বুক ফেটে যায় জননী আমার

চঞ্চল শাহরিয়ার

বীরাঙ্গনা কথা

অপূর্ব শর্মা

সাহিত্য প্রকাশ

ঢাকা, ২০১৩

১৭৫ টাকা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কারো অজানা নয়। তবু এই অহংকারের ইতিহাস লেখা হচ্ছে বারবার। প্রতিবার জানা হচ্চে নতুন নতুন অজানা সবকাহিনী। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা, তাদের আত্মত্যাগ আর দেশপ্রেমের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বপ্নের বিজয়, স্বপ্নের স্বাধীনতা।

যুদ্ধে শহীদ হয়েছে লাখো বাঙালি। নির্যাতিত হয়েছে অগণিত নারী-পুরুষ। গৃহহারা হয়েছে লাখো মানুষ। পিতা হারিয়েছে পুত্রকে। বোন হারিয়েছে ভাইকে। স্ত্রী হারিয়েছে স্বামীকে। মা হারিয়ে প্রিয় সন্তানকে। এসব নিয়ে বিস্তর লেখা হচ্ছে। দায়িত্ববোধ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেশপ্রেমী বাঙালিকে।

গল্পে, গানে, কবিতায়, উপন্যাসে প্রবন্ধে, স্মৃতিকথায় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকারীন সময়। ফিরে  এসেছে একাত্তরের ভয়াল কালো রাত, পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা,  এদেশে তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের নিয়ে পাক সেনাদের তান্ডবলীলা, হত্যাযজ্ঞ, খুন, ধর্ষণ আর লুটতরাজের রাজত্বের কথা।

পত্র-পত্রিকায়, টিভির পর্দায় আসছে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পবিরার আর বীরাঙ্গনাদের কথা। সেসব বীরাঙ্গনা যাঁরা একাত্তরের যুদ্ধে নিজেদের সম্ভ্রম হারিয়ে আমাদের জন্য বয়ে এনেছেন প্রিয় স্বাধীনতা।

এই বীরাঙ্গনাদের নিয়ে, এই নির্যাতিত, এই অবহেলিত, এই সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে বই লিখেছেন অপূর্ব শর্মা। বইয়ের নাম বীরাঙ্গনা কথা। সিলেটের আঞ্চলিক পর্যায়ের বারোজন বীরাঙ্গনার মুক্তিযুদ্ধে অন্যতর অবদান নিয়ে এই বই।

এই বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করা তাদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের সেই নির্যাতিত দিনের সত্য উদ্ঘাটন করাসহজ কথা নয়। দিনের পর দিন সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলের মাঠঘাট পেরিয়ে কখনো গাম, কখনো শহর ছাড়িয়ে, নদী পেরিয়ে, কতো সাধ্যসাধনায়, কতো কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই অপূর্ব শর্মা দাঁড় করিয়েছেন এই হৃদয়-কাঁপানো, মর্মস্পর্শী কাহিনি। বীরাঙ্গনা কথা পড়লেই বোঝা যাবে সেই অনবদ্য কাহিনি। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

হীরামনি, প্রভারাণী, সাবিত্রী, সাফিয়া খাতুন, মনোয়ারা, ছাবেদা, প্রবাসী মালাকার, পুষ্পরাণী, এশনু বেগম, জ্যোৎস্না, আরিনা, সন্ধ্যারাণীদের পাক-সেনাদের হাতে নির্যাতিত হওয়া, সিঁথির সিদুঁর মুছে যাওয়া, কারো চিরতরে নিঃস্ব হওয়ার গল্প খুব যত্নে লিখেছেন অপূর্ব শর্মা।

বীরাঙ্গনাদের এই সত্যকাহিনি পড়তে পড়তে নিজের চোখকে অবিশ্বাস হয়। মনে হয় সিনেমা দেখছি। মনে হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের কোনো চরিত্র আমার সামনে দাঁড়ানো।

অপূর্ব শর্মা যত্ন করে, গুছিয়ে, খুব আগ্রহে, খুব সাবধানে, গভীর মমতায় মাখিয়ে উপস্থাপন করেছেন জনমদুখিনী বীরাঙ্গনাদের           দুঃখগাঁথা, যা পড়তে পড়তে চোখে জল এসে যায়। ঘৃণা জাগে পাক সেনা আর রাজাকারদের প্রতি।

বীরাঙ্গনাদের বঞ্চনার কথা, দারিদ্রে্যর কথা, লোকলজ্জার ভয়, যুদ্ধ দিনের ভয়ংকর সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি, এখনো রাজাকারদের শাসানিতে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া মুহূর্তের বর্ণনা আমাদের বিস্মিত করে।

আমরা জানি, দেশব্যাপী অসংখ্য বীরাঙ্গনা। কারো সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে। এলাকার মানুষের চোখে কেউ বা পাঞ্জাবির বউ। কেউ নিঃস্ব হয়ে পথের ভিখিরি। যাদের জন্য বীরাঙ্গনাদের এই পরিণতি সেই পাকসেনা ধূর্ত রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া দোষের কিছু নয়।

অপূর্ব শর্মা দায়িত্বের সঙ্গে বীরাঙ্গনা কথা লিখতে সমর্থ হয়েছেন। বীরাঙ্গনাদের কথা আর ছবি পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যাবে। চিরদিন। নিঃসন্দেহে বইটির ব্যাপক প্রচার কামনা করছি। আর চাইছি আগামীতে আরো একবার অপূর্ব শর্মার হাতে উঠে আসুক মুক্তিযুদ্ধের অজানা তথ্যনির্ভর কাহিনি।