বিষণ্ণ শুভ্রতা

অনুবাদ : মেহবুব আহমেদ

সাদা ফ্রিজের গায়ে টেপ দিয়ে ছবি সাজিয়ে রেখেছে বেথ। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ও ফ্রিজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, একেকটা ছবিতে আঙুল দিয়ে মা প্রথমে মানুষের নাম বলে, পরে বলে শিশু। সময় কাটানোর ছলে এ-খেলাটা প্রায়ই খেলে – বড় দীর্ঘ সময় কেবল তারা দুজনেই কাটায়। ছোট্ট গোলাপি আঙুল দিয়ে শিশু ছবিতে খোঁচা দিতেই মা বলে ওঠে, ‘এ তো ড্যাডি, নতুন গাড়িতে!’ বা ‘টেড-এর প্রথম জন্মদিনে সুসান আর টেড’, ‘ক্রিসমাস ট্রির পাশে এই তো গ্র্যানমা!’ প্রতিটি ছবিই ঝলমল করছে, চুমকি আর কাগুজে মিষ্টি দিয়ে সাজানো উৎসবের রঙে রঙিন। সবাই হাসছে; আছে জন্মদিনের কেক, ক্রিসমাস ট্রি, চকচকে নতুন গাড়ি, আরো আছে ঝকঝকে সবুজ ঘাসের লন আর সাদা রঙের ঘরবাড়ি। শিশু জোরালো কণ্ঠে বলে, ‘ড্য … ডি!’ ‘সু … সান!’ উজ্জ্বল রঙের আনন্দে ও হাসে। মাও হাসে, আনন্দে খেলাটা খেলে, তার বাচ্চা পরিবারের সবার সঙ্গে পরিচিত হতে হতে পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠছে।

এবার শিশু আরেকটি ছবির দিকে হাত বাড়ায় কিন্তু ওর আঙুল ওখানে পৌঁছায় না; ছবিটি প্রায় পুরোপুরি সাদা, কেবল ধূসর কিছু ছায়ারেখা আকার ও অবয়ব তুলে ধরেছে। দুজনের ছবি, দুজনের পরনেই তুষারশুভ্র কাপড়, কাঁধ পর্যন্ত ঢাকা সে-কাপড়ে; তাদের মাথার পেছনটা অনাবৃত এবং তাও একেবারে সাদা। সাদা রঙের রান্নাঘরে, সাদা ফ্রিজের পাশে, সাদা ফ্রেমের জানালায় তারা দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে নয়, তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। তুষার ঝরছে জানালার শার্সি বেয়ে, ঢেকে দিচ্ছে পত্রবিহীন গাছ, কাঠের পাঁচিল আর বাইরের জমি। তাদের চোখের সামনে এক তুষারশুভ্র দৃশ্য, সে-দৃশ্যের সঙ্গে তারাও যেন মিলেমিশে গেছে। প্রায় একাকার হয়ে গেছে।

গোলাপি আঙুল বাড়িয়ে শিশু সাদা ছবিটিতে খোঁচা দেয়। মায়ের মুখে তক্ষুনি কোনো কথা সরে না, সেও যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। সেও যেন জানালায় দাঁড়ানো দুজন মানুষের সঙ্গে সাদা রান্নাঘরের বাইরের সাদা পৃথিবীটা দেখছে। ছবিটা কীভাবে যেন বরফের মতোই স্তব্ধতা দাবি করে, স্তব্ধতা সৃষ্টি করে।

ঝুলে পড়ে শিশুর হাতটা, মাথা নামিয়ে মায়ের কাঁধে রেখে হাই তোলে, তুষার স্তব্ধতা, তন্দ্রা : সাদা ছবিটা তার চোখে রাজ্যের ঘুম এনে দিয়েছে, হারিয়ে গেছে ও। ওকে ধরে মা পায়ের ওপর দুলে দুলে দোলাতে থাকে। কাঁধে রাখা মাথার স্পর্শটা ভালোবাসে মা, নিজের চিবুক দিয়ে চেপে সামলে রাখে। ঘুরে ঘুরে জানালার কাছে যায় যেন দুটো সাদা মানুষকে দেখতে পাচ্ছে আর দেখতে দেখতে তারা যেন মিলিয়ে যাচ্ছে গ্রীষ্মসন্ধ্যার সবুজ বিষণ্ণতায়। শিশুর কালো চুলের মধ্যে মৃদুস্বরে গাইতে থাকে, ‘মা আর মাসি – মা আর মাসি।’

 

‘দুটো?’ বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিল বেথ, নীল চাদরে ঢাকা গোল পেটের ওপর বইটা নামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে চশমার ওপর দিয়ে রাকেশের দিকে তাকাল। ‘দুটো টিকিট? কার জন্য?’ ও জানে রাকেশের বাবা নেই, মা বিধবা।

রাতের পোশাকে বিছানার ধারে বসে আঙুল মোচড়াচ্ছিল রাকেশ, নিচু ভাঙা গলায় বলল, ‘আমার মা আর মাসির জন্য।’ বেথের দিকে পিঠ দিয়ে কাঁধ ঝুঁকিয়ে বসে ছিল ও। সময়ের পার্থক্যের জন্য ভারতের ওই গ্রামে মধ্যরাতে ফোন করতে হয়েছে।

‘তোমার মাসি?’ নিজের চড়া গলা কানে গেল বেথের। ‘তোমার মাসির জন্য কেন আমাদের টিকিট পাঠাতে হবে? বাচ্চা হওয়ার সময় কেন তাকে আসতে হবে? বাড়িতে এত লোকজন, আমি পারব না রাকেশ।’

ধীরে ওর দিকে ফিরে বসল রাকেশ। ওর চোখের নিচে
কালচে-নীল কিছু জায়গা গোল গোল হয়ে ফুলে আছে। অন্য সময় বেথ ওই ফোলা জায়গাগুলো আঙুল ছুঁইয়ে দেখত; কিন্তু এখন ওর ভেতরটা কঠিন হয়ে উঠেছে, এরকম একটা সময়ে দুজন অপরিচিত বিদেশি হামলা করবে বাড়িতে, তারা আবার রাকেশের অতীতের অংশ। ইতোমধ্যেই ওর মনে হয়েছে বাচ্চা হওয়ার সময়টাতে ওর মায়ের আসার অনুমতি দিতে দেওয়া উচিত হয়নি রাকেশকে। প্রথম যখন রাকেশ কথাটা বলেছিল তখনই ওর মনে হয়েছিল কেমন অস্বাভাবিক, সেকেলে ধারণা আর এখন তো সত্যিই অদ্ভুত মনে হচ্ছে। জোর গলায় বলল, ‘দুজন কেন? আমরা তো কেবল তোমার মাকে বলেছি।’

রাকেশ সাধারণত সহজেই হাসতে পারে, আশ্বস্ত করতে পারে, মৃদুস্বরে সান্তবনা দিতে পারে; কিন্তু বেথ সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর থেকে ও অস্থিরতার মধ্যে আছে। এ-বিষয়টাকে বেথ কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে নিয়েছে অথচ রাকেশ কেবলই উদ্বিগ্ন হচ্ছে। কিন্তু বেথ বুঝতে পারল তা নয়, অন্য কোনো কারণে ও চুপচাপ মনমরা হয়ে বিছানার ধারে বসে হাত কচলাচ্ছে, বেরিয়ে এসেছে চোখের নিচের নীলচে ফোলা জায়গাগুলো।

‘কী ব্যাপার?’ তীক্ষনস্বরে প্রশ্ন করে চশমাটা খুলে রেখে বই বন্ধ করল বেথ। ‘কোনো অসুবিধে হয়েছে?’

নিজেকে সচেতন করে মাথা নাড়ল রাকেশ; কিন্তু হাসতে চেষ্টা করেও পারল না, তারপর বিছানায় পা তুলে বিমর্ষ চেহারাটা নিয়েই ওর পাশে শুয়ে পড়ল। বেথকে তেমন দেখতে পাচ্ছিল না; কিন্তু হাত বাড়িয়ে ওর কপালের পাশের চুলগুলো বুলিয়ে দিতে চাইছিল। এতে বিরক্ত হলো বেথ, পরিষ্কার বোঝা গেল সাধারণ নয়, কঠিন কোনো অনুরোধ করতে চাইছে রাকেশ। শক্ত হয়ে উঠল বেথ, প্রত্যাখ্যান করতে প্রস্ত্তত হলো। এই অবস্থায় ওর কাছে কিছুই আশা করা উচিত নয় রাকেশের। দুজন অতিথি, দুজন বিদেশি – এরকম একটা সময়ে। ‘আমাকে বলো কী ব্যাপার’, দাবি করল বেথ।

সুতরাং রাকেশ ওকে বলতে শুরু করল। ‘তারা দুজনেই আমার মা বেথ। আমার দুই মা।’

আশা অনুর তিন বছরের বড় আর তাতেই যেন সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। আশা পরিবারের প্রথম সন্তান। বাবা ওকে নিয়ে এত আনন্দে ছিলেন যে, কখনো তার মনেই হয়নি ও ছেলে হলে ভালো  হতো। তিনি ওকে ওপরে ছুড়ে দিয়ে হাত পেতে ধরতেন, ওর কাঁধে মুখ গুঁজে গোঁ-গোঁ শব্দ করতেন আর ও খিলখিল করে হেসে উঠত। ফর্সা, গোলগাল, কোঁকড়া চুল আর উজ্জ্বল কালো চোখের বাচ্চাটা তাকে খুশি করেছিল। ওর মা যখন ওকে কুঁচি-দেওয়া ফুলতোলা, ফোলা ফোলা জামা পরিয়ে মাথায় ফিতে বেঁধে দিতেন, তখন বাবার আরো ভালো লাগত। মেয়েকে নিয়ে বাবা যে আনন্দিত ছিলেন এতে মাও খুশি হতেন, স্বস্তি পেতেন। ওর বাবা বলতেন, ‘সুন্দরী মেয়ে ঘরের অলংকার।’

সুতরাং আশা নিজেকে অলংকার ও আনন্দ জেনেই বড় হচ্ছিল।  খেলনা বা খাবার চাইতে, মা-বাবার কোলে উঠতে কখনো কোনো দ্বিধা করেনি। নিঃসংকোচে সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গান গাইত, লাফালাফি করত।

তিন বছর পর যখন অনুর জন্ম হলো, তখন কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াল। বাবা যদিও তার ওপর ঝুঁকে পড়ে মাথায় আদর করলেন এবং হতাশাব্যঞ্জক কোনো কথাই বললেন না, তবু হতাশার ছায়া বাতাসে ছিল আর অনুকে তা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। ওর নামকরণ হয়েছিল অন্নপূর্ণা, দেবী দুর্গার নামে এ-নাম (কেউ মনেই রাখেনি)! পরিবারের যেসব বয়স্ক লোক মায়া বা বিবেকের তেমন পরোয়া করে না, তারা হতাশার কথা গুনগুন করে বলেই যেতে লাগল এবং মা যখন ওকে শক্ত হাতে কাছে টেনে ওর পক্ষে কথা বলতেন তখনই ওই শিশু অনু বুঝতে পারত ও দুর্বল অবস্থানে আছে। ওভাবেই ও বড় হতে লাগল।

বড় বোনের কাছে কাছে ওর কাপড়ের কোণটা ধরে ছায়ার মতো থাকত অনু, আর আশা তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ওকে পেয়ে খুশিই ছিল, তারপরও প্রতিটি পদক্ষেপেই অনু ইতস্তত করত, সাহসের অভাব – কি জানি কি হয় অবস্থায় থাকত। ওর ব্যবহারে আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ ছিল না।

ওদিকে ঘরের কাজকর্মে আশার স্বাভাবিক দক্ষতা ছিল। রান্না, বাসন ধোয়া, ঘর ঝাড়া এসব ও মেয়েদের সঙ্গে মিলে উৎসাহ নিয়েই করত, ওড়না কানের পেছনে আটকে কামিজের হাতা গুটিয়ে স্বচ্ছন্দভাবে বসে মশলা গুঁড়ো করত, আটা মাখত, রুটি বানাত অথচ অনু সেখানে কিছুই ভালো পারত না। পকোড়া ভাজতে গিয়ে কীভাবে যেন হাত পুড়িয়ে ফেলত আর শুকনো লংকা গুঁড়ো করতে এত সময় লাগাত যে, ওর মা অধৈর্য হয়ে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিতেন। কুয়ো থেকে এক বালতি জল তোলার শক্তিটুকুও অনুর ছিল না, আধ বালতি করে তুলত। বাড়িভরা যখন অতিথি আর সবদিকে কেবল হইচই আর এলোমেলো, অনু তখন আসেত্ম সরে গিয়ে চোখের আড়ালে থাকত, ডাকাডাকির পর সামনে এলে কাজ ফাঁকি দিচ্ছে বলে বকাঝকা করা হতো। সবসময় পরামর্শ দেওয়া হতো, ‘দেখো, বোনকে দেখো’, তখন সে শান্ত ও প্রশংসাভরা চোখ তুলে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকত। আশা জানত বোনের স্বভাব, চোখ টিপত ওর দিকে তাকিয়ে। তারপর অনুপস্থিতিতে যে-খাবারটা ও পায়নি তাই লুকিয়ে ওর হাতে তুলে দিত। ওদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে উঠেছিল, সুতোয় সুতোয় গাঁথা হয়ে শক্ত হয়েছিল সেই একাত্মা।

পরে ওদের বাবা-মার কোলে ছেলেরা এলো এবং মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন আর রইল না। সহৃদয় পিতা মেয়েদুটিকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন; তার এই অসাধারণ পদক্ষেপে বয়স্কদের সমালোচনার উত্তরে বলেছিলেন, ‘ক্ষতি কী? আজকাল মেয়েদের লেখাপড়া জানা উচিত। কে জানে একদিন ওরা হয়তো অফিসে বা ব্যাংকে কাজ করবে!’

অবশ্য ওরকম কিছু ঘটেনি। কোনো মেয়ের অফিসের কেরানি বা ব্যাংকের টেলর হওয়ার জন্য পাঞ্জাবের ওই গ্রামে আরো একটি প্রজন্মকে আসতে হয়েছে। নীল সুতির কামিজের ওপর সাদা ওড়না দিয়ে, কেডস পরে আশা আর অনু স্থানীয় সরকারি বিদ্যালয়ে কয়েক বছর গিয়েছিল। সেখানে তারা বেঞ্চে বসে পাঞ্জাবি বর্ণমালা ও সংখ্যা শিখেছে এবং এখানে ওদের দুজনের মাপকাঠিটা একেবারে উলটে গেল, কারণ আশার কাছে লেখাপড়া ব্যাপারটা ভয়ংকরভাবে কঠিন লাগছিল, যোগ-বিয়োগ করতে বা ছবিওয়ালা পুরনো পাঠ্যবই পড়তে ও ঘর্মাক্ত হয়ে উঠত, অথচ অনু আশাতীত দ্রম্নততায় চঞ্চল ছাগশিশুর মতো সংখ্যার ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলত আর বর্ণমালাও ও খুব সহজে শিখল। আশা মেজাজ খারাপ করে তাকাত বোনের দিকে কিন্তু বাড়ি ফিরে অনু যখন সুন্দর হাতের লেখায় ওর বাড়ির কাজ করে দিত, তখন তার ভালোই লাগত। ‘গরু’, ‘আমার প্রিয় উৎসব’, এসবের ওপর রচনা লিখে অনু প্রশংসা পেয়েছে; কিন্তু সেই সঙ্গেই বেজে উঠল ওর স্কুলপর্ব শেষের ঘণ্টা, কারণ তখন আশার বয়স পনেরো, তোড়জোড় করে তার বর খুঁজে এনে বিয়ে দেওয়া হলো আর সেই থেকেই অনু ঘরে রয়েছে, মাকে সাহায্য করছে।

আশার বর বেশ বড়সড় একজন মানুষ এবং তার বয়সও তেমন কম নয়; কিন্তু তা নিয়ে কেউ ভাবল না, কারণ তার জমিজমা ও পশুপাল ছিল প্রচুর। সে পাগড়ি পরত আর তার বিশাল এক পাকানো গোঁফ ছিল। তাকে প্রথম দেখে অনুর আশার কথা মনে হলো এবং প্রচ- ভয় পেয়ে গেল ও; কিন্তু পরে বুঝেছিল ওই সৎস্বভাবের স্নেহপ্রবণ মানুষটিকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। উজ্জ্বল চোখের বাকপটু প্রাণবন্ত স্ত্রীর প্রতি তার অনুরাগ পরিষ্কার বোঝা যেত এবং স্ত্রী ও তার পুরো পরিবারের প্রতিই সে উদার ছিল। তার গলার স্বর ছিল আশাতীত রকমের নরম ও সুরেলা, প্রায়ই সে তার অতিথিদের এবং গ্রামের সমাবেশে গান গেয়ে মাতিয়ে দিত। বহুরকম গুণ আশারও ছিল; কিন্তু এই ধরনের শিল্পগুণ ছিল না। ওর স্বামীর গান ও আসন গেড়ে বসে প্রশংসাভরা দৃষ্টিতে দুহাতের তালুর মধ্যে মুখটা রেখে শুনত, সে-হাত আর হাতের আঙুল ঝলমল করত স্বামীর দেওয়া আংটি-চুড়িতে।

ওরা প্রায়ই অনুকে এনে ওদের সঙ্গে রাখত। পায়ে পায়ে ঘোরা অনুকে রেখে থাকতে পারছিল না আশা। ও মা হলে হয়তো পারত – অনেক শিশুই ওর গর্ভে এসেছে; কিন্তু তার কয়েকজনকে ও মৃত প্রসব করেছে, কয়েকজন হয়েই মারা গেছে, কেউই দিন কয়েকের বেশি বেঁচে থাকেনি। এই কারণে ওদের বিলাসবহুল, জিনিসপত্রে ঠাসা বড় বাড়িটার মধ্যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। আশা খিটখিটে আর বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল, ওর সমস্ত ভাবে-ভঙ্গিতে তিক্ততা প্রকাশ পাচ্ছিল। ওদিকে ওর স্বামীও হতাশায় ডুবে যেতে লাগল, এরকম যে হতে পারে কেউ ভাবতে পারেনি আগে। অনু দেখেছে, হয় সে বারান্দার শেষ প্রামেত্ম রাখা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে রয়েছে, নয়তো শীতল সন্ধ্যায় বাড়ির ছাদে বসে গভীর বিষণ্ণতায় নিজের দিগন্তবিসত্মৃত ক্ষক্ষত-খামারের ওপারে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো শিখ মন্দিরের সাদা চূড়া আর সোনার গম্বুজের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের সমস্ত কাজ সে তার প্রধানতম বিশ্বস্ত কর্মচারীর হাতে দিয়ে নিজে কর্মহীন দিনযাপন করতে শুরু করল। আশা তাতে আরো অস্থির হয়ে উঠল। ও নিজে দৃঢ় মনোবল নিয়ে সম্ভাব্য সমস্ত রকম কাজের মধ্যে নিজেকে নিযুক্ত করছিল এবং মনে করত, একজন পুরুষেরও তাই করা উচিত।

এরপর আরেকবার মা হতে গিয়ে ব্যর্থ আশা কঠিন ইচ্ছাশক্তিতে নিজেকে সক্রিয় করে অনুর বিয়ের আয়োজনে যোগ দিলো। বিয়ে বাবা-মা ঠিক করেছেন। পাশের শহরের চুপচাপ গম্ভীর ছেলেটি কেরানির কাজ করে, তার দাঁত বেশ বড় আর হাতদুটোও এবং দু-হাত একত্র করে সে অবিরাম ঘষতে থাকে। বধূবেশী মেয়েরা যেমন করে মুখ আর চোখের জল গোপন করে, অনুও বিবাহপর্বের সারাটা সময় তা-ই করল। আশা ওকে সান্তবনা দিলো, উৎসাহিত করতে চেষ্টা করল, ওর সঙ্গে অন্য মেয়েরাও ছিল।

আশ্চর্যজনকভাবে এই সম্ভাবনাহীন ছেলেটি, চশমার ভেতরে যার চোখ অবিরাম পিটপিট করছে এবং কর্কশ স্বরে একটা পুরো বাক্য যে একবারে বলতে পারে না, সে কিন্তু বাবা হওয়ার ব্যাপারে একটুও থতমত খেল না, এমনকি ছোটখাটো অনু, নিঃশব্দে হেঁটেচলে বেড়ায়, তারও নারীত্বে বা মাতৃত্বে কোনো অসুবিধে দেখা গেল না – তার সন্তান সহজেই জন্মাল এবং ছেলে হলো। গোলগাল, কালো চুলের, লালচে গালের ছেলেটি পা ছুড়ে, হাত মুঠো করে চিৎকার করতে লাগল দুধের জন্য, পরিষ্কার বোঝা গেল এ-শিশু বেঁচে থাকবে বলেই এসেছে এবং জীবনযুদ্ধে জয়ীও হবে।

অনু আর তার স্বামী যদি-বা শিশুকে দেখে কিছু আশ্চর্য হয়ে থাকে তা আশা আর তার স্বামীর বিস্ময়ের কাছে কিছুই নয়। এ ছেলে তাদের অভিভূত করে ফেলল। লম্বা, নরম হাতে আশা শিশুকে তুলে নিয়ে দোল দেয়, আদর করে আর ওর স্বামী আশার হাতেবোনা গোলাপি উলের শালে জড়ানো শিশুকে আশার কোল থেকে নিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। আশার যোগ্যতায় মনটা গলে যায় অনুর, কৃতজ্ঞবোধ করে; মাখন তোলা, মিষ্টি বানানোর মতোই দক্ষ হাতে আশা শিশুর যত্ন নিতে জানে। অনু শুয়ে থাকে এবং মা আর শিশুকে নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয় বোনকে। অনুর জন্য লম্বা বড় পাত্রে তালমিছরি দিয়ে দুধ আর বাদামের শরবত করে আশা, বাচ্চাটাকে হাসিখুশি রাখে, খাইয়ে সন্তুষ্ট করে, গায়ে শর্ষের তেল মাখায়, রুপোর ঝিনুক দিয়ে মিষ্টি দুধ খাওয়ায়, না হাসা পর্যন্ত সুড়সুড়ি দিতে থাকে।

অনুর স্বামী হতবাক হয়ে দেখতে থাকে, নিজের বাচ্চাকে যে কোলে নেবে তাতেও ও দ্বিধাগ্রস্ত : ছোট জীবজন্তুকে ভয় পাওয়ার প্রবণতা অবশ্য ওর আছে, কুকুর-বেড়ালের বাচ্চা সামনে পড়লে সজোরে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। আর অনু মাঝে মাঝে বিছানা ছেড়ে উঠে মাতৃসুলভ কিছু দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছে; কিন্তু একটার পর একটা আশার হাতে ছেড়ে দিতে বেশি সময় লাগেনি তার। প্রথমে ছেড়ে দিলো খাওয়ানোর ভার এবং কাপড় পরানোর কাজ, তারপর বাচ্চাকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর প্রচেষ্টাও ছেড়ে দিলো আর সেই থেকেই খাওয়ানোর দায়িত্ব পুরোপুরি আশার হাতে।

প্রথমবার যখন মনে হলো বাচ্চাটা একটু অসুস্থ – আসলে দাঁত ওঠার সময়টাতে পেটে গোলমাল হয়েছিল – আশা ওকে কম্বলে জড়িয়ে নিজের বাড়িতে গিয়ে উঠল, বলে গেল, ‘সুস্থ হলেই আমি ওকে নিয়ে আসব, তুই বিশ্রাম কর অনু, তোর ঘুম হয়নি, অসুস্থ দেখাচ্ছে তোকে।’

এক সপ্তাহ পর বাচ্চাকে আনতে গেল অনু। প্রথমেই ওর দেখা হলো আশার স্বামীর সঙ্গে, বারান্দায় সেই একই চেয়ারে বসে আছে, কিন্তু তখন তার একেবারেই অন্যরূপ : বাচ্চাটাকে হাঁটুর ওপর নিয়ে লোফালুফি করছে আর গুনগুনিয়ে গাইছে এক গানের কলি, তার দুই চোখ জ্বলজ্বল করছে শিশুর চোখের সঙ্গে। বাচ্চাকে তার কোল থেকে নিতে এগিয়ে গেল না অনু, বরং থমকে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করতে লাগল। তারপর পাগড়ি পরা সেই বড়সড় মানুষটার চোখে পড়ল অনু দাঁড়িয়ে আছে, উচ্ছ্বসিত চেহারায় বলে উঠল, ‘রাজপুত্র! আমার যা কিছু জমিজমা, গরু-ছাগল, দুধের খামার, আখ মাড়াই কল সব ওর হবে, রাজপুত্রের মতো বড় হবে ও!’

রাকেশের প্রথম জন্মদিন উদ্যাপন করা হবে আশার বাড়িতে – ‘আমরা জাঁকজমক করে জন্মদিনটা করব’, আশার কথায় পরিষ্কার বোঝা গেল অনুদের ওরকম কিছু করার সামর্থ্য নেই। কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রস্ত্ততি চলতে লাগল। সমস্ত গ্রাম খাবে। আস্ত ছাগলের রোস্ট হবে, পরিবারের মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল মিষ্টি আর রকমারি খাবার তৈরিতে। খরচের কথা কেউ ভাবল না। সবকিছুর তদারকিতে রইল আশার স্বামী। ভোজে দেওয়ার জন্য নিজেই ভোরবেলা পাখি শিকারে বেরিয়ে পড়ল, ঢেউ-খেলানো শস্যক্ষক্ষতের ভেতর নামার আগে মেয়েদের ডেকে বলে গেল, তার ফেরার সময়টাতে যেন আগুন তৈরি থাকে।

এই তার শেষ কথা – ‘আগুন তৈরি রেখো।’ আশার মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ও যেন বুঝতে পেরেছিল, নিজের চিতার আগুন জ্বালাবার কথাই বলে গেছে।’ হঠাৎ করেই বন্দুকের গুলি ওর কাঁধ আর একপাশের ফুসফুস ভেদ করে মারাত্মক আহত করল, রক্তপাত হতে হতে মারা গেল মানুষটা। এক বছরের রাকেশের জন্মদিনের উৎসব হলো না।

অনু বুঝতে পারল, আশার সান্তবনার একমাত্র অবলম্বন রাকেশ, ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা তুলতে পারল না সে। ভেবেছিল শোকের প্রথম মাসটা বিধবা আশার কাছে থাকুক রাকেশ, তারপর সময় গড়িয়ে গেল দু-মাসে, তারপর তিন মাসে। পরিবারের লোকজনের কাছে ঠাট্টাবিদ্রূপ শুনতে হলো অনুর স্বামীকে – নিজেকে সে পরিবারের কর্তা হিসেবে দাঁড় করাতে পারেনি ইত্যাদি। সুতরাং অনুকে সে হুকুম করল বাচ্চা ফিরিয়ে আনতে। ‘ও ওখানেই থাক, ওকে আশার দরকার, আমাদের তো আবার ছেলে হতে পারে’, নিজের উত্তরে নিজেই আশ্চর্য হলো অনু। আসবাবহীন তুচ্ছ, বিষণ্ণ একটা বাড়ি ওদের, বাজারের মধ্যে সরু, ঘিঞ্জিমতো কিছু ঘর, আলো-বাতাস কিছু ঢোকে না – এই নিরানন্দ পরিবেশে বসে রাকেশের জন্য জামাকাপড় সেলাই করে অনু, দ্রম্নত বাড়ছে ছেলে। মাথায় ওড়না টানা অনুকে দেখে মনে হয় ওর স্বামী যে তেমন জ্বালাতন করে না তাতেই যেন ও সব মেনে নিয়েছে, তবে মাঝে মাঝে কিন্তু সেও প্রচ- রাগারাগি করে।

অবশ্য ওরকম ঘটনার পর উপহার নিয়ে বাচ্চাটাকে ওরা দেখতে যায়। রাকেশ বাবা-মাকে মেসো আর মাসি বলে জানে। ওকে খুশি করার জন্য আবেদনের ভঙ্গিতে নিঃশব্দে খেলনা, মিষ্টি এগিয়ে দেয় ওরা। কবে থেকে রাকেশ ওদের মাসি-মেসো বলে ডাকছে কারো মনে নেই, আশাকে তো ইতোমধ্যেই মা বলে ডাকে : স্পষ্টতই সে মায়ের ভূমিকায় আছে।

অনুর বিশ্বাস ছিল, তাদের ঘরে আরো সন্তান আসবে। চাইছিল একটা মেয়ে হোক। কেন যেন মনে হতো, মেয়েটা ওর মতো হবে এবং হয়তো ওর কাছেই থাকবে। কিন্তু আশার বাড়িতে রাকেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় জন্মদিন পার হয়ে গেল, অনুর ঘরে আর সন্তান এলো না। হতাশ হয়ে পড়েছে অনুর স্বামী, বিরক্ত হয়ে থাকে; ওর গোটা পরিবার সম্মিলিতভাবে ওকে বিদ্রূপ করে। দীর্ঘ সময় ও বাইরে কাটায়। গুজব রটতে থাকে, অনুর কানে আসতে দেরি হয় না। ভদ্রলোকের যাবার কথা নয় শহরের এমন সব পাড়ায় সে যাচ্ছে বলে শোনা গেল। অনু তেমন উত্তেজিত বা উদ্বিগ্ন হয় না : সবার অলক্ষ্যে রাত্রিকালীন এক যোগসূত্রতার মধ্যে সীমাবদ্ধ তাদের সম্পর্ক, দিনের আলোতে তো তার প্রকাশ ছিল না। কিন্তু স্বামীকে অসুস্থ হতে দেখে অনু চিমিত্মত হয়ে পড়ল। তার সমস্ত শরীর জুড়ে ফোঁড়া আর চুলকানি, জ্বর হয় ঘনঘন, একই রকম ইতস্তত ভঙ্গিতে অনু তার সেবা করে। তবু ওর স্বামীর পরিবারের লোকজন তীব্র ভাষায় বকাঝকা করে অনুকে এবং কিছু জানে না বলে ওকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরাই সেবার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু অনুর স্বামী দিন দিন খারাপের দিকেই যেতে থাকে এবং রাকেশের পঞ্চম জন্মদিনের কয়েকদিন আগেই তার মৃত্যু হয়। বিলাপ করতে লাগল তার পরিবার। বলল, তাদের যত্ন সত্ত্বেও অনুর দোষেই শুকিয়ে ছোট হতে হতে মারা গেছে সে। যা কিছু নিয়ে এ-বাড়িতে বধূবেশে ঢুকেছিল অনু, তাই দিয়ে ট্রাঙ্ক গুছিয়ে নিল। এ-বাড়ির কোনো কিছুতে হাত দিলো না। তারপর আশার বাড়িতে গিয়ে উঠল – আশা আর ছেলের সঙ্গে থাকবে অনু।

অন্ধকারে কখন থেকে যেন বেথ রাকেশের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করেছে আর রাকেশ সোজা হয়ে শুয়ে হাতদুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে ছাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ‘তাহলে তুমি যাকে মা বলে ডাকো সে আসলে তোমার মাসি?’ বেথ জিজ্ঞেস করল।

দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলল রাকেশ। ‘আমি তাকে মা বলেই জেনেছি।’

‘আর তোমার মাসি তোমার সত্যিকার মা? তোমাকে কখন তারা কথাটা বলেছে?’

‘জানি না’, স্বীকার করল রাকেশ, ‘জেনেই বড় হয়েছি আমি – গ্রামের লোকে হয়ত বলাবলি করত; কিন্তু ছোটবেলায় তো কেউ প্রশ্ন করে না, মেনে নেয়।’

‘কিন্তু তোমার সত্যিকারের মা তোমাকে বলেনি কখনো? তোমাকে সরিয়ে নিতে চায়নি?’

‘না!’ উত্তেজিত হয়ে বলল ও। ‘যা ঘটেছে বলেছি, এটুকুই বেথ। তিনি কখনো ওরকম কিছু করেননি – তিনি আমাকে তার বোনের হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন, তার স্বামী মারা যাওয়ার পর ভালোবেসে এবং মায়া করে দিয়েছিলেন। কখনো আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। ভালোবেসে করেছিলেন।’ আবার বোঝাতে চাইল রাকেশ, ‘এ বোনের জন্য বোনের ভালোবাসা।’

রাকেশের বোন নেই; কিন্তু বেথের সুসান নামে একটি বোন আছে। সুসানের কথা ভাবতে লাগল বেথ, অপদার্থ, বেকার স্বামী আর একরাশ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চাকাওয়ালা অস্থায়ী এক আবাসে ম্যানিটোবার কোথায় যেন থাকে। তার হাতে নিজের বাচ্চা দেওয়ার অদ্ভুত চিন্তাটা আসতেই নাক টানল বেথ। ‘আমি তো জানি, আমার বাচ্চা আমি কোনোভাবেই সুসানের হাতে দিতে পারতাম না’, রাকেশের কপালের পাশ থেকে হাতটা সরিয়ে নিজের পেটের ওপর রেখে ঘোষণা দিলো বেথ।

‘তুমি জানো না, বলতে পারো না – ঘটনা কি ঘটে আর মানুষ কি করতে পারে -’

‘অবশ্যই আমি জানি’, গলা চড়িয়ে বলল বেথ। ‘কেউ কিছুতেই আমাকে দিয়ে এ-কাজটা করাতে পারবে না, আমার বাচ্চা আমি দিয়ে দেবো?’ এবার ওর স্বর তীক্ষন। রাকেশ চোখ বুজে, পাশ ফিরে বোঝাতে চাইল বিষয়টি ও আর টানতে চায় না।

রাকেশের এই ভঙ্গির ইঙ্গিতটুকু বুঝেও বেথ বলতে লাগল, ‘কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হয়নি কখনো, তোমাকে মানুষ করার ব্যাপারে তারা কি কখনো দ্বিমত করেনি? তাদের আলাদা কোনো চিন্তাই ছিল না এ-ব্যাপারে? জানো, সুসানকে আমি বলেছি -’

রাকেশ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘ব্যাপারটা তা নয়, তারা একে অন্যকে বুঝতেন। আমার দেখাশোনা করতেন মা, আমার জন্য রান্না করে আমাকে খাইয়ে দিতেন, আমাকে একটা পাটিতে বসিয়ে নিজে সামনে বসে নিজের হাতে আমাকে খাওয়াতেন। কী যে ভালো রান্না মায়ের! বেথ, তোমার ভালো লাগবে -।’ এটুকু বলেই হাসল রাকেশ, বুঝল বেশি হয়ে যাচ্ছে, বোকার মতো শোনাচ্ছে। সামলে নিয়ে বলল, ‘আর মাসি আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন আমার হাত ধরে। সন্ধ্যায় আলো জ্বালিয়ে দিতেন, তখন বই বার করে তাকে দেখাতে হতো। তিনি আমাকে লেখাপড়া দেখিয়ে দিতেন – আর মনে হয় আমার সঙ্গে নিজেও শিখতেন। তিনি তোমার মতোই পড়তে ভালোবাসেন’, এবার সে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাটা বলতে পারল।

‘কিন্তু ওরা কেউ কাউকে ঈর্ষা করেননি কখনো? একজন তোমার জন্য রান্না করছেন, খাইয়ে দিচ্ছেন, আর একজন পড়া দেখিয়ে দিচ্ছেন? দুজনে আলাদা আলাদা কাজ করেছেন, তাই না?’

ওকে থামিয়ে দেওয়ার জন্যই বেডকভারের ওপর দিয়ে ওর হাতটা ধরল রাকেশ, বলল, ‘ব্যাপারটা ঠিক তা নয়।’ ও চাইছিল বেথ চুপ করলে গ্রামের সেই দেয়ালঘেরা উঠোনটার কথা মনে করবে, সেই পাম্প টিউবওয়েলটা, খাবার জল পড়ে ঝরঝর করে, গরু-বাছুরগুলো ওদের ঘরে খাবারের চারপাশে নড়াচড়া করছে, দুধওয়ালা এসেছে ফেনা ওঠা দুধের পাত্র নিয়ে, ভোরবেলায় মাটির চুলোয় মা, ওর মাসি, ওর জন্য চা বানাচ্ছেন ধোঁয়াচ্ছন্ন অস্পষ্টতায়। কবুতরগুলো তক্তার ওপর বসে ডাকছে, একটা পালক খসে পড়ছে –

‘যাই হোক, আমার সঙ্গে তো দেখা হচ্ছেই তাহলে দুজনের – আমি নিজেই জেনে নিতে পারব’, একটু কঠিন স্বরে কথাটা বলে ঝট করে আলো নিভিয়ে দিলো বেথ।

সকালবেলা বেথ এসেছে মায়ের কাছে। এত সকালে সাধারণত ও আসে না। বেথের মা ডরিস মেয়ের জন্য কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বলল, ‘এরকম অদ্ভুত কথা কখনো শুনিনি।’ রান্নাঘরের পস্নাস্টিক ঢাকা টেবিলে কনুই তুলে দুহাতে মুখটা ধরে বসেছিল বেথ। ডরিসের পায়ে তখনো সিস্নপার। শোবার পোশাকের ওপর হাউসকোট পরে নিয়েছে। রান্নাঘরে রোদ এসেছে, এখানেই সে ছিল।

উত্তর না পেয়ে টেবিলে হাতদুটো রেখে ওর বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাই না! রাকেশের দুই মা! কে শুনেছে এরকম কথা? আমাদের আগে বলেনি কেন?’

‘রাকেশ আমাকে দুজনের কথাই বলেছে’, রেগে গিয়ে কফি নাড়তে শুরু করল বেথ। ‘বলেছে মা আর মাসি হিসেবে। আমি জানতাম তারা দুজনেই বিধবা, একই সঙ্গে থাকে, এইমাত্র।’

মনে হলো ডরিসের যেন আরো অনেক কথা বলার ছিল এ-বিষয়ে। লাল ডোরাকাটা হাউসকোটের বেল্ট শক্ত করে বেঁধে বেথের মুখোমুখি বসল। ‘মনে হচ্ছে কোনোদিন তোমাকে বলেনি কে তার মা আর কেই বা তার বাবা, মানে সত্যিকারের বাবা-মার কথা বলছি। ব্যাপারটাকে আমি অদ্ভুত ছাড়া কিছুই বলতে পারিনে বেথ, অদ্ভুত!’

বিরক্ত হয়ে নড়ে উঠল বেথ। ‘মনে হয় না এভাবে কখনো ও ভেবেছে, ও শিশু থাকতেই ঘটনাটা ঘটেছে। ও বলে ব্যাপারটা জেনেই ও বড় হয়েছে। বলেছে, বোনেরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে।’

এক হাতে মাথা চুলকাতে লাগল ডরিস, আর এক হাতে সসারের ওপর কফি কাপটা বাজাতে লাগল, ‘বোনেরা ভালোবাসে একে অপরকে – এতখানি? কথাটা পাগলামির মতো নয় কি? মাথা ঠিক থাকলে কেউ নিজের বাচ্চা এভাবে বোনকে দিয়ে দেয়? মানে তুমি কি সুসানকে তোমার বাচ্চা দেবে? আর সুসান কি নেবে? যেন জন্মদিনের উপহার একটা!’

‘ওহ্, মা!’

‘এই তো কফি ফেলে দিলে, দাঁড়াও স্পঞ্জটা নিয়ে আসি, উঠো না, শরীরটা বাড়ছে তোমার। ঠিক আছো তো? আমার কথায় কিছু মনে করো না।’

‘আমি ঠিক আছি মা, কিন্তু দুজন মানুষ আসবে বাড়িতে, রাকেশের মা হলে সে এক কথা, কিন্তু দুজন একসঙ্গে – জানি না।’

‘তাই তো বলছি আমি’, ডরিস দ্রম্নত যোগ করল। ‘তার ওপর এত খরচ, ও টিকিট পাঠাচ্ছে কেন? ভেবেছিলাম ওদের টাকা আছে, এমনভাবে খামার জমির কথা বলে মনে হয় যেন জমিদার ছিল -’

‘ওহ্ মা, ও তো বড় হয়েছে ওখানে, তাই বলে! অনেক দিন আগেই ওসব বিক্রি হয়ে গেছে। ওই টাকায়ই ওর লেখাপড়া হয়েছে ম্যাকগিলে। টাকা লাগে তো।’

‘কী – পড়াতে সব শেষ হয়ে গেল? সবসময়ই বলেছে ওদের বিরাট খামারের কথা -’

‘তারা ভাগে ভাগে বিক্রি করেছে। আমাদের বাড়ি কিনতে টাকা দিয়েছে, রাকেশের প্র্যাকটিস শুরু করার জন্যও টাকা দিয়েছে।’

ডরিস প্যাকেট ঝাঁকিয়ে একটা সিগারেট বার করে মুখে দিয়ে বলল, ‘হুম।’

‘ওহ্ মা, আমি যে এখন ধোঁয়া সহ্য করতে পারিনে, বমি বমি লাগে, তুমি তো জানো’, আপত্তি জানিয়ে বলল বেথ।

‘তাই তো আমার সোনা’, দেশলাইটা নামিয়ে রেখে বলল ডরিস, কিন্তু সিগারেটটা তখনো ওর মুখে।

‘আমি কেবল তোমার জন্য চিন্তা করছি, দুজন ভারতীয় মহিলার সঙ্গে থাকা – তাও এ-অবস্থায়।’

‘আমার ধারণা তারা বাচ্চার যত্নটা জানে’, বেথ বলল।

‘কিন্তু কানাডার কথা কি কিছু জানে?’ নিজে যে জানে সেই আত্মবিশ্বাসে বলল ডরিস। ‘আর কানাডার শীতের কথা?’

 

রাকেশের মায়েরা ভেবেছিল তারা জানে। এতো বছর রাকেশের নিয়মিত লেখা চিঠি তারা পেয়েছে যদিও কানাডার তেমন কোনো খবর সেসব চিঠিতে থাকত না। স্থানীয় কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর বিদেশে গিয়ে আরো পড়ার জন্য আশা চাপ দিতে লাগল। অনুর নিজের টাকা ছিল না, সুতরাং এ-ধরনের প্রস্তাব করার সাহসও পায়নি এবং এটা ওর বোনের সাহস ও দৃঢ়তার আরেকটি উদাহরণ। গ্রামের ভালো ছেলেদের চলে যেতে দেখেছিল আশা এবং তাই অনুকে স্বামীর উলেস্নখ দিয়ে বলেছিল, ‘তিনি রাকেশকে বিদেশে পড়াতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমরা ওকে সবচেয়ে ভালো শিক্ষা দেব’, সুতরাং আমি কেবল তার কথামতো কাজটাই করছি।’ বলে আশা কানের পেছনে বিধবার সাদা ওড়নাটা আটকে দিয়ে আত্মসম্মানে উজ্জ্বল মুখটা তুলে ধরল। অনু খরচের কথা তুলতেই হাত নেড়ে থামিয়ে দিলো – ওর এই দক্ষ হাতে ছেলেকে যথাযথভাবে মানুষ করেছে; জমিজমা, খামার চালিয়েছে এবং সমস্ত হিসাবপত্র রাখছে। বলল, ‘কিছু জমি আমরা বিক্রি করে দেবো। এত রেখে কী হবে? রাকেশ তো এ-কাজ কখনো করবে না।’ সুতরাং রাকেশ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন পাঠাতে শুরু করল। রাকেশের চলে যাওয়ার চিন্তাটা দুই মায়ের বুকে চেপে বসছিল ঠিকই কিন্তু ও যে যেতে পারছে এবং পরিবারে এই প্রথম উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে, এই গর্বেও তারা উচ্ছ্বসিত ছিল। পড়ার খরচ চালাতে একটু একটু করে জমি বিক্রি করতে করতে পুরনো খামারবাড়িটা ছাড়া আর কিছুই রইল না। পড়া শেষ হলে রাকেশ চিঠিতে জানাল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ওর ডাক আসছে – চিঠিতে সাফল্যের কথা যেমন ছিল তেমন ওর দেশে না ফেরার ইঙ্গিতটুকুও ছিল – মায়েরা ওড়নার কোণ দিয়ে আনন্দ-বেদনার অশ্রম্ন মুছল।

রাকেশ চিঠিতে ওর অর্জন জানাত : ওর বেতন, ওর পদোন্নতি এবং আরো থাকত শহরে ওর অ্যাপার্টমেন্টের কথা; তারপর এসেছে ওর নিজের অফিস ও প্র্যাকটিস সাজানোর কথা। চিঠির সঙ্গে প্রমাণস্বরূপ ছবিও আসত।

তারপর একদিন একটা ছবি দেখে তারা হতবাক হয়ে গেল : ছবিতে রয়েছে অফিস পার্টিতে রাকেশ এক হাতে একটি মেয়ের পিঠ জড়িয়ে রেখেছে, মেয়েটির ছোট করে ছাঁটা বাদামি চুলে সবুজ হেয়ার ব্যান্ড আর পরনে সবুজ ড্রেস। মেয়েটির মুখে ছড়িয়ে আছে হাসি আর জ্বলজ্বল করছে রাকেশের মুখ। একটু মোটা হয়েছে রাকেশ। বড় বক্লেসওয়ালা চামড়ার বেল্টের ওপর ডুরে শার্টের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আছে পেটটা। চুল পড়ে গেছে অনেক। ওর পাশে মেয়েটিকে ছোটখাটো, একহারা এবং কমবয়সী লাগছে। মেয়েটির কত বয়স, কোথায় লেখাপড়া করেছে, কোন পরিবারের মেয়ে, বিয়ে কবে, তারা যাবে কি না এবং এর সঙ্গে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, তেমন খুঁটিনাটি কথা কিছু বলেনি রাকেশ। সবই বাদ দিয়ে বলেছে, বিয়েটা ছোট করে হবে, টাউন হলে গিয়ে রেজিস্ট্রি হবে মাত্র। আর মায়েরা সাহস করে যাবে বলে যে-প্রস্তাব রেখেছে – না, কষ্ট করে তাদের যাওয়ার কোনো দরকার নেই।

মায়েরা আঘাত পেল। কিন্তু প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সে-আঘাত গোপন করার উদ্দেশ্যে তবকমোড়া মিষ্টির বাক্স নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে দিয়ে বহুদূরের ওই অনুষ্ঠান উদ্যাপন করল। তাই বেথের সন্তানসম্ভাবনা ও শিশুর জন্মকাল জানিয়ে রাকেশের চিঠি এলে তারা আর কৌশলী জিজ্ঞাসাবাদ করার মতো ভুল করল না এবং অনু ওর অনভ্যস্ত সাহসিকতায় পরিষ্কার জানিয়ে দিলো যে, তাদের নাতিকে তারা কানাডা গিয়ে দেখতে চায়। লিখেছিল, ‘আমাদের নাতি’।

কিন্তু এ-অভিযানে তারা পা বাড়াল অত্যন্ত ভয় আর দুশ্চিন্তা নিয়ে। অবশ্য গ্রামের সবাই তাদের সাহস ও সমর্থন দিতে লাগল। অনেকেই ইতোমধ্যে কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ডে গেছে ছেলেমেয়েদের দেখতে। নয়া দিলিস্নতে গিয়ে পেস্নন নিয়ে দূরের কোনো মহাদেশে যাওয়াটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে এসব পরিবারের; তারা পরবর্তী বংশধরদের জন্য পোঁটলা-পুঁটলি, বাক্সভর্তি পছন্দের চাটনি, আচার, মিষ্টি নিয়ে যায়। এয়ারপোর্টে এসব খাবারের অনেক কিছুই মহাবিরক্ত কাস্টমস অফিসাররা পুড়িয়ে ফেলার জন্য বাজেয়াপ্ত করে, সেসব খবরও আছে। ‘আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কী?’ ‘এটা কী?’  আমের আচার চেনে না, বিশ্বাস করতে পারো?’ ‘পানপাতা কী জানে না! বলে, ‘কি বিটল১? তুমি এখানে পোকামাকড় নিয়ে এসেছ?’ আবার বাইরে হয়ত বয়ফের ঝড় হচ্ছে বা বজ্রপাত হচ্ছে, তখন এয়ারপোর্টের কর্মচারীরাই বেরিয়ে আসতে বারণ করে – ‘কপাল ভালো আমরা বিছানা নিয়ে গিয়েছিলাম তাই মেঝেয় পেতে ঘুমাতে পেরেছি।’ আবার একজন আরেকজনের চেয়ে গলা উঁচিয়ে ছেলেমেয়েদের প্রাসাদোপম বাড়ির গল্প করে আর বলে কত বড় বড় সব গাড়ি, খাবারভর্তি ফ্রিজ আর বিশাল বিশাল দোকানপাটে বিস্ময়কর সব জিনিসপত্র কেনাকাটার কথা। তারা ফিরে আসে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, প্রসাধনসামগ্রী আর ঘড়ি নিয়ে। এসবই তাদের কাছে ‘বিদেশ’ শব্দের চিহ্ন।

এরা দুজন এসব কথায় যোগ দেয় না, বলে, ‘এ তো আমরা এখানেও কিনতে পারি’; তারা রাকেশ, ওর স্ত্রী এবং ওদের টরন্টোর বাড়ির মাত্র-আসা ছবি দেখিয়ে নিজেদের খুশি রাখে। এখন এই মহাঅভিযানে এরাও যুক্ত হতে যাচ্ছে, ওরা দুজনেই এমনকি আশাও ভয় পেতে লাগল। পুরনো বন্ধুদের অল্পবয়সী মেয়েরা ও নাতনিরা ওদের আশ্বস্ত করছিল, ‘আন্টি, একটুও কঠিন কিছু না, টিকিটের বুথ থেকে টিকিট কিনে নির্দিষ্ট জায়গায় দেবেন, তারপর সাবওয়েতে উঠে পড়বেন, যেখানে যেতে চাইবেন নিয়ে যাবে।’ অথবা ‘ওখানে চুলো ধরাতে কেরোসিন, কয়লা কিছুই লাগবে না, সুইচ ঘোরালেই আগুন এসে যাবে।’ বা ‘আন্টি, ওখানে কাপড় ধুতে হবে না, মেশিন আছে, কাপড় আর সাবান দেবেন, মেশিনই ধুয়ে ফেলবে।’ আশা আর অনু আশ্বস্তবোধ করত না। ওদের মনে হতো কী জানি এসব অল্পবয়সী, আত্মপ্রত্যয়ী মেয়েরা তাদের ঠাট্টা করছে না তো? কত তথ্যই হাজির করা হয়েছে ওদের সহজ করার আশায়; কিন্তু তাতে কেবল অস্থিরতাই বেড়েছে। বাইরে বেরোলে সাবওয়ে যে ওদের গিলে ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না আর ঘরে
থাকলে বিদ্যুৎস্পর্শে  তো মারাই যাবে। যাওয়ার দিন যতই কাছিয়ে এলো, ততই উদ্বেগ আর নিদ্রাহীনতায় জ্বরজ্বর লাগছিল ওদের। এ-পরিকল্পনা অনু খুশিমনেই বাদ দিতে পারত কিন্তু আশা মনে করিয়ে দিলো রাকেশ তাদের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছে। বাড়ি ছাড়ার পর এই তার প্রথম উপহার, কীভাবে প্রত্যাখ্যান করবে?

বছর দশেক আগে মায়েদের ছেড়ে এসেছে রাকেশ, তাদের পাতলা কাপড় যে এদেশের আবহাওয়ায় একেবারেই চলে না তা ভুলে গিয়েছিল। আশা আর অনু যখন বিপজ্জনকভাবে মালপত্র সাজানো ট্রলিটা দুজনের মাঝখানে ঠেলতে ঠেলতে ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে এলো, তখন বেথের চোখে প্রথম পড়েছিল ওদের পাতলা, সাদা পোশাক আর প্রতি পদক্ষেপে ফটফটিয়ে শব্দ করা স্যান্ডেল। রাকেশও বিব্রত হলো তাদের অপরিমিত সাজপোশাকে, আর আচমকা কেন যেন বেথ ঘুরে দাঁড়াল। এতদিন ও সবসময়ই ভেবেছে ওদের বহুকিছু আছে, এখন দেখে বুঝল আসলে তারা কিছুই তেমন নয়।

বেথ তাদের নিয়ে সোজা দোকানে গিয়ে ওভারকোট, দস্তানা, মাফলার আর উলের মোজা পরিয়ে দিলো। কিন্তু জুতোয় এসে তাদের আর রাজি করানো গেল না, জুতো তারা কোনোদিন পরেনি – বলল ভারী মোজা প’রে স্যান্ডাল পরবে। বাড়ির সামনে এসে তারা কোনোরকমে টলমল পায়ে গাড়ি থেকে নেমে ওপরে উঠল। পুরু পশমি ওভারকোট পরে হাতদুটো যথাস্থানে রাখতে পারছিল না, হাতে আবার বড় বড় দস্তানা আর গলায় জড়ানো মাফলারে মাথাটা প্রায় ঢেকেই গেছে। এসবের নিচে তাদের সাদা সুতির কামিজ পুরনো কাপড়ের মতো করুণভাবে ঝুলে রইল।

দূরদর্শী ডরিস ঘরের সমস্ত বাড়তি কম্বল নিয়ে দেখা করতে এলো। বলল, ‘মনে হলো আপনাদের ঠান্ডা লাগছে। যুদ্ধের সময় আমি ইংল্যান্ডে ছিলাম, জানি অবস্থাটা। আর এখনো তো ঠান্ডা পড়েনি তেমন, বরফ পড়তে শুরু করবে যখন দেখবেন।’ কথাগুলো বিনয়ের  হাসি হেসে তারা শুনল।

বেথ আর ডরিস যখন মহাব্যস্ততায় ওদের থাকবার ব্যবস্থা করছিল রাকেশ, তখন কেমন জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়েই রইল, কেন যেন স্বস্তিবোধ করতে পারছিল না। পুরনো মসলিনের কামিজ পরা বিরলকেশী মায়েদের গায়ে ফসল আর কাঠের ধোঁয়ার গন্ধ, প্রথম উত্তেজিত আলিঙ্গনের পর মনে হলো, ও যেন তাদের আগের রাকেশ আর নেই, নিজেকে বাধার মতো মনে হলো তাদের সামনে, বুঝতে পারছিল না নিজেকে নিয়ে বা তাদেরকে নিয়ে ঠিক কী করা উচিত। বেথই চা করে এনে তাদের ইংরেজির জ্ঞান দেখতে লাগল, রাকেশ তখন পা ছড়িয়ে বসে আঙুল মটকাচ্ছিল, আর অকারণ হাসছিল।

টেবিলে ঘটনা বদলে গেল : মায়েরা ছোট ছোট বাক্স আর পোঁটলা করে খাবার এনেছে, সেসব খুলে রাকেশকে আদর করে খেতে দিলো। ছোটবেলায় এই খাবারগুলোর জন্য ও যে মায়েদের অস্থির করে তুলত সে-কথা মনে করে নিজেরাই হাসতে লাগল। তাদের কাছে ও এখনো সেই ছোট্ট রাকেশই আছে; খেতে খেতে আঙুলের তেলের আবরণের মতোই স্মৃতির চকচকে দ্যুতি ওর সারামুখে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেথের দিকে অপরাধীর ভঙ্গিতে না তাকিয়ে পারল না, কী জানি অবিচার হচ্ছে কিনা ওর প্রতি। একটু নাক কুঁচকে পেটে হাত দিয়ে বেথ বোঝাতে চাইল এ-অবস্থায় ওসব ও খেতে পারবে না। মায়েরা সহানুভূতির সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, ওর জন্য অন্য কিছু রান্না করে দেবে।

ছুটির দিনে বেথ চাইত রাকেশ ওদের নিয়ে দেখার মতো বিশেষ কোথাও যাক। তারাও লক্ষ্মীর মতো রাকেশের গাড়িতে গিয়ে বসত আর তারপর জাদুঘর, রেডিও টাওয়ার আর বড় দোকানপাটে যেত রাকেশ। কিন্তু গাড়িতে অসুস্থবোধ করার প্রবণতা ছিল তাদের, জাদুঘরে গেলে পায়ে ব্যথা হতো আর দোকানে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত। আসলে তারা ঘরে থাকতেই পছন্দ করত। কিন্তু ঘরে বসে থাকাও তো কষ্টকর, ক্লামিত্ম দূর করার একমাত্র উপায় ছিল ভিডিও এনে ছবি দেখা; কিন্তু তাতে যে যার মতো মাথাটা পেছনে হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, নয়তো ঘুমের ভান করে সময় কাটিয়ে দেয়।

হতাশ বেথ কাজের দিনে টেলিভিশনে একেবারে নিরীহ ধরনের অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা করে দিত। ওর ধারণা ছিল, দুজনে সোফায় বসে প্রকৃতি, ভ্রমণ আর রান্না খুশি হয়েই দেখবে; কিন্তু ওগুলো তো একসময় শেষ হতো এবং অন্য প্রোগ্রাম আসত আর তাতে হয়তো প্রচ- যুদ্ধ বা শরীরী মিলনের দৃশ্য থাকত। বেথ ফিরে এসে দেখত, তারা ভীত ও অপমানিত হয়ে বসে আছে। ছবিগুলো তাদের অবিশ্বাস্যও মনে হতো। পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে বসে টেলিভিশনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বন্দুকের গুলির শব্দ, বোমার বিস্ফোরণ আর বস্ত্রহীন শরীরী দৃশ্য দেখে ভয়ে তাদের দাঁতে দাঁত লেগে যেত। বেথ চা খেতে ডাকলে তখনই কেবল মুক্তির আভাস ফুটে উঠত মুখেচোখে। তীক্ষন শব্দে বাঁশি বাজে কেটলিতে, চায়ের কাপে রাখা টি-ব্যাগ থেকে সুতোগুলো ঝুলতে থাকে, এ নিশ্চিন্ত আশ্রয় ওরা ছাড়তে চায় না। চকচকে বাসনপত্র আর আধুনিকতম বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে রান্নাঘরেই তারা বিশেষ আনন্দে থাকে। নির্ভুলভাবে মাইক্রোওয়েভের বোতাম টেপে তবে ভেতরে কী দেওয়া যায় আর কী যায় না তা কোনোদিন শেখেনি। রাকেশ বিস্মিত হয়ে দেখে অনুই নিয়মকানুনগুলো ভালো বুঝতে পারে; লেখা দেখলে পড়ে, অর্থ বার করার চেষ্টা করে। কেবল সকালের মধ্যেই বিশবার অন্তত দুজনে মিলে ফ্রিজটা খুলে দেখে, খাবার সাজানো আলোকিত শেলফগুলো দেখার লোভ সামলাতে পারে না – খাবারের প্রাচুর্য মনের কোনো এক গভীরে তাদের আনন্দ দেয়, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চোখদুটো, স্বপ্নালু ভঙ্গিতে আসেত্ম ফ্রিজের দরজাটা বন্ধ করে।

কিন্তু রান্নাঘরের জিনিসপত্র তো সীমাহীন নয়, বিশেষ সময় লাগে না ওসব জানতে, বুঝতে এবং দুই মায়ের সান্নিধ্যে বেথের সময় কেবল দীর্ঘায়িত হতে থাকে। কতবার যে ও ডরিসকে ডেকে এনেছে এদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য; কতবার যে কাজ খুঁজে বার করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, বাড়িতে যেন ভিড় করে আছে মায়েদের আশা, আকাঙক্ষা, বিভ্রামিত্ম আর হতাশা। ও জানে রাকেশ তাদের হতাশ করেছে অথচ মায়েদের সঙ্গে নিজের সম্পর্কটাকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং অন্তরঙ্গ বলেই ওর কাছে গল্প করত। বেথ লক্ষ করেছে, মায়েরা সেই পুরনো সম্পর্কটা জিইয়ে তোলার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। মায়েদের হাতে একমাত্র উপায় ছিল ওর ছোটবেলার পছন্দের রান্নাগুলো – এই অদ্ভুত দেশে যতটা সম্ভব – করে খাওয়ানো। তারা গ্রামের মানুষের গল্পও করে। বুঝতে পারে না, যাদের কথা বলছে রাকেশ তাদের ভুলেই গেছে। কে কাকে বিয়ে করেছে, আর কে জমি বিক্রি করে গরু-ছাগল কিনেছে তাতে ওর সামান্যতম আগ্রহও নেই। বিব্রত হয়ে হাসে রাকেশ আর আবেদনের ভঙ্গিতে চোরা চোখে বেথের দিকে তাকায়, অফিস থেকে দেরিতে ফেরার কারণ খুঁজে বার করে। রাকেশের ব্যর্থতায় বিরক্ত হয় বেথ; কিন্তু আবার ও যে সম্পূর্ণভাবে স্বামী হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে এবং কানাডার যথার্থ নাগরিক হয়ে উঠেছে তাতে ভেতরে একধরনের  শামিত্মও বোধ করে। ও নিজেও বাড়ি থেকে ঘন ঘন পালানোর সুযোগ খোঁজে – এতে অপরাধবোধ যে হয় না তা নয় – কোনোদিন বিকেলটা মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে আসে, সাগ্রহে ডরিস ভারতীয় মায়েদের গ্রাম্য চালচলনের কথা শোনে, কোনোদিন বা বান্ধবীদের সঙ্গে কফি খেতে যায়, কখনো বা লাইব্রেরিতে গিয়ে শিশুযত্নের বই পড়ে, তারপর বাড়ি ফেরে বন্দি দুই নারীর জন্য অস্থির চিন্তা নিয়ে।

বেথ একদিন দুপুরের পর লাইব্রেরিতে গিয়ে পরিচিত নির্জন কোণে গদি আটা চেয়ারে বসে পড়তে শুরু করে – বাড়িতে পড়তে পারছে না, মায়েরা তাকিয়ে থাকে, যেন অপেক্ষা করে কখন শেষ হবে ওর পড়া – তারপর যখন আলো কমে আসছে তখন ওর খেয়াল হয়, যে লম্বা জানালার নিচে বসে ও পড়ছিল, সেখানে অন্ধকার নামছে। চোখ তুলে তাকিয়ে সেই আধো অন্ধকারেই বরফের কণা ভাসতে দেখে চমকে ওঠে ও, ছোট ছোট অস্থির মৌমাছিরা যেন ঝাঁক বেঁধে ঘুরছে, তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দ্রম্নততর হতে লাগল সে-গতি আর ও জানে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো ভারী আকারের তুষারপাত শুরু হবে। দ্রম্নত হাতে পত্রিকা বন্ধ করে র‌্যাকে তুলে দিলো, তারপর টুপি আর দস্তানা পরে ব্যাগটা তুলে গাড়িতে চলে এলো। গাড়ির দরজা খুলে কোনোমতে সিটে বসল, বড় হয়ে গেছে শরীর, স্টিয়ারিংয়ের ভেতর দিয়ে নিজেকে বসানো কঠিন হচ্ছিল।

রাস্তায় গাড়ি আর গাড়ি, ভারী বরফপতন শুরু হওয়ার আগেই সবাই বাড়ি ফিরতে চায়। দ্রম্নততম গতিতে ওয়াইপার চলছে। বেথ সতর্কভাবেই গাড়ি চালায়। বছরের প্রথম তুষারপাতের মধ্যে বিস্ময়ের একটা উপাদান থাকে, আর মনটা এখনো যেন শৈশবে পড়ে আছে, ও নিজেও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কিন্তু এবার কেবলই মনে হচ্ছে মায়েরা কত না বিস্মিত হবে, আরো কতটা কঠিন হবে তাদের বন্দিদশা।

চাবি দিয়ে ঘরে ঢোকে বেথ, লম্বা জায়গাটা পেরিয়ে রান্নাঘর চোখে পড়ে, সেখানেই তারা জানালায় দাঁড়িয়ে নিষ্পত্র চেরি গাছের শাখা-প্রশাখায়, বাগানের চালের টালিতে আর তারও ওপাশে কাঠের পাঁচিলের ওপরে বরফ জমা দেখছে। সাদা সুতির শাড়ি শালের মতো করে জড়ানো, একে অপরের মাথায় হেলান দিয়ে নির্বাক হয়ে তারা বাইরে তাকিয়ে রয়েছে।

বেথের ঢোকার শব্দ তারা পায়নি, নিমগ্ন হয়ে দেখছিল জানালার বাইরেটা কীভাবে চোখের সামনে সাদা হয়ে যাচ্ছে। নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে চুপিসারে শোবার ঘরে গিয়ে ক্যামেরাটা নিয়ে এলো বেথ, তারপর আবার লম্বা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলল।

পরে বাচ্চার প্রথম ছবির সঙ্গে এ-ছবিটা এলে বেথ মায়েদের দেখাল, দেখে বিস্ময়ে মুখে হাত চাপা দিলো তারা; বলল, ‘আমাদের বলোনি কেন? জানতাম না – পেছন ফিরে ছিলাম।’ বেথ বলতে চাইল তাতে কোনো অসুবিধে হয়নি, এই ভঙ্গিটাতেই সবকিছু প্রকাশ পেয়েছে আর তখন তারা জানতে চাইল ‘সবকিছুটা’ কী; কিন্তু, ব্যাখ্যাটা দিতে চাইল না বেথ, শব্দ দিয়ে স্থির ছোট্ট ছবিটার নিঃশব্দ সম্পূর্ণতাকে ভাঙতে চাইল না। ছবিটা যেমন সম্পূর্ণ, তেমনি ভঙ্গুর, যেন এক স্বচ্ছ বরফখ-।

এর মধ্যেই জন্ম নিল শিশু। বোনেরা প্রাণ ফিরে পেল – আবার যেন ফিরে এসেছে রাকেশ। শিশুকে ওরা হাতের তালুতে ধরে রাখতে চায়, সোফায় পা মুড়ে বসে এক হাঁটু নাচিয়ে দোল দিতে চায়, কিছুতেই বুঝতে পারে না, কেন বেথ বারবার বলে অন্ধকার ঘরে ওকে ছোট বিছানায় শুইয়ে দিতে। বাচ্চাটা ওভাবে থাকতে চায় না আর প্রতিবাদীর সুরে কাঁদতেই থাকে, মায়েরা চায় ওকে ছোঁ মেরে বুকে তুলে নিয়ে শান্ত করতে, বেথকে তখন নিষেধ করে বলতেই হয়, ‘ওকে নিজে থেকেই ঘুমিয়ে পড়া শিখতে হবে।’

শিশুকে সময়মতো খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, বোতল সিদ্ধ করে জীবণুমুক্ত করা, টিনের ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো, ডায়াপার ব্যবহার সবই বেথ মেনে চলে; কিন্তু কেন এসব করতে হবে মায়েরা বুঝতেই পারে না। প্রথম আনন্দ ও উত্তেজনা শিগগিরই উপনীত হলো থমকে যাওয়া ভাবে, মতদ্বৈততায় এবং কথাকাটাকাটিতে আর তারপর বিষণ্ণতায়। বাচ্চা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বেথ যে, এসব দেখার সময় ছিল না তার।

কঠিন শীত পড়ল, অতিথিদের জন্য বড় দীর্ঘ সে-সময়। অসুস্থ আর অবসন্ন হয়ে পড়ল তারা, ব্যবহারে হতাশা আর অস্থিরতা প্রকাশ পেতে লাগল। অবস্থাটা রাকেশ হয় লক্ষ করল, না হয় লক্ষ না-করার ভান করল। একদিন রাতে বেথ শোবার ঘরে কথাটা রাকেশকে বলতে ও জানতে চাইল বেথ অতিরঞ্জন করছে কি না – এটা ওর প্রিয় একটা শব্দ। উত্তেজিত বেথ বলল, ‘জিজ্ঞেস করো তাদের, কেবল জিজ্ঞেস করো।’ ‘আমি কিভাবে জিজ্ঞেস করব? যদি বলি ‘তোমরা কি দেশে যেতে চাও?’ তাহলে মায়েরা ভাববে আমি তাদের দেশে পাঠিয়ে দিতে চাইছি।’ রেগে দু-হাতে মাথা চেপে ধরল বেথ, বলল, ‘তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারো না তুমি?’

বেথ নিজেও অস্থির হয়ে উঠছিল, বহুদিন তো হলো এবার তাদের  যাওয়াই উচিত। ও যখন বাচ্চার বিছানা আর রান্নাঘরে দৌড়াতে থাকে তখন যেন এই ছোটখাটো দুজন বয়সী নারীকে ওর পায়ে পায়ে বাধার মতো লাগে। তাদের দিকে তাকিয়ে স্নেহের হাসি হাসতে চেষ্টা করে কিন্তু বুঝতে পারে সে কেবল মুখভঙ্গিই হয়। এই দুই নারীর ব্যাখ্যাতীত সম্পর্কটা নিয়ে প্রায়ই ভাবে – কী করে এই ছোটখাটো মাসি রাকেশকে জন্ম দিয়ে বোনের হাতে তুলে দিয়েছে। মাসি কী কারণে কাজটা করল? কীভাবে করল? নিজের কোলভরা, বুকজোড়া বাচ্চাটার কথা ভাবলে কেমন গোলমেলে লাগে, তাদের দিকে তীক্ষন দৃষ্টি নিক্ষক্ষপ না করে পারে না। ও জানে ওর বাচ্চাকে ও কিছুতেই কারো হাতে দিতে পারত না, সুসানের কাছে তো নয়ই, নিজেরগুলোই সে টানতে পারছে না। কিন্তু এই দুজন একটি আবেগের অনুশাসনে জীবনটা কাটিয়ে দিলো – ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে অস্বাভাবিক মনে হয় ওর কাছে। মায়েরা ওর অসহিষ্ণুতা অনুমান করে পেছন ফিরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় ওর দিকে।

শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনাশেষে একমতে পৌঁছে অত্যন্ত ইতস্তত ভঙ্গিতে, নম্রভাবে কিন্তু পরিষ্কার করে রাকেশকে জানাল, তারা দেশে যেতে চায়। নিরাপদে বাচ্চা হয়ে গেছে, বেথ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তবে তারা থাকলে বেথের ওপর চাপ পড়ছে বেশি, না, না বেথ কিছু বলেনি, অবশ্যই না, এ-ধরনের কোনো কিছুই ঘটেনি এবং বেথ বা রাকেশ কেউ কখনো অসতর্ক ভাবেও কিছু বলেনি। এমন বিব্রতকর একটা অবস্থা, তার ওপর ঠান্ডাও লেগেছিল। দুইয়ে মিলে কথা বলতে গিয়ে তারা কেবল কাশতেই লাগল – এখানে ভালো ছিল, খুশি ছিল, কিন্তু এখন -। মায়া হলো রাকেশের, মায়েদের কথা হাতড়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা থামিয়ে দিয়ে জানাল, বাড়ি যাওয়ার দুটো টিকিট ও কিনে ফেলবে। বাচ্চাটা দূরে যাওয়ার মতো বড় হলে বেথ আর ও গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করে আসবে।

যথাযথ কথা বলেছে রাকেশ। মায়েদের মুখে এখন কত বলিরেখা, কৃতজ্ঞতামাখা সেই মুখ তুলে তারা সন্তানের দিকে তাকাল। ও যেন নেতিয়েপড়া গাছে জল ঢেলেছে আর তাতে তারা প্রাণ ফিরে পেয়েছে : তারা এবার হাসল। তারপর বাড়ির সবার জন্য উপহার কেনা আরম্ভ হলো। পরিবার-পরিজনের কথা ভাবতে শুরু করল তারা আর তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আশায় মুখে হাসি ফুটে রইল।

 

রাকেশ একাই মায়েদের নিয়ে এয়ারপোর্টে গেল। বাচ্চাটার ঠান্ডা লেগেছিল, বেথ ওকে নিয়ে ঘরে রইল। ট্রলি বোঝাই হয়ে গেছে ট্রাঙ্ক আর বাক্সে, তাতে আছে প্রতিবেশী আর পরিবারের জন্য উপহার। বিদায়ের আগে মায়েরা মমতা আর কৃতজ্ঞতামাখা দৃষ্টিতে আবার রাকেশের দিকে তাকাল, তারপরই ঘুরে ট্রলি ঠেলতে শুরু করল। সাদা ওড়না জড়ানো কাঁধ আর সামনে ঝোঁকানো দুটো সাদা মাথা ওকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল, রাকেশ তাকিয়েই রইল, তাদের  আর যখন দেখা গেল না তখন ওর একটা হাত আপনা থেকেই উঠে এলো দুচোখের ওপর। তারপর মুক্তির নিশ্বাস ফেলে গাড়ির দিকে চলতে লাগল – কালচে বরফের ওপর গাড়িটা রাখা ছিল।

বাচ্চাটাকে ওর বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল বেথ। তারপর রাতের খাবার রান্না করেছিল। রাকেশের ঘরে ঢোকার শব্দ পেয়ে, টেবিলে রাখা মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিলো, যেন একটা উদ্যাপনের বিষয়। জিজ্ঞাসু চোখে রাকেশ তাকাল বেথের দিকে, উত্তরে ও কেবল হাসল। ওর প্রিয় পাস্তা রান্না করেছিল বেথ, টেবিলে বসে কাঁটা হাতে নিয়ে খাবার চেষ্টা করল। কেন? কিসের এ-উদ্যাপন? স্বামী-সন্তানের সঙ্গে ওর একা হতে পারার দৃশ্যমান আনন্দে অসন্তোষের ছোট্ট বিরক্তিকর একটা গ্রন্থি যেন রাকেশের কাঁটায় বিধল। কাঁটাটা স্থির রেখে ও বেথের দিকে তাকাল, জানতে চাইল, সত্যিই তাই কিনা; তারপর বেথের কাঁধের ওপর দিয়ে ফ্রিজের গায়ে সাজিয়ে রাখা ওর পছন্দের ছবি আর স্মারক দেখতে পেল, পরে ওর চোখ থমকে গেল নতুন লাগানো ছবিটাতে – সাদা জানালায়, সাদা পোশাকে দুই নারী আর বরফের ঘূর্ণি।

পাস্তাসহ কাঁটা নামিয়ে রাখল রাকেশ। ‘রাকেশ? রাকেশ?’ কয়েকবার ডাকল বেথ, তারপর ঘুরে বসল নিজে দেখার জন্য। দুজন একসঙ্গে তাকিয়ে রইল শ্বেতবসনা শৈত্যের দিকে।

‘কেন?’ রাকেশ জানতে চাইল।

‘থাক না।’ কাধ ঝাঁকিয়ে বলল বেথ।

 

লেখক-পরিচিতি

আনিতা দেশাই : বাঙালি পিতা ও জার্মান মায়ের সন্তান আনিতা মজুমদার দেশাই ১৯৩৭ সালে ভারতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে, The Peacock উপন্যাসের মাধ্যমে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। এরপর থেকে দেশাই অসংখ্য উপন্যাস লিখেছেন যার মধ্যে আছে ফায়ার ইন দি মাউন্টেন, ক্লিয়ার লাইট অব ডে, ইন কাস্টডি, ফিস্টিং ফাস্টিং, ডায়মন্ড ডাস্ট ইত্যাদি। তিনবার বুকার প্রাইজের জন্য মনোনীতদের তালিকায় তাঁর নাম ছিল। তিনি Massachusettes Insitute of Technology (MIT)-তে সৃজনশীল রচনা (creative writing)-এর শিক্ষক। প্রতিবছর এক সেমিস্টার তিনি আমেরিকায় থাকেন এবং বাকি সময় থাকেন ভারতে।

এখনকার গল্পটি আনিতা দেশাইয়ের ‘Winterscape’ গল্পটির অনুবাদ। গল্পটি শ্যাম সেলভাদুরাই-সম্পাদিত South Asian writer-দের Story Wallah নামক গল্পসংকলন থেকে গৃহীত।

 

১. Betel (বিটল) পানপাতা।

Beetle (বিটল) এক ধরনের পোকা।