বিশ্বনাগরিকের স্থানীয় সংকট

ইনানি যখন জেটির কাছাকাছি এসে পৌঁছয়, তখন ন্যাভাল অ্যাভিনিউর দিকটা থেকে আসা কিছু ফ্লুরোসেন্ট, কিছু সোডিয়াম আর কিছু মার্কারির সম্মিলিত আলোক পুরো এলাকাটাকে একেবারে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। সল্টগোলা ক্রসিংয়ের দিক থেকেই হতে পারে একটা লং-ভেহিক্যাল গজরাতে গজরাতে চলে যায়। নভো কি রিজেন্ট কি বিমান যে-কোনো একটা পেস্নন আসেত্ম নেমে আসে রানওয়েতে। গতি এবং শব্দ মিলিয়ে বোঝা গেল মাঝারি ধরনের পেস্নন এবং অবশ্যই যাত্রীবাহী। বহুদিন পর সে এলো এদিকটায়। কী বলা যাবে একে – মিরাকল! পতেঙ্গার ছেলে ইনানি নিজের বাড়ির কাছে এলো অনেকদিন পরে এবং এলো ইউরোপ থেকে। একানববইয়ের ঘূর্ণিঝড়ে বাবা-মাকে হারিয়ে ঝড়ের তোড়ে সে কোথায় গিয়ে পড়ে। আর কোনোদিনই দেখা হয় না তার
বাবা-মার সঙ্গে। একটা বিদেশি এনজিওর বদৌলতে চাকরি জোটে। তারপর বহু কায়দাকানুন করে সে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলে একটা বিদেশি জাহাজে। মেডিটেরানিয়ান অঞ্চলের সেই জাহাজ তাকে নিয়ে যায় মাল্টায়। এখন সে মাল্টার নাগরিক। ইতালীয় সিসিলির দক্ষক্ষণে গোজো কমিনো আর মাল্টা। এগুলোর মধ্যে সবচাইতে বড় দ্বীপ মাল্টা। চট্টগ্রামের ছেলে ইনানি এখন মাল্টাবাসী। বিশ্বাস করা কঠিনই বটে। চাকরি নিয়েছে এমভি আর্থার বলে একটা জাহাজে। মূলত ওষুধের চালান নিয়ে আসে ওদের জাহাজ। সিঙ্গাপুর, মাদাগাস্কার, সাউথ আফ্রিকা এসব দেশ ছাড়াও ছোট ছোট দ্বীপ সিসিলি, সিরাকুজ, কর্সিকা, মেসিন্না, সার্দিনিয়া সবই খানিকটা করে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তার। শৈশবের বন্ধু খুরশিদকে সে খুঁজে পেয়েছে এই বিশ^-পর্যটনের জলভ্রমির মধ্যেই। গত বছর দেখা হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। দলবেঁধে মারলায়ন দেখতে গিয়েছিল ইনানির জাহাজের লোকেরা। সেই মারলায়ন যেখানে একটা আধা সিংহ আর আধা মৎস্যকন্যার মুখগহবর থেকে অবিরাম ঝর্ণার ধারার মতো জলপ্রবাহ গলগলিয়ে বেরোতেই থাকে। অনেক লোকের ভিড়ে জায়গাটা তখন গমগমে। সেলফি তুলতে গিয়ে মারলায়ন-মূর্তিটার খুব কাছে এগিয়ে যেতেই জলের কিছুটা ছাঁট তার মোবাইল সেটের কাচে এসে পড়তেই সেটা মুছতে-মুছতে অকস্মাৎ লক্ষ করে, পাশেই তার ছোটবেলার বন্ধু খুরশিদ দাঁড়িয়ে। ওর চোখে গুচ্চির বাদামি সানগস্নাস।

আসলে সে ছিল খুরশিদই। পলিটেকনিক থেকে ডিপেস্নামা করে শেষে বহু চেষ্টা-তদবির করে নিজেকে সে বিশ্বের শ্রমবাজারের উপাদানে পরিণত করতে পেরেছে। তার চাকরি অর্কিড পস্নাজায়। সিঙ্গাপুরের গার্ডেন বাই দ্য বে-র মধ্যকার সেই পস্নাজায় পৃথিবীর প্রায় সব অর্কিড পাওয়া যায়। হলুদ, বেগুনি, গোলাপি এরকম দুর্লভ সব রঙের অর্কিড। তবে তার ডিপেস্নামা ডিগ্রির সঙ্গে অর্কিডের কোনো সম্পর্ক নেই। তাকে বলা যায় একজন বাগান পরিচর্যাকারী। থাকে লিটল ইন্ডিয়ায়। আর কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে আড্ডা দেয় মোস্তাফা সেন্টারে। ইনানির সঙ্গে দেখাটাকে দৈবই বলতে হবে। কাঠগড়ে তাদের বাড়িতে বহুবার গেছে ইনানি। সল্টগোলা থেকে কাঠগড় খুব দূরে নয়। কিন্তু বাবা-মা হারানো ইনানির সঙ্গে তার আকস্মিক বিচ্ছেদে খুরশিদ বেশ মর্মাহতই হয়ে পড়ে। অনেক খোঁজ করেও যখন আর হদিসের সম্ভাবনা নেই তখন ভাবল, একবার ফেসবুকে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আর তখনই মারলায়নের জলের ছিটকানো প্রবাহের নিচে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার শৈশবের বন্ধুর। আর সে যে কী উচ্ছ্বাস দুজনের। তারা ভুলেই যায় যে তারা বিদেশের মাটিতে। অস্ফুটে বেরোয় ইনানির কণ্ঠ থেকে – দোস্ত, তুই এ্যাডে! খুরশিদও হতভম্ব – তুই হাচা-হাচা ইনানি না? নাকি অন্য কনো ক্যা? না, সে ইনানিই এবং সানগস্নাসটা চোখ থেকে খুলে যে হাতে নিয়েছিল সে খুরশিদই। তারপর তারা সেই সন্ধ্যায় ঘুরে বেড়াল মেরিনা বে-র আলোছায়াময় মায়াবি অঞ্চলে। লেজার শো দেখাচ্ছিল রাত্রির পটভূমিতে। আর চীনা নববর্ষের উদ্যাপন চলছিল চারদিকে। ডাম্পলিং নুডল্স, মমো অন্থন আর একদম বিন থেকে গুঁড়ো করা ব্রাজিলের কালো কফি। দুই বন্ধু যেন ঈনা উদ্যাপনের ছদ্মবেশে বাংলা নববর্ষ উপভোগে মেতে উঠেছিল।

ইনানির জীবনটা খুরশিদের কাছে মনে হলো এক রহস্য আর রোমাঞ্চকর কাহিনির চাইতেও ভিন্ন। যে-ছেলে সাঁতার জানতো না বলে কখনো বাড়ির কাছের সমুদ্রে যায়নি, সে কিনা চাকরি করে জাহাজে মানে সারাক্ষণ জলের ওপর বসবাস তার। না জানলেও শিখতে তাকে হয়েছে। অনেকবার খুরশিদ তাকে বলেছে, হোটেল আগ্রাবাদে গিয়ে নন্দীবাবুকে ধরে সাঁতারটা শিখে নে। নন্দীবাবুর ছেলে থাকে ডুলাহাজারায়। একবার হাত ভেঙে শেষে ওখানকার সমেত্মাষ ডাক্তারের চিকিৎসায় ভালো হয় খুরশিদ। সমেত্মাষের পরিচিত হলো নন্দীবাবুর ছেলে মিহির। সেই ইনানি সাঁতার শিখেছে গিয়ে মাল্টায়। কোথায় হলো আগ্রাবাদ হোটেলের নন্দীবাবুর সাঁতার আর কোথায় গোজো কমিনো মাল্টার সাঁতার। গোজোতে আছে ডয়েজ্রা বে, বালুটা বে আর গোল্ডেন বিচ। তারপর ধরো যেখানটায় ও শিখেছিল – ওরা বলে মাল্টিজ আর্চিপেলাগো। মাল্টা গোজো আর কমিনো থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার বিসত্মৃত তটরেখা। সাদা বালু আর নীল জলের এক স্বপ্নিল আয়োজন সেখানে। কোথাও জলের মধ্যে পাথরের পাহাড় মাথা তুলে রয়েছে, যেনবা প্রাগৈতিহাসিক যুগের ভাস্কর্য সব। শত শত পর্যটকের ভিড়ে এলাকাটা সারাক্ষণ আন্দোলিত। কেউ রোদে শুয়ে, কেউবা ক্যানো নিয়ে ছুটে চলেছে জলের বুক চিরে। খুরশিদ তাকে একদিন খাওয়ালো বাসমতি হোটেলের ভাত-তরকারি-ফিরনি, আরেকদিন ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানি। সিঙ্গাপুরে সবই সুলভ। যে-জিনিস দেশে মেলে না, তা সিঙ্গাপুরে অনায়াসলব্ধ। বিদায়বেলায় কথা থাকলো এপ্রিলে যখন ইনানির জাহাজ ওষুধের চালান নিয়ে চট্টগ্রামে ভিড়বে, তখন দেখা হবে দুই বন্ধুর। তখন খুরশিদেরও ছুটি মিলবে সিঙ্গাপুরের অর্কিড পস্নাজা থেকে।

আজকাল লোকেরা খুব সমুদ্রে যায়। মানে সমুদ্রসৈকতে। এলাকাটা ছুটির দিন ছাড়াও মুখরিত থাকে। ইপিজেডের শ্রমিক বিদেশি কর্মী কিংবা অন্যান্য জেলার পর্যটক – আসছে আর যাচ্ছে। শহর থেকে এবং শহরের দিকে যানবাহন আর লোক চলাচলের মুহুর্মুহু ব্যস্ততা মন্দ লাগে না দেখতে। জাহাজের ভ্রাম্যমাণ
সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত ইনানির মনে হয়, এইসব ভিড়, কোলাহল আর ব্যস্ততাই আসলে তার সংস্কৃতি। মাঝে মাঝে জাহাজ থামলে, থেমে বিশ্রামের বাঁশিতে কিছুদিনের জন্যে স্থিরতা নিয়ে এলে মাল্টার নির্জন নাগরিকতার মধ্যে সে বড় উপদ্রুত বোধ করতে থাকে। মনে হতে থাকে, ভালোই ছিল গতির মধ্যে থাকা। একটা চলমান আবর্ত যেন তাকে জীবনের চক্রের মধ্যে গতিময় করে সচল রেখে দেয়  সারাটা ক্ষণ। আরো একটা পেস্নন সাঁই করে নেমে এলে সাদাটে আলোর মধ্য দিয়ে দেখা গেল খুরশিদকে। ন্যাভাল এলাকার কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট আর তার লাগোয়া খানিকটা ছায়া-ছায়া একটা জায়গায় ওরা বসে। জায়গাটাকে বলা যায় একটা চওড়া চাতাল। ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে খুরশিদ। সিঙ্গাপুরে দুজনে খেয়েছিল লাগার, ডেনমার্কের। সেখানেও অ্যালকোহল থাকে। খুরশিদ ভাবলো, বন্ধু ইনানি যতই দেশি বন্ধু হোক, এক অর্থে সে তো বিদেশিই বটে। সিঙ্গাপুরে এক বন্ধের দিনে আঙ্গুলিয়া মসজিদের মাঠে বসে আড্ডা দেওয়ার সময় কেউ একজন বলছিল, মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ মূলত চট্টগ্রামের মানুষ – গ্রামটার নামও মনে আছে, কদলপুর। রাউজান না রাঙ্গুনিয়া কোথায় যেন। তাহলে চট্টগ্রামের মানুষ ভাসতে ভাসতে কই চলে গেল আর গোটা বিশ্ব জানে, আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার হলেন মাহাথির। সেদিক থেকে দেখলে পতেঙ্গার সে মানে ইনানির মধ্যেও নিশ্চয়ই লুকোনো থাকলেও থাকতে পারে ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাবনা।

কে বলবে ইনানি ইউরোপীয় লোক। দেখে কারো বোঝার জো নেই। বুঝবেই বা কেন। যদিও বাদামি চামড়ারও বহু লোক ইউরোপীয় নাগরিক। আর এ-যুগের বৈশ্বিক গ্রামব্যবস্থায়
ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়া কেবল মানচিত্রের ব্যাপার। কত লোক, খুরশিদ দেখেছে, থাকে হয়তো সিঙ্গাপুরের ঝুরংয়ে কিন্তু অনলাইনে যেসব ডাটা বিশেস্নষণ করছে চাকরির জন্যে, সেগুলো আসছে হয়তো জাপান কি থাইল্যান্ড থেকে। কিন্তু ঘাসের ওপর বসতে বসতে খুরশিদ যখন বলে, দোস্ত তোত্তে মনত্ আছে না, আঁরার ধর্মর স্যারোরে আঁরা মলই মাস্টর কইতাম? হাসতে হাসতে ঘাসের ওপর বসে উচ্ছ্বসিত ইনানি, হ্যাঁ, স্পষ্টই মনে পড়ে তার মলই মাস্টারের কথা। পড়া না পারলে কান মলে দিত, তাই ওঁর নাম মলই মাস্টর। বেঁচে আছে কিনা কে জানে। তখনই অর্ধেকের বেশি চুল পেকে গিয়েছিল। না, মরে গেছেন তিনি। সৌদি আরবে গিয়েছিলেন হজ করতে। কিন্তু মৃত্যুবরণ করেছেন দুর্ঘটনায়। তবু লোকে, বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা মহাখুশি – ভিড়ের ওপর ভারী ক্রেন পড়লে একসঙ্গে বহু লোকই মারা পড়ে; কিন্তু তাদের আত্মীয়রা বিমর্ষ হয় না কেউ শুনে। পবিত্র মাটিতে মৃত্যু মানে তাদের মনে ভিন্ন এক তাৎপর্যে অনূদিত হলে তারা প্রত্যেকেই গায়েবানা জানাজা আর জিয়ারত সেরে মিসকিন খাইয়ে ভাবে, আহা, এরিম্মা মরণ কজনে পায়!

পকেট থেকে রুচি চানাচুরের প্যাকেট আর কাঁধের চামড়ার ব্যাগ থেকে কাঠ-রঙের হুইস্কির বোতলটা বের করে আনে খুরশিদ। উঠে খানিকটা এগোলে একটা বাঁক পেরোলেই ইনানিদের জাহাজটা দেখা যায়। আসার সময় ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় যাওয়া হচ্ছে, ফিরবে কখন। ক্যাপ্টেন ম্যাকেঞ্জি জানে, মাল্টার নাগরিক হলেও ইনানি আসলে চট্টগ্রামের মানুষ। কাজেই নিজের মাটি কাছে পেয়ে ছেলেটা না-হয় একটু আদিখ্যেতা করলোই। তাতে কার কী এমন ক্ষতি! কিন্তু জাহাজ ছেড়ে কিছুদূর আসতেই, সম্ভবত সিকিউরিটির লোক, হাঁকে – গোয়িং হোয়ার? প্রশ্ন সে ইংরেজিতেই করে এবং সেটি অশুদ্ধ হলেও বোঝে ইনানি। উত্তরে সে কোনো এক অনির্দেশ্য দিকে ইঙ্গিত করে বলে, আঁর বাড়ি অ্যাডে। তখন সেই ইউনিফর্ম-পরা লোকটা হে হে করে হেসে বলে, তইলে তো আর কনো অসুবিধা নাই। কিন্তু অসুবিধা যে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আসবে সেটা না খুরশিদ, না ইনানি কেউই ভাবতে পারেনি। ধরো, সমুদ্রঘেঁষা জায়গাটায় সারাক্ষণই লোকজনের আনাগোনা। কে কোন তালে থাকে দেখে বোঝা মুশকিল। অবশ্য পুলিশ থাকে এক তালেই। তারা প্রায় সারাক্ষণ সন্দেহের বড়শি ঝুলিয়ে দিয়ে রাখে কখন শিকার পড়বে। পড়েও। সমুদ্রের ওপার থেকে, কাছাকাছি নানান জায়গা দিয়ে চোরাই মাল ঢুকে পড়ার ঝুঁকি সারাটা প্রহর। নৌ-পুলিশের টহল-বোট কিছুক্ষণ পরপরই ঢেউ তুলে ছুট দেয়। আর স্থলভাগেও প্রহরা বিরাজমান। জায়গাটা আবছায়াময়, খানিকটা আলো আর খানিকটা আঁধারে ঢাকা। চানাচুরের মোড়কটা চিরে নিয়ে বোতলের ছিপি খুলে খুরশিদ কেবল দুটো পস্নাস্টিকের ওয়ান-টাইম গস্নাসে ঢেলে নিয়েছে, চুমুক দেয়ওনি, তখনই আচমকা দুটো পুলিশ হামলে এসে পড়ে তাদের ওপর। চমকায় ওরা। কোথায় ছিল, মাটির নিচে বুঝি। প্রায় নিঃশব্দেই উদয় ঘটে ওদের। একই সঙ্গে গাম্ভীর্য আর বিদ্রূপাত্মক স্বর তাদের –

: কী, মিয়ারা, আসর জমাইয়া বসছো দেহি? জানো না, এইহানো মদ্যপান করা নিষেধ!

অনিবার্য বিপদের ঝুঁকি ওরা টের পায়; কিন্তু খুরশিদ তত ঘাবড়ায় না। বেশ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ চাহনি স্থাপন করে সে পুলিশদের একজনকে বলে, না, আমার বন্ধু বিদেশি তো, আসছে, সেই জন্য ওকে আপ্যায়ন করতেছি আর কী। বিদেশিরা তো খাইলে আপত্তি নাই। কী বলেন – তাই না? কাকে সে বলে সে ঠিক বোঝে না। তবে দুজনের মধ্যে যে-কোনো একজনকে সেটা বলা যায়। তখন দাড়িঅলা পুলিশটা কণ্ঠে ঠাট্টা বা উপহাস কিংবা ব্যঙ্গ যাই বলা হোক মিশিয়ে বলে, কী ব্যাপার, দেইখ্যা তো মনে অয় বোতল কেবল খোলা অইছে। আর প্যাটেও অহনও যায় নাই। না খাইয়াই মাতাল অইয়া গেলা নাকি? ইশারায় ইনানি খুরশিদকে কিছু একটা বোঝাতে চাইলেও সে-কথায় কান না দিয়ে খুরশিদ জোর প্রতিবাদ জানায় পুলিশের – আমরা এখনো কিছুই খাই নাই আর আমরা মিথ্যাও বলি না। আমার এই বন্ধু বিদেশি, সে এই দেশের নাগরিক না। ওর উত্তর শুনে পুলিশদুটো পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। দুজনেরই চোখেমুখে অবিশ্বাস। একজন আবার এককাঠি সরেস। দুম করে প্রশ্ন করে বসে ইনানিকে লক্ষ করে – কী নাম তোমার কও দেহি?

: ইনানি। ওর উত্তর।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই এমন প্রশ্নের হামলা ঘটবে সেটা ভাবেনি খুরশিদ। চোখে ইশারা দেওয়ার কথা ভাবছিল কিংবা কোনো একটা ইঙ্গিত দেয়। সেও কম যায় না। পুলিশকে পালটা প্রশ্ন তার – ও বাংলা বোঝে না, ইংরেজিতে বলেন। শুনে দুই পুলিশ এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে হাসতে হাসতে। ওরা ধরেই নিয়েছে তারা দুজনই মাতলামো করছে। কিন্তু আচমকা হাসি থামিয়ে দিয়ে দুজনেই বেশ গম্ভীর হয়ে পড়ে। যারা মদ না খেয়েই মাতলামো করতে চাইছে তারা কি আসলেই মাতাল নাকি অভিনয় করে মাতালের। কাছেই বিমানবন্দর এবং কাছেই সমুদ্রবন্দরও। কাজেই যতটা সহজ মনে করা যাচ্ছিলো ওরা এবং বিষয়টা, ততটা সহজ হয়তো নয়। হতে পারে তারা ইয়াবার কারবারি কিংবা অন্য কোনো চালানের দফাদার। খুরশিদের মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশটা স্পষ্ট ব্যঙ্গের সুরে পালটা আক্রমণ করে তাকে, ইংরেজি যদি না বুঝতো তাইলে উত্তর দিলো কেমনে? শুনে সহসা যুক্তি খুঁজে পায় না খুরশিদ। সত্যি কথা, শব্দ একটাই, কিন্তু সে-শব্দটা একটা প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর – মানে সে তার নামটাই বলেছে পুলিশের প্রশ্নের জবাবে। তবু খুরশিদ প্রতিবাদী – আরে ভাই মিথ্যা বলবো কেন, তিনি আমাদের দেশের নাগরিক নন, ওনার দেশ হইলো মাল্টা। ইনানিও সেইসঙ্গে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। এবারে পুলিশ ওদের ধমক লাগায় –

: দুনিয়ার এত দ্যাশ থাকতে মাল্টা লইয়া টানাটানি করতাছো ক্যান? মাল কি বেশি টানছো নাকি?

খুরশিদ ততক্ষণে হুইস্কির বোতলটাতে ছিপি লাগিয়ে দিয়েছে। বোতল থেকে ঢেলে নেওয়া মদসহ পস্নাস্টিকের গস্নাসদুটো ছুড়ে ফেলে দিয়েছে ঝোপের দিকে। ওর এসব কা- দেখে একটা পুলিশ আচমকা এসে ওকে জাপটে ধরে, এই যে আলামত নষ্ট করবার লাগছো তাই না? কাজ হবে না। চলো আমাদের সঙ্গে। দেখি তোমাদের আসল উদ্দেশ্য কী সেটা অহনই বার করতাছি। বলেই পুলিশ দুজন ওদেরকে পাকড়াও করে। খুরশিদের বয়ে আনা ব্যাগ ব্যাগের মধ্যকার বোতল গুছিয়ে নিয়ে তাড়া লাগায় খুরশিদ এবং ইনানি দুজনকেই। কিন্তু নাছোড় খুরশিদও। শৈশবের বন্ধু বলেই নয়, সে তো আসলেই অন্য দেশের নাগরিক। তাই অন্য দেশের নাগরিকের সম্মান রক্ষা করাটা তার অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য। পুলিশ তাদের ভুল বুঝলে তাতে তার ক্ষতি হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু তার বন্ধু কেন অপমানিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কণ্ঠে সজোর একটা ভঙ্গি করে আগুয়ান পুলিশকে বলে সে, শোনেন ভাই, আপনেরা মন দিয়া কথাটা শোনেন, আমার এই বন্ধু বাংলাদেশি না, বিদেশি। হয়তো পুলিশেরাও খানিকটা ধর্তব্যে নেয় তাকে – ঠিক আছে তোমার পাসপোর্ট দেখাও। খুরশিদ ভেবেছিল, ইনানি পকেট থেকে পাসপোর্টটা বের করলেই তারা আপদমুক্ত হবে; কিন্তু বাঘের ভয় ছাড়াই রাত হয়ে যায়। পাসপোর্টটাই জাহাজে নিজের কামরায় রেখে এসেছে ইনানি। সে-কথা সে বলেও সরল স্বীকারোক্তির মতো। বলে সে মাতৃভাষা বাংলাতেই। একবার যখন ওরা বুঝেই গেছে সে বাঙালি, তাহলে আর অভিনয়ে কাজ নেই ভেবে সে জবাব দেয় –

: ভাই শোনেন, ভুলবশত পাসপোর্টটা জাহাজে রাইখ্যা আসছি।

: কোন জাহাজ? একটা পুলিশ প্রশ্ন করে।

: ওই যে একটু সামনে আগাইলেই দেখা যায় – এমভি     আর্থার, মাল্টার জাহাজ।

ইচ্ছে করলে হয়তো কথাটা বিশবাস করা যেত। কিন্তু পুলিশ তা করে না। বরং উপহাসের সুর ওদের তীক্ষন হয় – এতক্ষণ বললা বিদেশি লোক, এহন বলো পাসপোর্ট নাই, ফ্যালায়া আসছো জাহাজের মধ্যে। তোমাদের উদ্দেশ্যটা কী কও তো দেহি? ইনানি দেখল পুলিশদুটো ক্রমে ঘোরেল হয়ে পড়ছে। তারা হয়তো তাদের পিছু ছাড়ার লোকও না। একটা বুদ্ধি খেললো মাথার ভেতরে। গলাকে যতটা সম্ভব নরম করে সে বলতে থাকে – ভাই শোনেন, আপনে ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে জাহাজে আমার রুমে আসেন। আমি আপনাকে দেখাবো, রুমে আমার কাপড়-চোপড় আছে, বাংলা পেপার আছে, বাংলা বই আছে মানে গল্প-উপন্যাসের বই আছে। আর আপনাকে আমার পাসপোর্টটাও দেখাবো। আসেন। বলে ইনানি প্রায় করজোড়ে মিনতি করতে করতে দুই পুলিশকেই সঙ্গে নিতে উদ্যত হয়। খুরশিদও সমর্থন জোগায় বন্ধুকে, হুম, দোস্ত তুমি ঠিকই বলছো, হ্যাঁ-হ্যাঁ, চলেন-চলেন, জাহাজে চলেন। কিন্তু পুলিশের স্বভাবই এমন, তারা কোনো কিছুতেই দ্রুত আস্থাশীল হয় না। তাদেরকে বলেই দেওয়া আছে – দুই চোখের আড়ালে আরো দুই চোখ রাখতে হয়, সেই দুই চোখের নাম অবিশ্বাসীর চোখ। কোনো কিছুই প্রথম দফায় বিশ্বাস করা যাবে না।

পুলিশ দুজনের কী হয় কে জানে। তাদের ইশারা-ইঙ্গিতের পাঠোদ্ধার খুরশিদ-ইনানির কাজ নয়। তারা তাদের মাল্টা, জাহাজ, পাসপোর্ট রেখে আসা এসব গল্পে কোনো আস্থাই রাখতে চায় না। উলটো খুরশিদ এবং ইনানিকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে প্রায় আদেশের সুরে বলতে থাকে – শোনো, তোমাদের কাছে নিষিদ্ধ বস্ত্ত মদের বোতল পাওয়া গেছে। তোমরা আসামি। এখন আমরা যা বলি মন দিয়া শোনো। দুজনে খাড়াও এইহানে। একজন পুলিশ তাদের দুজনকে হাতে-কলমে পাশাপাশি দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা দেখিয়ে দিতে থাকে। আর অন্যজন তখন তার পকেট থেকে মোবাইল সেটটা মুঠোয় বাগিয়ে ধরে। তার কাঁধে বন্দুক, মাথায় টুপি, গায়ে ইউনিফর্ম এবং হাতে মোবাইল সেট। সেটটা কী বোঝা দুরূহ তবে আয়তাকার ও চওড়া সেই সেট হতে পারে অপ্পো, হতে পারে স্যামসাং কিংবা সিম্ফনি, তবে আইফোন নয়, যার হাতে মোবাইল নেই তারও কাঁধে বন্দুক এবং অন্যসব আনুষ্ঠানিকতার বিন্যাস। তবে একটু আগেই তার হাতে যে-ব্যাগটা ধরা ছিল এবারে সেটার মধ্যে দুই হাত গলিয়ে দিয়ে সে বোতলটা বের করে আনে। বোতলটার আদি মালিক খুরশিদ এবং সেটির সম্ভাব্য ভোক্তা তারা দুই বন্ধু। দুজনেই আমতা-আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করলে দুই পুলিশ প্রায় সমস্বরে ধমক লাগায় –

: যা বলি করো, নইলে প্যাঁদানি চেনো?

দুজনেই মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ, সেটা চেনে তারা। দুই বন্ধু শৈশবের দুই সহচর যাদের একজন স্বদেশি এবং ভাগ্যের ফেরে আরেকজন বিদেশি, পাশাপাশি দাঁড়ায় এবং বোতলটা হাতে ধরে রাখে সেটির মূল মালিক খুরশিদই। তবে একটা কাজ ইনানিকেও করতে হয়। তাকে একটা হাত রাখতে হয় তার বন্ধুরই কাঁধে। সেটা হয়তো অপ্রত্যাশিত দৃশ্য নয়। কেননা, বন্ধু তো বন্ধুর কাঁধে হাত রাখতেই পারে। দৃশ্য হিসেবে ফ্রেমটিকে সত্যের প্রতিফলনই বলতে হবে; কিন্তু সেই দৃশ্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য ততক্ষণে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে দুজনের নিকটেই। শেষ চেষ্টা চালায় ইনানি, শোনেন ভাই, আপনারা যা ভাবতেছেন আমরা তা না। আমি বহুদিন পর আমার দোসেত্মর দেখা পেলাম তো তাই একটু আনন্দ করতে চেয়েছিলাম। তাছাড়া আমি তো এদেশের নাগরিকও না, আমি মাল্টার নাগরিক। আমার পাসপোর্টটা আছে জাহাজের মধ্যে। পুলিশদের বিরক্তি বাড়ে। ভাবে, ব্যাটারা আবার বিদেশ জাহাজ মাল্টা পাসপোর্ট এসব উজির-নাজির মারতে শুরু করেছে। তারা আরো বিরক্ত হয় দেখে, মদ না খেয়েই ছেলেদুটো মাতলামো শুরু করেছে, খেলে না জানি কী করে। আবার, আগের সন্দেহটাও সংশয়ে ফেলে, নাকি অভিনয় করছে মাতালের। যাহোক, যা করার দ্রুত করতে হবে। মোবাইল সেটটা বাগিয়ে ধরে উদ্যত এক পুলিশ হামলে পড়ে, হ্যাঁ হ্যাঁ রেডি রেডি রেডি! খুরশিদের হাতে বোতল-ধরা এবং তার কাঁধে ইনানির একটা হাত রাখা। ফ্রেমের একদিকে সমুদ্র, ওপরে আকাশ আর নদীর ওপারের সবুজ রেখা এখন কালচে মেরে গেছে।

: হে-হে-হে। ছবি তোলা শেষ। আমার মোবাইলের ক্যামরাটা ৫ পিক্সেলের, বুঝলা, খারাপ অইবো না।

তখন হর্ন-বাজানো একটা জাহাজের শব্দ শোনা যায়। সম্ভবত বহির্নোঙরে ভিড়ছিল। আবার, প্রায় একই সময়ে পেস্ননও নেমে আসে একখানা। একটু এগিয়ে গেলেই বাঁক পেরোলে ইনানিদের এমভি আর্থার জাহাজটা। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে – বলবে নাকি আরো একবার, জাহাজে গেলেই পাসপোর্টটা দেখানো যায়। কিন্তু পুলিশদের হাতে হয়তো অত সময় নেই তার কথা শোনার। তবে অন্য কথা শোনার সময় পুলিশের হাতে তখনো থাকে। কেননা, ওদেরই একজন তখন ইনানি এবং খুরশিদকে লক্ষ করে বলতে থাকে –

: জাহাজের গল্প থাক। জেটির কাছে বহু জাহাজ আছে, সেটা সকলেরই জানা। অন্য গল্প করো। কিন্তু ইনানি জাহাজ ছেড়ে অন্যদিকে যেতে চাইলেও পারে না। কারণ, জাহাজই তার চাকরি, জাহাজই তার জীবন। তাই সে মাল্টা থেকে ওষুধের চালান নিয়ে আসা নোঙর-করে রাখা এমভি আর্থারের দিকে এগোবার চেষ্টা করে খুরশিদকে নিয়ে। আর দুটো পুলিশ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে খুরশিদ এবং ইনানি দুজনকেই টানতে থাকে উলটো দিকে। জাহাজটা ততক্ষণে নোঙরশেষে নিঃশব্দ। নেমে আসা পেস্ননের প্রপেলারও ঘূর্ণন থামিয়ে বিশ্রামে।