বিনয়ের ছোটগল্প-স্বরূপ

 

গল্প নিয়ে আলাপের আগে তাঁর সম্পর্কেই একটা ‘গল্প’ বলি, স্বয়ং বিনয় মজুমদারের ভাষ্য থেকে পাওয়া। তখন তাঁর মা মারা যাওয়ায় বেশ একা সময় কাটাচ্ছেন। এরকম সময় জামশেদপুরের পত্রিকা কৌরবের সম্পাদক কমল চক্রবর্তী অনুরোধ করলেন, গোটাকয়েক গান লিখে পাঠাতে। তিনি পাঠালেন। মাসখানেক বাদে কমল চক্রবর্তী বিনয় মজুমদারকে লিখে পাঠালেন, ‘দাদা, যে-কটা গান পাঠিয়েছেন সব গানই রবীন্দ্রনাথের লেখা।’ এই ঘটনায় অন্য লেখক হলে বিব্রত হতেন, নিজের নামে প্রকাশের অভিপ্রায় মোটেই ছিল না প্রমাণে নানারকম যুক্তি-তর্কে তৎপর হতেন। বিনয় মজুমদার মোটে একটি বাক্য বললেন, ‘যাক রবীন্দ্রনাথই ভরসা’। এই বাক্য থেকে পাঠক দুটো বিষয় ধরতে পারেন, কমল চক্রবর্তীকে গানের জন্য রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই – এমন একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি অথবা এমনভাবে আত্মস্থ হয়েছিলেন যে, শব্দ সৃষ্টির ঘোরে কোনটি নিজের আর কোনটি তাঁর নয়, সে-ব্যবধান অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিনয় কিন্তু বলেননি, কাজটি তিনি কেন করেছিলেন। বরং এজন্য যুক্তি এঁটেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ দিয়ে। যেন বিষে বিষক্ষয়। ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর একখানি বইয়ের জন্য কবিতা বাছাই ক’রে দিয়েছেন – সঙ্কলনগ্রন্থখানি ছাপাও হয়ে গেছে।’ তার পরে রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি বই হাতে রবীন্দ্রনাথকে বললেন, ‘গুরুদেব, আপনার বইতে এই যে-কবিতাটি ছেপেছেন এটা আসলে প্রিয়ম্বদা দেবীর লেখা কবিতা।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘প্রিয়ম্বদার কবিতা আমার কবিতা ব’লে ছেপেছি বলছো। তবে কবিতাটি বাদ দিয়ে আবার বই ছাপো।’ ‘সে জন্যই ভাবছিলাম যে এখনো রবীন্দ্রনাথই আমাদের ভরসা।’  এই হলেন বিনয় মজুমদার, যাঁর কিছু হারাবার ভয় ছিল না বলে যা লিখেছেন তা একেবারেই নিজের ইচ্ছা-খেয়ালে সৃষ্টির আনন্দে। পয়ারের কবিতা থেকে মুক্তগদ্য বা দিনলিপি। বিনয় মজুমদারের অপরাহ্ণকালে লেখা গদ্য যা অধিকাংশই আসলে একপ্রকার দিনলিপি, সেসবই প্রকাশ করা হয়েছে ছোটগল্প নামে।

তাঁর গল্প নিয়ে আলাপ হয়তো সম্ভব তবে ব্যবচ্ছেদের ভেতর দিয়ে স্বরূপ সন্ধান কঠিন। গল্পের ভাব, বিষয়, বুনন, প্রকাশের ধরন আমাদের মসিত্মষ্কে গেঁথে দেওয়া গল্পের যে-চেহারা তার মতো নয়। তবু কেন কবি বিনয় মজুমদারের গল্প নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হলো তারও একটি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এ-ব্যাখ্যা বোধকরি গল্পের প্রকার বিশেস্নষণের ভেতর দিয়েই কিছুটা পাওয়া যাবে। একটি ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসাও আছে। বিনয় মজুমদারের এই লেখাগুলোকে আসলেই ছোটগল্পের নামকরণে উপস্থাপন করা উচিত কিনা? যদিও প্রথা ভাঙার প্রবণতা কবির প্রথম থেকেই ছিল তবে তিনি নিজে ‘ছোটগল্প’ হিসেবে পরিচিত করতে চাইতেন কি না স্পষ্ট করেননি। বই হিসেবে প্রকাশে খুশি ছিলেন সত্যি কিন্তু তা ছোটগল্পের নাম-পরিচয়ে যত, তার চেয়ে বেশি ছিল সাহিত্যসেবীরা শ্রদ্ধাভরে বই নিজ উদ্যোগে ছেপে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে হেতু। ‘আত্মপরিচয়ে’র কথোপকথন তেমনি ইঙ্গিত দেয়। ১৯৯৮ সালে উৎপল ভট্টাচার্য-সম্পাদিত কবিতীর্থ সাহিত্য পত্রিকার উদ্যোগে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় বারোটি গল্প নিয়ে। বারো বছর পর দ্বিতীয় সংস্করণে আরো আঠারোটি গল্প যুক্ত হয়। এর বাইরে বিনয় মজুমদারের একটি বিখ্যাত গল্প আছে ‘ফাঁস’ নামে। আরো গল্প থাকতে পারে, যার সন্ধান আমার জানা নেই। কবি বিনয় মজুমদার তাঁর গল্পের বই নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম, গল্পের সংখ্যা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গান্তর ঘটল। যা হোক এক সাক্ষাৎকারে বিনয় জানিয়েছেন, একদিন ঘরে বসে আছি। জানালার কাছে একটি যুবক এসে বললো, ‘দরজা খুলুন, আমি কবিতীর্থ থেকে এসেছি।’ দরজা খুলে যুবকটিকে ঘরে আনলাম। যুবকটি হাতে দুকপি বই দিয়ে বলল, ‘এই আপনার ছোটগল্প। নিন’। দেখি যে, সত্যই তাই। বইয়ের মলাটেই মোটা ব্রাশ দিয়ে অাঁকা নাম – ‘বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প’। আমি আনন্দে আর কথাই বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ।’ এই শেষ বাক্যটি পাঠককে প্রভাবিত করে। জীবনের প্রতি বিপুল নির্মোহতাই ব্যক্তি বিনয় মজুমদারের প্রতি আরো বেশি আগ্রহ তৈরি করে পাঠকের। তবে কবিতা নিয়ে যেমন উচ্ছ্বাস, পাঠক ততটাই নীরব গদ্যে। কবিতীর্থের বাংলা ১৪২৪ সালে প্রকাশিত সাড়ে পাঁচশো পৃষ্ঠার ‘বিনয় মজুমদার’ সংখ্যায় একটি আর ছোট কাগজ মাদুলি প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যার ষাটটি লেখার ভেতর মাত্র একটি লেখা পেলাম গদ্য-সম্পর্কিত। অথচ বিনয়ের স্বতন্ত্র স্বরই তাঁর সব লেখা নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। এই স্বতন্ত্রতা শুধু আত্মমুখী নয়, ভিন্ন ধারারও পথ তৈরি করেছে, যা খতিয়ে দেখলে আমাদের জীবনের সঙ্গে গল্পের চেয়েও বেশি বাস্তব সম্পর্কিত যা সুসংহত রচনা। ছোটগল্প নিয়ে কথা বলার সুবিধার্থে বিনয় মজুমদারের গল্পগুলোর কয়েকটি আঙ্গিক থেকে দেখতে পারলে সুবিধা হবে।

 

চরিত্র নির্মাণ

বিনয় মজুমদারের সব ছোটগল্পের মূল চরিত্র কথক নিজে। একটি উদ্দেশ্য ছাড়া এই চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই। তাঁর উদ্দেশ্য একটা দর্শন প্রতিষ্ঠা। অন্যান্য গল্পে বা সাহিত্যে যেমন নাম-চরিত্রের বিশেষ কোনো আচরণ থাকে, যা দিয়ে তাঁকে চেনা যায় বা তাঁর সম্পর্কে পাঠকের মনে ধারণা তৈরি হয়, তা নেই। বিনয়ের মূল চরিত্র কোথাও কাজ করেন না, অফিসের কর্মকর্তা বা কর্মচারী নন আবার শিক্ষক-প্রকাশক বা চিকিৎসকও নন। কালো নন, সাদাও নন, মোটা-খাটো বা লম্বাটে নয়, গোঁফ আছে বা নেই। চা খাওয়ার সময় সুরুৎ শব্দটা হয় না বা উচ্চকিত শব্দে পিরিচে ঢেলে খান এর কিছুই ভাবার বিশেষ অবকাশ রাখেননি। চপ্পল বা জুতো দুটোই পরেন বা কোনোটাই পরেন না। একেবারে নিছক শুধুই একজন মানুষ, স্রেফ মানুষ। যে-কোনো প্রকার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে একজন যার গৃহস্থালির সংজ্ঞা নেই, প্রেমিকার অনুপস্থিতি। হাঁড়ির গহবরে ভাত ফুটে উঠছে কিনা তাও ভাবার অবকাশ রাখেননি বিনয় মজুমদার তাঁর ছোটগল্প নামকরণের গদ্যগুলোতে। যেমন – লেখা লিখন রচনা, বিশ্ববীক্ষা, দর্জিপাড়ার ইতিহাস, মনা আজ এসেছিল আমার কাছে, মানচিত্র বা ভারত গল্পের মূল চরিত্রগুলো ধরা যাক। তাহলে রইল কী চরিত্রের? রইল একজন মানুষের ভাবার অবারিত স্বাধীনতা। আর সে-স্বাধীনতাই কেন্দ্রীয় চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সবটাতেই স্বয়ং বিনয় নিজেই প্রধান চরিত্র। উত্তম পুরুষে লেখা গদ্য সব। ‘লেখা লিখন রচনা’য় আশুতোষ সেন যাকে দেখেই প্রথম বললেন ‘আসুন দাদা, আসুন। বসুন।’ এই দাদা চরিত্র যিনি ক্রমাগত সেই বৃদ্ধকে তাঁর সারাজীবনে লেখা সব চিঠি একসঙ্গে প্রকাশে উৎসাহ দিতে শুরু করেন। এবং এ-চরিত্রটিই শেষ পর্যন্ত আসল কথাটি বললেন, ‘তাহলে আপনি কবিতা লিখুন, গদ্য পদ্য যা পারেন। গোটা পঞ্চাশ কবিতা লিখে নিজের দুহাজার টাকা মূলধন দিয়ে ছাপুন। আপনার নিজের টাকায় ছাপা, যা খুশি লিখে ছাপবেন কারও কিছু বলার নেই, আপনার নিজের টাকায় ছাপা।’ এই যে বক্তব্য দিচ্ছেন, এ হচ্ছে কথক যা বিনয় নিজে তা পাঠক মাত্রই বুঝতে পারেন। এখানে মূল চরিত্রের কোনো বিশেষত্বই যেন নেই। চরিত্রের বাক্যবিনিময়ের ভেতর দিয়ে বুঝতে হবে ব্যক্তির ধাঁচটা। এতক্ষণ যে বললাম বিশেষত্ব নেই, মনে হয় কিছুটা ভুল বলেছি। এই প্রধান চরিত্রদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে মানুষজনকে ধরে ধরে বই ছাপাতে বলে আর কবিতা লিখতে উৎসাহ দেয় অতএব সে একজন উৎসাহদাতা ও বিশ্ব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী মানুষ।

অন্যান্য ছোটগল্পের মতো বিনয়ের সব গল্পেই মূল চরিত্রের সঙ্গে আরো কয়েকটি চরিত্র নির্মাণ করেছেন এবং তা ছোটগল্পের মতো সংখ্যায়ও কম। বিনয় যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র নিয়েই মাথা ঘামাননি সেখানে অসংখ্য ছোট ছোট নক্ষত্রের মতো অস্পষ্ট চরিত্রে বৈশিষ্ট্য দিতে যাবেন, হতেই পারে না। তবে অধিকাংশই ‘শ্রোতা’ হিসেবে গল্পে উপস্থিত, যারা একটু মোটা বুদ্ধির। শুধু প্রথমজনের কথার জন্যই যেন তাদের নানা প্রকার সামাজিক অবস্থানে বসানো হয়েছে। যেমন ধরুন ‘জমির দাম’ গল্পটি। এখানে আশুবাবু নামক ব্যক্তি একজন দর্জি দোকানদার, যিনি একটা প্যান্ট বানাতে কত কাপড় লাগে সেটা জানেন। লেখকের মূল উদ্দেশ্য জমির দামের সঙ্গে কাপড়ের দামের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে জমির দাম সম্পর্কে একটি মন্তব্যে আসা। এখানে আশুবাবুর মুখ দিয়ে ‘প্যান্ট তো ছিঁড়েই যাবে দুই তিন বছরে আর জমি থাকবে পুরুষানুক্রমে। পৃথিবী যদ্দিন থাকবে ততদিন।’ এই একটি বোধ বলিয়ে নেওয়া ছাড়া গল্পে তাঁর উপস্থিতি শ্রোতা ছাড়া কিছু নয়। ধরা যাক ‘যুদ্ধ’ গল্পের কথা। প্রথম বাক্যটিতে প্রধান বক্তা নরেশ নামে একজনকে সম্বোধন করে যুদ্ধ শুরুর বর্ণনা শুরু করলেন, পুরো গল্পে কোথাও আর নরেশের কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি যুদ্ধ নিয়ে নরেশের কোনো মন্তব্য পর্যন্ত তিনি আনেননি। যুদ্ধক্ষেত্রে হিন্দুস্থানের সৈন্য আঠারো বছর বয়স্ক সদানন্দ বাড়ৈ যার হাতে লোহার নল আর তারই বয়সী প্রায় অসংখ্য সৈন্য দুই শত্রুদল তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে সীমান্ত বরাবর। এই গল্পে লেখকের প্রধান বক্তব্য, ভারত-পাকিস্তান প্রতিবেশী দুদেশের মধ্যে যে-যুদ্ধ, গোটা পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধই এই একপ্রকার। সে অভিজ্ঞানদানের কাজটি প্রধান চরিত্রই করেছে। এখানে নরেশ ও সুরেশ শ্রোতামাত্র। একই রকম ‘দু’দিন’ গল্পে মধুসূদনের কাপড়ের দোকানের গল্প বা মানচিত্র গল্পের অনিল নামের মানুষরা হলেন পার্শ্বচরিত্র।

বিনয়ের কবিতার সঙ্গে গল্পের চরিত্রদের বিস্তর ব্যবধান। কবিতায় যে-ভাবাবেগ এবং তার যে স্বকীয় প্রকাশ, সেখানে যার উদ্দেশ্যে সেই অভিব্যক্তি সেও পাঠকের কাছে বিশেষ হয়ে ওঠে। কবিতায় বিনয়ের নিবেদনই এ দুইকে বিশেষ করেছে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় নিবেদন কোনো ব্যক্তিবিশেষও নয়। যেমন তার বহু কবিতায় তিনি কাউকে উদ্দেশ্য না করে প্রকৃতি নিয়ে নিজস্ব দর্শন বলে গেছেন। গল্পে তা সম্ভব নয়। গল্পে তিনি চরিত্র এনেছেন সমাজের অধিকাংশ নিম্নমধ্যবিত্ত স্তর থেকে। স্বভাবতই ধারণা করা যায়, শিমুলপুরে ফিরে যাওয়ার পর তার বাড়ির আশপাশে যাদের পেয়েছেন, রেলস্টেশনের পাশে যে-চায়ের দোকানে বসেছেন বা বিকেলে গাঁয়ের মাঠে যারা কাজ করেছে তারাই চরিত্র হিসেবে এসেছে। কখনো কল্পনায়, কখনো সত্যিকারেই সেই মানুষের সঙ্গে আলোচনাই লিখেছেন বিনয়। এই অন্যরা গল্পে বিশেষ কোনো মত দেননি, কথা বলেননি। লেখক তাদের অস্পষ্ট আকৃতি দিয়েছেন, যেমন ‘কবির গল্প’ নামক গল্পে এক ব্যক্তি ইলিশ মাছ নিয়ে ট্রামে উঠে অন্য যাত্রীদের কাছ থেকে বিড়ম্বনার শিকার হলেন। মাছ ক্রেতা ব্যক্তির বারবার নিচুস্বরে প্রতিবাদের ভাষা বলছে, তিনি পচা ইলিশ নিয়ে ট্রামে ওঠেননি কিন্তু এই সত্যিটাকে প্রমাণের মানসিক জোরটা নেই। অগত্যা ট্রাম থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর বোঝা গেল আসলে গন্ধটা তাঁর মাছ থেকে নয়, পাশে চলা একটা শুঁটকি মাছের লরি থেকে আসছিল। লরিটা কাছে এলে বাতাসে সে-গন্ধ এই বাসে আসে আবার গতির তারতম্যে দূরে গেলে গন্ধও সরে যায়। এই যে লোকটির বিপর্যস্ত পরিস্থিতি নিয়ে গল্পটা করলেন, সেখানে ওই কেন্দ্রীয় চরিত্র সম্পর্কে আর একটি বাক্যও তিনি টানেননি। এই মাছটি নিয়ে তিনি শ্বশুরবাড়ি বা নিজের গৃহে যাচ্ছিলেন বললে আমরা একটা বয়স ধরে নিতে পারতাম। যদি তাঁর পোশাকের বর্ণনা থাকত তবে কোনো অফিসের কনিষ্ঠ কেরানি নাকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বাঁশি কবিতার হরিপদ তাও ভাবার একটা সুযোগ থাকত। বিনয় ইচ্ছা করেই কিছু অাঁকেননি। যেন এই চরিত্ররা হেঁটে গেলে ছায়াও পড়ে না। যেমন ধরুন ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’তে মুকুন্দ বণিক মিষ্টি তৈরি করেন। গল্পে কোথাও মুকুন্দ বণিকের বিশেষ কোনো মতামত বা কথা নেই। কিন্তু লেখক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থেকে মুকুন্দ বণিককে শ্রেষ্ঠ করে দিলেন মিষ্টি থেকে মানুষের শরীরে মাংস তৈরির হিসাব দেখিয়ে। ‘তাহলে আসল কথা আপনি নিশ্চয়ই হিসাব করেন দৈনিক পঁচিশ কেজি আপনার তৈরি খাবার খেয়ে অত এক কেজি মাংস তৈরি হয়েছে দৈনিক খাদকের।’ পরের প্যারায় বলছেন, ‘অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এক কেজি মাংসও বানায়নি কারো। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিছুই না আপনার তুলনায়।’ বিনয় মজুমদারের গল্পে প্রধান চরিত্রের যাদের সঙ্গে আলাপ হয় তাদের কেউ ধোপা, কেউ দর্জি, কেউ খাবারের দোকানদার। আদতে তার সবগুলো চরিত্রের দিকে তাকালে মনে হয়, একটি চরিত্রকেই তিনি ভেঙে ভেঙে প্রত্যেকটি গল্পে এনেছেন। এরা সবাই আমাদের নিত্যদিনের দেখা আশপাশের মানুষগুলোর সঙ্গেই সাধারণ কথা বলছে। তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি উপস্থাপনের চেয়ে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত করার প্রবণতা বেশি। আর তাদেরই কর্মজীবনকে টেনে একটি দর্শন উপস্থাপনই কেন্দ্রীয় চরিত্রের কর্তব্য। লেখকের স্ব-ইচ্ছাতেই এসব চরিত্র বিশেষ না হয়েও বিশেষ। আমাদের পরিচিত সব গল্পে যেমন চরিত্রনির্ভর করে কাহিনিবিন্যাস হয়, তাঁর গল্পে তা ঘটেনি। তিনি চরিত্র তৈরি করেছেন প্রয়োজনের ভেতরে থেকে।

কাঠামোবিন্যাস

বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প হচ্ছে স্পেস বা পরিসরকে একটি সম্পর্কের ভেতর দিয়ে ক্রমাগত শাশ্বতের দিকে নিয়ে যাওয়া। অভীক চট্টোপাধ্যায় বিনয়ের ছোটগল্প সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি  যেন ডায়ালেকটিক পদ্ধতিতে সাবট্র্যাকশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোনো সত্যে উন্নীত হতে চাইছেন।’ তবে এত কঠিনভাবে বললে ঠিক ধরনটা বোঝা যায় কিনা জানি না, কারণ আমার কাছে পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে বিনয়ের গল্পে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাবলীল বর্ণনা। টানটান উত্তেজনা না ছড়িয়ে এক গতিতে পাঠককে শেষে নিয়ে গিয়েছেন  কথাকার। ছোটগল্পে সাধারণত মূল ঘটনা উপস্থাপনে তিনটি কালেরই ব্যবহার দেখা যায়। বর্তমান থেকে শুরু করে লেখক অতীতে যান, সেখান থেকে আবারো বর্তমানে ফেরেন। অতীত থেকে শুরু করে লেখক বর্তমানে আসেন, মাঝখানে ভবিষ্যতের চিত্রকল্প তৈরি করেন অথবা বর্তমান-ভবিষ্যতের দিকে গল্প টেনে শেষ করেন। মাঝখানে পাঠককে অতীতের দিকে নিয়ে যান সংশয় তৈরি করতে। বিনয় গদ্যে কোনো ব্যাকরণ মানেননি। যেখানে গল্প শুরু করেন সেখানেই শেষ করেছেন। শুধু মূল বক্তব্যটি ধারণা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু হয়ে একটি নির্দিষ্ট যুক্তিবিদ্যার পথ হেঁটে আসে। এই কাজ তিনি কবিতার বিষয়েও করেছেন। একটি ইচ্ছা, অনুভূতির প্রকাশের চেয়ে বেশি কাজ করেছে তাঁর ধারণা বা দর্শনটি প্রমাণের চেষ্টা। এ-কথা নিজে স্বীকারও করেছেন আত্মপরিচয় গ্রন্থে। ‘মাঝে মাঝে কবিতা লেখা যে বন্ধ থাকতো তার প্রধান কারণ হলো বিষয়বস্ত্তর অভাব। বিষয়বস্ত্ত খুঁজে পেতাম না আমি। চারিপাশে যে সকল দৃশ্য দেখি, আমরা সকলেই দেখি, তার হুবহু বর্ণনা লিখলে কবিতা হয় না। সেই দৃশ্য আদৌ কেন আছে, কী কারণে বিশ্বে তার থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’ কবিতায় কাজটি তাও উপমা দিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা রেখে করেছেন কিন্তু গদ্যে যেন একেবারে সুদে-আসলে শোধ তুললেন। গদ্যের লেখা প্রতিটি বাক্য স্পষ্ট, একেবারে সোজসাপ্টা বোধগম্য উপস্থাপন। উপমা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘উপমা দেওয়া মানেও দর্শনকে হাজির করা। এই দর্শন উপস্থাপনের কৌশল ছিল গল্পে একটি বিষয়কে উল্লেখ করে সে-সম্পর্কে গণিতের আশ্রয় বা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা তৈরি। তার ফলে কাঠামো পুরোটাই বর্তমান। কখনো কখনো বর্তমানকে প্রমাণ করতে তিনি অতীতের কোনো ঘটনা টেনেছেন বটে তবে তা গল্পের আকারে নয়। তাই বিনয়ের গল্পকে ৩-২-১ বা ২-১-৩ এমন কোনো ধারার বলা যাবে না। গল্পে ঘটনার ঘনঘটা নেই। সাসপেন্স তৈরি করেননি।

বিনয় মজুমদারের গল্পসংখ্যা যেমন সীমিত তেমনি আকারও। কোনো গল্পই হাজার দেড়েক শব্দও অতিক্রম করেনি, এক হাজার থেকে বারোশো শব্দে সীমিত। বহুমুখী ব্যঞ্জনা নিয়ে নয়, একমুখী হয়ে রচনা করেছেন। তবে তাতে মূল গল্পটি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। আর সেটি করেছেন যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে বিশ্বের নিত্যসত্য। বিনয় মজুমদারের গল্প পড়তে পড়তে আপনার মনে পড়বে বেলজিয়াম-বংশোদ্ভূত ফরাসি লেখক অঁরি মিশোর ‘অ্যান্ড মোর চেঞ্জেস স্টিল’ গল্পটার কথা। এ-গল্পে লেখক তাঁর শরীর ও সহনশীলতার বিসর্জন দেওয়ার পর থেকে রূপান্তর হতে থাকে। আকৃতি বিলুপ্ত হতে শুরু করে মানুষটার। প্রথমে সে পিঁপড়ের শরীরে বিবর্তিত হয়, এরপর অরণ্যে। একপর্যায়ে জীবন হারিয়ে জড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। প্রথমে নৌকা সেখান থেকে রূপান্তর হতে হতে অ্যামোনিয়া হাইড্রোক্লোরেটে পর্যন্ত হয়ে উঠলেন। বিনয় মজুমদারের গল্পের প্রধান চরিত্র এক একটি গল্পে তাঁর দর্শনকে প্রমাণের জন্য বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে, জ্যামিতি, ইঞ্জিনের অংশ এমনকি মানুষের মাংস পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। শুধু আনেননি মোটাদাগের ব্যক্তিগত আবেগ। তবে বলে রাখছি, অঁরি মিশোর গল্পটা যেমন  নিজস্ব সত্তা বিসর্জন দিয়ে এ সবকিছুর ভেতরে প্রবেশ করেছে বিনয়ের গল্পে তা নয়। তিনি মনুষ্য পরিচিতি বজায় রেখেই  সবকিছুকে টানছেন মূল বক্তব্যটির জন্য। বিনয়ের ‘মানচিত্র’ গল্পের বিষয় পৃথিবীর আকার আর মানবজাতির উন্নয়ন। এই উন্নয়ন প্রসঙ্গে অনিল যখন বলছেন, ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে মানুষজাতির জ্ঞানের রাজ্যে, তখন লেখক উত্তর দিচ্ছেন – ‘এ কী উন্নতি? উন্নতি কিনা ভাববার বিষয়। আমরা বাড়াচ্ছি না বলে বরং বলতে পারি আমাদের অজ্ঞতা কমাচ্ছি। যখনই আমরা আবিষ্কার করি তবেই আমরা ক্ষুদ্র তুচ্ছ বলে ধরা পড়ি।মাত্র দেড় পৃষ্ঠার এই ‘মানচিত্র’ গল্পে কোনো প্যারা নেই। তেইশটি প্রশ্ন-উত্তর পর্বের মধ্য দিয়ে গল্পের শুরু ও শেষ। অধিকাংশ গল্পই এই ধারায় লেখা।

 

বিষয় ও উপমার ব্যবহার

প্রচলিত প্রমিত ভাষা। কোথাও কোথাও স্বল্পপরিসরে স্থানীয় দু-একটি বাক্য ব্যবহার করেছেন। তবে উপমার ব্যবহার নেই বললেই চলে বরং তুলনামূলক প্রসঙ্গ বেশি। গদ্য পড়তে গেলে মনে হয়, যেন ক্রমাগত ভেতরের যন্ত্রণাশব্দ, সংখ্যা, চিহ্নের ওপর আছড়ে পড়ছে। তাঁর গল্পে ঈশপের গল্পের মতো প্রাণীনির্ভর বা মানবাশ্রয়ের নীতিধর্মের সমাহার নেই আবার নিরুদ্দেশপন্থীও হয়ে ওঠেনি। বরং এতটাই সুসংহত যে, ঘটনা নয় বিশেষ একটি বাক্য প্রতিষ্ঠার জন্যই গল্পটা সাজানো। এই যে বললাম সুসংহত এর বিপরীতে আবার অসংবদ্ধও বটে। নিজেকে তিনি ভাঙতে ভাঙতে প্রকাশ করেছেন যন্ত্রণার। প্রকাশের সুতীব্র প্রকট বাসনাই যেন তাকে নিজের কাছে নিজেকে অবাধ্য করেছে। তাই সাহিত্যের ব্যাকরণিক দিকটি স্পর্শ করার ভাবনা বিনয় মজুমদারের ছিল না। তিনি আনন্দে মুক্তগদ্য লিখেছেন। আসলে  তা হলে কী আছে বিনয় মজুমদারের গল্পে? বিনয় মজুমদার তাঁর গল্পে চলমান জীবনে নানা উপেক্ষেত কিন্তু নিত্যসত্যকে উপস্থাপন করেছেন। এতে সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে সাধারণ দৃষ্টিতে এড়িয়ে যাওয়া জীবনে বিশেষভাবে উপস্থিত বিষয়গুলো। গদ্যের ভেতর দিয়েও তিনি বারবার কবিতা লেখার ইচ্ছা উসকে দিয়েছেন। ঘুরেফিরে এসেছে দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ এবং খাদ্যদ্রব্য প্রসঙ্গ। তিনি পরিবেশ চিত্রণ করেননি। পরিবেশই চিত্রিত হয়েছে স্বাভাবিক ধারায় কথোপকথনের ভেতর দিয়ে। ধরা যাক তাঁর ‘আমার চাষিভাইয়েরা’ গল্পটি। এখানে তিনি বলছেন, ‘যাচ্ছিলাম বাড়ি ফিরে দুপুরের কিছু আগে। দেখলাম আমাদের রেলস্টেশনে মাইক বসিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে গোবিন্দ দেব (গ্রাম শিমুলপুর, ডাকঘর : ঠাকুরনগর, ২৪ পরগনা) তার পাশে বিরাট আরো অনেকে।’ এটুকু পাঠ করলেই লেখকের মনে কিন্তু একটা পরিচিত দৃশ্য কল্পনা হয়ে যায়। পাঠক তার পরিচিত একটি স্টেশন ভাবেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে, রোদ বাড়ছে এমন একটা সময়ে স্টেশনের পাশে জনসমাগম দৃশ্য দেখে ফেলেন পাঠক। এখানে ‘বিরাট’ এক ব্যক্তির নাম, যার সঙ্গে আলাপ দিয়ে গল্পে এগিয়েছে।

তাঁর গল্পে মানবিক ভাববিনিময় মোটা দাগে নেই। আছে খুব সূক্ষ্মভাবে গোপনে তা সচেতন পাঠকের বুঝে নেওয়ার দায় থাকে, সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে পাঠক সেখানে পৌঁছাবেন না। যেমন একটি গল্প : এ-গল্পে লেখক শিবেনের বাড়ি গেল। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে শিবেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। শিবেন বাড়িতেই আছে কিন্তু দেখা হচ্ছে না, একবার কেউ জানাল শিবেন কলতলায় আবার শিবেন ছাদে কাপড় জামা শুকোতে দিচ্ছে। বহুক্ষণ বাদে যাওবা শিবেন এলো, কথা বলা হলো না। শিবেন তাকে বসিয়ে রেখে ভাত খেলো এবং প্রস্ত্তত হয়ে বাইরে চলে গেল। তবে এরই মধ্যে শিবেন তাকে বিড়ি সেধেছে এবং যাওয়ার সময় লেখক তাকে ছাতা নিয়ে বের হতে বললেন। এই ছোট ছোট বাক্যবিনিময়ের ভেতর দিয়ে দুজনের মধ্যকার উষ্ণতার জায়গাটা যে বিনয় তুলে আনলেন, তা এতটাই স্বল্পপরিসর আবার গভীরে যে, পাঠক মন দিয়ে না বুঝলে ধরতে পারবেন না শিবেনের সঙ্গে লেখকের দেখা হওয়ার আকুতিটুকু। এও যেন তাঁর গণিতের কোনো একটি সূত্রের একটি চিহ্ন বদলে গেলে পুরো ঘটনাই অন্য খাতে ভাবার অবকাশের মতো। তাঁর গল্পে উপমার পরিবর্তে আছে তথ্যের সন্নিবেশ। উলের সুতোর মতো যেন গুটিয়ে রাখা একটি আল সেটি টানলে অন্য প্রসঙ্গ আপনাতেই চলে আসবে। আছে স্মৃতিচারণ। ‘খাদ্য’ গল্পে শেষে বলছেন – ‘মাছ বলতে গেলে আমার আবার বাঁধাকপি, ফুলকপির কথা মনে পড়ে। আমি নিজের হাতে বাঁধাকপি কিনেছি এক কেজি পঞ্চাশ পয়সা দরে। আমি বলেছিলাম – এই বাঁধাকপি রান্না করে এয়ার টাইট করা টিনে-বড়ো টিনে রাখুন ভারত সরকার। এবং এই টিন কেটে বাঁধাকপির তরকারি খেতে পারি আমরা চৈত্র মাসে।’ লক্ষ করুন একটি খাদ্যের নাম থেকে তিনি আরো দুটো খাবার যার সঙ্গে মাছ রান্না হয় সেখানে গিয়েছেন। সেখান থেকে খাবার সংরক্ষণ এবং মানুষের খাদ্যাভাব নিরসনের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এটি একটি উপমা যদি ধরি তাহলে বলতে হবে বিনয় মজুমদার তাঁর গল্পে উপমাকেও এনেছেন বিষয়ের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে। সরকারকে সবজি সংরক্ষণের যে-পরামর্শ দিয়েছেন তা পড়ামাত্র পাঠকের চোখে খাদ্য মজুদের পাশাপাশি কালোবাজারি, চালের দাম বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো উঠে আসে। এভাবেই বাস্তবে থেকে বাস্তব বিষয়কে গল্পে উপযুক্ত উপস্থাপন করেছেন বিনয় মজুমদার। তিনি নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, উপমা দেওয়া মানেই দর্শনকে হাজির করা। এর উদাহরণ দিতে নিজের কবিতা তুলে এনে একে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘অথচ তীক্ষনতা আছে, অভিজ্ঞতাগুলি সূচিমুখ,/ ফুলের কাঁটার মতো কিংবা অতি দূর নক্ষত্রের/ পরিধির মতো তীক্ষ্ণ, নাগালের অনেক বাহিরে

এর ভেতরের উপমাকে দেখিয়েছেন এভাবে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা দিতে এ-স্থানে ফুল এবং নক্ষত্র আনা হয়েছে। ফুল এবং নক্ষত্র দুই-ই খুব সুন্দর, তার মানে অভিজ্ঞতাগুলোও সুন্দর। কিন্তু ফুলের সৌন্দর্যের সঙ্গে কাঁটা থাকে, তার মানে সুন্দর অভিজ্ঞতা হতে গিয়ে নির্মম বাধা আসে – এ হয়তো এক নিয়ম। এই দার্শনিক তত্ত্বের জন্য তুলনায় ফুল এসে পড়ে। বিনয়ের গদ্য কবিতায় প্রকৃতি যেমন করে উপস্থিত তা শেলির সেই প্রকৃতির প্রাণসত্তা নিয়ে উপমার মতো। শেলি এই নিসর্গের উপমা হিসেবে বলেছিলেন ‘লাইফ অফ লাইফ’। বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতির মর্মলক্ষ্মী যে-ধারা তার প্রথম মুকুর দেখিয়েছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির উপস্থিতিকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন নিসর্গশ্রীর সর্বাত্মিকারই অংশমাত্র। এরই ধারাবাহিকতায় যেন এসেছেন রবীন্দ্রনাথ তারপর জীবনানন্দ, গদ্যে এনেছেন বিভূতিভূষণ। এরই উত্তরসূরি হয়ে এসেছিলেন বিনয় মজুমদার। কিন্তু তিনি শুধু আসেননি; তিনি আত্মীকরণ করে ভাঙচুর করেছেন নিজস্ব ধারায়। তৈরি করেছেন প্রকৃতিকে আরেক রকম করে দেখার মানসিক দৃষ্টি। বিনয়ের প্রকৃতি দেখার ধরনটা এ-সময়ের ভারতীয় গল্পকার সিদ্ধার্থ গিগুর ‘দ্য অ্যামব্রেলা ম্যান’ গল্পের অপ্রকৃতস্থ মানুষটির কথা মনে করায়।প্রকৃতির সঙ্গে যার সম্পর্ক অন্যের কাছে অবিশ্বাস্য। একা একজন মানুষ, রোজ বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে। তাঁর সখ্য হয় হলুদ ডোরা দেওয়া একটি ছাতার সঙ্গে। কথোপকথন চলে বেঞ্চের পাশে থাকা একটি লাল পিঁপড়ের সঙ্গে। অন্যের কাছে তা অবিশ্বাস্য হলেও তিনি জড়ের সঙ্গেই নিজের সম্পর্ক পেয়েছিলেন। বিনয়ের গদ্যেও ঠিক তাই।

 

দর্শন

এতক্ষণে তাঁর গল্পের মূল জায়গায় আসা গেল। কি কবিতা, কি গল্প বিনয় মজুমদার মানেই একটি দর্শন প্রমাণের সাহিত্য। বোধকরি বাংলা সাহিত্যে এ-কাজটি তাঁরই প্রথম করা। অনেকেই করে থাকলেও তা বিচ্ছিন্ন রচনায়। একক ধারা বজায় রেখে কাজটি কেউ করেননি। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ-প্রভাবিত বিনয় মজুমদার এই ধারা তাঁর পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পাননি। অর্জন করেছেন নিজের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে। এখানেই তিনি একক স্বতন্ত্রে উদ্ভাসিত। তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেনএখনো আমি ভেবেই চলেছি’।এই দর্শনের উপস্থিতি কবিতায় একেবারে প্রত্যক্ষণা হলেও চলে, হয়তো তার আভাস-মাত্র থাকলেই হয়। কিন্তু আভাসই হোক আর যাই হোক, উপস্থিতি অবশ্যই প্রয়োজন। এই উপস্থিতিই পাঠকের মনকে ভাবাবেগে আন্দোলিত করে, রসাপস্নুত করে। কবিতাকে চিরস্থায়ী করে’ এ হলো তাঁর কবিতায় দর্শনের উপস্থিতি। সামগ্রিক লেখায়ও তিনি দর্শন প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকেই সমুন্নত রেখেছেন জীবনের ব্যক্তিগত দর্শন উপলব্ধি থেকে। গদ্যও লিখেছেন সেই অনুভব থেকেই। ব্যক্তি বিনয়ের প্রধান আকর্ষণ ছিল জড়ের প্রতি। সবকিছু এক সূত্রে গাঁথা অতএব কোনোকিছুই বিচ্ছিন্ন নয়, এই হচ্ছে তাঁর ভাবনা। বিনয় মজুমদার তাঁর এই অভিজ্ঞান নিয়ে বলেছেন – ‘সৃষ্টির মূল যে সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, উদ্ভিদের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও প্রকাশিত। এদের ভিতরে সূত্রগুলি পৃথক নয়, একই সূত্র তিনের ভিতরে বিদ্যমান। আর এই সত্য সম্বল করে ভেবে দেখলাম, জড়ের জীবনে যা সত্য মানুষের জীবনেও তাই সত্য। অতএব  জড় এবং উদ্ভিদের জীবন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতে লাগলাম আমি। এইভাবে শুরু হলো কবিতার জগতে আমার পদযাত্রা, আমার নিজস্বতা। এইভাবে সৃষ্টি হলো আমার সমস্ত রচনা।’

এই কথাটিই যেন তিনি ভেঙে সূত্র মিলিয়ে দেখিয়েছেন তাঁর সমস্ত গদ্যে। ধরা যাক ‘বিশ্ববীক্ষা’ নামের গল্পটি। এ-গল্পে পঞ্চানন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর কথোপকথন চলছে। গল্পের সার কথা –  বিশ্ব একটি বিশালাকার প্রাণী। প্রমাণ করতে চেয়েছেন বিশ্ব যতদিন মানে এই পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন আমরা সবাই বেঁচে থাকব, সব প্রাণীও বেঁচে থাকবে। আর এই প্রমাণটি দিতে গিয়ে বিনয় মজুমদার গল্পের শুরুতে এনেছেন বাসের ইঞ্জিনের কথা। তিনি বলছেন – ‘এই ইঞ্জিনের সমস্ত অংশ নানানভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কিছু ইঞ্জিনের মধ্যে  থাকলে তাকে আর ইঞ্জিনের অংশ বলা চলে না। ইঞ্জিনের মধ্যে বহিরাগত সে।’ বিশ্ববীক্ষা গল্পে বিনয় মজুমদার একটি বৈজ্ঞানিক চমকপ্রদ তথ্য সে আমলেই দিয়েছেন, যখন অন্তর্জালের পদযাত্রা হয়নি। তার মতে বিশ্বের বাইরেও প্রচুর লোক রয়েছে। নানা ধরনের তারা। তারা উলটো জানতে চাইছে পৃথিবী তৈরির রহস্য। কোন পদ্ধতিতে বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ-গল্পটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অভীক চট্টোপাধ্যায় একে স্ফিয়ারোলজি বা গোলকবীক্ষার নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। ‘পৃথিবী বিখ্যাত’ গল্পে বিনয় মনোজাগতিক তত্ত্ব এনেছেন। সেখানে লেখকদের জন্য রয়েছে দর্শন। বিনয়ের মতে, লেখকরা প্রায়শই বিষয়বস্ত্তর অভাবে ভোগেন, কিন্তু সত্যানুসারক হলে নাকি লেখার অভাব হয় না। ‘যত সোজা সত্যি কথা লিখবে তত বেশি করে পড়বে।’জ্ঞানদান’ গল্পে জ্যামিতির আশ্রয়। ত্রিভুজের দুই বাহুর যোগফল তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বড় এই কা-জ্ঞানটি তিনি শিলাদিত্যকে বোঝালেন অথচ শিলাদিত্য তাঁর কাছে শুনতে চেয়েছিল কিছু কাব্যতত্ত্ব। জ্যামিতি ছাড়াই শিলাদিত্য নিজস্ব ধারণা থেকে যখন বুঝলেন যে, দুয়ের সমষ্টি একক বৃহতের চেয়েও বিশাল তখন তিনি তাঁর দর্শন উপস্থাপন করলেন, কাউকে কিছু বোঝানো যায় না। ‘তোমাকে আমার পক্ষে কিছু বোঝানো সম্ভব নয়। তোমার মনে যে জ্ঞান আছে তাই বাড়তে থাকবে তোমার সুযোগ সুবিধে প্রয়োজনমতো। আমি সেটা বলে পালটানো সম্ভব নয়।’  প্রতিটি গল্পেই এমন বেশ কিছু দর্শন তিনি উপস্থাপন করেছেন আর সেটি প্রমাণের জন্যই যেন পুরো গল্পটি সাজানো আর এ-কাজটি তিনি করেছেন  অবরোহণ পদ্ধতিতে। তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মূল লক্ষ্যই জীব ও জড়জগতের সঙ্গে বিশ্ব-সম্পর্কিত নানা দর্শন।

বিনয় মজুমদারের গল্প আত্মমুখী হয়েও সমাজনির্ভর। যদিও সেস্নাগানমুখী নয়, কিন্তু প্রখরভাবে রাজনৈতিক। কবিতার মতোই তাঁর গদ্যের কণ্ঠস্বর স্বতন্ত্র, ভিন্ন ধারার। একটা ছোটগল্প শেষ করার পর পাঠকের যে-আত্মতৃপ্তি বা অতৃপ্তির বাসনা রয়ে যায়, তাঁর গদ্যে তা নেই। তিনি সফলভাবে তাঁর গল্পটিতে দর্শন নিয়েই আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে, চরিত্র নিয়ে নয়। বিনয় মজুমদারের গল্পে অংক এসেছে, জ্যামিতি অধিক আর অধিকাংশে রয়েছে প্রকৃতি, জড় বস্ত্ততে সন্নিবেশ। পাঠের পর মনে হয়, একটা দিনলিপি শেষ হলো। নির্মেদ এই বাক্যসকল কোনো আত্মগস্নানি তৈরি করবে না, শুধু মনে হবে, আরো চারপাশে যে এসব ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে কিছুই তো দেখছি না। কিন্তু সেই বোধ থেকে কোনো অপরাধপ্রবণতা তৈরি করে পাঠককে বিব্রত করার বিচারিক দায় তিনি নেননি। বিনয়ের কবিতার দুটো বাক্যই যেন তাঁর এসব গদ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। ‘মুকুরে প্রতিফলিত’ কবিতার শেষ দুটো লাইন, ‘তবু কেন যে আজও, হায় হাসি, হায় দেবদারু, মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।’  বিনয়ের গদ্যের খুব কাছে গেলে কী যেন উড়ে যায়, হতে পারে বিনয়াসক্তি। তাঁর কবিতা ভক্তদের বা পাঁড় পাঠকের মনে এক রকম কষ্ট তৈরি হয়। মনে হয় বাকি রয়ে গেল। আহা গল্পের মুখ্য চরিত্রটি সম্পর্কে আর কিছুই জানা হলো না। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবু যদি এক বাক্যে বলি, বিনয় মজুমদারের গদ্য আসলে কেমন? বলব, কাব্যের কাছে পরাজিত তবু তীব্রভাবে আকর্ষণ করে কেননা এই যে রিয়ালিজমকে অ-মানবকেন্দ্রিকতার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া সেখানে বিনয় বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়। এ এক প্রকট স্ববিরোধিতা বিনয়ের লেখায়, অনেক কিছুই পাবেন না তবু যেন কী এক টেনে নিয়ে যায় শেষ বাক্যটি পর্যন্ত। ওই যে ভাবটি আপনাকে শেষ অবধি টেনে নিয়ে যাবে – ওই হচ্ছে বিনয় মজুমদারের স্বতন্ত্র শক্তি। r