বুকঝিম এক ভালবাসা আবহমান বাংলার অবাক পৃথিবীর চাবিকাঠি

বুকঝিম এক ভালবাসা।

এমন কথা আমরা সচরাচর শুনি না। কথাটার মধ্যে যে মন কেমন-করা সুর আছে, যে ঘোরলাগা আবেশ আছে তা বুঝি আমাদের রোজকার চলাফেরার যে-সুর তার সঙ্গে মানায় না। তাই শুনি না। তবু এ-নামে একটা নাটক দু-বছরের ওপর হলো কলকাতা তো বটেই, সারা পশ্চিমবঙ্গকে অবাক করে দিচ্ছে। গ-া গ-া অভিনয় হয়েছে এমন নয়। কিন্তু যারা একবার দেখছেন তারা বারবার দেখতে আসছেন। যারা একা এসেছেন তারা সদলবলে আসছেন। যারা কোনোদিন নাটক দেখেননি তারা আসছেন। নাটক দেখে দেখে যাদের দিন কাটে তারা আসছেন। দেখতে দেখতে পশ্চিমবঙ্গের নাটমহলে বড় আদরের ধন হয়ে উঠেছে বুকঝিম এক ভালবাসা।

গেল শীতে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব বড়মাপের নাট্যোৎসবে ডাক পেয়েছে এ-নাটক। কত নাটকের দল নিজেদের গরজে এর প্রদর্শনীর বন্দোবস্ত করেছে। প্রথম প্রথম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় এ-নাটকের আসর বসত। কুশীলবদের স্বউদ্যোগে। তারপর ‘একুশ শতক’ নামে এক নাটকের দল এর হাল ধরল। আজকাল পোড়খাওয়া অনীকের ঘাড়ে এ-নাটকের ভার ন্যস্ত হয়েছে। ছোট-বড় কত রকমের প্রসেনিয়াম স্টেজে এর মঞ্চায়ন হয়েছে। প্রসেনিয়ামের বাইরেও হয়েছে। এই সমালোচক এ-নাটক প্রথম দেখেছেন গেল বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি কালীঘাটের তপন থিয়েটারের ঘেরাটোপে। মঞ্চ থেকে বিশ-বাইশ ফুটের দূরত্বে থেকে। দ্বিতীয়বার মধ্যমগ্রাম-বাদু রোডে অলটারনেটিভ লিভিং থিয়েটারের আটপৌরে আখড়ায়। দিনের বেলায় রোদের আলোয়। কুশীলবদের সঙ্গে প্রায় গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে। সেটাও গেল বছর, ৩০ জুন। তৃতীয়বার দেখা হলো এই ১৬ আগস্ট। কলকাতার রবীন্দ্র সদনের বিপুল পরিসরে। এবার শতিনেক দর্শকের মাঝখানে বসে। প্রসেনিয়ামের মস্ত খাঁচার মধ্যে থেকেও কীভাবে তাকে ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে একটা অন্তরঙ্গ নাটক তা নাগরিক দর্শকের কাছে নতুন। নাগরিক অস্তিত্বের অতলে গ্রামীণ কৌমজীবনের যে-আহ্বান এ-নাটক তার সম্প্রসারণ। প্রকৃত প্রস্তাবে তাদের সবার কাছে এক অবাক পৃথিবীর নামান্তর হয়ে উঠছে বুকঝিম এক ভালবাসা।

অবাক পৃথিবী। কারণ এ-নাটক একেবারে অন্য ধাতের, অন্য গতের। সত্যি বলতে কী, উত্তর-ঔপনিবেশিক নগর যাকে নাটক বলে চেনে, বুকঝিম এক ভালবাসা তা নয়। এর শেকড়ে আছে সৈয়দ শামসুল হকের এক নাতিদীর্ঘ নাতিখ্যাত উপন্যাস। বুকঝিম এক ভালবাসা। নাট্যরূপ দিয়েছেন শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়। আবার গদ্যরচনার নাট্যরূপ বলতে আমরা যা বুঝি বুকঝিম এক ভালবাসা তা নয়। এমনকি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি ইদানীংকালে দুই বাংলায় বিশেষ করে বাংলাদেশে যেভাবে নাট্যায়িত হয়েছে তার থেকেও আলাদা। নাটক বুকঝিম এক ভালবাসা মূল উপন্যাসের প্রায় বিশ্বস্ত অনুসরণ। এ যেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা বলার ধরন। বলতে বলতে দেশ-কাল-সমাজ-সভ্যতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেওয়ার ফিকির। আর তার জন্য কিছু কায়দা-কৌশল। যৎসামান্য মঞ্চসজ্জা। আলোর কারসাজি। তার চেয়ে অনেক বড় জায়গাজুড়ে শুভদীপ গুহর বোনা সুরের চাঁদোয়া। তাতে তিন-চারজন বাজনদারের সংগত। আর পালাগানের আদলে দুজনের দোহারকি।

আবহমান যে-বাংলা কাব্যগদ্যের তফাৎ করে না, নাচগানবাজনা দিয়ে কথকতার কাঠামোয় মাটি লেপে রং চড়ায়, প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে, বুকঝিম এক ভালবাসা তার ঘুম-ভাঙানিয়া উচ্চারণ। তাই পশ্চিমি আন্দাজের প্লে নয়, এমনকি ভরতের নাট্যশাস্ত্র-বাহিত নাটক নয়, বুকঝিম এক ভালবাসার দোস্তালি পাতানো আছে বাংলার সমন্বয়ী

সংস্কৃতির জল-হাওয়ায় বড় হওয়া পালার কাছে, কিসসার কাছে। হলোই-বা ‘ছোট’লোকের সংস্কৃতি, হলোই বা ‘বড়’লোকের অনুগ্রহভাজন, সামাজিক স্তরবিন্যাসকে তছনছ করে দেওয়ার যে-ক্ষমতা এই প্রান্তিক বিনোদনের মূলসুর, বুকঝিম এক ভালবাসায় তা সংরক্ষিত। কৃষিভিত্তিক বাংলায়, পুজো-পরবের বাংলার কোলে তার নিশ্চিত অবস্থান।

এ-পালার একদিকে থাকেন সৈয়দ শামসুল হক, অন্যদিকে শ্রমণ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর সঙ্গীসাথিরা। এর কথক যেন সৈয়দ শামসুল হক। আর এর গায়েন বলুন, বয়াতি বলুন, একজনই। প্রখর ও প্রতিভাবান শ্রমণ। তবে এ-পালা অতটা পারম্পরিক নয় যতটা ইসলামউদ্দিন পালাকার বা কুদ্দুস বয়াতির পালা। তীজন বাঈয়ের পা-বাণীর সঙ্গে শাঁওলী মিত্রের কথকতার যতখানি ফারাক, বা সতীশ কাশ্যপের স্বাংয়ের সঙ্গে গৌতম হালদারের মেঘনাদবধ কাব্য পরিবেশনার, বাংলাদেশের হৃৎকমলে ফুটে ওঠা পালাকারদের সঙ্গে শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের ফারাক কতক ওইরকমের। তাতে নাগরিক মন ও মগজের ছাপ আছে। বর্ণনাত্মক ঐতিহ্যের কাছে নতশির হয়েও এ-পালা আসলে সেতু বাঁধে। সেকাল-একাল গ্রাম-শহর আমরা-ওরা হিন্দু-মুসলমান এসব দোহাই দিয়ে যারা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আমাদের দেশটাকে ছিঁড়েকুটে দিয়েছে এবং দিচ্ছে তাদের উড়িয়ে দেওয়ার খোয়াব দেখে। দেখায়।

ঘণ্টাদুয়েকের এ-নাটকের শুরুতেই চমক। আল্লাহ নিরঞ্জন নয়। ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বর নয়। বুকঝিম এক ভালবাসার কথক ডাক দিলেন আম-আদমিকে। বন্দনা করলেন সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থাকা বিদ্যাবতীকে।

লোকসকল, একালের শর্করা-স্বপ্নমাখা সরল সকল আখ্যান থেকে অনেক দূরে ও গভীরে আপনাদের আমি এখন ডাকি। এখন আমি সেই বিদ্যাবতীকে ডাকি, যখন তিনি ছিলেন ভারত-সম্রাট আকবর শাহের কালে। বাদশাহর বাদশাহি গেছে, সময় তো থেমে থাকেনি। একালে আমি সেই সেকালের বিদ্যাবতীকে ডাকি, যিনি দিয়েছিলেন আমাদেরই বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা আরো কত ছোট-বড় নদ-নদীর তীরে বয়াতির কণ্ঠে মানুষের কথাসকলের গাথা-গান।

এ-নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র মনসুর বয়াতি। কোন মনসুর বয়াতি? যিনি কিংবদন্তির নায়ক তথা ঐতিহাসিক চরিত্র? যিনি দেওয়ানা মদিনার পালাকার?

উত্তর মেলে অচিরেই।

তেরোশো নদীমাতা এই পলিমাটির দেশে আমাদের একালের কথাকার আর নাট্যকারদের পূর্বপুরুষ মনসুর বয়াতির জীবনের কথা আমি কত খুঁজেছি। কত দীর্ঘদিন আমি পালাগানের পাতায় পাতায় মনসুর বয়াতির ইতিহাস সন্ধান করেছি। কিছুই তো পাইনি আমি কোনো গানে, গাথায়, কী পালায়। শুধু এটুকু আবিষ্কার করি যে, আমাদের প্রত্যেকের অন্তর্গত বুকঝিম এক ভালবাসার ভেতরে আছে এই মানুষটির নিশ্বাস। লেখায় তিনি আমার অগ্রজ, ভালোবাসায় তিনি আমার প্রেম-কাঠামো।

এ-পালা শুনতে শুনতে এক ছবি ভেসে ওঠে চিত্তপটে। সে-ছবি বৃহৎবঙ্গের। সৈয়দ শামসুল হকের কথায় ভর দিয়ে পাঁচশো বছরের উজান বেয়ে আমরা পাড়ি দিই ‘তেরোশত নদীমাতা এই পলিমাটির দেশে’। সে-বঙ্গের বুকের আঁচলের নাম ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র নদ।

আর সে-বঙ্গের হর্তাকর্তাবিধাতা বারোভুঁইয়া। সেই বারোভুঁইয়ার এক ভুঁইয়ার কন্যা চাঁদ সুলতানা। চাঁদ ভালোবেসেছে মনসুরকে। মনসুর বয়াতি। যার দাদা হায়দার মাঠে লাঙল দেয়, হাল চষে। আর মনসুর এই দুনিয়াদারির আঁচ বাঁচিয়ে, কেনারাম-বেচারাম-বোকারামের ছাঁচ বাঁচিয়ে সারিন্দা বাজিয়ে গান করে। সাঙাত আবুল হোসেনকে গান বাঁধার বিদ্যে শেখায়। কী এক মাহেন্দ্রক্ষণে জমিদারবাড়ির সারি সারি দালানকোঠার মধ্যে ভেসে এলো মনসুরের গান। ‘চখা হলে আছে চখী/ সখা পেলে হয় রে সখী/ আমি তো এই বিধানের উলটা দেখি নাই/ তবে এই কথা বাকি/ আমি যে এই একাকী/ কারণ আমার জোড়া আমি তারে চিনতে পারি নাই।’ এই গান মরমে পশেছে চাঁদের।

মনসুর তো অবাক।

শোন কন্যা, শোন বিবি চাঁদ সুলতানা

জমিদারের ভগ্নি তুমি, জমিদারের ঝি।

আমি তো চাষীর ছেলে, ভাই আমার চাষী,

তুমি কেন আমার জন্য হইবা দিওয়ানা?

চাঁদের জবাব আসে,

তুমি কবি – এই জানি, গরিব জানি না।

দিওয়ানা হইলাম কেন, তুমি বোঝ না?

মানুষের মনের খবর এত তুমি রাখ,

এত জানো, নারীর হিয়া তুমি জানো না?

মন দেওয়া-নেওয়া হয়। বাদ সাধে জমিদার মহাব্বত জঙ্গ। নিজের বোনের সঙ্গে গরিব প্রজার কুটুম্বিতা পাতাতে ভারি বয়েই গেছে তাঁর। দেশ-বিদেশের মধ্যযুগীয় প্রেমাখ্যানের গতে বাঁধা পড়ে আখ্যান। বেগম নূরজাহানের আশকারা সত্ত্বেও বিপদসীমা পেরিয়ে যায় অসম প্রেম।

প্রাণসংকট হয় মনসুরের। যদিও-বা বাঁচে বিষপ্রয়োগে তাঁর কণ্ঠরোধ হয়। এদিকে ওষুধ খাইয়ে অচৈতন্য করে চাঁদের নিকে দেওয়া হয় পাশের পরগনার জমিদার ফিরোজ দেওয়ানের সঙ্গে। জ্ঞান ফিরলে চাঁদ সব জানায় ফিরোজকে। বড়মনের ফিরোজের তোড়জোড়ে খুঁজে আনা হয় মুমূর্ষু মনসুরকে। অনেক চেষ্টা করে বাঁচানোও যায় তাঁকে। এবারে বিষক্রিয়ায় প্রাণসংশয় হয় চাঁদের। তারপর? তারা বেছে নেয় সলিলসমাধি।

বুকঝিম এক ভালবাসা যেমন দেখার, যেমন শোনার, তেমনি ভাবার। ভাবতে গিয়ে নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচর্চার রেণু উড়ে আসে। সৈয়দ শামসুল হক এই চর্চার নান্দনিক সাধক। যে-হাতে নূরলদীনের সারাজীবন লেখা হয়েছিল, সে-হাত লিখে রাখে যে বাংলার বুকে মোগল সাম্রাজ্যবাদকে রুখতে বারোভুঁইয়াকে সামনে রেখে কারা জান কবুল করেছিলেন। কারা সেই প্রবল প্রতিরোধের প্রমুখ। চাঁদ বিবির ভাইজান জমিদার মহাব্বত জঙ্গের লোকলস্কর যখন বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার ‘অপরাধে’ মনসুর বয়াতির গর্দান নিতে চলেছে, তখন তাঁর নায়েবের মুখে বসানো হয়, ‘কাজটা কি ঠিক হবে হুজুর? একেবারে প্রাণে মেরে ফেলা? জানেন তো, এ দেশে মোগলের সঙ্গে যুদ্ধ কি ভুঁইয়ারা করেছে? করেছে প্রজারা? প্রজা শক্তি, প্রজা বল। আর এই প্রজা সকলের কাছে মনসুর বয়াতির বড় খাতির, বড় নাম, বড় মান। তাকে তারা বুকের মধ্যে রাখে। প্রাণে শেষ করে দিলে যদি প্রজা ক্ষেপে ওঠে?’ ধুরন্ধর নায়েবের কথায় উঠে আসে খরায় ফুটিফাটা বাংলার কথা, উপোসি বাংলার কথা, খাজনা দিতে নাচার বাংলার কৃষকের কথা, ধূমায়িত কৃষক বিদ্রোহের আঁতুড়ঘর এই ক্ষুব্ধ বাংলার কথা। এই শলার খেই ধরে উঠে আসেন নূরলদীন, মুকুন্দদাসের পূর্বসূরি। নায়েব মিঠাইয়ের মধ্যে বিষ পুরে বয়াতির কণ্ঠরোধের জাল সাজান। নিজের অজান্তে বিষেভরা মিঠাই তাঁর মুখে তুলে দেন চাঁদ। সামন্ততন্ত্রের জালে ছটফট করে প্রেম। সেই জালে ধরা পড়েন মহাভারতের একলব্য। উঠে আসেন বাংলার মসলিনের অযুত কারিগর মুনাফার খাতিরে যাদের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিল ভিনদেশি সওদাগরি কোম্পানি। কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের অনাদি

সংঘর্ষ ঠাঁই পাতে ব্রহ্মপুত্রবিধৌত বাংলার অববাহিকায়। কালাপানি খালের পড়শি মনসুর বয়াতি কেবল পালাকার নন, হয়ে ওঠেন শ্রমজীবী গণমুখী এক লোকনায়ক। প্রতিষ্ঠান যাকে ডরায়। প্রভুত্ব যাকে দমাতে চায়।

বাংলার প্রত্ন-ইতিহাস মন্থন করে রংপুরের ভূমিপুত্র সৈয়দ শামসুল হক লেখেন, ‘সাক্ষী থাকে জৈন্তা পাহাড়’। হ্যাঁ। লোকমুখে জৈন্তা পাহাড়। খাতায়-কলমে জয়ন্তী। বৃহৎবঙ্গের উত্তর-পূর্ব সীমা। প্রায় দেড়শো বছর আগে রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের আগে যা ছিল বাংলার মাটিতে। এভাবে বুকঝিম এক ভালবাসা শুধু যে বাংলার প্রান্তিক

সংস্কৃতিকে তার পূর্ণাঙ্গতায় আবিষ্কার করে তা নয়, বাংলার হৃত-ভৌগোলিক পরিসরকেও যেন ঘরে ফিরিয়ে আনে। আজকের অসম ‘বঙ্গাল খেদা’র জিগির তোলে। যে-বঙ্গসন্তান ১৯৭১-এর ২৩ মার্চের আগে অসম ভূখ-ে বসবাসের কবচকু-ল দেখাতে পারেন না আজকের ভারতরাষ্ট্র তাঁকে অস্বীকার করতে চায়। বুকঝিম এক ভালবাসা ওই পাহাড়, ওই নদ, ওই জনগোষ্ঠী, ওই কৌম-সংস্কৃতিকে বিনি সুতোর মালায় গাঁথে। ক্ষুদ্রকালের পাঁচিলের ওপর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বৃহৎকালের বিজয়বৈজয়ন্তী ওড়ায়। এই বাংলায় ‘কারবালার জঙ্গে ইমামের বংশ শেষ হলে যেমন মহাবীর আবু হানিফা, সেই হানিফার মতো এক চিৎকার দিয়ে ওঠে হায়দার।’ বাংলার মাটিতে হজরত আলির পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। আর ঠিক তখনি সাদা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে হায়দারের সহোদর মনসুরের প্রেমের সমাধি-তীরে বিবাহের বাদ্যি বাজান বংশীধারী ফিরোজ দেওয়ান। তাকে কেউ বলে রঙিলা রাজা, কেউ কেষ্ট রাজা। যমুনা পুলিনের পৌরাণিক অনুষঙ্গ কী অনায়াসে প্রসারিত হয় ব্রহ্মপুত্র তীরে। যমুনা নয়, মেঘনা নয়, ব্রহ্মপুত্র তীরে। এভাবে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চোরাবালিতে বারবার ডুবে যাওয়া বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক অখ-তাকে মান্যতা দেয় বুকঝিম এক ভালবাসা।

হাত ধরাধরি করে চলে সৈয়দ শামসুল হকের কবিসত্তা আর ঔপন্যাসিক সত্তা। সরানো থাকে পশ্চিমি গদ্যের বাংলা ছাঁদ। সমাপিকা ক্রিয়ার খবরদারি ঘুচিয়ে ‘স্রোতের টানে ভেসে চলে কন্যার মুখ’। ছুড়ে ফেলেন পশ্চিমি রেওয়াজের সরলরৈখিক আখ্যান। ফিরিয়ে আনেন তাস বাঁট পদ্ধতি। কখন যে মনসুর বয়াতি নিজে গান ধরেন আর কখন ধরেন তার শিষ্য আবুল, কখন যে কোন কালখ-ে নোঙর ফেলে আখ্যান, নাগরিক শ্রোতার কাছে তার হদিস মেলা দায় হয়। তবু হদিস মেলে ঠিকই। আবহমান বাংলার কথা ও কাহিনির হাত ধরেন সৈয়দ শামসুল হক। দরবারি সাহিত্য আর মজদুরি সাহিত্যের মণিকাঞ্চনযোগ ঘটান। সেখানে মৈমনসিং গীতিকার চন্দ্রাবতীর পূর্বজন্মের দোসর হয়ে ওঠেন চাঁদ বিবি। সেখানে ফিরোজ দেওয়ানের রাজবৈদ্য হতে ভোলানাথ শাস্ত্রীর আটকায় না। বিষের জ্বালায় মরমর মনসুর বয়াতির নাড়ি স্পর্শ করে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি সেই শাস্ত্রীমশাই জবাব দিলে হোমরা বাইদ্যার শরণাপন্ন হতে আটকায় না। আমাদের সামূহিক নির্জ্ঞানের দোর ধরে নাড়া দেয় মৈমনসিং গীতিকায় মহুয়া পালার বেদে সর্দার। বিষে বিষে বিষক্ষয়ের দেশজ চিকিৎসা মর্যাদা পায়। ঝাঁপির মুখ থেকে বিদ্যুতের মতো লাফিয়ে ফণা তোলে ত্রিশিরা সাপ। ছোবল মারে। ঢলে পড়ে মনসুর বয়াতির দেহ। কলার মান্দাসে লখিনদর ভাসানের সুতো ছড়ান কথক। আর তখন কালরক্ত চুষে স্বামীর জীবন ফিরিয়ে দেন স্বয়ংসিদ্ধা চাঁদ বিবি। শেষ জীবনে আব্বাসউদ্দীনের বেদের মেয়ে অবলম্বনে লেখা চম্পাবতী নাটকে অনুরূপ আখ্যান রচনা করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। বাংলার বেদেদের কাছ থেকে দেখিয়েছেন তাতে। বুকঝিম এক ভালবাসা যেন তাঁর সেই প্রস্তুতিপর্বকে চেনায়।

এমন আখ্যানকে বয়ান করতে এসে শ্রমণ যে সহজিয়া পথ নিয়েছেন তা যে জনসমাদর পেয়েছে তা আগেই বলা হয়েছে। নেত্রকোনা বা কিশোরগঞ্জের গ্রামে যেভাবে পালা গাওয়া হয় সেভাবে তাঁর গাওয়ার কথা নয়। তার চেষ্টাও তিনি করেননি। তাঁর চলনে যে নাগরিক ছাঁদ আছে সেটিকে দরকারমাফিক বদলে ফেলেছেন। তাঁর বলনে যে প্রমিত পরিশীলন আছে সেটিকে আগাগোড়া বজায় রেখেছেন। রাখবেনই তো। সৈয়দ শামসুল হক তো গৈগেরামের পাঁচালীর বাংলাকে আত্মস্থ করেও এক অনির্ধারিত কালখ-ে তাঁর গদ্যকে স্থাপন করেছেন। সেই গদ্য বা সেই গদ্যের অঙ্গাঙ্গী যে পদ্য, সবই অনাগরিক আধারকে বরণ করেও শেষমেশ নাগরিক উপভোক্তার অনুমোদনের প্রত্যাশী। সেদিকেই নজর রেখেছেন শ্রমণ। দীলু বয়াতি যেভাবে পালা গাইবেন সেভাবে শ্রমণের গাওয়ার কথা নয়, গাওয়ার দরকারও নেই। ওটা একটা পারম্পরিক ধারাবাহিকতা। এটা নাগরিক মন ও লৌকিক মেজাজের মিথস্ক্রিয়া। ওটা হাটেবাটেমাঠের আসর জমাতে পারে। প্রসেনিয়াম আর্চে পালা গাওয়ার এটাই চালু রেওয়াজ হতে পারে।

এই রেওয়াজ যে মান্যতার প্রত্যাশী হতে পারছে সেই কৃতিত্বের বড় ভাগীদার বুকঝিম এক ভালবাসার সংগীতকার শুভদীপ গুহ। নানাবিধ তালবাদ্যে চক্রপাণি দেব, তারবাদ্যে জয়ন্ত সাহা ও বাঁশিতে সুশ্রুত গোস্বামীকে সঙ্গী করে শুভদীপ এ-নাটকের কাঠামো গড়েছেন। যেখানে সুরের আদল নেই, সেখানে সুর করে নিয়েছেন, যে-সুর প্রচলিত তাকে বদলাননি। ‘এই পানি যায়, ভেসে যায়, দূরে যায়, দরিয়ায়’ এ-নাটকের ধ্রুবপদ। আনদ্ধ বাদ্যের প্রবল সংগতে তাকে বেঁধেছেন শুভদীপ। গলা মিলিয়েছেন শ্রমণ, চক্রপাণির সঙ্গে। শুনতে শুনতে আমাদের বুকের ভেতরকার বিষাদসিন্ধুতে জোয়ার এসেছে।

সারিন্দা এ-আখ্যানের এক চরিত্র। এ-নাটকের কথাসূত্র ফিরোজ দেওয়ানের মুখনিঃসৃত ‘তোমার সারিন্দা হাতে নাও বয়াতি। ধর, গান ধর।’ জানি না শ্রমণ নিজে সারিন্দা বাজাতে পারলে এ-নাটকের শব্দকল্পদ্রুমে কোন অচিন রং লাগত। তবে ব্যাঞ্জো-গিটারের সহযোগ মাঝেমধ্যে আমাদের চোখ টাটিয়েছে, কানে বিঁধেছে। মনে হয়েছে এমন আওয়াজ এমন পালাকে ধারণ করতে পারছে না। আলোর বেলায়ও এলাটিং-বেলাটিং হয়েছে। নাটকের মনমেজাজ মাফিক

লাল-নীল রঙের ব্যবহার চেনা ছকের বাইরে যেতে চাননি চন্দন দাস। গেলে মন্দ হতো না। মঞ্চ আরো হালকা হলে আমাদের কল্পনা আরো উড়ান দিতে পারত। সাইক্লোরামার সামনে রাজমহলের প্রবেশপথের একটা আলগা ইশারা রাখা আছে। নদীমাতৃক সংস্কৃতির নানা নকশা বুনে জুড়ে জুড়ে এই প্রবেশপথের ইশারা। আখ্যানের বাঁকবদলের সময় সেটিকে যাতায়াতের পথ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন শ্রমণ। অত ছোটাছুটি হয়তো না করলেও চলত।

তার কারণ শ্রমণ নিজে। ছোটখাটো গড়নের এই তরুণ নট যে কী অসাধ্য সাধন করেছেন তার হদিস এ-সমালোচনায় মেলা ভার। কোনো দেখানেপনা নেই। কোনো ছটফটানি নেই। জবান তাঁর সাফ। সৈয়দ শামসুল হকের অন্তর্গত উচ্চারণ তাঁর জিহ্বাগ্রে। খেটো ধুতির ওপর পাটকিলে ফতুয়ায় তাঁকে মানায়। লাল-সাদা খোপকাটা গামছা আর বাঁশের লাঠি – এইমাত্র মঞ্চসামগ্রী সম্বল করে দু-ঘণ্টা ধরে দর্শকদের অভিভূত করে রাখার মোহনীশক্তি তাঁর করতলগত। চকিতে এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্র হতে পারেন। চাউনি বদলে নেন। চেহারা বদলে নেন। আবার দর্শকশ্রোতাদের যখন ‘লোকসকল’ বলে সম্ভাষণ করেন, তখন আন্তরিকতার খামতি হয় না। তখন তাঁর কথায় তাঁর সুরে ভেসে যেতে আমাদের মন চায়। আমাদের নাগরিক পরিসর এমন সরলতা সহিষ্ণুতার সহায়ক নয়। শ্রমণের চোখ-মুখে যে বুদ্ধিদীপ্ত সরলতা আছে, তাঁর চলাফেরায় যে সহজাত সহিষ্ণুতা আছে, তা আমাদের মগ্ন হওয়ার মন্ত্রণা দেয়।

তবে একক অভিনয় নয়। বুকঝিম এক ভালবাসার দেহকা- যদি শ্রমণ হন, তবে দুজনের দোহার তাঁকে হাত-পা জুগিয়েছে। সর্বজিৎ ঘোষ আগাগোড়া মঞ্চের ওপর বসে তাঁকে সঙ্গ দেন। কখনো সংলাপে সহায় হয়ে, কখনো সায় দিয়ে সম্মতি জানিয়ে। সুহানিশি চক্রবর্তী এমনিতে সর্বজিতের পাশেই বসেন। মিটিমিটি চেয়ে থাকেন। তাঁর সঙ্গে শ্রমণের যুগলবন্দি তৈরি হয় মনসুর আর চাঁদের কথোপকথনকালে। অতি উপভোগ্য সেই যুগলবন্দি। কবিগানের মৌতাত ফুটে বেরোয় তাতে। ১৬ আগস্টের অভিনয়ে সুহানিশির জায়গায় সমাদৃতা পাল এলেন। তিনিও কেয়াবাত মেয়ে!

এমন নাটক যে আজকের পশ্চিমবঙ্গের বুকে হতে পেরেছে এ কম কথা নয়। পূর্ববঙ্গীয় আখ্যানকে কীভাবে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের অঙ্গীকৃত করা যায় তা নিয়ে দুই বঙ্গেই হরেকরকম পরীক্ষা চলেছে গত তিন দশক জুড়ে। কয়েকটি সার্থক রূপান্তর ঘটেছে। পালাগানের

সাংস্কৃতিক ইতিহাস পুনর্র্নির্মাণের পাশাপাশি বাংলার পারফর্মিং ট্র্যাডিশনের একটি আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রচনার আভাস ছিল সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাসে। আনকোরা এক তরুণের নেতৃত্বে তার সচলায়ন ঘটিয়ে বুকঝিম এক ভালবাসা ওই পরীক্ষণমঞ্চকে এক উত্তর-আধুনিক দিগন্ত চেনাল।