বুদ্ধদেব বসুর বহুমাত্রিক সত্তা

মুহম্মদ হায়দার

বহুমাত্রিক বুদ্ধদেব বসু : বৈচিত্র্যে বৈশিষ্ট্যে রাজীব সরকার
কথাপ্রকাশ  ঢাকা, ২০১৯  ১৫০ টাকা

মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের পর বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বলতম প্রতিভা নিঃসন্দেহে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪)। বাঙালির আবেগচৈতন্যের অসামান্য রূপকার তিনি। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে আধুনিকতা, মনস্বিতা ও নতুন ভাবনায় তিনি নক্ষত্রপ্রতিম ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর। প্রাতিস্বিকতা ও সৃষ্টির ঐশ্বর্যেও তিনি তুলনারহিত। সৃষ্টির বৈচিত্র্য তাঁর গলায় পরিয়েছে বহুমাত্রিক শিল্পীর অভিধা। পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যস্রষ্টার শিক্ষকতুল্য এই প্রতিভার সাহিত্যকীর্তি আজ ক্ষমাহীন অমনোযোগের শিকার। মননের দারিদ্র্য, রাজনীতির স্বার্থ-প্রবণতা প্রভৃতি অসাহিত্যিক স্থূল দৃষ্টির বাতাবরণ তাঁকে
উত্তর-প্রজন্মের যথাযথ মনোযোগের বাইরে ছুড়ে দিয়েছে। কিন্তু সমুদ্রের তলদেশ থেকে মুক্তা তুলে আনার কাজটিও কেউ কেউ করেন। তরুণ সমালোচক ও রম্যরচনাকার রাজীব সরকার বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যকীর্তির সামগ্রিক পরিচয় নিয়ে সমালোচনা-গ্রন্থ রচনা করে মুক্তা আহরণের শ্রমসাধ্য কাজটি করেছেন।
কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ, রম্যরচনা, আত্মজৈবনিক রচনা, পত্রসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণসাহিত্য ইত্যাকার সৃষ্টিবৈভবের সমান্তরালে বুদ্ধদেব বসু ছিলেন যুগস্রষ্টা সম্পাদক এবং আধুনিকতা ও সাহিত্যচর্চার মন্ত্রগুরু। তাঁর
সৃজনকৃতির দশটি ক্ষেত্র বাছাই করে দশটি অধ্যায়ে আলোচনা বিন্যসত্ম করে রাজীব সরকার রচনা করেছেন বহুমাত্রিক বুদ্ধদেব বসু : বৈচিত্র্যে বৈশিষ্ট্যে গ্রন্থটি। আলোচনার দশটি ক্ষেত্র – কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, রম্যরচনা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, ভ্রমণ, অনুবাদ এবং সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা।
বিচিত্র সৃষ্টিসম্ভারের স্রষ্টা হিসেবে চিহ্নিত হলেও বুদ্ধদেব বসুর প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তাঁর কবি-প্রতিভার সম্যক পরিচয় উদ্ঘাটনে সমালোচক রাজীব সরকার প্রথমেই ‘কবি বুদ্ধদেব বসু’ শিরোনামে রচনা করেছেন এক মননঋদ্ধ প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক কবিতার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেবের অবদানের মূলসূত্রটি চিহ্নিত করে নেন : ‘শুধু কবিতা লেখেননি, কবিতা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভেবেছেন এবং ভাবনাকে কর্মে রূপান্তরিত করেছেন। একজন প্রকৃত কবিকর্মী তিনি। কবি হিসেবে এবং আধুনিক কবিতার একনিষ্ঠ প্রচারক
ও সংগঠক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকা ঈর্ষণীয়।’ (পৃ ১৪) রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র স্বর সৃষ্টিতে
যে-কজন কবিকর্মী অনলস, নিঃসন্দেহে বুদ্ধদেব বসু তাঁদের অন্যতম। গ্রন্থকার রাজীব সরকার বুদ্ধদেব বসুর কাব্যসৃষ্টির প্রেরণা, আধুনিক ইউরোপীয় কবিতার সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র এবং প্রথম কাব্য থেকে শেষাবধি তাঁর সৃষ্টিশীলতার সংক্ষিপ্ত অথচ অনুপুঙ্খ বিশেস্নষণ হাজির করেছেন এ-অধ্যায়ে।
ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু অবিস্মরণীয় লেখক না হলেও বাংলা ছোটগল্পকে ভাবালুতার জগৎ থেকে বাসত্মবতার জমিনে স্থানান্তরে তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। তাঁর অধিকাংশ গল্পের উপজীব্য প্রেম হলেও মধ্যবিত্ত জীবনের নানা অনুষঙ্গ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান প্রভৃতি বিষয়ের নবতর উপস্থাপন তাঁকে অনন্যতা দান করেছে। রাজীব সরকার ‘গল্পকার বুদ্ধদেব বসু’ শিরোনামীয় অধ্যায়ে বুদ্ধদেবের ছোটগল্পের বিশেস্নষণ এবং সমালোচকদের মতামত যাচাই করে ভিন্ন এক বুদ্ধদেব বসুকে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন বলেই মনে হয়।
বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসের প্রধান বিষয় নৈঃসঙ্গ্যতার বোধ। ‘ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব বসু’ অধ্যায়ে লেখক রাজীব সরকার তাঁর নৈঃসঙ্গ্যচেতনার মৌল সূত্রটি আবিষ্কার করে নেন আলোচনার সূচনাতেই। তিনি লিখেছেন : ‘বুদ্ধদেবের সব শিল্প প্রয়াসেই মৌল বিষয় হিসেবে অবভাসিত হতে থাকে ব্যক্তির একাকিত্ব, মূল্যবোধহীনতা, ইন্দ্রিয়ঘন প্রেম, রিরংসা, যুগযন্ত্রণা – এককথায় দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়ে মধ্যবিত্ত জীবনের সামূহিক সংকট। এই সংকট সবচেয়ে তীব্রভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে বুদ্ধদেবের বিভিন্ন উপন্যাসে।’ (পৃ ৩৪)
বাংলা নাট্যসাহিত্যে বুদ্ধদেব বসু আধুনিকতার বিশেষ দূত হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বসাহিত্যের মহাসমুদ্র মন্থনজাত অমৃত পান করে তাঁর শিল্পীসত্তা ঋদ্ধ হয়েছে; কিন্তু বিদেশি সাহিত্যের অনুকারী না হয়ে তিনি রয়ে গেছেন সর্বদা শিকড়সংলগ্ন। নাট্যসাহিত্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান হলো, প্রাচ্যদেশীয় পুরাণ বিশেষত ‘মহাভারতে’র কয়েকটি কাহিনিকে তিনি আধুনিক মননচৈতন্যের ভূমিতে স্থাপন করে নাট্যরূপ দিয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে ‘নাট্যকার বুদ্ধদেব বসু’ অধ্যায়ে রাজীব সরকারের সুস্পষ্ট মূল্যায়ন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে : ‘… তাঁর নাট্যকার সত্তা পূর্ণতা পেয়েছে প্রাচীন ভারতীয় পুরাণকে অবলম্বন করে। মহাভারত নিংড়ে তিনি উপহার দিয়েছেন পাঁচটি কাব্যনাটক, যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বেঁচে থাকবে চিরকাল। ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’, ‘কালসন্ধ্যা’, প্রথম পার্থ’, ‘অনাম্নী অঙ্গনা’ এবং ‘সংক্রান্তি’ নাটকের অনন্য শিল্পমূল্য সাক্ষ্য দেয় প্রাচ্য দেশীয় পুরাণের অনুবীক্ষণেই তিনি বিশ্বদর্শন করতে চেয়েছেন।’ (পৃ ৪৩) পুরাণের পুনর্নির্মাণে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস তাঁকে অনন্যতা দান করেছে।
কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটক ছাড়া আরো ছয়টি ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর অনন্য অবদানের কথা তুলে ধরেছেন রাজীব সরকার। অধ্যায়গুলোর শিরোনাম : ‘রম্যরচনাকার বুদ্ধদেব বসু’, ‘প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু’, ‘সাহিত্যসমালোচক বুদ্ধদেব বসু’, ‘ভ্রমণসাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু’, ‘অনুবাদক বুদ্ধদেব বসু’ এবং ‘সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু’। সহজ শিরোনাম থেকেই অধ্যায়গুলোর বিষয় অনুধাবন করা যায়। গ্রন্থকার রাজীব সরকার প্রতিটি অধ্যায়ে সংশিস্নষ্ট বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর
শিল্পকৃতির বিশদ অথচ সংক্ষিপ্ত বিশেস্নষণ ও বিবরণ উপস্থিত করেছেন। বুদ্ধদেব বসুর অনন্য গদ্যশৈলী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন।
বুদ্ধদেব বসুর আত্মজৈবনিক রচনা, শিশুসাহিত্য, পত্রসাহিত্য, ইংরেজি রচনা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা এ-গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ-প্রসঙ্গে লেখকের স্বীকারোক্তি : ‘আলোচনার বাইরে থেকে গেল তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা, শিশুসাহিত্য, পত্রসাহিত্য এবং ইংরেজি রচনা। জীবনের শেষ প্রামেত্ম রচিত ‘মহাভারতের কথা’ নিয়েও পৃথক গবেষণা হতে পারে। দশটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করার কারণ হচ্ছে – এই ক্ষেত্রগুলোর মূল্যায়নের মাধ্যমেই বুদ্ধদেব বসুর বহুমাত্রিক প্রতিভা শনাক্তকরণ সম্ভব।’ (পৃ ১৩) এক্ষেত্রে লেখকের সঙ্গে সহমত হওয়া মুশকিল। কারণ দশটি ক্ষেত্রের অবদান আলোচনা করে বুদ্ধদেব বসুর বহুমাত্রিক প্রতিভা শনাক্ত করা যেমন সম্ভব, তেমনি পাঁচটি বা ছয়টি ক্ষেত্রের
কৃতি মূল্যায়ন করেও তাঁর বহুমাত্রিকতা চিহ্নিত করা অসম্ভব নয়। রাজীব সরকার উল্লেখ করেছেন, মহাভারতের কথা গ্রন্থ নিয়ে পৃথক গবেষণা হতে পারে। এ-বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত হয়েও বলা যায়, যে-গ্রন্থ নিয়ে পৃথক গবেষণা হতে পারে, সে-গ্রন্থটি একটি ক্ষুদ্র অধ্যায় দাবি করতেই পারে। পাঠক হিসেবে আমরা আরো দাবি করতে পারি : বুদ্ধদেব বসুর সংক্ষিপ্ত একটি জীবনপঞ্জি পরবর্তী সংস্করণে যুক্ত হতেই পারে।