বিভূতিভূষণ-পাঠ

আমিনুর রহমান সুলতান

একজন সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টির মূল্যায়নের পাশাপাশি যাপিত জীবনেরও থাকে মূল্যায়নের নানা দিক। বলা যায়, ‘একজন সৃজনশীল মানুষের জীবনকে অন্বেষণের’ নানা মাত্রা। মোট কথা, শিল্পকর্মের খ্যাতির জন্যই জীবনকে জানার আগ্রহই গবেষক, ইতিহাস রচয়িতা ও পাঠকদের কৌতূহলী করে তোলে। আর এদিকটির পূর্ণতা এনে দেন জীবনী-রচয়িতাগণ।

একজন সৃজনশীল মানুষের জীবনের নানা দিক যখন উঠে আসে জীবনীগ্রন্থে, তখন সে-গ্রন্থে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক প্রামাণ্য উপাদানে সমৃদ্ধ হয়। সাহিত্যের ইতিহাসে এভাবেই তা সমৃদ্ধ ও তথ্যবহুল এবং সত্যনিষ্ঠ হয়ে প্রতিষ্ঠা পায়।

সুব্রত বড়ুয়ার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনীগ্রন্থটিও উলেস্নখযোগ্য সংযোজন বলে মনে করি।

বিভূতির পথের পাঁচালী, অপরাজিতা, আরণ্যক, ইছামতি প্রভৃতি কালজয়ী কথাশিল্পের কথা আমরা জানি। এগুলো তাঁর অমর সৃষ্টি। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্মের পাশাপাশি হয়তো আমরা অনেকেই পরিচিত বিভূতির পরিবার-পরিজন, জন্মকথা, বাল্য ও কৈশোর এবং লেখকজীবনের সঙ্গে। এসব অভাব পূরণ করেছেন কথাশিল্পী সুব্রত বড়ুয়া।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকজীবনের বড় হয়ে-ওঠার ক্ষেত্রে পারিবারিক ও পরিপার্শ্বের প্রভাব খুবই প্রাসঙ্গিক। আর এ-জায়গাটিকে প্রথমেই গুরুত্বের সঙ্গে কথাশিল্পী সুব্রত বড়ুয়া তুলে ধরেছেন, যা একটি পরিবারের, একটি অঞ্চলের, ব্যক্তির বিকাশের নতুন চিন্তা-চেতনার জগৎটিকে জানার জন্য অতিজরুরি।

বিভূতিভূষণের পিতামহের ও পিতার পেশার এবং পেশার সূত্রে স্থানিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে গভীর ও নিবিড় জানাশোনা অন্য দশটি পরিবার থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের তাকে সুব্রত বড়ুয়া আবিষ্কার করেছেন পাঠকদের জন্য। পাঠকরা যেন বিভূতির মনোজগতের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। এজন্য অবশ্য তিনি অন্যান্য জীবনীগ্রন্থের ছকবাঁধা কঠোর বিধির ভেতর না থেকে নিজস্ব একটি ছক নির্মাণ করেছেন, যা এক, দুই করে এগারোটি পর্বে ধরা আছে বিভূতির জীবনকথায়।

একজন লেখকের শিক্ষাজীবন জরুরি নয়। তার পরও যে-লেখক ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তার ক্ষেত্রেও তো খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে শিক্ষার কালটা। আর সে-কালটা যদি হয় অর্থনৈতিক সমস্যায় আঁধার-ঘেরা তাহলে তো তাঁর শিক্ষাজীবনের পরিবেশ খুবই প্রাসঙ্গিক একজন জীবনীকারের কাছে। এক্ষেত্রে সুব্রত বড়ুয়া বিশেষভাবে আমাদের মনোযোগী করে তোলেন।

বিভূতির হাতে খড়ি দিয়ে পাঠ শুরু হয় – হুগলি জেলার শা’ গঞ্জ কেওটায় প্রসন্নণচরণ মোদকের পাঠশালায়। বারাকপুর থেকে বিভূতিদের পরিবারটি তখন তাদের এক আত্মীয় বাড়ির কাছে কেওটায় বাসা করেছিলেন। কেওটায় প্রথম কথকতার গান পরিবেশনের জন্য তার বাবা মহানন্দ গিয়েছিলেন। ওই সূত্রেই পরিবারটিকে নিয়ে তিনি বাসা করেছিলেন। ওখানে বিভূতির ছোটভাই ইন্দুভূষণ মারা যান হুপিংকাশিতে। ছোট বোন জাহ্নবীর জন্ম ওখানেই। কিছুকাল পর বিভূতিভূষণের পরিবার আবার ফিরে আসে বারাকপুরে। এখানে এসে প্রথমে পড়তে যায় হরিমোহন রায়ের পাঠশালায়। এখানে বিভূতি বেশিদিন পড়তে পারেননি গুরুর নগদ পাওনা দিতে না পারায়। বাবা মহানন্দ কথকতার গান গাওয়ার জন্য বেশ কিছুদিন ভিন গাঁয়ে ছিলেন।

তারপর বিভূতি পড়তে যান রাখাল বাড়ুজ্যের পাঠশালায়। এরপর আপার প্রাইমারিতে ভর্তি হন গোপালনগরের গগন পালের ইউপি স্কুলে। তাঁর বাবা মহানন্দও এই স্কুলে অস্থায়ীভাবে দ্বিতীয় প–তের পদে নিযুক্ত হন। সালটি ছিল ১৯০৫। এই স্কুলে যাতায়াতের সময় পলিস্নপ্রকৃতির সান্নিধ্য পান ও তার রূপটি বিভূতির কাছে নতুনভাবে ধরা দেয়। আপার প্রাইমারিতে পড়ার সময়ই তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায় এবং পাঠ্যবইয়ের অনেক কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় মুখস্থ হয়ে যায়।

পঞ্চম শ্রেণিতে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন বনগাঁ হাই ইংলিশ স্কুলে। সালটি ছিল ১৯০৮। ওই স্কুলে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে। তিনি বিভূতির অর্থনৈতিক সংকটে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। সাহায্য ছাড়া যে তাঁর অন্য গতিও ছিল না। কারণ, তাঁর বাবা মহানন্দ মুখোপাধ্যায় মারা যান ১৯১১ সালে। বিভূতি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। এ-সময় অবশ্য বিভূতি নিচের ক্লাসের দু-একজন ছাত্রও পড়াতেন। মেধাবী ছাত্রটি শুধু পাঠ্যবই নিয়ে বসে থাকতেন না, পাঠ করতেন স্কুল-পাঠাগারের বই, কারো কারো বাড়িতে রাখা প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বঙ্গবাসী, হিতবাদী, বসুমতী প্রভৃতি পত্রিকা।

শুধু তাই নয়, চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সেই পাঠ সম্পন্ন হয়েছিল – বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সব নভেল, বঙ্কিম, রমেশচন্দ্র, দীনবন্ধু প্রমুখের বইসহ অখ্যাত ও অজ্ঞাতপরিচয় অনেক লেখকের বই। শুধু গল্প, উপন্যাস নয়, আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিল তাঁর ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বইয়ের প্রতি। ১৯১৪ সালে বিভূতি বনগাঁ হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে পড়তে গিয়েছিলেন কলকাতায়। কলকাতা রিপন কলেজ থেকে ১৯১৬ সালে এফএ (আইএ) পাশ করেন প্রথম বিভাগেই। এ সময়ও তিনি আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন। তাকে সহায়তা করেছে তার ছোট মামা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, বন্ধু সুরেন ও বিজ্ঞান কলেজের আচার্য প্রফুলস্নচন্দ্র রায়। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময়ও তিনি নতুন নতুন লেখকের বই পাঠ করেন। উলেস্নখযোগ্য নতুন লেখক হচ্ছেন – গিবন, মমসেন, বিউরি, লর্ড অ্যাক্টন প্রমুখ। ইতিহাস, দর্শন, ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত লেখকদের বেশিরভাগ বই তাঁর পড়া হয়ে গিয়েছিল।

১৯১৮ সালে বিভূতি ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। কিন্তু বিএ পড়ার সময়েই তিনি তাঁর পৈতৃক এলাকা পানিতরের গৌরীকে বিয়ে করেন। পড়ার খরচ মেটাবেন তাঁর শ্বশুর, এটিই ছিল বিয়ের অন্যতম কারণ। কিন্তু গৌরীর আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। এভাবেই তাঁর শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে। যদিও তিনি দর্শনে এমএ ভর্তি হয়েছিলেন। গৌরী ও তার ছোটবোন সরস্বতীর মৃত্যুর পর পস্ন্যানচেট চর্চা ও পরলোকতত্ত্বের সাধনায় বিভূতির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।

শিক্ষাজীবন এভাবেই শেষ করে মেস-বন্ধু বৃন্দাবন সিংহ রায়ের পরামর্শে হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়ায় দ্বারকানা হাই স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বন্ধু ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

চাকরিজীবন এভাবেই শুরু হয় স্কুলের শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু গ্রাম্য রাজনীতির খপ্পরে পড়ে বিভূতি ও তাঁর বন্ধু স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯১৬ সালের ৭ ফেব্রম্নয়ারি যোগদান করে মাত্র এক বছর তিন মাস এখানে শিক্ষকতায় ছিলেন। অর্থাৎ ১৯২০ সালে ৩১ মে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।

আচার্য প্রফুলস্নচন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় কলকাতার দক্ষক্ষণে হরিনাভি অ্যাংলো স্যানসক্রিট ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতায় আবার যোগ দেন ১৯২০ সালের ১ জুলাই। হরিনাভি স্কুলে শিক্ষকতার সময় তিনি কলকাতায় এসে পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। তিনি তখন থাকতেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র লাহিড়ীর শ্বশুর নগেন্দ্রনাথ বাগচীর রাজপুরের খালি বাড়িতে। এ সময় মা এসেছিলেন ছেলের সেবার জন্য। কিন্তু এখানে এসে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। সঙ্গে এসেছিল ছোট ভাই নুটু। মায়ের মৃত্যু হয় ১৯২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। হরিনাভি স্কুলও তাঁর জন্য স্থায়ী হয়নি। ১৯২২ সালের ১৭ জুলাই তিনি এ স্কুল থেকে বিদায় নেন।

তবে এখানে থাকতেই তাঁর লেখক-জীবনের শুরু হয়। প্রবাসীতে তাঁর প্রথম গল্প ‘উপেক্ষক্ষতা’ ছাপা হয় ১৪ জানুয়ারি ১৯২২ সালে। লেখা ছাপার পেছনেও রয়েছে আরেক গল্প সুব্রত বড়ুয়া এদিকটি তুলে ধরেছেন।

হরিনাভি স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিভূতি আবার কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ওঠেন ৪১নং মির্জাপুর স্ট্রিটের মেস বাড়িতে। চাকরি ছেড়ে আসার এবং
লেখক-জীবনের শুরুরও রয়েছে ঘটনা। ঘটনাদুটির সমাপ্তি এখানেই যে ঘটে যায় তারও বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। চাকরির প্রথম পর্বটা ছিল শিক্ষকতার। দ্বিতীয় পর্বটা অবশ্য ভিন্ন ধরনের। লেখকের বর্ণনা এক্ষেত্রে উলেস্নখ করছি, ‘এবার অবশ্য চাকরিটা একটু ভিন্ন ধরনের। মাড়োয়ারি কোটিপতি ব্যবসায়ী কেশোরাম পোদ্দারের গো-রক্ষণী সভার প্রচারকের চাকরি। আগে বক্তৃতা দিতেন শ্রেণিকক্ষক্ষ ছাত্রদের সামনে, এবার বক্তৃতা দিতে হবে দেশ ঘুরে ঘুরে সাধারণ শ্রোতা-মানুষদের সামনে
গো-জবাইয়ের বিরুদ্ধে’ (পৃ ৩২)।

শিক্ষকতা-জীবনের অবসান ঘটিয়ে তিনি চাকরি নেন ১৯২২ সালে কেশোরাম পোদ্দারের ‘গো-রক্ষণী সভা’র প্রচারক হিসেবে ছমাসের চাকরি। তিনি প্রচারণায় প্রথমে নামেন কুষ্টিয়ায়। তারপর একে একে ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, চাটগাঁ, কক্সবাজার, মংডু, সীতাকু–র চন্দ্রনাথ মন্দির, ত্রিপুরার আগরতলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী প্রভৃতি স্থানে। তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন কখনো ট্রেনে, কখনো স্টিমারে। যদিও তিনি বিশেষ প্রচারণায় বিভিন্ন স্থানে বেড়িয়েছেন, প্রচারণাও তার মুখ্য হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতি আর মানুষকে তিনি উপলব্ধি করেছেন গভীরভাবে। ভ্রমণ দিনলিপি অভিযাত্রিকে তিনি লিখেছেন, ‘দেশ বেড়িয়ে যদি মানুষ না দেখলুম, তবে কি দেখতে বেরিয়েচি?’

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন তাঁকে মুগ্ধ করেছে, তেমনি অদ্ভুত ধরনের মানুষ আকৃষ্ট করেছে। চাঁদের পাহাড় নামক কিশোর উপন্যাসের ডিয়োগো আলভারেজ নামের চরিত্রটি সেই অদ্ভুত ধরনের মানুষের প্রতিনিধিস্থানীয় চরিত্র। এরও বর্ণনা দিয়েছেন সুব্রত বড়ুয়া।

‘গো-রক্ষণী সভা’র চাকরি শেষে তাঁর আবার কলকাতা ফেরা। ১৯২৩ সালে ‘মৌরীফুল’ গল্পের জন্য প্রথমবার পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং পাথুরে ঘটার জমিদার খেলাতচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর খেলাত ঘোষ এস্টেটের ভাগলপুর জঙ্গলমহালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে ভাগলপুরে অবস্থানকালে তাঁর লেখক-জীবনের রূপান্তর ঘটে। এদিকটিকে গুরুত্বের সঙ্গে সুব্রত বড়ুয়া অবলোকন করেছেন এবং পাঠককে বিভূতির লেখকজীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে গেছেন।

১৯২৬ সালের ৩ এপ্রিল বিভূতির পথের পাঁচালী লেখার সূচনা হয়। ভাগলপুরের জঙ্গলমহাল থেকে কলকাতায় ফিরে আসার প্রায় দশ বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর আরণ্যক উপন্যাস। সুব্রত বড়ুয়া একটি লাইনের মধ্যে এ-উপন্যাসের মূল্যায়ন করেছেন এভাবে – ‘যেখানে জঙ্গলমহালের প্রকৃতি ও জীবন প্রতিফলিত হয়েছে নিবিড়ভাবে’ (পৃ ৩৮)।

এস্টেটের কাজের মধ্যে ছিল তাঁর ‘জঙ্গল আবাদ, জমির বিলি বন্দোবস্ত, তহসিলের তহবিল ঠিক রাখা, মাইলের পর মাইল ঘোড়ার পিঠে ঘুরে ঘুরে মহলের তদারকি।’

যে পথের পাঁচালীর সূচনা হয়েছিল ১৯২৬ সালে, তা বিচিত্রায় ১৯২৮ সালের জুলাই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে।

তথ্যসমৃদ্ধ এ-গ্রন্থটিতে সুব্রত বড়ুয়া খুঁটিনাটি বিষয়বস্ত্তও তুলে এনেছেন, যা গবেষক ও শিক্ষার্থীদের কাজে আসবে। যেমন পথের পাঁচালীর প্রথম খসড়ায় দুর্গা চরিত্রটি ছিল না, তা গোপা দত্ত ভৌমিক সূত্রে উলেস্নখ করেছেন জীবনীকার। পথের পাঁচালী লিখতেও যে প্রায় দুবছর সময় লেগেছিল, তারও বর্ণনা আছে। পথের পাঁচালীর যে তিনটি পর্ব, তারও সংক্ষক্ষপ্ত আকারে মন্তব্য করেছেন সুব্রত বড়ুয়া।

ভাগলপুর থেকে বিভূতি কলকাতায় আসার জন্য ঠিক করেন চাকরি ছেড়ে দেবেন। হলোও তাই, ১৯২৯ সালে তিনি পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসেন। তবে ধর্মতলা নতুন করে গড়ে তোলা খেলাতচন্দ্র ক্যালকাটা ইনস্টিটিউশনের শিক্ষকতায় যুক্ত হতে হলো।

এখানে এসে পথের পাঁচালীর পরবর্তী আখ্যান অপরাজিত উপন্যাস লিখলেন। অবশ্য অপরাজিতর পূর্বনাম ছিল আলোক সারথি।

প্রসঙ্গক্রমে অন্যান্য উপন্যাসসহ মেঘমলস্নারমৌরীফুল গল্পগ্রন্থসহ অন্যান্য গল্পগ্রন্থ প্রকাশের দিকেও নজর রেখেছেন লেখক। কথাশিল্পী সুব্রত বড়ুয়া যথার্থই বলেছেন, ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশিত হওয়ার পরই বাংলা কথাসাহিত্যে নতুন প্রতিভা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। ‘অপরাজিত’ প্রকাশিত হওয়ার পর সে খ্যাতি আরো বিসত্মৃত হলো। তারপর দু’খানি বই নিয়ে হই-হই। লেখককে নিয়ে টানাটানি, অভিনন্দন, সভা-সমিতিতে সম্বর্ধনা, আলোচনা-সমালোচনা, পত্রপত্রিকায় লেখালেখির ঝড়। এ-রকম নগদপ্রাপ্তির আর নজির নেই বাংলাদেশে।’ (পৃ ৪৯)।

সুপ্রভা দত্ত নামের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রীর সঙ্গে বিভূতির পরিচয় হলেও পরিণয় ঘটেনি। সুপ্রভা দত্তের সংক্ষক্ষপ্ত পরিচয়ও লেখক তুলে ধরেছেন। বিভূতি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সাতচলিস্নশ বছর বয়সে ১৯৪০ সালের ৩ ডিসেম্বর। স্ত্রীর নাম শ্রীমতী কল্যাণী।

প্রথম স্ত্রী ও দ্বিতীয় স্ত্রীর পাশাপাশি আরো দুটি মেয়ে খুকু ও সুপ্রভাও বিভূতির জীবনে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল। এদিকটিতেও আলো ফেলেছেন জীবনীকার।

মোট কথা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও সৃষ্টিকর্মের চমৎকার সরল পাঠ এবং প্রথার বাইরে বিবেচনা-গ্রন্থটিকে অন্য রকমের নতুন ধারায় মূল্যায়নের কথা ভাবায়।

গ্রন্থটিতে উঠে এসেছে বন্ধুদের সহযোগিতার কথা। শিক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতার কথা, যা পূর্বে উলিস্নখিত হয়েছে। বন্ধু নিরোদ চৌধুরী, আড্ডার অন্যতম সদস্য অমরেন্দ্রনাথ দাসও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন।

বন্ধু নিরোদ চৌধুরীসহ অন্য বন্ধুদের মূল্যায়ন ছাড়াও উদ্ধৃতি হিসেবে সুব্রত বড়ুয়া যেসব লেখকের বর্ণনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা খুবই অর্থবহ। বিশেষ করে কিশলয় ঠাকুরের পথের কবি, রুশতী সেনের বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিভূতিভূষণ : দেশে-বিদেশেবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি লেখা।

প্রাসঙ্গিকক্রমে বিভূতির রয়েছে পঁচিশটি গল্প, এগারোটি কিশোর-রচনা অনুবাদ দুটি, অন্যান্য রচনা পাঁচটি। দিনলিপি, ভ্রমণ দিনলিপির উদ্ধৃতি দিয়েছেন খুব সহজ-সরল ভাষায়।

গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি। r