বাল্যকাল

অ তী ন  ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

এই বুড়ো বয়সে আর প্রাক-যৌবনের কথা আমার ঠিকঠাক মনে নেই। সম্ভবত আমি সবে বহরমপুর থেকে কলকাতায় জীবিকার খোঁজে চলে এসেছি। তখন তরুণ এক যুবক। এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি – আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠি। থাকি খাই। আমার সমুদ্র মানুষ বইটি তখন মিত্রালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক গৌরিশঙ্কর ভট্টাচার্য সস্নেহে বইটি প্রকাশ করেছেন। এবং দুশো টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। মানিক স্মৃতি পুরস্কারেও সম্মানিত হয় বইটি। মতি নন্দী পান প্রথম পুরস্কার, দ্বিতীয় পুরস্কার পান পূর্ণেন্দু পত্রী, তৃতীয় পুরস্কারের জন্য আমি নির্বাচিত হই। উল্টোরথ পত্রিকার এই প্রতিযোগিতা এবং

তৃতীয় পুরস্কার আমার সাহিত্যজীবনের প্রথম ধাপ বলা যেতে পারে। বহরমপুরের হবু সাহিত্যিকদের কাছে এজন্য আমি ঋণী। তাঁদের প্রেরণাতেই আমার উপন্যাস রচনা। তাঁদেরই একজন পা-ুলিপিটি উল্টোরথ পত্রিকা অফিসে কলকাতায় এসে জমা দেন।

আর সেইসব প্রিয় বন্ধু বেঁচে আছে কিনা জানা নেই। তাঁদের কারো সঙ্গে আমার আর যোগাযোগও নেই। কখনো বহরমপুরে গেলে খোঁজ যে না করেছি তাও নয়, আমার বন্ধুরা অধিকাংশই পিডবিস্নউডির কোয়ার্টারের বাসিন্দা। আমার বন্ধু প্রশান্ত কান্তি সেনগুপ্তর দাদা পিডব্লিউডির হেডক্লার্ক সম্ভবত।

প্রথমদিকে খোঁজখবর নিতে পিডব্লিউডির অফিসেও গেছি। কারো খোঁজ পাইনি। শুধু একজন হদিস দেয় – প্রশান্ত বিয়ে করেছে, কোনো এক বেসিক কলেজের প্রিন্সিপাল সে। তাও আবার উত্তরবঙ্গে। আমার প্রিয় বন্ধুর সঙ্গেও সেই যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আজ পর্যন্ত আমার আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। এই নগণ্য লেখকের এই বেদনার কথা বড় গভীর। প্রশান্ত না থাকলে আমার লেখকসত্তা যে বন্ধ্যা তাও বুঝি। আর লেখা থেকে আর্থিক উপার্জন ক্রমশ বাড়তে থাকে। রয়েলটি থেকেও ভালো আয় হয়। স্কুলের বেতন যতই সামান্য হোক, বেতনে আমাদের ভালোই চলে যায়। কিন্তু বিধি বাম, স্কুলের চাকরিটি কপালে সইল না।

আবার বাসাবদল। আবার বাড়ি ফিরে আসা। তবে ইতোমধ্যে স্ত্রীর একটি চাকরি জুটে গেল – শ্যামবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার। কলকাতায় এসে, মহারাজকুমার সোমেন নন্দীর সঙ্গে দেখা – বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে আলাপ, তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই তিনি তাঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে বলেন।

কাশিমবাজার রাজবাটিতে একটি অংশে আমার দুই নাবালক পুত্রসহ আমি এবং আমার স্ত্রীর থাকার বন্দোবস্ত করে দেন তিনি।

কাশিমবাজার হাউসের একপ্রান্তে তিনটি ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেন।

সেখানেই আমার দুই পুত্র বড় হয়েছে – কাশিমবাজারের এই রাজপরিবারটির পূর্বপুরুষ মহারাজ মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী, তাঁর প্রচুর

দানধ্যানের খ্যাতি আছে। মহারাজকুমার সোমেন্দ্র চন্দ্র নন্দীর সঙ্গে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে আলাপ। তারপর সখ্য। তিনি বললেন, তোমার লেখা আমি পত্রপত্রিকায় পড়েছি।

এখন কী লিখছ!

কী যে বলি! বললাম থাকারই সংস্থান নেই। দেশে স্ত্রী-পুত্রকে রেখে এসেছি।

– তোমার পুত্রদের পড়াশোনা –

কিছু বলতে পারি না, চুপ করে থাকি।

তিনি সোজা বলে দিলেন, আমি তোমার লেখা পড়েছি। আর কোথাও ছোটাছুটি করবে না – তাঁর ক্যালকাটা অফিস থেকে কাউকে ডেকে পাঠালেন – তিনি এলে বললেন, বাগানের সংলগ্ন ঘরগুলোতে ও থাকবে। ওর স্ত্রী-পুত্ররাও থাকবে। কথাবার্তা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে আছি। এত বড় রাজপ্রাসাদের কোনো এক অংশে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন। কিন্তু কোনো কাজের কথা বলছেন না। শুধু ওঠার সময় বললেন, পরেশবাবুকে বলে দেবেন, এখন থেকে এই ছেলেটি কলার প্রিন্টিংয়ে ম্যানেজারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করবে।

বাড়িটা রাজবাড়ি – তার দুপাশে বিশালমতি দোতলা রাজপ্রাসাদ। স্বপ্ন না সত্যি, বিশ্বাস করতে পারছি না।

অগত্যা কলকাতা। মহারাজকুমার সোমেন্দ্র চন্দ্র নন্দী বলেছিলেন কোনো অসুবিধা হলে আমার কাছে চলে এসো – সেই থেকে কাশিমবাজার হাউসে আশ্রয়। তাঁর কলার প্রিন্টিং কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।

সেখানেও গণ্ডগোল। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন।

মিছিল-মিটিং-অনশন যাবতীয় অস্ত্র প্রয়োগের ফল লকআউট। মাসের পর মাস লকআউট, বেতন নেই, থাকার জায়গা নেই,

মা-বাবা, ভাই-বোন এবং স্ত্রী-পুত্র পরিবার, নিঃস্ব এক মানুষ। বাধ্য হয়ে রাজবাড়ি ছাড়তে হয়। বাগুইহাটির দিকে বাসা ভাড়া নিয়ে চলে আসি।

ঠিক এই সময়েই কবি মনীন্দ্র রায় অমৃত পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক উপন্যাস শুরু করতে বলেন। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসটি সেই থেকে ধারাবাহিক শুরু হয়। ধারাবাহিক লেখার ফলে লেখক হিসেবে স্বীকৃতিও কিছুটা বৃদ্ধি পায়।

প্রথমে মিত্রালয় প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় সমুদ্র মানুষ, তারপর সমুদ্র পাখির কান্না – এবং অমৃত, দেশ, আনন্দবাজার, যুগান্তর পত্রিকায় তখন নিয়মিত লেখক।

এত বেশি লেখার চাপ সবসময় বহন করতে-করতে লেখক ছাপও পড়ে গেল। করুনা প্রকাশনী, আনন্দ – আরও সব প্রকাশকের আগ্রহে বইও প্রকাশ হতে থাকে এবং ক্রমশ এভাবেই নিয়মিত লেখক বলে চিহ্নিত হই।

ততদিনে বিমল করেরও এক আস্থাভাজন লেখক।

কার্জন পার্কে প্রায় বিকেলেই হবু লেখকদের একটি আড্ডাও বসে। বিমল কর সেই আড্ডার মধ্যমণি। আমরা যাঁরা হবু লেখক তাঁরাই এই আড্ডার প্রাণ বলা যায়। বিমলদার প্রিয় কেসি দাসের দোকান থেকে জলযোগ সেরে সাঁজবেলায় আমরা সব হবু লেখকরা গোল হয়ে বসতাম। কার্জন পার্কে, বিমলদা আড্ডা সেরে আমাকে নিয়ে বাস ধরতেন। কলেজ স্ট্রিটে নামতাম। তারপর আনন্দ পাবলিশার্সের বাদলের (বাদল বসু) অফিসে আর এক প্রস্ত আড্ডা, শেষবেলায় বিমলদা আর আমি একই বাসে রওনা দিতাম।

একাদশীর সকালেই নদীর ঘাটে নৌকা এসে ভিড়ত শীতলক্ষার বাবুদের ঘাটে। ভরা নদী – শীতলক্ষা নদী তখন সমুদ্র হয়ে যেত। এপার-ওপার অদৃশ্য হয়ে যেত – জোয়ারের সময় জল বাড়ত, ভাটার সময় নদীর চরের দু-একটা বেলা  ঘাসের মাথা দেখা যেত।

জল কমে গেলে নদীতে ভাটা শুরু, জল বাড়লে নদীতে জোয়ার এসে যায়।

এই জোয়ার-ভাটার সুযোগে জলে ফেলা ডালপালার ঝোপে শ্যাওলা খেতে মাছেরা উঠে আসত নদী থেকে। ঠিক জল নেমে যাওয়ার মুখে সেঁচা বাঁশের বেড়া দিয়ে জলে ফেলা ডালপালা ঘিরে ফেলা হতো। পাঁচ-সাত দিন অন্তর-অন্তর জলে ফেলা ডালপালা ঘিরে মাছ ধরার কৌতূহলে আমরা সুকুমারদাকে জ্বালিয়ে মারতাম। কবে ফের ডালপালা তুলে মাছ ধরা হবে। এই এক কৌতূহল।

পূজার কদিন আমাদের বাড়ি-বাড়ি পূজা দেখা, বাড়ি-বাড়ি পূজার প্রসাদ গ্রহণ, নিরন্তর ষষ্ঠী থেকে দশমী বাড়ি-বাড়ি এই প্রসাদ গ্রহণে আমাদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। মুড়াপাড়ায় বড়-বড় জমিদার তাদের আমলাদের ছেলেপেলেদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত রাখত।

পঞ্চমীতে মুড়াপাড়া যেতাম। একাদশীর দিন নৌকায় বাড়ি ফিরতাম।

আমাদের বাড়িতে গৃহদেবতার নিত্যপূজা ছাড়াও কার্তিক পূজা হতো ঘটা করে। আশ্বিন-কার্তিক বলতে গেলে পূজার মাসই বলা যায়। ঠাকুরদা মারা গেলেন। আশ্বিনের এক রাতে, পুবের ঘরে মা আমাদের নিয়ে থাকতেন। তিনি আমাদের ডেকে তুললেন।

ঘুম থেকে উঠে দেখি উঠোনে ঠাকুরদা শুয়ে আছেন। তিনি যে মৃত বোঝার বয়স ছিল না, এইটুকু শুধু মনে আছে। ভোররাতের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়ায় ঠাকুরদার পাশে বসে ছিলাম। কখন ঠাকুরদাকে জড়িয়ে ঘুমিয়েও পড়েছিলাম লেপের নিচে। পুকুরপাড়ে ঠাকুরদাকে নিয়ে যাওয়া হয়। আত্মীয়স্বজনে ভর্তি বাড়িটা। পুকুরের দক্ষিণপাড়ে ঠাকুরদার দাহ হয়।

ঠাকুরদা মারা গেছেন, আত্মীয়স্বজনে ভর্তি বাড়ি। বাড়ির সবাই আছে। কেবল আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল ছেলেটা! – মুখাগ্নির সময় টের পাওয়া গেল, বাড়ির সেই ছেলেটা লেপের নিচে ঠাকুরদাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।

নিখোঁজ থাকার পেছনে আমারও দোষ নেই।

ঠাকুরদার মৃত্যু নিয়ে সবাই ব্যস্ত। অঞ্চলের বিখ্যাত কবিরাজ তারিণী সেন ঘণ্টায়-ঘণ্টায় ওষুধ পালটে দিচ্ছেন। ঠাকুরদার আচ্ছন্ন অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

আমি সেই যে ঠাকুরদার পাশে বসেছিলাম, বসেই আছি।

রাত বাড়লে কখন ঠাকুরদার পাশে লেপ টেনে শুয়ে পড়েছি খেয়াল নেই – আত্মীয়স্বজনের তো শেষ নেই – শত হলেও আমার ঠাকুরদা বড় কর্তা বলে চিহ্নিত – আবার বহু মানুষের গুরুঠাকুর – খবর তো এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে না।

খবর ছড়ায়।

লোকজন লাইন দিয়ে উঠে আসছে।

আমার ঠাকুরদা কারো গুরুঠাকুর, আবার কারো রাজপুরোহিত। মুড়াপাড়ার জমিদার দীনেশবাবু ঘোড়ায় চড়ে চলে এসেছেন, জমিদার তারকবাবুর হাতিও দূরে দেখা যাচ্ছে, তিনিও বোধহয় আসছেন – বাইরের উঠোনে সামিয়ানা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণের ঘরে শিষ্য এবং যজমানদের ভিড়। জায়গা হচ্ছে না। পুকরপাড়ে অর্জুনগাছের ছায়ায় শতরঞ্চি বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে – পুকুরের দক্ষিণপাড়ে ভিড়।

আমাদের রনাদা, ধনাদার একদ- বিশ্রাম নেই। নানা প্রকারের হুঁকো, জাত বিচারে হুঁকোর বন্দোবস্ত – সেজন্য রমণীদা সম্মান্দির বাড়ি থেকে চলে এসেছেন – তিমি কাকা, ভবানী জেঠা, চিনি কাকা, বংশের যে যেখানে আছে সবাই হাজির।

একমাত্র বড় জেঠামশাই দক্ষিণের ঘরে একা নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছেন।

ঠিক একা বলা যাবে না। তবে তিনি কারো সঙ্গে কথা বলছেন না।

তিনি তাঁর মতো ইজিচেয়ারে পা তুলে আরাম উপভোগ করছেন।

মানুষ মরে গেলে ঘরে রাখতে নেই।

আমার ঠাকুরদার ঊর্ধ্বশ্বাস উঠে গেছে। রাতের দিকেই যায়-যায় অবস্থা, দীনবন্ধু কাকা তাঁর শিয়রে বসে আছেন। আত্মার কী ইচ্ছে কেউ জানে না। কেবল একটা বিষয়েই সকলের নজর, আত্মা যেন ঘরের ভেতরে দেহত্যাগ না করে।

ঠাকুরদাকে সেজন্যে উঠোনে রাখা হয়েছে – মুক্ত হাওয়া, মুক্ত আকাশের নিচে তাঁর প্রাণবায়ু অনন্তের সঙ্গে মিলে যাক – এই ইচ্ছা বাবা-কাকাদের। সম্মান্দির বাড়ি থেকে ভবানী জেঠা খবর পেয়ে রওনা দিয়েছেন। ছয় ক্রোশ রাস্তা তাঁকে হেঁটে আসতে হবে। ঠাকুরদার নির্দিষ্ট আমগাছের গোড়ায় দুজন লোক বসে আছে। হাতে কুড়ুল। গাছটাকে কাটা হবে, তারপর চেলাকাঠ করে ঠাকুরদাকে শুইয়ে দেবে চেলা কাঠের ওপর।

বল হরি, হরি বল।

ঠাকুরদাকে তোলা হচ্ছে –

বাবা-কাকারা বারবার আমার খোঁজ করছেন।

ভোলা গেল কোনখানে?

ভোলা গেল কোথায়?

রাতে বেশ ঠান্ডা পড়েছে।

আমিও ঠান্ডায় কিছুটা কাতর। একমাত্র ঠাকুরদার লেপের তলায় কিছুটা উষ্ণতা আছে। প্রথমে পা ঢুকিয়ে দিতেই টের পেলাম বেশ আরামদায়ক বোধ হচ্ছে। গ্রামের মানুষজনের ভিড় সারাবাড়িতে, ঠাকুরদার যজমান গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে আছে – ঠাকুরদার অন্তিমকালের যে আর দেরি নেই – হেঁচকি থেমে গেলেই শেষ – প্রাণবায়ুকে দেখা যায় কিনা জানা নেই। তবু আমার কৌতূহল ঠাকুরদার প্রাণবায়ু শরীর থেকে বের হবার সময় যদি জোনাকি পোকার মতো খপ করে ধরে ফেলা যায়,  যাবেটা কোথায়।

যখন বুঁদ হয়ে আছি – হেঁচকি থেমে গেল – সারা বাড়িময় ঠাকুরদাকে ঘিরে রেখেছিল যারা, তারা আর মুহূর্ত দেরি করলেন না – বল হরি, হরি বল, বলে বিছানার চার কোনায় ধরে পুকুরপাড়ে হাঁটা দিলো –

বড়দা চেঁচাচ্ছে, এই ভোলা পৈঠায় বসে থাকলি কেন!

ছোটকাকা চেঁচাচ্ছে, কান্নার সময় পাওয়া যাবে, আগে এদিকে আয়।

বাবার বিছানা ধর।

আমরা নাতিরা, ঘিরে ফেললাম ঠাকুরদার বিছানা। ব্রাহ্মণের মৃতদেহ ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায় সেই আতঙ্কও কম নয়। মৃতের স্পর্শ যেন কোনো অব্রাহ্মণ না পায়, বামুনের মড়া বামুনকেই বহন করতে হবে – দীনবন্ধু কাকার তদারকিতে অর্জুনগাছের নিচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে – লাহুরচরের শীতল চক্রবর্তী সঙ্গে আছেন। শ্মশানের খালকাটা সবে শেষ করছেন তিনি।

একটি আস্ত আমগাছের গুঁড়ি ফালা-ফালা করে দীনবন্ধু কাকার নির্দেশে চিতা সাজানো হচ্ছে। পাটকাঠির আঁটি নামে-নামে বিলি করা হচ্ছে – অর্থাৎ আমরা সবাই হাতে পাটকাঠির আঁটি নিয়ে প্রস্ত্তত। এখনো মেলা কাজ বাকি।

আমার বড় জেঠিমা দুদু কাকাকে বললেন, আপনার ঠাকুরভাই তো কাল ফেরেননি।

আমার পাগল জেঠামশাই খুশিমতো গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘুরে বেড়ান, গ্রামের পর গ্রাম সব আমাদের যজমান। আমার সেজ জেঠামশাই এবং বাবা মুড়াপাড়ার জমিদারি সেরেস্তায় আছেন, তাদেরও খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে মৃত্যু নিশ্চিত নয়। উপসর্গ দেখে মৃত্যু স্থির করতে হয়, শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলেই যে মৃত্যু হয়, আমার ঠাকুরদার বেলায় তা বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

আমার ঠাকুরমা ঠাকুরদার শিয়রে আজ দুদিন টানা বসে আছেন।

তাঁর শাঁখা-সিঁদুর মুছে দিতে হবে।

ঠাকুরদার প্রাণবায়ু গত হলেই কাজটা করার কথা।

গোপাটে সকাল থেকেই লোক জমায়েত হচ্ছে – শত হলেও আমার দাদু এ-অঞ্চলের ঠাকুরকর্তা, শুভ সময় কখন একমাত্র তিনিই বলে দিতে পারেন, তাঁর নির্দেশমতো সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত স্থির হয়।

পঞ্জিকার পাতা উলটে তিনি কাউকে বলে দেন। সূর্যোদয়, সূর্যাসেত্মর সময় জানার জন্য সকাল থেকেই লোক সমাগম হতে থাকে।

আমাদের বাড়ির সামনে উঠোন, পেছনে উঠোন – তাছাড়া অন্দরের উঠোনও একটি আছে। অন্দরের উঠোনের দুপাশে দুটো ঘর। একটা নিরামিষ ঘর আর একটি আমিষ ঘর।

বড় জেঠিমা নিরামিষ ঘরে ঠাকুরমার নিরামিষ রান্নার বন্দোবস্ত করে থাকেন। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর নিরামিষ ঘরের দায়িত্ব এই দুজনের। অর্থাৎ আমার ঠাকুরমা, নয় জেঠিমা। – সবারই বয়েস হয়েছে। তারপরের ধাপে, আমার ধন-জেঠিমা – শেষের ধাপে রাঙ্গা কাকিমা, ছোট জেঠিমা – এসব নানা ধাপে নিরামিষ-আমিষ রান্না হয়। আমার মেলা জেঠিমা-কাকিমা। বাবা-জেঠারা প্রবাসে থাকেন, দুদু কাকা বাড়ির গৃহকর্তা। তাঁর-ই অনুশাসনে সংসার চলে।

আমাদের ভাইবোন মেলা।

খুড়তুতো, জেঠতুতো ভাইবোন মিলে আমরা আঠারোজন।

ছোট কাকার স্ত্রী গর্ভবতী।

অন্দরের উঠোনে একটি চিরস্থায়ী অসুজ ঘর তৈরিই থাকে।

কাকিমা-জেঠিমারা প্রয়োজনমতো সেই অসুজ-ঘরে ঢুকে যান।

বাবা-জেঠারা কিংবা কাকারা অধিকাংশই প্রবাসে, শুধু দুদু কাকা বাড়ির গৃহকর্তা – জমিজমা দেখাশোনার ভার তাঁর ওপর। আমরা কেউ-কেউ সম্মান্দির বাড়িতেও বড় হয়েছি। পাশের গাঁয়ের মাইনর স্কুলের পাঠ শেষ করে সম্মান্দির বাড়িতে চলে যাই। একইসঙ্গে ঠাকুরভাইও যান। আমার ছোটদাদু রামচন্দ্র মুড়াপাড়ার জমিদারিতে কাজে ঢুকেছিলেন – আমার বাবাকেও তিনি সঙ্গে নিয়ে যান। সেই থেকে বাবাও তাঁর খুড়ামশাইয়ের সঙ্গে থেকে জমিদারির আদায়পত্রের কাজ শিখে নেন।

আসলে আমি দুটো বাড়িতেই বড় হয়েছি।

দেশভাগ হয়ে যাওয়ায় প্রথমে রাইনাদি বাড়ির সবাই হিন্দুস্থানে রওনা হয়ে যান।

তবে দেশের বাড়ির দুই বাড়িরই কাকা-জেঠারা দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় হিন্দুস্থানে রওনা হয়ে যান। তখন বর্ষাকাল – দুটো তিন মালস্না নৌকায় মা, কাকিমা-জেঠিমারা যে-যার প্রিয় টুকিটাকি জিনিসপত্র সব নৌকায় তুলে নেন। বাকি  তৈজসপত্র অ-দামে

কু-দামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আমার ঠাকুরদার বদ্রি হুঁকোটির প্রতি টোডারবাগের হাজি আবদুলস্নাহর চিরদিনই লোভ ছিল। ঠাকুরমা হাজি আবদুলস্নাহকে ডেকে বললেন, নে, রেখে দে। আমাদের কথা মনে হলে টিকা জ্বেলে মনের সুখে হুঁকো টানিস।

সোনা-জেঠামশাই বাদ সাধলেন।

না দেওয়া যাবে না, বংশের হুঁকো আর যা-ই করা যাক তোদের দেওয়া যাবে না।

হুঁকোটি আমাদের সঙ্গেই যাবে। সব স্মৃতিই বিনাশ,

বাপ-ঠাকুরদার স্মৃতি এই বদ্রি হুঁকো কিছুতেই দেওয়া যাবে না।

বাড়িঘর সবই বিক্রি হয়ে গেছে – টিনের চালগুলি আমরা নৌকায় ওঠার আগে খুলে ফেলা হলো।

অবশ্য আমরা তখন গয়না নৌকায় – ফাউসার খালে তিন মালস্না নৌকা দুটি নোঙর ফেলে আছে – বাড়ির কোষা নৌকাটিতেও তোলা হয়েছে বড়-বড় টিনের বাক্স – টিনের চাল খুলে দেওয়া হলে আমরা গিয়ে গয়না নৌকায় আশ্রয় নিলাম। বদুরুজ্জা সাহেব

আমাদের ঘরবাড়ি ক্রয় করেছেন। তাঁর বাড়ির লোকজন যে-যার ভাগমতো ঘরে-ঘরে ঢুকে গেছে – নৌকায় বসে কিছু-কিছু দৃশ্য দেখা যায়। আমার খুবই কান্না পাচ্ছিল, মা-জেঠিমারাও ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। জাফরুলস্না সাহেব বললেন, দেশ তো অদৃশ্য হয়ে যায় না। মন খারাপ লাগলে ঘুরে যাবেন – থাকা-খাওয়ার অসুবিধা হবে না। আপনেরা আমাগো চিরকালের মেমান – তা কি ভোলা যায়! দেশ ভাগ হয়েছে তো কী হয়েছে – দিল তো ভাগ হয় নাই।

 

আমরা তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। বড়দা এবং আমি থাকি সম্মান্দির বাড়িতে। বড়দা আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। দেশ ভেঙে যাচ্ছে – বড়দার মানে উমাশঙ্কর পরীক্ষায় বারবারই ফেল করার অভ্যাস।

আমরা দুজনেই একসঙ্গে টেস্ট পরীক্ষা দিই। তখন রাইনাদির বাড়ি থাকি।

রাইনাদির বাড়ির অস্তিত্বও আর নেই।

বদুরুজ্জা সাহেব তাঁর পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠে গেছেন। বাবা গৃহদেবতা গলায় ঝুলিয়ে হিন্দুস্থানে রওনা হয়ে গেছেন। আমাদের টেস্ট পরীক্ষা হলেই আমরাও চলে যাব। পাকিস্তানে থাকার আর প্রয়োজন নেই। আমাদের ঠাকুর দেবতা মেলা, রাধা গোবিন্দের বড়-বড় দুটো পেতলের মূর্তি, শালগ্রাম শীলা, একটি নৃসিংহ কবচ, আমার দুদু কাকা গলায় ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে

বের হয়ে গেলেন। ঠাকুর দেবতারাও আমাদের সঙ্গে দেশছাড়া হলেন।

এখন আমাদের সম্বল একমাত্র আমার মেজকাকা। তিনি বহরমপুরে থাকেন, একটি প্রাচীন শ্যাওলাধরা বাড়ি আমাদের বসবাসের জন্য ব্যবস্থা করা হলো। বহরমপুর শহরে থাকেন তিনি।

শহরে মাস্টারদা বললেই তাঁকে সবাই চিনত। মেজকাকা খাদি- ভা-ারে খাগড়ার বাজারে একটি সেলাই কল সম্বল করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। জ্ঞান কাকা খাদি-ভা-ারের মালিক। তিনি স্বদেশি, মেজকাকার তিনি আশ্রয়দাতা।

বহরমপুরের নতুন বাজারে তালই বাবুর একটি অতিকায় লজঝড়ে দুতালা বাড়ি। মেজকাকা সেই বাড়ির দোতলায় একটি অংশে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে থাকতেন। নিজের বসবাস থেকে উচ্ছেদ হওয়া যে কত মর্মান্তিক বাড়িটিতে থাকার সময় টের পেয়েছিলাম।

মেজকাকার নির্দেশেই ঘরবাড়ি বিক্রি। খাদি-ভা-ারের এককোনায় একটি সেলাই কল নিয়ে তাঁর দর্জির দোকান।

দোকানটি খোলা, বন্ধ করা, ধূপ-ধুনো দেওয়া, ঘর ঝাঁট দেওয়ার কাজ আমার মেজকাকাই করেন। দোকানে তাকে-তাকে সাজানো থাকে সিল্ক, তসর, মটকার থান। আমার কাকা এককোনায় একটি সেলাই কল সম্বল করে খদ্দেরের আশায় বসে থাকেন।

খদ্দের হচ্ছে লক্ষ্মী। তার মনোরঞ্জন করাও কাজ তাঁর। জ্ঞান কাকা সকালের দিকে একবার আসেন।

লাল মলাটের একটি খাতায় দৈনিক বেচাকেনার হিসাব থাকে। তাছাড়া খদ্দেরদের মাপমতো পাঞ্জাবি, হাফশার্ট, বেস্নজার মাপ নিয়ে খাতায় লেখা হয়।

জ্ঞান কাকা অবসর বুঝে আসেন। খাতাটি উলটেপালটে দেখেন – এই পর্যন্ত, তারপর জ্ঞান কাকা এলে শহরের গণ্যমান্য লোকেরাও ভিড় করেন। জ্ঞান কাকা রাজনীতি করেন। তিনি কংগ্রেসের জেলা সম্পাদক, তাঁকে নানাজনের আবদারও মেটাতে হয়।

জ্ঞান কাকা কংগ্রেসের জেলা সম্পাদক। তাঁর দায়িত্বের শেষ নেই। মিছিল, মিটিং এবং আলোচনা চলে। আমার মেজকাকার নির্দেশেই পেয়ালাভর্তি চা আসে। সকালে তিনি দোকানে বসেই পার্টির কাজকর্মের তদারকি করেন।

মেজকাকার সামনে সেলাইকল।

খাতায় খদ্দেরদের নাম লেখা, ডেলিভারির দিন উল্লেখ করতে হয়।

খাদি-ভা-ারের খ্যাতিও কম নয়।

আসলে খাদির শার্ট-পাঞ্জাবির ওয়েস্ট কোট কার কবে ডেলিভারি সব কিছুই ফর্দমতো দিতে হয়। এজন্য খাদি-ভা-ারের সুনামও আছে – কাজের ভিড় লেগেই থাকে। আমার কাকার ফুরসত থাকে না।

এরপরে আছে বাড়ির বাজার – কাকা থলে হাতে ঢুকলে বাজারও হয়ে যায়। কাকার চেলারা খুব সস্তায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী থলেয় ভরে দেন। দোকান ফেলে কাকাই জ্ঞান কাকার বাজার করে দেন। তিনি একবার উঁকি দিয়ে দেখেনও না, কী বাজার হলো!

হরিহর সব জানে।

হরিহর আমার ছোট কাকা – তাঁর কাজ শেষে তিনি জ্ঞান কাকার টুকিটাকি কাজও করে দেন।

দেশভাগের সঙ্গে-সঙ্গে পূর্ববঙ্গ থেকে লক্ষ-লক্ষ মানুষ রেল কিংবা হাঁটাপথে হিন্দুস্থানে ঢুকতে শুরু করেছে। যে-যেখানে খালি জায়গা পাচ্ছে দলবেঁধে বসে পড়ছে। কারো কিছু বলার নেই। রিফুজি বললেই সাত খুন মাফ।

আমরাও ট্রেনে-বাসে উঠে পড়তাম। টিকিট চাইলে এককথা – রিফুজি।

রিফুজি বললেই কারো কিছু বলার সাহস থাকত না। তবে কাশিমবাজারের আদি রাজবাড়িতে ঢুকতে কেউ সাহস পায়নি। রাজবাড়ির তহশিলদার খাকির হাফপ্যান্ট, হাফশার্ট পরে আমাদের কলোনিতে ঘুরে বেড়াত।

রাজার আমবাগান, সুমিষ্ট আম – তবে জমির অধিকার পাওয়ার জন্য রাজবাড়ির অফিসে কিছুটা অর্থ দিতে হতো। সেই অর্থের বিনিময়ে রাজবাড়ির সিল দেওয়া রসিদ মিলত। জমির অধিকার সেই যে বর্তাল, আর কার ক্ষমতা আছে জমি থেকে রিফুজিদের উৎখাত করে।

আমার জেঠামশাই রাজবাড়ির অফিসে গিয়ে পঁচিশ বিঘা জমির বন্দোবস্ত করেছেন। রাজবাড়ির সিল দেওয়া একটি কাগজে তার উল্লেখ আছে। পঁচিশ বিঘা জমির মালিকানা উপেন্দ্র ব্যানার্জির এবং তাঁর সহোদর ভাইরা ভোগ করবে।

আমার জেঠামশাই সেই জমি ভাইদের নামে বিলি-বণ্টন করার পর আমাদের নিজস্ব বসবাসের জায়গা স্থির হয়। পঁচিশ বিঘার জমিটি বনজঙ্গলে ভর্তি। জঙ্গলের ভেতর বড়-বড় শালগাছের মেলা। জেঠামশাই সব জমিই ভাইদের নামে-নামে ভাগ করে দেন।

প্রায় তিন বিঘা করে জমি ভাইদের নামে-নামে, বাকি জমি গৃহদেবতার নামে –

আমার দুদু কাকা গৃহদেবতার পূজারি। আপাতত তাঁরই অধিকার।

এদেশে আসার পরই জেঠামশাই ভাইদের ডেকে বলেছেন – আমাদের একান্নবর্তী সংসার কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি। যে-যার মতো অন্নসংস্থানের দায় তোমাদের সবার।

পরিবারে বলতে গেলে কোনো উপার্জন নেই। ছোট কাকা কংগ্রেসের জেলা অফিসের দেখাশোনা করতেন – জ্ঞান কাকা বললেন, হরিহর জেলা অফিসের দেখাশোনা করে। তাঁর একটা নির্দিষ্ট মাইনে থাকলে আমাদের পরিবারে সুবিধে হবে।

জেঠামশাই মাথা চুলকে বললেন, দাদা একটা কথা আছে।

কী কথা!

এঁদের সবারই যদি কোনো কাজের ব্যবস্থা হয়।

জ্ঞান কাকার অসীম ক্ষমতা। তিনি ইচ্ছা করলে পারেন।

দ্যাখ হরিহর সবই করা যায়। তবে এই নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

প্রতিক্রিয়া হলেও কিছু করার নেই।

বাবা শুনে বললেন, আমার চলে যাবে। দেশ থেকে যজমানরা চিঠি লিখেছে, তারাও চলে আসতে চায়। সবাই চলে এলে

পুজো-আর্চা করে কিছু আয় হতে পারে।

সংসারে বাবা-মা, ছোট দুটো ভাইবোনও আছে, কলোনিতে আমাদের যজমানরা আছে, তাদের পুজো-আর্চা আছে – কথা আছে প্রতাপ চন্দ্রও চলে আসছে, তাঁর গৃহদেবতার পূজা আছে। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় কে কোথায় যাচ্ছে কিছুই ঠিক নেই, সবাই চ্যাটার্জি-ব্যানার্জি হয়ে আছে, চেনা বামুনের বড় অভাব, এইতো শ্যামবাবুর সঙ্গে দেখা, তিনি বললেন চেনা বামুন ছাড়া কাকে অন্নপূর্ণার সেবাইত করি বলুন তো – এই চেনা বামুনের হিসেব দেখতে গেলে, আমার বাবা, জেঠা-কাকারা একটা বিশ্বাসের জায়গা আগেই ঠিক করে ফেলেছে।

বামুনের কাজের অভাব হয় না – আমাদের কলোনিতে, একঘর বামুন, তাঁর খোঁজখবর সবাই রাখে। এদেশে এসেই দুটো দুর্গাপূজার ভার পেয়ে গেছে সে। দেশ থেকে ফুরফুর করে মানুষজন ঢুকে যাচ্ছে। তাদের কথা, সব তো হলো, মেয়ের বিয়ে ঠিক হচ্ছে – চেনা বামুন না পেলে হয়!

মেজকাকা বলেছেন, আমার দাদারা সবাই তো দেশ থেকে চলে আসছে – চেনা বামুনের অভাব হবে না।

আমার বাবা দেশেও পুজো-আর্চা করতেন। এদেশে এসেই তিনি প্রথমে একটি পঞ্জিকা কিনে ফেললেন। বিবাহের দিনক্ষণ বলে কথা। শুভ-অশুভ বলে কথা। বাবা পঞ্জিকা দেখে সব বলে দিতেন – শুভ-অশুভ দিন তাঁর কথাতেই স্থির হতো। তিনি গীতার সব শেস্নাক মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। তাঁর জীবনচর্চায় একজন খাঁটি বামুনের লক্ষণগুলি স্পষ্ট ছিল।

মাথায় খাটো চুল – শিখাটি সুবৃহৎ, পৈতা ধবধবে সাদা।

তবে মাথায় শিখা রাখতে রাজি হতাম না।

বাবা জোরজার করলে বলতাম, শিখা না রাখলে কিছু হয় না বাবা।

তবু পৈতার সময় আমার জেঠামশাইর নির্দেশ, শিখাটিকে তুচ্ছ করতে নেই। বামুনের শিখা নেই হয় নাকি।

হয়।

গোঁয়ার্তুমি করবে না। শিখা না থাকলে তুমি বামুনের সন্তান কে বিশ্বাস করবে!

সবাই বিশ্বাস করবে।

কী করে সম্ভব।

গলায় পৈতা আছে না।

গলায় পৈতা থাকলেই হলো।

ওটা তো জামার নিচে থাকবে। তোমার গলায় পৈতা আছে বুঝবে কী করে।

ঠিক বুঝবে। আপনাকে আমার পৈতা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

বাবা বললেন, গুরুজনদের কথা শুনতে হয়। গুরুজনের অবাধ্য হতে নেই। অবাধ্য হলে ঈশ্বর কুপিত হন।

পৈতা না থাকলে একসময় তুমি মূক-বধির হয়ে যাবে।

ভয় পেতাম। সত্যি যদি মূক-বধির হয়ে যাই।

আমাদের সেই পূর্ববঙ্গের গ্রামে এমনিতেই বামুন ঠাকুরের অভাব। লক্ষ্মীপূজায় সরস্বতীপূজায় বামুনেরও অভাব। ঘরে-ঘরে পূজা – লক্ষ্মীর সরা ঘরে-ঘরে আসত। একজন বামুন ঠাকুর চাই। আমার শৈশবেই উপনয়নের কাজটি সারা হয়ে যায়। ফলে আমিও বামুন ঠাকুর হয়ে গেছি, ঘরে-ঘরে কোজাগরি লক্ষ্মীপূজা – গাঁয়ে দু-ঘর মাত্র বামুনের পরিবার, আর পাশের গ্রামগুলিও হিন্দুপ্রধান। হিন্দুদের আলাদা গ্রাম, মুসলমানদের আলাদা গ্রাম।

জাতকুল দেখে বাড়িঘর। হিন্দুগ্রামে কোনো মুসলমানের বসবাস ছিল না – পাশের টোডারবাগ গ্রামটিতে মুসলমানরা ঘরবাড়ি করে বসবাস করত। আমাদের গায়ে কোনো মুসলমান পরিবার ছিল না। মুসলমানরা ছিল অচ্ছুত। তবে বিপদে-আপদে মুসলমানরাই ছিল রক্ষাকর্তা।

হিন্দু-মুসলমানের আলাদা অবস্থান, অথচ ঝগড়া-বিবাদে হিন্দু মাতববরদের ওপর ভরসা ছিল মুসলমানদের। মুসলমানদের ওপরও যথেষ্ট ভরসা রাখত হিন্দুরা।

অথচ আমাদের বাড়িতে, শুধু আমাদের বাড়ি কেন, যে-কোনো সম্পন্ন হিন্দু পরিবারের বিশ্বস্ত কাজের মানুষ ছিলেন এঁরাই।

বাড়ির বউ বাপের বাড়ি যাবে – সঙ্গে যাবে কে।

সঙ্গে যাবে রহমান। সে ধনবউকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

আমার মনে আছে, মামারবাড়ি যাওয়ার সময় মা রনাদাকে ডেকে পাঠাতেন। রনাদা যে পারিশ্রমিক পাবেন জানতেন।

পোটলা-পুঁটলি তিনি মাথায় তুলে নিতেন। আমি-বড়দা তুলে দিতাম। তারপর বাড়ি থেকে নেমে মাঠে পড়তাম। বড়দিনের ছুটিতে মা আমাদের নিয়ে বাপের বাড়ি যাবেন, কিংবা অষ্টমী স্নানে যাবেন, সঙ্গে পাহারাদার আমাদের রনাদা। এত বিশ্বাসী তিনি, টাকা-পয়সাও তার কাছে থাকত। রনা-ধনা দুই ভাই আমাদের বাড়ির দক্ষিণের ঘরে থাকতেন। ঘরের তক্তপোশে থাকতেন আমাদের মাস্টারমশাই, মেঝেতে মাদুর পেতে শুতেন রনাদা।

বাড়ির চার ভিটিতে চারটি চৌচালা ঘর। দক্ষিণের ঘরের সংলগ্ন ঠাকুরঘর।

দক্ষিণের ঘরটি বৈঠকখানা হিসেবে রাখা হয়েছে। পুবের ঘরটিতে থাকেন বড় জেঠিমা। আমার জেঠামশাই নিখোঁজ। এতে বাড়িতে কোনো ত্রাস নেই। জেঠামশাইর স্বভাবই এরকমের। দু-একদিন তার কোনো খোঁজ থাকে না।

তাঁর মাথা খারাপ আছে।

আগে আমরা নানা জায়গায় খোঁজ করতাম, আমার ঠাকুরভাই, অর্থাৎ আমাদের বড়দা খুঁজতে বের হতো, দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার পাতা থাকত।

ইজিচেয়ারটি জেঠামশাইয়ের নিজস্ব – বাড়িতে থাকলে জেঠামশাই ইজিচেয়ারটিতেই লম্বা হয়ে শুয়ে থাকেন। এক-দুদিন ঠিকঠাকই চলে তাঁর। বাড়িতে জেঠামশাই থাকলে তাঁকে দেখাশোনার ভার আমাদের ওপরেই থাকত। তিনি মানসিকভাবে কিছুটা বিপন্ন। তাঁর চিকিৎসারও শেষ ছিল না। সাধু-সন্ন্যাসী এলে রাতের আশ্রয় আমাদের দক্ষিণঘর।

আমাদের স্যারও দক্ষিণের ঘরে থাকেন। আমাদের পড়াশোনাও সে-ঘরেই হয়।

একটা বড় টেবিল, টেবিলের চারপাশে চেয়ার, সকালে আমরা

পাঁচ ভাই, খুড়তুতো, জেঠতুতো ভাই মিলে আমরা পাঁচজন, সকালে এবং রাতে পড়াশোনা হয় এই ঘরে।

জেঠামশাই বাড়ি থাকলে বারান্দায় একটি ইজিচেয়ার পাতা থাকে।  জেঠামশাইর দখলে এই ইজিচেয়ারটি। তিনি বাড়ি থাকলে ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকেন। ঘরের ভেতরে জেঠতুতো-খুড়তুতো ভাই মিলে পড়াশোনায় মগ্ন থাকি। সকালে তাঁর অধীনেই থাকতে হয়। রাতেও। রাত দশটার পর আমাদের ছুটি।

এ-বছর আমার এক পিসতুতো দাদাও হাজির। আমাদের বাড়িতেই তার পড়াশোনার ব্যবস্থা হয়েছে। কলাগাছিয়া স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে।

কলাগাছিয়া মাইনর স্কুলের পড়া শেষ হলেই আমরা বাড়িছাড়া হতাম। বড়দা উমাশঙ্কর এবং আমি সম্মান্দির বাড়িতে চলে গেছিলাম। আমার চিনি কাকিমা তাঁর ছেলেমেয়েদের কলকাতায় ফের নিয়ে গেছেন। হাতিবাগানে বোম পড়ায় কলকাতা শহর খালি হয়ে যাচ্ছিল। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। বোমা পড়ার আতঙ্ক আর নেই। তবে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ায় আবার যে-যার জায়গায় – চিনি কাকিমাও কলকাতায় ফিরে গেলেন। সঙ্গে রেখা, কালী, দুলাল, শুধু ধনঠাকুরমা বাড়িতে থাকলেন। আমি ঠাকুরভাই আছি – আমরা পানাম স্কুলের ছাত্র। সম্মান্দির বাড়ি থেকে রাইনাদির বাড়ির দূরত্ব চার ক্রোশের মতো। ধনঠাকুরমা আমাদের নিয়ে সম্মান্দির বাড়িতে থেকে গেলেন। টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে আমিও চলে যাব।

আমার সহোদর দাদা চন্দ্রশেখর চলে গেল মামারবাড়ি মনোহরদি। দুপতারা হাইস্কুলে তাকে ভর্তি করে ছিলেন আমার দাদু। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ছারখার হয়ে গেল। আমি আর বড়দা আছি সম্মান্দির বাড়িতে, আমার দাদা চন্দ্রশেখর আছেন আমার মামারবাড়ি মনোহরদি গ্রামে। দক্ষিণের ঘর খালি – শিক্ষক অনিল পাকরাশি – যার শাসনে আমরা বড় হচ্ছিলাম, তিনিও এক সকালে বিদায় নিলেন।

দেশে কী যে হচ্ছে!

এমন এক সুন্দর দেশ, যার অর্জুনগাছের ছায়ায় আমার ঠাকুরদার দাহপর্ব সারা হয়েছে। চারপাশের মুসলমান গ্রাম থেকে লোকের ভিড়। লাদুরচর থেকে ঝেঁটিয়ে সব মানুষজন দাহ পর্বে যোগদান করেছিল – মুসলমান গ্রাম থেকেও লোক ভেঙে পড়েছিল, কারণ দাহ প্রক্রিয়া দেখার কৌতূহল সবার – একজন মানুষকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া সহজ কথা নয়।

ঠাকুরমার নির্দেশ, তাঁর মৃত্যুর পর অর্জুনগাছের নিচেই যেন দাহকার্য করা হয় – আমাদের বাড়ির যেকোনো মৃত্যুর দাহকার্য সম্পাদনে এই অর্জুনগাছটি নির্দিষ্ট ছিল – এলাকায় দু-ঘর ব্রাহ্মণের বাস। বাকি গ্রামগুলি হিন্দুপ্রধান। তাদের দাহকার্য হতো দন্দের ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে। শুধু আমাদের নিজস্ব শ্মশান পুকুরপাড়ের অর্জুনগাছটার নিচে – আমার ঠাকুরদা-ঠাকুরমার চিতাও অর্জুনগাছটার নিচে।

আমাদের বাড়িটা লোকজনে ভর্তি। আত্মীয়স্বজনে সবসময় ভর্তি থাকত। বালি থেকে মেজপিসি এসে থেকে গেলেন মাসের পর মাস। আমার পিসেমশাই বেকার। চরসিন্দুর চিনির কলে তিনি চাকরি করতেন। কথায়-কথায় দু-মাস, ন-মাসের জন্য বিনা নোটিশে চিনির কলটি বন্ধ হয়ে যেত। আমার পিসিমা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সোজা আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন।

উত্তরের বড় ঘরে থাকতেন ঠাকুরমা – ঠাকুরমার ঘরে সবাই আশ্রয় নিত। সুবৃহৎ এই চৌচালা ঘরটির খোপে-খোপে আমার পিসিরা বিনা নোটিশে এসে উঠতেন। ঠাকুরদা বেঁচে নেই – ঠাকুরমার ঘরে প্রয়োজনে আমরাও শুতাম। দক্ষিণের ঘরে পড়াশোনা – দক্ষিণের ঘরে স্যার থাকেন – তাঁর নিজস্ব একটি তক্তপোশ আছে, শতরঞ্চি পাতা আছে। বিছানার এক প্রান্তে সারি-সারি বই। আমাদের স্যার আইএ পাস – তাঁর ইচ্ছে তিনি প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষা দেবেন – দিলেনও, পাশ করেও গেলেন। স্কুলের হেডমাস্টারও হয়ে গেলেন।

আমরা স্কুলে যেতাম আমাদের স্যারের সঙ্গে। স্যারের দায়িত্ব আমাদের সামলানো। যেমন তিনি সকালে ঘরে-ঘরে দরজায় নাড়া দিয়ে আমাদের সতর্ক করে দিতেন –

তিনি বলতেন, ওঠ এবার। বেলা কিন্তু কম হয়নি।

আমার মা জেঠি কাকিমারা এতে খুব একটা খুশি ছিলেন না – প্রাণভরে যে একটু ঘুমোবেন তারও উপায় ছিল না। আমার কাকিমা জেঠিমারা খুবই বিরক্ত হতেন। কিন্তু স্যারের মুখের ওপর কারো কথা বলার সাহস নেই। বাবা-কাকা-জেঠারা প্রবাসে। আমরা এতগুলি ভাইবোন। আমরা মেলা ভাইবোন –

আমাদের বোনেরা পড়াশোনার তাড়া থেকে ছাড় পেত। তারা পছন্দমতো বই নিয়ে পড়তে বসত। পড়তেই বসত না কেউ-কেউ। এত সকালে আমাদের ঘুম ভাঙে না।

রাতে দশটার আগে ছুটি পাই না।

ঠিক দশটায় রান্নাঘরে পিঁড়ি পড়ত।

পিঁড়ি পড়ার শব্দ শোনা যেত দক্ষিণের ঘর থেকে।

এই শব্দ শোনার প্রতীক্ষায় আমরা কান খাড়া করে রাখতাম।

অথবা, স্যার বাইরে যাব।

বাইরে যাব বললেই তিনি ছেড়ে দিতেন।

ছেড়ে না দিয়েও উপায় নেই।

কারণ কার ছোট বাইরের, কার বড় বাইরের দরকার, প্রকৃতির ডাককে উপেক্ষা করা যায় না। তিনি বিনা দ্বিধায় বলতেন, যাও।

আমরাও এই ছুতোয় বের হয়ে দেখতাম রান্নাঘরে পাত পড়ার আয়োজন হয়েছে কিনা।

এক নম্বর শান্তি।

ছোট বাইরের তাগিদ শান্তিরই বেশি। তবে একবার, বেশি হলে দুবার বাইরে যাওয়ার অনুমতি মিলত।

রাত দশটা পর্যন্ত স্যার আমাদের পড়ায় বসিয়ে রাখতেন।

একান্নবর্তী পরিবারে আমাদের জেঠিমা, মা, কাকিমারা পালা করে নিরামিষ-আমিষের ঘর সামলাতেন।

তবে আমার বড় জেঠামশাই – দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির দক্ষিণের ঘরে ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকতেন।

পড়ার ঘরে ইজিচেয়ারেও তিনি শুয়ে থাকতেন।

আমার বড় জেঠামশাই মর্জি হলে সকালে খেতেন, মর্জি না হলে সকালেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেন।

আমার জেঠিমা চেঁচামেচি শুরু করতেন।

ওরে অচল, দ্যাখ তোর জেঠামশাই কোথায় যাচ্ছে।

আমার সোনাভাই, অর্থাৎ আমাদের মেজদাই জেঠামশাইকে রুখে দিতে পারত।

কোথায় যাবেন!

জেঠামশাই কোনো জবাব দিতেন না।

জেঠামশাই নিজের মতো হাঁটা দিতেন।

আমার বড়দা উমাশঙ্কর বইটই ফেলে দৌড়ে আসত।

জেঠামশাইকে আগলে বলত, আপনি আমাদের পড়তেও দেবেন না। আমরা পাশ করব কী করে!

জেঠামশাইয়ের কেমন তখন বোধোদয় হতো।

তিনি ভালো মানুষ হয়ে যেতেন।

সুবোধ বালকের মতো ঠাকুরভাইয়ের হাত ধরে দক্ষিণের ঘরের দিকে হাঁটা দিতেন।

তাঁকে একটা টুলে বসিয়ে দিয়ে সামনে একটা বই খুলে দিলেই তিনি শান্ত।

যেন কত মনোযোগী ছাত্র।

মুশকিল ছিল সেই বইটি আর তার কাছ থেকে ফেরত নেওয়া যেত না।

আমরা এজন্য একটি অপ্রয়োজনীয় অথবা গল্পের বই হাতের কাছে রেডি রাখতাম।

স্কুল খোলা থাকলে আমরা গৃহশিক্ষকের আওতায় চলে যেতাম।

তাঁর কথাই শেষ কথা।

স্কুল শনিবারে হাফ, রবিবার বন্ধ –

মাস্টারমশাই শনিবারে সকালেই সব গোছগাছ করে রাখতেন। স্কুল থেকে ফিরেই তিনি তাঁর পোটলা-পুঁটলি – পোটলা-পুঁটলি বলতে একটি কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, তাতে একটি গামছা, একখানা ধুতি, দু-একটি বই, অথবা সাপ্তাহিক পরীক্ষার কখনো মাসিক পরীক্ষার খাতার বান্ডিল এসব নিয়ে দেশে যেতেন। আর সোমবার সকালে সোজা স্কুলে। টিফিনে খাবার দোকান থেকে জিলিপি আর একঠোঙা মুড়ি এনে খেতেন।

স্কুল ছুটি হলে আমাদের সঙ্গেই ফিরতেন। দেশ থেকে বাড়ির ফলপাকুড় যা-ই কিছু মিলত, যেমন লটকন ফল – টক মিষ্টি এবং সুস্বাদু, আমাদের খুব প্রিয় – তিনি আনতেন।

এদিকটায় আমাদের বাড়িতে কামরাঙা ফলের গাছ থাকলেও লটকন ফলের গাছ ছিল না। লটকন ফলের এক-একটি কোয়া মুখে ফেলে দিলে সারা মুখ রসে ভরে যেত।

টক-মিষ্টি-ঝাল এই ফলের স্বাদ না খেলে বোঝা যায় না।

কখনো-কখনো বিশাল বাতাবিলেবু, এতটা দূর থেকে, চার-পাঁচ ক্রোশের কম নয় রাস্তাটি, তাঁর ছাত্রদেরও নিজ গৃহের এবং তাঁর নিজ হাতে লাগানো গাছের সুস্বাদু ফল খাওয়াতে না পারলে তিনি তৃপ্তি পেতেন না।

কিরে কেমন মিষ্টি।

উলস্নাস, পড়ার চেয়ে খাদ্যরসিকের পর্বটি আমাদের কাছে খুবই মধুর ছিল। পড়া না পারলে, অঙ্ক ঠিক না হলে, বেত্রাঘাতেরও শেষ থাকে না। তিনিই আবার বাড়ির ফলপাকুড় তাঁর ছাত্রদের না খাওয়াতে পারলে মনোকষ্টে ভুগতেন।

– দহিপুরি নিয়ে এলেন একবার।

খাদ্যবস্ত্তটি আমাদের বাড়িতে একদম অচেনা –

অথচ গৃহশিক্ষক নিয়ে এসেছেন, তাঁর মান-মর্যাদা রক্ষা করতে হয় – দুধের পায়েশ, তাতে পুলি পিঠা সেদ্ধ দিয়ে খাদ্যবস্ত্তটি তৈরি।

দেশ থেকে ফিরে স্যার আমাদের হাতে দিয়ে বলতেন – যা নিয়ে যা, ঠাইনদির হাতে দিবি।

আমার ঠাকুরমা যত্ন করে তাঁর নিরামিষ ঘরে রেখে দিতেন। আমাদের রাক্ষুসে স্বভাব – কখন বেমালুম হজম করে ফেলব ঠাকুমরার এই আতংক – নিরামিষ ঘরে দরজা বন্ধ করে একটি তালাও ঝুলিয়ে দিতেন।

নিরামিষ ঘরটি একেবারে আলাদা – আমরাও খুশিমতো নিরামিষ ঘরে ঢুকতে পারতাম না। ঠাকুরমার ছিল একটাই

অভিযোগ – সারা রাজ্যের গু-মুত মাড়িয়ে নিরামিষ ঘরে ঢোকা যায় না।

ঠাকুরমার কথা না শুনলে বউমাদের শাসাতেন, আসুক উপেন, সে এর কী বিহিত করে দেখি – আমার কাকিমারা এবং আমার জেঠিমার এক কথা, মা এরা ছেলেমানুষ, এদের ওপর রাগ করে আপনি খাবেন না, তা হয়?  তারপরই আমাদের ডাক পড়ত, জেঠামশাই বাড়ি এলেই বিধান জারি করতেন।

আমরা ভীতসন্তস্ত্র হয়ে থাকতাম। আমাদের মাস্টারমশাইকেও হাজির থাকতে হতো।

জেঠামশাই বলতেন, মাস্টার তোমার ছাত্ররা একদম কথা শুনছে না –

নিরামিষ ঘরে বাসি কাপড়ে ঢোকা নিষেধ। তোমার ছাত্ররা আমার মাকে নরকে পাঠাতে চায় – মার এমনই অভিযোগ। ভালোমন্দ খাবার যেমন পুলি পিঠা কিংবা পাটিসাপটার পায়েশ কিংবা আসটে পিঠার দুধেসেদ্ধ পায়েশও বাটিসুদ্ধ গায়েব হয়ে যাচ্ছে। কে খায়, কারা খায় দেখবে না!

 

বইটি হাতে ধরিয়ে দিলেই তিনি খুশি।

তাঁর আর কোথাও যাওয়ার কথা মনে থাকত না।

তিনি আমাদের খাতা-কলম নিয়ে টেবিলে বসে পড়তেন।

স্যার আমাদের তক্তপোশে বসে বলতেন, কী হলো তোরা পড়ছিস না কেন!

আর তখনই আমরা উচ্চৈঃস্বরে পড়তে শুরু করতাম।

আমরা উচ্চৈঃস্বরে না পড়লে আমার মা-জেঠিরা মনে করতেন, আমরা পড়ছি না।

খুব বেশি উচ্চৈঃস্বরে পড়লে আমাদের মা-জেঠিরা ভাবতেন, তাদের ছেলেরা ঠিকঠাক পড়াশোনা করছে। তাদের ছেলেরা খুব মনোযোগী ছাত্র।

আমরা পাঁচ ভাই একসঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে পড়লে মাস্টারমশাইয়ের কান ঝালাপালা হয়ে যেত।

তিনি ম্রিয়মাণ গলায় বলতেন, আর একটু আসেত্ম পড়লে হয় না! এটা তো হাটবাজার নয়।

স্যার একদিন সোজাসুজি জেঠিমাকে বললেন, বউঠান জোরে-জোরে পড়লেই পড়া হয় না।

জেঠিমা বললেন, তা হলে কীভাবে পড়াশোনা হয়!

আসেত্ম পড়লেও পড়াশোনা হয়।

আসেত্ম পড়লে পড়া মনে থাকে না।

আমার দুদুকাকার এক কথা – তোমাদের পুত্ররা পড়ছে কি না মাস্টারই ভালো বুঝবে। তোমাদের খবরদারি করতে হবে না।

দুদুকাকা সোজা বলে দিলেন, সবাই খবরদারি করলে চলে! যার যা কাজ। মাস্টার বুঝবে তারা পড়ছে কি পড়ছে না। পরীক্ষা তোমরা দেবে না – ছেলেরা দেবে। মনে-মনে পড়লেও পাশ করা যায় সেটা কি বোঝ!

জেঠিমা রেগে বলতেন, আমরা কিছুই বুঝি না। সব বোঝো তোমরা।

বাড়িটায় মেলা ঘর। ছোটকাকা, মেজকাকা বহরমপুরে থাকেন। ছোটকাকার বিয়ে হয়নি। আমার ঠাকুরমার এটি একটি বড় দায়। তিনি বেঁচে আছেন। ছোটকাকার কোনো গতি হয়নি বলে ছোটকে বিয়ে দিতে পারলেই তিনি দায়মুক্ত।

আমার ঠাকুরমার পুত্রসন্তান, অর্থাৎ আমার কাকা-জেঠা মিলে তারা ছয় ভাই, দুই পিসি আমাদের। বড় পিসির বিয়ে হয়েছে বনদুর্গাপুরে।

জঙ্গলের দেশ।

জঙ্গলে বাঘ-ভালুকও দেখা যায়। আমার পিসতুতো দাদা সুধীর বলতেন, রাতেই বেশি ভয়।

সুধীরকে আমরা চিনিদাদা ডাকতাম। সুধীর মানে আমার চিনিদা সেই দুর্গম এলাকা থেকে উঠে এসেছে। পূবাইল ইস্টিশনে নেমে পাঁচ ক্রোশ হাঁটলে গ্রামটির খোঁজ পাওয়া যায়। আমাদের গ্রামে কোনো বাঘ-ভালুকের উপদ্রব ছিল না। তবে বর্ষাকালে অজগর সাপের উৎপাত হতো।

শীতের সময় কচুরিপানায় পুকুরগুলি ভরে থাকত। তার ভিতর অজগর সাপের বসবাসের সুবন্দোবস্ত ছিল। কবিরাজ দাদা অমূল্য সেনের একটি বন্দুক ছিল।

আমাদের অসুখে-বিসুখে কবিরাজ দাদাই সম্বল। কবিরাজ দাদার গলায় কণ্ঠি ছিল। তুলসির মালা গলায় জড়িয়ে রাখতেন। পরিবারটি পরম বৈষ্ণব।

আমাকে আর ঠাকুরভাইকে ছোট দাদু সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।

তাঁর পুত্র রাসমোহন রেলে বড় চাকরি করেন। তিনি লোকো ফোরম্যান – তাঁকে সোজা চিঠি – পত্রপাঠ যেন আমার রাঙ্গাকাকা আরো একশ টাকা বেশি মনি-

অর্ডারে পাঠায়। কারণ রাইনাদির বাড়ি থেকে উমা আর ভোলাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, পানাম হাইস্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছেন। আমার বাবা-জেঠাদের অভিভাবক তিনি। তাঁর কথার ওপর কথা নাই। আমার রাঙ্গাকাকা পিতার আদেশ শিরোধার্য করে প্রতিমাসে আরো একশ টাকা বেশি পাঠাতে শুরু করেন।

বাড়িঘর থাকলেও জমিজমা বেশি ছিল না। রনাদা, ধনাদা পুবের ঘরেই থাকতেন। তক্তপোশে আমি আর ঠাকুরভাই শুতাম। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ায় দুলাল, রেখা এবং চিনিকাকিমা কলকাতায় কাকার কাছে রওনা হয়ে গেলেন।

বাড়িটা আরো খালি হয়ে গেল।

সম্মান্দির বাড়িতে তখন ধনঠাকুরমা থাকেন। আমি আর ঠাকুরভাই থাকি। সন্ধ্যা পিসি থাকে।

আমার উপনয়ন হয় ন-বছর বয়সে। দু-বেলা সন্ধ্যা আহ্নিকের সঙ্গে প্রয়োজনে, গৃহদেবতার পূজার দায়ও আমার থাকে। ঠাকুরভাই অর্থাৎ উমাশঙ্কর কোনো কারণে রাইনাদির বাড়ি গেলে, গৃহদেবতার পূজার ভার পড়ত আমার ওপরে। আমার বাবা, অথবা সোনা-জেঠামশাই কেউ না কেউ বাড়িতে এসে হাজির হতো।

ঠাকুরের নিত্যপূজা আছে।

তার সন্ধ্যারতি আছে। পেনা কাকার ওপরে পূজার ভার বর্তাল। কিন্তু বেশিদিন এই ভার বহন করতে হয়নি তাঁকে। আমার রাঙ্গাকাকার চিঠি এসে হাজির।

চিঠিটি লেখা হয়েছে সোনা জেঠামশাইকে –

পূজনীয়েষু, সোনাভাই আপনি শতকোটি প্রণাম নেবেন। রেলে পেনার জন্য একটি চাকরি ঠিক করেছি।

তাকে পত্রপাঠ লামডিং চলে আসতে বলেছি – রেলে লোক নিয়োগ হচ্ছে, এই সুযোগ, সবই আপনার অনুমতিসাপেক্ষি।

এক দুপুরে মুড়াপাড়া থেকে আমার সোনা জেঠামশাই এসে হাজির। রাত থাকতেই বোধহয় মুড়াপাড়া থেকে তিনি রওনা হয়েছিলেন – পেনা চাকরি নিয়ে চলে গেলে বাড়ির গৃহদেবতার কী উপায়! তার পূজা-আর্চা কে করে! ঠাকুরভাই উমাশঙ্কর ক্লাস এইটে পড়ে, আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, আর আছে গঙ্গাদা, একমাত্র রনাদা-ধনাদাকে এ-বাড়িতে নিয়ে আসা যেতে পারে। তাদের কোনো একজন থাকলেও হয়।

অবশ্য আমার ধনঠাকুরমার কাছে এটা কোনো সমস্যাই নয়। উমা-ভোলা আছে – ওদের উপনয়ন হয়ে গেছে। ওরা ঠিক পারবে।

প্রথম দিকে আমার খুব অসুবিধা হতো। মন্ত্রপাঠ ঠিকঠাক হতো না, গণেশের পূজা দিয়ে মন্ত্রপাঠ শুরু হতো। ঠাকুরের সিংহাসনে পূজা পাঠের একটি বই থাকত।

ঠাকুরঘর আমার ঠাকুরভাই সামলাতেন – তবে মাঝে-মাঝে আমাকেও ঠেকা কাজ চালিয়ে দিতে হতো, আমার সোনা জেঠামশাই বলে গেছেন, সর্বাগ্রে গণেশের পূজা দেবে, তারপর পঞ্চদেবতার পূজা শেষ করে পূজা-পাঠের কাজ শেষ করবে।

কোথাও ঠেকে গেলে দশবার গায়িত্রী জপ করলেই পূজার ত্রুটি খ-ন হয়ে যাবে।

আমি সবই পারতাম। ফুল, বেলপাতা ঠিকঠাক দেবতাদের মন্ত্রপাঠ শেষে দিতেও পারতাম, যেখানে অসুবিধা হতো ঠাকুরের সিংহাসন থেকে পূজাবিধি বইটির সাহায্য নিতাম।

সাধারণভাবে ঠাকুরপূজা আমার বড়দা অর্থাৎ উমাশঙ্করই করতেন। পেনাকাকা যদ্দিন ছিলেন তিনি করতেন, পেনাকাকার রেলে চাকরি হয়ে যাওয়ায় এবং পা-ু নামে কোনো এক সুদূর অঞ্চলে চলে যাওয়ায় আমার বড়দার ওপর গৃহদেবতার পূজার ভার বর্তাল।

ঠাকুরভাইয়ের জ্বরজ্বালা হলে আমার ওপর গৃহদেবতার পূজার ভার পড়ত।

আমার বাবা পূজাপাঠের কিছু শর্টকাট বিধির ব্যবস্থা করে দেওয়ায় আমার পক্ষেও গৃহদেবতার পূজার কোনো আর অসুবিধা থাকল না।

যদি মনে হয় মন্ত্রপাঠে কোথাও গোলমাল হয়ে গেছে, দশবার গায়িত্রী মন্ত্র জপ করে তার সংশোধন হতে পারে।

এভাবে আমি এবং বড়দা ঠাকুর পূজা থেকে গরুর গোয়াল সামলাতাম। গঙ্গাদা জমিজমার তদারকি করতেন। গরু সনাতনিকে জাবনা দেওয়া থেকে গোয়ালের সব কাজ করার দায়িত্ব তাঁর। আমার ধনঠাকুরমা নিরামিষ ঘর সামলাতেন – সন্ধ্যাপিসির বিয়ে হয়ে গেলে আমরা দু-ভাই আমি এবং উমাশঙ্করের জলে পড়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই। রাইনাদির বাড়ি চলে যেতে পারি, সেখানে মা, জেঠিমা-কাকিমারা আছেন, তবে সেখান থেকে হাইস্কুলের দূরত্ব তিন ক্রোশের মতো। পড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

আমাদের বাড়িতে ঠাকুর-দেবতার উপদ্রব এমনিতেই একটু বেশিমাত্রায়। নিত্যপূজার সঙ্গে ষষ্ঠী সংক্রান্তি, কার্তিক পূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা এসব তো আছেই, তার ওপর দোল উপলক্ষে ছোটখাটো একটি মচ্ছবের আয়োজন থাকত।

আমাদের বাড়িটা তো যে সে বাড়ি নয়, ঠাকুরবাড়ি বললে এক ডাকে সবাই বুঝত কোন বাড়ির কথা বলা হচ্ছে।

তুমি কেডারে বাবা।

আমি ঠাকুরবাড়ির ছেলে।

ঠাকুরবাড়ির ছেলে বললেই সব দোষ খ-ন।

স্কুলের পথে আস্তানা সাবের দরগা। দরগার চারপাশ বনজঙ্গলে ভর্তি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ঠাকুরঘরে মাথা ঠুকতে হয়। দরগার কাছে এলে সেখানেও মাথা ঠুকতে হয়। দরগার মাজারে পরীক্ষার আগে মোমবাতিও জ্বেলে দিই। পরীক্ষায় ফেল-পাশ সবই এসব দেবতার হাতে।

তাঁদের কৃপা হলে পাশ।

কৃপা না হলে ফেল।

এসব কারণেই মাথা ঠুকে না গেলে ফেল-পাশের খচখচানি থাকত।

কোনো কারণে আস্তানা সাবের দরগায় মাথা না ঠুকে যাওয়া যায় না। মাথা না ঠুকে গেলে পরীক্ষা খারাপ হতে পারে।

আমাদের ফেল-পাশের জন্য ঠাকুর দেবতার যেমন প্রয়োজন, তেমনি আস্তানা সাবের দরগায়ও মোমবাতি জ্বেলে দিতাম। পরীক্ষায় ফেল-পাশের এই গ্যারান্টি বাবা-কাকারাই স্থির করে দিয়েছেন। বাজার-সওদায় এক প্যাকেট মোমবাতির তালিকা থাকত।

আমাদের গাঁয়ে বিয়ে অন্নপ্রাশনে আস্তানা সাবের মাজারে সবাই সারি-সারি মোমবাতি জ্বেলে দিত সন্ধ্যায়।