বুদ্ধদেব বসু : শিল্পীর অন্তর্যামী

কোনো লেখক যখন শিল্পের সমগ্র সত্তায় নিজেকে স্পর্শিত ও আলোড়িত করেন তখন তাঁর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দুরূহ হয়ে পড়ে। আরো জটিলতা দেখা দেয় তাঁর প্রতিটি সত্তার স্বাতন্ত্র্য বিবেচনার ক্ষেত্রে। এ-সমস্যাটি বড় হয়ে দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের বেলায়। আর ‘খানিকটা’ দেখা যায় বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে। কিন্তু এমন বহু পাঠক পাওয়া যাবে, যারা কখনো বুদ্ধদেব বসুর কোনো নাটক, কবিতা কিংবা কথাসাহিত্য পড়েননি, অথচ বুদ্ধদেব দ্বারা প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, একজন লেখকের ‘সৃষ্টিশীল’ কোনো রচনা পাঠ না করেও পাঠক আলোড়িত কিংবা অনুপ্রাণিত হন কীভাবে? এ-প্রশ্নের উত্তরে একটি কথা বলা যেতে পারে যে, বুদ্ধদেব বসুর সৃষ্টিশীল কোনো রচনা ছাড়াও কালিদাস থেকে ‘আধুনিক’ বাংলা কাব্যধারার চলিস্নশের দশক পর্যন্ত বিবেচনার জন্য অপরিহার্য নাম বুদ্ধদেব বসু। আর কোনো কিছু না পড়েও কেবল রবীন্দ্রনাথ পাঠ এবং বিবেচনার জন্যও অনস্বীকার্য হয়ে পড়েন বুদ্ধদেব বসু। দায় নিয়ে বলতে হয়, ‘আধুনিক’ কাব্যপাঠের ক্ষেত্রে, বিশেষত তিরিশোত্তর ‘আধুনিক’ বাংলা কাব্যপাঠের ক্ষেত্রে, বুদ্ধদেব বসুর বিকল্প কেবল তিনি নিজেই। বুদ্ধদেব বসুর এই সত্তার নাম সমালোচক বুদ্ধদেব বসু। বসুর সৃষ্টিশীল অন্য যেকোনো শাখা থেকে তা মোটেও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর অন্য সব সৃষ্টিশীল শাখার চেয়েও বেশি আলোচিত ও প্রশংসিত। কিন্তু আশ্চর্য হওয়ার কথা হলো, তাঁর জন্মশতবর্ষ অতিক্রমের পরেও অদ্যাবধি সে-রূপটি থেকেছে অরূপে। তাঁর এই সমালোচকসত্তার রূপকে অপরূপে নির্মাণের কোনো প্রয়াস দেখা যায়নি – না বাংলাদেশে, না পশ্চিম বাংলায়। যথার্থ সমালোচনা ছাড়া যে সাহিত্য অর্থহীন এই দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করে বুদ্ধদেব বসুর সবচেয়ে প্রোজ্জ্বল অথচ অনালোচিত শাখাটি যথার্থরূপে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন বাংলাদেশের এক তরুণ গবেষক-কবি হিমেল বরকত। হিমেল বরকত-রচিত গ্রন্থটির নাম সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু (২০১৩)।

বুদ্ধদেব বসু বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে কেন অপরিহার্য, কেন তাঁর মন্তব্যগুলো বাংলা সাহিত্যে ঐশ্বরিক বাণী হিসেবে বিবেচিত হয়? তিনি কি কোনো নতুন সমালোচনারীতি নির্মাণ করেছেন অথবা বুদ্ধদেব বসু কেন-ই বা তিরিশোত্তর ‘আধুনিক’ বাংলা সাহিত্যের ‘অধিদেবী’তে পরিণত হলেন, কেন-ই বা হলেন নিঃসঙ্গ জীবনের এক প্রতিবিম্ব। এমন প্রশ্নের যথার্থ উত্তরসহ বুদ্ধদেব বসুর শিল্পসত্তার স্বরূপটি উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন হিমেল বরকত। সংক্ষিপ্ত পরিসরের এই গ্রন্থটি পাঁচটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। ‘বুদ্ধদেব বসুর মানসগঠন ও শিল্পদৃষ্টির স্বরূপ’ নামক প্রথম পরিচ্ছেদে মূলত বসুর সমগ্র শিল্পসত্তাকে স্পর্শ করেছেন। প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম অংশে বুদ্ধদেব বসুর ব্যক্তিনিঃসঙ্গতা এবং পরিশীলিত ও অনুশীলিত নিঃসঙ্গতার স্বরূপটি উন্মোচন করেছেন। এবং এই নিঃসঙ্গতাই যে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধদেব বসুকে দুর্মরভাবে আত্মচেতন শিল্পীতে পরিণত করে, তা প্রমাণের প্রয়াস পেয়েছেন। তাই লেখক বুদ্ধদেব বসুর শিল্পীমানসের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এভাবে :

আত্ম-উন্মোচন ও বিশুদ্ধ শিল্পের ধ্যানে তাঁর নিরাময় হল আশৈশব নৈঃসঙ্গ্যের আর সমাজবিবিক্ত নন্দননির্ভরতায়, তিনি লাভ করলেন শিল্প-আত্মার প্রমিত আয়ু।

বুদ্ধদেব বসুর শিল্পীসত্তার স্বরূপ এমন অনবদ্যভাবে কখনো চিহ্নিত হয়েছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু এই অংশে বিশেষভাবে অনুলেস্নখ থেকেছে দৈশিক-বৈশ্বিক পরিস্থিতি কীভাবে বুদ্ধদেব বসুকে আত্মচেতন সমাজবিবিক্ত শিল্পীতে রূপান্তর করল তার প্রেক্ষাপট। কেননা কোনো শিল্পসত্তাই আপনাআপনি আত্মচেতনমুখী হয়ে ওঠে না। বিশেষত, তৎকালীন সমাজ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক উত্তালতায় তিনি কীভাবে আত্মচৈতন্যকামী হয়ে উঠেছিলেন তা উলেস্নখ একান্ত কাম্য ছিল। এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে অন্তত দুটো বইয়ের কথা। প্রথমটি হুমায়ুন কবিরের বাঙলার কাব্য, যে-বইয়ে সময় ও সমাজের পরিবেশ-প্রতিবেশ কীভাবে ব্যক্তিমনন তৈরি করে তার স্বরূপ অনুসন্ধান করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি বিশ্বজিৎ ঘোষের বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসে নৈঃসঙ্গ্যচেতনার রূপায়ণ, যে-বইয়ে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণকে প্রাধান্য দিয়ে নৈঃসঙ্গ্যচেতনার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার সম্পর্ক ও কার্যকারণের হদিস করে বুদ্ধদেব বসুর নৈঃসঙ্গ্যচেতনার স্বরূপ সন্ধান করা হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর মানসগঠনে নৈঃসঙ্গ্যচেতনা ও শিল্পবোধ পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কিত। কারণ পারিপার্শিবক সমাজ, কাল, দৈশিক-বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মনস্তত্ত্ব, দর্শন ও ‘আধুনিক’ সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে বুদ্ধদেব বসুর নৈঃসঙ্গ্যচেতনার যথার্থ বিচার-বিশেস্নষণ ছাড়া তাঁর মন-মনন ও সমাজবিবিক্ত শিল্পীতে রূপান্তরের স্বরূপ অনুসন্ধান হবে খণ্ডত। প্রথম পরিচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশে আলোচিত হয়েছে দুর্মরভাবে রোমান্টিক বুদ্ধদেব বসুর সুন্দরের পূজারি হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট। বিশেষত, তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মূলে সর্বদা যে ক্রিয়াশীল থেকেছে রোমান্টিক চৈতন্য, তাঁর এই সত্তাটি ছিল অর্জিত ও অনুশীলিত। আর তার পশ্চাতে রয়েছেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলি, বায়রন। তাছাড়াও সৌন্দর্যবাদী তাত্ত্বিক সুইনবার্ন, অস্কার ওয়াইল্ডের কিংবা বোদলেয়ারের সঙ্গে প্রাণের সংযোগের কথা উলেস্নখ থাকলেও অনুলিস্নখিত রয়েছে নন্দনতাত্ত্বিক ক্রোচের প্রভাবের কথা – যা প্রমথ চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসুসহ আরো বহু লেখককে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা, যার প্রবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি তা হলো কলাকৈবল্যবাদী সাহিত্যভাবনা। কেননা তিনি সাহিত্যকে উপযোগপূরণের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করতে চান না, চান সৌন্দর্যের প্রতিমারূপে। তবে তাঁর এই সৌন্দর্যচেতনা যে প্রকৃতির তা নয়। হিমেল বরকতের এই বইয়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব যে, তিনি বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যতাত্ত্বিক ভাবনা সম্পর্কে বাজারে চালু ‘গড়মত’কে যথাযথ যুক্তিতর্কে, তথ্য-উপাত্তে খারিজ করতে পেরেছেন। আর তাও আবার বুদ্ধদেব বসুর নিজের মন্তব্যের মাধ্যমেই। যেখানে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘শিল্পের জন্য শিল্প কথাটাও অর্থহীন, কেননা মানুষ ছাড়া কে-ই বা আছে তার স্রষ্টা বা ভোক্তা – স্পষ্টত মানুষের জন্যই শিল্প। স্পষ্টত মানুষের জন্যই শিল্পকলা।’ বসুর এই মন্তব্য হিমেল বরকত কেবল হাজির করেননি, নিজেও এ-বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন সত্যিই তা বিশেষ বিবেচনার যোগ্য :

শিল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু কলাকৈবল্যবাদী মতাদর্শকে গ্রহণ করেছেন একটু ভিন্ন অর্থে। তাঁর মতে, শিল্পের সামাজিক উপযোগিতা না থাকলে তা আলস্যজীবীর বিলাসিতা নয়, মানুষের আত্মার ও অনুভূতির পক্ষে প্রয়োজনীয় শুশ্রূষা।

এই পরিচ্ছেদের তৃতীয় অংশটি সাহিত্য সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর স্বাতন্ত্রিক ভাবনার সারাৎসার। কেননা বুদ্ধদেব বসু সব্যসাচী লেখক হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা নিয়ে মন্তব্য করতে তিনি কোনো সংশয়বোধ করেননি, যার বিশেষভাবে উলেস্নখ আছে। বুদ্ধদেব বসুর কাছে কাব্যের শিল্পগত ভাবনা প্রাধান্য পেলেও কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষত উপন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি জোর দিয়েছেন থিমের প্রতি। আবার নিজে নাট্যকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি মনে করতেন, নাটক ‘প্রোজ্জ্বল শিল্প’ কিন্তু বহু সীমাবদ্ধতায় বন্দি। নাটকে অধিকাংশ কথাই সংলাপে জানাতে হয়; কিন্তু জীবনের সবচেয়ে জরুরি কথাগুলো মুখে উচ্চারিত হয় না বলে বসুর মনে হয়েছে, ‘নাটকে কৃত্রিমতা অপরিহার্য।’ তাঁর কাছে সাহিত্য মানেই বিশ্বসাহিত্য। সাহিত্যেও নানা ভেদকে তিনি অনর্থক মনে করতেন। তিনি সাহিত্যের দুটো শ্রেণির নাম দিয়েছিলেন – ‘দেশজ’ ও ‘দেশোত্তর’ সাহিত্য। তাই বুদ্ধদেব বসুর কাছে অনুবাদ মৌলিক শিল্প। তিনি অনুবাদকে কবিতা সৃষ্টিরই একটি ‘সন্নিকট বিকল্প’ বলে মনে করতেন। সাহিত্য সম্পর্কে বসুর এই স্বাতন্ত্রিক ভাবমানস যথার্থভাবে উপস্থাপন এ-গ্রন্থটিকে করেছে বিশেষভাবে ঋদ্ধ।

‘সমালোচক বুদ্ধদেব বসু : সাহিত্যবিচারের মতাদর্শ ও পদ্ধতি’ অংশে লেখক বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের ধারা এবং বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনা-সাহিত্যের আলোচনা করেছেন। এখানে স্থান পায়নি বিশ্ব সমালোচনা-সাহিত্যের উদ্ভব কিংবা রীতি ও প্রকৃতি। বাংলা সমালোচনা-সাহিত্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে গুরু মেনেই আলোচনা করা হয়েছে। লেখক বলেছেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্য সমালোচনার সার্থক স্থপতি। সে সময়ে তিনিই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রধান পুরুষ।’

কিন্তু আমরা গ্রন্থপাঠে বিস্মিত হয়েছি সমালোচক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আলোচনায় কেবল একটি মাত্র বাক্য ব্যয়ে। অথচ রবীন্দ্রনাথের হাতেই সমালোচনা যথার্থ সমালোচনা হয়ে উঠেছে; কিন্তু লেখক হিমেল বরকত এ-বিষয়ে কোনো আলোচনা করেননি। একইভাবে ধারাবাহিকতাহীন, দ্রম্নত মোহিতলাল মজুমদার, প্রমথ চৌধুরী কিংবা ধূর্জটিপ্রসাদের কেবল নাম উলেস্নখ করেই বুদ্ধদেব বসুতে এসে পৌঁছেছেন। বঙ্কিম-পরবর্তী সমালোচকদের
রীতি-প্রকৃতি আলোচনার মাধ্যমেই বুদ্ধদেব বসুর আলোচনা হতে পারে। আর তাতেই ধরা পড়বে সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর ভিন্ন মেজাজ ও দৃষ্টি। তবে উলেস্নখ করার মতো তথ্য হলো, হিমেল বরকত সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর কৃতিত্ব ও অভিনবত্ব যেমন উলেস্নখ করেছেন, তেমনি চিহ্নিত করেছেন তাঁর সমালোচনার সংকটকেও।
এবং নির্মোহ নিরাসক্তভাবে তিনি তা উলেস্নখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ সমালোচনাকে সাহিত্য করে তোলার পক্ষপাতী হলেও বুদ্ধদেব বসুর আদর্শ সে-রকম নয়, তা তিনি উলেস্নখ করেছেন। হিমেল বরকত আরো বিশেষভাবে উলেস্নখ করেছেন সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর দ্বৈতাদ্বৈত রূপ :

সমালোচনার বিচার পদ্ধতিতে আঙ্গিক বিশেস্নষণের বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর মতদ্বৈততা লক্ষণীয়। প্রথম দিকে তিনি কবিতার সমালোচনায় আঙ্গিকের বিচারকে অনিবার্য বলে মনে করেছেন। […] কিন্তু পরবর্তীকালে আঙ্গিক-বিশেস্নষণের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ তিনি সমর্থন করতে পারেন নি।

এই পরিচ্ছেদের পরের অংশে হিমেল বরকত সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যবিচারকে ইম্প্রেশনিস্টিক সমালোচনা, তুলনামূলক বিচার-পদ্ধতি ও রূপগত বিচার-পদ্ধতি – এই তিনটি রীতিতে বিভাজন করেছেন। ইম্প্রেশনিস্টিক সমালোচনার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যের শিক্ষক না হয়ে হয়েছেন সাহিত্যের সহৃদয় পাঠক। এবং সমালোচনার জন্য প্রয়োজন যে-অপরিহার্য অনুশীলন এবং সংস্কৃতি, তা উলেস্নখ করেছেন। গ্রন্থকার একই সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর এই সমালোচকসত্তার দৃষ্টান্তরূপে রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস ও জীবনানন্দ দাশের ধূসর পা-ুলিপি কাব্য সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। আর তুলনামূলক বিচার-পদ্ধতিতেও বসুকে খুঁজে দেখেছেন হিমেল বরকত। কেননা, বুদ্ধদেবের সমালোচনামূলক প্রবন্ধের অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে তুলনামূলক বিচার-পদ্ধতির প্রয়োগ। একইভাবে
রূপগত বিচার-পদ্ধতিতে বসুর সমালোচক-মানসকে চিহ্নিত করেছেন গ্রন্থকার আর দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির করেছেন রবীন্দ্রনাথের ক্ষণিকা কাব্যকে। কথাসাহিত্যের রূপগত বিচার যে বুদ্ধদেব বসুর মাধ্যমে আরম্ভ, সেটার উলেস্নখ এই আলোচনাকে প্রাণবন্ত করেছে। তবে সমালোচনার রীতি-বিষয়ে বসুর ভাবমানসকে অসাধারণভাবে চিহ্নিত করেছেন হিমেল বরকত। সেখানে তিনি উলেস্নখ করেছেন :

সৃজন ও মননের এক অবিচ্ছেদ্য সূত্রে জড়িয়ে আছে বুদ্ধদেব বসুর সমালোচক মানস। শিল্পীসত্তার স্ব-বিকাশে বিশ্বাসী বুদ্ধদেবের সমালোচনায় আশ্রয় পায় নি কোনো মতবাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ। বিশুদ্ধ শিল্পধ্যান তাঁর সাহিত্য বিচারকেও দিয়েছে আরেক সাহিত্যের মর্যাদা। কেবল উপভোগ ও ভালো লাগা’র প্রকাশের মধ্যেই তিনি সীমিত রাখেননি সমালোচনাকে। বরং তুলনামূলক বিচার পদ্ধতির প্রয়োগ এবং শিল্প-আঙ্গিক বিশেস্নষণের মেধাবী অনুধ্যান তাঁর সমালোচনা সত্তাকে দিয়েছে সমগ্রতাস্পর্শী উজ্জ্বলতা।

এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি আলোচনাকে ভারী করার জন্য নয়, বরং পাঠককে ভাবনার সূত্র ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। কেননা বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনার যথার্থ স্বরূপটি চিহ্নিত হয়েছে আলোচ্য মন্তব্যে, একই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি।

কবি হিসেবে বুদ্ধদেব বসু সর্বাধিক আলোচিত হলেও সমালোচক বসুও তাঁর সমবয়সী। তাছাড়া কবিতার চেয়ে তাঁর পরিচয় হলো তিনি ‘আধুনিক’ বাংলা কাব্যের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। সত্যি বললে, ত্রিশোত্তর কবিদের ‘সেন্সরপত্র’ ছিল তাঁর কবিতা পত্রিকা। আর সেই ‘সেন্সরপত্রে’র আলোড়িত ও বিশেস্নষিত রূপ হলো সমালোচক বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসুর এই সমগ্র সমালোচনাকে গ্রন্থকার আলোচনা করেছেন ‘বুদ্ধদেব বসুর  সাহিত্যবিচার : বিষয় ও মূল্যায়ন’ নামক পরিচ্ছেদে। এখানে প্রথমেই তিনি সমালোচনাগ্রন্থ ও প্রবন্ধসমূহের একটি সুনির্বাচিত ও সুনির্দিষ্ট তালিকা দিয়েছেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সুকুমার রায় পর্যন্ত সাহিত্য-আলোচনা, অনুবাদ, বিদেশি সাহিত্য ভিন্ন ভিন্নরূপে আলোচনা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বুদ্ধদেবের পূর্বে ও পরে বহু মূল্যায়ন করা হয়েছে; কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর মূল্যায়নই প্রাতিস্বিক রূপ পেয়েছে। এই প্রাতিস্বিক মূল্যায়নের নববিবেচনা অত্যন্ত দুরূহ কর্ম; কিন্তু এই দুরূহ কর্মটি নির্মোহভাবে সম্পন্ন করেছেন গবেষক হিমেল বরকত। বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথকে বিবেচনায় আগেই ‘দেবতা’ বলে মেনে নিয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, দেবতার সমালোচনায় নির্মোহ থাকা সম্ভব কি? দেবতার মূল্যায়ন কি সমালোচনা, নাকি ভোগ? এসব প্রশ্ন সাধারণ পাঠকের মনে দেখা দিলেও দেখা দেয়নি গবেষক হিমেল বরকতের কাছে, যা পাঠক হিসেবে আমাদের বিস্মিত করেছে। রবীন্দ্রনাথকে কবি,
কথাসাহিত্যিক, আত্মজীবনীকার, গীতিকার কিংবা শিশুসাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করলেও সমালোচক হিসেবে আলোচনা করেননি বুদ্ধদেব বসু এবং লেখকও তা উলেস্নখ করেননি। রবীন্দ্র-মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বসু গোরা উপন্যাসকে মানদ- হিসেবে বিবেচনা করেছেন যেমন করেছেন মানসী কাব্যকে। কাব্যের ক্ষেত্রে তা অণুবিশ্ব হলেও কথাসাহিত্যে এই মূল্যায়ন খণ্ডত বলে মনে করেন হিমেল বরকত। তিনি মনে করেন :

রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য উপন্যাস বিচারেও তিনি প্রয়োগ করেছেন গোরা-র মানদ-। অবশ্য সমাজ সত্য এড়িয়ে শিল্পীর সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করার ফলে যোগাযোগ সম্পর্কে বুদ্ধদেবের মূল্যায়ন অনেকটাই খণ্ডত হয়ে পড়েছে।

শুধু তাই নয়, কৌশলী বসু রবীন্দ্রসাহিত্য-মূল্যায়নে নবতর কৌশল আশ্রয়ের মাধ্যমে পাঠকের সামনে একটি উপভোগের জগৎ নির্মাণ করেছেন। ফলে রবীন্দ্রনাথকে বিচারের এই দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধদেব বসুর উপভোগবাদী সমালোচক সত্তারই পরিচয় বলে মনে করেন লেখক। এরপর বুদ্ধদেব বসুর পূর্বসূরির মূল্যায়ন অংশে যতীন্দ্রনাথ, প্রথম চৌধুরী, রাজশেখর বসু প্রমুখের সমালোচনার রূপটি ব্যাখ্যা করেছেন হিমেল। এখানে লেখক যেন উঁচু থেকে ক্যামেরা দিয়ে নিখুঁত ছবি নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে গ্রন্থকার নজরুলকে সমালোচনার জন্য যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনি রাজশেখর বসুর মূল্যায়নে নির্মোহ না থাকতে পারার জন্য বুদ্ধদেবকে দায়ী করেছেন।

আমরা পূর্বেই উলেস্নখ করেছি, বুদ্ধদেব বসু কেবল নিজে কবি ছিলেন না, ছিলেন ‘আধুনিক’ কবিদের ‘অধিদেবী’ – প্রধান আশ্রয়। তাই তিনি তাঁর সতীর্থ ও অনুজদের কাব্য নিয়ে বিস্তর সমালোচনা করেছেন। তাঁদের কাব্যের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে শাণিত মন্তব্য করেছেন এবং তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন মেজাজকে ভিন্ন ভিন্ন অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। এই গ্রন্থে তাই বড় অংশ জুড়ে স্থান পেয়েছে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, অন্নদাশঙ্কর রায়, নিশিকান্ত কিংবা ফাল্গুনী রায় সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর সর্বাধিক আলোচিত সমালোচনা। গ্রন্থকার হিমেল নিজেও একজন কবি হওয়ায় এখানে তিনি বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনায় লেখক আপস্নুত হয়েছেন বলেই আমাদের কাছে মনে হয়। ফলে জীবনানন্দ, সুধীন্দ্র বা বিষ্ণু দে সম্পর্কে সমালোচনায় যেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, তেমনি সুভাষ-সমর সংক্রান্ত সমালোচনায় বুদ্ধদেব বসুকে সমালোচক নয়, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টারূপে তিনি দেখাতে চেয়েছেন :

কোনো মতবাদের প্রচারক হয়ে পড়লেই শিল্পের অপমৃত্যু ঘটতে বাধ্য – সমালোচক বুদ্ধদেবের এই ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি যে স্বচ্ছ ছিল তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি পরবর্তীকালে সমর সেনের অনাকাঙিক্ষত স্তব্ধতায় এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অমৃত্যু ‘কবি ও কর্মী’র দ্বন্দ্বে।

হিমেল বরকত বুদ্ধদেব বসুর সমালোচক-সত্তার সমগ্রতাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। তাই সংস্কৃত সাহিত্য, বিদেশি সাহিত্য এবং শিশুসাহিত্য – সবটাকে স্থান দিয়েছেন এ-গ্রন্থে। হিমেল বরকতের কাছে মনে হয়েছে, বাংলা শিশুসাহিত্য-সমালোচনার মাধ্যমে বুদ্ধদেব বসু শিশুসাহিত্য সম্পর্কে প্রচলিত উপেক্ষা ও অবহেলার দৃষ্টিকে বদলাতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এই মন্তব্য অস্বীকার করা কঠিন। কিন্তু বিদেশি সাহিত্য-সমালোচনায় বুদ্ধদেবের সংকীর্ণতাকে গ্রন্থাকার উলেস্নখ করেননি। বিশেষত চার্লস চ্যাপলিনকে নিয়ে বুদ্ধদেবের মন্তব্যটি শিল্পসম্মত নয়। কেননা বুদ্ধদেব সিনেমাকে সাহিত্যের মতো চিন্তা করার কারণে চ্যাপলিনকে বাহবা দিয়েছেন। কিন্তু সিনেমা কেন সাহিত্যের মতো হবে? সাহিত্য ক্ষেত্রবিশেষে হতে পারে সিনেমার মতো। কেননা, আমাদের মনে রাখতে হবে ‘সিনেমা হলো শিল্পের সর্বোত্তম মাধ্যম’। তাই সিনেমাকে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেবের সতর্কহীন মন্তব্য গ্রন্থকারের চোখ এড়িয়ে গেছে।

শিল্পের বিমূর্ত সত্তার রূপায়ণ বহুমাত্রিকভাবেই হতে পারে; কিন্তু যখন শিল্পটি বিশেষভাবে হয় সাহিত্য, তখন তা অনিবার্যভাবে হয়ে পড়ে ভাষানির্ভর। সমালোচনায়ও প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে একটি নিজস্ব ভাষার বা গদ্যশৈলীর। গ্রন্থকার বিষয়টি বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পেরেই গ্রন্থের একটি পরিচ্ছেদের শিরোনাম দিয়েছেন ‘বাংলা সাহিত্য সমালোচনায় বুদ্ধদেব বসুর গদ্যশৈলী।’ এই পর্বে লেখক বাংলা গদ্য ও সমালোচনা-গদ্যের মধ্যকার আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন। গদ্যের মধ্যে কবির গদ্য, গদ্যের কবি, গদ্যের ছন্দস্পন্দ বা অন্তরঙ্গ স্বরভঙ্গি, শব্দকৌশল ও বাক্যসংগঠন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফলে এই আলোচনায় বোঝা যায়, হিমেল বরকত বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের প্রেমে পড়েছেন। তবে উলেস্নখ করা প্রয়োজন, শিল্পের প্রতি প্রেম অনিবার্য; কিন্তু তা হতে হয় সংযত ও অনুশীলিত। লেখকও যথার্থ সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। কেননা, বুদ্ধদেব বসুর গদ্য সম্পর্কে মন্তব্যে নেই কোনো উচ্ছ্বাস, আছে কেবল যুক্তির পরম্পরা। হিমেল মনে করেন, বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের পেছনে আছে গভীর অনুশীলন, অভিনিবেশ, শ্রমার্জিত মনন ও মেধাবী বিশেস্নষণ। এই যুক্তিনিষ্ঠ মন্তব্য সত্ত্বেও বলে রাখা ভালো যে, সাধারণ পাঠকের পক্ষে কিংবা ‘সরল পাঠে’ বুদ্ধদেব বসুর গদ্যশৈলীর প্রেমে পড়া অস্বাভাবিক নয়, তাঁর গদ্যের সেই সৌন্দর্যই তাঁকে করেছে অনিন্দ্য গদ্যশিল্পী।

সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু নামক গ্রন্থের উপসংহারে গ্রন্থকার হিমেল বরকত সামগ্রিক পর্যালোচনা করেছেন
এবং দ্বিধাহীনচিত্তে বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনা-সত্তার প্রশংসা যেমন করেছেন, তেমনি সংকটগুলোকে অনায়াসে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর রীতি ও পদ্ধতি যে নবতর দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। আর তা কেবল সম্ভব হয়েছে বুদ্ধদেব বসুর মতো সতর্কসন্ধানী শিল্পীর সংযত ও অনুশীলিত শিল্প-মানসের কারণে। বুদ্ধদেব বসুর রচনার পাঠকমাত্রই জানেন তিনি ছিলেন অত্যন্ত মন্তব্যপ্রিয়/ মন্তব্যধর্মী সমালোচক। তবে তাঁর মন্তব্যগুলো কোনো বাষ্পীয় আয়োজন ছিল না; তাঁর সবটাই ছিল যুক্তিবোধ ও বিশেস্নষিত মন্তব্য। বুদ্ধদেব বসুর সমালোচক-সত্তার স্বরূপনির্মাণে হিমেল বরকতের বিবেচনাও ‘অনেক ক্ষেত্রে’ হয়ে উঠেছে মন্তব্যধর্মী। তবে, বুদ্ধদেব বসুর মতো তা হয়তো সর্বাংশে যুক্তিবোধ ও বিশেস্নষিত নয়। কেননা এই গ্রন্থে গ্রন্থকারের চিন্তার অস্থিরতা পাঠকের নজর এড়াবে না বলেই মনে হয়। বুদ্ধদেব বসুর সমালোচক-সত্তার বিশেস্নষণ এক অর্থে সমগ্র বাংলা সাহিত্যেরই নবতর পর্যালোচনা। এই দুরূহ ও দুঃসাহসিক কর্মের মাধ্যমে হিমেল বরকত যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন
তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন সমালোচনাকে সাহিত্য করতে আর বুদ্ধদেব বসু সমালোচনাকে শিল্পে উত্তীর্ণ করেছেন। হিমেল বরকত বুদ্ধদেবের এই সমালোচনাকে শিল্পে উত্তীর্ণ করার স্বরূপটি যথার্থরূপেই নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন। ফলে সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু নামক গ্রন্থটি কেবল কোনো সমালোচনা-গ্রন্থে আর সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছে বুদ্ধদেব বসুর শিল্পের অন্তর্যামী। বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের, বিশেষত বুদ্ধদেব বসুর নন্দনবোধের স্বরূপ অনুধাবনে এই গ্রন্থপাঠ তাই অনেকটাই অনিবার্য হতে পারে বলে আমাদের প্রত্যাশা। r