বিশালত্বের ব্যঞ্জনা

সৈয়দ আজিজুল হক

শিল্পী রফিকুন নবীর (জ. ১৯৪৩) একক প্রদর্শনী মানেই একেকটি বিস্ময়। সেটা যখন তিনি একটিমাত্র টোকাই চরিত্র নিয়ে শিল্পপ্রদর্শনী করেন (২০০৪) তখন যেমন দর্শক এর নান্দনিকতায় বিস্মিত হয়, তেমনি যখন তিনি চারকোলের সাহায্যে রেখাচিত্র এঁকে প্রতিটিকে পূর্ণাঙ্গ শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করে প্রদর্শনীর আয়োজন করেন (২০১০) তখনো দর্শকের বিস্ময়ের অবধি থাকে না। এবার ঢাকা আর্ট সেন্টারে তাঁর দশম একক চিত্রপ্রদর্শনীতে (১২-৩০ এপ্রিল ২০১৩) আরেক বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। এ প্রদর্শনীর প্রায় সব চিত্রই তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বড় মাপের ও অবয়বধর্মী; কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি আছে বিশালাকৃতির। এখন তাঁর বয়স সত্তর। বয়সের এমন একটি প্রান্তে এসে বহুসংখ্যক অবয়বের সমাহার ঘটিয়ে, শিল্পগুণ অক্ষুণ্ণ রেখে, এমন বিশালাকারের ক্যানভাসকে শিল্পরসে জারিত করার মধ্যে যে অসামান্য শক্তি ও সাহসের পরিচয় নিহিত, সেটাই দর্শককে বিস্ময়ে অভিভূত করেছে।

সবচেয়ে বড়ো ছবিটির আকার ১০ফুট x ৬ ফুট, আরেকটি ৮ ফুট x ৬ ফুট, একটি ৬ ফুট x ৬ ফুট। এরকম বিশালায়তনের ছয়টি ছবির প্রতিটির জন্য একেকটি পুরো দেয়াল ছেড়ে দিতে হয়েছে। এর প্রতিটিতেই আবার রয়েছে অনেক অনেক অবয়বের এক সুচারু বিন্যাস। রয়েছে প্রকৃতির বিশাল পটভূমিতে জীবনকে উপলব্ধির এক দার্শনিক প্রত্যয়। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও জীবনের নিবিড় সম্পর্কের দ্যোতনাও তৈরি হয় দর্শকমনে। অবয়বের সংস্থানের জন্য তিনি চিত্রের জমিনকে যেভাবে বিভাজন করেন, তাতেও পরিসরের ক্ষেত্রে বিশালত্বের ব্যঞ্জনাটি নতুন মাত্রা লাভ করে।

এ প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড়ো চিত্রটির শিরোনাম : ‘বিশ্রামরত ধীবরকুল’। চিত্রটির দিকে তাকালে শুধু ক্যানভাসের বিশালত্বই আমাদের চমৎকৃত করে না, চিত্রতলে বিন্যস্ত বিষয়ের বিশালত্বও আমাদের মুগ্ধ ও বিমোহিত করে। সামনে দিকচিহ্নহীন বিশাল সমুদ্র, তার মধ্যে দূরে দু-একটি মাছধরা নৌকার আবছা আভাস, তারপর সীমাহীন শূন্যতা নিয়ে নীল আকাশ। এরূপ পটভূমিতে সমুদ্রতীরে এসে ভিড়েছে কয়েকটি মাছধরা নৌকা। সেসবের আরোহী ধীবরকুল বিশ্রামরত। কেউ সটান শুয়ে পড়েছে – তার মধ্যে কেউ ঘুমিয়ে গেছে, কেউ হুঁকা টানছে, কেউ হাতে তুলে নিয়েছে বাঁশি, আবার কেউ তাস নিয়ে গভীর মনোযোগে জয়-পরাজয়ের প্রতিযোগিতায় বিভোর। শ্রমজীবী বাঙালিজীবনের এমন একটি খন্ডমুহূর্তকে শিল্পী এক শাশ্বত রূপ দিয়েছেন, এখানেই তাঁর সার্থকতা। শায়িত ও উপবিষ্ট অনেকগুলো অবয়বের বিন্যাসগত নৈপুণ্য এবং তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত রূপ প্রদানের কৃতিত্ব প্রভৃতি শিল্পীর গভীর ও পরমসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণেরই ফল। এই পর্যবেক্ষণের পরিচয় পাওয়া যায় সমুদ্রের রূপসৃষ্টির বাস্তবতায়ও। এই চিত্রের পুরোভাগে অবয়বের বিন্যাসে এবং নৌকার উপরিভাগ ও পার্শ্বদেশে বাস্তবতার প্রয়োজনেই ঘটেছে নানা রঙের আগমন; কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই চিত্রের পটভূমির আকাশে শুধু নীল ও মধ্যভাগের সমুদ্রপৃষ্ঠে শুধু সাদা রঙের প্রলেপ। অথচ সমুদ্রের পানিতেও আমরা সবসময় নীলেরই প্রাচুর্য দেখতে পাই; কিন্তু দিবাভাগের মেঘমুক্ত আকাশে সূর্যের আলোর একচ্ছত্র আধিপত্যে সমুদ্রজল থেকে নীল উধাও হয়ে যায়, চোখের দৃষ্টিতে তখন শুধু সাদারই প্রাধান্য। শিল্পীর স্বভাবজাত পর্যবেক্ষণের নিবিড়তায় সে-বাস্তবতা চিত্রে বিধৃত হয়েছে। নৌকার উপরিতলে বর্ণলেপনে শিল্পী অতিশয় সহজ-সাধারণ প্রক্রিয়ার অনুসরণ করলেও তাতে ওরই মধ্যে পরিস্ফুটিত হয়েছে গভীরতর ব্যঞ্জনা। যেমন, দূর থেকে দেখলে মনে হবে, শিল্পী নানা সূক্ষ্ম কারুকাজের মধ্য দিয়ে বিচিত্রধর্মী টোনাল ভেরিয়েশন সৃষ্টি করেছেন। অবয়ব সংস্থান কৌশল এবং সমগ্র চিত্রতলের বিভাজনগত বিন্যাসেও স্ফুরিত হয়েছে শিল্পীর নান্দনিকতার সুউচ্চ বোধ। সাধারণত অনেকগুলো অবয়বের আগমন ঘটালে কোনো চিত্রতল ভরাট হয়ে ওঠে এবং পরিসরের সংকীর্ণতা দর্শকের দৃষ্টিকে পীড়া দেয়। কিন্তু এ-চিত্রে এতগুলো অবয়বের বিন্যাসের পরও দেখা যায়, পরিসরের সংকীর্ণতা তো ঘটেইনি বরং চিত্রতলে পরিসর যেন আরো বেড়ে গেছে। এখানেই শিল্পীর উন্নত নান্দনিক চেতনার প্রকাশ আমরা লক্ষ করি। তিনি অবয়বকে চিত্রতলের এমন একটি অংশে বিন্যস্ত করেছেন এবং সমুদ্র, আকাশ ও উপকূলভূমির জন্য চিত্রতলের এতটা অংশ উন্মুক্ত রেখেছেন, যাতে পরিসরের বিশালতার এ-বোধটি দর্শকচিত্তে সহজেই সঞ্চারিত হয়।

এই প্রদর্শনীতে সমুদ্রসংশ্লিষ্ট বা জল-অধ্যুষিত চিত্র আছে আরো সাতটি। তার মধ্যে বৃহদাকৃতির চিত্র ‘মৎস্যজীবী’ ও ‘সমুদ্র সৈকত-২’। এছাড়া আছে ‘শ্রমক্লান্ত জেলে’, ‘সমুদ্র সৈকত-১’, ‘টেকনাফ’,  ‘শ্রীলঙ্কার গলে’ ও ‘ফেরির জন্য অপেক্ষা’। ‘মৎস্যজীবী’ চিত্রটিতে সমুদ্রের পটভূমিতেই অঙ্কিত হয়েছে জেলেদের মৎস্য শিকারের একটি দৃশ্য। জাল ও মাছ ঘিরে অবয়বগুলোকে বৃত্তাকারে বিন্যাসের মধ্যে ফুটে উঠেছে শিল্পীর অঙ্কনদক্ষতা ও সুচারু পরিকল্পনার পরিচয়। মাছের সঙ্গে জেলেদের অন্তরঙ্গতা সৃষ্টিতেও চিত্রটি বিশেষত্বমন্ডিত। নীল জলে ঘেরা মৎস্যশিকারিদের জীবনচিত্রটি চিত্রতলে অনুরূপ প্রতীকী বিন্যাসে অর্থময়। জালের মধ্যে মাছের অবস্থান চিহ্নিত করতে শিল্পী যথার্থভাবে আলোর প্রক্ষেপণ ঘটিয়েছেন। ‘সমুদ্র সৈকত-২’ চিত্রটিও সমুদ্রের পটভূমিতে জেলে, জাল ও নৌকার বিন্যাসে স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। সৈকতভূমে জালসহ জেলে এবং সমুদ্রজলে নৌকাসহ জেলে এই দুই অংশের বিপরীত বিন্যাসে এক ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি করেছেন শিল্পী। উল্লম্ব প্রকৃতির এই চিত্রের পুরোভাগে হলুদাভ সৈকতভূমে সামুদ্রিক পাখির ঝাঁক, মধ্যভাগে সমুদ্রজলের সাদাটে বিস্তার এবং পটভূমিতে মেঘাবৃত আকাশে কালো, ধূসর ও ঝাপসা নীলের সমারোহ। পুরোভাগে কালো জালের সঙ্গে পটভূমির কালো মেঘ এবং মধ্যভাগে সমুদ্রজলে নৌকার কালো ছায়া প্রভৃতির মাধ্যমেও শিল্পী চিত্রতলে এক ভারসাম্য রক্ষা করেছেন।

‘শ্রমক্লান্ত জেলে’ চিত্রটিতে নীলরঙের মাধ্যমে শিল্পী এঁকেছেন জ্যোৎস্নাবিধৌত সমুদ্রসৈকতের এক অসাধারণ রূপ। সৈকতভূমি, সমুদ্রজল ও আকাশ সর্বত্রই নীলের প্রবাহ, এবং ওই প্রবাহের মধ্যেই চাঁদের আলোরও এক স্নিগ্ধ মধুর পরশ। নীল রঙেরই নানা টোন সৃষ্টির মাধ্যমে শিল্পী চন্দ্রালোকিত রাত্রির এক মিস্টিক অনুভূতি সঞ্চার করেছেন এ-চিত্রে। সমুদ্রতীর সংলগ্ন নৌকার কোনোটিতে জেলে ঘুমাচ্ছে, কোনোটিতে তারা উপবিষ্ট হয়ে গল্প করছে। নৌকার এ-দৃশ্যটি যেহেতু কাছের, সেহেতু এখানকার জ্যোৎস্না তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ। অন্যদিকে দূরবর্তী স্থানগুলোর আলোতে এসেছে স্বাভাবিকভাবে অস্বচ্ছতা। জ্যোৎস্নার এই স্বচ্ছ ও অনচ্ছ রূপ অঙ্কন করে শিল্পী তাঁর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের নিগূঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। ‘সমুদ্রসৈকত-১’ চিত্রটিতেও নীলেরই সমারোহ। অথচ এ নীল আর আগের চিত্রটির মতো জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রির স্নিগ্ধতা প্রকাশ করছে না। এ নীল দিবালোকে সমুদ্রজল ও আকাশের নীলেরই বাস্তবতা নিয়ে এসেছে চিত্রটিতে। এ চিত্রে মূলত কল্লোলিত হচ্ছে সমুদ্রজলেরই সীমাহীন নীল। একই নীল রঙের ব্যবহার ঘটিয়ে দুই চিত্রে দুটি ভিন্নতর আবহ সৃষ্টির এই সার্থক প্রয়াসে শিল্পীর শক্তিমত্তার পরিচয় মেলে।

‘টেকনাফ’ চিত্রটিতে লক্ষণীয় পাহাড়, সমুদ্র ও আকাশের এক যৌক্তিক বিস্তার। জলরঙের চিত্র অঙ্কনে শিল্পীর মুনশিয়ানার স্বাক্ষর এখানেও সমভাবে বর্তমান। জলরঙের পরিমিত ও পরিকল্পিত ওয়াশের মাধ্যমেই যেমন তিনি ফুটিয়ে তোলেন ঊর্মিচঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠে ভাসমান নৌকার দৃশ্য, তেমনি থমথমে আকাশের নীলাভ রূপ। রঙের সৌকর্যেই সৃষ্টি হয় সমুদ্রের স্নিগ্ধ রূপের ব্যঞ্জনা, সৃষ্টি হয় আকাশ ও পাহাড়ের বৈপরীত্যের মধ্যে এক নিবিড় ভারসাম্য। ‘শ্রীলঙ্কার গলে’র সমুদ্রসৈকতের দৃশ্যরূপেও দুই বিশাল পাথরখন্ডের ওপর আছড়েপড়া ঢেউ জলের যে-উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে, তারই চিত্র এঁকেছেন শিল্পী। শিল্পীর মনের উচ্ছ্বাসও যেন এমন দৃশ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম হয়ে পড়েছে। ‘ফেরির জন্য অপেক্ষা’ শীর্ষক চিত্রেও একই রূপে জলের বিস্তার। তবে এ-জল শান্ত, নদীতীরলগ্ন। শিল্পীর সুন্দরবন ভ্রমণের অভিজ্ঞতাজাত হলেও এরূপ দৃশ্যে মানুষের পারাপার তথা বাঙালিজীবনের এক শাশ্বত রূপই অভিব্যক্ত, যেখানে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য তাকে চিরদিন শুধু প্রতীক্ষাই করে যেতে হয়।

সমুদ্র ও জলের বিপুল বিস্তারের দৃশ্যসংবলিত এসব আখ্যান রচনার পাশাপাশি রফিকুন নবী এঁকেছেন পাহাড়ের দৃশ্য। এখানে শিল্পীর দৃষ্টি আনুভূমিকভাবে বিস্তৃত না হয়ে লতিয়ে উঠেছে উল্লম্বভাবে। ‘সীতাকুন্ড’ ও ‘পার্বত্য উপত্যকা’ শীর্ষক চিত্রদ্বয়ে পরিস্ফুটিত হয়েছে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের নিসর্গদৃশ্য। সীতাকুন্ড পাহাড়ের পাদদেশ বরাবর সবুজ প্রকৃতির মধ্যে ট্রেনযাত্রার দৃশ্যটি বড়ো মনোহর। এ চিত্রে ফুটে উঠেছে স্থিতি ও গতির বৈপরীত্য। অচল পর্বতের পটভূমিতে জীবনের সচলতা। আমাদের সমতলভূমির এই দেশে পার্বত্য প্রকৃতি নিয়ে যে-মুগ্ধতা আছে, চিত্রটির সামনে দাঁড়িয়ে দর্শক তা উপলব্ধি করতে পারে। অন্য চিত্রটিতেও দৃষ্টির উল্লম্ব বিস্তারের বিশালতার পরিপ্রেক্ষিতে উপত্যকা ঘিরে পার্বত্য প্রকৃতির সৌন্দর্যসন্ধানই শিল্পীর লক্ষ্য। বাস্তবে সমুদ্র, আকাশ ও পর্বতের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ মহাবিশ্বের অসীমতাকে যেরূপ উপলব্ধি করে, এসব চিত্রও দর্শককে সেরূপ অনুভূতির সামনে নিয়ে দাঁড় করায়।

পাহাড়ের স্থির অচঞ্চলতার বিপরীতে ট্রেন গতিশীলতার প্রতীক। সেই গতিময়তার সঙ্গে জীবনের যোগ বড়ো নিবিড়। মানবজীবন তথা মানবসভ্যতার চলমানতাকেই তা প্রতীকায়িত করে। শিল্পীর লক্ষ্য মূলত মানবজীবনের ওই নিরবচ্ছিন্ন চলিষ্ণুতাকে দৃশ্যবদ্ধ করা। সে-উদ্দেশ্যে যেমন খেয়াপারে প্রতীক্ষারত যাত্রীদের ছবি চিত্রিত হয়, তেমনি ট্রেনের জন্য রেলস্টেশনে অপেক্ষারত মানুষের চিত্রও সজীব হয়ে ওঠে। ‘প্ল্যাটফরম’ শীর্ষক ছবিতে চিত্রিত হয়েছে পরস্পর-অপরিচিত বহু পরিবারের যাত্রীকালীন নিবিড় সম্পর্কের বিষয়টি। চলমান এই জীবন মুখর হয়ে ওঠে বাসের ভেতরে কিংবা ছাদে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার দৃশ্যেও। বিপুল জনসংখ্যা-অধ্যুষিত বাংলাদেশের এই নিষ্ঠুর বাস্তবতাকেই শিল্পী মূর্ত করে তুলেছেন ‘ছাদের যাত্রী’ শীর্ষক চিত্রে। ট্রেন-বাস তো এসেছে আধুনিককালে; কিন্তু আমাদের চিরায়ত যাতায়াতের গ্রামীণ মাধ্যম গরু-মোষের গাড়ি। ‘মোষের গাড়ি’ শীর্ষক চিত্রে অঙ্কিত হয়েছে একটি পরিবারের ভ্রমণের ছবি। গাড়ির বস্ত্রাচ্ছাদিত অভ্যন্তরভাগ থেকে কৌতূহলী বধূর বাইরের চলমান জীবনকে দেখার প্রয়াস, গাড়ির পেছনে-বসা বালকদ্বয়ের সবকিছু পর্যবেক্ষণের আনন্দলাভ, পুরুষ-যাত্রীটির গাড়ির সঙ্গে হেঁটে-চলা প্রভৃতি একান্তভাবে বাস্তবতারই চিত্রায়ণ। তবে শিল্পীর কৃতিত্ব হলো, মোষসহ গাড়ির দৃশ্যায়নে এর নকশাগুণ বৃদ্ধির অভিপ্রায়ে, চিত্রের সৌন্দর্যসৃষ্টির অন্তর্তাগিদে, বাস্তবের ফর্ম ভেঙে তিনি একে একটি নিজস্ব জ্যামিতিক রূপ দানের চেষ্টা করেছেন। ফর্ম ভাঙার বা নতুন ফর্ম সৃষ্টির এই প্রয়াসটি ‘সুখী ভ্রমণ’ শীর্ষক চিত্রেও লক্ষণীয়। পুত্রকে সামনে ও কন্যাকে পেছনে বসিয়ে এক পিতার সাইকেলযাত্রার চিত্রটিকেও বিন্যাস করা হয়েছে জ্যামিতিক ফর্মে। অবয়ব সংস্থাপনের ক্ষেত্রেও শিল্পী চিত্রের বাস্তবতার সঙ্গে নিজস্ব রসবোধের মিলন ঘটিয়েছেন।

‘মোষের গাড়ি’ কিংবা ‘সুখী ভ্রমণ’ চিত্রে পরিবারজীবনের যে-অন্তরঙ্গতা দৃশ্যায়িত হয়েছে তারই সূত্রে আলোচিত হতে পারে ‘পরিবার’ শীর্ষক চিত্রটি।  কেননা, সন্তানপরিবৃত এক দম্পতির সুখী জীবনচিত্র হিসেবে ছবিটি তাৎপর্যপূর্ণ। দুই পুত্র ও এক কন্যাকে নিয়ে ওই দম্পতির এক বিজড়িত আনন্দঘন মমতাময় মুহূর্তকে শিল্পী এ-চিত্রে দৃশ্যবদ্ধ করেছেন। তাদের আনন্দ ও অন্তরঙ্গতার বিষয়টি শারীরিক ভাষার মধ্য দিয়েও প্রকাশিত। অবয়বসংস্থান কৌশলেই শিল্পী পারস্পরিক সম্পর্কের নিবিড়তাকে পরিস্ফুটিত করেছেন। অবয়বের বিন্যাসে, শিশুর সারল্যে, বালকবয়সের ক্রীড়ামোদে একটি সার্বিক আনন্দঘন পরিবেশ রচিত হয়েছে। পরিবারজীবনের এরূপ চিত্র রফিকুন নবীর খুবই প্রিয় একটি বিষয়। এ-চিত্র তাঁর ব্যক্তিজীবনেরই বাস্তব প্রতিফলন কিনা সে-প্রশ্ন উত্থাপন করারও যৌক্তিক কারণ আছে। বাস্তবে তিনিও দুই পুত্র ও এক কন্যার জনক। আসলে আদর্শগত দিক থেকে শিল্পী মানবসম্পর্কের এই ক্ষেত্রটিতেই প্রকৃত আনন্দের সন্ধান করেন, সেটাই বড়ো কথা। ‘দুই বোন’ শীর্ষক চিত্রেও এই একই আনন্দের বার্তা, একই আদর্শের প্রতিধ্বনি। একদিকে হাতে শান্তির পায়রা, আরেকদিকে মুক্ত বাতায়নপথে কিশোরী-তরুণীর চোখ। মুক্ত বিহঙ্গীর মতো উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছাদীপ্ত মনেরই বহিঃপ্রকাশ যেন।

শিল্পীর প্রিয় টোকাই-চরিত্রও শিল্পের বিষয় হিসেবে এখানে আদৃত। ‘টোকাই-১’, ‘টোকাই-২’, ‘পথশিশু’ প্রভৃতি চিত্র ছাড়াও ‘প্ল্যাটফরমে’ টোকাইয়ের সন্ধান মেলে। বস্তা-কাঁধে, ফুটপাতে কিংবা দেওয়ালের ওপরে, কখনো বাঁশিমুখে তাদের জনকোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থানের মধ্যে প্রান্তিক জীবনবৈশিষ্ট্যটি ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট থেকেছেন শিল্পী। এই প্রান্তিকতার সঙ্গেই যেন নাগরিক জীবনে কাকের এক অবিচ্ছেদ্য নিবিড় সম্পর্ক। যেখানেই টোকাই, সেখানেই কাক – এই অবিচ্ছিন্নতা চিত্রের জমিনে মূর্ত হয়েছে।

শুধু কাক নিয়ে একটি স্বতন্ত্র চিত্র আছে ‘সমাবেশ’ নামে। এটি যেমন কাকের চিত্র, তেমনি একটি নকশাচিত্রও বটে। এর নকশাগুণটিই প্রধান। অনেকগুলো কাককে তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ও বিচিত্র ভঙ্গি ও অভিব্যক্তিসহ এ-চিত্রে বিন্যস্ত করার মাধ্যমে শিল্পী তাঁর নান্দনিক সৌকর্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। এমনই বিরচন-কৌশলের উন্নত চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় তিনটি ছাগশিশুসহ ‘ছাগমাতা’র চিত্রটিতে। ছাগমাতার সঙ্গে পরম মমতায় সংলগ্ন  করে শিশুত্রয়কে বিন্যস্ত করার নৈপুণ্যটিই এ-চিত্রের প্রধান দিক। একইরূপ উন্নত বিরচন-কৌশল ও নকশা-গুণসমৃদ্ধ একটি চিত্র ‘মধ্যাহ্নের মাঠে’। বরেন্দ্রভূমির এরূপ দৃশ্য রফিকুন নবীর চিত্রমালার এক প্রিয় বিষয়। এ প্রদর্শনীর দ্বিতীয় বৃহত্তম চিত্র এটি : ছটি গরু-মোষ আর তাদের রাখালদের নিয়ে এ-চিত্র। বিন্যাসগত নৈপুণ্যের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে নকশার চমৎকারিত্ব। প্রতিটি মানুষ ও প্রাণীর বিচিত্র ভঙ্গিমাকে স্বতন্ত্রভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চিত্রপট থেকে নিসর্গ ও আকাশকে সচেতনভাবে পরিহার করে সমগ্র চিত্রতলজুড়ে ভূমিলগ্ন মানুষ ও প্রাণীরই একচ্ছত্র আধিপত্যকে মূর্ত করে তোলা হয়েছে। প্রিয় জন্মস্থান বরেন্দ্রভূমির মানুষ ও প্রাণীর মধ্যেকার মমতাময় সম্পর্কের কাছে বারবার শিল্পীর নস্টালজিক প্রত্যাবর্তনের একটি ইতিহাস যেন এই চিত্রে প্রতীকীভাবে বিধৃত হয়ে আছে।

সমগ্র প্রদর্শনীর দিকে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়বে ড্রইংয়ে শিল্পী রফিকুন নবীর অসাধারণ দক্ষতার বিষয়টি। অতিসাম্প্রতিককালে (২০১২-১৩) অাঁকা এই চিত্রগুচ্ছে (সংখ্যা ২৭) অ্যাক্রিলিক ও জলরং শুধু দুটি মাধ্যমের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এ দুটি মাধ্যমেই দ্রুত কাজ করা সম্ভব। রফিকুন নবীর চিত্রাঙ্কন পদ্ধতিতে দ্রুত কর্ম সম্পাদনের বৈশিষ্ট্যটি লক্ষণীয়। জলরঙের দক্ষ শিল্পী হিসেবেই গত শতকের ষাটের দশকে শিল্পজগতে তাঁর আবির্ভাব। সুতরাং এ-মাধ্যমে নৈপুণ্য অর্জন করতে গিয়ে মাধ্যমের বৈশিষ্ট্যটিও তাঁর আয়ত্তাধীন হয়েছে। রঙের বিচিত্র ব্যবহার ও রঙের কম্পোজিশন সৃষ্টির মাধ্যমে একটি দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ রচনায় রফিকুন নবী সিদ্ধহস্ত। এ প্রদর্শনীর চিত্রমালায়ও রয়েছে তার পরিচয়। সেইসঙ্গে আছে কালো রঙের ব্যঞ্জনাদীপ্ত ব্যবহার। প্রায় সব চিত্রেই তিনি কালোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্থময় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাঁর চিত্রকে গাম্ভীর্য দান করেন। এ প্রদর্শনীর চিত্রগুচ্ছে বাস্তবধর্মিতা পরিলক্ষিত হলেও শিল্পী মোটেই বাস্তবের অনুকরণ করেননি। জীবনের নানা সময়ে অর্জিত নানা অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, আনন্দঘন রসময় রূপ প্রভৃতির স্মৃতিজারিত বিনির্মাণই তাঁর চিত্রের মূলকথা। সবই মস্তিষ্কপ্রসূত, স্মৃতিতাড়িত নতুন সৃষ্টি, নতুন পরিকল্পনা, নতুন কম্পোজিশন, প্রকৃত বাস্তবের সঙ্গে যার মিল নেই। সমকালীন সংকট, বিক্ষোভ, বিসংবাদ, রূঢ়তা ও যন্ত্রণার কোনো প্রকাশ এই চিত্রগুচ্ছে নেই; নেই কোনো কুৎসিত, কদাকার কিংবা অসুন্দরের প্রকাশ। আসলে কোনো কালেই রফিকুন নবীর চিত্রে তা থাকে না। যা আছে তা হলো সর্বকালিক জীবনচিত্র, আনন্দ ও সুন্দরের আখ্যান। কদর্য বিষয় থেকে তিনি যে ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ ফিরিয়ে থাকেন তা নয়, ওটা তাঁর জীবনানুভূতিকে একেবারেই স্পর্শ করে না। সে-কারণে তাঁর চিত্রেও তার কোনো প্রতিফলন নেই। যা আছে তা হলো, সমগ্র দেশটার এক সুন্দর সুললিত রূপ। এটাই তাঁর স্বপ্ন ও জীবনবোধের মুখ্য বিষয়।