বিসর্জন

আনোয়ারা সৈয়দ হক

Anowara Syed Haq (Q)
Anowara Syed Haq (Q)

মেলেটারি আইত্যাছে! মেলেটারি আইত্যাছে!
রাতের নিস্তব্ধতার বুকে হঠাৎ করে কারা যেন বর্শা ফুঁড়ে দিলো। ঘুমের আচ্ছন্নতার ভেতরেও জেগে ছিল যে-ইন্দ্রিয়, পাহারায় ছিল অস্তিত্ব রক্ষার, তাই নাদের মোল্লাকে তড়াক করে যেন ছুড়ে ফেলল বাঁশের জালিপাতা মাচা থেকে মাটির মেঝেয়। মাটির মেঝে নিশুতি রাতের ঠান্ডায় জমে থাকা পাথরের মতো শক্ত। হাঁটলে ঠক-ঠক করে বাজে; কিন্তু এখন সময় এমন যে, কোনো প্রকারের শব্দ করা চলবে না।
এর আগেও তিনবার এরকম হয়েছিল। সতর্ক সংকেত কানে যেতেই সেই তিনবারই সে আশ্রয় নিয়েছিল জঙ্গলে। প্রতিবার কাঁধে ছিল তার মা। দৌড়তে গিয়ে জংলি গাগড়ার আঘাতে পা তার ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। প্রথম দুবার দুদিন-দুরাত করে জঙ্গলে পালিয়ে ছিল সে এবং গ্রামবাসী। তৃতীয়বার একদিন। প্রতিবারই তাদের আশপাশের গ্রামগুলো হয়েছিল ক্ষতবিক্ষত। কোনো কারণে, হয়তো নদী, হাওর বা পাগাড়ের কারণে, বা অতিরিক্ত গাছগাছালির জন্যে তারা কোনোবার এতদূর আসতে পারেনি। তবে এসে যে যাবে তার আলামত আজকাল টের পাওয়া যাচ্ছে।
এই দেশটির এক ইঞ্চি মাটিও তারা ছাড় দেবে না, এ-ঘোষণা তো হানাদারদের নিজের মুখে।
আজ কত মাস ধরে যেন এ-গ্রামের মানুষের চোখে ঘুম নেই। ভোর থেকে গভীর রাত বা সারাটা রাতই মানুষের চোখে ঘুম নেই, বরং এক অস্থিরতার দাঁত, অনিশ্চয়তার দাঁত, সর্বগ্রাসী এক আতঙ্কের দাঁত গ্রামবাসী সকলকে যেন প্রতিনিয়ত আঁচড়ে-কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলছে।
অথচ বাইরে এর কোনো যেন বহিঃপ্রকাশ নেই। কোনো  কিছুর, কোনো আলামতের বহিঃপ্রকাশও এখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। মুখের ভাব রাখতে হচ্ছে স্বাভাবিকের স্বাভাবিক। হিন্দুপাড়ার মানুষগুলো যেন ষড়যন্ত্রীর মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা তাদের মহল্লা থেকে প্রায়ই বেরোচ্ছে না। কাজ সারছে গোপনে; ইশারায়, ইশারায়। পুজো-আর্চা যা কিছু করতে হচ্ছে, সব বড় নীরবতার সঙ্গে। আর কেউ না বুঝুক, অন্তত রাধা-গোবিন্দ বুঝবেন যে, এছাড়া মানুষের এখন আর কোনো উপায় নেই।
মাত্র দিন পনেরো আগেই আরো একবার পাশের গ্রামে থাবা মেরেছিল মনসুর ডাকুয়া। রাজাকার মনসুর। এইতো কিছুদিন আগেই সে এ-গ্রামের আশেপাশে ডাকাতি করে খেত। এখন সে হয়েছে পাকিস্তানি সৈন্য আর বিহারিদের সহযোগী। আগে সে থাকত লোকচক্ষুর অন্তরালে। এখন গ্রামবাসীর সামনে বুক ফুলিয়ে হাঁটে। এবার তার সঙ্গে ছিল মিলিটারির এক দঙ্গল। তারা ধ্বংসযজ্ঞ শেষে বেরিয়ে গেলে রাজাকার মনসুর বকুল বেগমের কিশোরী মেয়েকে সকলের চোখের সামনে ধরে ধর্ষণ করেছিল। কচি মেয়ে ধর্ষণ শেষে মারা যায়। তারপরও আগুন জ্বালানো আর লুটপাটের শেষ হয়নি। মিলিটারির অত্যাচার আর রাজাকারের অত্যাচার দুই মিলিয়ে সারারাত পাশের গ্রামের প্রাণভেদী আর্তনাদ জাগিয়ে রেখেছিল নাদের মোল্লার গ্রামটিকেও।
পরদিন সকালেই অনেক মানুষ নাদেরের গ্রাম ছেড়েছিল। পুড়ে যাওয়া গ্রামের মানুষজনও অনেকে ছিল তাদের ভেতরে। টাকা-পয়সা কাপড়-চোপড় সব হারিয়ে শুধু নিজের নিজের শরীরটিকে সম্বল করে তারা পাড়ি  দিয়েছিল অচেনা সেই সীমান্তের দিকে।
কিন্তু নাদের এখনো যেতে পারেনি। পঙ্গু মাকে ফেলে সে কোথায় যাবে? আজও রাতের আঁধারে শত্র“র আগমন হয়েছে শুনে সে মাকে কাঁধে তুলে দৌড়ল। তার সঙ্গে আরো অনেক গ্রামবাসী। তাদের মুখে নিঃশব্দ সব বিলাপ। এ বিলাপ শুধু শরীরের প্রতিটি øায়ু একটু একটু করে খেয়ে ফেলে। নাদের বলশালী মানুষ। পঙ্গু মা শরীরে ভারী হলেও সে তাকে পাশের ঘর থেকে তুলে কাঁধে নিয়ে দৌড়তে পারে। নাদের ছোট থাকতেই তার মা বিধবা। বস্তুত বাবার কোনো স্মৃতিই নাদেরের মনের ভেতরে নেই, কোনোদিন ছিল না। আর তার মা ছেলেবেলা থেকে এমনই পঙ্গু আর বিধবা যে, গ্রামের কোনো পুরুষই তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার জন্যে আহ্বান করেনি। তাই নাদের মণ্ডলের জীবনে তার মা-ই সব।
আজ দৌড়তে গিয়ে মায়ের শরীর বেশ ভারী মনে হলো নাদেরের। এই দুমাসেই মা কি তার ভারী হয়ে গেল বেশি? কথাটা ভাবতে ভাবতে বাইন গাছের জঙ্গলে মাকে কাঁধ থেকে মাটিতে নামিয়ে রাখল নাদের। আজ সে জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। গ্রামবাসী সকলেই ততক্ষণে যে যার মতো করে আশ্রয় করে নিয়েছে। বাইরে থেকে চোখে দেখলে কেউ বলতে পারবে না যে, এই জঙ্গলে গাছ ছাড়া আর কোনো কিছুর বসবাস আছে। বড় বড় গাছ ছাড়াও আছে বাঁশবন; অসংখ্য, অগুনতি বাঁশবন। আরো আছে হারগোজা আর ময়নাকাটার ঝোঁপ। অথচ বাইরে থেকে দেখতে সব একেবারে ছিমছাম। শত্র“পক্ষ এখন পর্যন্ত জানে না, এর অন্তঃপ্রবাহে বয়ে চলেছে অবিশ্রাম তাজা ও টাটকা রক্তের ওঠানামা। অবিশ্রাম দীর্ঘশ্বাস, হাঁপানি ও ফিসফিস।
অথবা হয়তো জানে, কে জানে!
কতমাস ধরে এ-গ্রামের মানুষের চোখে ঘুম নেই। বরং ঘুমের বিকল্প কেমন এক আচ্ছন্নতা সকলের চোখে-মুখে। এরকম এক আচ্ছন্নতার ভেতরেই তারা তাদের দিন গুজরান করছে রান্নাবাড়ি করে, মাঠে গরু চরিয়ে, খেতের আগাছা পরিষ্কার করে, চাটাইয়ের বেড়ার গায়ে গোবরের ঘুঁটে বসিয়ে অথবা নদীতে জাল বিছিয়ে মাছ ধরে। সবই করছে তারা কিন্তু কোথাও যেন কোনো স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। শুধু যেন অভ্যাসের দাস হয়ে কাটাচ্ছে জীবন। সেই যে শেখের পোলা একখান বক্তৃতা দিলেন, সেই সুদূর ঢাকা শহরে,  তারপর থেকে সবকিছু যেন ওলট-পালট, ওলট-পালট। যেন দিন কি রাত তার কোনো স্থিরতা নেই। এখন নাকি দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই তো নাদের মোল্লার গঞ্জে কিছুদিন আগেই বন্দুুক কাঁধে নিয়ে এসেছিল কজন মুক্তিযোদ্ধা। নাকি শহরের ট্রেজারি লুট করে তারা এসব বন্দুক পেয়েছিল। নিজেরা তখনো ঠিকমতো গুলি চালাতে জানত না। রোজ নাকি হাত-প্র্যাকটিস করতে হতো, কলাগাছের গায়ে গুলি চালিয়ে ঠিক করতে হতো নিশানা। কিন্তু তারা এখন কোথায়? অনেকদিন তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।  তারা কি জানে না, এখানে কীসব বর্তমানে শুরু হয়েছে?
নাদের মোল্লা বাঁশের মাচায় রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে। খবর পাচ্ছে আশপাশের গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ঘরবাড়ি লুটপাট করছে, মেয়েদের বাড়ির উঠোনে ফেলে দলাইমলাই করছে, আগুন জ্বালিয়ে ছত্রখান করছে মানুষের জীবন, উঠোনের ভাগাড়ে পড়ে আছে মৃতদেহ, কাক-শকুনে ছিঁড়ে খাচ্ছে মুখের চামড়া, পেটের নরম মাংস, তবু  সব যেন কেমন ভাসা-ভাসা। সব যেন গল্পকথা।
রাতের গভীরে নারীকণ্ঠের আর্তনাদে ভরে উঠছে বাতাসের গহ্বর, আগুনের দাউ-দাউ দিকচক্রবালে ঘাই দিয়ে উঠছে বারবার,  মাঝে মাঝে আল্লাহু আকবর হাঁক। তবু মনে হচ্ছে সেসব যেন  কোনো অচিন দেশে ঘটে চলেছে। যেন যা চোখে দেখা যায়, তা সবসময় সত্য নয়, বা এসব বাস্তব কল্পনাতেই ঘটে থাকে। এত বীভৎসতা কীভাবে সম্ভব, মানুষের দ্বারা কি এরকম কোনো  ভয়াবহ কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব? না, সম্ভব নয়, এসব অবান্তর কথা কাদের মোল্লার মনের ভেতরে সর্বক্ষণই যেন পাক দিয়ে বেড়ায়। আর যা কাদের মোল্লার মনে পাক দিয়ে বেড়ায়, তা কি গ্রামবাসীর মনের ভেতরেও ঘটে চলে না?
অনেকে যারা বেশি বুঝদার তারা গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আশেপাশের গাঁয়ে এরকম অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। ছেড়ে যাওয়ার পথে অনেকে মরে গেছে রাজাকারদের হাতে, কখনো বা মিলিটারির হাতে, অনেকে বুড়ো বাবা-মাকে ফেলে চলে যাচ্ছে, সেই বাবা-মা আবার আলবদরদের হাতে জবাই হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। কখনো বা বুড়ো মায়েরা হচ্ছে রাজাকারদের শয্যাসঙ্গিনী, তারপর বেয়োনেটের খোঁচায় তারা প্রাণত্যাগ করছে, না করলে তারা নিজেরাই হামাগুড়ি দিয়ে রাতের অন্ধকারে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ছে। গর্ভবতীরা আর আঁতুড়ঘরে যাওয়ার সময় পাচ্ছে না, রাজাকার বা মিলিটারির বেয়োনেটের খোঁচায় তাদের প্রসব সমাধা করা হচ্ছে।
নাদেরের অবশ্য গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে কোনো অসুবিধে নেই, কিন্তু তার মা হচ্ছে তার জীবনের আশ্রয়। তার øেহের খাঁচা। জ্ঞান হওয়া অবধি সে তার এই মাকেই চোখে দেখেছে। তার মা হাঁটতে পারে না। পা দুটো ছেলেবেলায় পোলিও হয়ে সরু হয়ে গেছে, কিন্তু তার মাথা পরিষ্কার। বাড়ির উঠোনে কেউ পা দেওয়া মাত্র সে বুঝতে পারে, কে বাড়িতে ঢুকেছে। কথাবার্তাতেও তার মায়ের কণ্ঠ বেশ জোরালো এবং খটখটে। দরকার হলে চিৎকার করে বলে উঠতে পারে, কে, ক্যাডা? নাদের বাড়িত নাই।
তবে রাতদিন বিছানায় বা বাড়ির হাতনেয় শুয়ে থেকে থেকে তার শরীরের উপরিভাগটা ক্রমে ভারী হয়ে উঠেছে। নাদের যতবার রাতের অন্ধকারে পড়ি কি মরি করে মাকে কাঁধে তুলে জঙ্গলের দিকে ছুটেছে, ততবার তার কষ্ট হয়েছে। তবে  খুব বেশি কষ্ট নয়। কারণ নাদের মণ্ডল নিজেও জওয়ান-মর্দ কম নয়। তার শরীর পেটানো লোহার মতো। হাত-পাগুলো মুগুরের মতো সলিড। তার বাবার রেখে যাওয়া তিন একর ধানি জমিতে সে নিজেই সবকিছু করে। বিশেষ কারো সাহায্যের জন্যে হাত বাড়ায় না।
অন্য কোনো বাড়ির এরকম ভারী শরীরের মা হলে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে লুকাতে পারত না, বাড়িতে ফেলে যেতে হতো; কিন্তু নাদের পেরেছে।
না, গতকালও কেউ এ-গ্রাম আক্রমণ করেনি। তবে তার আর বেশি দেরিও নেই। এখন যা কিছু করার দু-একদিনের ভেতরেই করতে হবে। অযথা সময় ক্ষেপণ কোনো কাজের কথা নয়।
পরদিন সকাল হলে আবার গ্রামবাসী একেকজন করে ফিরে এসেছে তাদের বাড়ি। উনুনে এখন তৈরি হচ্ছে সকাল বেলাকার জাউভাত। অনেকে বিলে নেমে চটপট গোসলটা সেরে নিচ্ছে। কেউবা গামছা কাঁধে চলেছে মাঠে কাজ করতে। নাদের নিজেও বসে নেই। সে আজ জঙ্গল থেকে ফেরার পথে একঝাঁপা মুলি বাঁশ তুলে এনেছে। সকাল থেকে উঠোনে বসে সে বুনে তুলছে একটা ঝুড়ি। মুলি বাঁশের কঞ্চি ফাঁড়াই করে সরু-সরু চেঁছে ঝুড়িটা সে বেশ বুনে তুলছে দ্রুত। ঘরের বিছানায় শুয়ে থেকে বুড়ি একমনে ছেলে  নাদেরের কাজ দেখে চলেছে। একসময় থাকতে না পেরে বুড়ি স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, এই ঝুড়ি বুনোস কিয়ের লাইগা, ওরে ও নাদাইরা।
তোমার জন্য। গম্ভীর হয়ে বলে উঠল নাদের।
আমার জন্য? হাঃ, কস কী বাজান?
নাদের বেশি কথার মানুষ না। এরপর সে আর কোনো উত্তর করে না।
অতঃপর দুদিন-দুরাত ধরে খুব মন দিয়ে ঝুড়িটা বুনে তুলল নাদের। গ্রামবাসী কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিয়ে বলল, এহন এই অ্যাত্ত বড় একখান ঝুড়ি বুইনা কী করবিরে নাদাইরা?
উত্তরে নাদের আবারো বলল, মায়ের লাইগ্যা বুনি, কাকা।
সত্যি মায়ের জন্যেই কাদের ঝুড়ি বুনে তুলেছে। বোনা শেষ করে তার ভেতরে খড় আর ছালা পেতে ভেতরটা নরম করেছে সে।  এখন মাকে এর ভেতরে বসিয়ে সে দিব্যি টেনে নিয়ে যেতে পারবে দূরে। নদী পার হয়ে চলে যাবে তারা আরো পশ্চিমের কোনো গ্রামে। সেখানে আরো কিছু খাল-বিল-হাওর পার হয়ে তারা পৌঁছে যাবে ভারতীয় সীমান্তে। সে-জায়গাটা কেমন তা জানে না নাদের।  এই গ্রামের কেউ জানে না; কিন্তু না জানলেও এটা শুনেছে, সেখানে আছে অভয় আশ্রম। সেখানে কেউ তাদের হত্যা করবে না।

আজ ভোররাত থেকে নৌকায় এসে জড়ো হচ্ছে একের পর এক গ্রামবাসী। বড় একটা গয়নার নৌকা। তবে খেপে খেপে যেতে হবে। এই নৌকা তাদের নদী পার করে দিয়ে আবার ফিরে এসে আরেক দল গ্রামবাসী নিয়ে যাবে।
আজ ভোররাত থেকে আকাশের অবস্থা ভালো নেই। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। শ্রাবণের নদী বর্ষার পানিতে থই-থই। তার ওপর নদীতে আজ মাঝে মাঝেই উত্তাল ঢেউ। এই নদী রাগী নদী নয়। অবশ্য মাঝে মাঝে ক্ষেপে গেলে কিছু তাণ্ডব ঘটিয়ে ফেলে। তবে বছরের অধিকাংশ সময় সে পড়ে থাকে চুপচাপ।
ভোররাত থেকেই নৌকায় এসে বসেছে গ্রামের চরণ মাঝি আর তার ছেলে ও ছেলের বউ। বউয়ের কোলে দুবছরের বাচ্চা। বাচ্চাটিকে নিজের আঁচলের তলায় একেবারে যেন গুঁজে রেখেছে বউটি। নৌকায় এসে বসেছে পালপাড়ার মোদক পাল আর তার স্ত্রী সবিতা পাল। সঙ্গে তাদের ছেলেমেয়েরা। যুবতী মেয়েও আছে দুজন। বসেছে খাজাবাড়ির বউ নুরুন্নাহার ও তার পুত্রবধূরা।  বসেছে সগির মোস্তফা ও তার পুরো পরিবার। পুরো নৌকাজুড়ে তাদের মালসামান।
নাদেরও এই নৌকায় শামিল হয়েছে। সে তার মাকে ঝুড়ির ভেতরে বসিয়ে মাথায় করে বয়ে নিয়ে এসেছে। বুড়ি ঝুড়ির ভেতরে বসে জুল-জুল করে তাকিয়ে দেখছে সকলকে। মুখ নিচু করে তাকিয়ে দেখছে। বুড়ির মাথায় গামছা দিয়ে রেখেছে নাদের, যেন মায়ের মাথায় বৃষ্টি না পড়ে। কিন্তু তা বললে কি হয়, বৃষ্টি এই নৌকায় সকলের মাথায় ঝরে পড়ছে। জামাকাপড় ভিজে উঠেছে সকলের। তার ওপর সরাসরি নদীর ওপারে যাওয়া যাবে না।  ওদিকে রাজাকারের উৎপাত বেশি। যেতে হবে ঘুরপথ দিয়ে। মাঝি সবকিছু জানে। তার ওপর ভরসা করেই সকলের এই অনির্দিষ্টের দিকে যাত্রা। এই নৌকার যাত্রীদের অধিকাংশেরই গ্রাম ছেড়ে বাইরে যাওয়ার কোনো ইতিহাস নেই। নেই কোনো অভিজ্ঞতাও। শুধু পাটের দালাল সগির মোস্তফা ছাড়া। সে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত  গিয়েছে। বলতে গেলে সে এই নৌকার এক প্রকারের মুরুব্বি।
গ্রাম থেকে সকলের এই প্রস্থান যেন এক প্রকারের মহাপ্রস্থানের মতো।  যেন তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছে যাত্রীরা। কে, কখন, কবে এই গ্রামে আবার ফিরে আসবে, ফিরে এসে এই গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাবে আবার কে বলতে পারে?
এই ভিড়ের ভেতরে নাদের মোল্লা তার মাথার ঝুড়ি নামাবে কোথায়? সে তাই তার মাকে মাথায় করে রেখেছে। ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা একবার উঠছে আর নামছে; কিন্তু এই নৌকার মাঝি পুরনো এবং অভিজ্ঞতায় ঝানু। এসব ঢেউ তার কাছে কিছু না।
ওদিকে গ্রামের বউ-ঝিরা নাদেরের মাকে বলছে, কাকি, নমস্কার। নানি, সালাম। দাদি আসসালামো আলাইকুম। সগির মোস্তফা বলছে, ভাবি, ভালা আছেন?
ঝুড়ির ভেতরে বসে নাদেরের মা সকলের সালাম-আদাব নিচ্ছে। ঝুঁকে ঝুঁকে সকলকে দেখছে। তার গা-মাথায় এখন বৃষ্টির ধারা বয়ে যাচ্ছে, যদিও বৃষ্টির ধারা ঝিরিঝিরি, তবু তো তা একভাবে।
কিন্তু নাদের মোল্লার মায়ের কাছে পুরো ব্যাপারটা খারাপ লাগছে না। হাজার হোক বাড়ি ছেড়ে বেরোনো তার ভাগ্যে খুব কদাচিৎ ঘটে। বাইরের পৃথিবীটাকে কতটুকুই বা সে চোখে দেখেছে। সেই তো  ছোটবেলা থেকেই সে পঙ্গু। বিয়েও হতো না যদি না তার বাবা জামাইকে খুব বড় একটা ধানের জমি লিখে না দিত।
কিন্তু নদীতে আজ উত্তাল ঢেউ। নৌকা এদিক-ওদিক দুলছে। আবার কখনোবা বেশ স্থির। শ্রাবণ মাসের ভরা নদী। সকলে নৌকায় বসে চোখ ফেলে রেখেছে ঢেউয়ের ওঠাপড়ার দিকে। আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ। ভোর হয়ে এলেও আকাশের ঘোলাটে ভাব একভাবে থেকে যাচ্ছে। এর ভেতরেই তাদের নিজেদের গ্রামে হঠাৎ বোমাবাজি আর বন্দুকের আওয়াজ। আজই কি তাদের গ্রাম আক্রমণ করেছে হানাদাররা? হায়, হায়, এখনো তো গ্রামে শত শত মানুষ থেকে গেছে।
মাঝি তার বৃষ্টিভেজা কপাল তুলে ছেড়ে আসা গ্রামের দিকে তাকিয়ে জোরে দাঁড় বেয়ে যেতে যেতে আপন মনে ভাবল, আবার কি এইহানে আইজ আইতে পারুম?
নৌকার চড়নদারদের মুখে এখন আর টুঁ-শব্দটি নেই। সকলে নিঃশব্দে ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে ছেড়ে আসা তীরের দিকে।  ওই কি দেখা যায় রাইফেলের নলের প্রান্ত? ওই কি তারা ছুড়ে মারল গ্রেনেড? ওই কি কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিলো ঘরের চালা?  বাঁশের বাগানে কি আগুন ধরিয়েছে কেউ? তাই কি ওরকম ফটফট করে আওয়াজ?
নৌকা এখন দুলতে দুলতে মাঝনদীতে। নাদের মণ্ডল নৌকার মাঝখানে কোনোরকমে জায়গা করে দাঁড়িয়েছিল। তাকিয়েছিল ছেড়ে আসা তীরের দিকে। এখন হঠাৎ চোখ উলটে নিজের মাথার ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, হেই মা, শুনতেছিস?
কী বলস, বাজান? বুড়ি ঝুঁকে ঝুড়ির ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে দিলো।
তরে আইজকা আমি এই নদীতে বিসর্জন দিমু!
একটুখানির জন্যে যেন নিস্তব্ধতা নেমে এলো নৌকায়। ঢেউগুলো হঠাৎ করে যেন থমকে গেল। বৃষ্টিও যেন থেমে গেল আচমকা।
কস কী বাজান? বিস্মিত হয়ে বলে উঠল বুড়ি।
হ, এইজন্যেই তরে আমি আজ এইহানে লইয়া আসছি। মাঝনদীতে তরে আমি বিসর্জন দিমু।
বাবা, আমার ডর লাগে! আমারে তুই বিসর্জন দিস না। আমি ডুইব্যা যামু।
মায়ের কথা শুনে হা-হা করে হেসে উঠল নাদের। বলল, বিসর্জন দিমু বইল্যাই তো দিনরাত বইয়া-বইয়া ঝুড়ি বুনছি। আমি মুক্তিযুদ্ধে যামু বইল্যা মনস্থির করছি, কিন্তুক তরে এইহানে ফালাইয়া যামু না। রাজাকারের হাতে তরে দিমু না। আমি নিজের হাতে তরে পানিতে বিসর্জন দিমু।
বাজান, ও বাজান, তর পায়ে ধরি, আমারে বিসর্জন দিস না।  ও বাজান।
এসব কথা যেন নাদেরের মন স্পর্শ করল না।  সে তার মাথা থেকে ঝুড়ি নামিয়ে পানির দিকে ঝুঁকে আস্তে করে পানিতে ভাসিয়ে দিলো ঝুড়ি।
নৌকার মানুষজন সব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল। তবে ততটা হতভম্ব হয়তো নয় কারণ এই কমাসে তারা অনেক কিছুর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। তারা তাদের চোখের সামনে পুড়ে যেতে দেখেছে তাদের অতিপ্রিয় ঘর, প্রতিবেশীর গরু-ছাগল টেনে  নিয়ে যেতে দেখেছে রাজাকারদের, গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিতে দেখেছে সদ্য গোঁফ ওঠা তরুণ ও কিশোরদের, তারা জমির আলের ধারে পড়ে থাকা মানুষের শরীর থেকে আঁত খুঁচিয়ে খেতে দেখেছে কাক ও শকুনকে। কুমারীর যোনিপথ ছিন্নভিন্ন হতে দেখেছে বেয়োনেটের খোঁচায়। জীবন্ত মানুষকে দগ্ধ হয়ে ঝুলতে দেখেছে গাছের শাখায়।
নৌকার সগির মিয়া শুধু বিড়বিড় করে বলল, এতদিন কষ্ট কইরাছো, আর কয়দিন?
বুড়ি এদিকে চিৎকার দিতে দিতে ঝুড়ির ভেতরে ভেসে চলল কতদূর।  মাথার কাঁচাপাকা চুল তার লেপ্টে থাকল মাথায়। তারপর টুপ করে ডুবে গেল।

মুহূর্তের ভেতরে সবকিছু যেন সেই আবার আগের মতো! আবার নদীতে বড়-বড় ঢেউ। কলার মোচার মতো নৌকার ওঠানামা।  আবার আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ। আবার আকাশ থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। নৌকার আরোহীদের মাথা-বুক বেয়ে বৃষ্টির ধারা নামা। আর বাতাসে-বাতাসে একভাবে জড়াজড়ি, মাঝে মাঝে শোঁ-শোঁ আওয়াজ।
বর্তমান যেন হয়ে গেল মুহূর্তেই অতীত।
প্রকৃতি তার প্রবহমানতার ভেতর দিয়ে বয়ে চলল আপন মনে।
কাদের মণ্ডল স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল পানির দিকে, ঠিক যেখানটায় একটু আগে ডুবে গেছে তার মা। সে নড়ল না, চড়ল না, শুধু কান খাড়া করে রাখল। আবার কোনো চিৎকার শোনা যায় কি না।