বাংলা নাট্যের আত্মসন্ধিৎসা

প্রতি জাতিগোষ্ঠীরই থাকে কি অন্তস্থ, আত্মস্থ, নিহিত এক স্বভাব – যা তার মৌল সত্তাস্বরূপ, প্রবণতা-গড়ন? যার আদলে গঠিত হয় তার তাবৎ সংস্কৃতি-বিশ্ব, শিল্পপ্রকরণ, রীতিনীতি? যাকে বলে তার মানসের সমগ্র এক তত্ত্ববিশ্ব। এমন বুঝি মনে করা যেতেই পারে – যেমন ব্যক্তিরও থাকে বৈশিষ্ট্যের আদি কোনো কাঠামো-বিন্যাস। ভারত-উপমহাদেশের আদি নাট্যতত্ত্ব মীমাংসাগ্রন্থ ভরতের নাট্যশাস্ত্রে, নানা অঞ্চলের নাট্যরীতির এক ব্যাখ্যান মেলে। তাতে পূর্ব-ভারতীয় খ-ে আচরিত এক প্রকরণ-বৈশিষ্ট্যের কথা বলা আছে। স্বতঃস্ফূর্ত এক মিশ্র, মুদ্রা-মুক্ত ধরনের কথা বর্ণিত সেখানে – যা অন্য অঞ্চলের রীতি থেকে ভিন্নতর। আজো গ্রামদেশে যেসব নাট্যগীতিরঙ্গ আছে তাও দেখি সেই একই প্রকরণের। এই কি তাহলে বাংলানাট্যের মৌল বৈশিষ্ট্য? মিশ্র, মুক্ত এক স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশনা, মুদ্রাবদ্ধ ‘নৃত্য’ নয়, স্ফূর্ত মুক্ত ‘নৃত্ত’? তবে বাংলা-অঞ্চলে প্রাপ্ত আদি নাটলিপি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কিন্তু সংলাপ-চরিত্রের পরিচিত প্রকরণের ছিল। তা থেকে কী করে এক গীতবাদ্য-নাট্যের বর্ণনাত্মক পাঁচালি-রীতির উদ্বর্তন ঘটল – সংলাপ-চরিত্রের ভিন্নতর আঙ্গিকে? তার মধ্যেই কি বাংলা-স্বভাবের মৌল স্বরূপ নিহিত? কেবল সংলাপ-চরিত্রের নির্দিষ্ট গড়নে যার মানসের সায় ছিল না বুঝি – কোথাও সে তাতে আবদ্ধ বোধ করত, একই মুদ্রার ঘেরাটোপে, মন যাতে তার প্রকাশের মুক্তি যেন ঠিক পেত না। তাই বুঝি

গ্রিসের মতো, বর্ণনা ছেড়ে সংলাপচরিত্রের নির্দিষ্টতায় তার দৃশ্যকাব্য-প্রকরণ সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠেনি। যার জন্য একসময় আমাদের ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক আফসোস ছিল – বাঙালির কোনো নাট্য নেই বলে। অথচ মধ্যযুগ থেকেই পয়ার-পাঁচালির গেয়, অভিনেয় এক আখ্যান-বর্ণনাত্মক নাট্যধারা আজো প্রবহমান নানা অঞ্চলে। তার এই প্রকরণ-বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট এক নাট্যরীতির বিবেচনায় অগ্রাহ্য, নগণ্য অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেল! এর পেছনে তাহলে এমন এক ঔপনিবেশিক-মন ছিল  –  যা স্বদেশীয় সত্তাশিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন! পরদাস্য মনননির্ভরতায় উৎকেন্দ্রিক যে দশাপ্রাপ্তি, ঐতিহাসিক কার্যকারণে নিহিত সে আধিব্যাধির আদি বিকার।

অথচ কলকাতাকেন্দ্রিক ছদ্ম-নাগরিক থিয়েটারের উদ্গাতা রুশ লেবেদেফও ইংরেজির আদলে সে নাট্য-পরিবেশনায়ও স্বদেশীয় রুচির কথা মাথায় রেখে নাচ-গান-বাজনার সঙ্গে সংস্কৃত-রীতির প্রস্তাবনা – এমনকি কৌতুক-ভাঁড়ামিও যুক্ত করেন।

তারপর কলকাতার শৌখিন নাট্যশালায় শেক্সপিয়র ও সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ হতে থাকে। পরবর্তীকালে মৌলিক বাংলা নাটকের ধারা শুরু হয়। ইঙ্গবঙ্গ সমাজ-সংস্কারের মানসে, পুরস্কার ঘোষণা করে নাটক-লেখানো হয় – রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার লেখেন : কুলীনকুলসর্বস্ব। নাগরিক বাংলা নাটকের শুরু থেকেই তাহলে একধরনের সমাজসংলগ্ন প্রবণতা ছিল। সে সঙ্গে স্বদেশি দর্শক-রুচির বিবেচনায় প্রচলিত যাত্রারীতির নানা প্রকরণ অনুসৃত হয়, হতে থাকে। দৃশ্যমধ্যে নাচ-গান-বাজনার প্রয়োগ, কৌতুক-ভাঁড়ামি এবং বিবেকের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। সর্বোপরি বাচিক অভিনয়ে সুরেলা বাচনের অতিনাটকীয়তা, ইংরেজি মঞ্চের অনুসরণে হলেও তার মধ্যে অজ্ঞাতে যাত্রা-রীতিরই প্রবর্তনা ছিল বুঝি।

পেশাদার রঙ্গমঞ্চে দর্শক-রুচি অধিক গ্রাহ্য হতে থাকে। তৎকালীন প্রধান নট-নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের বিখ্যাত উক্তি হলো : ‘মর্মাশ্রয় করিতে হইলে ধর্মাশ্রয় করিতে হইবে।’ বোঝা যায়, সমাজ-মানস ততদিনে সমাজ-সংস্কার থেকে ধর্মাশ্রয়ী হয়ে উঠছে। অতীতে কল্পিত এক ভারতবর্ষের ধর্মীয় ঐতিহ্যে আত্মপরিচয় খুঁজে নিচ্ছে। আর তা যে কেবল হিন্দু-ভারত হয়ে উঠছে – নানা ধর্মমতের সমন্বয়-সংশ্লেষণের অখ-তায় নয়। তাই বুঝি, তার আগের যুগেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত সুলতানা রাজিয়াকে নিয়ে নাটক লিখতে পারেননি – কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাবেন না বলে। স্বদেশীয় ঐতিহ্যের গৌরবমণ্ডিত ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে তাঁর মনোযোগ কেড়ে ছিল রাজিয়া। মহররম নিয়ে মহাকাব্য রচিত হতে পারে বলেও মনে হয় তাঁর; স্বধর্মীয় কেউ কবে তার উদ্যোগ করবে – ভাবেন!

এই সমগ্রতা-বোধ হারিয়ে যায় একমাত্র এক ধর্মীয় উচ্ছ্বাসের আত্মঘাতী বিচ্ছিন্নতায়; যদিও ঐতিহাসিক নাটকের প্রধান আশ্রয় ছিল মোগল বাদশাহি ইতিহাস ও চরিত্র-সকল – শাহজাহান, নূরজাহান, সিরাজদ্দৌলা, মীর কাশিম, টিপু সুলতান। আর পৌরাণিক নাটক মানেই হিন্দুধর্মীয় আখ্যান। বঙ্গভঙ্গ রোধকল্পে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির নাটক হিসেবে ঐতিহাসিক চরিত্রাবলির প্রাধান্য হয়। যদিও সে-আন্দোলনও কোনো যৌথ যোগযুক্ততার আন্দোলন ছিল না – বরং পারস্পরিক ভেদ তাতে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথও এই প্রথম সচেতন হন বিভেদের বাস্তবতা বিষয়ে। যদিও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সে-বিষয়ে অচেতন তখনো। সম্প্রীতি-নাটক সিরাজদ্দৌলা বাঙালি-মনে অবশ্য পরবর্তীকালেও আবেগ-সঞ্চার করে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। শাহজাহান এককালে অভিন্ন মানবনাট্য হয়ে উঠেছিল।

গত শতকের ত্রিশের দশকে শিশিরকুমার ভাদুড়ী বাংলা নাটকের স্বদেশিয়ানা নিয়ে ভাবিত হন। মঞ্চসজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ, সংগীত – সবকিছুতে স্বদেশি রুচির প্রবর্তনা ঘটান। তিনিই বাংলা থিয়েটারের এক অর্থে প্রথম নির্দেশক। থিয়েটারের সব উপাদান একটি সূত্রে যুক্তির সমগ্রতায় বাঁধেন। বাচিক অভিনয়ের একাধিপত্য থেকে নাটক হয়ে ওঠে নাট্য, দৃশ্যকাব্য – একালের অর্থে থিয়েটার।

মনোমোহন বসুই প্রথম নাগরিক থিয়েটারের স্বদেশি হয়ে ওঠার কথা বললেও, শিশিরকুমার তাঁর নাট্যজীবনের শেষপর্বে ঘোষণা করেন – যাত্রাই বাঙালির নিজস্ব থিয়েটার। – হয়তো থিয়েটারের সঙ্গে মেলে বেশি বলে, তার নিজস্বতাসহ। বর্ণনাত্মক নানা বিচিত্ররীতির আখ্যান-পরিবেশনা নিশ্চয়ই তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল। আর সেগুলো তো নাট্য পদবাচ্যই ছিল না নাগরিক মনোবিশ্বে। সে-ই তো অনিবার্য এক ঐতিহাসিক উপনিবেশী সীমাবদ্ধতা।

রবীন্দ্রনাথই একক সৃজন-মনন সামর্থ্যে এই বিচ্ছিন্নতার স্বরূপ বিষয়ে প্রথম সচেতন মহাজন। কিশোরবেলা থেকে বাড়ির

নানা বয়সী কাজের নারী-পুরুষের কাছেই হাতেখড়ি হয় তাঁর স্বদেশীয় বিচিত্র শিল্পপ্রকরণের। – রামায়ণের গল্প শোনা,

লোকগল্প-কিচ্ছা-আখ্যান বর্ণনা, ছড়া কাটা, নানা সুরের বাংলা গান, যাত্রা পরিবেশনা – সবই তাঁর আশৈশব স্মৃতিভাণ্ডারে জীবন্ত স্থায়িত্ব পায়। উনিশ শতকের শেষদিকে জাতীয় মেলায় স্বদেশীয় নানা ক্রীড়া-কসরত ক্রিয়াদিও তাঁর চিরগ্রহিষ্ণু মনে গভীর উত্তেজনা ঘটায়। মধ্যযুগের বাংলা কাব্যসাহিত্যের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, ব্যাখ্যান, লোকছড়া সংগ্রহ  – সে বিষয়ে তাঁর অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণ – এসব তাঁর শিলাইদহ-পূর্বকাল থেকেই চর্চার-পাঠের বিষয় হয়ে ওঠে। দেশসেবা যে নাগরিক আবেদন-নিবেদন, বক্তৃতা-বিবৃতি নয়, আহ্বান করেন তাই তিনি গ্রামসমাজে নাগরিকজনকে স্বদেশযাত্রায়।

তারপর ঘটে তাঁর প্রকৃত স্বদেশবাস – শিলাইদহ, সাজাদপুরের সাধারণ মানুষজন, তাদের কঠিন জীবনের বহুবিধ অনগ্রসরতার সুলুকসন্ধান – আত্মশক্তির উদ্বোধনে বিবিধ বাস্তবপন্থা উদ্ঘাটন-প্রয়োগ; পদ্মার বুকে ঘটে তাঁর প্রকৃতি-প্রতিবেশের সঙ্গে গভীর যোগযুক্ততা – তার ফলে বাংলা ছোটগল্পের প্রবর্তনা। ‘ফিরিয়া এসেছি যেন/ জননীর মাতৃক্রোড়ে’ – কবিতায় সেই সময়কার ধ্রুবপদ বিশেষ। বাউল-ফকির-বৈষ্ণবী সংযোগ তাঁর স্বদেশব্রতের ষোলোকলা পূর্ণ করে।

তারপর শুরু হয় তাঁর বিচিত্র শিল্পপ্রকরণে স্বদেশীয় এক সমগ্রতাসন্ধান, রূপায়ণ। ভারতবর্ষীয় ভাবদর্শন-সংস্কৃতি, কাব্যভাণ্ডার, মধ্যপ্রাচ্য-সুফিতত্ত্ব ও কাব্য-ভাবুকতা আর ইউরোপীয় নন্দন – এই ত্রিবেণি মেলবন্ধন তাঁর পরিবারেই ঘটেছিল – বাংলা-স্বদেশীয় এক সংস্কৃতি-জিজ্ঞাসায়, সহযোগে সম্পন্ন করেন তিনি বিশ্বভারতীয় এক সমগ্রতার আদল – তারই আতীব্র আততিতে তাঁর বিচিত্রবীর্য সৃজন-স্ফূর্তি চিরক্লান্তিহীন ছিল।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন যেন এক প্রভাব-কবি। প্রতিবেশের সঙ্গে নিরন্তর এক মিথস্ক্রিয়ায় সদাজাগ্রত তাঁর মনন, সৃজন-রূপায়ণ।

প্রাথমিক পর্বে, বিলাতফেরত তরুণ ইংরেজি-অপেরার আদলে ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ রচনা-পরিবেশনা করেন। তারপর গীতিনাট্য-নাট্যগীতির নানা নবিসি কাল; শেক্সপিয়রীয় নানা স্থান-কালের পঞ্চাংক নাটক, গ্রিসীয় ত্রিঐক্যচর্চা, গদ্যনাটক, রচিত নাটকের বিচিত্র রূপান্তরণে জীবনভর ক্লান্তিহীন ছিলেন তিনি। গীতাঞ্জলি-পর্বে, আত্ম ও সমগ্রর সঙ্গে জীবন-সম্বন্ধপাতের নাট্য রূপায়ণ ‘শারোদোৎসব’। শুরু হলো স্বদেশি, নিজস্ব আত্মস্থ, এক অনেকান্ত অভিযাত্রা, বিচিত্র প্রকাশোন্মুখতায়। ডাকঘর, প্রায়শ্চিত্ত, অচলায়তন, মুক্তধারা, রক্তকরবী, তাসের দেশ, রথের রশি হয়ে শ্যামা-চিত্রাঙ্গদা-চণ্ডালিকায় উত্তরণ। ইউরোপীয় প্রচলিত মডেল-উত্তীর্ণ স্বদেশীয়তায়। খোলা মুক্ত এক অনির্দিষ্ট পথ, হাটের বাতায়ন-উন্মুক্ত মঞ্চ, তবে বহুবিচিত্র প্রয়োগসাধ্য সে-পরিসর – প্রসেনিয়ামের বদ্ধতা নয়; নাচ-গান-বাদ্যের অভিনব গীতরঙ্গে, সংলাপ-চরিত্রের একাধিপত্যের বদলে বর্ণনাত্মক আখ্যান পরিবেশনার বিচিত্র রূপ-রূপান্তরণ – ক্রমসৃজ্যমান, অনেকা- গঠনবিন্যাসে। নবপুরাণ-প্রতিম আখ্যান-বস্তু, চিরকালের সঙ্গে একালের মেলবন্ধন – চরিত্রসকল আবহমান স্বদেশ-সমাজের আর্কেটাইপ কল্পমুদ্রায় জীবন্ত, তথাকথিত বাস্তব চরিত্রের বিচ্ছিন্নতা পার হয়ে।

রাজা ঠাকুরদা, দাদাঠাকুর, অমল, পঞ্চক, কিশোর, বিশু, রঞ্জন, সুদর্শনা, সুধা, সুরঙ্গমা, প্রকৃতি, সুধা, সুমন, অভিজিৎ – এরা সব প্রাচ্যস্বদেশীয় দীর্ঘ স্মৃতি-শ্রুতিধারায় চিরনব্য চরিত্রবিশেষ। সংলাপও বাংলার গ্রামীণ কথ্যস্পন্দে কাব্যময় – কোনো অঞ্চলবিশেষ বা নাগরিক প্রচলিত মধ্যবিত্ত বাস্তবমন্য কি পৌরাণিক/ঐতিহাসিক অতিনাটকীয় নয়। তার মধ্যে বাংলা অঞ্চলের চিরকালের সারল্য – সম্পর্কের মানববিচ্ছিন্ন ক্ষমতা-ভেদদীর্ণ নয় – তুমি-তুইয়ের কথ্য আন্তরিকতায় যেন ঘুচে গেছে তাবৎ ক্ষমতাসম্পর্ক – মুক্ত এক মানবসম্পর্কের পারস্পরিক উচ্চজ্ঞানের সমতায়। বুঝি আদি এক যৌথ সাম্য-সমাজের স্মৃতি-শ্রুতির কল্প-রূপায়ণ। ‘যে ভাষায় আমরা কথা কইতে পারি না, অথচ যা আমাদের আবেগের সত্য গভীর ভাষা’ – শম্ভু মিত্র রক্তকরবীর বাংলা-বাচন উদ্ঘাটন-আবিষ্কার সন্ধিৎসায় বলেন।

স্বভাবত নাগরিক মধ্যবিত্তের কাছে এহেন রবীন্দ্র-বাচন কবি-কল্পনামাত্র ঠেকে, যার প্রথাগত ভাষ্য করা চলে – সীমা-অসীম কি জীবনদেবতা বা জীবাত্মা-পরমাত্মার চর্বিতচর্বণ-বৎ – কিন্তু রূপায়ণ-অসম্ভব, তাই অমঞ্চস্থ। পাবলিক থিয়েটার, এমনকি শিশিরকুমারও তাঁর প্রাথমিক পর্বের হাস্যরঙ্গাত্মক নাটক করেন কেবল। শোনা যায় শিশিরকুমার রক্তকরবীর কথা নাকি ভেবেছিলেন, নন্দিনীর অভিনেত্রী না পেয়ে ক্ষান্ত হন, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ংও তা করে উঠতে পারেননি।

তবে নানা দেশে নানা ভাষায় ডাকঘর মঞ্চস্থ হয়, ফ্যাসিবাদী সংহার-পর্বে, ছোটদের মানস-প্রস্তুতি হিসেবেও; এমন কি রাজাও হয়েছে কোথাও। তবে বাংলা-মঞ্চের সাধ্য হয়নি রবীন্দ্রনাথের নবীন নাট্য-বাচন মঞ্চে ধারণ করা; ঐতিহাসিক সামাজিক ছদ্ম এক অনুকারী নাট্য-গয়ংগচ্ছ আমু-ুগ্রস্ততায়। তবে গত শতকের চল্লিশের দশকে, বৃহৎবঙ্গে যুদ্ধ-অনুষঙ্গী মানব-দুর্ভিক্ষ নাট্যজনের মানস-জাড্য ভেঙে দেয়। তাতে বামপন্থি গণনাট্য সংঘের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। বিজন ভট্টাচার্য-রচিত এবং শম্ভু মিত্রের সঙ্গে যুগ্ম নির্দেশনায় নবান্ন নাট্যে থিয়েটারের রাজনৈতিক সামাজিক-সংলগ্নতা, এই প্রথম স্পষ্ট চারিত্র্য পায়। নাট্যকার নয়দিনে বাংলা-অঞ্চলের তৎকালীন বাস্তবতা ‘এপিসোডিক’ বিন্যাসে বাঁধেন। বুভুক্ষু মানব-সাধারণের সে দুঃসহ-দুষ্কালে, নির্দেশকদ্বয় প্রচলিত ছদ্ম মঞ্চ-মায়া ভেঙেচুরে নব এক দৃশ্যকাব্য রূপায়ণ করেন – যাতে বাস্তবতা অভিনব মঞ্চভাষ্যে দর্শক-মনে ভিন্নতর অভিভাব জাগায়। এই প্রথম থিয়েটার স্বদেশের সঙ্গে, মূলধারা সমাজ-সংলগ্ন বিনিময়-ভাবনায় সাবালক হয়ে ওঠে।

স্বদেশি নন্দন-সংস্কৃতি ভাণ্ডারের বিচিত্র রূপরীতি-প্রকরণের সুলুকসন্ধান সামাজিক দায় হিসেবে গ্রহণের ঘোষণা দেন তাঁরা। একালের সমূহ বাস্তবতাকে যাতে লাগসই ইডিয়মে ধরা যায় – যাতে দেশের মানব সাধারণ তাতে যুক্ত হতে পারে। এই অন্বিষ্ট-কল্পনা অবশ্য বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি সংঘ – তবু নব নাট্যভাবনার বীজতলার মর্যাদা সে পেতে পারে। রাজনীতির সঙ্গে শিল্প-নন্দনের জটিল সম্পর্ক বুঝে নেওয়ার পরিণতি নাগরিক নাট্যজনের অনায়ত্ত তখন। আজো কি তা সম্পন্ন হয়েছে?

তবু কোথাও একটা নন্দন-এষণা কি চেতাবনি জাগিয়ে দিয়েছে গণনাট্য সংঘ – আজো যা অনিঃশেষ বলা যায়।

সেই থেকে নবনাট্য বা গ্রুপ থিয়েটারের এক অভিযাত্রাই চলছে ভারতে, পশ্চিমবঙ্গে বলা যায়। তাতে থিয়েটারে শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে বহু মত-মতান্তর। যার ফলে গড়ে উঠেছে নানা দল  – আজো তার শেষ নেই।

শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য্য, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাদল সরকার এই বহু মত-পথের নানা দিশার একেক প্রতিভাধর রূপকার।

মঞ্চে রবীন্দ্র-বাচন নাগরিক বাকস্পন্দে ধারণ করতে সমর্থ হন শম্ভু মিত্র। সেই সূত্রে তিনি এক জাতীয় নাট্য-পদ্ধতির কথা বলেন। তা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্কও হতে থাকে। স্বদেশীয় নানা রীতির কোনটি হবে জাতীয় তাই নিয়ে। নাট্য প্রকাশের ভারতীয় এক পদ্ধতি নিরূপণ-উদ্ঘাটনের কথা বলেন যদিও তিনি।

উৎপল দত্ত রাজনৈতিক থিয়েটারের কথা বলেন। তাতে দেশ-বিদেশের নানা রীতির প্রয়োগে অধিক দর্শককে যেন তা অধিক আলোড়িত করতে পারে। গণনাট্য সংঘের সরল নিরাভরণ নাট্য-উপাদানে তা সম্ভব নয় মনে করেন। আলো-মঞ্চ-ধ্বনি-দলগত অভিনয়ে, নানা প্রযুক্তির প্রয়োগে তা সম্পন্ন হবে।

অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদেশি নাটকের দেশজ রূপান্তরে এক দর্শক-গ্রাহ্য নাট্যমুদ্রা মঞ্চে পরিবেশন করেন। তাতে বিদেশি তত্ত্বের কোনো গুরুভার সংস্কার মানতে চান না। এই নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ব্রেশট-তরলীকরণের অভিযোগ ওঠে; দর্শককে ভাবাবেগে ভাসিয়ে তাকে যুক্তিবুদ্ধিরহিত করা হয় – ব্রেশট যা চাননি;                         নাচ-গান-বাজনার এক জমজমাট থিয়েটার মাত্র হয়ে ওঠে তা বলে। বাদল সরকার প্রসেনিয়াম থিয়েটারের বাইরে যে-কোনো স্থলে এক আভরণহীন, সহজে বহনযোগ্য, শরীরী ভাষানির্ভর থার্ড থিয়েটারের কথা বলেন, যা দর্শকের সঙ্গে কেনাবেচার সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেবে। মঞ্চ ছেড়ে সর্বত্র তার মঞ্চায়ন সম্ভব হতে পারবে। এ-মতের এক ধারা সূচিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক দলাদলির সমান্তরালে থিয়েটারেও মত-পথ নিয়ে বিভেদ-বিতণ্ডা একদা জল-অচল ছুঁৎমার্গীয় হয়ে উঠেছিল। পরিবর্তিত প্রতিবেশে তার হাড্ডাহাড্ডি প্রকোপ কমেছে। নানা ভিন্ন ঘরানার মধ্যে লেনদেন, গ্রহণ-বর্জনের মতি ফিরেছে। নতুন প্রজন্ম একরোখা আনুগত্যের বদলে স্বেচ্ছা নির্বাচনে-মিশ্রণে সৃজনশীল হয়ে উঠেছে। পূর্বেকার উত্তেজনা রহিত হয়েছে – ঠেকে শিখে সাবালক হয়ে উঠেছে ক্রমে এ-কথা বুঝি বলা যায়।

নীতি-আদর্শের কট্টর মতান্ধতা তাই আর প্রবল নয়। তাতে পারস্পরিক নীতি-বিচ্যুতির অভিযোগ অবশ্য নানা সূত্রে ওঠে। তার ধার-ভার যদিও তেমন নয়। বাজার ও মিডিয়ার বাস্তবতা কোনো মৌলবাদিতার প্রশ্রয় দেয় না – তার কেনাবেচার অর্থনীতির একাধিপত্যে। বিনির্মিত করে ছেড়েছে সে তাবৎ ন্যায়-নীতি-আদর্শের তত্ত্ব-বিশ্ব। কোনোকিছুর ‘কোনো যে মানে নেই/ সেটাই মানে।’ তাই কি ‘কঠিনে সহজ খুঁজি/ কঠিন সহজ?’

তবু পশ্চিমবঙ্গে থিয়েটার বিষয়-রূপ-রীতির বিচিত্র সৃজনশীলতায় আজো ক্রিয়াশীল – বিরূপ বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে, তাকে

মঞ্চ-রূপায়ণের কঠিন ব্রতে। কেবল কলকাতায় আর সীমাবদ্ধ নয় তা। প্রদেশজুড়ে তার চর্চা-প্রয়োগ চলছে, নাট্যজন ও দর্শকের পারস্পরিক বিনিময়ে, মেলবন্ধনে। সরকারি অনুদান তাতে সহায়ক হয়েছে বলা যায় –

গত শতকের শেষদিক থেকে কলকাতায় ‘নান্দীকার’-আয়োজিত ‘জাতীয় নাট্যমেলা’ হচ্ছে। তাতে ভারতের নানা অঞ্চলের বিবিধ বিচিত্র রূপ-রীতির নাটক দেখার সুযোগ পায় নাট্যজন। স্বদেশের নানা আঙ্গিকের মঞ্চে প্রয়োগ দেখা হয়। নানা দেশীয় নাট্যরীতির সঙ্গে দেশীয় রীতির মিথস্ক্রিয়া, মেলবন্ধনে অভিনব সব প্রযোজনা হকচকিয়ে দেয় দর্শককে। প্রচলিত নাট্য অভ্যাসে তাতে বিরাট অভিভাব সঞ্চার করে। এক ধরনের মুক্তধারার বাঁধভাঙা জোয়ার যেন-বা জাগে।

এমনিতে দিল্লির নাট্য বিদ্যালয়ের নানা নিরীক্ষায় সন্দিহান ছিল কলকাতা, নাটকের কর্মশালা বিষয়টিকেই বাঁকাভাবে দেখা হতো। তবে জাতীয় নাট্যমেলার আঙ্গিক-রীতি-প্রকরণের বিচিত্র নিরীক্ষা আর উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। নানা অঞ্চলের নানা রীতির প্রয়োগে যে বিবিধ আধুনিক থিয়েটার হতে পারে এতটা প্রকাশক্ষম – তা মেনে না নিয়ে পারেনি কেউ। তিনজন বাঈয়ের পা-বানির একক পরিবেশনা-অনুপ্রাণিত নাথবতী অনাথবৎ তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পায়; নানা নাটকের মঞ্চভাষায় নানা আঙ্গিকের বিচিত্র প্রয়োগ হতে থাকে, যেমন মাধব মালঞ্চি কইন্যা – এতদিন যা এনএসডি-ঘরানার বলেই বিবেচিত হতো। কলকাতার গয়ংগচ্ছ, পুনরাবৃত্ত প্রযোজনায় সৃজন-জোয়ার জাগে বুঝিবা। তারই বিচিত্র রূপায়ণ চলছে। বিষয়ের কতক ঘেরাটোপ থেকেও মুক্তি ঘটেছে।

বাংলাদেশের বর্তমানকার নাগরিক থিয়েটার ‘মুক্তিযুদ্ধের ফসল’ হিসেবে বিবেচিত। যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধার একাংশ মঞ্চে নবনাট্যের সূচনা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭২ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় নাট্য-প্রতিযোগিতায় দুটো শর্ত গৃহীত হয় : ছাত্রদের লিখিত নতুন নাটক হতে হবে আর নির্দেশনা-অভিনয় হলের শিক্ষার্থীদের নিয়েই করতে হবে। তাতে অভিনব ঘটনা ঘটে। বেশিরভাগ নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়া ‘ব্যতিক্রমী’ ‘নিরীক্ষামূলক’ ‘অভিনব’ সব নাট্যরূপায়ণ করেন। তাতে সেই সময়কার ছাত্র-যুবার অনির্দেশ্য সংকটযন্ত্রণা বিচিত্র পথে প্রকাশ-মুক্তি খুঁজে নেয়। দর্শক তাতে আলোড়িত, রোমাঞ্চিত হয়। পত্র-পত্রিকা নিয়মিত নাট্যচর্চার আবেগসঞ্চার করে। স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে অনিয়মিত শৌখিন নাট্যচর্চা হতো পাড়ার ক্লাবের উদ্যোগে। ষাটের দশকে ‘ড্রামা সার্কেল’ বলে একটি গ্রুপ কেবল গোটাকয়েক ভিন্ন ভাবনা-রীতির প্রযোজনা করেছিল – সেটা কোনো নিয়মিত ধারাপাত করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদও কয়েকটি ভালো মানের প্রযোজনা করে। ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ গঠিত হলেও মঞ্চে নয়, টেলিভিশনে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এদের অনেকের মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার থিয়েটার দেখার অভিজ্ঞতা ছিল। তারাই প্রথম মুক্ত স্বদেশে ‘দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক দেখুন’ – বলে নাট্যপ্রযোজনা শুরু করে।  – তারপর একে একে গ্রুপ গঠিত হতে থাকে। নিয়মিত নাটকের সূচনা এভাবেই ঘটে বাংলাদেশে।

পঞ্চাশের দশকে কলকাতার বহুরূপীর দুটি প্রযোজনা রক্তকরবী ও ছেঁড়া তার ঢাকার সাধারণ দর্শকের দেখা প্রথম অন্যধরনের থিয়েটার। তাতে তখনকার নাট্যোৎসাহীরা আলোড়িত হন, নিজেরা তেমন নাটক করার নানা উদ্যোগ নিলেও, পরাধীন দেশের বাস্তবতায় তা করে উঠতে পারেননি।

১৯৭৪ সালে কলকাতার ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’-এর দুটি নাটক রাজরক্ত ও চাকভাঙা মধু বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে অভিনীত হয়। নতুন ধরনের নাটকের একটা ধারণা তাতে মেলে।

পাকিস্তান আমলে জনাদুই/ তিন বিদেশে নাট্যশিক্ষা করেন। তাঁরা দেশে ফিরে তার কিছু প্রয়োগও করেন – ‘ড্রামা সার্কেল’ ও ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে’।

এই হলো মোটের ওপর পূর্ব-অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের থিয়েটারের। এই পূর্ব-অভিজ্ঞতার স্বল্প-পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু। নাটকের বিষয় অনির্দেশ্যভাবে খুঁজে নিচ্ছিল রীতি-প্রকরণের আধার। নবীন-অনতিনবীন নাট্যকারদের মৌলিক নাটক আর বিদেশি অনুবাদ-রূপান্তর – এই দুই ধারায় চলছিল নাটক। তার মধ্যে ঢাকা থিয়েটার ও সেলিম আল দীনের বিপরীতে এক তৃতীয় ধারার কথা বলেন – যদিও তার কোনো হদিস সহজে মেলেনি – নানা বিদেশীয় নাটকের ছায়ায় তার সন্ধান চলছিল। – সংবাদ কার্টুন-শকুন্তলা-মুনতাসীর ফ্যান্টাসিতে তা ধরা যায়। রাজনৈতিক রঙ্গব্যঙ্গ আর পুরাণের নবভাষ্য প্রদান – তাতে কোনো চারিত্র্য ঠিক পাওয়া যায় না। এছাড়া ভালো করে ভালো নাটক বা দেশ-বিদেশের ভালো নাটকের সন্ধান চাই, জাতীয়তাবাদী হুজুগ নয় অথবা নাটক হবে শ্রেণি-সংগ্রামের সুতীক্ষè হাতিয়ার বলার আরেক মেজাজ – সবই মূলত বিষয়-ভাবনা, তবে রীতি-আঙ্গিক হিসেবে ‘ব্যতিক্রমী’, ‘নিরীক্ষাধর্মী’, ‘আধুনিক’ – এসব চলতি বুলি ছিল। অবশ্য কেবল বিষয় নয়, শিল্প-নন্দনের ভাবনার কথা ঢাকা থিয়েটার ও নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় প্রথম থেকে তুলেছিল। এর মধ্যে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় প্রতিবছর যেতে শুরু করে নাট্যোৎসুক শিক্ষার্থী – তারপর তারা ফিরতেও থাকে। এর মধ্যে ঢাকা থিয়েটার অনুকারী ঔপনিবেশিক নাটকের বদলে বাংলা নাটকের নিজস্ব আঙ্গিক নির্মাণের ঘোষণা করে চলে। – বাংলা নাটকের ইতিহাস দুশো বছরের নয় – হাজার বছরের দেশজ

সে-ধারা বর্ণনাত্মক পাঁচালি, ইউরোপীয় প্রসেনিয়াম থিয়েটারের সংলাপ-চরিত্রনির্ভর নয়।

এসব ভাবনার নাট্যভাষ্য হলো : ঢাকা থিয়েটারের কিত্তনখোলা। ততদিনে সৈয়দ জামিল আহমেদ এনএসডি শেষ করে ফিরেছেন। তিনি এ-নাটকের মঞ্চ-কল্পনা প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে খোলা এক মেলার আঙ্গিকে দেন – নাটকের দৃশ্য-প্রতিবেশ অনুসরণে। অবশ্য মঞ্চের নানা ব্যবহার তার আগেই শুরু হয়েছে – ফণীমনসা বা কোপের্নিকের ক্যাপ্টেনেও।

তবে কিত্তনখোলা নাট্যের গঠনশৈলী ভিন্ন : গায়েনের গান সেখানে বর্ণনাত্মক মেজাজ আনে, চরিত্রাবলির সংলাপও বর্ণনাত্মক হয়ে ওঠে। মেলায় আগত বিচিত্র মানুষ আর যাত্রাদলের অভিনেত্রীদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং স্থানীয় ক্ষমতা-কাঠামোর সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া – বৃহৎ এক সামাজিক প্রতিবেশ তৈরি করে। তার মধ্যে আস্ত এক মেলার গতায়াতে মঞ্চরূপায়ণ বিচিত্র গতিসম্পন্ন হয় – অভিনেত্রীদের যূথসঞ্চালনে – নানা ইডিয়মে, কম্পোজিশনে।

এনএসডির শিক্ষার্থীরাই বাংলাদেশের থিয়েটারের খোলনলচে অনেকটা বদলে দেয়। মঞ্চসজ্জা ও তার ব্যবহার, আলোকবিন্যাস, পোশাকের বাস্তবতা ছেড়ে রঙের মনস্তত্ত্বনির্ভর নানা থিয়েটারি কস্টিউম, গান-নাচের ব্যবহার – বিশেষ করে শারীরিক অভিনয়ের প্রয়োগ – প্রযোজনার পূর্ববর্তী ধীর-মধ্যলয়ের পুনরাবৃত্তি ভেঙে দেয় – বাড়তি গতি সঞ্চার করে। তবে তাতে চরিত্রাভিনয়, বিশেষত বাচিক অভিনয় নাট্যের ক্ষিপ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিতে অপারগ হয়। সবটা তো এক অর্থে বাইরে থেকে ঘটিয়ে তোলা; বিষয় ও দর্শকের সঙ্গে সম্বন্ধপাতে হয়ে ওঠেনি; বরং  এনএসডিতে চর্চিত, একধরনের অবাঙালি নাট্যবাচনের বিবিধ প্রয়োগ বলা যায় একে। কেউ কেউ তো দিল্লির কোনো প্রযোজনার হুবহু অনুসরণ করেন। তাতে নতুন চমকে দর্শক বিস্মিত, হকচকিত হয়। তার গয়ংগচ্ছ অভ্যাস তাতে কাটে যদিও – তবু কোথাও মঞ্চ উৎকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে – দর্শকের সঙ্গে স্বাভাবিক বোঝাপড়া ও বিনিময় তাতে বিঘিœত হয়। প্রায় পাল্লা দিয়ে একের পর এক প্রযোজনা, অভিনব রূপায়ণের প্রদর্শন হয়ে ওঠে! সেই ঘোর তার এখনো কাটেনি বুঝি, সচেতন চর্চায় অঙ্গাঙ্গি হয়ে গেছে বরং।

১৯৭২-৭৩ সালে অনুষ্ঠিত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যরচনা করে সেলিম আল দীনের মঞ্চনাটকের সূচনা। তারপর ঢাকা থিয়েটার পত্তন করে তিনি আর নাসির উদ্দীন বাচ্চু যুগ্ম এক নাট্যরচনা-রূপায়ণের যাত্রা শুরু করেন। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র সেলিম আল দীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। এখানেই তিনি নাট্যতত্ত্ব ও নাটক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ পঠনকালে তিনি লক্ষ করেন, বাংলা কাব্য হিসেবে পঠিত তাবৎ বিবিধ পদাবলি ও আখ্যানকাব্যগুলো মূলত গেয়, অভিনেয়, পরিবেশিত হতো। এই সূত্র ধরে তিনি মধ্যযুগের বাংলা নাটক বলে এক অভিনব গবেষণাগ্রন্থ পিএইচডি সন্দর্ভ হিসেবে প্রণয়ন করেন। এখানে তিনি চর্যাপদ থেকে শুরু করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, শ্রীচৈতন্যদেবের কীর্তন ও নানা আখ্যান পালা-যাত্রা পরিবেশনা, মঙ্গলকাব্যসমূহ, মৈমনসিং গীতিকা, ধর্মীয়-ধর্মনিরপেক্ষ রোমান্টিক আখ্যানসমূহ, পুঁথি-পয়ার-পাঁচালি-নাটকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে ঘোষণা করেন – এসবই বাংলা নাটকের ধারাবাহিক ইতিহাস – মূলত বর্ণনাত্মক পাঁচালি রীতিতে পরিবেশিত বাংলা নাটকের আবহমান মূলধারা – যা সংলাপ-চরিত্রনির্ভর পাশ্চাত্য নাটক থেকে মূলত ভিন্ন চারিত্র্যে নিজস্ব; দেশজ নানা সেসব নাট্যরীতি দেশজুড়ে এখনো চর্চিত, অভিনীত বাংলা নাটক। তিনি কেবল বাংলা নাটকের এই ইতিহাস উদ্ঘাটন-আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হন না; কিত্তনখোলা থেকে কেরামত মঙ্গল, হাতহদাই, বনপাংশুল, চাকা, যৈবতী কন্যার মন, প্রাচ্য নাটকের নানা সময়ে নানা নাম দেন – এপিক থিয়েটার, কথানাট্য, পাঁচালি রীতির বিবিধ বিচিত্র বাংলা নাটকের অনুসরণে একালের আধুনিক নাটক – যা স্বদেশীয়-বিদেশীয় নানা উৎসখাত থেকে সৃজনশীল মিশ্র মেলবন্ধন করে চলেন। তাতে তিনি আখ্যান-বিন্যাসে এপিক আঙ্গিক-প্রকরণ রচনা করেন – যা চরিত্রে, বিচারে মহাকাব্যিক – বর্ণনাত্মক রীতিতে চরিত্র-সংলাপের এক অভিনব যুগলবন্দি হয়ে ওঠে।

নাসির উদ্দীন বাচ্চু অভিনব এই রচনাবলির নানা নাটভাষ্য উদ্ঘাটন, রূপায়ণ করেন। তাঁদের এই যৌথ যুগ্ম সৃজনকর্ম বাংলাদেশের থিয়েটারের এক অর্জন হিসেবে বিবেচিত। তবে এসব নাটকের বর্ণনা ও সংলাপের ভাষা আধুনিক কবিতা ও গদ্যের জটিলতার সমকক্ষ – মঞ্চে যার শ্রুতিবাচন, দৃশ্যগত বিবিধ প্রকরণের দ্বৈততায় গুরুভার হয়ে ওঠে – বাংলা পরিবেশনার শ্রুতিনির্ভর কাব্যসকল শ্রোতা-সাধারণের দীর্ঘ ঐতিহ্যনির্ভর সুপরিচিত; আর সেলিম আল দীনের নবপুরাণসুলভ আখ্যান দর্শক-সাধারণের কোনো সাধারণ ভূমির অবচেতন-অচেতন তলে ভিত্তি ঠিক পায় না; এমনিতে নাগরিক দর্শক স্বদেশীয় আখ্যান-কাব্যের ভাব-ভাষার রীতির সঙ্গে বিদেশিতুল্য অপরিচিত – তাঁরা সেলিম আল দীনের এই সৃজন উল্লম্ফে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তবে দৃশ্যকাব্যের, নাট্যবাচনের অভিনবত্ব ও রূপায়ণের মাহাত্ম্যে তাঁরা অনাস্বাদিত এক নান্দনিক অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

তবু দর্শক-সাধারণ ও নাট্যজন বিস্মিত অভিনন্দনে এর সৃজন-সামর্থ্যে অভিভূত হন। পরবর্তী প্রজন্মের নাট্যজন, বিশেষত নাট্যকারের ওপর সেলিম আল দীনের রচনা সবিশেষ এক উত্তরাধিকারের মর্যাদা পায় – যা প্রায়শ অসম অনুসারী দলের ছেলেমানুষি হয়ে পড়ে – গলায় উত্তরীয় ঝুলিয়ে ‘হে শ্রোতৃম-লী’ বলে বর্ণনা-ব্যাখ্যান, আর থেকে থেকে সংলাপ-চরিত্রের পুনরাবৃত্ত এক গঠনশৈলীতে রচিত হয়ে চলে একের পর এক রচনা। আচার্যের এসব অনুকারী একলব্যদল, কে কত খাঁটি অনুসারী তাই নিয়ে বিতণ্ডায় মাতে। – তবে দুই বাংলার প্রায় সব নাট্যদলের ওপর সেলিম আল দীনের এই বাচন-ইডিয়ম নানা ধরনের অভিভাব তৈরি করেছে, পরিচিত প্রথাগত নাট্য রচনাধারায় এক ভিন্ন ধারাপাত করেছে তা, একথা বুঝি বলা যায়।

এর পাশাপাশি নাম করতে হয় সৈয়দ শামসুল হকের। কবি, গল্পকার-ঔপন্যাসিক-প্রবন্ধকার হিসেবে গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যের প্রধান এক রূপকার। ’৭৬ সালে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নামে মুক্তিযুদ্ধের পটে রচিত তাঁর কাব্যনাট্য বাংলাদেশের নাটকের এক মর্যাদা সম্পন্ন করে। ‘সব্যসাচী’ অভিধাটি তাতে অনিবার্য হয়ে ওঠে তাঁর। একটি কোনো অঞ্চলের ভাষা না হয়েও এর প্রাকৃত শব্দাবলি, আধুনিক কাব্যের প্রকরণে অভিনব এই নাটক রচিত। কাব্য-নাটকের প্রথাগত কাব্যিকতা তাতে নেই, গদ্যবাচন যেন-বা কাব্যছন্দে ধ্রুপদি নাটকের চরিত্র পেয়েছে। এর পর নূরল দীনের সারাজীবন নাটক সামরিক শাসনের দুষ্কালে ইতিহাসের বিস্মৃত এক গণনায়ককে ব্রিটিশ সংগ্রহশালা থেকে উদ্ধার ও একালে তাকে অন্বিত করে লক্ষ্যভেদী নান্দনিক আয়ুধ হয়ে উঠেছে – ‘জাগো বাহে কুনঠে সবায়’ রংপুর অঞ্চলের এই আহ্বান যেন জয় বাংলার পুনরুদ্ধারের এক জিয়নকাঠি হয়ে ওঠে – যা বাঙালির এক চিরকালের সেøাগান হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশবিরোধী পরাজিত কৃষক নায়ক, একালের আরেক বিপুল জাগরণ-জয়ের বীর নায়কের ট্র্যাজিক পরিণতিতে হয়ে উঠেছেন তাঁর পূর্বসূরি – যেন বাঙালির সম্ভাবনা-সীমাবদ্ধতায় পুরাণ-প্রতিম। এতখানি চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য আর কোনো বাংলা নাটক সম্ভবত অর্জন করেনি। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে সাধু বাংলায় বিদেশীয় বাচন অভিনব বিন্যাসে এই কাব্যনাটকে অন্বিত।

‘ঈর্ষা’ও এক আশ্চর্য নাটক – তেরোটি সংলাপে, তিনটি চরিত্রের চিরকালের দুই প্রজন্মের ঈর্ষাজাত প্রেম, একালের কাব্যভাষায় ঈর্ষণীয় বিষয়-রীতিতে অভিনব প্রকরণ হয়ে উঠেছে। এছাড়া শেক্সপিয়র অনুবাদকর্মে – ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট ও হ্যামলেট – তাঁর সিদ্ধি যথামর্যাদাসস্পন্ন। ডফম্যানের নাটকের রূপান্তরণও একালের রাজনৈতিক সংকটের ভাষ্য এক – মুখোশ। গণনায়ক শেক্সপিয়র-প্রণোদিত জুলিয়াস সিজারের দুষ্কাল ভাষ্য।

সব মিলিয়ে সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের থিয়েটারে বিবিধ মাত্রা সঞ্চার করেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও তাঁর নাটকের মঞ্চায়ন-সূত্রে বিশিষ্ট এক অভিভাব ঘটেছে। আবদুল্লাহ আল মামুন আর মামুনুর রশীদ দেশজুড়ে মঞ্চায়িত নাট্যকার হিসেবে সময়ের প্রয়োজনে তাঁদের সীমাবদ্ধতাসহ ঐতিহাসিক দায় পালন করেন বাংলাদেশের থিয়েটারে। আঞ্চলিক ও নাগরিক ভাষার নানা প্রয়োগ তাঁরা করেছেন। সুবচন নির্বাচনে আবদুল্লাহ আল মামুন-রচিত প্রথম দর্শকগ্রাহ্য নাটক। তাঁর এখন দুঃসময়, এখনো ক্রীতদাস এবং মেরাজ ফকিরের মা সময়কে ধারণ করে। মামুনুর রশীদের ইবলিশ, ওরা কদম আলী, জয়জয়ন্তী এবং রাঢ়াঙ – বিশিষ্ট রচনা, যা বাংলাদেশের নাটকের আরেক চারিত্র্য নির্ধারণ করেছে – শ্রেণিসংগ্রাম নানা আঞ্চলিক ভাষায় বাঙ্ময় হয়েছে।

সবশেষে বলতে হয় সৈয়দ জামিল আহমেদের নাম। দিল্লির এনএসডির এই স্নাতক বাংলাদেশের নাটকে মঞ্চকল্প-রচনা, দৃশ্যকাব্য-প্রকরণ রূপায়ণ-নির্দেশনা ও শিক্ষকতায় বিপুল প্রভাব সঞ্চার করেছেন। প্রাথমিকপর্বে মঞ্চসৃজন ও আলোকপাতে তিনি নাট্যের দৃশ্যকল্পের নানা নিরীক্ষা করেছেন – কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গলে – চাকা তো তাঁরই নির্দেশিত। তবে বিষাদসিন্ধু নাট্যে তাঁর সৃজনকল্পনা সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করেছে। এ-নাটকের মঞ্চগঠন, দৃশ্যগত কম্পোজিশন, কোরিওগ্রাফি, পোশাক-আশাক, আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদির ব্যবহার – সব মিলিয়ে দুই পর্বে বিভক্ত এই মহাকাব্যিক আখ্যান যে-দৃশ্যকাব্য সৃজন করে মঞ্চে – পিটার ব্রুকের মহাভারত অনুপ্রাণিত বলে অনেকে মনে করেন – নবীন-প্রবীণ তাবৎ নির্দেশক-রূপকার-অভিনয়শিল্পীর ওপর তা স্থায়ী অভিভাব সঞ্চার করে – তার অনুকারী অসম অপব্যবহার তো অনিবার্যভাবে হবেই। তবে পরবর্তীকালে প্রায় সব প্রযোজনা-চারিত্র্যে তা গভীর ছাপ ফেলেছে, এ-কথা বলতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁর বেহুলার ভাসান – আরেক মর্যাদাসম্পন্ন প্রযোজনা। সবশেষে নানা দলের নবীন অভিনয়শিল্পী সহযোগে রিজওয়ান বিপুল সাড়া জাগায় – যার মধ্যে ক্যারিশমার অতিরেক লক্ষ করেন অনেকে। এটা অবশ্য তাঁর স্বভাবের এক বিশিষ্ট মুদ্রাদোষ বটে। সেখানেই তাঁর শক্তি আর দুর্বলতা।

নাট্যকর্মশালা ও শিক্ষকতা এবং বর্তমানকার নাট্যবিষয়ক বাচন-ভাষ্য বৈঠকেও তাঁর ধীমান আতীব্র প্রখরতা নবীন নাট্যজনকে উদ্বেলিত করে। নানা দেশে তাঁর নাট্য নির্দেশন, শিক্ষকতা ও আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত গবেষণা-লেখন তাঁকে মর্যাদার আসনে বৃত করেছে।

সেলিম আল দীন মধ্যযুগের বাংলা নাটকের একার্থে উদ্ধার-আবিষ্কার করলেও তা ছিল তাত্ত্বিক, পুঁথিগত। আর জামিল আহমেদ দেশজুড়ে বর্তমানে জীবন্ত ক্রিয়াশীল তাবৎ বিচিত্র বাংলানাট্য রূপ-রীতি-প্রকরণের শ্রেণিকরণ চিহ্নিত করেছেন মাঠ-পর্যায়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ, দর্শন-মনন-গবেষণায় – তাঁর অচিন পাখি বাংলা নাটকের জীবন্ত রূপ-রীতি-ভাব-ভাষের আকরগ্রন্থ। পরবর্তীকালে ইসলামের সঙ্গে নাটকের সম্পর্ক বিষয়ে, মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলা অঞ্চলে চর্চিত নানা নাটকের সুলুকসন্ধান করেছেন। নাটক বিষয়ে জনমনের ভুল ব্যাখ্যা অপনোদনের দায়বদ্ধ জিজ্ঞাসায়।

সব মিলিয়ে বলতে হয়, সেলিম আল দীন আর জামিল আহমেদ – রচনা-প্রকরণ ও নির্দেশনা রূপায়ণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের থিয়েটারে পরবর্তী নাট্যজনের চেতন-অবচেতনে গভীর, স্থায়ী চেতাবনি সঞ্চার করেছে। তার মধ্যকার তাবৎ অক্ষম অনুকারী অপব্যবহারের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেও তার জীবন্ত উদ্বেজন অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের নাট্যের চারিত্র্য নির্মাণে এই দুই মহাজনের অর্জন ইতিহাসের অংশ বটে। যদিও রচনা-নির্দেশনা-অভিনয়ে অন্য নানা প্রতিভার বিচিত্র অভিভাব নিশ্চয় বাংলাদেশের নাট্য মানচিত্র নির্মাণ করেছে। আলী যাকের, আতাউর রহমান, ফেরদৌসী মজুমদার, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াৎ, হুমায়ুন ফরিদী, রাইসুল ইসলাম আসাদ, শিমূল ইউসুফ এবং প্রয়াত খালেদ খান ও এসএম সোলায়মান বাংলাদেশের থিয়েটারে নির্দেশনা-অভিনয়ে কিংবদন্তিতুল্য।

নাট্য একটি যৌথ শিল্পনন্দন কলামাধ্যম বটে। বাংলা নাট্যজনের এ এক সমবেত অর্জন নিশ্চয়। যেমন ‘নাট্যজন’ অভিধাটি সৈয়দ শামসুল হকের উদ্ভাবন – নাট্যপাগল, নাট্যোৎসাহী বা নাট্যকর্মীর ব্যক্তিসত্তারহিত দশা থেকে এক সমর্থ উত্তরণের সাক্ষ্য।