বিচ্ছিন্নতাবোধ ও একাকিত্বের বয়ান

শফিক আনোয়ারBichinnotabodh

শিল্পকর্মে সৃজিত আকার-আকৃতি আর রঙের স্ফুরণ মানেই আনন্দ নয়। কখনো কখনো বেদনার দগদগে ঘা তুলে ধরেন শিল্পীরা ক্যানভাসে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এ রহমান অনেকটাই একা পথ চলেন। শিল্প-সৃষ্টি আর শহর দেখা এ নিয়েই তাঁর দিনাতিপাত। এ-প্রদর্শনীর ৬২টি কাজে নানা মেজাজ লক্ষ করা যায়। তবে বর্ণলেপনের মাঝে একপ্রকার বিষয়ানুভবতার খোঁজ মেলে। মূলত রহমান ছাপচিত্রশিল্পী। ঢাকায় চিত্রকলা বিষয়ে অধ্যয়নকালে ছাপচিত্রের নানান নিরীক্ষা শিল্পীমহলে তাঁকে স্থান দিয়েছে। নববইয়ের দশকের শেষার্ধে এ রহমান ইতালির রোম শহরে পাড়ি জমান। শিল্পীজীবনের শুরুতে প্রকৃতি থেকে নানা ফর্ম নির্বাচন করতে শুরু করেন। আসলে শিল্পজ্ঞান অন্বেষণের জন্যে পাঠ নিতে হয় প্রকৃতি থেকেই। প্রকাশবাদী ধারার শিল্পী ভ্যান গঘের সঙ্গে জোট বাঁধা পল সেজান যে প্রকৃতি থেকে নিজের জীবনযন্ত্রণার রং খুঁজে নিয়েছেন, রহমানও হয়তো প্রকৃতি থেকে ছবির বিষয় খুঁজে নেন।

এক বিচ্ছিন্নতাবোধে ছবিতে দাগ কাটেন রহমান। ক্যানভাসে, দস্তায়, তামার পাতে অন্ধকার ও ছায়া অাঁকেন। চলমান প্রকৃতির ছায়া। ধূসর ও মেটে হলুদরঙা জমিনে ছুটে চলা ছায়া। এ চলমান ছায়া দেখে বোঝা যায় প্রাণিকুলের আকৃতি। মনোজগৎ আর বাস্তবে দেখা বিষয়ের সম্মিলনে তৈরি হয়েছে রহমানের ছবির ভান্ডার। মানুষের অস্তিত্বে থাকা সটান বিপর্যয়ের সময় মানুষ সামনে ছোটে। ভাসমান দেহের সঙ্গে মিলে যায় প্রকৃতির আকৃতি। রহমানের ছবি সচল মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা প্রকৃতির বয়ান। দাউ দাউ আগুনে পুড়ে শেষে যে-অবশিষ্ট থাকে, সে-রং কখনো খুঁজে পাওয়া যায় ক্যানভাসে। নন্দননির্ভর আনন্দ উদযাপন হয়তো এসব ছবিতে একেবারেই নেই। কিছু চলমান উদ্বিগ্ন অবস্থাকে নির্দেশ করে যায় অন্যসব ছবিতে। রহমানের শিল্পযাত্রায় সঙ্গী হয়ে আছে স্মৃতি, সময়, নগর, সভ্যতা, বাস্তবতা আর ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতাবোধ। ছবির বিষয় হিসেবে এগুলো হয়তো দর্শককে আনন্দ দেয় না, কিছু বার্তা পৌঁছে দেয়। ক্যানভাসের ছবির দিকে তাকালে আমরা একটি সিদ্ধান্তে  পৌঁছে যেতে পারি। কিছু ক্যানভাসের মুখোমুখি মেঝেতে রহমান প্রতিবিম্ব দেখার জন্য আয়না রেখেছেন। ছবির বিম্বিত প্রকাশের সঙ্গে দর্শক নিজেও শিল্পকর্মের অংশ হয়ে যান। এরকম শিল্প-নির্মাণে শিল্পীর চিন্তায় অভিনবত্ব প্রকাশ পেয়েছে। মিশর ও মোসাপটেমিয়ান সভ্যতায় স্মৃতিকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে রেখে যায় চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য দিয়ে, ইতালির রোম থেকে ঘুরে আসা রহমানের কাজে সে-স্মৃতি নিদর্শনের কোনো ইঙ্গিত নেই। শুধু সময়কে ধারণ করে এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার শিল্পীদের কাজের মতো আবেগপ্রধান হয়ে দেখা দেয়। ‘গ্র্যাভিটি আনলার্নড’ ১, ২’ শিরোনামের ক্যানভাসের ডিজিটাল প্রিন্টে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কালো, বৃত্তের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আলোকচিত্রে মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। একটি আকৃতির সঙ্গে আরেকটি আকৃতি যুক্ত হয়েছে দ্রুতলয়ে। মোট কথা, এ দুটি ছবির মধ্যে বিষয় বর্ণনার সঙ্গে চলমান সময়ের গতি যুক্ত হয়েছে। ‘সাইকোডেলিক নয়েজ নোটস’ শিরোনামের কাজে রং আলাদা হয়ে বর্ণিত হয়ে মনোজগতের ভঙ্গুর অবস্থা জানান দিচ্ছে। কখনো ছবিগুলোতে রং আর অন্তর্গত ক্ষতের সমাবেশ দেখা যায়। ‘রিফ্লেকশন’ বা ‘প্রতিফলন’  সিরিজের কাজে একই রকম বর্ণের প্রতিফলন দেখা যায়। ‘অন আনডিফাইন্ড প্লাটেয়ু’ শিরোনামের কাজে ধাবমান আকৃতির প্রয়োগে ক্যানভাসের সঙ্গে দর্শকের যোগাযোগ তৈরি হয় সহজে। ৬২টি কাজের মধ্যে প্রিন্ট, মিশ্র মাধ্যম, ডিজিটাল প্রিন্ট, ইন্টাগলিও প্রিন্টের কাজে বিষয় বর্ণনায় ভিন্নতা রয়েছে। অনেক কাজের করণপদ্ধতির সঙ্গে দর্শক যোগাযোগ তৈরি করতে পারেননি। গ্যালারির পরিসরের তুলনায় ছবির সংখ্যা বেশি হওয়ায় দর্শক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন খানিক বিলম্বে। ইউরোপীয় দেশ ঘুরে আসা একজন অাঁকিয়ের কাছে বাংলাদেশের দর্শক হয়তো স্থিতি আশা করেন। এ রহমানের ছায়াহীন, দেহহীন চলমান আত্মার সঙ্গে যুক্ত হওয়া রং-রেখার গতি যেন আমাদের শিল্পে নতুন স্পন্দন দেয়। শূন্যতা থেকে শূন্যতার অতলে যাওয়া স্পন্দন খুঁজে দিতে এ রহমানের শিল্পযাত্রা। বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে গত ১৮ জানুয়ারি শুরু হওয়া প্রদর্শনী শেষ হয় ৩১ জানুয়ারি।