধ, বাংলা ও ইংরেজি এখনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে।

আর একটি বিষয় সবার জানা দরকার। সনৎ অর্থনীতির ছাত্র। শুধু তা নিয়েই সনৎ সন্তুষ্ট থাকেননি। সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতি-রাজনীতি-বিজ্ঞান নিয়েও তাঁর গভীর আগ্রহ ও মতামত আছে। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন হয়ে সনৎ তার অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারেননি। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গল্পে-আড্ডায় তার কিছু প্রকাশ করতেন, কিন্তু তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় বেগম রোকেয়া তাঁর বড়বোন করিমুন্নেছা সম্পর্কে কী বলেছিলেন। ‘লুকোনো রত্ন’ প্রবন্ধে বলেছিলেন যে, আমাদের এই ‘গলাটেপা’ সমাজের জন্য করিমুন্নেছার পা–ত্য ও সৃজনশীলতা মাটিচাপা পড়ে ছিল। তিনি ছিলেন একটি ‘লুকোনো রত্ন’। বাঙালি সমাজ সে-রত্ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে সমাজ সংসার কলরবে। সনৎও অনেক কিছু আড়াল করে রাখতে চান। তা সত্ত্বেও তাঁর ওপর দুবার আক্রমণ হয়েছিল। তাই আমার মনে হয়, সনৎ সাহিত্য-সমালোচনায়, বিশেষ করে ‘রবীন্দ্র-মহাসাগরে’ ডুব দেন। তাঁর তীব্র ও তীক্ষন অনুভূতিগুলো ইচ্ছাহীন ‘অপ্রকাশের ভারে’র নিচে চাপা রয়ে গেল। পরিপূর্ণ সনতের সাক্ষাৎ পেল না বাঙালি-সমাজ।

সনতের তিনজন গুণী ছাত্র তাঁদের প্রিয় ‘স্যারের’ প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তাঁর অজাস্তেই নিজেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই অসাধারণ স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন ২০১৬ সালে। প্রকাশ করেছেন মফিদুল হক, সাহিত্য প্রকাশের কর্ণধার। ৪০৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির অঙ্গসজ্জা যে-কোনো নামকরা বিদেশি প্রকাশককেও হার মানাবে। সনতেরই একটি পুরনো লেখার নাম বেছে নিয়েছেন বইটির সম্পাদকত্রয় মহম্মদ আলাউদ্দিন, মুস্তফা কে. মুজেরি ও দিলীপকুমার নাথ। ওই প্রবন্ধটিতে সনৎ কিছু কথা বলেছেন অতি স্তর্পণে। এটা সনতের চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। বেশি কথা বলতে চান না। যা বলেন তা অনেক চিন্তার পর বলেন। সম্পাদকদের কথায়, ‘সনৎ আগে চিন্তা করেন, তারপর বলেন বা লেখেন।’ কথাটা যে সত্য, আমি তার দীর্ঘদিনের একজন সাক্ষী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমাদের সাহস অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আশায় দেশবাসী উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। তাই সনৎ বাহাত্তরে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ওপর সেমিনারে নিজেকে নাসিন্তক বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু মানুষের কল্যাণকামী বলে দাবি করেন। সবকিছুর মতো সনৎ ধর্মের প্রতিও নিস্পৃহ।

সম্পাদকরা ভুল করেছেন আমার মতো একজন রসায়নের ছাত্রের ওপর এই বিশাল বইটির একটি বিস্তারিত সমালোচনা লেখার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে। বইটি পুরোপুরি অর্থনীতির, যা আমি কিছুই বুঝি না। তবে লিখতে বসে সনৎ-সম্পর্কে আমার নিজের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো ভিড় করে আসছে। সেসব নিয়ে আজকের লেখায় কিছু লেখা ঠিক হবে না। তবে একটা কথা বলি, ছাইচাপা দিলেও হীরকখ–র দ্যুতিকে ঠেকানো যায় না – বেরিয়ে আসবেই। সনতের নির্লিপ্ততা, নিস্পৃহতা, সম্পদ-নাম-ডাকের প্রতি চরম অনীহা সত্ত্বেও তাঁর সন্ধান পেয়েছেন বাংলাদেশের গুণীজনরা। তাই সনৎ একের পর এক বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক ও রবীন্দ্র-পদকে ভূষিত হয়েছেন। যদিও এগুলো সনৎকে মোটেই টানে না। মোহহীন সনৎ এগুলোকে সামান্যই গুরুত্ব দেন।

 

দুই

দ্বিতীয় লেখায় সনতের একজন যোগ্য ছাত্র দিলীপকুমার নাথ সনৎ স্যারকে যেরকম দেখেছেন, তা বর্ণনা করেছেন। তার আগে দিলীপ-সম্পর্কে কিছু বলা দরকার বলে মনে করি। দিলীপ তাঁর গুরু সনতের অনেক গুণ তাঁর চরিত্রে মিশিয়ে নিতে পেরেছেন। তার মধ্যে প্রধান হলো, নিজেকে লুকিয়ে রাখা। আমরা যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে ছিলাম, দিলীপ আমাদের কাছ থেকে দূরে-দূরে থাকতেন। তবে দিলীপের পা–ত্যের কিছু-কিছু আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়েছিল। হাসান আজিজুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত প্রাকৃত পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য কেমন করে তাঁর কাছ থেকে একটি লেখা আদায় করতে হয়েছিল, সেটা খুব কাছ থেকে আমি দেখেছি। কিন্তু প্রকাশের পর প্রবন্ধটি সবার নজর কাড়ে। তবে দিলীপকে আমি ভালোভাবে চিনতে পারি গোপালগঞ্জের শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-বছর ওঁর সঙ্গে কাজ করার সময়। জনৈক প্রভাষক একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘স্যার, দিলীপ স্যার কি পিএইচ.ডি. করেছেন?’ মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দিলীপ যে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন, সেটি তিনি ঢেকে রাখতে তৎপর। নামের আগে কখনো ‘ড.’ লেখেন না, কিংবা নামের শেষে পিএইচ.ডি.। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত ও রুশ ভাষার ওপর তাঁর দখল দেখে আশ্চর্য হতে হয়। সেই দিলীপও তাঁর প্রিয় শিক্ষক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ভাষা খুঁজে পান না। কোনো কিছুর প্রতি সনতের নিস্পৃহতা প্রকাশ করার জন্য তাঁকে ভগবদগীতার সাহায্য নিতে হয়। যুধিষ্ঠিরের এক প্রশ্নের উত্তরে নারদ বলেন, ‘আত্মা ও দেহকে একত্রে বাঁচিয়ে রাখতে যেটুকু সম্পদ দরকার, সেটুকুতে দোষের কিছু নাই কিন্তু যে তার চেয়ে বেশি সম্পদের আকাঙক্ষা করে, সে চোর এবং প্রাকৃতিক বিচারে শাসিন্তযোগ্য অপরাধ।’ সনতের প্রয়োজন সামান্য।

হাসান ও দিলীপের লেখায় সনতের জীবনযাপন প্রণালির বহু দিক উন্মোচিত হয়েছে। ভগবদগীতা থেকে দিলীপ আর একটি উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছেন, ‘তোমার কাজ করার অধিকার আছে কিন্তু তার ফল ভোগ করার কোনো অধিকার নাই।’ সনৎ সারাজীবন কাজ করে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। কখনো তার ফল প্রত্যাশা করেননি। আমি জানি, তাঁর কটা বই বিক্রি হলো, সে-হিসাব প্রকাশকরা তাঁকে দেন না। এতগুলো বই প্রকাশনায় তাঁর কোনো অর্থপ্রাপ্তি হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এ নিয়ে সনতের মনে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। জিজ্ঞেস করলে সেই একই কথা ‘আমার বই কে কিনবে?’ সেজন্য সনতের মনে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই।

 

তিন

তৃতীয় প্রবন্ধটি লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অ্যালান ডুশ। তাঁর প্রবন্ধটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তিনজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদের মতামতগুলো তুলে ধরেছেন। তাঁরা হলেন গুনার মিরডাল (১৯৭৪), অমর্ত্য সেন (১৯৯৮) এবং জোসেফ স্টিগলিজ (২০০১)। তাঁদের অর্থনৈতিক তত্ত্বের মিল-অমিলের কথা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। সেইসঙ্গে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অনুন্নয়নের এক সমালোচনামূলক আলোচনা করেছেন অ্যালান ডুশ। ১৯৭৪ সালে গুনার মিরডালের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান ভন হায়েক। কিন্তু দুজনের অর্থনৈতিক দর্শন উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত। হায়েক বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী, রাষ্ট্রকে দুর্বল করার পক্ষপাতী; রাষ্ট্র যেন কোনোভাবেই বাজারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে না পারে। মিরডাল বিপরীত মত পোষণ করেন। রাষ্ট্রকে শক্তিশালী ও বাজার নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার তিন বছর আগে মিরডালের বিশ্বখ্যাত বই এশিয়ান ড্রামার তিন খ- প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নাটক তখন প্রায় তার শেষ অংকে পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে প্রথমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাইতে জাতি-পরিচয়ই গুরুত্ব পায় বেশি। স্বাধীনতার পর প্রথম দিকে বাংলাদেশের ধীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি মোটেই আশ্চর্য হন না। স্বাধীনতাযুদ্ধে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর সামাজিক অস্থিরতা যেন এক স্বাভাবিক ঘটনা। সেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে মানুষের আয় হ্রাস এবং দুর্নীতির প্রসারণ, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকের মতো মিরডালও চিমিন্তত ছিলেন। সেদিনের সেই বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশের হাল ধরার জন্য রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার কথা বলেন। শিকাগো স্কুলের সহকর্মী পি. টি. বাওয়ার বিপরীত মত প্রকাশ করেন। বাওয়ারের অর্থনৈতিক দর্শন অনেকটাই হায়েকের মতো। তিনিও রাষ্ট্রের পরিকল্পিত হস্তক্ষেপ এবং বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কমিয়ে আনা ও বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোর জন্য তাঁর এ-সুপারিশ সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। গরিব বা উন্নয়নশীল দেশের বাজারের সক্রিয়তার সামনে অনেকগুলো বাধা রয়েছে। সেগুলো হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, দীর্ঘকালীন দারিদ্র্য, জমির মালিকানা সমস্যা, ধর্ম ইত্যাদি। এসব দেশের সংস্কৃতির মূলে রয়েছে যে আয় ও সম্পদের এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বৈষম্য, মিরডালের মতে, সেগুলো মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবার সুযোগের সমান অধিকারের দাবিকে হাস্যকর করে তোলে। তাই তিনি উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সুপারিশ করেন, যা মানব-উন্নয়ন ও সুযোগের সৃষ্টি করবে। সেজন্য প্রয়োজন হলে তিনি ‘শক্তিশালী রাষ্ট্রের’ প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। এতটাই শক্তিশালী যে, তা ঐতিহ্যবাহী প্রথা ও সংস্কার গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এতে যদি আধুনিকতা ও উন্নয়নের গাড়ি স্বল্পকালের জন্য কিছুটা শস্নথ হয়ে পড়ে, তিনি মনে করেন, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। সেজন্য অনেকেই মিরডালের তত্ত্ব ‘সমাজতান্ত্রিক’ দোষে দুষ্ট বলে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। মিরডাল তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘neo-classical orthodoxy’-এর বিরোধিতা করেন। তাই তিনি দাবি করেন, ‘মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ’ সমাজবিজ্ঞান একটি অসম্ভব কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। তিনি আহবান জানান তাঁদের মূল্যবোধগুলো খোলাখুলি প্রকাশ করার জন্য।

দুশো বছরের ব্রিটিশ ও চবিবশ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে জর্জরিত এবং মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অসিন্তত্ব এবং অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের সেই সংশয়ের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু, চার লাখেরও বেশি নারীর সম্ভ্রম হারানো, এক কোটিরও বেশি মানুষের ভারতে আশ্রয়গ্রহণ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা প্রায় সব মানুষের এখানে-সেখানে পালিয়ে আন্তরক্ষা করার প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে এক ধ্বংসসত্মূপে পরিণত করে। সেই রক্তস্নাত বাংলাদেশের পুনর্গঠন খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। অভিজ্ঞতাশূন্য একটা নতুন সরকারের ঘাড়ে বাংলাদেশ ছিল এক বিশাল বোঝা। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, ঘরবাড়ি, মানুষের পুনর্বাসন করা যে দুঃসাধ্য বিষয় ছিল, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের সমস্যা নতুন সরকারের অনভিজ্ঞ প্রশাসন কাঠামোর ওপর এক কঠিন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বোঝা নিয়েই বাংলাদেশের জন্ম। তাই বাংলাদেশের অসিন্তত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করাই ছিল স্বাভাবিক। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সমস্ত সমস্যা দূর করে বাংলাদেশের টিকে থাকা এবং তার উন্নয়ন-প্রক্রিয়া নিয়ে দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদরা প্রচুর  চিন্তা-ভাবনা, তর্ক-বিতর্ক ও লেখালেখি করেছিলেন। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ তাঁদের উন্নয়ন-দর্শনের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু সবার সংশয় দূর করে তার প্রথম পঁয়তালিস্নশটা বছর পার করেছে বাংলাদেশ। শুধু পারই করেনি; অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশ আজ সবার নজর কেড়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ইউএনডিপির সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানকেও ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতিতে ক্রমশ পুঁজিবাদী কাঠামো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। মোট জাতীয় আয়ের এক-পঞ্চমাংশ কৃষি খাত থেকে আসছে। শিল্প খাতের অংশ ক্রমবর্ধমানশীল। কৃষি খাতে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। প্রায় অর্ধেক শ্রম সরবরাহ করছে কৃষি খাত। বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারিত হয়েছে। পোশাকশিল্প আজ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ এগিয়ে এসেছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের (GDP) হার আজ ছয় শতাংশে পৌঁছে গেছে। ২০১৫-১৬ সালে তা সাত শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। পোশাকশিল্প ও কৃষিজাত পণ্যের পাশাপাশি মানব-সম্পদ রফতানি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে তুলেছে। তবু মিরডাল মনে করেন, বাংলাদেশের এই উন্নয়নের ধারার সামনে এখনো অনেকগুলো বাধা দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের ভঙ্গুর আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামো, পরিবেশ দূষণ, গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণে ব্যর্থতা ও ব্যাপক দুর্নীতি বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রার পথ ক্রমশ কণ্টকাকীর্ণ করে তুলছে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া ২০১৫ সালের বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশকে বড় ধরনের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তার ওপর আছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জঙ্গিবাদী ইসলামের ছোবল। তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের হুমকি।

মিরডালের মতে, নববইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি পায় – একই সঙ্গে বৈষম্যের গতিও। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের রিপোর্ট প্রমাণ করে যে, এই বৈষম্যই উন্নয়ন ধারার সামনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আঁন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংকের বিখ্যাত থিসিস অনুন্নয়নের উন্নয়ন (Development of Underdevelopment) মডেলের এক বাস্তব চিত্র বাংলাদেশ। ডুশ মিরডালের পাঁচটি প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা করেন। পুষ্টিহীনতা, জন্মগত পঙ্গুতা এবং শিশুবিবাহ। ১৫ বছরের নিচে শিশুবিবাহের হার বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। দারিদ্রের সঙ্গে এসবের যেমন যোগসূত্র আছে, তেমনি এসব উন্নয়নবিরোধী সূচক দারিদ্র বৃদ্ধির অন্যতম নির্দেশক। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ২-৩ শতাংশ কমিয়ে দেয় পুষ্টিহীনতা। সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ২.৬৯ শতাংশ বরাদ্দ এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের (৫.৩%) চেয়ে অনেক কম। পুষ্টিহীনতা ইতোমধ্যে উন্নয়নের গতি অনেকটাই শস্নথ করে দিয়েছে এবং দরিদ্রশ্রেণির জন্য তা ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছাবে। তাই এই অশুভ চক্রকে ভাঙার জন্য মিরডাল একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রকৃতিবাদী অর্থনীতিবিদ ডুফলো, মিরডালের নাম উল্লেখ না করে, মিরডালের ‘ফিডব্যাক মডেল’টি সমর্থন করেন। ডুফলো মনে করেন যে, ‘পূর্বানুমানের’ একটি ভূমিকা আছে। পূর্বানুমান মানুষের স্বভাব ও চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে। পূর্বানুমান ও আশাবাদের মাধ্যমে যা অর্জন করা সম্ভব, তা দারিদ্রের সেই অশুভ চক্রকে ভাঙতে সাহায্য করে। অন্যদিকে যা অর্জন করা সম্ভব নয়, তেমন পূর্বানুমান ও আশাবাদ মানুষের আশাভঙ্গের কারণ হয় এবং সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ‘নিরাশাবাদ মানুষের শ্রমক্ষমতা কমিয়ে দেয়।’ তাই মিরডাল ও ডুফলো উভয়েই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে মানুষের যুক্তিপূর্ণ আশা-জাগানোর পক্ষপাতী, যা শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও দারিদ্র কমিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে। তাঁরা সিদ্ধান্ত দেন যে, এমন একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা প্রয়োজন, যা দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। মিরডালের নাম উল্লেখ না করে আধুনিক উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ডুফলো তাঁর দারিদ্রের অশুভ চক্রকে অতিক্রম করার প্রস্তাব রাখেন। ১৯৮৭ সালে মিরডালের মৃত্যু হয়, কিন্তু ডুশের মতে, নামের চেয়েও তাঁর তত্ত্বটি আজো শক্তিশালী।

‘আরব বস্ত’ মিরডালের তত্ত্বের আরেকটি শক্তিশালী প্রমাণ। আরব দেশগুলো অর্থনৈতিক ও মানব-উন্নয়ন সূচকে ভালো করলেও গণতান্ত্রিক কাঠামো গঠন, বেকারত্ব, স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তাদের অর্জন মোটেই ভালো নয়। ডুশ বাংলাদেশকে এ-থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে সুপারিশ করেন। আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভালো করলেও দুর্নীতি, বেকারত্ব ও গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণে ব্যর্থতা বাংলাদেশকেও ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন করতে পারে।

অর্থনীতিবিদ রড্রিকের মূল বক্তব্য হলো এই যে, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্বারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কেনা যায় না।’ ‘economic growth on its own does not buy political stability’. অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব, দুর্নীতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক কাঠামো তৈরিতে ব্যর্থতা সে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল ব্যর্থ করে দিতে পারে। চীনের সাফল্য মিরডালের তত্ত্বের আর একটি প্রমাণ। শাসননীতি, দুর্নীতি, বৈষম্য এবং উন্নয়ন – বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় – পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। আজিজুর রহমান খান প্রমাণ করেছেন যে, গোঁড়া (orthodox) সংস্কার দ্রুত উন্নয়ন বা অধিক সমতাবাদী উন্নয়ন সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশে উদার অর্থনৈতিক বৈশ্বিকীকরণ হ্রাস পায়নি বরং বেড়েছে। এর ফলে মানুষের ‘আয়-বৈষম্য’ বৃদ্ধি পেয়েছে। মিরডালের নাম উল্লেখ না করে তিনিও মুক্তবাজার অর্থনীতির রাশ টেনে ধরার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তেমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমবর্ধমান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভালো ফল দেখাতে পারলেও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, বৈষম্য, জলবায়ু-সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তেমন কোনো দৃশ্যমান সাফল্য দেখাতে পারেনি। মিরডালের মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা অর্থনীতি নয়, প্রধান বাধা হলো ‘সুপার ধনিকশ্রেণির’ লোভ-লালসা, দুর্নীতি, বৈষম্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের মতে, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় প্রবেশগম্যতা সামান্য বাড়লেও, তার মান ক্রম-অবনতিশীল।… মোট শ্রমশক্তির ৭৮% স্বল্প বেতনভুক। এটা দুর্নীতি সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত করেছে। উৎপাদন হ্রাসের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়’ (২০১৩ : ১)।

তাই  মিরডাল অত্যধিক জোরের সঙ্গে বলেন যে, একটি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশই মুক্তবাজার অর্থনীতির লাগামহীন স্বাধীনতা এবং তার বৈষম্য সৃষ্টিকারী প্রভাব ঠেকাতে পারে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়, ‘The resilience of the Bangladeshi economy continues to be tested by faltering political stability, weak global markets, and structural constraints’. মানবকল্যাণ ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির জন্য ১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পান। বাস্তবে অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে বাজার ও রাষ্ট্র পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং পরস্পর সম্পূরক। তাঁর মতে, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য প্রথম স্তরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত। সেজন্য তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকতে হবে। তিনি মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, তবে মনে করেন যে, স্বাধীনতার ভালো-মন্দ উভয় দিকই আছে। অমর্ত্য সেনের কাছে স্বাধীনতার অর্থ অপুষ্টি ও অশিক্ষা থেকে মুক্তি। ‘অপুষ্টি ও অশিক্ষাই হলো স্বাধীনতাহীনতা।’ এই স্বাধীনতাহীনতা থেকে মুক্তির জন্য এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে বুনিয়াদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাক-স্বাধীনতা এবং সবার জন্য সমান সুযোগের গ্যারান্টি বিরাজ করে। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য কেবল দড়ি ও শৃঙ্খলের প্রয়োজন পড়ে না, এসব ছাড়াও মানুষের স্বাধীনতা আইনসম্মতভাবে ছিনিয়ে নেওয়া যায়। অশিক্ষা, অপুষ্টি, মতপ্রকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং শ্রেণিবিভাজনের মাধ্যমে সুযোগের বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে বন্দি করা যায় – তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া যায়।

সেন মনে করেন, মানুষের সামর্থ্য বৃদ্ধি করে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যায়। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার প্রশংসা করেন। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন যে, নিম্নতর মাথাপিছু আয় নিয়েও বাংলাদেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তান থেকে এগিয়ে গেছে। যেমন গড় আয় বৃদ্ধি, শিশুদের টীকা প্রদান ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা। মানব-উন্নয়ন ও সামাজিক সূচকের উন্নয়ন ধরে রাখা বা আরো শক্তিশালী করার জন্য সেন কোনোরকম উপদেশ দেননি। কিন্তু বাজারের শক্তি ও নির্ভরতার ওপর দৃষ্টি দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যকে আঘাত করার বিষয়ে সেন মিরডালের চেয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু তিনিও তাঁর ‘স্বাধীনতার উন্নয়নের’ তত্ত্বে মিরডালের নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন অজ্ঞাত কারণে। সেন ভারতের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন, এ থেকে ভারতের শিক্ষা নেওয়া উচিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এবং শিশুমৃত্যুর হারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অর্জন চোখে পড়ার মতো।

জাতিসংঘের ‘মানব উন্নয়নসূচক’ এবং ‘সামাজিক উন্নয়নসূচক’ প্রণেতা হিসেবে সেন ও স্টিগলিজের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের মতে, ‘মাথাপিছু আয়ের’ হিসাবে কোনো দেশের উন্নয়ন সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। ২০১৫ সালের ‘সামাজিক উন্নয়ন সূচকে’ দেখা যায় যে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খুব ভালো করলেও ‘সমান সুযোগ’ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাংঘাতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। যেমন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সহনশীলতা, উচ্চশিক্ষায় গমন এবং একটি নিরাপত্তা বেষ্টনী সৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। এটা মোকাবিলা করার জন্য সেন মিরডালের সুপারিশ অনুসরণ করেন। শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও দক্ষ শ্রমিকের সাহায্যে উৎপাদিত পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি, এ-দুটোতেই যেটা দরকার তা হলো মানসম্মত উচ্চশিক্ষার প্রসার, যা বাংলাদেশ এখনো অর্জন করতে পারেনি। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছু বেড়েছে কিন্তু তার মানের ক্রমাবনতি অব্যাহত আছে। তাই ২০১৫ সালের SPI রিপোর্টে বাংলাদেশের সাফল্যের চিত্র তুলে ধরা হলেও বাংলাদেশ আজ ‘নিম্ন সামাজিক গ্রম্নপের’ মধ্যেই পড়ে। বিভিন্ন ছকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ করেছে মানবকল্যাণমুখী সূচকে এবং প্রাযুক্তিক ও শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে। এনজিওর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে অনেক নিচে। পুঁজির ঘনীভবনে বাংলাদেশের চোখ-ধাঁধানো সাফল্য অর্জন অনেকটাই মস্নান হয়ে যায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অনুন্নয়নে, যা ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে এবং সেসঙ্গে দারিদ্রবিমোচনেও বড় হুমকি হয়ে দেখা দেয়। বাংলাদেশের জন্য ‘আরব বসস্তে’র সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আগেই বলা হয়েছে, ‘ভালো অর্থনীতি ভালো রাজনীতি ক্রয় করতে পারে না।’ অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রসারে, দারিদ্রবিমোচনে এবং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের অর্জন অতি সামান্য। বাংলাদেশের ওপর অমর্ত্য সেনের প্রভাব মিরডাল ও স্টিগলিজের চেয়ে বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নে যে-সাফল্য অর্জন করেছে, তা ধরে রাখা বা তাকে আরো অগ্রসরে নেওয়ার জন্য মিরডাল ও স্টিগলিজ যে-কাঠামোগত সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, অ্যালান ডুশ তাকে বেশি গুরুত্ববাহী বলে মনে করেন।

ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে চীনের তুলনা করে সেন কষ্ট পান। উপমহাদেশের সরকারগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম দৃষ্টি দেয়। তাছাড়া নারীর ক্ষমতায়নে উপমহাদেশের উদ্যোগ সম্পর্কে সেন অভিযোগ উত্থাপন করেন।

১৯৯৪ সালে মানবকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক মূল তত্ত্বগুলোর শক্ত সমালোচনার মাধ্যমে স্টিগলিজ নিজেকে সম্মুখ সারিতে নিয়ে আসেন এবং সেই পথ ধরে তিনি ২০০২ সালে নোবেল পান। তাঁর সেসব তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সুসংগঠিত বাজারের কোনো অসিন্তত্ব নেই, যা আছে তা ত্রম্নটিপূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ।  তাই এ-কথা সহজেই বলা যায় যে, প্রতিযোগিতা কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। স্টিগলিজ বিষয়টিকে সহজভাবে দেখেন না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা তখনই মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যখন বিশটি অনুমান সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। সেগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনুপস্থিত। অর্থনীতিকে মানুষের কল্যাণমুখী করার জন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। সমতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও কাঠামোগত সংস্কারে পিছিয়ে-পড়া বাংলাদেশে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

সেন ও স্টিগলিজ দুজনেই মনে করেন, রাষ্ট্র ও বাজার পরস্পরের পরিপূরক – প্রতিস্থাপক নয়। সেন প্রথমদিকে মানুষের সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রতি জোর দেন আর স্টিগলিজ তাঁকে ছাড়িয়ে বাজারের কর্মদক্ষতার উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেন। বাজার কীভাবে কাজ করে স্টিগলিজের কাছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। বাজারের পরিপূরক হিসেবে রাষ্ট্রের ভূমিকা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। স্টিগলিজ সেনের মতো বাওয়ারের প্রশংসা করতে ইতস্তত করেন। মিরডালের জন্য তা ভাবাই যায় না। যেসব সেক্টর দুর্বল, সেসব সেক্টরে স্টিগলিজের তত্ত্বানুসারে রাষ্ট্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ কাম্য। যেমন কৃষি খাত। এ-সেক্টরে পূর্ব এশিয়ার দ্রুত সাফল্য বাংলাদেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। কৃষিতে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদন-ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের ২০১১ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘দরিদ্রশ্রেণি’ খুবই অসুবিধার মধ্যে আছে। তাদের কোনো সম্পত্তি নেই, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সাহায্য সচরাচর তাদের কাছে পৌঁছে না। মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সুপেয় পানি ও উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা থেকে তারা বঞ্চিত। স্টিগলিজের তত্ত্বের প্রতিধ্বনি শোনা যায় তাদের রিপোর্টে (BPC-pp 1, 2)। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণ কৃষিজমির ওপর চাপ বৃদ্ধি করে চলেছে। তাই জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য স্টিগলিজ কাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দেন। জ্বালানি ও শক্তির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অসমর্থতা ও অসমতার সমালোচনা করেন তিনি। বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে যে ভর্তুকি দেয়, তা অসমর্থতা ও অসমতা দোষে দুষ্ট। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, নিচের ৪০ শতাংশ মানুষ জ্বালানি-ভর্তুকির মাত্র ১৫-২০ শতাংশ পায়। বাংলাদেশ সরকার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি এবং টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে জ্বালানি তেলের মূল্য যৌক্তিকীকরণ ও ভর্তুকি কমানোর ঘোষণা দেয়। কিন্তু দক্ষতা বৃদ্ধি ও বৈষম্য হ্রাসের ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। স্টিগলিজ মনে করেন, ‘সেসঙ্গে দারিদ্রবান্ধব সৃজনশীল দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

স্টিগলিজ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার নৈতিক দিকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন। উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাস করার জন্য চাপ দেয় অথচ নিজেদের দেশ কৃষিতে প্রচুর ভর্তুকি দেয়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান দৈনিক এক বিলিয়নেরও বেশি ডলার ভর্তুকি দেয়। এতে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর রফতানি আয় কমে যায়। তাই স্টিগলিজ দাবি করেন, যদি উন্নত বিশ্ব এমন ভর্তুকি দিতেই থাকে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সরকারগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনার জন্য; কিন্তু নিজেদের দেশে তারা করপোরেট সেক্টরে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দেয়। এই ভ-ামির জন্য গরিব দেশগুলোর যে-ক্ষতি হয়, স্টিগলিজ তার জন্য ক্ষতিপূরণের জোর দাবি জানাতে আহবান করেন। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। হিমালয়ে বরফ গলে যাওয়ায়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে চলেছে, সুপেয় পানির অভাবের ফলে প্রাণহানির আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে, বেকারত্ব ও দারিদ্র বৃদ্ধি পেয়েছে। সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের সতেরো শতাংশ তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বিদেশি সংস্থাগুলো। এর ফলে বাংলাদেশের ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই এগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশের উন্নয়ন সেক্টরের প্রসার ও রফতানি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন স্টিগলিজ। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার না দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন তিনি।

এই তিন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদের পার্থক্য থাকলেও, তা তেমন সাংঘাতিক কিছু নয়। সেন ও স্টিগলিজ মিরডালের অনেক তত্ত্বই গ্রহণ করেছেন, নাম উল্লেখ না করেও। তাঁরা সবাই বিশ্বাস করেন যে, কেবল মূল্যই সবকিছু নয় – প্রতিষ্ঠানও গুরুত্ব বহন করে। ‘In one way or another, all accept that it is not just prices that matter, but the institutions matter too.’ (p 50)। প্রাথমিক পর্যায়ে সবাই রাষ্ট্রের শক্ত হস্তক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানান; কিন্তু মানব-উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়, প্রধান অর্থনীতির অর্থ কী, অথবা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বলতেই বা কী বোঝানো হয়েছে – এসব বিষয়ে তাঁদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ‘তলাহীন ঝুড়ি’ থেকে আজ বিশ্বের এগারোটি সম্ভাবনাময় দেশে উপনীত হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নের এই সাফল্য সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। মানব-উন্নয়ন ও দারিদ্রবিমোচনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অসমঞ্জস। মাত্র চলিস্নশ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জনকারী রক্তাক্ত বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গত দু-তিন দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নে মিরডাল, সেন ও স্টিগলিজ ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য সমালোচনা করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। বাংলাদেশের উন্নয়নে তাঁরা দুটি তালি দিয়েছেন, তিনটি নয়। বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ভিত গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে, এটা ঠিক; কিন্তু তা এখনো চীন, ভারত ও ভিয়েতনামের উন্নয়ন-গতির সমকক্ষ হতে পারেনি (BPC, 2013, p 12)। ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথে এখনো অনেক বাধা আছে। তার মধ্যে রয়েছে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ, জনসংখ্যার প্রচ- চাপ, উপযুক্ত অবকাঠামোর অভাব, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, অপর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, জলবায়ু দূষণরোধে ব্যর্থতা এবং শ্রমশক্তির দক্ষতা ও উৎপাদন-ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যর্থতা প্রধান। তাঁরা মনে করেন, রাষ্ট্রের জনকল্যাণমুখী হস্তক্ষেপ ছাড়া এসব বাধা দূর করা সম্ভব নয়। ডুশ তাঁর প্রবন্ধটি শেষ করেছেন বিশ্বব্যাংকের একটা বক্তব্য উল্লেখ করে, – ‘Moveing forward, the biggest challange remains ensuring durable political stability. This is a pre-condition for accelerated, inclusive and sustainable growth’, (WB 2015)। দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক সুস্থিরতাই ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রার জন্য বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে ভালো করলেও বাংলাদেশ এখনো সেই ভয়ংকর ঝুঁকির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

 

চার

কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে, শিল্প-বিপস্নবের আগের অর্থনীতি মালথুসের তাত্ত্বিক জালে জড়িয়ে পড়ে স্থবির হয়ে পড়েছিল। সেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে মাথাপিছু আয় একবিন্দুতে স্থির হয়েছিল। তাঁরা দাবি করেন যে, শিল্প-বিপস্নবের পরই সেই মালথুসের জাল ছিঁড়ে অর্থনীতি সদম্ভে এগিয়ে আসে এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁদের কাছে শিল্প-বিপস্নবই হলো প্রাচীন অর্থনীতি এবং আধুনিক (পুঁজিবাদী) অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্যরেখা রচিত করে।

চতুর্থ প্রবন্ধে ক্লিমেন্ট টিসডেল এবং সার্দ ভিজেরো তাঁদের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানান। লেখকদ্বয় বিশ্বাস করেন, কেবল মাথাপিছু আয় দিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাত্রা নির্ধারণ করা যায় না। মাথাপিছু আয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক একমাত্র সূচক নয়। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে প্রাক্-শিল্পযুগে পৃথিবীর অনেক স্থানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছিল, তা না হলে শিল্প-বিপস্নবই হয়তো সম্ভব হতো না। তবে লেখকদ্বয় অস্বীকার করেন না যে, শিল্প-বিপস্নবের ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন মালথুসের জাল ছিঁড়ে এক নাটকীয় দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে। টিসডেল ও ভিজেরো ‘শিল্প-বিপস্নবের পরই সত্যিকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে’, এই সমসাময়িক মতকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং বলেন যে, এ-মত তাঁরাই বিশ্বাস করেন, যাঁরা মাথাপিছু আয় দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতির তত্ত্বে বিশ্বাসী। সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসের প্রতি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে যে, প্রথম স্তরে শিকারি-যুগেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে এবং দ্বিতীয় স্তরে কৃষি আবিষ্কার তার গতি ত্বরান্বিত করে। কৃষি সভ্যতায় সমাজে শ্রেণিবিভাজন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। একটি ছোট্ট শক্তিশালী শাসকশ্রেণির উত্থান ঘটে। তারা দুর্বল উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ‘কর’ (উৎপাদিত কৃষি ফসল) সংগ্রহ করে একটি উদ্বৃত্ত অর্থনীতির জন্ম দেয়। কৃষি অর্থনীতির কেন্দ্রীভবনের পরিবর্তে শিল্প-বিপস্নব অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ করে। তার ফলে অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছিল। গবেষকদ্বয় এই বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে আদিম সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রমাণ হাজির করেন। সেসঙ্গে তাঁরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর আমত্মঃনির্ভরশীলতার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন।

তাঁরা শিকারি-সংগ্রহকারী অর্থনৈতিক কাঠামোকে প্রথম স্তর হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই স্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে ব্যাপক মতদ্বৈধতা লক্ষ করেন। যেমন হব্স সে-সময়ে মানুষের জীবনকে বলেছেন, ‘dismal, fratish and small.’ অন্ধকারময়, বর্বর (পাশবিক) ও ক্ষণস্থায়ী। অপরদিকে সাহ্লিনস (Sahlins) মনে করেন, অনেক গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে উঁচুস্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছিল এবং তারা অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করত। আবার অনেকে মনে করেন, সে-যুগে মানুষের সংখ্যার ধীরগতি বৃদ্ধি তাদের কোনোরকমে জীবনযাপনে বাধ্য করত। অনেকে বিপরীত মতটাই বিশ্বাস করে বলেন যে, প্রথম স্তরে মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির কৃষিযুগের আবির্ভাবে বড় অবদান রেখেছিল। গর্ডন চাইল্ডের বিখ্যাত বই Man Makes Himself (১৯৬৫)-এর সাহায্যে তাঁরা বলেন যে, চাইল্ড কৃষিযুগকে দুভাগে ভাগ করেছেন। জলবায়ু, উদ্ভিদ ও পশু বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় প্রথম স্তর থেকে দ্বিতীয় স্তরে উন্নয়নও বিভিন্নভাবে ঘটেছে। এমনকি কোনো কোনো অঞ্চল দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছাতেই পারেনি। যেমন নিউগিনি। দ্বিতীয় স্তর সবচেয়ে বেশি উন্নত হয় ইউরেশিয়া ও আমেরিকায়। কারণ সেসব জায়গার বন্য উদ্ভিদ ও পশু গৃহপালিত হওয়ার পক্ষে উপযুক্ত ছিল।

কৃষি-সভ্যতার প্রথম স্তরে উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য উৎপাদন, তার সংরক্ষণ এবং সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টির পরই কৃষি-সভ্যতা দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করে। সেসব স্থানে সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে জমিতে পানি দেওয়া সহজ ছিল, আদিমতম লাঙল আবিষ্কার এবং তা টানার জন্য যখন পশুর গৃহপালন শুরু হলো, তখন কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং ইউরেশিয়ার অনেক স্থানে উদ্বৃত্তের সৃষ্টি হয়। চাকা ও পালতোলা নৌকার আবিষ্কার শস্য আদান-প্রদান সহজতর করে তোলে। ফলে স্থানে স্থানে ছোট ছোট শহর বা নগরের সৃষ্টি হয়। সেখানে একটি ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠী অর্থনীতির কেন্দ্রীভবন করে এবং নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি শক্ত করে। উৎপাদক-শ্রেণির উৎপাদিত পণ্য আন্তসাতের মাধ্যমে তারা উৎপাদক-শ্রেণির জীবনযাত্রার মান নিম্নস্তরে রাখতে সমর্থ হয়। এতে বিপুল কৃষিজীবীর জন্মহার সাংঘাতিকভাবে কমে যায় এবং তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি মোটামুটি এক জায়গায় স্থির থাকে। ফলে উদ্বৃত্তের ভা-ার বাড়তে থাকে। এতে শাসকগোষ্ঠীর হাতে অধিকতর সম্পদ জমা হয়, যার দ্বারা তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমর্থ হয়। প্রতিরক্ষা ব্যয় ছাড়াও উদ্বৃত্ত সম্পদ দিয়ে তারা অর্থনৈতিক অবকাঠামো (যেমন সেচ) গড়ে তোলে, জাঁকালো, বিলাসবহুল জীবন যাপন করে। শুধু আন্তরক্ষাই নয়, অন্য নগর দখলের জন্য যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতাও অর্জন করে।

রাজা ও পুরোহিতশ্রেণির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে শাসকশ্রেণি। তারা ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী। এমনকি কেউ নিজেকেই ঈশ্বর বলে ঘোষণা করে। দ্বিতীয় স্তরে শাসকশ্রেণির শোষণের ওপরই কেবল মালথুসের জালের স্থিতি নির্ভর করে না। শাসকশ্রেণির সংখ্যাবৃদ্ধিও একটি বড় নির্ধারক। তাই শাসকশ্রেণির সংখ্যা কমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্মের জনক ফারাও চতুর্থ এমেনহোটেপের কথা। ঈশ্বর ও সেসঙ্গে পুরোহিতের সংখ্যাবৃদ্ধিতে যখন ফারাও নিজের ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা লক্ষ করেন, তখন তিনি ১৩৭৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সব ঈশ্বরের অসিন্তত্ব ধ্বংস করে একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচার করেন। এতে পুরোহিতরা তাদের ঐক্যবদ্ধ ক্ষমতা হারায়। সে ঈশ্বরের নাম ‘অ্যাটন’। সেসঙ্গে তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘অ্যাখেনটিন’ (ঈশ্বরের সন্তুষ্টি)। অ্যাটনই সবকিছুর স্রষ্টা, সুতরাং তিনি কেবল মিসরীয়দের ঈশ্বর নন, সমগ্র পৃথিবীর ঈশ্বর। কিন্তু ক্ষমতালোভী পুরোহিত শ্রেণির ষড়যন্ত্রে মাত্র পনেরো বছর পর তাঁকে হত্যা করা হয় এবং ‘অ্যাটন’কে হত্যা করে পূর্বের সব ঈশ্বরকে ফিরিয়ে আনা হয়। ফলে পুরোহিতরা তাঁদের হারানো শক্তি ফিরে পান। ছশো বছর পর পুনরায় হিব্রম্ন পয়গম্বরের হাতে অ্যাটনের মতো সর্বশক্তিমান, সর্বমঙ্গলময়, সর্বজ্ঞ এবং সর্বত্রগামী ঈশ্বরের পুনর্জন্ম হয়। যাক সে-কথা। মালথুসের তত্ত্বানুযায়ী যদি শাসকশ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি হয়, তাহলে তা উদ্বৃত্ত খেয়ে ফেলে। তাই অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের জন্য তাঁরা নানারকম সংস্কার সাধন করতেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারে সহায়তা ও নেতৃত্ব দিতেন। কাজেই সে-সময় অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল ওপর থেকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। এভাবেই অতিমন্থর অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরবর্তীকালে শিল্প-বিপস্নবের পথ খুলে দেয়।

কেন শিল্প-বিপস্নব ইংল্যান্ডে সংঘটিত হলো? এ-প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। লেখকদ্বয় বিষয়টি নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা করেছেন। রেনেসাঁস ও রিফরর্মেশনের মাধ্যমে অবিকল এমেনহোটেপের ঘটনাই ঘটে। পুরোহিত ও নাইটশ্রেণির ক্ষমতা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও সম্রাটশ্রেণি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পোপ আরবান-` ১০৯৬ সালে যে প্রথম ক্রুসেড শুরু করেন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইটরা যেন বহিরাগত শত্রম্নদের মোকাবিলায় নিয়োজিত হয়ে পড়ে। তারা যেন ইউরোপে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে না যায়। প্রবন্ধের লেখকদ্বয় প্রমাণ করেছেন যে, প্রতিটি আন্দোলন বা যুদ্ধের পেছনে শাসকশ্রেণির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করে। এভাবেই সতেরো শতকে ইউরোপে ‘মধ্যযুগের’ অবসান হয় – মনে করেন হিল। সতেরো শতকের ১৬৪০-৬০ দশকের প্রধান নায়ক ছিলেন অলিভার ক্রমওয়েল। টিসডেল ও ভিজেরোর লেখায় এটা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে যে, শিকারি-যুগে মানুষ খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য যুদ্ধ করত, কৃষি-যুগে জমি ও পশুর জন্য যুদ্ধ করত আর শিল্প-যুগে মানুষ পুঁজির জন্য যুদ্ধ করে।

রেনেসাঁস-রিফরমেশন থেকে শিল্প-বিপস্নবের পরিচিত ইতিহাস পর্যালোচনা শেষে তাঁরা উপসংহার টানেন এভাবে যে, উৎপাদকশ্রেণির জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধি ও পণ্যের উৎপাদন উৎকর্ষতা বৃদ্ধির ফলে মধ্যযুগের কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। কেন অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়, তা নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। তবে গবেষকদ্বয়ের মতে, বাজারের বিসত্মৃতি এবং উদ্বৃত্ত আন্তসাতের নবতর পদ্ধতি এজন্য অনেকটা কার্যকর ভূমিকা রাখে। তাঁরা মনে করেন, শিল্প-বিপস্নব পূর্বনির্ধারিত কোনো ঘটনা নয় – শিল্প-বিপস্নব ছিল একটি অপরিহার্য বিষয়।

 

পাঁচ

‘Development Planning under strategic Uncertaintity’ প্রবন্ধে ব্রস লিটলরয় বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার দিকে লক্ষ রেখে যে-কোনো পরিকল্পনায় বিভিন্নমুখী কিন্তু আমত্মঃসম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এজন্য তিনি বিখ্যাত অর্থনীতির দার্শনিক জিএলএস শ্যাক্ল (G.L.S. Shackle) এবং আলবার্ট হিরস্ম্যানের (Albert Hirschman) মডেলটি ব্যবহার করেছেন। পরিকল্পনাকারীকে ভবিষ্যতের অনেক অনিশ্চিত সম্ভাবনার কথা মনে রাখতে হয়। বাংলাদেশের পরিকল্পনা রচনাকারীদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। সামনে এগিয়ে যাওয়াই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি অনিশ্চিত। এখানে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, যা দেশটিকে সবসময় পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের যে-কোনো পরিকল্পনার স্থিতিস্থাপকতা এবং বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার শক্তি বৃদ্ধির জন্য দরকার বস্ত্তগত, মানবিক ও সাংগঠনিক এক অখ- পরিকল্পনা তৈরি করা; কিন্তু দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে তা যে-কোনো সময়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

কোনো দেশের পরিকল্পনা সে-দেশের জলবায়ু, মাটি, পানি ইত্যাদির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হয়। যে-কোনো সরকার স্থিত অবকাঠামো ভালো বা মন্দভাবে ব্যবহার করতে পারে। যেমন শিক্ষা একজন কৃষককে উৎপাদনে আগ্রহী ও দক্ষ করে তুলতে পারে, আবার সেই একই শিক্ষা কাউকে দুর্নীতিপরায়ণ করতে পারে। পরিকল্পনাবিদ ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ করেন। অনেক কিছু অনুমান করতে হয়। কেউ ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না। এমন কোনো টেলিস্কোপ নেই, যার দ্বারা আমরা ভবিষ্যৎ দেখতে পারি। গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শ্যাক্ল সেগুলোকে ‘চূড়ান্ত পছন্দ’ বলেন, যেগুলো পরিবর্তনহীনভাবে ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করে। আমাদের ভবিষ্যৎ অজানা অনুমানমাত্র। তখন কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দ্বারা ‘চূড়ান্ত পছন্দ’ তৈরি করা যায় না।

যে-কোনো পরিকল্পনা তৈরির সময় যেসব সহযোগিতামূলক উপাত্তকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, সেগুলো যে তখন ‘অসহযোগিতায়’ পরিণত হয়, তা বলা যায় না। এই অনিশ্চিত ‘ভাগ্য’ নিয়েই একজন পরিকল্পনাবিদ একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। যেমন একটা কৌশল হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া কিংবা কৌশলে তার অভিঘাত পাশ কাটিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প যাঁরা তৈরি করেন, তাঁদের ‘চূড়ান্ত পছন্দ’ বাছাই করা অনেকটা দাবা খেলার মতো।

উপসংহারে লিটলরয় বলেন যে, অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার চিন্তার অনেকখানি জায়গা নিয়ে আছে মানুষের কল্যাণে শিক্ষা। সে-শিক্ষা মানুষের ভেতরের সূক্ষ্ম মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণাগুলো উস্কে দেয় – মানুষকে অমানবতার পথ থেকে দূরে সরিয়ে আনে। তাঁর মতে, ফলিত পা–ত্য সব আনুষ্ঠানিক তত্ত্ব এবং পরিসংখ্যানের জটিল হিসাব-নিকাশ অতিক্রম করে যায়। বাংলাদেশে সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্যে পার্থক্য বিশাল। ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার অনেক পড়ে তা ধরা পরে। কোনো তত্ত্ব ও পরিসংখ্যানই অনিশ্চয়তার জাল ছিন্ন করতে পারে না। দূরকল্পনা ও আবেগ হিসাব-নিকাশের স্থান গ্রহণ করে।

 

ছয়

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। ১৯৯০ সালের পর দেশের প্রকৃত আয় মাথাপিছু চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উন্নয়নের ফলে দারিদ্রে্যর মাত্রা কিছুটা কমলেও আয়-বৈষম্য এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনেকটাই মস্নান করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কিছু বিশ্বসূচক স্পর্শ করেছে। যেমন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লিঙ্গবৈষম্য দূর করেছে, শিশুমৃত্যুর হার কমিয়েছে, HIV প্রতিরোধে সাফল্য অর্জন করেছে, যক্ষ্মারোগ বিস্তার বন্ধ করতে পেরেছে, ওজোন নির্গতকারী বস্ত্তর ব্যবহার কমাতে পেরেছে এবং সুপেয় পানির প্রাপ্যতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে পেরেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ব্যর্থতার দিকগুলোর মধ্যে আছে ক্ষুধা হ্রাসে ব্যর্থতা, ছেলেমেয়েদের প্রাইমারি শিক্ষার শেষ ধাপে নিয়ে যেতে পারেনি, তার আগেই সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় কারণে ছেলেমেয়েরা ঝরে পড়ে; মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারেনি এবং বৈজ্ঞানিক পয়ঃপ্রণালির কাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। ড. মুজেরি বাংলাদেশের অর্থনীতির এই ভালো-মন্দ দিকগুলোর প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর ‘Financing Development Gaps in the Post-2015 Era : Challenges and Prospects in Bangladesh’ নামের বড় প্রবন্ধটি উপস্থিত করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষেতে মুজেরি জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ‘Sustainable Development Goal (SDG)’-এর শর্ত পূরণে বাংলাদেশের অর্জন বা অসমর্থতা তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে বাংলাদেশের সব অর্জনকে মস্নান করে দেয় যেগুলো সেগুলো হলো আয়-বৈষম্যের ফাঁদ, দুর্বল সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং জলবায়ুর ধ্বংসান্তক প্রভাব মোকাবিলায় ব্যর্থতা। তিনি ২০১৫ সালের পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষক্ষ্যর ১৭টি উদ্দেশ্য সামনে রেখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্যগুলোকে নির্দেশ করতে চেয়েছেন। ছোট্ট অথচ বিপুল জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা ও ধারাবাহিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে সামনে এগিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ভালো ফল করতে পেরেছে। বিশ্বকে দেখাতে পেরেছে যে, সম্পদের স্বল্পতা সত্ত্বেও একটি দেশ মানবও সমাজ-উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে।

গত দশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মাথাপিছু জিডিপি শতকরা ছয়ে পৌঁছেছে। তবে তা এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে এখনো কম। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশ সাহায্য করেছে। তবে মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে কৃষির অবদান কমেছে এবং শিল্পের অবদান বেড়েছে। সেবা খাতে আয় তেমন বাড়েনি। সমাজ ও মানব-উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধীরগতি সত্ত্বেও সমাজ ও মানব-উন্নয়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার গড় উন্নয়নকেও ছাড়িয়ে গেছে। সামাজিক, মানবিক এই উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্র ও বৈষম্যেরও কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। যদিও বলা হয়, ‘অর্থনৈতিক উন্নতি দরিদ্রের বন্ধু, শত্রম্ন নয়’, তবু অর্থনৈতিক উন্নয়নসূচক দিয়ে দারিদ্র মাপা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে দরিদ্রশ্রেণির ভাগ্য পরিবর্তনের বিষয়টি খুবই জটিল। এটা নির্ভর করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্রের সম্পর্কের চরিত্রের ওপর। মুজেরির মতে, এ দুয়ের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ নয় এবং দুভাবে কাজ করে। এক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আয়-বণ্টনের সম্পর্ক এবং দুই, আয়-বণ্টন ও দারিদ্রের সম্পর্কের ওপরই দারিদ্র হ্রাস বা বৃদ্ধি পাওয়া নির্ভর করে। দারিদ্রবিমোচনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূমিকা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।

বাংলাদেশের দরিদ্রশ্রেণির এক-তৃতীয়াংশ ‘চরম দারিদ্রে’র মধ্যে বাস করে। ১৯৯০ দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধিও দ্রুতগতি লাভ করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্রবিমোচন কর্মসূচি ব্যর্থ হলো কেন, এটা এক জরুরি প্রশ্ন। সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভালো ফল করলেও দ্রুত উন্নয়নশীল এশিয়ার অন্যান্য দেশের পর্যায়ে পৌঁছাতে বাংলাদেশকে এখনো অনেক দূর যেতে হবে। এজন্য ‘ঐতিহ্যবাহী’ অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে বের হয়ে আসা একান্ত দরকার। ২০১৩ সালে মোট জাতীয় আয় ছিল ১,০১০ ডলার জনপ্রতি। এটা পূর্ব এশিয়ার মাত্র শতকরা ১৮ শতাংশ এবং বৈশ্বিক জিএনআইয়ের ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে প্রবেশ করেছে বটে, তা এখনো অনেক কম। সম্প্রতি মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে বাংলাদেশ কিছুটা অগ্রসর হয়েছে। এটা ঠিক, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতাও সত্য। এমনকি যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো, সেখানেও ক্রমবর্ধমান বৈষম্য চোখে পড়ে। যেমন গ্রাম ও শহরের পার্থক্য, ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য, নারী ও পুরুষের মধ্যে বিরাজিত বৈষম্য এবং ছেলে ও মেয়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈষম্য বিমোচনে বাংলাদেশের অর্জন সামান্যই। মুজেরি বাংলাদেশের কর্মসংস্থার প্রাপ্যতা এবং উন্নয়নমুখী কাজের স্বল্পতা নিয়ে তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন। যেহেতু বাংলাদেশের বৈষম্য মহামারি আকার ধারণ করেছে, তাই বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফাঁক হচ্ছে মানুষের ভোগ-বঞ্চনা। সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে চরমতম ফাঁকে জড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। এখানে দারিদ্রের বহু রূপ। তারা সচরাচর মূল কেন্দ্র থেকে বহুদূরে শহরের স্কুল-কলেজ-সুযোগ-সুবিধাবর্জিত স্থানে জড়াজড়ি করে বাস করে। সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত এসব মানুষ ঘন অন্ধকারে ডুবে আছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীরা জাতীয় ও আঞ্চলিক ভেদে পুরুষতন্ত্রের পদভারে জর্জরিত। সম্প্রতি গৃহীত নতুন বিবাহনীতি এ-অবস্থার অবনতি ঘটাবে বলে জাতীয় দৈনিকে প্রায় প্রতিদিন সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে – নারী সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অর্জনে, সঞ্চয় সৃষ্টিতে অসমর্থতা এবং অদক্ষ শ্রম প্রদানকারী এসব দরিদ্রশ্রেণি প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানবেতর স্তরে পড়ে আছে। এছাড়া প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন তাদের জীবন আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে। বাংলাদেশের শ্রমশক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কর্মক্ষেত্রের যথেষ্ট প্রসার ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। তার কারণ হিসেবে মুজেরি অর্থনৈতিক উন্নয়নের চরিত্র ও রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনকেই দায়ী করেছেন। কাজের আশায় যারা কৃষিকাজ ছেড়ে শহরে আসছে তারা অধিকাংশই নিম্ন-উৎপাদনশীল সেবা সেক্টরে স্বল্পবেতনে ঢুকতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যক্তিপর্যায়ে গড়ে ওঠা ছোট ছোট সেবা খাত বা গৃহশ্রমিক হিসেবে ঢুকছে। তাদের বাধ্য করা হয় এমন নিম্ন-উৎপাদনশীল কাজে প্রবেশ করার জন্য, কারণ উচ্চ-উৎপাদনশীল কাজে ঢোকার অনেক বিপদ আছে এবং তার জন্য দরকার মানসম্মত শিক্ষা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ। এভাবে তারা বৈষম্যের জালে জড়িয়ে পড়ে। ফলে তারা বাধ্য হয় গ্রামের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিতে। এভাবে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যবঞ্চিতদের জীবন আরো বিপদসংকুল হয়ে ওঠে। তাই মুজেরি বলেন যে, দ্রুত দারিদ্রবিমোচনের জন্য দারিদ্র-সৃষ্টিকারী কর্মসংস্থানের দ্রুত হ্রাস করা দরকার। সেজন্য দরকার বৃহত্তর অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন এবং সমতাবিধানের অর্থনীতির দ্রুত বাস্তবায়ন।

 

অবকাঠামোগত অসম্পূর্ণতা

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুবই সামান্য। এর ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য ক্রমশ অসুবিধাভোগী শ্রেণির বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। তাই মুজেরি মনে করেন, অবকাঠামোর উন্নয়ন বাংলাদেশের জন্য একটি জরুরি বিষয়। সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই শোচনীয়। মানুষ চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছে, সমাজকে অস্থির করে রেখেছে। এ থেকে উদ্ধারের জন্য যা করণীয়, তা করতে বাংলাদেশ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। বাস্ত্তসংস্থানিক (ecological) এবং জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তাই প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর আরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। সেজন্য বাংলাদেশ জৈবিক ও সৌর জ্বালানি ব্যবহার, বায়ুচালিত শক্তি উৎপাদন এবং বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার করে অবস্থা সামাল দিতে পারে। বিশ্ব যে-গতিতে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে, সে-তুলনায় বাংলাদেশের গতি খুব মন্থর। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের ফলে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। মুজেরি তাঁর বিরাট প্রবন্ধে বাংলাদেশের অগ্রগতির পাশাপাশি অনর্জিত ব্যর্থতার দিকগুলিই স্পষ্ট করে তুলেছেন। প্রচুর পরিসংখ্যানের সাহায্যে তাঁর বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন। ঢাকায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিশ্বের আমত্মঃসংসদীয় ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেল গত এপ্রিলে, ২০১৭ সংসদ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে যা বলেন তা মুজেরির বক্তব্যের প্রতিধ্বনি। অ্যালান ডুশের প্রবন্ধেও আমরা একই সুর লক্ষ করেছি। মার্টিন চুং গং বলেন, ‘হতাশা, সামাজিক অসমতা (বৈষম্য), অবিচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সুযোগের অভাব থেকেই সহিংস সন্ত্রাসবাদের জন্ম।’ অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে কেবল মাথাপিছু আয় দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, তাঁর কথার মধ্যে তারই প্রতিধ্বনি শুনি। তাই সেক্রেটারি জেনারেল চুং গং বলেন, ‘সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সর্বক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈষম্য কমাতে এবং মানবিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সংসদ কীভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, সে-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

(৪ এপ্রিল, ২০১৭, সমকাল)

 

সাত

এর পরের প্রবন্ধটির লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আতিউর রহমান। প্রবন্ধটির নাম ‘Inclusive Development and Rabindranath Tagore’। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের বিশ্বব্যাপী যে-ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, একশ বছর পর তার কতটা বজায় রয়েছে, সার্ধশতবার্ষিকীতে ২০১১ সালে জেমস ক্যামবেল লন্ডন টাইমস সাপিস্নমেন্টে এ-প্রশ্ন তুলেছিলেন। এখন রবীন্দ্রনাথ কে পড়ে? ইংরেজি ভাষাভাষি অঞ্চলে রবীন্দ্রচর্চা যথেষ্ট হ্রাস পেলেও স্পেন ও ল্যাটিন আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ এক নতুন প্রেরণা হিসেবে এখন যেন আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। ফ্রান্সের নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক আঁদ্রে জিদ রবীন্দ্রনাথের কবিতার সৌন্দর্য অস্বীকার করেননি। তিনি গীতাঞ্জলির ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনুবাদ করেন। চিলির নোবেলজয়ী কবি পাবলো নেরুদা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ২০টি প্রেমের কবিতা নামক সংকলনে রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথকে ভুল বোঝার প্রবণতা পশ্চিমা বিশ্বে ছিল। তাঁকে অনেকেই পূর্ব গোলার্ধের একজন অতীন্দ্রিয়বাদী কবি বলে মনে করতেন। এরকম ভুল বিশ্বাস ব্রিটেনে আজো অব্যাহত থাকলেও রবীন্দ্রনাথের ওপর নতুন গবেষণায় পৃথিবীর বহু দেশে তাঁর শিক্ষা-দর্শন ও কৃষি উন্নয়নে তাঁর ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা হচ্ছে। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক মাইকেল কলিন্স তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত Empire, Nationalism and the Postcolonial World : Rabindranath Tagore’s writings on history, politics and society (Collins, 2012) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথকে কেবল অতীন্দ্রিয়বাদী কবি হিসেবে চিহ্নিত করার বিরোধিতা করেছেন। বরং তাঁকে বর্তমানের একজন সমাজ-দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

এই বিতর্ক নিয়ে সামান্য আলোচনার পর আতিউর রহমান তাঁর মতামত তুলে ধরেন। ঠাকুর মূলত একজন কবি এবং সৃজনশীল লেখক। একজন স্বাপ্নিক – একই সঙ্গে একজন উপযোগবাদী। ১৯৯৭ সালে New York Review of Books জুন সংখ্যায় অমর্ত্য সেন ‘Tagore and His India’ নামক অসাধারণ প্রবন্ধে পাশ্চাত্য জগতের ভুল ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা সংস্কৃতির অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর রচনার কিছু অংশ পূর্ব-সংস্কৃতিজাত – বিশেষ করে ভারতীয়। হেগেলের মতে, যা হাজার বছর ধরে ইউরোপবাসীর স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছিল।’ সেন ইউরোপীয়দের এ-ভুল ভেঙে দেন যে, রবীন্দ্রনাথ অতীন্দ্রিয়বাদী কবি ছিলেন।

এই ভুল ধারণা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চিন্তার কোনো শেষ হয়নি পশ্চিমা বিশ্বে এবং ভারতীয় সমাজে। মূলত একজন কবি ও সৃজনশীল লেখক হিসেবে তাঁকে বিচার করা হয়। তিনি ছিলেন একজন স্বাপ্নিক। যেন স্বপ্নই দেখে গেছেন সারাজীবন। যেন কোনো ইহজাগতিক কাজের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। এ-ধরনের ত্রম্নটিগুলো উন্মোচন করেছেন আতিউর রহমান। অর্থনীতিবিদ হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন; সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি যে মৌলিক চিন্তা রেখে গেছেন, তা আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

আতিউর রবীন্দ্রনাথের মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রাম, গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং তাঁর শিক্ষা-দর্শন সম্পর্কে পাঠকের চিন্তা উস্কে দিয়েছেন। আজ যে টেকসই উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছে বিশ্ববাসী, তার সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ রবীন্দ্র-চিন্তার মধ্যে পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন লেখক। একশ বছর আগে এ-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। একজন মানবতাবাদী কবির চোখ দিয়ে তিনি জাতীয়তাবাদী আদর্শ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, শিক্ষা এবং উন্নয়নের তত্ত্ব দেখেছিলেন। কবির মন নিয়ে তিনি আর্থিক ও সামাজিক সমস্যাগুলোকে দেখেছিলেন। মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসার নৈতিক মূল্যবোধ যে-কোনো উন্নয়নের জন্য কত জরুরি রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন লেখায় তা উল্লেখ করেছেন। অমর্ত্য সেনও সম্প্রতি On Ethics and Economics বইয়ে সে-আদর্শ মূর্ত করে তোলেন এবং মানবকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক তত্ত্বের জন্ম দেন, যা কোনো গড়পড়তা আয় দিয়ে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

আতিউর বলেন, রবীন্দ্রনাথ ভাবতেন যে, ভারতের ইতিহাস একটি মিশ্রসংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। শুধু আর্য বা অনার্যের ইতিহাস নয়। শুধু হিন্দু কিংবা মুসলমানের ইতিহাস নয়। তিনি বলেন, ‘তাঁর পারিবারিক সংস্কৃতি তিনটি ভিন্ন-ভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। হিন্দু, মুসলিম ও ব্রিটিশ।’ ১৯১৬-১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদ নিয়ে যে-তিনটি বক্তৃতা দেন, তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় Nationalism নামে। উত্তাল জাতীয়তাবাদী জোয়ারের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদবিরোধী চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত হন। ওই বক্তৃতায় তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমের বিশাল সাফল্যের পাশাপাশি এ-কথাও তুলে ধরেন যে, পশ্চিমাবিশ্বে মানবতাবাদের পশ্চাদপসরণ ঘটেছে এবং তারা ক্ষমতার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই নয় শুধু, ভারতবর্ষেও রবীন্দ্রনাথের সে-বক্তব্য ভালোভাবে গৃহীত হয়নি। তিনি ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্ম ও জাতিকে একই ছাতার নিচে আসার আহবান জানান।

সব ঠাই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া।

দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া \

(প্রবাসীসঞ্চয়িতা, বিশ্বভারতী, পৌষ ১৪১৮, পৃ ৪৬৫)

 

গীতাঞ্জলির ‘ভারতবর্ষ’ কবিতাটিও তার সাক্ষ্য বহন করে। এ-প্রসঙ্গে দেবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ-বিরোধী স্বদেশ প্রেম (সেতু, কলকাতা, ২০১৫) বইটির উল্লেখ না করে পারলাম না। বইটির নামই বলে দেয় লেখক কী বলতে চেয়েছেন।

তবে তাঁর সবচেয়ে সৃজনশীল চিন্তার প্রকাশ দেখা যায় শিক্ষার ক্ষেত্রে। বারো বছর বয়সে ইংরেজি স্কুলের নিয়ম-কানুনের অত্যাচারে স্কুল-পালানো রবীন্দ্রনাথ আর কখনো স্কুলমুখো হননি। মেকলে-প্রবর্তিত ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থার তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধী। তাই তিনি সারাজীবন ভারতবাসীর জন্য ব্রিটিশের সিঁড়িভাঙা শিক্ষার কড়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে ভারতের নিজস্ব একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা করেছিলেন এবং তারই মূর্ত রূপ হলো শহর থেকে দূরে, ছায়াঢাকা এক গ্রাম্য পরিবেশে ‘শামিন্তনিকেতনের’ প্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথ পরিবারের জমিদারি তদারকিতে এলে (১৮৯১-১৯০১) পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং কৃষকদের দারিদ্র তাঁর চিন্তার ওপর প্রভাব ফেলে। শিয়ালদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরে নদীপথে যাতায়াতের সময় তিনি অনেক কবিতা লেখেন। তিনি সমবায় পদ্ধতিতে কৃষকদের ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করেন এবং নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে পতিসরে একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। পতিসরই তাঁর মানবতাবাদী চিন্তার এক বাস্তব চিত্র।

রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। কিন্তু তা যান্ত্রিকভাবে ভারতবর্ষের দরিদ্র কৃষকদের ওপর আরোপের বিরোধিতা করেন। তিনি পশ্চিমা আধুনিকতার সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী চিন্তার মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন ব্রিটিশের আগমনে এক নতুন যুগের শুরু হয়েছে। তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে ছিল শতাব্দীব্যাপী সামন্তবাদী অমানবিক ঐতিহ্যের পরিবর্তন, যে-কাজটি শুরু করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। কিন্তু তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী সমাজ-কাঠামোর কথা মোটেই ভুলে যাননি। শিক্ষা ও সমবায় পদ্ধতিতে চাষবাস তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে থেকেছে। আতিউর দক্ষতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই মানবিক চিন্তা ও তার সার্থক প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রবন্ধটি সুখপাঠ্য ও তথ্যবহুল।

 

আট

পরবর্তী প্রবন্ধে জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি-বাণিজ্য উদারীকরণ সম্পর্কে একটি পরিমাণগত পর্যবেক্ষণ করেছেন হেলাল আহম্মদ।

কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল এ-কথা সর্বজনবিদিত। তবে কৃষি দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপরও নির্ভরশীল। প্রাযুক্তিক উন্নয়ন সত্ত্বেও কৃষি এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন বলতে তিনি তাপমাত্রা বৃদ্ধি, স্বল্প বৃষ্টিপাত, দ্রুত পরিবর্তনশীলতা, ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির কথা বলেন। জলবায়ু ও কৃষি উৎপাদনের মধ্যে সম্পর্ক অতি নিবিড়। তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে কৃষিপণ্য উৎপাদন বিভিন্ন সমাজে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলতে পারে। তা নির্ভর করে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য সরবরাহ বা বিদেশে রপ্তানি নীতিমালার ওপর। হেলালের গবেষণা প্রমাণ করে যে, জলবায়ু পরিবর্তন সত্ত্বেও ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি কিছুটা মোকাবিলা করা যেতে পারে।

বাইরের চাহিদা ও অবস্থার ওপর নির্ভর করে কৃষক তার উৎপাদন বৃদ্ধি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও আরো কিছু বিষয় আছে, যা উৎপাদন ও মোট রেভিনিউয়ের ওপর প্রভাব রাখে। যেমন লিঙ্গ, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফার্মের আয়, ফার্মের বাইরের আয়, পরিবারের আয়তন, পারিবারিক সম্পদ, মালিকানার ধরন, উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানা ও আবহাওয়া বার্তার কার্যকারিতা। এছাড়া বিদ্যুৎ, পানি, ঋণ-ভর্তুকির প্রাপ্যতা ইত্যাদি।

 

নয়

রাজশাহী জেলার তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার আমন উৎপাদনের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন মো. আবদুর রশীদ সরকার ও জিনাতুল ইসলাম। এই অঞ্চলের মোট আয়ের শতকরা আশি ভাগ আসে কৃষি থেকে। এছাড়া ছোটখাটো ব্যবসা, সেবা ও দিনমজুর হিসেবে কেউ কিছু আয় করে। গবেষকদ্বয় কৃষকদের বৃহৎ, মাঝারি ও ছোট (ভূমিহীন মজুরও আছে) ভাগে ভাগ করেছেন। তাঁদের গবেষণা বলে, একাশি শতাংশ ছোট, পনেরো শতাংশ মাঝারি ও মাত্র চার শতাংশ বৃহৎ কৃষকের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, তা জাতীয় তথ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অভিজ্ঞতা ও পরিমাণভিত্তিক তথ্য সরবরাহ করেছেন, যা বাংলাদেশের জমি ও কৃষি নিয়ে গবেষণায় সামান্য প্রতিফলিত হয় বলে মনে করেন তাঁরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ-অঞ্চলে পণ্য উৎপাদন হ্রাস পায়, যদি তার তীব্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। নানা কারণে এ-অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন ঋণান্তক। উৎপাদন হ্রাস পায়।

 

দশ

বাংলাদেশের খাদ্য-নিরাপত্তা ও তার অর্জন, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে লিখেছেন কাজী শাহাবুদ্দিন ও মুস্তফা কে. মুজেরি।

খাদ্য-নিরাপত্তার বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় উঠে আসে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক খাদ্য-সংকটের পর। সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও খাদ্যমূল্য বেড়ে যায়। কিন্তু পরে যখন খাদ্যদ্রব্যের মূল্য কমে আসে, তারপরও মূল্য পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনিশ্চিত রয়ে যায়। ২০১১ সালের ‘ফাও’-এর হিসাবে জানা যায় যে, পৃথিবীর খাদ্য-নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা ১৯৯৫-৯৭ সালে ছিল ৮০০ মিলিয়ন, কিন্তু ২০০৯ সালে তা বেড়ে এক বিলিয়ন অতিক্রম করে। তথ্য-উপাত্তের অভাব সত্ত্বেও লেখকরা মনে করেন, বাংলাদেশেও খাদ্য-নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সবার আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু গবেষকদ্বয় মনে করেন, তারপরও খাদ্য-নিরাপত্তার কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। এর জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, সেসব নেওয়া হয়নি।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ২০১৫ সালে ষোলো কোটিতে দাঁড়িয়েছে। তারপরও মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানব-উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামনে এখনো কতকগুলো বাধা রয়ে গেছে। তার মধ্যে দারিদ্রের উচ্চমাত্রা, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং খাদ্য-নিরাপত্তাহীনতার স্থায়ী অটল-অনড় দেয়াল। এই বিশ বছরে দারিদ্রমাত্রা ষাট ভাগ থেকে ৩১.৫ ভাগে নেমে এলেও অনেক দরিদ্র ব্যক্তি লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন পাঁচ কোটি মানুষ দরিদ্র, প্রতি তিনজনে একজন। তাই এটা খুবই আশ্চর্য বলে মনে করেন গবেষকদ্বয়, যে-দেশ Millenium Development Goal (MDG)-এর পথে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে, সে-দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্যে ঘাটতি থাকে কী করে? তাই গবেষকদ্বয় মনে করেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের দারিদ্রের সংখ্যা নিয়ে যেসব উপাত্ত আমরা পাই, লাখ লাখ দরিদ্র সে-হিসাবের বাইরেই থেকে যায়। কারণ তারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে বাস করেন। খাদ্য-নিরাপত্তার বিষয়টি সাধারণত জাতীয় সংবাদমাধ্যমে তেমনভাবে প্রচারিত হয় না। এ-সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা দরকার, মনে করেন লেখকদ্বয়। শেষে অদূর-দূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর সূক্ষ্ম গবেষণা করে পথ-নির্দেশনার কথা বলা হয়েছে।

 

এগারো

আই. কে. এম. মোখতারুল ওয়াদুদ বাংলাদেশের গার্মেন্টসশিল্প গড়ে ওঠা এবং সেক্ষেত্রে বিশ্বায়ন বিষয়ে সরাসরি বিদেশি অর্থায়নের ভূমিকার ওপর কাজ করেছেন।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল নিচের সারির উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। লেখকের মতে তার কারণ ব্যক্তি খাতের প্রসার। ফলে অনেকে শিল্প ও সেবা খাতে অর্থ বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। এর মধ্যে পোশাকশিল্পের উন্নয়নই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। সমগ্র রপ্তানি আয়ের এক-তৃতীয়াংশ আসছে পোশাকশিল্প থেকে। তাই গবেষক পোশাকশিল্পকেই বেছে নিয়েছেন। এই শিল্পটি গড়ে ওঠার পেছনে বিশ্বায়ন ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা নির্ণয় করার প্রচেষ্টা নিয়েছেন।

সদ্যস্বাধীন দেশে তেমন কোনো ভারী শিল্প ছিল না। ছোটখাটো কিছু শিল্প-কারখানা ছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার বড় ও মাঝারি শিল্প, ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ করে। এতে ব্যক্তি খাত গড়ে ওঠে না। ১৯৮২ সালে বিপরীত প্রক্রিয়া শুরু হয়। শিল্প-কারখানাগুলো ব্যক্তি খাতে সমর্পণের অধ্যায় শুরু হয়। বিজাতীয়করণ ও ব্যক্তি খাতের প্রসার শিল্পায়নে জোয়ার আনে। এতে বিদেশি অর্থায়ন বড় ভূমিকা পালন করে। গবেষক বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের এক সংক্ষেপ্ত আলোচনা করেছেন। তিনি তথ্য-প্রমাণাদিসহ দেখান যে, মাত্র ত্রিশ বছরে তৈরি পোশাকশিল্পের আয় বত্রিশ মিলিয়ন ডলার থেকে ২১.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। শস্তা শ্রমের আকর্ষণে বিদেশি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসে। গবেষক ঘণ্টাপ্রতি শ্রমমূল্যের একটি তালিকা পেশ করেছেন। ২০১০ সাল থেকে পোশাকশিল্প-মালিকদের নানারকম সাহায্যের মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদের উৎসাহিত করে। সরকারের পলিসি ধনান্তক।

 

বারো

রেজাউল করিম বকশীও পোশাকশিল্পের ওপর কাজ করেছেন। তবে তিনি পোশাকশিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে তার বিয়োগগাথার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। পোশাকশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক, বিশেষ করে নারীশ্রমিকদের বঞ্চনার কথা তুলে এনেছেন। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কমমূল্যে শ্রম বিক্রি করছেন পোশাকশিল্পে নিয়োজিত পঁচাশি শতাংশ নারীশ্রমিক। অশিক্ষেত, অজ্ঞ, দরিদ্র ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার এসব নারী গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটে আসছেন একটা কাজের সন্ধানে। যে-কোনো কাজ পেলে তাঁরা বর্তে যান। পোশাকশিল্প তাঁদের সামনে এক বিশাল কর্মক্ষেত্রের দ্বার উন্মোচন করেছে। এই সুযোগটা মালিকশ্রেণি ভালোভাবেই ঘরে তুলেছেন। খুবই অমানবিক পরিবেশে ও চুক্তিপত্রহীন দিনমজুরের মতো তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের চাকরি মালিকের ইচ্ছাধীন। বেতন কম, মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে বঞ্চিত তাঁরা। তাঁদের ওপর যৌন হয়রানি চলে নিয়মিত। লজ্জা ও চাকরি হারানোর ভয়ে তাঁরা মুখ খোলেন না। ইউনিয়ন হয় নিষিদ্ধ, না হয় অকার্যকর। কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। শ্রমিকদের দরকষাকষির ক্ষমতা না থাকায় তাঁরা বাধ্য হন এই অল্প বেতনে কাজ করতে। গবেষকের মতে, তাঁরা ‘hand to mouth’ বেঁচে থাকেন। নারীশ্রমিকদের ওপর নানাবিধ নির্যাতনের ছবি তুলে ধরেছেন বকশী।

বিজিএমইএর ভূমিকাও রহস্যজনক। তারা সংবাদ পরিবেশনের সমালোচনা করে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সংবাদমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষাবলম্বন করে। মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ যে, দুর্ঘটনার জন্য মালিকপক্ষের কোনো শাসিন্ত হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ তাদের হাতে নেই। এতে প্রমাণ হয় যে, পোশাকশিল্পের ওপর ধনিক ও ক্ষমতাবানদের কব্জা কত শক্ত। ত্রিশজনেরও বেশি পোশাকশিল্পের মালিক সংসদ সদস্য। বকশী পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে এ-কথাও বলেন, এই অসুবিধাগুলো দূর করতে পারলে তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। শেষে সুপারিশ করেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিমালা মেনে পোশাকশিল্পগুলোর প্রতি বিদেশি দাতা ও ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করা।

 

তেরো

এম. সাইদুর রহমান খান বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ICT) উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ ও বাধাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রথমেই এই শিল্পের এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ১৯৬৪ সালে আণবিক শক্তি কেন্দ্রে প্রথম কম্পিউটার স্থাপন করার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞান গবেষণাগারে তা বিস্তার লাভ করে। জানা যায়, বিশ হাজার স্কুলে আইসিটি সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তথ্যশিল্পে প্রায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার মানুষ কাজ করছে। বর্তমান সরকার চার হাজার পাঁচশো সাতচলিস্নশটি ইউনিয়নে, তিনশো একুশটি পৌরসভায় এবং চারশো একটি ওয়ার্ডে ডিজিটাল কেন্দ্র স্থাপন করেছে। মূলত তিনি এ-পর্যন্ত সরকারি পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে ভবিষ্যতের জন্য কিছু সুপারিশ পেশ করেছেন।

 

চোদ্দো

স্মারকগ্রন্থের শেষে সনৎকুমার সাহার দুটো পুরনো লেখা মুদ্রিত হয়েছে। প্রথম প্রবন্ধে সনৎ গ্যারি জে. বাসের The Blood Talegram, 1971 এবং শ্রীনাথ রাঘবনের 1971, A Global History of the Creation of Bangladesh বই দু-খানা নিয়ে বিশেস্নষণ করেছেন। পাকিস্তানের গণহত্যার বিরুদ্ধে ঢাকার তৎকালীন আমেরিকান কনস্যুলেটের কনসাল-জেনারেল আর্চার বস্নাড ও তাঁর বিশজন সহকর্মী নিকসন-কিসিনজারের কাছে ৬ এপ্রিল একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা বলেছিলেন, ‘আমাদের সরকার গণতন্ত্র দমনের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার গণহত্যার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার প্রমাণ করেছে যে, তারা নৈতিকভাবে শূন্যগর্ভ।’ চাকরির ঝুঁকি নিয়ে বস্নাড টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলেন। মার্কিন সরকার ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে দেশে কোনো অফিসে তাঁকে বসিয়ে রাখে। এ-ঘটনা দীর্ঘদিন চাপা পড়ে ছিল। তথ্য-উন্মুক্তির পর গ্যারি জে. বাস প্রচুর পরিশ্রম করে বাংলাদেশের ২৪ বছরের ধারাবাহিক সংগ্রাম ও ২৫ মার্চ, ১৯৭১ বাংলাদেশের ওপর সামরিক আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ তুলে এনেছেন। এই বইটা আর্চার বস্নাডকে স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো বই।

রাঘবনের বইটিও প্রচুর পরিশ্রমের ফসল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে কলকাতায় বসে খোন্দকার মোশতাক ও আওয়ামী লীগের সাংসদ কাজী জহিরুল কাইয়ুমের বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের তথ্য ফাঁস করেছেন রাঘবন। কলকাতায় আমেরিকার কনসাল জেনারেলের বৈঠকের দিনক্ষণ তুলে ধরেছেন তিনি। সে-ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে মোশতাককে রাজনৈতিক কারণে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার না করে প্রবাসী সরকার তাকে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ করে রাখে। সনৎ তাঁর প্রবন্ধটি শেষ করেন আমাদের স্বপ্ন, বাস্তবতা এবং তার বর্ণনার মধ্য দিয়ে। পঁচাত্তরের হত্যাকা- ও সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ক্যু-পালটা ক্যুর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। অতিপরিচিত ইতিহাসের পথ ধরে জিয়াউর রহমান তাঁর অবৈধ ক্ষমতাদখলকে হালাল করার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধান রক্তাক্ত হয়। তারপর জিয়া হত্যা ও জেনারেল এরশাদের ক্ষমতারোহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকীকরণ সম্পূর্ণ হয়। গণআন্দোলনে এরশাদের পদত্যাগ ও ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। সনৎ বলেন, ১৯৭০ সালের পঁচিশ শতাংশ শক্ত লবি আওয়ামী লীগের বাক্সে ভোট দেয়নি। সেনা শাসনামলে তাদেরই আধিপত্য স্থাপিত হয়। ‘Bangladesh : Yesterday, Today and Tomorrow’ প্রবন্ধের ভূমিকায় সনৎ বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলেও ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আন্তসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ শত্রম্নমুক্ত হয়। এই নয় মাস পাকবাহিনী এদেশে সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালিয়েছিল। কিন্তু গল্পের শেষ এখানেই নয়। অতীতের দ্বান্দ্বিকতার মধ্যে বর্তমান লুকিয়ে থাকে, যা ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। বিপুল ক্ষতিস্বীকার করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার সে-চেতনা কালের গতিতে ভেঙে পড়েছে এবং ক্ষুদ্র অর্থে তা আমাদের বাঙালি জাতিকে নিয়ে নোংরা খেলা খেলতে শুরু করেছে। অতীতের শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে আজ আমরা বর্তমানে পৌঁছেছি এবং এখান থেকেই আমাদের ভবিষ্যতের পথ খুঁজে নিতে হবে। সনতের ‘গতকাল’ দুই হাজার বছরের পথচলা। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। এই দুই হাজার বছরের ইতিহাস, সনৎ যা বলতে চেয়েছেন, তা রবীন্দ্রনাথের

হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন-

শক-হুনদল-পাঠান-মোগল এক দেহে হলো লীন।

 

এই দুটি চরণেই বলা যায়। কিন্তু সনতের ‘গতকাল’ সেখানেই থেমে যায়নি। তার মধ্যে পাকিস্তানের (১৯৪৭-৭১) অভিজ্ঞতাও অন্তর্ভুক্ত। সনৎ দক্ষতার সঙ্গে সে ‘গতকালের’ চিত্র অংকন করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা-সূর্য পূর্ব আকাশ আলোকিত করে উদিত হয় এক নতুন দিনের সূচনার বার্তা নিয়ে। এখানেই শেষ হয় সনতের ‘গতকাল’।

সনতের ‘আজের’ শুরু হয় তখন থেকে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবের দেশে প্রত্যাবর্তন, প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ, অল্পদিনের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ ও শেখ মুজিবের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ। তারপর শুরু হয় সনতের ‘আজকের’ রাজনৈতিক ও আদর্শিক পালাবদল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ, পরপর দুই বছর খারাপ আবহাওয়া ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। সেই সুযোগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে থাকা বাংলাদেশবিরোধী শক্তি আঘাত হানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে। সনৎ বলেন যে, ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের কূলভাঙা বিজয়ে পঁচিশ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে সে-সংখ্যা পঁয়ত্রিশ শতাংশে উন্নীত হয়। কলকাতার ষড়যন্ত্রকারীকে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসিয়ে আসল খুনিরা থাকে পর্দার পেছনে। মোশতাককে দিয়ে জেলখানার হত্যাকা- ঘটায়। অতঃপর আইয়ুব খানের পথ অনুসরণ করে মেজর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেন। অতঃপর সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন, জিয়া হত্যা, এরশাদের ক্ষমতা দখল, রাষ্ট্রধর্ম আইন করায় ইতিহাসের চাকা উলটো দিকে ঘুরতে শুরু করে। ১৯৯১ সালে বিএনপির বিজয় দেশকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। ২০০৬ সালে আবার সামরিক শাসন। কিন্তু জনসমর্থনহীন সামরিক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ২০০৯ সালে সে-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে।

সনৎ বলেন যে, এতসব বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জাতীয় আয়ের মাত্র বিশ শতাংশ কৃষি থেকে, ত্রিশ শতাংশ শিল্প থেকে এবং পঞ্চাশ শতাংশ সেবা খাত থেকে আসছে। শিক্ষার হার ষাট শতাংশের কাছাকাছি। জন্মহার কমে ১.২ শতাংশ হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছরে পৌঁছেছে। সনৎ আশা করেন, বাংলাদেশ এ-অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে পশ্চাৎপদতা ও পশ্চাৎপদ ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে।

সনতের ‘আগামীকাল’ কেমন হবে? এ-বিষয়ে জোর দিয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। লিটলরয়ের লেখায় আমরা জেনেছি ‘ভবিষ্যৎ দেখার মতো কোনো টেলিস্কোপ এখনো আবিষ্কার হয়নি।’ তবে অতীতের ঘাত-প্রতিঘাতপূর্ণ সমাজ-পরিবর্তনের আলোকে তার কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে। সনৎও তাই করেছেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে প্রাযুক্তিক বিপস্নব সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশেরও চেহারা পালটে দিয়েছে। উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন হয়েছে। বর্ণবাদ বা সাম্প্রদায়িক পরিচয় গুঁড়িয়ে গেছে। এতে অনিশ্চয়তা বেড়েছে ঠিক, কিন্তু মানুষের কর্মদক্ষতা বেড়েছে, বেড়েছে বিদেশের সঙ্গে আদান-প্রদান, নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে দলে দলে নারীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। শিক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের পেছনে ফেলে দিয়েছে।

এ প্রেক্ষাপটে সনৎ বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার সংক্ষেপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে বলতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশের সভ্যতার শেকড় অনেক গভীরে এবং অনেক শক্ত। সে-সভ্যতার ভিত্তি কিন্তু কোনো বিশ্বধর্ম নয় – বাঙালিত্বই সে-সভ্যতার প্রধান প্রেরণাস্থল। বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু, ইসলাম, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য স্থানীয় উপজাতীয় ধর্মবিশ্বাস সে-সভ্যতাকে শক্তিশালী করেছে মাত্র, বাঙালির বাঙালিয়ানায় নতুন নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত করেছে এ-কথা ঠিক, কিন্তু রয়েছে এতদঞ্চলের মানুষের বাঙালি সত্তা। নানা দিক থেকে নানা স্রোত এসে এ-সভ্যতাকে উড়িয়ে নিতে চেয়েছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। বরং সে-স্রোতটিই বাঙালি সত্তার সঙ্গে মিশে গিয়ে বাংলাদেশের সভ্যতা আরো উন্নত স্তরে নিয়ে গেছে। তার সর্বশেষ প্রমাণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। যে-শক্তি বাঙালি সত্তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তারাই বরং পরাজিত হয়েছে। এরকম গর্ব করার অধিকার কেবল বাঙালিরই আছে।

সনৎ বলেন, কিন্তু এ-কথা ভেবে সুস্থির হয়ে বসে থাকা ঠিক নয়। এখনো নানাভাবে নানা অপশক্তির হুঙ্কার শোনা যায়। আমাদের বাঙালিয়ানার অব্যাহত যাত্রা ব্যাহত করতে তৎপর এখনো নানা অপশক্তি। বঙ্গবন্ধু সে-বাঙালিয়ানার সর্বোচ্চ শিখরে বসে আছেন। আজো সেই আন্তপরিচয়ের সংগ্রাম অব্যাহত আছে। প্রতিটি ‘আগামীকালের’ জন্য নতুন করে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। আমাদের ‘আগামীকাল’ নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেননি সনৎ। অতীতের নানা ঘটনার মধ্য থেকে একটি রাস্তার সন্ধান দিয়েছেন মাত্র। আমরা স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সে-স্বপ্নের বাস্তবায়নে বাধা-বিপত্তি আসবেই – তার মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে একটি সুন্দর সিদ্ধান্ত। সনৎ আশাবাদী। বলেন, আমরা তা আগে ধারণা করতে পারি না। আমরা স্বপ্নপূরণের আশা করতে পারি মাত্র। একই সামাজিক-
সাংস্কৃতিক কাঠামোয় বিভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন দেখেন, ভিন্ন ভিন্ন হয় তাঁদের চাহিদা। কিন্তু সনৎ যে-স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছেন, সেখানেই আমাদের মুক্তি; সেখানেই আমাদের সর্বান্তক মনোসংযোগ করতে হবে। তাহলে অতীত ঐতিহ্যের সিঁড়ি বেয়ে আমাদের প্রত্যাশিত স্বপ্নপূরণের সম্ভাবনার শক্তি সঞ্চয় করবে। r