বানিয়াশান্তার মেয়ে

কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ঝাঁঝালো হুইস্কি খেয়ে পাঁড় মাতাল হয়ে তরুণ কবি বলল, বুঝলেন ভাই, ইচ্ছে করে কোনো বেশ্যাকে বিয়ে করে জীবনটা কাটিয়ে দিই। আমি জানতে চাইলাম, কোনো কুমারীকে নয় কেন? কবি বলল, বেশ্যারা পতিভক্ত হয়, স্বামীকে প্রাণপণ ভালোবাসে। সঙ্গে সঙ্গে আমার কল্পচোখে ভেসে উঠল এক বেশ্যার মুখ। কবির কথার দিকে আর আমার খেয়াল থাকে না, আমি ভাবতে থাকি কবির কথা থেকে বেরিয়ে আসা কল্পিত তরুণী বেশ্যার কথা। তার চেহারা কল্পনা করি। কেমন হওয়া উচিত তার চেহারা? জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাস বা চলচ্চিত্রের নায়িকাদের মতো? হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। পৃথিবীর সব নায়িকাকে সুন্দরী হতে হবে এমন তো কোনো শর্ত নেই। আমার কল্পিত তরুণী বেশ্যাকে সুন্দরী ও অসুন্দরীর মাঝামাঝি রাখা যেতে পারে। যেমন তার মুখটি
লম্বাটে, গালে কোনো তিল-টিল নেই, নাকটা খাড়া, মাথার চুল কোমর অবধি লম্বা আর গায়ের রং শ্যামলা। ঠিক শ্যামলা বলা যাবে না, শ্যামলা ও ফর্সার মাঝামাঝি। নাকে নথ, কানে দুল। যখন হাসে  তখন শীতঋতুর পাতা ঝরার দৃশ্য মনে পড়ে যায়। বড় মলিন, বড় করুণ হাসি। সকালবেলায় সালোয়ার-কামিজ পরে, বিকেলবেলায় শাড়ি। শাড়ি পরলে কোমর আর পিঠটা ইচ্ছে করেই উদোম করে রাখে, খদ্দের আকর্ষণের হাতিয়ার হিসেবে।

চেহারা কল্পনা করা গেল, এবার তো একটা নাম রাখতে হয়। কী নাম রাখা যায়? আমি বহুবার বহু পতিতালয়ে গিয়েছি, বহু পতিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, আমার নোটবুকে বহু পতিতার নাম টুকে রেখেছি। যেমন বাসমত্মী, বর্ষা, চামেলী, জুঁই, আঁখি, চুমকি, নদী, খেয়া, গোলাপি, হাসি, শ্রাবমত্মী। আমার কল্পিত তরুণী বেশ্যার নাম এর যে-কোনো একটি রাখা যেতে পারে। আঁখি রাখা যাক। আঁখি যৌক্তিক। কারণ তার চোখ দুটি বড়ই মনোহারী। চোখ দুটির দিকে তাকালে একটা জ্বলন্ত পিদিম মনে হয় তাকে। সেই পিদিমের অগ্নিপি– পোকামাকড়ের মতো যে-কোনো পুরুষের ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে।

নাম তো হলো, এবার নিবাস। কোথায় তার নিবাস? কান্দাপাড়া? রথখোলা? দৌলতদিয়া? নাকি বানিয়াশামন্তা? বানিয়াশামন্তা নামটা সুন্দর। প্রাচীনগন্ধি। প্রাচীনই বটে। যাত্রা সেই ১৯৫৪ সালে। একটা সময় দেশের সবচেয়ে বড় পতিতাপল্লি ছিল। আঁখির নিবাস বানিয়াশামন্তা হলে মন্দ হয় না।

আঁখি কোথা থেকে বানিয়াশান্তা গিয়েছিল? হতে পারে কুমিলস্না থেকে, হতে পারে চাঁদপুর থেকে, হতে পারে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল বা খুলনা থেকে। নাকি বানিয়াশান্তায় তার বাবা-মায়েরও নিবাস? সেখানেই তার জন্ম? না। তবে কীভাবে সে বানিয়াশান্তা নামক এই কৃষ্ণগহবরে ঢুকেছিল? হতে পারে গ্রামের বাড়ি থেকে গার্মেন্টে চাকরির আশায় ঢাকায় গিয়েছিল। গাবতলী, মহাখালী, গুলিস্তান বা সায়েদাবাদে বাস থেকে নামার পর নারী ও শিশু পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছিল। পাচারকারীরা তাকে বেশ্যার দালালদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। এমনও হতে পারে, প্রেমের নামে প্রতারণার শিকার হয়ে কিংবা অপহৃত হয়ে কিংবা দারিদ্রে্যর কশাঘাতে কিংবা স্বেচ্ছায় সে বানিয়াশামন্তা পতিতাপল্লিতে ঠাঁই নিয়েছিল।

আচ্ছা, আমি যে বারবার পতিতাপল্লি পতিতাপল্লি বলছি, তা কতটা সংগত হচ্ছে? এনজিওকর্মীরা পতিতাপল্লিকে বলে যৌনপল্লি, বেশ্যাকে বলে যৌনকর্মী। আমার কি উচিত নয় তাদের মতো করে বলা? আমি তো সাধারণ মানুষ নই, বিশেষ। গল্পকার। সাধারণরা যা বলে আমার পক্ষে তা বলা কি শোভন? হয়তো অশোভন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো পতিতাপল্লিকে পতিতাপল্লিই বলে। তারা যৌনপল্লি বোঝে না, শব্দটা তাদের অচেনা, শুনলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র আঁখিও সাধারণ পরিবারের মেয়ে। সেও পতিতাপল্লিকে পতিতাপল্লিই বলে। তাকে নিয়ে লেখা এই গল্পে আমি যৌনপল্লি বলি কী করে? তাছাড়া আঁখি তো পতিতাই। ভদ্রসমাজ থেকে তার পতন হয়। ভদ্রসমাজের মানুষেরা ভালো, না পতিতালয়ের পতিতারা ভালো – সেই বিচার কে করবে? জগতের সবকিছুই আপেক্ষেক। আমার কাছে যা ভালো অন্যের কাছে তা মন্দ। আমার কাছে যা সত্য অন্যের কাছে তা মিথ্যা। সুতরাং পতিতাপল্লিকে পতিতাপল্লি বলাই সংগত মনে করছি।

বানিয়াশান্তা পতিতাপল্লি কোথায় অবস্থিত? খুলনা ছাড়া কোথায় আবার! মংলা বন্দর থেকে ট্রলারে করে পশুর নদ হয়ে করমজল যাওয়ার পথে এর পশ্চিমতীরে দেখা যাবে সারি সারি কুঁড়ে। শনের ছাউনি, বাঁশের বেড়া। ঘাপটি মেরে আছে সমুদ্রসহোদরা পশুর। যেন যে-কোনো মুহূর্তে কুঁড়েগুলোকে টেনে নিতে পারে তার গভীর উদরে। কুঁড়েগুলো দেখে কবিতাপ্রেমী যে কারো মনে পড়ে যেতে পারে সবুজ করুণ ডাঙার কবির কবিতার পঙ্ক্তি : … বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে/ কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়/ সোনালী ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিলো, হায়,/ শ্যামার নরম গান শুনেছিল, একদিন অমরায় গিয়ে/ ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়/ বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়।

পল্লির ঘাটে ট্রলার নোঙর করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তীরে উঠলে প্রথমে যে-কুঁড়েটি পড়ে, সেটি একটি দোকান। চাল-ডাল-নুন-তেল থেকে শুরু করে স্নো, পাউডার, লিপস্টিকসহ বেশ্যাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য হেন জিনিস নেই যা পাওয়া যায় না। দোকানের পাশের গলি ধরে সামনে এগোলে চার কোঠার চৌচালা যে-কুঁড়েটি পড়ে তার একটিতে থাকে আঁখি। সতেরো বছর বয়সে এসেছিল। এখন একুশ। প্রায় পাঁচ বছর ধরে আছে। পাঁচ বছরে কত খদ্দেরের মন তুষ্ট করেছে? হিসাব রাখেনি। পাঁচশো হতে পারে, এক হাজার হতে পারে, বারোশোও হতে পারে, কিংবা বেশিও হতে পারে। এমন দিনও যায়, চবিবশ ঘণ্টায় তিন-চারজন পুরুষের দেহ তুষ্ট করতে হয়। পল্লিতে যে-কজন তরুণী বেশ্যা রয়েছে তার মধ্যে সে সবচেয়ে খাসা। রেটও বেশি। প্রতি শট দুশো। খদ্দের বুঝে তিনশোও নেয়। শটপ্রতি সে পায় একশ, বাকিটা সরদারনির, যাকে সবাই ‘আপা’ বলে ডাকে। আপার অজামেত্ম বাড়তি শটের টাকা মাঝেমধ্যে সে মেরে দেয়। গোপনে জমায়। জমানো টাকা কোথায় রাখে আপা জানে না। না জানাটা একটা বিস্ময়। কেননা, কোঠার হেন জায়গা নেই যেখানে আপার চোখ পড়ে না। আপার চোখ ফাঁকি দিয়ে বানিয়াশামন্তা পতিতাপল্লির কোনো বেশ্যা টাকা জমাতে পারে না। আঁখি পারছে। এটা তার বিশেষ দক্ষতা।

নানা কিসিমের খদ্দের আসে। কেউ তরুণ, কেউ যুবক, কেউ বুড়ো। কেউ শ্যামলা, কেউ কালো, কেউ ফর্সা। কেউ কানা, কেউ ল্যাংড়া, কেউ বয়রা। কারো মুখে বিড়ি-সিগারেটের গন্ধ, কারো মুখে মদের গন্ধ। কারো গায়ে ঘামের গন্ধ, কারো গায়ে গুলপচা গন্ধ। খদ্দেররা দিনে যেমন আসে, তেমন আসে রাতেও। এখানে রাত-দিন সমান। কোথা দিয়ে সূর্যটা উদয় হয় আর কোথা দিয়ে অস্ত যায় কেউ খেয়াল করে না।

হেমন্তের এক সূর্যাস্তের কালে, পশুর নদের জলে যখন সোনারং, একটা ট্রলার ভেড়ে পল্লির ঘাটে। মোটে চারজন যাত্রী। যাত্রীদের নামিয়ে মাঝি নোঙর করে। কিছুক্ষণের মধ্যে আপার সঙ্গে দরদাম ঠিক করে তিন যাত্রী ঢুকে যায় তিন বেশ্যার ঘরে। বাকি থাকে একজন। বাইশ-তেইশের বেশি হবে না তার বয়স। পরনে জিন্সের শার্ট-প্যান্ট, মাথায় দীর্ঘদিন না-ছাঁটা চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পায়ে কালো কেডস। এই তরুণই হচ্ছে এই গল্পের প্রধান দুই চরিত্রের একজন। তার একটা নাম দেওয়া যাক। রিজভি আহমেদ সাগর হলে মন্দ হয় না। আজকাল এই ধরনের নামের খুব চল।

গল্পের প্রয়োজনে সাগরের পরিবার ও বংশপরিচয় সম্পর্কে একটুখানি বলে রাখি। তার বাড়ি মেহেরপুর। ১৯৮৯ সালের ২৬ জুলাই, তুমুল বর্ষার রাতে, এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা এখলাসউদ্দিন মজুমদার, মাতা সালেহা বেগম। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে সে চতুর্থ। মেহেরপুর সদরে তার বাবার টিন-সিমেন্টের ব্যবসা। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। থাকে হলে। পড়ালেখার খরচ বাবদ প্রতি মাসে বাবার কাছ থেকে যা পায় তার একটা অংশ জমায়। তার ভ্রমণের নেশা। ছুটিছাটায় বাড়ি না গিয়ে দেশের নানা প্রামেত্ম ঘুরে বেড়ায়। এই বয়সে দেশের চৌষট্টি জেলার উনিশটি ঘোরা শেষ। মাস্টার্স পাশের আগেই অন্তত পঞ্চাশটি জেলা ভ্রমণের ইচ্ছা। সুন্দরবন দেখার আশায় খুলনায় আসে। ঢাকার সদরঘাট থেকে এমভি মধুমতি লঞ্চের একটা কেবিনে চড়ে প্রথমে যায় মোরেলগঞ্জ। সেখান থেকে বাইকে চড়ে মংলা বন্দর। করমজল যাওয়ার জন্য ঘাটে দাঁড়িয়েছিল ট্রলারের অপেক্ষায়। সব ট্রলারই রিজার্ভে যাচ্ছে। ভাড়া পনেরোশো থেকে দুই হাজার। তার এত টাকা নেই। কীভাবে যাওয়া যায় তার উপায় খুঁজছিল।

এক তরুণ এবং মধ্যবয়সী দুই লোক তখন এক মাঝির সঙ্গে দরদাম করছিল। সাগর এগিয়ে যায়। বলেকয়ে তিনশো টাকার বিনিময়ে সেও তাদের সঙ্গে ট্রলারে চড়ে বসে। বিকেল চারটা পর্যন্ত করমজলে কাটায়। ফেরার সময় ট্রলার যে বানিয়াশামন্তা পতিতাপল্লির ঘাটে নোঙর করবে, তা সে জানত না। সঙ্গী তিন যাত্রী তাকে কিছু বলেনি। ট্রলার থেকে নামার সময় টাকমাথার লোকটি শুধু বলল, ছোট মানুষ, আপনি ট্রলারেই থাকুন। আমরা আধা ঘণ্টার মধ্যে চলে আসব।

সাগরের কিছু বোঝার বাকি রইল না। এর আগে সে দৌলতদিয়া পতিতাপল্লি দেখেছে, যদিও পল্লির কোনো বারাঙ্গনাকে আলিঙ্গনের অভিজ্ঞতা হয়নি। বানিয়াশান্তার কথা সে অনেক শুনেছে। এখানকার বারাঙ্গনাদের দুঃসহ জীবনকথা পত্রিকায় পড়েছে। বহুদিন আগে এই পল্লির এক কিশোরী বারাঙ্গনাকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন পড়েছিল পত্রিকায়। কিশোরীর নামটি মনে নেই, মনে আছে কাহিনিটা। নারী ও শিশু পাচারকারীরা এক রোহিঙ্গা কিশোরীকে টেকনাফ থেকে এনে এই পতিতাপল্লিতে বিক্রি করে দেয়। এক সপ্তাহ পর তার লাশ পাওয়া পায় পশুর নদের ভাটিতে এক দুর্গম চরে।

টাকা থাকলে সাগরও ঢুকে পড়ত। কোনো বাসমত্মী, বর্ষা, চামেলি, জুঁই বা চুমকিকে বুকে নিয়ে রসের সাগরে ডুব দিত। কেন দেবে না? সে কি পুরুষ নয়? বানিয়াশামন্তা পতিতাপল্লিতে এসে তার মতো কোনো তরুণ কি কৌমার্য অক্ষুণ্ণ রেখে ফিরে যায়? তার ধারণা, রসের সাগরে ডুব দিতে হলে হাজার-পনেরোশো টাকার কমে হবে না। তার পকেটে আছে মোটে আঠারোশো। খরচ করে ফেললে রাজশাহী ফিরবে কেমন করে? অগত্যা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের রং দেখে। ক্রমে আলো কমে আসছে পৃথিবীর, ক্রমে কালো হয়ে আসছে পশুরের জল, নীড়ে ফিরছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, দূরে দূরে ভাসছে কালো কালো ট্রলার। একটা জাহাজের মাস্ত্তলে পতপত করে উড়ছে ভিনদেশি পতাকা।

হঠাৎ কারো পদশব্দে সে ঘুরে দাঁড়াল। পাউডারের গন্ধ নাকে ঝাপটা দিলো। তার পেছনে বিগতযৌবনা এক বারাঙ্গনা। থুতনিতে ডান হাতের তালু ঠেকিয়ে, কোমর বাঁকিয়ে বারাঙ্গনা বলল, বানিশামন্তায় আইয়া কেউ এরাম কইরা খাড়ায়া থাহে? হি হি, কেমন পুরুষ! ধোন নাইক্কা!

বারাঙ্গনার কথার গূঢ়ার্থ বুঝতে সাগরের দেরি হলো না। সে লজ্জা পেল। একই সঙ্গে খানিকটা অপমানও বোধ করল। তার পর্যাপ্ত টাকা নেই। থাকলে বুঝিয়ে দিত সে কেমন পুরুষ। সে চুপ করে রইল। বারাঙ্গনা তার দুই ভ্রম্ন ওপরে ঠেলে বলল, কী? লাগবে?

কয়েক মুহূর্ত। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সাগর বলল, রেট কত?

পানি ফেলবা?

সাগর না-সূচক মাথা নাড়ল।

শুধুই বসা?

সাগর এবারো না-সূচক মাথা নাড়ল।

তাহলে করবাটা কী?

পানি … মানে পানি ফেলব।

তিনশো।

সাগর একটু অবাক হলো। এত কম টাকা! তবু বলল, দুইশো হয় না?

ইস্! ইডা কি মাছের বাজার? এক রেট। দরাদরি নাইক্কা।

আর দেরি করল না সাগর, বারাঙ্গনার পিছু ধরল। হাঁটতে হাঁটতে দোকানের পাশের গলি ধরে চার কোঠার চৌচালা কুঁড়েটির সামনে দাঁড়াল। বারাঙ্গনা ডাক দিলো, আঁখি!

হুঁ। ভেতর থেকে জবাব এলো।

দুয়ার খোল। দেখ, তোর নাগর আইয়া পড়ছে।

আঁখি দরজা খুলল। ভেতরে ঢুকল সাগর।

সূর্য অস্ত গেল। পশুর নদের জল কালো হয়ে উঠল। আঁখির সঙ্গে সাগর কী করল তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বেশ্যার ঘরে গিয়ে পুরুষ কী করে তা কি বুঝিয়ে বলতে হয়? চটি হলে দরকার হয়। এটি তো চটি নয়, গল্প। তবে এটুকু বলা যায়, আঁখির কপালে ঠোঁট ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে সাগরের মনে পড়ে যায় বহুদিন আগে পড়া একটি কবিতার পঙ্ক্তি : ‘আমার ভিতর থেকে আমার পিতৃপুরুষ তার লকলকে যৌনাঙ্গ রাষ্ট্রকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ব্যক্তিত্বের আরো এক নাম গোপনীয়তা।’ কার কবিতা? মনে নেই। পঙ্ক্তিটা মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতেই থাকে।

সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হলো। তিন সঙ্গীর কথা সাগরের খেয়ালে ছিল না। খেয়াল হলো ঘাটে ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দে। সে বিচলিত হলো। তাকে রেখেই কি সঙ্গীরা চলে যাচ্ছে? চলে গেলে তো বিপদ। মংলায় কীভাবে ফিরবে? দ্রম্নত সে প্যান্ট পরতে লাগল। অমনি  দরজার বাইরে মানুষের পদশব্দ শুনতে পেল। সহসা হাঁক ভেসে এলো, এই, দরজা খোল।

আঁখি এগিয়ে গেল। দরজা খুলল। চমকে উঠল সাগর। বাইরে পুলিশ! সর্বনাশ! কেননা ব্যক্তিত্বের আরো এক নাম গোপনীয়তা। পুলিশ যদি তাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো না কোনোভাবে এই গোপন খবর পৌঁছে যাবে তার সম্ভ্রান্ত বাবার কানে। বাবা বড় পাষাণ হৃদয়ের মানুষ। কী করে বসে ঠিক নেই। তার ভাবনাতেই ছিল না পতিতাপল্লিতে পুলিশ আসতে পারে। কাঁপুনি ধরে গেল তার গায়ে। সে কাঁপতে থাকে। পুলিশ দেখে আঁখিও খানিকটা অবাক। কারণ এই পল্লিতে পুলিশ সাধারণত আসে না। ঠিক আসে না বলা যাবে না। আসে। তবে খাকি পোশাকে নয়, সাদা পোশাকে। আসে রসের সাগরে ডুব দিতে। খাকি পোশাকে আসত, যদি না মাসোয়ারা পেত। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট অংকের টাকা চলে যায় থানায়। তবু কেন এলো? এই মাসে কি মাসোয়ারা পৌঁছেনি?

এক কনস্টেবল ঢুকল কুঁড়ের ভেতরে। সাগরের শার্টের কলার ধরে অবাধ্য ছাগলের মতো টানতে টানতে দোকানের সামনে নিয়ে গেল। আঁখিকেও। দোকানের সামনে আরো পাঁচটি জুটি। তিন সঙ্গীকেও দেখতে পেল সাগর। তরুণ সঙ্গীটি উবু হয়ে বসে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে, বাকি দুজন হাসছে। সাগরেরও কাঁদতে ইচ্ছে করে। দুই সঙ্গীর হাসি দেখে কাঁদতে পারে না। এই বিপদকালে তাদের হাসির কারণ খুঁজে পায় না সে। খুঁজে পেল প্রায় পনেরো মিনিট পর, তারা যখন পুলিশের হাতে তিন হাজার করে নয় হাজার টাকা তুলে দিলো। ছাড়া পেয়ে তরুণটির কান্না থামল।

এবার কান্না পেল সাগরের। তিন হাজার টাকা! এতো টাকা তো তার কাছে নেই। পুলিশের এক কথা – হয় তিন হাজার টাকা দিতে হবে, নয় মুন্সি ডেকে বেশ্যার সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হবে। বাড়াবাড়ি করলে সোজা চালান করে দেওয়া হবে লালঘরে। কী করে সাগর? আঠারোশো টাকা থেকে তিনশো আগেই আঁখিকে দিয়েছে। বাকি আছে পনেরোশো। এই টাকা পুলিশকে দিয়ে দিলে সে রাজশাহী ফিরবে কেমন করে? না খেয়ে মরতে হবে। তবু তিনশো হাতে রেখে বারোশো দেওয়ার কথা ভাবল। তিনশো টাকায় আগামীকাল পর্যন্ত চলা যাবে। রাতটা মংলা বন্দরে ঘুরেফিরে কাটিয়ে সকালে বাসে করে খুলনায় গিয়ে ট্রেন ধরবে। ট্রেনের ছাদে করে বিনা টিকেটে সোজা ঈশ্বরদী। একই কায়দায় ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী। এক কনস্টেবলকে সে পনেরোশো টাকার কথা বলল। কনস্টেবল কড়া ধমক দিয়ে বলল, সোজা লালঘরে ঢুকিয়ে দেব নটীর বেটা! অগত্যা সে চুপ করে থাকে। কেননা ব্যক্তিত্বের আরো এক নাম গোপনীয়তা।

রাত বাড়ে। বাড়ে বেশ্যাদের হই-হলস্না। দুই খদ্দেরের কোমরে রশি লাগাল পুলিশ। তারা টাকা দিতে পারেনি, বিয়ে করতেও রাজি নয়। উপরন্তু পুলিশের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করেছে। তাদের চালান করা হবে লালঘরে।

দারোগা এসে সাগরের সামনে দাঁড়াল।

কী? টাকা দেবা? নাকি বিয়া করবা?

সাগর জবাব দেয় না। নিচের দিকে তাকিয়ে বুড়ো আঙুলে মাটি খোঁচায়।

মুন্সি কি পুলিশের সঙ্গে এসেছিল, না আগে থেকেই ছিল কে জানে। তাকে দোকানের সামনে দেখা গেল। মাথায় গোল টুপি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পরনে নীল লুঙ্গি, থুতনির নিচে একগোছা দাড়ি, গালভরা পান, হাতে একটা পানের ডাঁটা, তার ডগায় চুন। আগের মতো শার্টের কলার ধরে টানতে টানতে সাগরকে নেওয়া হলো আঁখির কোঠায়। বসানো হলো চকির ওপর। পাশে আঁখিকেও। সাগরের নাম-সাকিন জানতে চাইল মুন্সি। সাগর ঠিক ঠিক সব জানাল। মুন্সি এক টুকরো কাগজে টুকে নিল। সাগরের তখন মনে হলো, হায়, ভুল ঠিকানা দিলেও তো পারতাম। বাবার নামটি ভুল দেওয়া উচিত ছিল। সর্বনাশ!

মুন্সি এবার আঁখির নাম-ঠিকানা জানতে চাইল। আঁখি সব জানাল। ভুল বলল না, শুদ্ধ বলল বোঝার উপায় নেই। কে যাচাই করবে? মুন্সির কাজ কলেমাটা পড়িয়ে দেওয়া। ঠিকানা ভুল বললে তার কী? আঁখির নাম-ঠিকানাও কাগজটায় টুকে নিল সে। নিল আঁখির এজিন। তারপর তার নাম, বাবার নাম, সাকিন ইত্যাদি উলেস্নখ করে মুন্সি যখন সাগরকে বলল, বলুন কবুল, সাগরের বুক ফেটে তখন কান্না এলো। আর আঁখির এলো হাসি। অট্টহাসি। তবে বড় মলিন। বড় করুণ। হাসতে হাসতে বলল, বিয়ার সময় তো মাইয়া মানুষ কান্দে। আপনে কি মাইয়া মানুষ? সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছল সাগর। বলল, কবুল।

ব্যাস, লেঠা চুকে গেল। দুই খদ্দেরকে নিয়ে চলে গেল পুলিশ। দোকানের সামনে বারাঙ্গনাদের জটলাও ভেঙে গেল। পল্লিতে আর বহিরাগত কেউ থাকল না, কেবল সাগর ছাড়া। অবশ্য তাকে এখন আর বহিরাগত বলা যায় না। আঁখি এখন তার বিবাহিত স্ত্রী। আঁখি এই পল্লির বাসিন্দা। সেই সুবাদে সাগরও। স্ত্রীর কোঠায় বসে হাঁটুতে মাথা রেখে সে কাঁদে। আঁখি বলল, কান্নার কী আছে? এমন বিয়া কত হয়! চাইলে আপনে আমারে তালাক দিতে পারেন।

মুখ তুলল সাগর। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকাল। মনে হলো, আঁখি যেন একটা জ্বলন্ত পিদিম। এই পিদিমের শিখায় পোকামাকড়ের মতো তার ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে। সে তাকিয়ে থাকে আঁখির মনোহারী চোখদুটির দিকে। আঁখি হেসে উঠল। সাগরের মনে হলো করমজলের গভীর অরণ্যে যেন পাতারা ঝরছে। মড়মড় কড়কড় করে। হাসি নয়, যেন গভীর কান্না।

আঁখি বলল, দেনমোহর লাগব না। তালাক দিয়া যান গা।

সাগর চোখ সরায় না। মনে পড়ে দাদির কথা। শৈশবে দাদি বলতো, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তকদিরের লিখন। আগেই ঠিক করা থাকে। কেতাবের কথা। এই তিনে মানুষের হাত থাকে না। সাগর ভাবে, আঁখির সঙ্গে তার বিয়েও কি তবে তকদিরের লিখন? পূর্বনির্ধারিত? নিশ্চয়ই। কেতাবের কথা তো আর মিথ্যে নয়। কিন্তু আঁখিও তো ভুল কিছু বলেনি। কেতাবে তো তালাকের কথাও লেখা আছে। সাগর চাইলেই তাকে তালাক দিতে পারে। দিয়ে চলে যেতে পারে আপন ঠিকানায়। কেউ কিচ্ছু বলবে না, কেউ কিচ্ছু জানবে না। এই গোপন কথা চিরকাল গোপন থেকে যাবে।

আঁখির হাসি থামে না। সাগর বাইরে তাকায়। কল্পচোখে ভেসে ওঠে ভিখেরি আঁখির ভিখ মাগার দৃশ্য। পৌষ মাসের তীব্র শীতের সন্ধ্যা। আঁখির গায়ে চটের বস্তা, হাতে ভিক্ষার থালা। কোনো এক পস্ন্যাটফর্মে লোকাল ট্রেন থামে। ভাঙা থালাটা আঁখি জানালায় গলিয়ে দেয়, দেন গো বাবা, দুইটা টাকা দেন। পেটে বড় খিদা। দেন গো মা …। ট্রেনের ভেতরে সাগর। মানিব্যাগ বের করে পাঁচ টাকার একটা কয়েন সে আঁখির থালায় রাখে। ঠন করে শব্দ হয়।

চোখ ফেরায় সাগর। কোঠার এক কোণে দাঁড়িয়ে আঁখি শাড়ি পরছে। তার উদোম ফর্সা পিঠের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। সে বুঝতে পারে না কেন তার কল্পনায় আঁখির ভিখ মাগার দৃশ্যটা ভেসে উঠল। খুব খারাপ লাগে তার, খুব। আঁখির জন্য খুব মায়া হয় তার, খুব। সে চকি থেকে নামল। আঁখির দিকে ফিরে বলল, না।

আঁখি বলল, কী?

আমি তালাক দেব না।

হা হা হা।

আমার দাদি বলতেন, জন্ম-মৃত্যু আর বিয়ে তকদিরের লেখা। এতে মানুষের হাত থাকে না।

এই কথা তো আপনের দাদির না, কেতাবের।

হ্যাঁ, কেতাবের।

কিন্তু মানুষ চাইলে তকদির বদলাতে পারে।

আমি বদলাতে চাই না।

হা হা হা।

জন্ম-মৃত্যু যেমন একবার হয়, বিয়েও মানুষ একবারই করে।

মুসলমান চার বিয়া করতে পারে। কেতাবের কথা।

আমি মানি না।

আপনের বাপ-মা তো এই বিয়া মানবে না।

মানবে। বাবা আমাকে বড্ড ভালোবাসে।

রাতটা সাগর আঁখির কোঠাতেই থাকল। আঁখিকে বুকে নিয়ে। রসের সাগরে ডুব দিয়েছিল কিনা তা তো আর বলার দরকার নেই। নববিবাহিতা স্ত্রীকে বুকে নিয়ে ঘুমালে কোনো পুরুষ তো আর সাধু-সন্ন্যাসীর মতো অটল থাকতে পারে না। সাগরও ছিল না।

ভোর হলো। কাপড়-চোপড় যা কিছু আছে একটা ব্যাগে ভরল আঁখি। চকির নিচ থেকে বের করে আনলো একটা ট্রাঙ্ক। তালা খুলে বের করল একটা ভ্যানিটি ব্যাগ। পাঁচ বছরের জমানো সাতাশ হাজার টাকা বের করে সাগরের হাতে দিলো। একশ ও পাঁচশো টাকার তিনটা বান্ডিল। নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল সাগর। আঁখি বেরিয়ে গেল কোঠা থেকে। কোথায় গেল কে জানে। ফিরল প্রায় এক ঘণ্টা পর। সঙ্গে আপাকে নিয়ে। আপার মুখে খিস্তি। মুখে যা আসছে তাই ছেড়ে দিচ্ছে। আঁখি গায়ে মাখছে না। সাগরের উদ্দেশে আপা বলল, খানকি মাগিকে নিয়া ঘর করবা? করো গিয়া। কদিন? এই মাগি আবার আমার (আমার-এর পরের শব্দটা ভদ্রসমাজে উচ্চারণের অযোগ্য) তলে আইসা হাজির হইব।

না, হাজির হয়নি আঁখি। কেন হয়নি সে-কথা পরে বলা যাবে। আগে বললে তো এই গল্প কেউ পড়বে না। শেষটা জেনে গেলে পুরো গল্প কি কেউ পড়ে? ডালের মজা যেমন তলায়, গল্পের মজাও তেমন শেষে।

আঁখিকে নিয়ে বানিয়াশামন্তা পতিতাপল্লি ছাড়ল সাগর। প্রথমে খুলনা। বাস বদলে তারপর মেহেরপুর। সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি পৌঁছল। পুত্রের বিয়ের কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে গেল সালেহা বেগম। এখলাসউদ্দিন মজুমদার চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলল। পাড়াপড়শি এলো। এক মহিলা আঁখির ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। সারাপথ সাগর তাকে বলেছে, সাবধান, ভুলেও বানিয়াশামন্তার কথা বলবে না। আঁখি প্রতিবারই বলেছে, না, বলব না। আমার কি মাথা খারাপ? কিন্তু এখন তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, বানিয়াশামন্তা।

বানিয়াশামন্তা? তার মানে বেশ্যাপাড়া!

এবার আঁখির মুখ ফসকাল না। শুধু আঁচলে মুখ ঢাকল।

তার মানে বেশ্যা? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ও শিবলির মা, তোমার পোলায় তো বেশ্যা বিয়ে করে ঘরে তুলল! বংশের মান-ইজ্জত তো আর কিছু থাকল না গো! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

এবার সাগরের সম্ভ্রান্ত বাবাও জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চিলের মতো উড়ে এলো সাগরের বড়ভাই শিবলি। ছোটভাইয়ের গালে কষে দুটো চড় দিয়ে বলল, এই বাড়ি থেকে এক্ষুনি বের হ কুত্তার বাচ্চা।

বেরিয়ে গেল সাগর। আঁখিকে নিয়ে। তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ছুটি হচ্ছে মেহেরপুর শহর। পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে দুজন। দুজনের হাতে দুটি ব্যাগ। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল শহরের পূর্বপ্রামেত্ম এক পরিত্যক্ত বানুকে। ঠিক বানুকে নয়, বানুকের গোড়ায় একটা পরিত্যক্ত দালানের দাওয়ায়। ব্রিটিশ আমলের লাল দালান। কুঠিয়ালের অফিস ছিল। এখন ভবঘুরেদের আস্তানা। বসে থেকে রাতটা কাটিয়ে দিলো। ভোরে উঠে চড়ে বসল বাসে। প্রথমে কুষ্টিয়া। তারপর বাস বদলে নাটোর। নাটোরে বন্ধু জগদীশের বাড়ি। ঠিক বন্ধু নয়। জগদীশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পিয়ন। সাতাশ-আটাশ বয়স। দুই সমন্তানের বাবা। শহরের অদূরে ছাতনী গ্রামে বাড়ি। সাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব হওয়ার কথা। হয়নি যে তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অনেক বন্ধু। বাংলা বিভাগের এক অধ্যাপকের সঙ্গে একবার পুঠিয়ায় গিয়েছিল মাদার পিরের পালা শুনতে। সঙ্গে জগদীশও ছিল। সেই থেকে জগদীশের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। দু-মাস আগে জগদীশের বাড়িতে বেড়িয়েও গেছে।

জগদীশ তাকে হেলা করল না। তার বউও না। আদর-আপ্যায়ন করল। প্রায় এক সপ্তাহ থাকল তার বাড়িতে। অক্টোবর মাস ফুরাল। নভেম্বরের এক তারিখে আঁখিকে নিয়ে একটা ভাড়া বাসায় উঠল সাগর। জগদীশই ঠিক করে দেয়। টিনের ঘর। দুই রুম। পেছনে রান্নাঘর ও টিউকল। তার পেছনে স্যানিটারি ল্যাট্রিন। ভাড়া চারশো টাকা। বিদ্যুৎ বিল আলাদা। একই ঘরের আরো তিনটি রুমে স্ত্রী-সমন্তান নিয়ে তিন রিকশাঅলা থাকে।

দুদিন কাটল। আয়-রোজগারের কথা ভাবল সাগর। আঁখির সাতাশ হাজার টাকা থেকে এরই মধ্যে তিন হাজার খরচ হয়ে গেছে। বাকি টাকা দিয়ে আর কদিন? দেখতে না দেখতেই ফুরিয়ে যাবে। তখন কী করে চলবে সংসার?

আঁখি বলল, ওসব ভাবতে হবে না, আপনে পড়ালেখায় মন দেন।

আর পড়ালেখা!

কেন?

পড়ালেখা করতে গেলে সংসার চলবে?

চলবে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনের পড়ালেখা বন্ধ করা যাবে না।

আঁখির মুখের দিকে তাকাল সাগর। আঁখি হাসল। সেই মলিন হাসি। কিন্তু একটা চাপা আত্মবিশ্বাস লুকিয়ে। সাগর ভেবে পায় না কী ব্যবস্থা করবে আঁখি। সে কি আগের মতো দেহব্যবসা করবে? অসম্ভব। কিছুতেই হতে পারে না। অতীতে যা হয়েছে তো হয়েছে। এখন সে তার বিবাহিত স্ত্রী। একান্তই তার। কোটি টাকার বিনিময়েও তাকে পরপুরুষের কাছে যেতে দেবে না।

আঁখি বলল, আমাদের একটা সেলাই মেশিন ছিল। বাজান মরার পর মা সেলাই করে সংসার চালাতো। আমিও শিখেছিলাম।

সাগরের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গভীর অন্ধকারে যেন একটু আলোর দিশা পেল। কিন্তু মুহূর্তে আবার বিষাদের ছায়া নামল মুখে। সেলাই করে কি আর দুজনের সংসার চলবে? শহরে এখন কত ভালো ভালো টেইলার। টাকা বেশি হলেও মানুষ ভালো দর্জির কাছেই যায়। আঁখির কাছে কে আসবে?

আঁখি বলল, আসবে। ওপরে আলস্নাহ, নিচে আপনে।

দুদিন পর আঁখিকে নিয়ে রাজশাহী শহরে গেল সাগর। সাড়ে তিন হাজার টাকায় কিনল একটা সিঙ্গার সেলাই মেশিন। ফার্নিচার দোকান থেকে পাঁচশো টাকায় কিনল একটা চেয়ার। আর কিনল কয়েক বান্ডিল সুতা। কিনল সংসারের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ফিরে এলো সন্ধ্যায়। পরদিন গেল নাটোর শহরের সবুজ আর্ট সেন্টারে। দুটি সাইনবোর্ডের অর্ডার দিলো। একটি বড়, আরেকটি ছোট। দুটিতেই একই লেখা :

আঁখি টেইলার্স

এখানে সেলোয়ার, কামিজ, সায়া, বস্নাউজসহ

মেয়েদের সব ধরনের পোশাক সিলানো হয়।

প্রো : আকলিমা আকতার আঁখি।

ছাতনী, নাটোর।

দুদিন পর সাইনবোর্ড দুটি আনলো। বড়টি লাগিয়ে দিলো বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে, ছোটটি ঘরের দরজার ওপর।

সেদিনই রাজশাহী চলে গেল সাগর। যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বুকে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, সাবধানে থেকো।

আঁখি হাসলো। সেই হাসির অর্থ : হিংস্র হায়েনার থাবা খেতে খেতে আমি নিজেকে রক্ষার কৌশল জেনে গেছি সাগর। আমাকে নিয়ে তুমি চিমন্তা করো না। তোমাকে ছাড়া আমার তো আর হারাবার কিছু নেই।

পাঁচটা বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই কাটাল সাগর। কখনো সপ্তায়, কখনো পনেরো দিনে, কখনো মাসে একবার করে আঁখির কাছে এসেছে। দু-এক রাত থেকে আবার ফিরে গেছে। যাওয়ার সময় আঁখি টাকা দিয়েছে। কখনো এক হাজার, কখনো দুই হাজার, কখনোবা পাঁচ হাজার। সেই টাকায় পড়ালেখা চালিয়েছে সাগর। প্রথম শ্রেণিতে মার্স্টাস পাশ করেছে। রেজাল্টের আগেই পুত্রসমন্তানের বাবা হয়েছে।

এখন বাসাতেই থাকে। সারাদিন সেলাইয়ের কাজ করে আঁখি। সারাদিন মেশিনটা চলে, খটখট … খটখট … খটখট করে। সাগর পুত্রকে সামলায় আর সংসারের নানা কাজে আঁখিকে সহযোগিতা করে। অবসরে সদরে গিয়ে পত্রপত্রিকা ঘেঁটে চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জোগাড় করে। রাত জেগে অ্যাপ্লিকেশন লেখে। ঢাকায় গিয়ে তিনবার ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে। চাকরি হয়নি।

একদিন আঁখি বলল, আচ্ছা, মানুষ ডিসি-এসপি হয় কেমন করে?

সাগর হেসে বলল, কেমন করে আবার? বিসিএস পাশ করে।

আপনে কি সেটা পাশ করেন নাই?

না, আমি তো মাস্টার্স।

বিসিএস পাশ করছেন না কেন?

বিসিএস কি এতো সোজা? আমাকে দিয়ে হবে না।

চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নাই।

উৎসাহিত হলো সাগর। চেষ্টা করলো। আড়াই হাজার টাকা বেতনে টানা দুই বছর নাটোরে এক ফুড কোম্পানির সেলসম্যানের চাকরি করলো। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে বিসিএসের প্রস্ত্ততি নিল। দুই বছর পর দিলো পরীক্ষা। প্রশাসন ক্যাডারে। ভেবেছিল টিকবে না, অথচ টিকে গেল। পোস্টিং হলো চাঁদপুর ডিসি অফিসে। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। স্ত্রী-পুত্রকে সঙ্গে নিতে চাইল। আঁখি রাজি হলো না। এখন তার ব্যবসার অনেক পসার, দর্জি হিসেবে তার অনেক সুনাম। কয়েকটা বছর যাক, চাকরিতে সাগর থিতু হোক, তারপর না হয় যাবে।

আড়াই বছর পর পদোন্নতি পেল সাগর। এসি ল্যান্ড হিসেবে পোস্টিং হলো নেত্রকোনায়। এবার আর আঁখি না করতে পারল না। নাটোরের পাট চুকিয়ে স্বামীর সঙ্গী হলো।

কেটে গেল সাত বছর। শাওনের বয়স তখন নয় বছর। ক্লাস থ্রিতে পড়ছে। আবার পদোন্নতি পেল সাগর। ইউএনও হয়ে পোস্টিং পেল গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে।

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারে। তরুণ কবি এতক্ষণে আরো কয়েক পেগ গিলেছে। সে এখন অন্য জগতে। আরেক তরুণ কবির সঙ্গে সাহিত্যতর্কে লিপ্ত। মফস্বলের কবিদের ধুয়ে দিচ্ছে। একেকটা মহাকবি কালিদাস। অথচ রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি তো দূরে থাক, মেঘদূতটাও ভালোভাবে পড়ে না। আর ঢাকার কবিরা তো একেকটা বাইঞ্চোৎ। সারাক্ষণ ধান্ধায় ব্যস্ত। আর একটা আরেকটার পুটকিতে আঙুল দিয়ে বেড়ায়। এ বলে ওর কবিতা হয় না, ও বলে এর কবিতা হয় না। কার কবিতা যে হয় সেটা গবেষণার বিষয়। কী বলেন বড়ভাই?

আমি হাসি। তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। আমি ভাবছি গল্পের শেষটা নিয়ে। পদোন্নতি পেয়ে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল সাগর – গল্পটা এভাবে শেষ করে দেওয়া যায়। সুরেশ চৌধুরী, আকবর উদ্দিন বা শ্রীমান ভট্টের গল্প-উপন্যাসের মতো। তাদের বেশিরভাগ গল্প-উপন্যাসের
পাত্র-পাত্রীরা শেষে এসে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। আমিও কি তাই করব? এই গল্পের পাত্র-পাত্রীকে সুখের সংসারে পাঠিয়ে দেবো?

না, আমি তা করব না। আমি এখলাসউদ্দিন মজুমদারের কথা ভাবি। সাগর বাড়ি ছাড়ার দু-বছর পর তার বড়ভাই শিবলি বিয়ে করে, কুষ্টিয়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। মেয়ের বাবা কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় কর্মকর্তা। বিয়ের পাঁচ বছরেও কোনো সমন্তানাদি হলো না। একদিন এক বন্ধুকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেল শিবলি। স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়াটা শুরু হলো বন্ধুকে কেন্দ্র করেই। যখন-তখন যাকে-তাকে নিয়ে শিবলির শ্বশুরবাড়ি যাওয়াটা স্ত্রীর পছন্দ নয়। এ নিয়ে শুরু হলো দুজনের তুমুল ঝগড়া। এক পর্যায়ে স্ত্রী তার গালে মারল এক ঘুসি। তার নাক ফেটে বেরোতে লাগল রক্ত। হইচই শুনে ছুটে এলো শাশুড়ি, এলো শ্বশুর এবং শালা-শালিরা। সবাই মিলে শিবলির স্ত্রীকে বকঝকা করল, মা কয়েকটা চড়-থাপ্পড়ও দিলো। বাথরুমে গিয়ে নাকের রক্ত পরিষ্কার করল শিবলি। বেরিয়ে আর দাঁড়ালো না। বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তারপর আর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। উকিলের মাধ্যমে তালাকনামা পাঠিয়ে দেয়।

বছরখানেক পর এখলাসউদ্দিন পুত্রকে আবার বিয়ে করাল। এবারো সম্ভ্রান্ত পরিবারে। খুবই সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু এখলাসউদ্দিনের কপাল খারাপ। বিয়ের এক বছরের মাথায় জুদা হয়ে গেল পুত্র। বাড়িতে আলাদা ঘর তুলল। বউকে নিয়ে সেই ঘরেই থাকতে লাগল। বাবার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে না। না পারতে মায়ের সঙ্গে বলে। তাও দু-তিনদিনে একবার।

বড় পুত্রের জুদা হওয়ার ঘটনায় মনে বড় আঘাত পায় এখলাসউদ্দিন। ছোট পুত্রের কথা মনে করে সারাক্ষণ কাঁদে। আগে যে কাঁদত না, তা নয়। গোপনে কাঁদত। গোপন বেদনার কথা কখনো কারো কাছে প্রকাশ করতো না। সে জানে না তার পুত্র কোথায় আছে, কেমন আছে। কোনোদিন খবর নেয়নি। নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। যে-পুত্র বেশ্যাকে বিয়ে করেছে সেই কুপুত্রের খবর কেন নেবে? মানসম্মান তো এমনিতেই গেছে। খবর নিতে গেলে যেটুকু আছে সেটুকুও যাবে।

বাগানে ফুল ফুটলে সুবাসকে তো আর লুকিয়ে রাখা যায় না। সাগর তো এখন ফুল। ফুলের মতো সুবাস ছড়াচ্ছে। মুকসুদপুরের মানুষের মুখে মুখে তার সুনাম। এমন জনদরদি ইউএনও মুকসুদপুরবাসী এর আগে পায়নি। গোপালগঞ্জ শহর থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই তার নানা কর্মকা–র খবর ছাপা হয়। সেই খবর মুকসুদপুর থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। একদিন গোপালগঞ্জ থেকে দুজন লোক আসে এখলাসউদ্দিনের দোকানে। তারা তাদের ইউএনওর গল্প করে। এখলাসউদ্দিন কান পেতে শোনে। শুনতে শুনতে তার কান্না পায়। কেন কান্না পায় তা তো আর খুলে বলার দরকার নেই।

সেদিন বিকেল থেকে শুরু হলো তুমুল বর্ষা। বৃষ্টি থামার আর নাম নেই। যেন কোনোদিন থামবে না। মাঠঘাট সব ভাসিয়ে দিচ্ছে। সারাদেশ না ডুবিয়ে যেন থামবে না। পরদিনও বৃষ্টি। দুপুরে একটু ছেক দিলো। কোয়ার্টারের ছাদে উঠে কাপড়-চোপড় রোদে দিচ্ছিল আঁখি। হঠাৎ তার চোখ গেল গেটের দিকে। এক বুড়ো ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছে, দারোয়ানে তাকে বাধা দিচ্ছে। আঁখি চমকে উঠলো। দ্রম্নত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। উড়াল দিয়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। বুড়োকে চিনতে তার একটুও দেরি হলো না। ষোলো বছর আগে মুখের চাপদাড়ির বেশিরভাগই ছিল কালো, এখন সবকটাই সাদা। হাতের ছাতাটা বগলে নিয়ে আঁখির মুখের দিকে তাকালো বুড়ো। শাড়ির আঁচলটা টেনে মাথায় দিলো আঁখি। কদমবুচি করার জন্য ঝুঁকে যেই না হাত বাড়াল, অমনি হাত দুটো ধরে কেঁদে উঠে বুড়ো বললো, মা গো, আমি ভুল করেছিলাম মা।