বিশ্বায়নের কালপরিধিতে দৃশ্যকলার রূপভাবনা

আবুল মনসুর

প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উলস্নম্ফন আজকে আমাদের জীবনের সকল পরিপ্রেক্ষিতকে পালটে দিয়েছে। এর যত নেতিবাচক পরিণতির কথাই বলি না কেন, এটি স্বীকার করতে হবে, প্রযুক্তির কল্যাণেই গোটা পৃথিবীটা আজ চলে এসেছে আমাদের হাতের মুঠোয়। বিশেষ করে সময়ের বিবেচনায় এ-প্রবণতা বিগত একশ বছরে অভূতপূর্ব – সেটি তথ্যের আদান-প্রদান, যাতায়াত থেকে শুরু করে পণ্য, পেশা, ব্যবসা, পর্যটন, বিনিয়োগ, খাদ্য,
সংস্কৃতিচর্চা থেকে জীবনের প্রাত্যহিকতা পর্যন্ত বিসত্মৃত। এই বিস্তারকে সমকালের পশ্চিমা জগৎ গেস্নাবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন নামের একটি অনন্য ও উপযোগী উদ্ভাবন হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস করে থাকে। ধারণা দেওয়া হয় যে, এই বিশ্বায়নের ফলে গোটা পৃথিবী একটি একক বৈশ্বিক গ্রামের (ওয়ার্ল্ড ভিলেজ) ছাতাতলে শামিল হবে এবং পারস্পরিক নৈকট্যে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হবে।

এই বিশ্বায়ন কি আসলেই কোনো অভিনব উদ্ভাবন – এ-প্রশ্নও সংগতভাবেই উত্থাপিত হয়েছে। মানুষে মানুষে বা জাতিতে জাতিতে যোগাযোগ সভ্যতার বিকাশের আগেই সূচিত হয়েছে, মূলত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিবিধ কারণে স্থানত্যাগ বা বাস্ত্তচ্যুতির মাধ্যমে। ভারতীয় উপমহাদেশে পশ্চিম থেকে
আর্য-জনগোষ্ঠীর আগমন ব্যাপকহারে বাস্ত্তত্যাগের মাধ্যমেই ঘটেছিল, সেইসঙ্গে তাদের ধর্মবিশ্বাস, লোকাচার ও শিল্পশৈলী এদেশে স্থায়ী হয়েছে। সভ্যতার বিকাশের কালে এ-যোগাযোগ মূলত ঘটেছে বাণিজ্য ও বিনিময়ের দ্বারা। এশিয়ার চৈনিক ও ভারতীয় সভ্যতাগুলোর সঙ্গে সমসাময়িক ইউরোপীয় গ্রিক ও রোমান সভ্যতার বাণিজ্যিক যোগাযোগ সুপ্রাচীন, সিল্ক রুট যার অন্যতম বিনিময়-পথ বলে আমরা জানি। এছাড়া যুদ্ধ ও সামরিক বিজয়ের  দ্বারাও এটি ঘটেছে – আলেকজান্দারের অভিযানের কারণে ভারতীয় গান্ধার শিল্পে গ্রিক প্রভাবের ছাপ পড়েছে, যদিও পাশ্চাত্য তাত্ত্বিকরা একে বাস্তবের চেয়ে অতিরঞ্জিতভাবে চিত্রণের চেষ্টা করে থাকেন। মধ্যযুগে মুসলিম ও মোঙ্গল সাম্রাজ্য বিভিন্ন জাতিকে একীভূত করে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের নতুন মাত্রা ঘটাতে সমর্থ হয়। একইভাবে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপনির্মাণে মুসলিম শাসনকালের গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করা যাবে না।

ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী বিশ্বায়ন ঘটে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দী থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত। এই সময়পরিধিতে ইউরোপীয় বিভিন্ন রাষ্ট্র সামরিক শক্তি প্রয়োগে বাকি বিশ্বের প্রায় সমস্তটির ওপর দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে। উপনিবেশের মাধ্যমেও জানার সঙ্গে অজানার যোগ ঘটার একটি উপলক্ষ তৈরি হয় বটে, তবে এ-বিশ্বায়নের চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। শ্রেষ্ঠত্বের অহং দ্বারা নির্মিত এই বিশ্বায়ন উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীকে অসভ্য, বর্বর ও নিম্নতর প্রজাতির হিসেবে চিত্রিত করে এবং নির্মম শোষণ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে একটি জবরদস্তি শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এ জাত্যাভিমান শাসিতের ধর্ম, লোকাচার ও
সংস্কৃতিকে হেয়প্রতিপন্ন করার দ্বারা শাসিতের মনের মধ্যে হীনমন্যতার বোধ গভীরভাবে প্রোথিত করে দেয়।

তবে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যতর মাত্রাও রয়েছে। এর মাধ্যমে পশ্চিমের চিমন্তা, সাহিত্য, দৃশ্যকলা, নাট্যধারা ও মূল্যবোধ উপনিবেশেও সঞ্চারিত হয়। বিশেষত ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে পশ্চিমের এই আদান-প্রদান আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও শিল্পভাবনায় একটি গতিশীলতা প্রদান করে। ভারতীয় সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল কিছু শিক্ষিত ইংরেজ রাজকর্মচারীর প্রচেষ্টায় ভারতীয় চিত্রকলা ও ভাস্কর্য বিশ্বশিল্পের অন্যতম সেরা কীর্তি হিসেবেও
স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। ঊনবিংশ শতকেই ব্রিটিশ পদ্ধতির অনুসরণে ভারতের বিভিন্ন প্রধান শহরে শিল্পশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম সূচিত হয় ও কিছু ভারতীয় শিল্পী পশ্চিমা বাস্তববাদী শিল্পশৈলীতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। স্বাধীনতার স্পৃহা ও জাতীয়তাবাদী জাগরণের অনুবর্তী একটি শিল্পধারাও পরবর্তীকালে সূচিত হয়, যার মধ্যে ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ও ইউরোপীয় বাস্তবতাবাদের সহাবস্থান দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও দেশভাগ ভিন্নতর পরিস্থিতির জন্ম দেয়। দেশজ প্রাসঙ্গিকতা ও আন্তর্জাতিকতার মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েন, আবার সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, যার জের হয়তো এখনো চলমান রয়েছে।

পঞ্চাশের দশক থেকে দৃশ্যকলার জগতে ব্যাপক পরিবর্তনের হাওয়া লাগে, বিশেষ করে বিমূর্ততার প্রচলনে দৃশ্যকলায় আন্তর্জাতিকতার যে-প্রচারণা চলছিল তাতে শক্তি জুগিয়েছিল এর গুরু ক্লেমেন্ট গ্রিনবার্গের বহুল-প্রচারিত নিবন্ধ মডার্নিস্ট পেইন্টিং (১৯৬০) ও অন্যান্য রচনা। অবশ্য এর বিপরীত প্রবণতা হিসেবে পপ ও নানাবিধ ব্যক্তিশৈলীর মাধ্যমে শিল্পধারায় গৌণ ও তাৎপর্যহীন বিষয়ের অবতারণা ও মিশ্র চরিত্রের প্রাধান্য শিল্পে বহুত্ববাদী ধারণাকে জোরদার করে তোলে। পরবর্তী সত্তর বছরে প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উত্তরণ মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে অচিমত্ম্যনীয় অভিঘাত নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে টেলিভিশন, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট, মোবাইল ও ইন্টারনেট সারাবিশ্বের তথ্যকে অধিগত করার এমন এক সুযোগ তৈরি করেছে, যা বিশ্বের যে-কোনো প্রামেত্মর সঙ্গে তাৎক্ষণিক ও অবিরল যোগাযোগকে মুঠোর মধ্যে এনে দিয়েছে। তবে প্রযুক্তির
এ-সুবিধা সর্বত্র সমানভাবে বিসত্মৃত হয়ে একটি সমতাভিত্তিক বিশ্বসমাজ নির্মাণের পথ প্রপঞ্চই রয়ে গেছে কি না সে-প্রশ্ন থেকেই যাবে। সমালোচকরা অভিযোগ করেন যে, বর্তমানের বিশ্বায়ন অতীতের উপনিবেশ-প্রথার একটি ভিন্ন রূপ ছাড়া আর কিছু নয়, এটি আসলে পুঁজিবাদী বিশ্বের পৃথিবীময় রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠারই একটি প্রকল্প। সংস্কৃতির রূপনির্মাণও এ-প্রকল্পের বাইরে নয়। দার্শনিক আর্থার দামেন্তা শিল্পকলায় আধুনিকতা তথা পশ্চিমা একরৈখিক তত্ত্বকে ঔপনিবেশিক শিল্পচিমন্তা হিসেবে চিহ্নিত করে দৃশ্যকলায় উচ্চ-গৌণ ভেদ নির্মূল করে সাংস্কৃতিক বহুত্ব ও প্রকাশের বহুমাত্রিকতাকে প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দিয়ে বিশ্বায়নের নিহিত উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করেছেন।

বিশ্বায়ন বিষয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে, সে-বিষয়ে অধিক আলোচনায় না গিয়ে মানুষের সৃজনশীলতার ওপর এর অভিঘাত নিয়েই আমাদের বিবেচনা সীমিত রাখতে হবে, বিশেষ করে দৃশ্যকলা। এটি তো মানতেই হবে যে, প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার এবং তার ফলশ্রম্নতিতে বিশ্বায়নের ব্যাপ্তি সমাজের গ– অতিক্রম করে ব্যক্তিমানুষের জীবনেও প্রবল প্রভাব হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখন আমরা কেউ এমন দাবি করতে পারি না – একক বা সামাজিক মানুষ তার স্থানিক বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রাখতে সমর্থ। বর্তমানের বিশ্বায়নের বহু আগে থেকেই আসলে সমাজজীবনে নির্ভেজাল কিছু নেই, সবই মিশ্র বা হাইব্রিড – সে আমাদের খাদ্য, পরিধেয় বা ব্যবহার্য বস্ত্তর কথা হোক অথবা ভাষা, ধর্ম, আচার বা সৃজনশীল সক্রিয়তাই হোক। ২৫০ খ্রিষ্টপূর্ব সময়কালের অশোকস্তম্ভে যদি পার্সেপোলিটন শিল্পের প্রভাব দেখতে পাই তবে পরবর্তী সকল শিল্পকর্মে যে-মিশ্রণ ঘটেছে সেটি উলেস্নখের প্রয়োজন পড়ে না। গান্ধার শিল্পে গ্রিক প্রভাবের কথা আগেই উলেস্নখ করা হয়েছে। সাতশো বছরের মুসলিম শাসন আরো ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। সর্বশেষ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে এ-অঞ্চলের শিল্পশৈলীতে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য ধারার মিশ্রণ যেমন ঘটেছে, তেমনি ভারতীয় শিল্প বিবিধ ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর ওপর এসে পড়েছে বিশ্বায়নের বিশাল অভিঘাত। সমস্ত বিশ্বের সকল সময়কালের শিল্পের নিদর্শন এসে গেছে প্রতিটি শিল্প-অনুসন্ধিৎসু মানুষের হাতের মুঠোয়। এমনকি ঘরে বসেই আমি ঘুরে আসতে পারি বিশ্বের যে-কোনো জাদুঘর, আর্ট গ্যালারি কিংবা চলমান কোনো প্রদর্শনী। জেনে নিতে পারি, দৃশ্যকলার সাম্প্রতিকতম প্রকাশশৈলী এবং তার নিদর্শন। শিল্পতাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেনজামিন ১৯৩৬ সালে তাঁর ‘দ্য ওয়র্ক অব আর্ট ইন দ্য এজ অব মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন’ নিবন্ধে মুদ্রণের আবির্ভাবে চিত্রকলার চারিত্রিক পরিবর্তনের যে-আভাস দিয়েছেন আজকের খোলনলচে পালটে যাওয়া পরিস্থিতিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া কল্পনা করাও সম্ভব নয়। পরিবর্তনের ব্যাপকতা দৃশ্যকলাজগতে ক্রিয়াশীল শিল্পীমহলকেও খানিকটা বিভ্রান্তিতে নিক্ষেপ করেছে বটে। পুঁজিবাদী বিশ্বের আধিপত্য বজায় রাখা যে বিশ্বায়নের অন্যতম প্রকল্প এবং এটি যে সৃজনশীলতার জগতেও ক্রিয়াশীল সেটি পরোক্ষক্ষ হলেও অনুধাবনযোগ্য। পশ্চিমা নন্দনধারণার প্রসার এবং দৃশ্যকলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে খুব একটা বেরিয়ে না আসতে পারায় আজকের একজন শিক্ষার্থী পাশ্চাত্যশিল্প বিষয়ে যতটুকু আগ্রহী, নিজস্ব শিল্পের ইতিহাস নিয়ে ততটুকু আগ্রহী নন। তিনি ভ্যান গঘ বা পিকাসো যতটুকু অনুধাবন করেন বা করতে চেষ্টা করেন অজমন্তা, মুঘল বা চৈনিক চিত্রকলার শিল্পগুণ উপলব্ধির প্রয়োজন ততটা অনুভব করতে পারেন না। এছাড়া সমসাময়িক হতে হলে পাশ্চাত্যশিল্পের সাম্প্রতিক তৎপরতাকেই জানতে হবে, অনুকরণ  বা অনুসরণ করতে হবে কিংবা ওই প্রকাশশৈলীতেই শিল্পচর্চা করতে হবে, এমন একটি একমাত্রিক ধারণা আমাদের শিল্পজগতে দীর্ঘদিন ধরে আচ্ছন্নতা তৈরি করেছে। এর ফলে বর্তমানের বাইরে
শিল্প-ইতিহাস জানার প্রয়োজনীয়তা শিক্ষার্থী উপলব্ধি করতে পারেন না। পিকাসো বিশ্বশিল্পের সম্পূর্ণ পরিচয় আয়ত্ত করেই আফ্রিকান আদিম শিল্প, আইবেরিয়ান ভাস্কর্য বা গ্রিক পাত্রের চিত্রণ থেকে আহরণ করেছেন। পূর্ববর্তী চেনা-অচেনা অনেক শিল্পীর চিত্রকর্ম নিজের মতো করে পুনঃরচনা করেছেন তিনি, এর মধ্যেও তাঁর জানাশোনার বিস্তার আন্দাজ করা সম্ভব। এমনকি মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ বলে বিবেচিত ভ্যান গঘের পত্রাবলি প্রকাশের পর আমরা জানতে পারি তাঁর অধ্যয়নের পরিধি ও ভাবনার সমকালীনতা।

এ-উপমহাদেশের সাম্প্রতিক শিল্পের গতিধারা পর্যালোচনা করলেও আমরা দেখতে পাব সূচনাকালের শিল্পীরা কতটা ব্যাপকভাবে দেশের শিল্প-ঐতিহ্যকে জানার চেষ্টা করেছেন। নন্দলাল বসু ওই সময় দুর্গম অজমন্তা গুহার চিত্রাবলি নকলের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। নন্দলাল, বিনোদবিহারী বা রামকিঙ্করের কাজে দেশীয় মেজাজটি নির্মিত হয়েছে ভারতীয় চিত্র-ভাস্কর্য বিষয়ে ব্যাপক পঠন, পর্যবেক্ষণ ও অনুশীলনের দ্বারা। অবনীন্দ্রনাথকে আমরা প্রায়শ নেহাত পুনরুজ্জীবনবাদী বলে খারিজ করে দিয়ে থাকি, জীবনের অন্তিম পর্বে তাঁর নিরীক্ষা কিংবা বাগেশ্বরী বক্তৃতামালায় তিনি যে একটি নতুনতর নন্দন-ভাবনা নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন কে. জি. সুব্রহ্মণ্যন সেটি আমাদের নজরে আনেন। পরবর্তী বেশকিছু ভারতীয় শিল্পীর কাজে সমকালের নিরিখে দেশজ পরিপ্রেক্ষিতের প্রাসঙ্গিক সমন্বয় চোখে পড়ে, সম্ভবত কে. জি. সুব্রহ্মণ্যনই এর সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁরা অজমন্তা, মুঘল, পাহাড়ি চিত্র বা ঐতিহ্যিক লোককলা দ্বারা যেমন উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, তেমনি কিউবিজম বা এক্সপ্রেশনিজম নিয়ে নিরীক্ষাও কেউ কেউ করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী বা কে. জি. সুব্রহ্মণ্যনের লেখাতেও এ-সম্পৃক্ততা উপলব্ধি করা যায়।

আমাদের দেশেও এ-প্রয়াস যে একেবারে হয়নি তা নয়, কামরুল হাসান অবশ্যই একটি বড়মাপের উদাহরণ। জয়নুল আবেদিন চমৎকার সূচনা করেও বিশেষ অগ্রসর হননি। পরবর্তীদের মধ্যে রশিদ চৌধুরী ও কাইয়ুম চৌধুরীই একমাত্র উদাহরণ যাঁদের কাজে এ-সম্মিলন একটি প্রাসঙ্গিকতা রচনা করতে পেরেছে।

তবে এ-কথাও সত্য, সময়ের প্রবাহে দৃশ্যকলার গতিধারা ও প্রেক্ষাপটে বৈপস্নবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিশ্বায়নের অভিঘাতে আমাদের দৃশ্যমান ও অনুভবের জগৎ পালটে গেছে। তবু এটি প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে যে, আধিপত্যবাদী পশ্চিমা নান্দনিকতাকে চ্যালেঞ্জ না করে আমরা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় রচনা করতে পারব না। এর জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মতবিনিময় অনুশীলনের যে-প্রয়োজনীয়তা সে-ক্ষক্ষত্রটিতে এখনো আমাদের ঘাটতি প্রবল রয়ে গেছে। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা কিছুটা ব্যক্তিগত, কিছুটা শিক্ষায়তন ও সামাজিক উদ্যোগে ঘটতে পারে। এশীয় দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনী অভিজ্ঞতা ও বিনিময় চর্চার একটি পস্নাটফর্ম হতে পারতো। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনার অভাব এবং শুধু এর পরিধি বৃদ্ধিই বিবেচ্য হওয়াতে গুণগতভাবে এটি প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

তবু খানিকটা পর্যবেক্ষণেই আমাদের দৃশ্যকলার প্রবণতাগুলি নিরীক্ষণ করা যায়। শিল্পনির্মাণে কুশলতার মান ও পেশাদারিত্ব অনেক বেড়েছে, তবে বিষয়চিমন্তা, রূপনির্মাণ ও উপস্থাপনে পশ্চিমা নন্দন-কাঠামো ও দৃশ্যকলার সাম্প্রতিক প্রবণতাসমূহের প্রতি পক্ষপাত নতুন নন্দনভাবনার সম্ভাবনাকে সংকীর্ণ করে রেখেছে। তবে এসব মোটা দাগের কথা। বাংলাদেশের নবীন শিল্পীদের অনেকেই সম্ভাবনাময়, কেউ কেউ নানামুখী নিরীক্ষা করছেন এবং বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা ও শিল্পনির্মাণে বিন্যাসের নতুনতর সোপানে উত্তরণের প্রয়াসও করছেন। তবে এজন্য বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্পজ্ঞান চর্চার ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন বাড়ানোর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। এর জন্য দৃশ্যকলা চর্চার প্রতিষ্ঠানগুলি – সরকারি ও বেসরকারি শিল্পশিক্ষালয়, দৃশ্যকলার পৃষ্ঠপোষকতাকারী প্রতিষ্ঠান, গ্যালারি, জাদুঘর – এদের আরো উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। এসবের পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্যক্তিশিল্পীর নিজেকে আজকের দৃশ্যকলাজগতের উপযোগী করে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী ও উদ্যমী হওয়া।