বিষয় বর্ণের বিভূতি

মইনুদ্দীন খালেদ

প্রুশিয়া। এই নামে একটি দেশ ছিল। দেশটি নেই এখন। কিন্তু দেশের নামে একটি রং রয়ে গেছে। রংটির নাম প্রুশিয়ান ব্লু। রং যখন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পেল, তখন নীলই স্বরাট হলো ব্লু রাইডার শিল্প-আন্দোলনে। তবে নীল ঠিকানাবিহীন। তাকে সীমায়িত করা যায় না। আকাশের কাছে – সমুদ্রের  কাছে দুচোখ এ বোধ অর্জন করেছে। এ-কথা বলেছিলেন মনোক্রমিক বা একবর্ণা শিল্প-রচনার প্রধান পুরোহিত ইভ ক্লাইন। ক্লাইনের নামেও একটা রং হয়ে গেল। ক্লাইনও ব্লু বা নীলের নানা উদ্ভাসে-উচ্ছ্বাসে শিল্পিত গূঢ়ৈষণা  জানিয়েছেন। যে-নীলটা তিনি বেছে নিয়েছিলেন সেটাও একটা মার্কা পেয়ে গেল বর্ণের ইতিহাসে। সেটার নাম সংক্ষেপে আই-কে-বি। মানে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইন ব্লু। তারপর রং নিয়ে আরো কত খেলা। ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীচূড়ামণি ক্লদ মর্নে ফর্মকে থিতিয়ে রঙে বিসর্জন দিলেন ওয়াটার লিলি এঁকে। মন্দ্রিয়ান কান্দিনিস্কি হয়ে রথকো ও কালারফিল্ড গ্রুপের কারবার তো চলেছে শুধু রং নিয়ে। বস্ত্তগত বর্ণসত্য থেকে বেরিয়ে এসে কত-না প্রতীক হয়েছে বর্ণধর্মীয় চিত্রকলায়। তারপর যদি রং মুছে ফেলি তাহলে কী দাঁড়ায়। রং মুছে যাওয়া মানে কি ধূসর হয়ে যাওয়া। ধূসর হতে হতে কি সাদা হয়ে যাওয়া? যদি তা-ই হয়, তবে কি পৃথিবীর সব ভূগোলের ধূসর ও সাদা একই? অভিজ্ঞতাটা আসে তো বস্ত্ত থেকেই। বস্ত্ত তো রংকে ধরে আছে। আলোকে বিকিরিত করে রেখেছে। রংই তো ফর্মের প্রচার চালায়।
গুলশানের বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে মাকসুদা ইকবাল নিপার বর্ণজমিনে বিহার করতে করতে অনেক কথা উজিয়ে এলো। তাঁর ছবির জমিনে রং ছাড়া আর কিছুই দেখার নেই। আর যদি রং দেখা যায় তবে অন্য কিছু দেখার অপেক্ষায় কে থাকে? নিপার ছবিতে বর্ণ শুধু সত্য; সত্য আর কিছু নয়। একক বর্ণকে ব্যাপ্ত জমিনে বিবৃত করেছেন শিল্পী। রং দিয়ে রংকে বোনা হয়েছে। তাকে আবার বলা হয়েছে বর্ণের টেক্সচার। বর্ণের বুননই তো এই বিশ্বপ্রকৃতি। নিপার নিপাট বর্ণ-বর্ণনাই পছন্দ। কোনো প্রতীক নয়, কোনো জটিল জ্যামিতির বিচরণও তাকে আকর্ষণ করেনি। এ-অভিজ্ঞতা শিল্পীর হলো কীভাবে? এ-প্রশ্নটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে দর্শনের কাছে চলে আসি। বর্ণ কি ধ্বনির কথা মনে করিয়ে দেয়? বর্ণকে ভিত্তি করে শৈত্য ও উষ্ণতার অনুভব তো প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মন কি শুধুই চোখের সত্য? নাকি তা মনের বিষয়? নাকি মন ছাড়া কোনো রঙেরই অনুভব স্পষ্ট নয়? তবে অভিজ্ঞতাটা নিপার বাংলার, জাপানের – এমন করে আরো অনেক দেশের। তারপর চিত্রশিল্পী বলে রং দেখতে দেখতে রঙের সঙ্গেই প্রণয়ের সম্পর্ক হয়ে গেছে তাঁর। আর নারীচৈতন্যের কাছে রঙের আকর্ষণের যে-তীব্রতা তা এখনো হয়তো দার্শনিক পুরুষের অজানা রয়ে গেছে। এ-কথাটা আমাকে বিশেষভাবে ভাবিয়েছে। বিভিন্ন রং নিয়ে এতটা আকুল কেন নিপা? পরিচ্ছদ প্রসাধনের প্রতি তীব্র আকুলতা কি পোশাকের বদলে তাঁর চিত্রকলায় প্রদর্শিত হয়ে পড়ল? নিপার মনের আকাশে রং গ্রহের মতো উদিত হয়েছে কিংবা ছায়া ফেলেছে। একটা স্বপ্নিল বর্ণিল পটভূমি। বর্ণপরিধির মধ্যে আত্মরূপমুগ্ধ আমি কে – নিপা আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। কথাটা আরো সহজ ভাষায় বুঝতে চাইলাম। বস্ত্তরাশি অবলোকন করলে সহসা সচকিত মন বলে ওঠে, ‘আহ কী সুন্দর নীল!’ ‘কী সুন্দর লাল!’ এইসব বিস্ময় ও ললিত আর্তি থেকেই বর্ণপ্রধান নিপা নতুন জন্মলাভ করেছেন। যদিও বর্ণ-ঝলমল তাঁর ছবি, তবু উচ্চকিত নয় পরিবেশ। নিবিড়, কোমল, পেলব এক অভিজ্ঞতার নির্জন স্বাক্ষর তাঁর ছবি। নিপার ছবিতে দুচোখ পেতে আমি উৎকর্ণ থেকেছি। কোনো নির্ঘোষ চোখে শুনতে পাইনি। একটা গুঞ্জরণ আছে। শিশিরকণা ফুটে পড়ার অস্ফুটতা আছে তাঁর চিত্রতলে। বর্ণের স্বাধীনতার বেদ-পাঠক বিমূর্তশিল্পের আদি পুরোহিত কান্দিনিস্কি মনে করতেন, বর্ণের সঙ্গে ধ্বনির সম্পর্ক রয়েছে। আর ধ্বনি মানেই তো তাঁর আত্মার সঙ্গে সম্পর্ক। এভাবে বয়ান করতে করতে চিত্রশিল্পের প্রথম বিমূর্তক রং ও সংগীত নিয়ে একটি বই লিখে ফেলেছেন এবং মীমাংসা টেনেছেন এই বলে যে, রং ও সুর একই সমীকরণের দুই প্রান্ত। আর আত্মা ছাড়া রংকে মাপা যায় না। বর্ণ তাই মরমি বিষয়।
নিপা মরমি নন। বর্ণ তাঁকে মুগ্ধ করেছে। মন্ত্রচালিতের মতো নিঃশব্দে তাঁকে রঙের ঐশ্বর্য দেখাতে বলেছে। উষ্ণ ও শীতলের অনুভবের মধ্য দিয়ে অনেকটা প্রসারিত থেকেছেন তিনি। প্রুশিয়ান ব্লুর প্রয়োগে রঙের ত্বক ও রক্ত দেখিয়েছেন। বিভিন্ন ঋতুর রূপায়ণে নিয়েছেন রঙের নির্ভরতা। গ্রীষ্মের উষ্ণতা, শরতের স্নিগ্ধতা আর দুপুরের বিজনতা ও বিকেলের শান্ত মুহূর্ত – এমন অনেক অনুভূতি প্রগাঢ় হয়ে ওঠে মনে এ-শিল্পীর কাজের দিকে তাকালে।
নিপার কাছে সুন্দর মানে বর্ণের সুচিতা ও স্নিগ্ধতার সুন্দর্শন। জন্মভূমি বাংলাদেশের গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রকৃতি দেখা এবং তারপর জাপানেও দীর্ঘবাস; – এই দুই পৃথিবীর মধ্যে বাস করে চোখ সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর এবং মন অনুভবের নতুন মাত্রা ছুঁয়েছে। শ্যামল বাংলা ও সোনার বাংলা তাঁর ছবিতে আছে। তবে বর্ণের অতিশোধিত প্রকাশই তাঁর ছবিতে প্রধানভাবে দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে। ঝাড়-জঙ্গলের ডোবা-কাদাময় জঙ্গল বুনো প্রকৃতির দিকে তাঁর চোখ যায়নি। জাপানে শিক্ষিত ও দীক্ষিত কাজি গিয়াসের শিল্পচৈতন্যও এরকম পরিশ্রুত ধোয়া-মোছা স্নিগ্ধ-সুচিতার অনুগামী। এই দুই শিল্পীর কাজের মধ্যে সুন্দরের সংজ্ঞার্থের প্রশ্নে আমি অনেকটা মিল খুঁজে পেয়েছি। অনুচ্চারিত, শান্ত, দৃষ্টিসুখকর একটা আবহ রচনা দুজনেরই অন্বিষ্ট। তবে গিয়াস যতটা দক্ষতায় জলীয় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত রেখে প্রকৃতিকে নির্মাণ করেন, নিপা তাঁর স্বভাবীয় তা এখনো পুরোপুরি আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। তাঁর ছবি আরো পরিমিতির দিকে অগ্রসরমান হতে চাচ্ছে।
নীলের মতো হলুদের সঙ্গে নিপার নিবিড় প্রেম রয়েছে – ভক্তি ও ভালোবাসা রয়েছে। আমরা এ-ধারার ছবিকে যদি বাংলা কবিতার সূত্র ধরে বুঝতে চাই তবে উপলব্ধি সহজতর হয়ে ওঠে। নীলাভ আকাশের নিচে সাদা সজিনার ফুলের কথা বলে স্নিগ্ধতার অর্থ-ব্যঞ্জনা প্রতিষ্ঠিত করেছেন রূপসী বাংলার জীবনানন্দ। আর রবীন্দ্রনাথ কণ্ঠে নিয়ে আমরা যখন সমবেত আরাধনায় বলি ‘ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি’ তখন সেই হাসিটা বা অভিব্যক্তিটার রং হলুদ – পাকা ধানের ক্ষেত। হলুদের সজীব সমৃদ্ধি নিপাকে বিমোহিত করে রেখেছে। ধানের ক্ষেতের মতোই ক্যানভাসে হলুদ ফলিয়েছেন বর্ণকাতর এই শিল্পী। একটি ছবিতে প্রসারণপ্রবণ হলুদকে সবুজের সীমানা দেওয়া হয়েছে। এতে বর্ণবিজ্ঞান অনুসারে হলুদ নীরব, অথচ উজ্জ্বল চেহারা পেয়েছে।
বর্ণ আসে নিপার ছবিতে নক্ষত্রের ছায়ার মতো। তাই বর্ণের বড় আয়ত প্রকাশ রয়ে গেছে তাঁর কাজে। আনুভূমিকতা ভর করে এবং চতুষ্কোণ স্পেসকে দুভাগে বিভাজিত করেছেন শিল্পী দুই জমিনে দুটি রং দেখার জন্য এবং দুরঙের আকর্ষণ ও বিকর্ষণ অনুভব সহজে অনুধাবন করার জন্য।
রং দেখার নেশা আছে। রং দেখে বিবশ ও তন্দ্রাচ্ছন্ন হয় চেতনা। আবার রং দেখে হাসিখুশিময় মন অপরিমেয় স্পেসের দিকে ছুটে যায়। এই দুই উপলব্ধিই নিপার চিত্রতলে বর্ণের সতেজ-সজীব আয়োজনে প্রমূর্ত।
কখনোবা মনে হয় স্বপ্ন নয়, বাস্তবতাই অাঁকছেন নিপা। সবই মূর্ত – সবই বাস্তব। বিমূর্ত বলে কিছু নেই এবং মনের সাপেক্ষে সব অনুভবই বাস্তব। পৃথিবীর তাবৎ শৈল্পিক আয়োজন মানুষের মনেরই বাস্তবতা, চোখের অভিজ্ঞতা, মস্তিষ্কের হিসাব। এসব ভেবে আমরা নিসর্গ পরিভ্রমণে চলে যেতে পারি। বাংলার মাঠেই হাঁটি। কতরকম চৌকোণ সবুজ ফলিয়েছে মানুষ ফসলের ক্ষেতে। কত রকম আয়তাকার ও বর্গাকার হলুদ স্বপ্ন অঘ্রানের মাঠে ফলবতী করেছে নিসর্গমাতার সন্তানেরা। আর জননী বসুন্ধরা মাটির গহিন থেকে শুরু করে মাটি-পৃথিবীর আয়োজন শেষ করে দূর দূর নক্ষত্রে কত রকম রঙের আসর জমিয়েছেন তা কি পারে মাপতে তার ভূমিপুত্ররা? জঙ্গমতা ভালোবাসেন না নিপা। তবু কচুরিপাতায় বুজে আসা প্রায় টলটলে জল তিনি একটি ছবির বিষয় করেছেন। এ-ছবিটি তাঁর বাংলাদেশের জলজ-সরস প্রকৃতি দেখার অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছে – এরকম ভাবা যেতে পারে।
আর যে-টেক্সচার বা বর্ণের বুনটে নিপার আস্থা তাতেও বোধহয় বাংলার প্রকৃতি তাকে সূত্র সরবরাহ করেছে তাঁর সৃজনের তাপিত প্রহরে। লালমরিচের ক্ষেত বা উঠানে বিছানো লাল মরিচের একখন্ড তপ্ত লাল অথবা সবুজতলায় সবুজ সবজি দুরকম সবুজের কথা বলে। অনিঃশেষ বিন্যাস বা প্যাটার্নের উৎস এই প্রকৃতি – এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করেই নিপা বর্ণের বীজ বুনে চলেছেন।